alt

উপ-সম্পাদকীয়

কথার কথা যত কথা

গাজী তারেক আজিজ

: মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪

কথার প্রয়োজনীয়তা সর্বত্র। কথায় রাজ্য জয়। আবার কথায় সম্পর্কে ক্ষয়। কথায় কথা বাড়ে সম্পর্কের অবনতি হয়। বিশিষ্টজনদের কথা হচ্ছে, কথা যত গুরুত্বপূর্ণই হোক বেশি কথা গুরুত্ব হারায়। বলা হয়, ‘যত কথা তত দোষ, ভেবেচিন্তে কথা কোস’। এক্ষেত্রে সাদামাটা বিশ্লেষণ হচ্ছে কথা কম বললে দোষও কম বের হয়। আবার বহুল প্রচলিত প্রবাদে আছে- পা ফসকালে দিতে হয় দাঁত, মুখ ফসকালে দিতে হয় সোনা। এর বিশেষ কারণ হচ্ছে একটি কথার গুরুত্ব অনেক। কথার পিঠে কথা থেকে যায়। আবার গানও আছে- দিন যায় কথা থাকে। এই গানে ভবিষ্যতের ওপর তুলে রাখা হয় কথার আবদার কিছুটা অনুযোগে।

অনেকেই আছেন বাকপটু। কথায় কথায় মানুষের মন জয় করে ফেলেন। তারাও কালেভদ্রে কথার খেই হারিয়ে মাশুল দিয়েছেন ব্যক্তিজীবনে। আবার কেউ কেউ পেশাগত জীবনে। আর রাজনীতিবিদদের কথা না-ই বা বলা হলো। কথায় আছে বাংলাদেশের সবাই রাজনীতিবিদ। আবার সবাই বক্তা। কখনো কখনো দাবি উঠেছে রাজনীতির মঞ্চে বক্তার প্রদত্ত প্রতি দৈর্ঘ্যের হিসেবে চার্জ ধার্য করার। অনেক পেশা আছে কথা বলার। কারণে অকারণে কথা বলে মাতিয়ে তুলতে হয় প্রোগ্রাম। যেমন এংকর কিংবা উপস্থাপক, রেডিও জকি, হাল আমলের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মার্কেটিং প্রমোটারদের অনর্গল কথাকে অনেকাংশে বকবক কিংবা বকবকানি বলে থাকেন। এর মধ্যে রেডিও জকি প্রফেশনের শুরু হয় এফএম রেডিও চালু হওয়ার পর। এ এক নতুন ধাঁচ।

কথা বলার নতুন ঢঙ। কথা বলার নিজস্ব শৈলী। কে কত চমৎকারভাবে অনুষ্ঠান প্রাণবন্ত করা যায় চলতে থাকে কথার প্রতিযোগ। শ্রোতারা পরিচিত হন আরেক স্টাইলে বলা কথা শুনতে। স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক দ্রুতলয়ে চলতে থাকা এ কথার লড়াই একা একা বা নিজে নিজে কথা বলার বাগ্মিতা। যেন আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের সাথে কথা বলা। তবে রেডিও জকির কথা বলার সময় কে শুনছে কে শুনছে না সেদিকে খেয়াল না করেই যত কথার চল। যেন মেশিন দিয়ে খই ভাজার মতো। একে বলে কথার খই ফোটা।

প্রেমিক-প্রেমিকা যখন কথা বলে তখন আরেক কথার ফোঁড়ন কাটা। যেন কোথাও আটকায় না। কি কবিতা কি গান। কথার মাধুর্য তাদের নিয়ে যায় অজানা অচেনা এক স্বর্গীয় অনুভূতির জগতে। তখন মনে হতে থাকে আহ্ পৃথিবীটা কত সুন্দর। এ সময় কথা যেন ফুরোতে চায় না। সময় দ্রুতই গড়িয়ে যায়। এ সময় বড় অদ্ভুত!

