alt

উপ-সম্পাদকীয়

বিচ্ছিন্নতা ও একাকীত্ব : শহুরে জীবনধারার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

মতিউর রহমান

: সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪

বাংলাদেশের শহরগুলোর দ্রুত বর্ধনশীল জীবনধারা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। জনসংখ্যার বিস্তৃতি, প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তরিত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে মানুষের সামাজিক জীবন আগের তুলনায় আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। আগে যেখানে পরিবার, সমাজ এবং আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক মানুষকে মানসিকভাবে শক্তিশালী রাখত, বর্তমানে শহরের ব্যস্ত জীবনে সেই সম্পর্কগুলো দূরত্বের শিকার হয়েছে। একাকীত্ব এবং বিচ্ছিন্নতা তাই অনেকের জীবনের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা তাদের মনস্তাত্ত্বিক ভারসাম্যহীনতা এবং হতাশার কারণ হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশের শহরগুলোর জীবনধারা গ্রামাঞ্চলের চেয়ে ভিন্ন। এখানে জীবনযাত্রা দ্রুত, প্রতিযোগিতামূলক এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক। শহুরে মানুষ জীবনের প্রাত্যহিক চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে সময়ের অভাবে তাদের সামাজিক সম্পর্কগুলোর প্রতি কম মনোযোগ দেয়। অনেকেই কর্মজীবন এবং আর্থিক নিরাপত্তার পেছনে ছুটতে গিয়ে পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ হারায়। সামাজিক সংযোগের এই অভাব ধীরে ধীরে মানসিক বিচ্ছিন্নতা এবং একাকীত্বের দিকে ঠেলে দেয়। প্রথমেই বলা যায়, শহরের যান্ত্রিক জীবনযাত্রা এবং মানুষের মনস্তাত্ত্বিক সংকটের মধ্যে একটি প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। গ্রামের সাধারণ জীবনযাত্রা থেকে শহরের ব্যস্ত জীবনে আসা অনেক মানুষ এখানে এসে নিজেদের একাকী এবং বিচ্ছিন্ন মনে করে। শহরের কর্মব্যস্ততা, যানজট, শব্দদূষণ এবং জনসংখ্যার চাপ মানুষকে মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত করে তোলে। শারীরিক ক্লান্তি যেমন মানসিক ক্লান্তির কারণ হয়, তেমনি সামাজিক দূরত্বও মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শহরের জীবনযাত্রার ব্যস্ততা মানুষের মানসিক প্রশান্তির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এর ফলে অনেকেই বিষণœতা, দুশ্চিন্তা এবং একাকীত্বের শিকার হয়। শহরের এই একাকীত্ব অনেক ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক রোগের জন্ম দেয়।

বাংলাদেশের শহুরে জীবনে মানুষ দ্রুতগতিতে নিজস্ব জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই ব্যস্ততা এবং প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে মানুষ নিজেকে সামাজিকভাবে একঘরে মনে করতে শুরু করে। শহুরে মানুষদের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা মানুষকে আরও বিচ্ছিন্ন করে তুলছে। এই বিচ্ছিন্নতা মানুষের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলে, যা দীর্ঘমেয়াদে বিষণœতা এবং হতাশার জন্ম দেয়।

মানুষের মনস্তাত্ত্বিক স্বাস্থ্যের ওপর তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারও একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। শহরের মানুষের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। যদিও এটি মানুষকে বিশ্বজুড়ে সংযুক্ত রাখার সুযোগ দেয়, কিন্তু এটি বাস্তব জীবনে সামাজিক সংযোগের বিকল্প হতে পারে না। ভার্চুয়াল বন্ধুত্ব এবং সম্পর্কগুলো অনেক সময় মানুষকে আর্থিক, মানসিক এবং সামাজিকভাবে নিরাপদ করে তুলতে পারে না। বাস্তব জীবনের সামাজিক সম্পর্কের অভাব এবং ভার্চুয়াল জগতের অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা মানুষকে আরও বিচ্ছিন্ন এবং একাকী করে তোলে।

