alt

উপ-সম্পাদকীয়

নতুন প্রেক্ষাপটে ‘চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড’ : স্বাধীনতা না প্রতিরোধ?

রেজাউল করিম খোকন

: সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে ‘চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড’ গঠনের মাধ্যমে। দীর্ঘদিন ধরে চলচ্চিত্রকর্মীদের যে দাবি ছিল সেন্সর বোর্ডের সংস্কার, অবশেষে সরকার সেটি বাস্তবায়ন করেছে। তবে প্রশ্ন উঠেছে, এটি কি সত্যিকারের স্বাধীনতা এনে দেবে, নাকি নতুন একটি বাধার সৃষ্টি করবে? চলুন, নতুন আইন এবং বোর্ডের ভূমিকা বিশ্লেষণ করি।

সেন্সর বোর্ড থেকে সার্টিফিকেশন বোর্ডের যাত্রা

চলচ্চিত্র নির্মাতাদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের মুখে সরকার ২০২৩ সালে ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড’ গঠন করে। এর মাধ্যমে পূর্বের ‘সেন্সর বোর্ড’ বাতিল করে নতুন একটি ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। সার্টিফিকেশন বোর্ডের মূল লক্ষ্য হলো, সিনেমাগুলোকে নির্দিষ্ট বয়সের দর্শকদের জন্য শ্রেণীবদ্ধ করা, যাতে কোনো চলচ্চিত্র অযথা আটকে না থাকে। এর ফলে, চলচ্চিত্র সেন্সরের পুরনো সংস্কৃতির অবসান ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে।

প্রথমে মনে হয়েছিল, নতুন বোর্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পে নতুন স্বাধীনতা আসবে। সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা এতদিন ছিল, সেগুলো দূর হবে। তবে নতুন সার্টিফিকেশন আইন এবং বিধিমালা পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, এই ব্যবস্থাও পুরোপুরি মুক্তচিন্তার সুযোগ দেবে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

সার্টিফিকেশন আইন : প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতা

নতুন ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন, ২০২৩’-এ ১৫ সদস্যের একটি বোর্ড গঠনের কথা বলা হয়েছে, যারা সিনেমা দেখবে এবং তা কোন বয়সের দর্শকদের জন্য উপযুক্ত, সেই সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, এ আইন কি সত্যিকার অর্থে চলচ্চিত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারবে?

সেন্সর বোর্ডের মতোই, নতুন সার্টিফিকেশন বোর্ডেও সিনেমা আটকে রাখার সুযোগ রাখা হয়েছে। অর্থাৎ, বোর্ড কোন সিনেমাকে বাতিল বা স্থগিত করতে পারবে। শুধু তাই নয়, জেলা প্রশাসকও চাইলে তার এলাকায় কোন সিনেমার প্রদর্শন বন্ধ করতে পারবেন। সার্টিফিকেশন বোর্ডের উদ্দেশ্য ছিল সিনেমা আটকে না রাখা, তবে আইন অনুযায়ী কিছু সিনেমা আটকে দেয়ার সুযোগ রয়ে গেছে। এই দ্বৈততা নিয়ে নির্মাতারা উদ্বিগ্ন।

চলচ্চিত্রে সেন্সরশিপ : শিল্পের স্বাধীনতা বনাম নিয়ন্ত্রণ

সেন্সর বোর্ডের অধীনে চলচ্চিত্র নির্মাণে যেসব চ্যালেঞ্জ ছিল, তার একটি প্রধান সমস্যা ছিল সেন্সর প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা এবং অপ্রয়োজনীয় সেন্সরশিপ। অনেক সময় সিনেমার কাহিনি বা দৃশ্য শুধু বোর্ডের সদস্যদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কাটছাঁট করা হতো, যা নির্মাতাদের সৃষ্টিশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করত। সেন্সর বোর্ডের মাধ্যমে সমাজের কিছু অংশকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করা হতো, যার ফলে বহু ভালো সিনেমা আলোর মুখ দেখেনি। এ অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে আশা করা হলেও, সার্টিফিকেশন আইনে সেই একই বাধা রয়ে গেছে।

সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠনের পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল, সিনেমা কোন বয়সের দর্শকের জন্য উপযুক্ত, তা নির্ধারণ করা। কিন্তু নতুন আইনে আবারও সেই পুরনো সেন্সরশিপ ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছে, যা নির্মাতাদের স্বাধীনতা হ্রাস করবে।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ

বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সেন্সরশিপ এখনো জোরালোভাবে কার্যকর। যেমন, হলিউড বা বলিউডে সেন্সরশিপের বদলে সিনেমাকে বয়সভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ করা হয়। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই প্রক্রিয়া এখনো শুরুই হয়নি। ‘সার্টিফিকেশন’ প্রক্রিয়াটি চালু হলেও তা কতটা স্বাধীন এবং কার্যকর হবে, সেটি নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে।

বিশ্বের অনেক দেশেই সেন্সরশিপ প্রথা উঠে গিয়ে চলচ্চিত্রকে শুধু নির্দিষ্ট বয়সের জন্য শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। এর ফলে, দর্শক নিজেরাই সিনেমা বাছাই করতে পারেন। বাংলাদেশের সার্টিফিকেশন আইনের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়ার সূচনা হলেও এর বাস্তবায়ন কতটা সঠিকভাবে হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ, এই নতুন আইনেও চলচ্চিত্র আটকে দেয়ার বা বাতিল করার সুযোগ রাখা হয়েছে।

সার্টিফিকেশন বোর্ডের গঠন ও কার্যকারিতা

নতুন সার্টিফিকেশন বোর্ডের গঠনে বেশ কিছু বিতর্কিত বিষয় রয়েছে। বোর্ডের সদস্য সংখ্যা ১৫ হলেও এর বেশিরভাগই সরকারি কর্মকর্তা, যারা চলচ্চিত্র বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন। একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বা চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বোর্ডের প্রধান করা উচিত ছিল, কিন্তু তা হয়নি। বরং সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরও দৃঢ় হয়েছে। ভারতে যেখানে সার্টিফিকেশন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে একজন চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে রাখা হয়, সেখানে বাংলাদেশে এই বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ রয়ে গেছে আমলাদের হাতে।

বোর্ডে সরকারি কর্মকর্তাদের আধিক্যের কারণে চলচ্চিত্রসংক্রান্ত বিশেষজ্ঞদের মতামত অবহেলিত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভারতে সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সার্টিফিকেশন (সিবিএফসি) একটি উদাহরণ হতে পারে, যেখানে শিল্পী এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা চলচ্চিত্রের পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারেন।

চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ

সেন্সর বোর্ডের পরিবর্তে সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠন করে সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে, তবে চলচ্চিত্র নির্মাতারা এতে সন্তুষ্ট নন। সার্টিফিকেশন আইনেও বেশ কিছু দমনমূলক ধারা রয়ে গেছে, যা চলচ্চিত্রের স্বাধীনতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যেমন, সার্টিফিকেশন বোর্ডের অনুমোদন ছাড়া কোন চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা যাবে না, এমনকি ডিজিটাল মাধ্যমেও না। এতে করে ওটিটি বা অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের নির্মাতারাও একই নিয়ন্ত্রণের আওতায় পড়বেন, যা সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং প্রদর্শনের ক্ষেত্রে এই নতুন আইন কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে চলচ্চিত্রকর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। সার্টিফিকেশন বোর্ড শুধু নামেই স্বাধীন, বাস্তবে এটি সেন্সর বোর্ডের একটি রূপান্তর ছাড়া আর কিছু নয়।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে ‘চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড’ গঠন একটি মাইলফলক হতে পারত, যদি এর কাঠামো এবং আইন সত্যিকার অর্থে চলচ্চিত্রের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করত। কিন্তু নতুন সার্টিফিকেশন আইন অনেকাংশেই পুরনো সেন্সরশিপ ব্যবস্থার ছায়া বহন করছে। চলচ্চিত্র শিল্পে স্বাধীনতা আসার পরিবর্তে, এটি আরও একটি বাধার জন্ম দিতে পারে।