তবে কথার আছে স্থান কাল পাত্র। অর্থাৎ যে কথা যে জায়গায় বলা যায়। কথায় আছে মানব সন্তান কথা বলা শিখে দুই বছর বয়স থেকে। আর কোথায় কি বলতে হয় সেটা শিখতে সারা জীবন লেগে যায়। তার মানে হচ্ছে কথা পরিমিত হওয়াই ভালো। ব্যক্তির কথা বলার পরিমিতিবোধ থাকা চাই। তা হচ্ছে শুরু যা-ই করেন না কেন, কোথায় থামতে হবে তা বুঝতে পারা জরুরি। যেমন সব কথা সকল জায়গায় বলা যায় না। এ বিষয়ে একটা প্রচলিত কৌতুক জানি, এক ইসলামী মাহফিলে বক্তা ওয়াজ শুরু করলেন, তিনি বলছেন, নারীর পরিধেয় বস্ত্র দিয়ে কাঁথা সেলাই করা জায়েজ নেই।

যথারীতি ওয়াজ শেষ হতে হতে রাতও অনেক হয়েছে দেখে বক্তাকে সবাই অনুরোধ করলেন থেকে যেতে। বক্তা থেকে যেতে সম্মত হন। ঘুমানোর প্রাক্কালে সেই বক্তা গায়ে পরার জন্য একটা কাঁথা চাইলেন। ঘরের লোকজন বললো হুজুর কাঁথাতে মহিলার কাপড় দিয়ে বানানো। হুজুর বললেন তাতে কোন সমস্যা নেই। তখন ঘরের লোকজন বললো কেন হুজুর, আপনি না ওয়াজে বললেন? তখন হুজুর বললেন, আরে ওইটা গরমের দিনের জন্য। শীতের দিনের জন্য প্রযোজ্য না। তখন সবাই খুশি হুজুর নিজের কথায় নিজেই ধরাশায়ী হলেন। তাই কথা বলার আগে ভেবেচিন্তে কথা বলাই সমীচীন যে, কথার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে।

আর এ কথার কথায় ঢের এগিয়ে থাকে রাজনীতিবিদ। যদিও তাদের রাজনীতিবিদ না বলে রাজনীতিজীবী বললেও অত্যুক্তি হয় না। কারণ বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ রাজনীতি নিয়ে নাক গলায়। এই নাক গলানো স্বভাব আবার সব জায়গায় সব বিষয়ে। রাজনীতিবিদরা মঞ্চে ওঠে বক্তৃতা নেয়ার সময় বুঝতে চান না শ্রোতার ধৈর্য। শ্রোতার ধৈর্যচ্যুতি ঘটলেও তারা হজম করাতে চান মূল্যহীন অতিকথন বাক্যসমষ্টি। এর থেকে খুব একটা পরিত্রাণ পাওয়াও সম্ভব হয়ে ওঠে না। একটা রাজনৈতিক কৌতুক শুনিÑ এক মঞ্চে ভাষণ দিয়েছেন উচ্চশিক্ষিত এক নেতা, তিনি বক্তব্য দেয়ার পর তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে সাংবাদিক সাহেব প্রশ্ন করেন, ওমুক সাহেব তো বলেছেন অমুক এলাকায় নৈশ স্কুল করে দেবেন। এই কথা শুনে কথার মর্মার্থ না বুঝেই স্বশিক্ষিত নেতা বলে ওঠেন সে যদি নয়শ’ স্কুল করে দেয় আমি তাহলে এগারোশ’ স্কুল করে দেব। তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় সাংবাদিক হাসি চেপে কোনরকম সটকে পড়েন। যদিও তখন ভাইরাল যুগ ছিল না। তথাপিও এ কথাটা ছড়িয়ে যায় সর্বত্র।

আবার আরেক স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির কৌতুক শুনুনÑ তিনি একদমই শিক্ষিত নন। তথাপিও টাকা থাকায় স্কুল এবং কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। যথারীতি একটা প্রোগ্রামে দেশের প্রধানমন্ত্রী আসলেন। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দাবি ছিল অনেকটা এই রকম- ম্যাডামের কাজ অইলো কলেজের সরকারি করে দেয়া আর আমার কাজ অইলো মাস্টারের বেতন দেয়া। এবার আসি বিচক্ষণ লোকের কথায়Ñ তারা সচরাচর কথাই বলতে চান না। যা-ও একটু আধটু বলেন তা-ও অর্ধেক মুখে অর্ধেক পেটে। অর্থাৎ তাদের কথার মর্ম বোঝা ভার।