শহরের জীবনে আরও একটি বড় সমস্যা হল মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক আলোচনা এবং সেবা পাওয়ার অভাব। যদিও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা ধীরে ধীরে বাড়ছে, কিন্তু অনেক মানুষ এখনো এটি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে সংকোচ বোধ করে। তাদের কাছে একাকীত্ব বা বিচ্ছিন্নতা থেকে উদ্ভূত সমস্যাগুলোকে গুরুত্বহীন মনে হয়। ফলে, মানসিক অসুস্থতার লক্ষণগুলো আরও গুরুতর আকার ধারণ করে এবং তা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

শহুরে জীবনের এই মানসিক চাপ এবং একাকীত্ব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রয়োজন সামাজিক সংযোগ এবং মনস্তাত্ত্বিক সুরক্ষার। শহরে মানসিক সেবা গ্রহণের সুযোগ বাড়ানো উচিত, যাতে মানুষ সহজেই মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হতে পারে এবং প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারে। এছাড়া শহুরে মানুষের মাঝে সামাজিক সংযোগের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং কমিউনিটি প্রোগ্রামের মাধ্যমে মানুষকে সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ করা যেতে পারে।

বাংলাদেশের শহুরে জীবনে সামগ্রিক সামাজিক সম্পর্ক এবং পারিবারিক বন্ধন আরও দৃঢ় করা প্রয়োজন। শহরের ব্যস্ত জীবনযাত্রার মাঝে পারিবারিক সময় এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। একসঙ্গে সময় কাটানো, খোলামেলা আলোচনা করা এবং পারস্পরিক সহানুভূতির মধ্য দিয়ে আমরা একাকীত্ব এবং বিচ্ছিন্নতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে পারি।

বিশ্বজুড়ে শহরায়নের ফলে বিভিন্ন সমাজেই একাকীত্ব এবং বিচ্ছিন্নতা একটি সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের শহুরে জীবনেও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রযুক্তি, কর্মব্যস্ততা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা মানুষকে একাকী করে তুলছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন মনস্তাত্ত্বিক সচেতনতা, সামাজিক সংযোগ এবং পারিবারিক সম্পর্কের ওপর জোর দেওয়া।

এখানে একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে যে, মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য ব্যক্তিগত পর্যায়ে সম্পর্কের উন্নতি ঘটানো জরুরি। শহরের ব্যস্ততায় মানুষ যখন একে অপরের পাশে সময় কাটানোর সুযোগ হারায়, তখন সম্পর্কের গুরুত্ব এবং গভীরতা কমে যায়। পারস্পরিক সহানুভূতি এবং সহযোগিতা মানুষের জীবনের একাকীত্ব দূর করতে পারে। পারিবারিক সম্পর্কের উন্নতির মাধ্যমেই আমরা শহুরে জীবনের বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্তি পেতে পারি।

শহুরে জীবনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো কর্মজীবনের চাপ। অনেকেই কাজের চাপে দম ফেলার সময় পায় না, যার ফলে মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায় এবং একাকীত্বের জন্ম হয়। কাজের প্রতি অতিরিক্ত মনোনিবেশ এবং কর্মক্ষেত্রের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে মানুষ তার মানসিক স্বাস্থ্যের যতœ নিতে পারে না। অফিসের দীর্ঘ সময় কাজ করা, ব্যক্তিগত সময়ের অভাব এবং কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত চাপ অনেক ক্ষেত্রেই মানসিক অসুস্থতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এছাড়া শহরের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মানুষকে একরকম নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দেয়। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে আর্থিক নিরাপত্তার অভাব তাদের সামাজিক সংযোগের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। এর ফলে, অর্থনৈতিক চাপ এবং মানসিক উদ্বেগ তাদের জীবনে একাকীত্বের অনুভূতি বাড়িয়ে তোলে। তারা পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সামাজিক সংযোগ হারিয়ে ফেলে, যা একাকীত্ব এবং বিষণœতার মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনের ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি। কর্মক্ষেত্রের চাপ এবং সামাজিক জীবনের অভাব একসঙ্গে মানসিক অসুস্থতার জন্ম দিতে পারে। তাই একদিকে কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সচেতনতা বাড়াতে হবে, অন্যদিকে সামাজিক জীবনকে আরও শক্তিশালী করার জন্য সামাজিক যোগাযোগ বাড়ানো জরুরি।

