alt

উপ-সম্পাদকীয়

কী হবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনীতি

গাজী তারেক আজিজ

: শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

রাজনীতির ভেতরের রাজনীতি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে আওয়ামী লীগ। একদিকে পতিত সরকারের নেতৃত্ব দেয়া দলটির গুটিকয়েক পোষা দল। অন্যদিকে একটি বৃহৎ বলয়ের দল ও জোট। তার ওপর দেশি-বিদেশি সক্রিয় গ্রুপ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিরূপ ধ্যান-ধারণা দলটিকে রাজনীতির মাঠ থেকে কোনরূপ আগাম সতর্কতা ব্যতিরেকে বলয় থেকে ছিটকে দিয়েছে। যেখানে দেশের বড় একটি অংশ তাদের বিরুদ্ধে তো বটেই উল্টো দলীয় বঞ্চিত ও নিগৃহীত হওয়া কর্মী-সমর্থকদের নীরবতা তাদের খড়কুটো আঁকড়ে ধরেও দাঁড়াতে সাহায্য করা তো দূরে থাক দায় নিতে আগ্রহী নয়। এতে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়েছে, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে একটা সিন্ডিকেট তাদের নিজস্ব অনুসারী ছাড়া আর কাউকে সুযোগ দিতেও সম্মত থাকে না। এতে পদবঞ্চিত, সুবিধাবঞ্চিত বৃহৎ সমর্থক গোষ্ঠীর সমর্থন হারিয়েও ক্ষমতা আর আধিপত্য বজায় রাখতে দমনপীড়ন চালিয়ে নিজ দলীয় কর্মীদের জামায়াত-শিবির ট্যাগ দিয়ে দল ছাড়তে বাধ্য করাও বেশ লক্ষণীয় ছিল। আবার দলে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করতে রাজনীতির মাঠে কোণঠাসা হয়ে পড়া জামায়াত-শিবিরকে কিংবা ভিন্ন দলের কর্মীদের দলে টেনে দলভারী করে আধিপত্য কায়েম করতে দেখা গেছে। আর শেষমেশ সেটাই পরিলক্ষিত হয়েছে সরকার পতনের সফল অভ্যুত্থানের সময়। তখন আওয়ামী লীগ কার্যত বন্ধুহীন একা হয়ে পড়ে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে পূর্বের যে কোন সময়ের চেয়ে কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ ৭১ সালে স্বাধীনতা-পরবর্তী বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তী ঘটনা প্রবাহের মতো দেশি-বিদেশি চক্রান্ত সামাল দিতে পারলেও এবারকার পরিস্থিতি যে ভিন্ন তা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের জন্যও বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে। ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের সমস্ত নেতাকর্মী ঘরছাড়া হয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন।

অনেকেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে অবস্থান করছেন। অনেকেই সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে বর্ডারে ধরা খেয়ে জেলে। কেউ কেউ আবার প্রাণ হারিয়েছেন। কারো কারো কাছে ছিল নগদ টাকা, ডলার সমেত। কেউ কেউ অবৈধ উপায়ে সীমান্ত পাড়ি দিতে চুক্তি করে উল্টো খুইয়েছেন সঙ্গে থাকা টাকা ও মালামাল। অর্থাৎ জীবন বাঁচাতেই আবার জীবনের ঝুঁকি নিতেও আগপিছ ভাবছেন না। এমন একটি করুণ পরিণতি ঘটেছে, সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের সঙ্গে। যিনি ছিলেন ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন উপসর্গের রোগী। তাকেও ভারতে যেতে সাহায্যের নামে স্থানীয় দালাল চক্র হাতিয়ে নিয়েছে অন্যূন ৭০ লক্ষ টাকা। ইতোমধ্যে সরকার আগের সরকারে থাকা মন্ত্রী-এমপিদের লাল পাসপোর্ট অর্থাৎ কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিল করায় এই মুহূর্তে যে যেখানে অবস্থান করছেন ভিনদেশে পাড়ি দেয়ার সুযোগ থাকছে না। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাসপোর্টও বাতিল হওয়ায় ৪৫ দিন মেয়াদের বেশি থাকা নিয়ে সংশয় থাকলেও ভারত তাকে আশ্রয় দিয়ে সর্বশেষ বন্ধুত্বের নজির স্থাপন করে বিশ্বস্ততার প্রতিদান দিলেও অধিকাংশ বাংলাদেশিদের কাছে চক্ষুশূলে পরিণত হয়েও সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় পরম যতেœ রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে ভারতেই অবস্থান করছেন। আবার গুঞ্জন রয়েছে, দেশে বিচার শুরু হলে গণহত্যার অভিযোগে গঠিত যুদ্ধাপরাধ বিচার নিষ্পত্তি আদালত অর্থাৎ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হলে শেখ হাসিনাকে বন্দীবিনিময় চুক্তির আওতায় ফেরত চাইবে। সেক্ষেত্রে ভারত কী ভূমিকা গ্রহণ করে সেটাও দেখার বিষয়। আবার অন্যদিকে আমেরিকার কূটচাল শুরু আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত ভারতকে নিয়ে। চীনও থেমে নেই ভারতের বিরুদ্ধে। আরেক প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানও চরম বৈরী আচরণ শুরু করায় বেশ বিপাকে পড়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হাত এখন দৃশ্যতই পিঠের নিচে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাববলয় টিকিয়ে রাখতে আমেরিকা লেগে আছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে। চীনকেও অস্থির করে তুলতে মরিয়া। ভারতে এখন প্রতিনিয়তই ভাঙনের খেলা চলছে। এদিকে মায়ানমারের ১০ লক্ষের অধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভার বয়ে চলতে পারছে না বাংলাদেশ। কূটনৈতিকভাবেও কাউকে বোঝাতে সক্ষম হচ্ছে না। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস হয়তো আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনায় এনে এই সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম হবেন বলেও দেশের মানুষ ধারণা করছে। কিছুদিন আগে ফাঁস হওয়া শেখ হাসিনার কলরেকর্ড নিয়েও চলছে জোর আলোচনা। কথোপকথনে জানা যায় তিনি দেশে আসতে চান। তারই ধারাবাহিকতায় রয়টার্সকে দেয়া সাক্ষাৎকারে হাসিনাপুত্র জয়ও সে বিষয়ই ইঙ্গিত করেছেন। জয় আরো জানিয়েছেন, শেখ হাসিনা দেশে এসে বিচার মোকাবিলা করতে চান।

এবার আসা যাক ফ্যাসিবাদ নিয়ে আলোচনায়। ফ্যাসিবাদ বলতে আমরা কী বুঝি? সর্বজনীনভাবে ফ্যাসিবাদ হচ্ছে একটি মতাদর্শ। ‘ফ্যাসিবাদ’ ধারণাটির উৎপত্তি হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ইতালিতে। তারপর জার্মানি এবং ইউরোপের নানা দেশে বিস্তার ঘটে এই মতবাদের। জার্মানিতে হিটলারের ‘নাৎসিবাদ’ এর উত্থান হয়। এটিও ছিল ‘ফ্যাসিবাদের একটি রূপ। ‘ফ্যাসিবাদ’ উত্থানের মধ্য দিয়ে ইউরোপে হিটলার ও মুসোলিনির মতো বিতর্কিত নেতার উদ্ভব হয়। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ বামপন্থীদের নিয়ে বাম মধ্যপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী হলেও দেশের চলমান সংকটের ফলে এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র রাজনৈতিক জোটকে বিরুদ্ধ মত ও মতাদর্শের রাজনৈতিক গোষ্ঠী ফ্যাসিস্ট হিসেবে আখ্যা দিতে শুরু করে। ফ্যাসিবাদ হচ্ছে উগ্র-ডানপন্থী মতাদর্শ হলেও আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে সমাজতান্ত্রিক ধারণার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। ফ্যাসিবাদী মতাদর্শে বিরোধী মতের কোন স্থান ছিল না। কর্তৃত্বময় শাসন ক্ষমতাই ছিল ‘ফ্যাসিবাদ’ এর মূলমন্ত্র। আর সেই তকমা আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের নির্বাচন পূর্ব ও পরবর্তী সরকার পতন পর্যন্ত এবং ফ্যাসিস্ট দল হিসেবে গণহত্যার অভিযোগে বিচারে দোষী প্রমাণিত হলে ১০ বছর শাস্তির আইন প্রণয়নের কথাও শোনা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতে আওয়ামী লীগ নামক স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দেয়া দলটির ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। দলটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন শেখ হাসিনা। তার নামে দুই শতাধিক মামলা রুজু হয়েছে। যাতে ছাত্র- জনতার আন্দোলন দমন করতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগে হত্যা, গুম ও পোড়ানো অভিযোগ আনা হয়েছে। এই লক্ষ্যে বিভিন্ন মামলায় তদন্তের অনুমতি চাওয়া হয়েছে। ঢেলে সাজানো হয়েছে তারই গড়ে তোলা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সেই ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউটর নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

