alt

উপ-সম্পাদকীয়

প্রশাসনিক সংস্কারে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা কতটা প্রতিষ্ঠা পাবে?

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

: বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৪

উনিশ শতাব্দী নাগাদ ইউরোপীয় দেশগুলোর রাষ্ট্র পরিচালনায় আমলাতন্ত্র বড় ভূমিকা নিতে শুরু করে। আমলাতন্ত্র বস্তুত আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অঙ্গ। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের স্থায়ী বা অরাজনৈতিক অংশই আমলাতন্ত্র বা সিভিল সার্ভিস নামে পরিচিত। গণতন্ত্রে নীতি-নির্ধারণ করেন রাজনৈতিক নেতারা এবং সেই নীতি বাস্তবায়ন করেন আমলারা বা প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। বিগত কয়েক দশক ধরেই সিভিল সার্ভিসের সংস্কার বিশ্বব্যাপী আলোচনার একটা গুরুত্বর্পূণ বিষয়বস্তু হয়ে আসছে। কোনো কোনো দেশের প্রশাসনিক সংস্কার দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের জনপ্রশাসন ব্যবস্থায় গুরুতপূর্ণ প্রভাবও সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। বিগত শতাব্দীতে আমলাতন্ত্ররে পরিসরও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিশ্বের সবচেয়ে পুরাতন আমলাতান্ত্রিক দেশ ব্রিটেনে সরকারি র্কমর্কতা-র্কমচারী সংখ্যা প্রায় ৭.৫ লাখে উন্নীত হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের তিনটি পর্যায়ে ১৮০৮ সালে মোট র্কমর্কতা-র্কমচারীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১২৬ জন, ১৯৭০ সালে তা ১২ লাখে উন্নীত হয়। ভারতে ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ সালে সরকারি র্কমচারীদের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩৯.৪৫ লাখ ও ৪০.১২ লাখ। ভারতবর্ষের আমলাতন্ত্র সম্পর্কে মিশ্র ধারণা বিদ্যমান রয়েছে। কেউ কেউ এর মধ্যে সমাধানের তুলনায় সমস্যাই বেশি দেখতে পান। একদিকে তাদের সংখ্যা অনেক বেশি, অন্যদিকে তারা বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাবত ট্যাক্সদাতাদের কাছ থেকে যে অর্থ গ্রহণ করেন প্রতিদানে তার সমপরিমাণ সেবা প্রদান করেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের কাজের পদ্ধতি জটিল, তারা অদক্ষ; তাদের দুর্নীতি এতই ব্যাপক যে, তা সার্বজনীনতা প্রতিষ্ঠার হুমকি সৃষ্টি করেছে।

১৯৯৭ সালে প্রকাশিত ভারতের পঞ্চম বেতন কমিশনের রিপোর্টে এই অভিযোগগুলো করা হয়েছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, একটি বেতন কমিশনের কাজ শুধু সরকারি কর্মচারী বেতন স্কেলে প্রদানের সুপারিশ প্রদান করাই নয়, এই কমিশন প্রশাসনিক সংস্কারের ব্যাপারে গুরুত্বর্পূণ সুপারশিও পেশ করে থাকে। আমলাতন্ত্ররে অবয়ব হ্রাস করা ভারতীয় বেতন কমিশনের অন্যতম সুপারিশ ছিল। ভারত, পাকিস্তান কিংবা ব্রিটিশ কলোনিভুক্ত সাবেক দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র বা সিভিল সার্ভিসের প্রসার ও ব্যাপ্তি দ্রুত ও ব্যাপক। তাদের সেবার মানও অনেক নীচু। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট অনুযায়ী আমাদের আমলাতন্ত্রের ভিত্তি হিসেবে পরিচিত ১ম শ্রেণীর র্কমর্কতারাই হচ্ছেন সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের মানুষ তাদের কাছ থেকে সেবার পরিবর্তে শোষণের হাতিয়ারই হন বেশি।