বাংলাদেশের শহুরে জীবনধারায় একাকীত্ব এবং বিচ্ছিন্নতা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলছে। শহরের ব্যস্ততা, প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং সামাজিক সংযোগের অভাব একসঙ্গে মানুষের জীবনকে একাকীত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। একসঙ্গে কাজ করে, পারিবারিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটিয়ে এবং সামাজিক সংযোগ বাড়িয়ে আমরা এই মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার সমাধান করতে পারি।

[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

বাংলার মৃৎশিল্প

প্রবারণা পূর্ণিমার আলোয় আলোকিত হোক মানবজাতি

খেলাপি ঋণের অপসংস্কৃতি

কথার কথা যত কথা

দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত হোক শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

সুইডেনের গণতন্ত্র

নতুন প্রেক্ষাপটে ‘চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড’ : স্বাধীনতা না প্রতিরোধ?

ধর্মীয় স্বাধীনতা ও কঠিন চীবরদান

ছবি

দুর্গাপূজার মর্মবাণী

মানুষ মূল্যস্ফীতি থেকে রক্ষা পাবে কীভাবে

গুজব ও মিথ্যা তথ্য : সমাজের এক ভয়াবহ ব্যাধি

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে দৃঢ় পদক্ষেপ প্রয়োজন

পুরাতত্ত্বের ধারায় সনাতনী সমাজের দুর্গাপূজা

জীবন-মৃত্যু কী?

নাসা : বিজ্ঞানের পীঠস্থান

শিক্ষা সংস্কারে প্রথাগত চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে

সাংঘাতিক ভাই, সাংঘাতিক...

প্রযুক্তির মায়াজালে বন্দি মানুষ

ছবি

এসএম সুলতান : সংস্কৃতি সত্তার সত্যপাঠ

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস

তরুণ সমাজ ও প্রযুক্তি নির্ভরতা : সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

বগুড়ার তাঁতপল্লী

অটিজম কোনো রোগ নয়

জনপ্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্যার সম্বোধন কি আইনসম্মত

দুর্বল ব্যাংকগুলোকে কতদিন সহায়তা দেয়া হবে?

বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য বয়সবৈষম্য দূর করুন

আসন্ন বোরো উৎপাদন ও কিছু শঙ্কা

ছবি

আইন পেশার জানা-অজানা কথা

ছবি

ব্যাংক খাতের সংকট

একাকিত্ব ও মানসিক অশান্তি

বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজ

ব্রি: কিছু প্রশ্ন, কিছু উত্তর

ক্রেতা ঠকে গেলে তার আইনগত প্রতিকার

ঢাকার যানজট : কিছু প্রস্তাব

রম্যগদ্য : দারিদ্র্য যাবে জাদুঘরে

গার্মেন্টস খাতে সংকট

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বিচ্ছিন্নতা ও একাকীত্ব : শহুরে জীবনধারার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