ফলে, চলচ্চিত্রকর্মীরা মনে করছেন, একটি উদার ও সৃজনশীল চলচ্চিত্র পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য এই আইনের সংস্কার প্রয়োজন। সার্টিফিকেশন বোর্ডের মূল লক্ষ্য যদি শুধুই চলচ্চিত্র শ্রেণীবিভাগ করা হয়, তবে তা যেন নির্মাতাদের সৃষ্টিশীলতাকে বাধাগ্রস্ত না করে। নতুন আইনটি যেভাবে গঠিত হয়েছে, তাতে এর সঙ্গে অনেকাংশে পুরনো সেন্সরশিপ আইনের মিল রয়েছে, যা স্বাধীন শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে নতুন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ]

বাংলার মৃৎশিল্প

প্রবারণা পূর্ণিমার আলোয় আলোকিত হোক মানবজাতি

খেলাপি ঋণের অপসংস্কৃতি

কথার কথা যত কথা

দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত হোক শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

সুইডেনের গণতন্ত্র

বিচ্ছিন্নতা ও একাকীত্ব : শহুরে জীবনধারার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

ধর্মীয় স্বাধীনতা ও কঠিন চীবরদান

ছবি

দুর্গাপূজার মর্মবাণী

মানুষ মূল্যস্ফীতি থেকে রক্ষা পাবে কীভাবে

গুজব ও মিথ্যা তথ্য : সমাজের এক ভয়াবহ ব্যাধি

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে দৃঢ় পদক্ষেপ প্রয়োজন

পুরাতত্ত্বের ধারায় সনাতনী সমাজের দুর্গাপূজা

জীবন-মৃত্যু কী?

নাসা : বিজ্ঞানের পীঠস্থান

শিক্ষা সংস্কারে প্রথাগত চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে

সাংঘাতিক ভাই, সাংঘাতিক...

প্রযুক্তির মায়াজালে বন্দি মানুষ

ছবি

এসএম সুলতান : সংস্কৃতি সত্তার সত্যপাঠ

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস

তরুণ সমাজ ও প্রযুক্তি নির্ভরতা : সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

বগুড়ার তাঁতপল্লী

অটিজম কোনো রোগ নয়

জনপ্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্যার সম্বোধন কি আইনসম্মত

দুর্বল ব্যাংকগুলোকে কতদিন সহায়তা দেয়া হবে?

বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য বয়সবৈষম্য দূর করুন

আসন্ন বোরো উৎপাদন ও কিছু শঙ্কা

ছবি

আইন পেশার জানা-অজানা কথা

ছবি

ব্যাংক খাতের সংকট

একাকিত্ব ও মানসিক অশান্তি

বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজ

ব্রি: কিছু প্রশ্ন, কিছু উত্তর

ক্রেতা ঠকে গেলে তার আইনগত প্রতিকার

ঢাকার যানজট : কিছু প্রস্তাব

রম্যগদ্য : দারিদ্র্য যাবে জাদুঘরে

গার্মেন্টস খাতে সংকট

tab

উপ-সম্পাদকীয়

নতুন প্রেক্ষাপটে ‘চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড’ : স্বাধীনতা না প্রতিরোধ?

রেজাউল করিম খোকন

সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে ‘চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড’ গঠনের মাধ্যমে। দীর্ঘদিন ধরে চলচ্চিত্রকর্মীদের যে দাবি ছিল সেন্সর বোর্ডের সংস্কার, অবশেষে সরকার সেটি বাস্তবায়ন করেছে। তবে প্রশ্ন উঠেছে, এটি কি সত্যিকারের স্বাধীনতা এনে দেবে, নাকি নতুন একটি বাধার সৃষ্টি করবে? চলুন, নতুন আইন এবং বোর্ডের ভূমিকা বিশ্লেষণ করি।