১৯৭২ সালে স্বাধীনতার অব্যবহিত পর আমাদের আমলাতন্ত্রের আকার ছিল ৪৫৪৪৫০ জন র্কমর্কতা-র্কমচারী নিয়ে গঠিত। ১৯৮২ সালে তা ৭৭৯০০০, ১৯৯২ সালে ৯৪৬৭৪৯ এবং ১৯৯৮ সালে ১০৪৫৪৪৭ জনে উন্নীত হয়। বর্তমানে আমাদের আমলাতন্ত্রের সদস্য সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১২ লাখ। সরকারি আধাসরকারি ও কর্পোরেশেনগুলো ধরলে এ সংখ্যা প্রায় ১৮ লাখ হবে। আমাদের মোট, জাতীয় বাজেটের প্রায় ১৫% এদের পেছনে ব্যয় হয়। এরা কি কাজ করেন জনগণ তা জানেন না। তবে তাদের অধিকাংশ যে ঘুষ ছাড়া কাজ করেন না এবং ট্যাক্সদাতাদের জুলুম করেন এটা সর্বজনবিদিত।

একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্রের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক এবং একে সেবামুখী ও অধিকতর কার্যকর ও ব্যয়সাশ্রয়ী করার জন্য সম্ভবত পাকিস্তান আমল থেকেই (যেমন কর্নেলিয়াস রিপোর্ট) প্রচেষ্টা চলে আসছিল। তারই ধারাবাহিকতায় জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন কিছু কাজ করেছে এবং জনবল যৌক্তিকীকরণের জন্য সুপারশিও পেশ করেছে। এই সুপারিশসমূহের অংশবিশেষ বিভিন্ন পত্রপত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হয়েছে। এই সুপারিশ সব যে মেনে নেয়ার মতো তা নয়। তবে জনগণের দুর্দশা লাঘব এবং সরকারি সেবা তাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থাকে সহজ ও ত্বরান্বিত করার পদক্ষেপ হিসেবে আমলাতন্ত্রের কাঠামো পুনর্গঠন জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে হয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পদোন্নতি দিয়ে এমন অবস্থায় সৃষ্টি করা হয়েছে যে, এখন কর্মকর্তাদের বসার স্থানও নেই। পদোন্নতি দেয়ার জন্য কাজ ছাড়া অতিরিক্ত পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে তাদের সন্তুষ্ট রেখে সরকার বারবার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য শুধু প্রমোশন নয়, তাদের বেতন-ভাতাও পাঁচগুণের বেশি বৃদ্ধি করা হয়েছে। আমলারা এখন মানুষের সেবক নয়, সরকারের সেবাদাসে পরণিত হয়েছে। এ অবস্থার আমূল সংস্কার প্রয়োজন।

প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশন সংস্কার একে অন্যের পরিপূরক। যেহেতু পাবলিক সার্ভিস কমিশন একটি প্রতিষ্ঠিত সাংবিধানিক কাঠামোগত কমিশন বিধায় প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনকে এই পরিকাঠামের আওতায় অঙ্গীভূত করে একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের রূপরেখা দিয়ে দাঁড় করানো যেতে পারে অথবা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাউন্সিল গঠন করে এই কাউন্সিলের আওতায় প্রশাসনিক ও প্রশিক্ষণ সংস্কার কমিশন নামে একটি আলাদা কমিশন গঠন করা যেতে পারে। অধিকন্তু প্রশিক্ষণ প্রশাসনের আওতায় প্রশাসন কমিশনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের সংস্কার কাজ চলমান রাখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ওই কাউন্সিলের নাম হতে পারে জাতীয় প্রশাসনিক ও প্রশিক্ষণ কাউন্সিল। যদিও আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রে জাতীয় প্রশিক্ষণ কাউন্সিল নামের একটি সাইনবোর্ড সর্বস্ব কাউন্সিল আছে; কিন্তু এ কাউন্সিলের কোন কার্যকারিতা নেই।