মতিউর রহমান

সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪

বাংলাদেশের শহরগুলোর দ্রুত বর্ধনশীল জীবনধারা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। জনসংখ্যার বিস্তৃতি, প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তরিত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে মানুষের সামাজিক জীবন আগের তুলনায় আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। আগে যেখানে পরিবার, সমাজ এবং আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক মানুষকে মানসিকভাবে শক্তিশালী রাখত, বর্তমানে শহরের ব্যস্ত জীবনে সেই সম্পর্কগুলো দূরত্বের শিকার হয়েছে। একাকীত্ব এবং বিচ্ছিন্নতা তাই অনেকের জীবনের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা তাদের মনস্তাত্ত্বিক ভারসাম্যহীনতা এবং হতাশার কারণ হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশের শহরগুলোর জীবনধারা গ্রামাঞ্চলের চেয়ে ভিন্ন। এখানে জীবনযাত্রা দ্রুত, প্রতিযোগিতামূলক এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক। শহুরে মানুষ জীবনের প্রাত্যহিক চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে সময়ের অভাবে তাদের সামাজিক সম্পর্কগুলোর প্রতি কম মনোযোগ দেয়। অনেকেই কর্মজীবন এবং আর্থিক নিরাপত্তার পেছনে ছুটতে গিয়ে পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ হারায়। সামাজিক সংযোগের এই অভাব ধীরে ধীরে মানসিক বিচ্ছিন্নতা এবং একাকীত্বের দিকে ঠেলে দেয়। প্রথমেই বলা যায়, শহরের যান্ত্রিক জীবনযাত্রা এবং মানুষের মনস্তাত্ত্বিক সংকটের মধ্যে একটি প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। গ্রামের সাধারণ জীবনযাত্রা থেকে শহরের ব্যস্ত জীবনে আসা অনেক মানুষ এখানে এসে নিজেদের একাকী এবং বিচ্ছিন্ন মনে করে। শহরের কর্মব্যস্ততা, যানজট, শব্দদূষণ এবং জনসংখ্যার চাপ মানুষকে মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত করে তোলে। শারীরিক ক্লান্তি যেমন মানসিক ক্লান্তির কারণ হয়, তেমনি সামাজিক দূরত্বও মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শহরের জীবনযাত্রার ব্যস্ততা মানুষের মানসিক প্রশান্তির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এর ফলে অনেকেই বিষণœতা, দুশ্চিন্তা এবং একাকীত্বের শিকার হয়। শহরের এই একাকীত্ব অনেক ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক রোগের জন্ম দেয়।

বাংলাদেশের শহুরে জীবনে মানুষ দ্রুতগতিতে নিজস্ব জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই ব্যস্ততা এবং প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে মানুষ নিজেকে সামাজিকভাবে একঘরে মনে করতে শুরু করে। শহুরে মানুষদের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা মানুষকে আরও বিচ্ছিন্ন করে তুলছে। এই বিচ্ছিন্নতা মানুষের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলে, যা দীর্ঘমেয়াদে বিষণœতা এবং হতাশার জন্ম দেয়।

মানুষের মনস্তাত্ত্বিক স্বাস্থ্যের ওপর তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারও একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। শহরের মানুষের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। যদিও এটি মানুষকে বিশ্বজুড়ে সংযুক্ত রাখার সুযোগ দেয়, কিন্তু এটি বাস্তব জীবনে সামাজিক সংযোগের বিকল্প হতে পারে না। ভার্চুয়াল বন্ধুত্ব এবং সম্পর্কগুলো অনেক সময় মানুষকে আর্থিক, মানসিক এবং সামাজিকভাবে নিরাপদ করে তুলতে পারে না। বাস্তব জীবনের সামাজিক সম্পর্কের অভাব এবং ভার্চুয়াল জগতের অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা মানুষকে আরও বিচ্ছিন্ন এবং একাকী করে তোলে।

শহরের জীবনে আরও একটি বড় সমস্যা হল মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক আলোচনা এবং সেবা পাওয়ার অভাব। যদিও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা ধীরে ধীরে বাড়ছে, কিন্তু অনেক মানুষ এখনো এটি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে সংকোচ বোধ করে। তাদের কাছে একাকীত্ব বা বিচ্ছিন্নতা থেকে উদ্ভূত সমস্যাগুলোকে গুরুত্বহীন মনে হয়। ফলে, মানসিক অসুস্থতার লক্ষণগুলো আরও গুরুতর আকার ধারণ করে এবং তা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

