alt

উপ-সম্পাদকীয়

বৈষম্যের অন্ধকারে নিমজ্জিত প্রকৌশল শিক্ষার আরেক জগৎ

সাঈদ ফয়সাল

: বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৪

ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ নামক প্রতিষ্ঠানগুলোর সমস্যা তৈরির মূল কারিগর যেই সংস্থা, তা হলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ এই কারিগরি অধিদপ্তরের অনিয়ম, দুর্নীতি ও পিছিয়ে রাখা মনোভাব বেশ পুরনো। তাদের অনিয়ম দুর্নীতির কারণেই বছরের পর বছর বৈষম্যের শিকার হয়ে অনেক আন্দোলন ও প্রতিবাদের পর বাংলাদেশের প্রাথমিক সময়ের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলো (পরবর্তীতে বিআইটি) আজকের রুয়েট, কুয়েট, চুয়েট, ডুয়েটে রূপান্তরিত হয়েছিল।

বর্তমানেও কারিগরি অধিদপ্তরের অধীনে রয়েছে সব পলিটেকনিক, মনোটেকনিক ও বাংলাদেশের সরকারি ৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিশেষায়িত কলেজগুলোই সবচেয়ে বেশি সমস্যা, জটিলতা কিংবা বৈষম্যের শিকার হয়; যা ইতোপূর্বে দেখেছে এ দেশের মানুষ।

দেশে বর্তমানে সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ সংখ্যা ৪টি এবং প্রস্তাবিত রয়েছে আরো ৪টি।

চার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ অনেক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অভিন্ন শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালার আলোকে মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যর্থতা। এই নিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগে বাংলাদেশ কর্ম কমিশন ও কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতা।

ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোতে অধ্যক্ষ পদ সৃষ্ট করার পর এই পদের উচ্চতর বেতন স্কেল অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমমান এই পদে ইউজিসির অভিন্ন ধারায় যেই ধরনের প্রতিষ্ঠানপ্রধান নিয়োগের বিধিমালা রয়েছে, সেই অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানপ্রধান নিয়োগ দিতে ব্যর্থ হয়েছে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর।

এখন পর্যন্ত মানসম্পন্ন একজন স্থায়ী অধ্যক্ষ নিয়োগ দিতে পারেনি বরং অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে যাদের অধ্যক্ষের পদে দেয়া হয়েছে তারা এর সমমানের পর্যায়েরও নয়। এমনকি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটপ্রধানকেও এসব কলেজে অতিরিক্ত দায়িত্বে অধ্যক্ষ হিসেবে বসিয়েছে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর; যা অযোগ্যতার স্পষ্ট দৃষ্টান্ত।

বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকা। গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সাত কলেজের প্রতিটি বিভাগে পর্যাপ্ত অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক বিদ্যমান, সেখানে এসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিএসসি ইন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো সত্ত্বেও ৪টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে মাত্র দুজন অধ্যাপক রয়েছেন। এমনকি দুটি কলেজের প্রতিষ্ঠানপ্রধান হলেন সহকারী অধ্যাপক। এখানেই পরিলক্ষিত হচ্ছে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর নিয়োগ ব্যর্থতা।

একটি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চতর ও গবেষণাধর্মী শিক্ষার পরিবেশ পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিত করতে যেই ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক আয়তন দরকার, সেই অনুযায়ী যথেষ্ঠ ভূমি এসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে নেই। এজন্য বারংবার দাবি জানিয়ে আসলেও প্রতিষ্ঠার এত বছরেও কলেজের জন্য নতুন করে ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেনি। এক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের উদাসীনতা স্পষ্ট।

বিভাগ সংখ্যা বৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত উন্নয়নে সম্পূর্ণ রূপে ব্যর্থ কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর।

শহর এবং হাসপাতাল দূরে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও কোনো পরিবহন ব্যবস্থা ও অ্যাম্বুল্যান্স না থাকা। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য কোনো মেডিকেল সেন্টার না থাকা। হাতে-কলমে প্রকৌশল শিক্ষার জন্য ল্যাব ইক্যুইপমেন্টের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু প্রতিষ্ঠার এত বছর পরও পুরাতন সব ইক্যুইপমেন্ট দিয়েই ল্যাব করতে হয় যার অধিকাংশই বর্তমানে অকেজো। ফলে বিভাগগুলোতে পর্যাপ্ত আধুনিক ল্যাব ইক্যুইপমেন্ট না থাকায় হাতে-কলমে মানসম্পন্ন শিক্ষা থেকে পিছিয়ে থাকা।