মাঠের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ অতীতে অনেক সংকট থেকে উত্তরণ ঘটিয়েছে দক্ষ নেতৃত্বের মাধ্যমে। এবার কোন পথে হাঁটবে দলটি? আর নেতৃত্বেইবা থাকবে কে? মাঠ গোছানোর মতো শক্ত কাজ করে, বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলা করে দলটি পারবে কি ‘ফ্যাসিবাদের’ তকমা মুছে ফেলতে? নাকি সাবেক স্বৈরাচারী শাসক হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের মতোই আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাকেও কাটাতে হবে সেই অভিশপ্ত ‘স্বৈরাচার’ নামক ঘৃণিত শব্দে। দেশের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দল বলে পরিচিত দলটি সবসময়ই ছিল নির্বাচনমুখী। অথচ সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, আওয়ামী লীগ ছাড়াও নির্বাচন বৈধ হবে। তাহলে অর্থ কী দাঁড়ায় বিচারে যাই হোক, আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে দূরে রাখতেই একটি মহল সোচ্চার। সরকারও সেই তেলে ঘি ঢেলে যাচ্ছে নিয়মিত। উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের স্পষ্ট বক্তব্য বিচারের আগে এই ফ্যাসিস্ট দলকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে দিতে চান না। উপদেষ্টা আসিফ নজরুলও একই মত ব্যক্ত করে চলেছেন মিডিয়ায় ও কর্ম পরিকল্পনায়। সময় যত গড়াচ্ছে ততোই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে। এতে করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অনেকেই আত্মগোপন অবস্থা থেকে গৃহে ফিরতে শুরু করেছেন। পাশাপাশি ধরপাকড়ও চলছে। মিডিয়ায় এসেছে সারাদেশে অনেক নিরপরাধ ব্যক্তিকে মামলায় আসামি শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে। সরকারও বিষয়টা আমলে নিয়ে যেনতেন গ্রেপ্তার নয় মর্মে পুলিশকে এই বিষয়ে মৌখিক নির্দেশনা দিয়ে রেখেছে।

অতীতে রাজনীতির ক্রান্তিকাল পেরিয়ে এসেছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং বামপন্থী দলগুলো। সবারই অভিজ্ঞতা আছে সংকট উত্তরণের। এবার আওয়ামী লীগ কীভাবে উত্তরণ ঘটাবে? আদৌ কি পারবে সংকট কাটিয়ে স্বাভাবিক রাজনীতে ফিরতে? নাকি ধুঁকে ধুঁকে কাটাতে হবে বাকি সময়টা? আমরা দেশে সুস্থির রাজনীতি দেখতে চাই। মানুষে মানুষে সহাবস্থান চাই। প্রয়োজনে রাজনীতিতে ঐতিহাসিক কোন চুক্তি সম্পাদন করে হলেও শান্তি চাই!

[লেখক : আইনজীবী, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]

অতীত থেকে মুক্তি এবং ইতিবাচক জীবনযাপন

মুক্তি সংগ্রামে তিনটি ধারা

বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকা কেন পিছিয়ে

শুধু নিচেই নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর

উপেক্ষিত আটকে পড়া পাকিস্তানিরা

রম্যগদ্য : সিন্দাবাদের বুড়ো ও আমরা

নেই কেনো সেই পাখি

বায়ুদূষণ থেকে মুক্তি কোন পথে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : রাষ্ট্র সংস্কারের দুর্গম পথ

পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র

বিজয়ের প্রেরণা

মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার পুনর্বীক্ষণ

সিদরাত জেবিনের মৃত্যু অথবা প্রশ্নহীন বায়ুদূষণ

বিজয়ের গৌরব ও সম্ভাবনাময় তরুণ সমাজ

ছবি

মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের অবদান

ছবি

বিজয় সংগ্রামের সূচনার সন্ধানে

মানসম্মত কনটেন্ট ও টিআরপির দ্বৈরথ

জিকা ভাইরাস রোধে প্রয়োজন সচেতনতা

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবার গুরুত্ব

ঢাকার বাতাস বিষাক্ত কেন

চরের কৃষি ও কৃষকের জীবন

নিম্ন আয়ের মানুষ ভালো নাই

সবার আগে নিজেকে পরিবর্তন করা দরকার

পুলিশ কবে পুলিশ হবে

জীবন ফিরে আসুক বাংলার নদীগুলোতে

কান্দন সরেন হত্যা ও ভূমি বিরোধ কি এড়ানো যেত না

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র: রাষ্ট্র বিনির্মাণে সমস্যা কোথায়?

