alt

উপ-সম্পাদকীয়

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির ভূমিকা

আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার

: শনিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৪

বর্তমান সময়ে জলবায়ু পরিবর্তন এক অভূতপূর্ব বৈশ্বিক সংকট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এ সংকটের ফলে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ, অর্থনীতি ও সমাজের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, খরা, বন্যা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ঝড়ের সংখ্যা বৃদ্ধির মতো ঘটনা এখন প্রায় নিত্যদিনের বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব পরিস্থিতি মোকাবিলায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে বিশ্ব আজ ঝুঁকছে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারের ফলে যে পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হচ্ছে, তা জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত। তাই নবায়নযোগ্য জ্বালানি বা রিনিউয়েবল এনার্জি এই সংকট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানি বলতে বোঝায় এমন জ্বালানি যা প্রকৃতি থেকে অবিরামভাবে প্রাপ্ত এবং এর উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পরিবেশের ক্ষতি হয় না। সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জলবিদ্যুৎ, জিওথার্মাল শক্তি এবং বায়োমাস থেকে উৎপাদিত শক্তি নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্তর্ভুক্ত। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করলে কার্বন নিঃসরণ কমানো, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করা এবং একটি টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব। আসুন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ভূমিকা কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কাজ করছে, তা বিশদভাবে আলোচনা করি।

জীবাশ্ম জ্বালানি, যেমনÑ তেল, গ্যাস এবং কয়লার ব্যবহার থেকে বিপুল পরিমাণ কার্বন-ডাই অক্সাইড এবং অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়, যা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণ ৯০ শতাংশ হ্রাস করার একটি লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে, যা নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমেই সম্ভব। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার (আইইএ) তথ্যমতে, ২০২১ সালে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার করে প্রায় ১০ দশমিক ৩ গিগাটন কার্বন-ডাই অক্সাইড নিঃসরণ রোধ করা সম্ভব হয়েছে। বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি একটি প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯৮০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা ৮২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা এবং দাবানল সবচেয়ে বেশি। এসব দুর্যোগের প্রধান কারণ হলো বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, যা কার্বন নিঃসরণ এবং গ্রিনহাউস গ্যাসের ফলে ঘটছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার উষ্ণায়নের গতি কমিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা হ্রাস করতে পারে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রায় ৭০ শতাংশ জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করলে এই ধরনের দুর্যোগের সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, বায়ুশক্তি এবং সৌরশক্তির ব্যবহার বাড়ালে কার্বন নিঃসরণ কমানো যাবে এবং ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

জীবাশ্ম জ্বালানি, সীমিত সম্পদ। তেল, গ্যাস ও কয়লা একসময় শেষ হয়ে যাবে এবং সেসময় বিশ্ববাসীকে জ্বালানির বিকল্প খুঁজতে বাধ্য হতে হবে। অন্যদিকে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি অফুরন্ত এবং সহজলভ্য। সুতরাং, টেকসই উন্নয়নের জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানি অপরিহার্য। বিশ্বের অনেক দেশ টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের ওপর জোর দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ২০৫০ সালের মধ্যে তার জ্বালানির ৫০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের পরিকল্পনা করেছে। এর মাধ্যমে তারা পরিবেশবান্ধব শক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। এছাড়া অনেক উন্নত দেশ বায়ুশক্তি, সৌরশক্তি এবং জলবিদ্যুতের মাধ্যমে তাদের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাচ্ছে, যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। বিশ্বব্যাপী জীবাশ্ম জ্বালানির মজুদ দিন দিন কমছে এবং এর ফলে জ্বালানি সংকট তৈরি হচ্ছে। বিপরীতে, নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস সীমাহীন এবং এটি জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকর। বাংলাদেশে সৌরশক্তি এবং বায়ুশক্তির সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল।

২০২০ সালে বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে প্রায় ৫ দশমিক ৮ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে, যার মধ্যে বেশির ভাগ সৌরশক্তি থেকে এসেছে। দেশের ২০৩০ সালের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, বিদ্যুতের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে। এতে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমবে।

বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৭ মিলিয়ন মানুষ মারা যাচ্ছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হল জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার থেকে সৃষ্ট দূষণ। বায়ুদূষণ মানুষের শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা, হৃদরোগ এবং ক্যান্সারের মতো রোগ সৃষ্টি করে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার এই বায়ুদূষণ হ্রাস করতে পারে এবং জনস্বাস্থ্য রক্ষা করতে সহায়ক হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিওএইচও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসেবা খরচ বছরে প্রায় ৪ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার কমাতে পারে। নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে জনস্বাস্থ্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির বিকাশের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানে সাহায্য করবে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহের একটি কার্যকর উপায়। বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুৎ গ্রামীণ উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে প্রায় ৬ মিলিয়ন মানুষ সৌরবিদ্যুতের সুবিধা পাচ্ছে, যা দেশের বিদ্যুৎ গ্রিডের বাইরে বসবাসকারী জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ। সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থানীয় উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের ফলে এসব অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা সহজ হচ্ছে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছে।

নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে বৈশ্বিক কর্মসংস্থান দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২২ সালে নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে প্রায় ১২ মিলিয়ন মানুষ কাজ করেছে, যা ২০৩০ সালের মধ্যে ৩৮ মিলিয়নে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশেও নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। সৌরশক্তি খাতে ইতোমধ্যে প্রায় ১ লাখ কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে গবেষণা ও উদ্ভাবন বিশ্বব্যাপী বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ কমছে এবং কার্যকারিতা বাড়ছে। ২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সৌরশক্তির উৎপাদন খরচ প্রায় ৮৫ শতাংশ কমে এসেছে। নবায়নযোগ্য শক্তির উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন ত্বরান্বিত হলে এটি জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা হ্রাস করবে এবং বিশ্বব্যাপী বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তির ক্ষেত্রে সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল। বিশেষ করে সৌরশক্তি ও বায়ুশক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে সৌরশক্তির মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে, যা দেশের প্রায় ৫ শতাংশ মানুষের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করছে। এছাড়া নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে দেশের বায়ুদূষণ কমানো, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় নবায়নযোগ্য শক্তির ভূমিকা অনস্বীকার্য। নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা কমানো, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা করা সম্ভব। বিশ্বব্যাপী নবায়নযোগ্য শক্তির ওপর জোর দেয়া হচ্ছে এবং বাংলাদেশও এই খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করছে। ভবিষ্যতে একটি টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসার অপরিহার্য।

[লেখক : ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ; অধ্যাপক, পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি]

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে করণীয়

শিক্ষা খাতে দলীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব

কোন পথে জামায়াতের রাজনীতি?

শ্রমিকের উন্নয়ন ছাড়া গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব নয়

ডিমের জারিজুরি

যোগ্য নেতৃত্ব সমাজ-সংগঠনকে এগিয়ে নেয়

ব্যক্তি স্বাধীনতার সংকট

কিল মারার গোঁসাই

ছবি

শেকড়ের সন্ধানে সাঁইজির ধামে

বৈষম্যের অন্ধকারে নিমজ্জিত প্রকৌশল শিক্ষার আরেক জগৎ

প্রশাসনিক সংস্কারে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা কতটা প্রতিষ্ঠা পাবে?

বাংলার মৃৎশিল্প

প্রবারণা পূর্ণিমার আলোয় আলোকিত হোক মানবজাতি

খেলাপি ঋণের অপসংস্কৃতি

কথার কথা যত কথা

দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত হোক শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

সুইডেনের গণতন্ত্র

বিচ্ছিন্নতা ও একাকীত্ব : শহুরে জীবনধারার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

নতুন প্রেক্ষাপটে ‘চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড’ : স্বাধীনতা না প্রতিরোধ?

ধর্মীয় স্বাধীনতা ও কঠিন চীবরদান

ছবি

দুর্গাপূজার মর্মবাণী

মানুষ মূল্যস্ফীতি থেকে রক্ষা পাবে কীভাবে

গুজব ও মিথ্যা তথ্য : সমাজের এক ভয়াবহ ব্যাধি

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে দৃঢ় পদক্ষেপ প্রয়োজন

পুরাতত্ত্বের ধারায় সনাতনী সমাজের দুর্গাপূজা

জীবন-মৃত্যু কী?

নাসা : বিজ্ঞানের পীঠস্থান

শিক্ষা সংস্কারে প্রথাগত চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে

সাংঘাতিক ভাই, সাংঘাতিক...

প্রযুক্তির মায়াজালে বন্দি মানুষ

ছবি

এসএম সুলতান : সংস্কৃতি সত্তার সত্যপাঠ

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস

তরুণ সমাজ ও প্রযুক্তি নির্ভরতা : সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

বগুড়ার তাঁতপল্লী

অটিজম কোনো রোগ নয়

জনপ্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্যার সম্বোধন কি আইনসম্মত

tab

উপ-সম্পাদকীয়

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির ভূমিকা

আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার

শনিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৪

বর্তমান সময়ে জলবায়ু পরিবর্তন এক অভূতপূর্ব বৈশ্বিক সংকট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এ সংকটের ফলে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ, অর্থনীতি ও সমাজের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, খরা, বন্যা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ঝড়ের সংখ্যা বৃদ্ধির মতো ঘটনা এখন প্রায় নিত্যদিনের বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব পরিস্থিতি মোকাবিলায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে বিশ্ব আজ ঝুঁকছে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারের ফলে যে পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হচ্ছে, তা জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত। তাই নবায়নযোগ্য জ্বালানি বা রিনিউয়েবল এনার্জি এই সংকট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানি বলতে বোঝায় এমন জ্বালানি যা প্রকৃতি থেকে অবিরামভাবে প্রাপ্ত এবং এর উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পরিবেশের ক্ষতি হয় না। সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জলবিদ্যুৎ, জিওথার্মাল শক্তি এবং বায়োমাস থেকে উৎপাদিত শক্তি নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্তর্ভুক্ত। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করলে কার্বন নিঃসরণ কমানো, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করা এবং একটি টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব। আসুন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ভূমিকা কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কাজ করছে, তা বিশদভাবে আলোচনা করি।