প্রকৌশল শিক্ষা মানেই গবেষণাধর্মী শিক্ষা। এরজন্য গবেষণা উপযোগী যে ধরনের পরিবেশ এবং অর্থের জোগান দেয়া দরকার, গবেষণার জন্য সে অর্থের ন্যূনতম জোগান দিতেও ব্যর্থ কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর, যা আমাদের গুণগত উচ্চশিক্ষা অর্জনের প্রধান অন্তরায়। ফলে উচ্চতর শিক্ষা ও চাকরির বাজারে বুয়েট, কুয়েট, চুয়েট, রুয়েট, ডুয়েটের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সমানতালে প্রতিযোগিতা হলেও শিক্ষা ও গবেষণার সুবিধার দিক থেকে যোজন যোজন পিছিয়ে রাখা।

দক্ষ ও টেকনিক্যাল ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরের নিয়োগে রয়েছে জটিলতা, যা আমাদের গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যাহত করছে। ফলে যেসব ল্যাব ইক্যুইপমেন্ট রয়েছে, সেগুলোও সঠিকভাবে অপারেট করার মতো ইন্সট্রাক্টর না থাকা।

সমস্যা, সংকট ও বৈষম্য নিরসনের দাবি আজকের নতুন নয়। কারিগরি অধিদপ্তরের ইচ্ছাকৃত অবহেলার কারণে সৃষ্ট এসব সমস্যা, সংকট ও বৈষম্য নিরসনের জন্য ৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মধ্যে সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ২০১৪, ২০১৫, ২০১৭, ২০১৮, ২০২০ সালসহ দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করার আন্দোলন ও দাবি জানিয়ে আসছে। এমনকি প্রতিষ্ঠার পর প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের কথা থাকলেও ভিন্ন সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠা হওয়ায় শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে এই ২টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়নি। সর্বশেষ ২০২২, ২০১৩, ২০১৮ সালে একাধিকবার জনগণের দাবির মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেট ও ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার কথা বলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করেনি।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থার নানাবিদ জটিল, ব্যাপক ও গুরুতর সমস্যা নিরসনের জন্য ১৯৭৪ সালের মে মাসে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট- মুহাম্মদ কুদরত-ই-খুদা’- এর ১৪নং অধ্যায়ে ১০৪নং পৃষ্ঠায় ‘ঙ’ নং অনুচ্ছেদে তৎকালীন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজসমূহের সমস্যা নিরসন ও কারিগরি অধিদপ্তরের অযোগ্যতার সমাধান প্রসঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে, ‘প্রকৌশল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষার মান উন্নীত করার জন্য আশু ব্যবস্থা অবলম্বন করা প্রয়োজন। প্রকৌশল কলেজগুলোতে সাজসরঞ্জাম এবং উপর্যুক্ত শিক্ষকের অভাব রয়েছে। বর্তমান প্রশাসনিক ব্যবস্থায় শিক্ষক ও অন্যান্য কর্মচারী নিয়োগ, সাজসরঞ্জাম ক্রয় ইত্যাদি ব্যাপারে কলেজগুলো বিশেষ অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে। তাই আমরা মনে করি যে, এ কলেজগুলোকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা দরকার।’

পাশাপাশি এই ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হলে পরিণাম হিসেবে পরবর্তী পয়েন্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘প্রকৌশল ও স্থাপত্য শিক্ষার ক্ষেত্রে সৃজনশীলতার উন্মেষ ঘটাতে না পারলে তা পরিণামে বন্ধ্যত্ব লাভ করে।’

একই দাবি একই অধ্যায়ে ১০৭নং পৃষ্ঠার ৭ম পয়েন্টে বলা হয়েছে ‘প্রকৌশল কলেজগুলো এবং কারিগরি শিক্ষক-শিক্ষণ কলেজের ব্যবস্থাপনা এবং শিক্ষার মান উন্নীত করা একান্ত প্রয়োজন। এ উদ্দেশ্যে কলেজগুলোকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা দরকার।’