সেন্সর বোর্ড থেকে সার্টিফিকেশন বোর্ডের যাত্রা

চলচ্চিত্র নির্মাতাদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের মুখে সরকার ২০২৩ সালে ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড’ গঠন করে। এর মাধ্যমে পূর্বের ‘সেন্সর বোর্ড’ বাতিল করে নতুন একটি ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। সার্টিফিকেশন বোর্ডের মূল লক্ষ্য হলো, সিনেমাগুলোকে নির্দিষ্ট বয়সের দর্শকদের জন্য শ্রেণীবদ্ধ করা, যাতে কোনো চলচ্চিত্র অযথা আটকে না থাকে। এর ফলে, চলচ্চিত্র সেন্সরের পুরনো সংস্কৃতির অবসান ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে।

প্রথমে মনে হয়েছিল, নতুন বোর্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পে নতুন স্বাধীনতা আসবে। সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা এতদিন ছিল, সেগুলো দূর হবে। তবে নতুন সার্টিফিকেশন আইন এবং বিধিমালা পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, এই ব্যবস্থাও পুরোপুরি মুক্তচিন্তার সুযোগ দেবে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

সার্টিফিকেশন আইন : প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতা

নতুন ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন, ২০২৩’-এ ১৫ সদস্যের একটি বোর্ড গঠনের কথা বলা হয়েছে, যারা সিনেমা দেখবে এবং তা কোন বয়সের দর্শকদের জন্য উপযুক্ত, সেই সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, এ আইন কি সত্যিকার অর্থে চলচ্চিত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারবে?

সেন্সর বোর্ডের মতোই, নতুন সার্টিফিকেশন বোর্ডেও সিনেমা আটকে রাখার সুযোগ রাখা হয়েছে। অর্থাৎ, বোর্ড কোন সিনেমাকে বাতিল বা স্থগিত করতে পারবে। শুধু তাই নয়, জেলা প্রশাসকও চাইলে তার এলাকায় কোন সিনেমার প্রদর্শন বন্ধ করতে পারবেন। সার্টিফিকেশন বোর্ডের উদ্দেশ্য ছিল সিনেমা আটকে না রাখা, তবে আইন অনুযায়ী কিছু সিনেমা আটকে দেয়ার সুযোগ রয়ে গেছে। এই দ্বৈততা নিয়ে নির্মাতারা উদ্বিগ্ন।

চলচ্চিত্রে সেন্সরশিপ : শিল্পের স্বাধীনতা বনাম নিয়ন্ত্রণ

সেন্সর বোর্ডের অধীনে চলচ্চিত্র নির্মাণে যেসব চ্যালেঞ্জ ছিল, তার একটি প্রধান সমস্যা ছিল সেন্সর প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা এবং অপ্রয়োজনীয় সেন্সরশিপ। অনেক সময় সিনেমার কাহিনি বা দৃশ্য শুধু বোর্ডের সদস্যদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কাটছাঁট করা হতো, যা নির্মাতাদের সৃষ্টিশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করত। সেন্সর বোর্ডের মাধ্যমে সমাজের কিছু অংশকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করা হতো, যার ফলে বহু ভালো সিনেমা আলোর মুখ দেখেনি। এ অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে আশা করা হলেও, সার্টিফিকেশন আইনে সেই একই বাধা রয়ে গেছে।

সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠনের পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল, সিনেমা কোন বয়সের দর্শকের জন্য উপযুক্ত, তা নির্ধারণ করা। কিন্তু নতুন আইনে আবারও সেই পুরনো সেন্সরশিপ ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছে, যা নির্মাতাদের স্বাধীনতা হ্রাস করবে।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ

বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সেন্সরশিপ এখনো জোরালোভাবে কার্যকর। যেমন, হলিউড বা বলিউডে সেন্সরশিপের বদলে সিনেমাকে বয়সভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ করা হয়। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই প্রক্রিয়া এখনো শুরুই হয়নি। ‘সার্টিফিকেশন’ প্রক্রিয়াটি চালু হলেও তা কতটা স্বাধীন এবং কার্যকর হবে, সেটি নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে।