যাই হোক, প্রশাসনিক এই কমিশনকে কাজ করতে হবে। মোটামুটিভাবে পাবলিক সার্ভিস কমিশন, শিক্ষা কমিশন, নির্বাচন কমিশন বিগত দিনে সংস্কারের যে পদক্ষেপ নিয়েছে তাতে কমিশনগুলো কোন কৃতিত্বের স্মারক প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। কমিশনের ভালো-মন্দ দিকগুলোকে বিবেচনায় আনতে হবে। নতুন করে কোন ট্রায়াল-এ্যারর ম্যাথড বা প্রজেক্ট দিয়ে শুধুমাত্র সময়ক্ষেপণ হবে। তবে বিগত দিনের কর্মকৌশল বর্তমান ও একবিংশ শতাব্দীর সামনের দিনগুলোর জন্য সময় উপযোগী প্রশাসনিক সংস্কারের একটি রূপরেখা তৈরি হতে পারে। নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের চাকরি-পূর্ব প্রশিক্ষণের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। প্রশিক্ষণ শেষে চাকরিতে প্রবেশ করলে নতুন চাকরিপ্রাপ্তদের প্রবেশন পিরিয়ড দীর্ঘ করতে হবে। এ সময় তাদের যোগ্যতা ও সততা গোপনভাবে পরীক্ষা করা যেতে পারে। এ কাজে প্রয়োজনে স্টিং অপারেশনের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। প্রশাসক জনগণকে সেবা প্রদানের কাজে গুরুত্ব কমিয়ে নিজের উন্নয়নে যাতে কাজ না করতে পারেন, তার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে।

প্রশাসনের সকল স্তরে সৎ, যোগ্য ও মেধাবী আমলাদের যথোপযুক্ত স্থানে বসিয়ে পেশাদারিত্ব ও কর্তব্যনিষ্ঠাকে প্রাধান্য দিয়ে একটি জনবান্ধব ও স্বচ্ছ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তী সরকারকে এখনই যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই ঘুষ, দুর্নীতি যেমন কমে যাবে, তেমনি সরকারের পক্ষেও জনগণের প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব হতে পারে। উপনিবেশিক প্রশাসন ও আমলাতন্ত্র সামাজিক বৈষম্যের জন্য দায়ী- এ কথা নির্জলা সত্য। তবে প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্গঠন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হলেও এ সরকার প্রশাসনিক সংস্কারে সামাজিক বৈষম্যের আবসান ঘটাতে সক্ষম হবে।

পরিশেষে স্থানীয় প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা মাথায় রেখে দুটি অ্যাপ্রোচ যথাক্রমে নিউ প্যাবলিক ম্যানেজমেন্ট (এনপিএম) ও নিউ প্যাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এনপিএ) সমন্বয়ে দেশে ব্যবসা-অনুকূল ও স্ব-বান্ধব একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়া তোলার এখনই সময়। এক্ষেত্রে দৃঢ় রাজনতৈকি অঙ্গীকারের অভাব হলেও এ সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতায় মৌলিক সংস্কার অনেকটাই সম্ভব। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে তার গৃহীত পদক্ষেপ ও নীতিমালায় সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা পাবে এবং তা নিশ্চিত হবে।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

ছবি

শেকড়ের সন্ধানে সাঁইজির ধামে

বৈষম্যের অন্ধকারে নিমজ্জিত প্রকৌশল শিক্ষার আরেক জগৎ

বাংলার মৃৎশিল্প

প্রবারণা পূর্ণিমার আলোয় আলোকিত হোক মানবজাতি

খেলাপি ঋণের অপসংস্কৃতি

কথার কথা যত কথা

দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত হোক শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

সুইডেনের গণতন্ত্র

বিচ্ছিন্নতা ও একাকীত্ব : শহুরে জীবনধারার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

নতুন প্রেক্ষাপটে ‘চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড’ : স্বাধীনতা না প্রতিরোধ?

ধর্মীয় স্বাধীনতা ও কঠিন চীবরদান

ছবি

দুর্গাপূজার মর্মবাণী

মানুষ মূল্যস্ফীতি থেকে রক্ষা পাবে কীভাবে

গুজব ও মিথ্যা তথ্য : সমাজের এক ভয়াবহ ব্যাধি

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে দৃঢ় পদক্ষেপ প্রয়োজন

পুরাতত্ত্বের ধারায় সনাতনী সমাজের দুর্গাপূজা

জীবন-মৃত্যু কী?