আবার খারাপ লোকের কথা হচ্ছে অস্ত্র। কথায় কথায় গালাগাল করে। ভয়ে অন্যরা তটস্থ হয়ে থাকে। তাই তাদের সামনে কোন কথা বলা বা কোন কথার উত্তর প্রত্যুত্তরে ইজ্জত হারানোর শঙ্কা প্রকট। জ্ঞানী ব্যক্তির কথা ভুল হলেও মানুষ বিশ্বাস করে। ছাত্ররা যেমন পিতামাতার চেয়ে শিক্ষকের কথায় বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কথা যদি হয় গুজব কিংবা অসত্য বানোয়াট তাহলে সেই কথা বাতাসের বেগে ছোটে। সেই কথার প্রতিক্রিয়ায় সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়। সম্পর্কের অবনতি হয়। মানুষ সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার পর বুঝতে পারে তার বলা কথা অযৌক্তিক। কথা হচ্ছে বুলেটের মতো মুখ ফসকেও যদি বের হয় তা আর ফেরানোর সুযোগ থাকে না। আবার কথার রয়েছে বিষফোঁড়া। একটা কেউ বললে সেটা রূপান্তর ঘটিয়ে অন্যজনের কাছে বলে দেয়াকে বলে কানকথা লাগানো। এই কান কথা যে কত ভয়ংকর তা ভুক্তভোগী ছাড়া বোঝার সুযোগ খুব একটা নেই। অর্থাৎ কোন কারণ ছাড়াই দেখবেন আপনার ঘনিষ্ঠজন আপনার সাথে বিরূপ আচরণ করছে। কারণ এরই মধ্যে কেউ তাকে কেউ কানপড়া দিয়ে রেখেছে। তাই যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবেন দ্রুত কথা বলে সমাধান করুন। না হলে বিষফোঁড়া হয়ে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকবে।

তাই সম্পর্কের প্রতি যতœশীল হোন। যত্রতত্র কথা বলার অভ্যাস পরিহার করুন। কথার পরিমিতিবোধ রেখে মানুষের সাথে কথা বলুন। প্রয়োজন না হলে কথা না বলাই ভালো। অনেক কথা, কথা না বলেও বলা যায়। চোখে চোখে কিংবা বাচনভঙ্গিতে। অথবা চুপ থেকেও বলা যায় অনেককিছু। আর আপনার বলা কথা আদৌ কথা হচ্ছে কিনা সেটা বুঝবেন যার সাথে কথা বলছেন তার মনোযোগের ওপর। তার চোখ মুখ দেখেই বুঝতে পারবেন সে ব্যক্তি আপনার কথা কতটা গ্রহণ করছে আর কতটা করছে না। আদৌ সে আপনার কথায় বিরক্ত হচ্ছে কিনাÑ সেটা বুঝে কিংবা তার সময়ের গুরুত্ব বুঝেই কথা বলে আর সমস্যা হয় না। আসুন আমরা কথা বলা শিখি স্থান-কাল-পাত্র ভেদে।

[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]

বাংলার মৃৎশিল্প

প্রবারণা পূর্ণিমার আলোয় আলোকিত হোক মানবজাতি

খেলাপি ঋণের অপসংস্কৃতি

দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত হোক শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

সুইডেনের গণতন্ত্র

বিচ্ছিন্নতা ও একাকীত্ব : শহুরে জীবনধারার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

নতুন প্রেক্ষাপটে ‘চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড’ : স্বাধীনতা না প্রতিরোধ?

ধর্মীয় স্বাধীনতা ও কঠিন চীবরদান

ছবি

দুর্গাপূজার মর্মবাণী

মানুষ মূল্যস্ফীতি থেকে রক্ষা পাবে কীভাবে

গুজব ও মিথ্যা তথ্য : সমাজের এক ভয়াবহ ব্যাধি

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে দৃঢ় পদক্ষেপ প্রয়োজন

পুরাতত্ত্বের ধারায় সনাতনী সমাজের দুর্গাপূজা

জীবন-মৃত্যু কী?

নাসা : বিজ্ঞানের পীঠস্থান

শিক্ষা সংস্কারে প্রথাগত চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে

সাংঘাতিক ভাই, সাংঘাতিক...