জীবাশ্ম জ্বালানি, যেমনÑ তেল, গ্যাস এবং কয়লার ব্যবহার থেকে বিপুল পরিমাণ কার্বন-ডাই অক্সাইড এবং অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়, যা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণ ৯০ শতাংশ হ্রাস করার একটি লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে, যা নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমেই সম্ভব। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার (আইইএ) তথ্যমতে, ২০২১ সালে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার করে প্রায় ১০ দশমিক ৩ গিগাটন কার্বন-ডাই অক্সাইড নিঃসরণ রোধ করা সম্ভব হয়েছে। বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি একটি প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯৮০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা ৮২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা এবং দাবানল সবচেয়ে বেশি। এসব দুর্যোগের প্রধান কারণ হলো বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, যা কার্বন নিঃসরণ এবং গ্রিনহাউস গ্যাসের ফলে ঘটছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার উষ্ণায়নের গতি কমিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা হ্রাস করতে পারে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রায় ৭০ শতাংশ জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করলে এই ধরনের দুর্যোগের সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, বায়ুশক্তি এবং সৌরশক্তির ব্যবহার বাড়ালে কার্বন নিঃসরণ কমানো যাবে এবং ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

জীবাশ্ম জ্বালানি, সীমিত সম্পদ। তেল, গ্যাস ও কয়লা একসময় শেষ হয়ে যাবে এবং সেসময় বিশ্ববাসীকে জ্বালানির বিকল্প খুঁজতে বাধ্য হতে হবে। অন্যদিকে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি অফুরন্ত এবং সহজলভ্য। সুতরাং, টেকসই উন্নয়নের জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানি অপরিহার্য। বিশ্বের অনেক দেশ টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের ওপর জোর দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ২০৫০ সালের মধ্যে তার জ্বালানির ৫০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের পরিকল্পনা করেছে। এর মাধ্যমে তারা পরিবেশবান্ধব শক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। এছাড়া অনেক উন্নত দেশ বায়ুশক্তি, সৌরশক্তি এবং জলবিদ্যুতের মাধ্যমে তাদের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাচ্ছে, যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। বিশ্বব্যাপী জীবাশ্ম জ্বালানির মজুদ দিন দিন কমছে এবং এর ফলে জ্বালানি সংকট তৈরি হচ্ছে। বিপরীতে, নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস সীমাহীন এবং এটি জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকর। বাংলাদেশে সৌরশক্তি এবং বায়ুশক্তির সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল।

২০২০ সালে বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে প্রায় ৫ দশমিক ৮ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে, যার মধ্যে বেশির ভাগ সৌরশক্তি থেকে এসেছে। দেশের ২০৩০ সালের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, বিদ্যুতের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে। এতে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমবে।

বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৭ মিলিয়ন মানুষ মারা যাচ্ছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হল জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার থেকে সৃষ্ট দূষণ। বায়ুদূষণ মানুষের শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা, হৃদরোগ এবং ক্যান্সারের মতো রোগ সৃষ্টি করে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার এই বায়ুদূষণ হ্রাস করতে পারে এবং জনস্বাস্থ্য রক্ষা করতে সহায়ক হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিওএইচও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসেবা খরচ বছরে প্রায় ৪ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার কমাতে পারে। নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে জনস্বাস্থ্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির বিকাশের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানে সাহায্য করবে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহের একটি কার্যকর উপায়। বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুৎ গ্রামীণ উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে প্রায় ৬ মিলিয়ন মানুষ সৌরবিদ্যুতের সুবিধা পাচ্ছে, যা দেশের বিদ্যুৎ গ্রিডের বাইরে বসবাসকারী জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ। সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থানীয় উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের ফলে এসব অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা সহজ হচ্ছে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছে।

নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে বৈশ্বিক কর্মসংস্থান দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২২ সালে নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে প্রায় ১২ মিলিয়ন মানুষ কাজ করেছে, যা ২০৩০ সালের মধ্যে ৩৮ মিলিয়নে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশেও নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। সৌরশক্তি খাতে ইতোমধ্যে প্রায় ১ লাখ কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে গবেষণা ও উদ্ভাবন বিশ্বব্যাপী বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ কমছে এবং কার্যকারিতা বাড়ছে। ২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সৌরশক্তির উৎপাদন খরচ প্রায় ৮৫ শতাংশ কমে এসেছে। নবায়নযোগ্য শক্তির উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন ত্বরান্বিত হলে এটি জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা হ্রাস করবে এবং বিশ্বব্যাপী বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তির ক্ষেত্রে সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল। বিশেষ করে সৌরশক্তি ও বায়ুশক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে সৌরশক্তির মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে, যা দেশের প্রায় ৫ শতাংশ মানুষের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করছে। এছাড়া নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে দেশের বায়ুদূষণ কমানো, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় নবায়নযোগ্য শক্তির ভূমিকা অনস্বীকার্য। নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা কমানো, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা করা সম্ভব। বিশ্বব্যাপী নবায়নযোগ্য শক্তির ওপর জোর দেয়া হচ্ছে এবং বাংলাদেশও এই খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করছে। ভবিষ্যতে একটি টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসার অপরিহার্য।

[লেখক : ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ; অধ্যাপক, পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি]

back to top