নাসা : বিজ্ঞানের পীঠস্থান

শিক্ষা সংস্কারে প্রথাগত চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে

সাংঘাতিক ভাই, সাংঘাতিক...

প্রযুক্তির মায়াজালে বন্দি মানুষ

ছবি

এসএম সুলতান : সংস্কৃতি সত্তার সত্যপাঠ

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস

তরুণ সমাজ ও প্রযুক্তি নির্ভরতা : সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

বগুড়ার তাঁতপল্লী

অটিজম কোনো রোগ নয়

জনপ্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্যার সম্বোধন কি আইনসম্মত

দুর্বল ব্যাংকগুলোকে কতদিন সহায়তা দেয়া হবে?

বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য বয়সবৈষম্য দূর করুন

আসন্ন বোরো উৎপাদন ও কিছু শঙ্কা

ছবি

আইন পেশার জানা-অজানা কথা

ছবি

ব্যাংক খাতের সংকট

একাকিত্ব ও মানসিক অশান্তি

বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজ

ব্রি: কিছু প্রশ্ন, কিছু উত্তর

ক্রেতা ঠকে গেলে তার আইনগত প্রতিকার

tab

উপ-সম্পাদকীয়

প্রশাসনিক সংস্কারে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা কতটা প্রতিষ্ঠা পাবে?

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৪

উনিশ শতাব্দী নাগাদ ইউরোপীয় দেশগুলোর রাষ্ট্র পরিচালনায় আমলাতন্ত্র বড় ভূমিকা নিতে শুরু করে। আমলাতন্ত্র বস্তুত আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অঙ্গ। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের স্থায়ী বা অরাজনৈতিক অংশই আমলাতন্ত্র বা সিভিল সার্ভিস নামে পরিচিত। গণতন্ত্রে নীতি-নির্ধারণ করেন রাজনৈতিক নেতারা এবং সেই নীতি বাস্তবায়ন করেন আমলারা বা প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। বিগত কয়েক দশক ধরেই সিভিল সার্ভিসের সংস্কার বিশ্বব্যাপী আলোচনার একটা গুরুত্বর্পূণ বিষয়বস্তু হয়ে আসছে। কোনো কোনো দেশের প্রশাসনিক সংস্কার দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের জনপ্রশাসন ব্যবস্থায় গুরুতপূর্ণ প্রভাবও সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। বিগত শতাব্দীতে আমলাতন্ত্ররে পরিসরও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিশ্বের সবচেয়ে পুরাতন আমলাতান্ত্রিক দেশ ব্রিটেনে সরকারি র্কমর্কতা-র্কমচারী সংখ্যা প্রায় ৭.৫ লাখে উন্নীত হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের তিনটি পর্যায়ে ১৮০৮ সালে মোট র্কমর্কতা-র্কমচারীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১২৬ জন, ১৯৭০ সালে তা ১২ লাখে উন্নীত হয়। ভারতে ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ সালে সরকারি র্কমচারীদের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩৯.৪৫ লাখ ও ৪০.১২ লাখ। ভারতবর্ষের আমলাতন্ত্র সম্পর্কে মিশ্র ধারণা বিদ্যমান রয়েছে। কেউ কেউ এর মধ্যে সমাধানের তুলনায় সমস্যাই বেশি দেখতে পান। একদিকে তাদের সংখ্যা অনেক বেশি, অন্যদিকে তারা বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাবত ট্যাক্সদাতাদের কাছ থেকে যে অর্থ গ্রহণ করেন প্রতিদানে তার সমপরিমাণ সেবা প্রদান করেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের কাজের পদ্ধতি জটিল, তারা অদক্ষ; তাদের দুর্নীতি এতই ব্যাপক যে, তা সার্বজনীনতা প্রতিষ্ঠার হুমকি সৃষ্টি করেছে।