প্রযুক্তির মায়াজালে বন্দি মানুষ

ছবি

এসএম সুলতান : সংস্কৃতি সত্তার সত্যপাঠ

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস

তরুণ সমাজ ও প্রযুক্তি নির্ভরতা : সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

বগুড়ার তাঁতপল্লী

অটিজম কোনো রোগ নয়

জনপ্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্যার সম্বোধন কি আইনসম্মত

দুর্বল ব্যাংকগুলোকে কতদিন সহায়তা দেয়া হবে?

বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য বয়সবৈষম্য দূর করুন

আসন্ন বোরো উৎপাদন ও কিছু শঙ্কা

ছবি

আইন পেশার জানা-অজানা কথা

ছবি

ব্যাংক খাতের সংকট

একাকিত্ব ও মানসিক অশান্তি

বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজ

ব্রি: কিছু প্রশ্ন, কিছু উত্তর

ক্রেতা ঠকে গেলে তার আইনগত প্রতিকার

ঢাকার যানজট : কিছু প্রস্তাব

রম্যগদ্য : দারিদ্র্য যাবে জাদুঘরে

গার্মেন্টস খাতে সংকট

tab

উপ-সম্পাদকীয়

কথার কথা যত কথা

গাজী তারেক আজিজ

মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪

কথার প্রয়োজনীয়তা সর্বত্র। কথায় রাজ্য জয়। আবার কথায় সম্পর্কে ক্ষয়। কথায় কথা বাড়ে সম্পর্কের অবনতি হয়। বিশিষ্টজনদের কথা হচ্ছে, কথা যত গুরুত্বপূর্ণই হোক বেশি কথা গুরুত্ব হারায়। বলা হয়, ‘যত কথা তত দোষ, ভেবেচিন্তে কথা কোস’। এক্ষেত্রে সাদামাটা বিশ্লেষণ হচ্ছে কথা কম বললে দোষও কম বের হয়। আবার বহুল প্রচলিত প্রবাদে আছে- পা ফসকালে দিতে হয় দাঁত, মুখ ফসকালে দিতে হয় সোনা। এর বিশেষ কারণ হচ্ছে একটি কথার গুরুত্ব অনেক। কথার পিঠে কথা থেকে যায়। আবার গানও আছে- দিন যায় কথা থাকে। এই গানে ভবিষ্যতের ওপর তুলে রাখা হয় কথার আবদার কিছুটা অনুযোগে।

অনেকেই আছেন বাকপটু। কথায় কথায় মানুষের মন জয় করে ফেলেন। তারাও কালেভদ্রে কথার খেই হারিয়ে মাশুল দিয়েছেন ব্যক্তিজীবনে। আবার কেউ কেউ পেশাগত জীবনে। আর রাজনীতিবিদদের কথা না-ই বা বলা হলো। কথায় আছে বাংলাদেশের সবাই রাজনীতিবিদ। আবার সবাই বক্তা। কখনো কখনো দাবি উঠেছে রাজনীতির মঞ্চে বক্তার প্রদত্ত প্রতি দৈর্ঘ্যের হিসেবে চার্জ ধার্য করার। অনেক পেশা আছে কথা বলার। কারণে অকারণে কথা বলে মাতিয়ে তুলতে হয় প্রোগ্রাম। যেমন এংকর কিংবা উপস্থাপক, রেডিও জকি, হাল আমলের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মার্কেটিং প্রমোটারদের অনর্গল কথাকে অনেকাংশে বকবক কিংবা বকবকানি বলে থাকেন। এর মধ্যে রেডিও জকি প্রফেশনের শুরু হয় এফএম রেডিও চালু হওয়ার পর। এ এক নতুন ধাঁচ।

কথা বলার নতুন ঢঙ। কথা বলার নিজস্ব শৈলী। কে কত চমৎকারভাবে অনুষ্ঠান প্রাণবন্ত করা যায় চলতে থাকে কথার প্রতিযোগ। শ্রোতারা পরিচিত হন আরেক স্টাইলে বলা কথা শুনতে। স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক দ্রুতলয়ে চলতে থাকা এ কথার লড়াই একা একা বা নিজে নিজে কথা বলার বাগ্মিতা। যেন আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের সাথে কথা বলা। তবে রেডিও জকির কথা বলার সময় কে শুনছে কে শুনছে না সেদিকে খেয়াল না করেই যত কথার চল। যেন মেশিন দিয়ে খই ভাজার মতো। একে বলে কথার খই ফোটা।