মানবাধিকার দিবস : মানুষের অধিকার নিয়ে কেন এত কথা?

আমলাতান্ত্রিক স্বচ্ছতা : সংস্কারের পথে নাকি পুনরাবৃত্তি?

খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কিছু কথা

ছবি

বেগম রোকেয়া : নারী জাগরণের অগ্রদূত

দুর্নীতির সর্বগ্রাসী বিস্তার বন্ধ করতে হবে

মা তোর বদনখানি মলিন হলে

ব্যবসায়ী নেতৃত্বশূন্য ই-ক্যাব

মূল্যস্ফীতির হিসাব নির্ণয়ে নতুন পদ্ধতির প্রাসঙ্গিকতা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

কী হবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনীতি

গাজী তারেক আজিজ

শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

রাজনীতির ভেতরের রাজনীতি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে আওয়ামী লীগ। একদিকে পতিত সরকারের নেতৃত্ব দেয়া দলটির গুটিকয়েক পোষা দল। অন্যদিকে একটি বৃহৎ বলয়ের দল ও জোট। তার ওপর দেশি-বিদেশি সক্রিয় গ্রুপ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিরূপ ধ্যান-ধারণা দলটিকে রাজনীতির মাঠ থেকে কোনরূপ আগাম সতর্কতা ব্যতিরেকে বলয় থেকে ছিটকে দিয়েছে। যেখানে দেশের বড় একটি অংশ তাদের বিরুদ্ধে তো বটেই উল্টো দলীয় বঞ্চিত ও নিগৃহীত হওয়া কর্মী-সমর্থকদের নীরবতা তাদের খড়কুটো আঁকড়ে ধরেও দাঁড়াতে সাহায্য করা তো দূরে থাক দায় নিতে আগ্রহী নয়। এতে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়েছে, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে একটা সিন্ডিকেট তাদের নিজস্ব অনুসারী ছাড়া আর কাউকে সুযোগ দিতেও সম্মত থাকে না। এতে পদবঞ্চিত, সুবিধাবঞ্চিত বৃহৎ সমর্থক গোষ্ঠীর সমর্থন হারিয়েও ক্ষমতা আর আধিপত্য বজায় রাখতে দমনপীড়ন চালিয়ে নিজ দলীয় কর্মীদের জামায়াত-শিবির ট্যাগ দিয়ে দল ছাড়তে বাধ্য করাও বেশ লক্ষণীয় ছিল। আবার দলে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করতে রাজনীতির মাঠে কোণঠাসা হয়ে পড়া জামায়াত-শিবিরকে কিংবা ভিন্ন দলের কর্মীদের দলে টেনে দলভারী করে আধিপত্য কায়েম করতে দেখা গেছে। আর শেষমেশ সেটাই পরিলক্ষিত হয়েছে সরকার পতনের সফল অভ্যুত্থানের সময়। তখন আওয়ামী লীগ কার্যত বন্ধুহীন একা হয়ে পড়ে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে পূর্বের যে কোন সময়ের চেয়ে কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ ৭১ সালে স্বাধীনতা-পরবর্তী বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তী ঘটনা প্রবাহের মতো দেশি-বিদেশি চক্রান্ত সামাল দিতে পারলেও এবারকার পরিস্থিতি যে ভিন্ন তা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের জন্যও বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে। ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের সমস্ত নেতাকর্মী ঘরছাড়া হয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন।

অনেকেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে অবস্থান করছেন। অনেকেই সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে বর্ডারে ধরা খেয়ে জেলে। কেউ কেউ আবার প্রাণ হারিয়েছেন। কারো কারো কাছে ছিল নগদ টাকা, ডলার সমেত। কেউ কেউ অবৈধ উপায়ে সীমান্ত পাড়ি দিতে চুক্তি করে উল্টো খুইয়েছেন সঙ্গে থাকা টাকা ও মালামাল। অর্থাৎ জীবন বাঁচাতেই আবার জীবনের ঝুঁকি নিতেও আগপিছ ভাবছেন না। এমন একটি করুণ পরিণতি ঘটেছে, সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের সঙ্গে। যিনি ছিলেন ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন উপসর্গের রোগী। তাকেও ভারতে যেতে সাহায্যের নামে স্থানীয় দালাল চক্র হাতিয়ে নিয়েছে অন্যূন ৭০ লক্ষ টাকা। ইতোমধ্যে সরকার আগের সরকারে থাকা মন্ত্রী-এমপিদের লাল পাসপোর্ট অর্থাৎ কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিল করায় এই মুহূর্তে যে যেখানে অবস্থান করছেন ভিনদেশে পাড়ি দেয়ার সুযোগ থাকছে না। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাসপোর্টও বাতিল হওয়ায় ৪৫ দিন মেয়াদের বেশি থাকা নিয়ে সংশয় থাকলেও ভারত তাকে আশ্রয় দিয়ে সর্বশেষ বন্ধুত্বের নজির স্থাপন করে বিশ্বস্ততার প্রতিদান দিলেও অধিকাংশ বাংলাদেশিদের কাছে চক্ষুশূলে পরিণত হয়েও সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় পরম যতেœ রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে ভারতেই অবস্থান করছেন। আবার গুঞ্জন রয়েছে, দেশে বিচার শুরু হলে গণহত্যার অভিযোগে গঠিত যুদ্ধাপরাধ বিচার নিষ্পত্তি আদালত অর্থাৎ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হলে শেখ হাসিনাকে বন্দীবিনিময় চুক্তির আওতায় ফেরত চাইবে। সেক্ষেত্রে ভারত কী ভূমিকা গ্রহণ করে সেটাও দেখার বিষয়। আবার অন্যদিকে আমেরিকার কূটচাল শুরু আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত ভারতকে নিয়ে। চীনও থেমে নেই ভারতের বিরুদ্ধে। আরেক প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানও চরম বৈরী আচরণ শুরু করায় বেশ বিপাকে পড়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হাত এখন দৃশ্যতই পিঠের নিচে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাববলয় টিকিয়ে রাখতে আমেরিকা লেগে আছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে। চীনকেও অস্থির করে তুলতে মরিয়া। ভারতে এখন প্রতিনিয়তই ভাঙনের খেলা চলছে। এদিকে মায়ানমারের ১০ লক্ষের অধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভার বয়ে চলতে পারছে না বাংলাদেশ। কূটনৈতিকভাবেও কাউকে বোঝাতে সক্ষম হচ্ছে না। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস হয়তো আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনায় এনে এই সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম হবেন বলেও দেশের মানুষ ধারণা করছে। কিছুদিন আগে ফাঁস হওয়া শেখ হাসিনার কলরেকর্ড নিয়েও চলছে জোর আলোচনা। কথোপকথনে জানা যায় তিনি দেশে আসতে চান। তারই ধারাবাহিকতায় রয়টার্সকে দেয়া সাক্ষাৎকারে হাসিনাপুত্র জয়ও সে বিষয়ই ইঙ্গিত করেছেন। জয় আরো জানিয়েছেন, শেখ হাসিনা দেশে এসে বিচার মোকাবিলা করতে চান।