অথচ আজ থেকে ৫০ বছর আগেও যেই সমস্যা তুলে ধরা হয়েছিল, সেই একই সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আছে বর্তমান ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং কারিগরি অধিদপ্তরের অধীনস্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু ৫০ বছর আগেই তৎকালীন শিক্ষানুরাগী শিক্ষাবিদরা এই সংকট ও সমস্যা নিরসনের যেই সমাধান তুলে ধরেছিলেন, সেই সমাধান তৎকালীন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোর ক্ষেত্রে বিকল্প সমাধানের বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট প্রয়োগ করে সবশেষে সেই একমাত্র সমাধান তথা বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের মাধ্যমেই নিরসন হয়েছে। কিন্তু ৫০ বছর আগেই সমাধানের রূপরেখা দেয়া হলেও, বারবার এক্সপেরিমেন্টাল টেস্ট করে অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয় করা হলেও, আজ এত বছর পর একই সমস্যায় জর্জরিত থাকা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোর ব্যাপারে চিন্তা চেতনায় সেই ৫০ বছর আগের শিক্ষাবিদদের থেকেও পিছিয়ে আছি। তাই চোখের সামনে দৃষ্টান্ত থাকা সত্ত্বেও আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলো আজও পর্যন্ত নানা টালবাহানার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় হয়নি, কারিগরি অধিদপ্তরের এই অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে বের হতে পারেনি।

[লেখক : শিক্ষার্থী, বিএসসি ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং (ফাইনাল ইয়ার), ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ]

ছবি

শেকড়ের সন্ধানে সাঁইজির ধামে

প্রশাসনিক সংস্কারে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা কতটা প্রতিষ্ঠা পাবে?

বাংলার মৃৎশিল্প

প্রবারণা পূর্ণিমার আলোয় আলোকিত হোক মানবজাতি

খেলাপি ঋণের অপসংস্কৃতি

কথার কথা যত কথা

দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত হোক শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

সুইডেনের গণতন্ত্র

বিচ্ছিন্নতা ও একাকীত্ব : শহুরে জীবনধারার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

নতুন প্রেক্ষাপটে ‘চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড’ : স্বাধীনতা না প্রতিরোধ?

ধর্মীয় স্বাধীনতা ও কঠিন চীবরদান

ছবি

দুর্গাপূজার মর্মবাণী

মানুষ মূল্যস্ফীতি থেকে রক্ষা পাবে কীভাবে

গুজব ও মিথ্যা তথ্য : সমাজের এক ভয়াবহ ব্যাধি

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে দৃঢ় পদক্ষেপ প্রয়োজন

পুরাতত্ত্বের ধারায় সনাতনী সমাজের দুর্গাপূজা

জীবন-মৃত্যু কী?

নাসা : বিজ্ঞানের পীঠস্থান

শিক্ষা সংস্কারে প্রথাগত চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে

সাংঘাতিক ভাই, সাংঘাতিক...

প্রযুক্তির মায়াজালে বন্দি মানুষ

ছবি

এসএম সুলতান : সংস্কৃতি সত্তার সত্যপাঠ

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস

তরুণ সমাজ ও প্রযুক্তি নির্ভরতা : সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

বগুড়ার তাঁতপল্লী

অটিজম কোনো রোগ নয়

জনপ্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্যার সম্বোধন কি আইনসম্মত

দুর্বল ব্যাংকগুলোকে কতদিন সহায়তা দেয়া হবে?

বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য বয়সবৈষম্য দূর করুন

আসন্ন বোরো উৎপাদন ও কিছু শঙ্কা

ছবি

আইন পেশার জানা-অজানা কথা

ছবি

ব্যাংক খাতের সংকট

একাকিত্ব ও মানসিক অশান্তি

বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজ

ব্রি: কিছু প্রশ্ন, কিছু উত্তর

ক্রেতা ঠকে গেলে তার আইনগত প্রতিকার

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বৈষম্যের অন্ধকারে নিমজ্জিত প্রকৌশল শিক্ষার আরেক জগৎ

সাঈদ ফয়সাল

বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৪

ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ নামক প্রতিষ্ঠানগুলোর সমস্যা তৈরির মূল কারিগর যেই সংস্থা, তা হলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ এই কারিগরি অধিদপ্তরের অনিয়ম, দুর্নীতি ও পিছিয়ে রাখা মনোভাব বেশ পুরনো। তাদের অনিয়ম দুর্নীতির কারণেই বছরের পর বছর বৈষম্যের শিকার হয়ে অনেক আন্দোলন ও প্রতিবাদের পর বাংলাদেশের প্রাথমিক সময়ের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলো (পরবর্তীতে বিআইটি) আজকের রুয়েট, কুয়েট, চুয়েট, ডুয়েটে রূপান্তরিত হয়েছিল।