১৯৯৭ সালে প্রকাশিত ভারতের পঞ্চম বেতন কমিশনের রিপোর্টে এই অভিযোগগুলো করা হয়েছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, একটি বেতন কমিশনের কাজ শুধু সরকারি কর্মচারী বেতন স্কেলে প্রদানের সুপারিশ প্রদান করাই নয়, এই কমিশন প্রশাসনিক সংস্কারের ব্যাপারে গুরুত্বর্পূণ সুপারশিও পেশ করে থাকে। আমলাতন্ত্ররে অবয়ব হ্রাস করা ভারতীয় বেতন কমিশনের অন্যতম সুপারিশ ছিল। ভারত, পাকিস্তান কিংবা ব্রিটিশ কলোনিভুক্ত সাবেক দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র বা সিভিল সার্ভিসের প্রসার ও ব্যাপ্তি দ্রুত ও ব্যাপক। তাদের সেবার মানও অনেক নীচু। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট অনুযায়ী আমাদের আমলাতন্ত্রের ভিত্তি হিসেবে পরিচিত ১ম শ্রেণীর র্কমর্কতারাই হচ্ছেন সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের মানুষ তাদের কাছ থেকে সেবার পরিবর্তে শোষণের হাতিয়ারই হন বেশি।

১৯৭২ সালে স্বাধীনতার অব্যবহিত পর আমাদের আমলাতন্ত্রের আকার ছিল ৪৫৪৪৫০ জন র্কমর্কতা-র্কমচারী নিয়ে গঠিত। ১৯৮২ সালে তা ৭৭৯০০০, ১৯৯২ সালে ৯৪৬৭৪৯ এবং ১৯৯৮ সালে ১০৪৫৪৪৭ জনে উন্নীত হয়। বর্তমানে আমাদের আমলাতন্ত্রের সদস্য সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১২ লাখ। সরকারি আধাসরকারি ও কর্পোরেশেনগুলো ধরলে এ সংখ্যা প্রায় ১৮ লাখ হবে। আমাদের মোট, জাতীয় বাজেটের প্রায় ১৫% এদের পেছনে ব্যয় হয়। এরা কি কাজ করেন জনগণ তা জানেন না। তবে তাদের অধিকাংশ যে ঘুষ ছাড়া কাজ করেন না এবং ট্যাক্সদাতাদের জুলুম করেন এটা সর্বজনবিদিত।

একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্রের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক এবং একে সেবামুখী ও অধিকতর কার্যকর ও ব্যয়সাশ্রয়ী করার জন্য সম্ভবত পাকিস্তান আমল থেকেই (যেমন কর্নেলিয়াস রিপোর্ট) প্রচেষ্টা চলে আসছিল। তারই ধারাবাহিকতায় জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন কিছু কাজ করেছে এবং জনবল যৌক্তিকীকরণের জন্য সুপারশিও পেশ করেছে। এই সুপারিশসমূহের অংশবিশেষ বিভিন্ন পত্রপত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হয়েছে। এই সুপারিশ সব যে মেনে নেয়ার মতো তা নয়। তবে জনগণের দুর্দশা লাঘব এবং সরকারি সেবা তাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থাকে সহজ ও ত্বরান্বিত করার পদক্ষেপ হিসেবে আমলাতন্ত্রের কাঠামো পুনর্গঠন জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে হয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পদোন্নতি দিয়ে এমন অবস্থায় সৃষ্টি করা হয়েছে যে, এখন কর্মকর্তাদের বসার স্থানও নেই। পদোন্নতি দেয়ার জন্য কাজ ছাড়া অতিরিক্ত পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে তাদের সন্তুষ্ট রেখে সরকার বারবার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য শুধু প্রমোশন নয়, তাদের বেতন-ভাতাও পাঁচগুণের বেশি বৃদ্ধি করা হয়েছে। আমলারা এখন মানুষের সেবক নয়, সরকারের সেবাদাসে পরণিত হয়েছে। এ অবস্থার আমূল সংস্কার প্রয়োজন।