শহুরে জীবনের এই মানসিক চাপ এবং একাকীত্ব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রয়োজন সামাজিক সংযোগ এবং মনস্তাত্ত্বিক সুরক্ষার। শহরে মানসিক সেবা গ্রহণের সুযোগ বাড়ানো উচিত, যাতে মানুষ সহজেই মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হতে পারে এবং প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারে। এছাড়া শহুরে মানুষের মাঝে সামাজিক সংযোগের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং কমিউনিটি প্রোগ্রামের মাধ্যমে মানুষকে সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ করা যেতে পারে।

বাংলাদেশের শহুরে জীবনে সামগ্রিক সামাজিক সম্পর্ক এবং পারিবারিক বন্ধন আরও দৃঢ় করা প্রয়োজন। শহরের ব্যস্ত জীবনযাত্রার মাঝে পারিবারিক সময় এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। একসঙ্গে সময় কাটানো, খোলামেলা আলোচনা করা এবং পারস্পরিক সহানুভূতির মধ্য দিয়ে আমরা একাকীত্ব এবং বিচ্ছিন্নতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে পারি।

বিশ্বজুড়ে শহরায়নের ফলে বিভিন্ন সমাজেই একাকীত্ব এবং বিচ্ছিন্নতা একটি সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের শহুরে জীবনেও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রযুক্তি, কর্মব্যস্ততা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা মানুষকে একাকী করে তুলছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন মনস্তাত্ত্বিক সচেতনতা, সামাজিক সংযোগ এবং পারিবারিক সম্পর্কের ওপর জোর দেওয়া।

এখানে একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে যে, মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য ব্যক্তিগত পর্যায়ে সম্পর্কের উন্নতি ঘটানো জরুরি। শহরের ব্যস্ততায় মানুষ যখন একে অপরের পাশে সময় কাটানোর সুযোগ হারায়, তখন সম্পর্কের গুরুত্ব এবং গভীরতা কমে যায়। পারস্পরিক সহানুভূতি এবং সহযোগিতা মানুষের জীবনের একাকীত্ব দূর করতে পারে। পারিবারিক সম্পর্কের উন্নতির মাধ্যমেই আমরা শহুরে জীবনের বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্তি পেতে পারি।

শহুরে জীবনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো কর্মজীবনের চাপ। অনেকেই কাজের চাপে দম ফেলার সময় পায় না, যার ফলে মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায় এবং একাকীত্বের জন্ম হয়। কাজের প্রতি অতিরিক্ত মনোনিবেশ এবং কর্মক্ষেত্রের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে মানুষ তার মানসিক স্বাস্থ্যের যতœ নিতে পারে না। অফিসের দীর্ঘ সময় কাজ করা, ব্যক্তিগত সময়ের অভাব এবং কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত চাপ অনেক ক্ষেত্রেই মানসিক অসুস্থতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এছাড়া শহরের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মানুষকে একরকম নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দেয়। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে আর্থিক নিরাপত্তার অভাব তাদের সামাজিক সংযোগের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। এর ফলে, অর্থনৈতিক চাপ এবং মানসিক উদ্বেগ তাদের জীবনে একাকীত্বের অনুভূতি বাড়িয়ে তোলে। তারা পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সামাজিক সংযোগ হারিয়ে ফেলে, যা একাকীত্ব এবং বিষণœতার মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনের ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি। কর্মক্ষেত্রের চাপ এবং সামাজিক জীবনের অভাব একসঙ্গে মানসিক অসুস্থতার জন্ম দিতে পারে। তাই একদিকে কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সচেতনতা বাড়াতে হবে, অন্যদিকে সামাজিক জীবনকে আরও শক্তিশালী করার জন্য সামাজিক যোগাযোগ বাড়ানো জরুরি।

বাংলাদেশের শহুরে জীবনধারায় একাকীত্ব এবং বিচ্ছিন্নতা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলছে। শহরের ব্যস্ততা, প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং সামাজিক সংযোগের অভাব একসঙ্গে মানুষের জীবনকে একাকীত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। একসঙ্গে কাজ করে, পারিবারিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটিয়ে এবং সামাজিক সংযোগ বাড়িয়ে আমরা এই মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার সমাধান করতে পারি।

[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

back to top