বর্তমানেও কারিগরি অধিদপ্তরের অধীনে রয়েছে সব পলিটেকনিক, মনোটেকনিক ও বাংলাদেশের সরকারি ৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিশেষায়িত কলেজগুলোই সবচেয়ে বেশি সমস্যা, জটিলতা কিংবা বৈষম্যের শিকার হয়; যা ইতোপূর্বে দেখেছে এ দেশের মানুষ।

দেশে বর্তমানে সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ সংখ্যা ৪টি এবং প্রস্তাবিত রয়েছে আরো ৪টি।

চার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ অনেক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অভিন্ন শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালার আলোকে মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যর্থতা। এই নিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগে বাংলাদেশ কর্ম কমিশন ও কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতা।

ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোতে অধ্যক্ষ পদ সৃষ্ট করার পর এই পদের উচ্চতর বেতন স্কেল অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমমান এই পদে ইউজিসির অভিন্ন ধারায় যেই ধরনের প্রতিষ্ঠানপ্রধান নিয়োগের বিধিমালা রয়েছে, সেই অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানপ্রধান নিয়োগ দিতে ব্যর্থ হয়েছে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর।

এখন পর্যন্ত মানসম্পন্ন একজন স্থায়ী অধ্যক্ষ নিয়োগ দিতে পারেনি বরং অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে যাদের অধ্যক্ষের পদে দেয়া হয়েছে তারা এর সমমানের পর্যায়েরও নয়। এমনকি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটপ্রধানকেও এসব কলেজে অতিরিক্ত দায়িত্বে অধ্যক্ষ হিসেবে বসিয়েছে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর; যা অযোগ্যতার স্পষ্ট দৃষ্টান্ত।

বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকা। গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সাত কলেজের প্রতিটি বিভাগে পর্যাপ্ত অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক বিদ্যমান, সেখানে এসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিএসসি ইন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো সত্ত্বেও ৪টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে মাত্র দুজন অধ্যাপক রয়েছেন। এমনকি দুটি কলেজের প্রতিষ্ঠানপ্রধান হলেন সহকারী অধ্যাপক। এখানেই পরিলক্ষিত হচ্ছে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর নিয়োগ ব্যর্থতা।

একটি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চতর ও গবেষণাধর্মী শিক্ষার পরিবেশ পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিত করতে যেই ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক আয়তন দরকার, সেই অনুযায়ী যথেষ্ঠ ভূমি এসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে নেই। এজন্য বারংবার দাবি জানিয়ে আসলেও প্রতিষ্ঠার এত বছরেও কলেজের জন্য নতুন করে ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেনি। এক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের উদাসীনতা স্পষ্ট।

বিভাগ সংখ্যা বৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত উন্নয়নে সম্পূর্ণ রূপে ব্যর্থ কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর।

শহর এবং হাসপাতাল দূরে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও কোনো পরিবহন ব্যবস্থা ও অ্যাম্বুল্যান্স না থাকা। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য কোনো মেডিকেল সেন্টার না থাকা। হাতে-কলমে প্রকৌশল শিক্ষার জন্য ল্যাব ইক্যুইপমেন্টের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু প্রতিষ্ঠার এত বছর পরও পুরাতন সব ইক্যুইপমেন্ট দিয়েই ল্যাব করতে হয় যার অধিকাংশই বর্তমানে অকেজো। ফলে বিভাগগুলোতে পর্যাপ্ত আধুনিক ল্যাব ইক্যুইপমেন্ট না থাকায় হাতে-কলমে মানসম্পন্ন শিক্ষা থেকে পিছিয়ে থাকা।

প্রকৌশল শিক্ষা মানেই গবেষণাধর্মী শিক্ষা। এরজন্য গবেষণা উপযোগী যে ধরনের পরিবেশ এবং অর্থের জোগান দেয়া দরকার, গবেষণার জন্য সে অর্থের ন্যূনতম জোগান দিতেও ব্যর্থ কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর, যা আমাদের গুণগত উচ্চশিক্ষা অর্জনের প্রধান অন্তরায়। ফলে উচ্চতর শিক্ষা ও চাকরির বাজারে বুয়েট, কুয়েট, চুয়েট, রুয়েট, ডুয়েটের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সমানতালে প্রতিযোগিতা হলেও শিক্ষা ও গবেষণার সুবিধার দিক থেকে যোজন যোজন পিছিয়ে রাখা।

দক্ষ ও টেকনিক্যাল ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরের নিয়োগে রয়েছে জটিলতা, যা আমাদের গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যাহত করছে। ফলে যেসব ল্যাব ইক্যুইপমেন্ট রয়েছে, সেগুলোও সঠিকভাবে অপারেট করার মতো ইন্সট্রাক্টর না থাকা।