প্রেমিক-প্রেমিকা যখন কথা বলে তখন আরেক কথার ফোঁড়ন কাটা। যেন কোথাও আটকায় না। কি কবিতা কি গান। কথার মাধুর্য তাদের নিয়ে যায় অজানা অচেনা এক স্বর্গীয় অনুভূতির জগতে। তখন মনে হতে থাকে আহ্ পৃথিবীটা কত সুন্দর। এ সময় কথা যেন ফুরোতে চায় না। সময় দ্রুতই গড়িয়ে যায়। এ সময় বড় অদ্ভুত!

তবে কথার আছে স্থান কাল পাত্র। অর্থাৎ যে কথা যে জায়গায় বলা যায়। কথায় আছে মানব সন্তান কথা বলা শিখে দুই বছর বয়স থেকে। আর কোথায় কি বলতে হয় সেটা শিখতে সারা জীবন লেগে যায়। তার মানে হচ্ছে কথা পরিমিত হওয়াই ভালো। ব্যক্তির কথা বলার পরিমিতিবোধ থাকা চাই। তা হচ্ছে শুরু যা-ই করেন না কেন, কোথায় থামতে হবে তা বুঝতে পারা জরুরি। যেমন সব কথা সকল জায়গায় বলা যায় না। এ বিষয়ে একটা প্রচলিত কৌতুক জানি, এক ইসলামী মাহফিলে বক্তা ওয়াজ শুরু করলেন, তিনি বলছেন, নারীর পরিধেয় বস্ত্র দিয়ে কাঁথা সেলাই করা জায়েজ নেই।

যথারীতি ওয়াজ শেষ হতে হতে রাতও অনেক হয়েছে দেখে বক্তাকে সবাই অনুরোধ করলেন থেকে যেতে। বক্তা থেকে যেতে সম্মত হন। ঘুমানোর প্রাক্কালে সেই বক্তা গায়ে পরার জন্য একটা কাঁথা চাইলেন। ঘরের লোকজন বললো হুজুর কাঁথাতে মহিলার কাপড় দিয়ে বানানো। হুজুর বললেন তাতে কোন সমস্যা নেই। তখন ঘরের লোকজন বললো কেন হুজুর, আপনি না ওয়াজে বললেন? তখন হুজুর বললেন, আরে ওইটা গরমের দিনের জন্য। শীতের দিনের জন্য প্রযোজ্য না। তখন সবাই খুশি হুজুর নিজের কথায় নিজেই ধরাশায়ী হলেন। তাই কথা বলার আগে ভেবেচিন্তে কথা বলাই সমীচীন যে, কথার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে।

আর এ কথার কথায় ঢের এগিয়ে থাকে রাজনীতিবিদ। যদিও তাদের রাজনীতিবিদ না বলে রাজনীতিজীবী বললেও অত্যুক্তি হয় না। কারণ বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ রাজনীতি নিয়ে নাক গলায়। এই নাক গলানো স্বভাব আবার সব জায়গায় সব বিষয়ে। রাজনীতিবিদরা মঞ্চে ওঠে বক্তৃতা নেয়ার সময় বুঝতে চান না শ্রোতার ধৈর্য। শ্রোতার ধৈর্যচ্যুতি ঘটলেও তারা হজম করাতে চান মূল্যহীন অতিকথন বাক্যসমষ্টি। এর থেকে খুব একটা পরিত্রাণ পাওয়াও সম্ভব হয়ে ওঠে না। একটা রাজনৈতিক কৌতুক শুনিÑ এক মঞ্চে ভাষণ দিয়েছেন উচ্চশিক্ষিত এক নেতা, তিনি বক্তব্য দেয়ার পর তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে সাংবাদিক সাহেব প্রশ্ন করেন, ওমুক সাহেব তো বলেছেন অমুক এলাকায় নৈশ স্কুল করে দেবেন। এই কথা শুনে কথার মর্মার্থ না বুঝেই স্বশিক্ষিত নেতা বলে ওঠেন সে যদি নয়শ’ স্কুল করে দেয় আমি তাহলে এগারোশ’ স্কুল করে দেব। তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় সাংবাদিক হাসি চেপে কোনরকম সটকে পড়েন। যদিও তখন ভাইরাল যুগ ছিল না। তথাপিও এ কথাটা ছড়িয়ে যায় সর্বত্র।