এবার আসা যাক ফ্যাসিবাদ নিয়ে আলোচনায়। ফ্যাসিবাদ বলতে আমরা কী বুঝি? সর্বজনীনভাবে ফ্যাসিবাদ হচ্ছে একটি মতাদর্শ। ‘ফ্যাসিবাদ’ ধারণাটির উৎপত্তি হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ইতালিতে। তারপর জার্মানি এবং ইউরোপের নানা দেশে বিস্তার ঘটে এই মতবাদের। জার্মানিতে হিটলারের ‘নাৎসিবাদ’ এর উত্থান হয়। এটিও ছিল ‘ফ্যাসিবাদের একটি রূপ। ‘ফ্যাসিবাদ’ উত্থানের মধ্য দিয়ে ইউরোপে হিটলার ও মুসোলিনির মতো বিতর্কিত নেতার উদ্ভব হয়। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ বামপন্থীদের নিয়ে বাম মধ্যপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী হলেও দেশের চলমান সংকটের ফলে এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র রাজনৈতিক জোটকে বিরুদ্ধ মত ও মতাদর্শের রাজনৈতিক গোষ্ঠী ফ্যাসিস্ট হিসেবে আখ্যা দিতে শুরু করে। ফ্যাসিবাদ হচ্ছে উগ্র-ডানপন্থী মতাদর্শ হলেও আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে সমাজতান্ত্রিক ধারণার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। ফ্যাসিবাদী মতাদর্শে বিরোধী মতের কোন স্থান ছিল না। কর্তৃত্বময় শাসন ক্ষমতাই ছিল ‘ফ্যাসিবাদ’ এর মূলমন্ত্র। আর সেই তকমা আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের নির্বাচন পূর্ব ও পরবর্তী সরকার পতন পর্যন্ত এবং ফ্যাসিস্ট দল হিসেবে গণহত্যার অভিযোগে বিচারে দোষী প্রমাণিত হলে ১০ বছর শাস্তির আইন প্রণয়নের কথাও শোনা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতে আওয়ামী লীগ নামক স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দেয়া দলটির ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। দলটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন শেখ হাসিনা। তার নামে দুই শতাধিক মামলা রুজু হয়েছে। যাতে ছাত্র- জনতার আন্দোলন দমন করতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগে হত্যা, গুম ও পোড়ানো অভিযোগ আনা হয়েছে। এই লক্ষ্যে বিভিন্ন মামলায় তদন্তের অনুমতি চাওয়া হয়েছে। ঢেলে সাজানো হয়েছে তারই গড়ে তোলা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সেই ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউটর নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

মাঠের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ অতীতে অনেক সংকট থেকে উত্তরণ ঘটিয়েছে দক্ষ নেতৃত্বের মাধ্যমে। এবার কোন পথে হাঁটবে দলটি? আর নেতৃত্বেইবা থাকবে কে? মাঠ গোছানোর মতো শক্ত কাজ করে, বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলা করে দলটি পারবে কি ‘ফ্যাসিবাদের’ তকমা মুছে ফেলতে? নাকি সাবেক স্বৈরাচারী শাসক হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের মতোই আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাকেও কাটাতে হবে সেই অভিশপ্ত ‘স্বৈরাচার’ নামক ঘৃণিত শব্দে। দেশের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দল বলে পরিচিত দলটি সবসময়ই ছিল নির্বাচনমুখী। অথচ সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, আওয়ামী লীগ ছাড়াও নির্বাচন বৈধ হবে। তাহলে অর্থ কী দাঁড়ায় বিচারে যাই হোক, আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে দূরে রাখতেই একটি মহল সোচ্চার। সরকারও সেই তেলে ঘি ঢেলে যাচ্ছে নিয়মিত। উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের স্পষ্ট বক্তব্য বিচারের আগে এই ফ্যাসিস্ট দলকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে দিতে চান না। উপদেষ্টা আসিফ নজরুলও একই মত ব্যক্ত করে চলেছেন মিডিয়ায় ও কর্ম পরিকল্পনায়। সময় যত গড়াচ্ছে ততোই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে। এতে করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অনেকেই আত্মগোপন অবস্থা থেকে গৃহে ফিরতে শুরু করেছেন। পাশাপাশি ধরপাকড়ও চলছে। মিডিয়ায় এসেছে সারাদেশে অনেক নিরপরাধ ব্যক্তিকে মামলায় আসামি শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে। সরকারও বিষয়টা আমলে নিয়ে যেনতেন গ্রেপ্তার নয় মর্মে পুলিশকে এই বিষয়ে মৌখিক নির্দেশনা দিয়ে রেখেছে।

অতীতে রাজনীতির ক্রান্তিকাল পেরিয়ে এসেছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং বামপন্থী দলগুলো। সবারই অভিজ্ঞতা আছে সংকট উত্তরণের। এবার আওয়ামী লীগ কীভাবে উত্তরণ ঘটাবে? আদৌ কি পারবে সংকট কাটিয়ে স্বাভাবিক রাজনীতে ফিরতে? নাকি ধুঁকে ধুঁকে কাটাতে হবে বাকি সময়টা? আমরা দেশে সুস্থির রাজনীতি দেখতে চাই। মানুষে মানুষে সহাবস্থান চাই। প্রয়োজনে রাজনীতিতে ঐতিহাসিক কোন চুক্তি সম্পাদন করে হলেও শান্তি চাই!

[লেখক : আইনজীবী, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]

back to top