সমস্যা, সংকট ও বৈষম্য নিরসনের দাবি আজকের নতুন নয়। কারিগরি অধিদপ্তরের ইচ্ছাকৃত অবহেলার কারণে সৃষ্ট এসব সমস্যা, সংকট ও বৈষম্য নিরসনের জন্য ৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মধ্যে সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ২০১৪, ২০১৫, ২০১৭, ২০১৮, ২০২০ সালসহ দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করার আন্দোলন ও দাবি জানিয়ে আসছে। এমনকি প্রতিষ্ঠার পর প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের কথা থাকলেও ভিন্ন সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠা হওয়ায় শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে এই ২টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়নি। সর্বশেষ ২০২২, ২০১৩, ২০১৮ সালে একাধিকবার জনগণের দাবির মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেট ও ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার কথা বলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করেনি।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থার নানাবিদ জটিল, ব্যাপক ও গুরুতর সমস্যা নিরসনের জন্য ১৯৭৪ সালের মে মাসে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট- মুহাম্মদ কুদরত-ই-খুদা’- এর ১৪নং অধ্যায়ে ১০৪নং পৃষ্ঠায় ‘ঙ’ নং অনুচ্ছেদে তৎকালীন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজসমূহের সমস্যা নিরসন ও কারিগরি অধিদপ্তরের অযোগ্যতার সমাধান প্রসঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে, ‘প্রকৌশল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষার মান উন্নীত করার জন্য আশু ব্যবস্থা অবলম্বন করা প্রয়োজন। প্রকৌশল কলেজগুলোতে সাজসরঞ্জাম এবং উপর্যুক্ত শিক্ষকের অভাব রয়েছে। বর্তমান প্রশাসনিক ব্যবস্থায় শিক্ষক ও অন্যান্য কর্মচারী নিয়োগ, সাজসরঞ্জাম ক্রয় ইত্যাদি ব্যাপারে কলেজগুলো বিশেষ অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে। তাই আমরা মনে করি যে, এ কলেজগুলোকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা দরকার।’

পাশাপাশি এই ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হলে পরিণাম হিসেবে পরবর্তী পয়েন্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘প্রকৌশল ও স্থাপত্য শিক্ষার ক্ষেত্রে সৃজনশীলতার উন্মেষ ঘটাতে না পারলে তা পরিণামে বন্ধ্যত্ব লাভ করে।’

একই দাবি একই অধ্যায়ে ১০৭নং পৃষ্ঠার ৭ম পয়েন্টে বলা হয়েছে ‘প্রকৌশল কলেজগুলো এবং কারিগরি শিক্ষক-শিক্ষণ কলেজের ব্যবস্থাপনা এবং শিক্ষার মান উন্নীত করা একান্ত প্রয়োজন। এ উদ্দেশ্যে কলেজগুলোকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা দরকার।’

অথচ আজ থেকে ৫০ বছর আগেও যেই সমস্যা তুলে ধরা হয়েছিল, সেই একই সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আছে বর্তমান ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং কারিগরি অধিদপ্তরের অধীনস্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু ৫০ বছর আগেই তৎকালীন শিক্ষানুরাগী শিক্ষাবিদরা এই সংকট ও সমস্যা নিরসনের যেই সমাধান তুলে ধরেছিলেন, সেই সমাধান তৎকালীন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোর ক্ষেত্রে বিকল্প সমাধানের বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট প্রয়োগ করে সবশেষে সেই একমাত্র সমাধান তথা বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের মাধ্যমেই নিরসন হয়েছে। কিন্তু ৫০ বছর আগেই সমাধানের রূপরেখা দেয়া হলেও, বারবার এক্সপেরিমেন্টাল টেস্ট করে অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয় করা হলেও, আজ এত বছর পর একই সমস্যায় জর্জরিত থাকা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোর ব্যাপারে চিন্তা চেতনায় সেই ৫০ বছর আগের শিক্ষাবিদদের থেকেও পিছিয়ে আছি। তাই চোখের সামনে দৃষ্টান্ত থাকা সত্ত্বেও আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলো আজও পর্যন্ত নানা টালবাহানার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় হয়নি, কারিগরি অধিদপ্তরের এই অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে বের হতে পারেনি।

[লেখক : শিক্ষার্থী, বিএসসি ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং (ফাইনাল ইয়ার), ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ]

back to top