বিশ্বের অনেক দেশেই সেন্সরশিপ প্রথা উঠে গিয়ে চলচ্চিত্রকে শুধু নির্দিষ্ট বয়সের জন্য শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। এর ফলে, দর্শক নিজেরাই সিনেমা বাছাই করতে পারেন। বাংলাদেশের সার্টিফিকেশন আইনের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়ার সূচনা হলেও এর বাস্তবায়ন কতটা সঠিকভাবে হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ, এই নতুন আইনেও চলচ্চিত্র আটকে দেয়ার বা বাতিল করার সুযোগ রাখা হয়েছে।

সার্টিফিকেশন বোর্ডের গঠন ও কার্যকারিতা

নতুন সার্টিফিকেশন বোর্ডের গঠনে বেশ কিছু বিতর্কিত বিষয় রয়েছে। বোর্ডের সদস্য সংখ্যা ১৫ হলেও এর বেশিরভাগই সরকারি কর্মকর্তা, যারা চলচ্চিত্র বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন। একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বা চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বোর্ডের প্রধান করা উচিত ছিল, কিন্তু তা হয়নি। বরং সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরও দৃঢ় হয়েছে। ভারতে যেখানে সার্টিফিকেশন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে একজন চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে রাখা হয়, সেখানে বাংলাদেশে এই বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ রয়ে গেছে আমলাদের হাতে।

বোর্ডে সরকারি কর্মকর্তাদের আধিক্যের কারণে চলচ্চিত্রসংক্রান্ত বিশেষজ্ঞদের মতামত অবহেলিত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভারতে সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সার্টিফিকেশন (সিবিএফসি) একটি উদাহরণ হতে পারে, যেখানে শিল্পী এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা চলচ্চিত্রের পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারেন।

চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ

সেন্সর বোর্ডের পরিবর্তে সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠন করে সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে, তবে চলচ্চিত্র নির্মাতারা এতে সন্তুষ্ট নন। সার্টিফিকেশন আইনেও বেশ কিছু দমনমূলক ধারা রয়ে গেছে, যা চলচ্চিত্রের স্বাধীনতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যেমন, সার্টিফিকেশন বোর্ডের অনুমোদন ছাড়া কোন চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা যাবে না, এমনকি ডিজিটাল মাধ্যমেও না। এতে করে ওটিটি বা অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের নির্মাতারাও একই নিয়ন্ত্রণের আওতায় পড়বেন, যা সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং প্রদর্শনের ক্ষেত্রে এই নতুন আইন কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে চলচ্চিত্রকর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। সার্টিফিকেশন বোর্ড শুধু নামেই স্বাধীন, বাস্তবে এটি সেন্সর বোর্ডের একটি রূপান্তর ছাড়া আর কিছু নয়।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে ‘চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড’ গঠন একটি মাইলফলক হতে পারত, যদি এর কাঠামো এবং আইন সত্যিকার অর্থে চলচ্চিত্রের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করত। কিন্তু নতুন সার্টিফিকেশন আইন অনেকাংশেই পুরনো সেন্সরশিপ ব্যবস্থার ছায়া বহন করছে। চলচ্চিত্র শিল্পে স্বাধীনতা আসার পরিবর্তে, এটি আরও একটি বাধার জন্ম দিতে পারে।

ফলে, চলচ্চিত্রকর্মীরা মনে করছেন, একটি উদার ও সৃজনশীল চলচ্চিত্র পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য এই আইনের সংস্কার প্রয়োজন। সার্টিফিকেশন বোর্ডের মূল লক্ষ্য যদি শুধুই চলচ্চিত্র শ্রেণীবিভাগ করা হয়, তবে তা যেন নির্মাতাদের সৃষ্টিশীলতাকে বাধাগ্রস্ত না করে। নতুন আইনটি যেভাবে গঠিত হয়েছে, তাতে এর সঙ্গে অনেকাংশে পুরনো সেন্সরশিপ আইনের মিল রয়েছে, যা স্বাধীন শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে নতুন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ]

back to top