প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশন সংস্কার একে অন্যের পরিপূরক। যেহেতু পাবলিক সার্ভিস কমিশন একটি প্রতিষ্ঠিত সাংবিধানিক কাঠামোগত কমিশন বিধায় প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনকে এই পরিকাঠামের আওতায় অঙ্গীভূত করে একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের রূপরেখা দিয়ে দাঁড় করানো যেতে পারে অথবা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাউন্সিল গঠন করে এই কাউন্সিলের আওতায় প্রশাসনিক ও প্রশিক্ষণ সংস্কার কমিশন নামে একটি আলাদা কমিশন গঠন করা যেতে পারে। অধিকন্তু প্রশিক্ষণ প্রশাসনের আওতায় প্রশাসন কমিশনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের সংস্কার কাজ চলমান রাখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ওই কাউন্সিলের নাম হতে পারে জাতীয় প্রশাসনিক ও প্রশিক্ষণ কাউন্সিল। যদিও আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রে জাতীয় প্রশিক্ষণ কাউন্সিল নামের একটি সাইনবোর্ড সর্বস্ব কাউন্সিল আছে; কিন্তু এ কাউন্সিলের কোন কার্যকারিতা নেই।

যাই হোক, প্রশাসনিক এই কমিশনকে কাজ করতে হবে। মোটামুটিভাবে পাবলিক সার্ভিস কমিশন, শিক্ষা কমিশন, নির্বাচন কমিশন বিগত দিনে সংস্কারের যে পদক্ষেপ নিয়েছে তাতে কমিশনগুলো কোন কৃতিত্বের স্মারক প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। কমিশনের ভালো-মন্দ দিকগুলোকে বিবেচনায় আনতে হবে। নতুন করে কোন ট্রায়াল-এ্যারর ম্যাথড বা প্রজেক্ট দিয়ে শুধুমাত্র সময়ক্ষেপণ হবে। তবে বিগত দিনের কর্মকৌশল বর্তমান ও একবিংশ শতাব্দীর সামনের দিনগুলোর জন্য সময় উপযোগী প্রশাসনিক সংস্কারের একটি রূপরেখা তৈরি হতে পারে। নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের চাকরি-পূর্ব প্রশিক্ষণের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। প্রশিক্ষণ শেষে চাকরিতে প্রবেশ করলে নতুন চাকরিপ্রাপ্তদের প্রবেশন পিরিয়ড দীর্ঘ করতে হবে। এ সময় তাদের যোগ্যতা ও সততা গোপনভাবে পরীক্ষা করা যেতে পারে। এ কাজে প্রয়োজনে স্টিং অপারেশনের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। প্রশাসক জনগণকে সেবা প্রদানের কাজে গুরুত্ব কমিয়ে নিজের উন্নয়নে যাতে কাজ না করতে পারেন, তার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে।

প্রশাসনের সকল স্তরে সৎ, যোগ্য ও মেধাবী আমলাদের যথোপযুক্ত স্থানে বসিয়ে পেশাদারিত্ব ও কর্তব্যনিষ্ঠাকে প্রাধান্য দিয়ে একটি জনবান্ধব ও স্বচ্ছ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তী সরকারকে এখনই যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই ঘুষ, দুর্নীতি যেমন কমে যাবে, তেমনি সরকারের পক্ষেও জনগণের প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব হতে পারে। উপনিবেশিক প্রশাসন ও আমলাতন্ত্র সামাজিক বৈষম্যের জন্য দায়ী- এ কথা নির্জলা সত্য। তবে প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্গঠন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হলেও এ সরকার প্রশাসনিক সংস্কারে সামাজিক বৈষম্যের আবসান ঘটাতে সক্ষম হবে।

পরিশেষে স্থানীয় প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা মাথায় রেখে দুটি অ্যাপ্রোচ যথাক্রমে নিউ প্যাবলিক ম্যানেজমেন্ট (এনপিএম) ও নিউ প্যাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এনপিএ) সমন্বয়ে দেশে ব্যবসা-অনুকূল ও স্ব-বান্ধব একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়া তোলার এখনই সময়। এক্ষেত্রে দৃঢ় রাজনতৈকি অঙ্গীকারের অভাব হলেও এ সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতায় মৌলিক সংস্কার অনেকটাই সম্ভব। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে তার গৃহীত পদক্ষেপ ও নীতিমালায় সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা পাবে এবং তা নিশ্চিত হবে।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

back to top