আবার আরেক স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির কৌতুক শুনুনÑ তিনি একদমই শিক্ষিত নন। তথাপিও টাকা থাকায় স্কুল এবং কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। যথারীতি একটা প্রোগ্রামে দেশের প্রধানমন্ত্রী আসলেন। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দাবি ছিল অনেকটা এই রকম- ম্যাডামের কাজ অইলো কলেজের সরকারি করে দেয়া আর আমার কাজ অইলো মাস্টারের বেতন দেয়া। এবার আসি বিচক্ষণ লোকের কথায়Ñ তারা সচরাচর কথাই বলতে চান না। যা-ও একটু আধটু বলেন তা-ও অর্ধেক মুখে অর্ধেক পেটে। অর্থাৎ তাদের কথার মর্ম বোঝা ভার।

আবার খারাপ লোকের কথা হচ্ছে অস্ত্র। কথায় কথায় গালাগাল করে। ভয়ে অন্যরা তটস্থ হয়ে থাকে। তাই তাদের সামনে কোন কথা বলা বা কোন কথার উত্তর প্রত্যুত্তরে ইজ্জত হারানোর শঙ্কা প্রকট। জ্ঞানী ব্যক্তির কথা ভুল হলেও মানুষ বিশ্বাস করে। ছাত্ররা যেমন পিতামাতার চেয়ে শিক্ষকের কথায় বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কথা যদি হয় গুজব কিংবা অসত্য বানোয়াট তাহলে সেই কথা বাতাসের বেগে ছোটে। সেই কথার প্রতিক্রিয়ায় সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়। সম্পর্কের অবনতি হয়। মানুষ সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার পর বুঝতে পারে তার বলা কথা অযৌক্তিক। কথা হচ্ছে বুলেটের মতো মুখ ফসকেও যদি বের হয় তা আর ফেরানোর সুযোগ থাকে না। আবার কথার রয়েছে বিষফোঁড়া। একটা কেউ বললে সেটা রূপান্তর ঘটিয়ে অন্যজনের কাছে বলে দেয়াকে বলে কানকথা লাগানো। এই কান কথা যে কত ভয়ংকর তা ভুক্তভোগী ছাড়া বোঝার সুযোগ খুব একটা নেই। অর্থাৎ কোন কারণ ছাড়াই দেখবেন আপনার ঘনিষ্ঠজন আপনার সাথে বিরূপ আচরণ করছে। কারণ এরই মধ্যে কেউ তাকে কেউ কানপড়া দিয়ে রেখেছে। তাই যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবেন দ্রুত কথা বলে সমাধান করুন। না হলে বিষফোঁড়া হয়ে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকবে।

তাই সম্পর্কের প্রতি যতœশীল হোন। যত্রতত্র কথা বলার অভ্যাস পরিহার করুন। কথার পরিমিতিবোধ রেখে মানুষের সাথে কথা বলুন। প্রয়োজন না হলে কথা না বলাই ভালো। অনেক কথা, কথা না বলেও বলা যায়। চোখে চোখে কিংবা বাচনভঙ্গিতে। অথবা চুপ থেকেও বলা যায় অনেককিছু। আর আপনার বলা কথা আদৌ কথা হচ্ছে কিনা সেটা বুঝবেন যার সাথে কথা বলছেন তার মনোযোগের ওপর। তার চোখ মুখ দেখেই বুঝতে পারবেন সে ব্যক্তি আপনার কথা কতটা গ্রহণ করছে আর কতটা করছে না। আদৌ সে আপনার কথায় বিরক্ত হচ্ছে কিনাÑ সেটা বুঝে কিংবা তার সময়ের গুরুত্ব বুঝেই কথা বলে আর সমস্যা হয় না। আসুন আমরা কথা বলা শিখি স্থান-কাল-পাত্র ভেদে।

[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]

back to top