alt

উপ-সম্পাদকীয়

শিক্ষাকে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করার উপায়

মাহরুফ চৌধুরী

: বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪

বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে নানা সমস্যার মূলে আছে শিক্ষার রাজনীতিকীকরণের প্রত্যক্ষ নেতিবাচক প্রভাব। আগের দুটো লেখাতে আমরা শিক্ষা খাতে দলীয় রাজনীতির উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রভাবের নানাদিক নিয়ে আলোচনা করেছি। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর বর্তমান প্রবণতা যে জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে, সেখান থেকে সংস্কারের মাধ্যমে বেরিয়ে আসা খুব একটা সহজ কাজ হবে বলে মনে হয় না। দুর্বৃত্তায়ণের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি দেশে দীর্ঘদিন ধরে চালু আছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চার অভাব ও বিভিন্ন দলের কিছু কিছু নেতা কর্মীদের বর্তমান আচার-আচরণের আলামত দেখে প্রচলিত রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি থেকে অতিসহজে বেরিয়ে আসা যাবে ভাবাটা হবে আমাদের অবাস্তব প্রত্যাশা। কিন্তু তাই বলে আমাদের আশা ছেড়ে দিলে চলবে না; অব্যাহত প্রচেষ্টা চালাতে হবে শিক্ষাকে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করতে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে হাজার হাজার মানুষের রক্তদান আর শত শত শহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে যে সুযোগ জাতির হাতে এসেছে সেটাকে হাতছাড়া করা নেহায়েত বোকমি ছাড়া আর কিছু নয়। বর্তমান এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টিতে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের পাশাপাশি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। সে যাই হোক, আমাদের সদ্বিচ্ছা থাকলে শিক্ষা খাতে দলীয় রাজনীতির সক্রিয় প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসা অসম্ভব কিছুও নয়। কিছু কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে আমরা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে শিক্ষার পরিবেশকে সুস্থ ও উন্নত করে গড়ে তুলতে শিক্ষার মান উন্নয়নে মাধ্যমে ‘বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত’ কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠন করতে পারি। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রাথমিকভাবে নিচের উদ্যোগগুলো গ্রহণ করা গেলে দলীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব থেকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কিছুটা হলেও মুক্ত করা সম্ভব।

১. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো সামাজিক প্রতিষ্ঠান। সমাজের প্রয়োজন পূরণ ও সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই হলো এপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ। সমাজের সামগ্রিক ও সার্বিক কল্যাণে কাজ করতে এদের স্বাধীনভাবে কাজ করা তথা স্বায়ত্তশাসন প্রয়োজন। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা গেলে দলীয় রাজনীতির প্রভাব কিছুটা হলেও কমিয়ে আনা সম্ভব। একদিকে স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ পেলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে তাদের নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতে পারবে। ফলে জাতীয় রাজনীতি বা দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে। অপরদিকে বৈষম্য দূর করে সমতা ফিরিয়ে আনতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিয়োগ, নীতিমালা প্রণয়ন, এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে সক্ষম হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে, যেখানে কোন দল বা ব্যক্তির রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ থাকবে না। বিশেষ করে প্রশাসনিক নিয়োগ এবং নীতিমালা প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক বিবেচনার বাইরে থেকে যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একটি কার্যকর স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গতিশীলতা বৃদ্ধি ও শিক্ষার গুণগত মান উন্নত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

২. গোষ্ঠিস্বার্থে ছাত্ররাজনীতিকে নানাভাবে ব্যবহারের ফলে শব্দের অর্থের অপচিতির মাধ্যমে ‘ছাত্ররাজনীতি’র এক সংকীর্ণ ধারণায় আমরা উপনীত হয়েছি। বর্তমান আলাপ-আলোচনা ও সংলাপে এসংকীর্ণ ধারণা থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে এসে ছাত্ররাজনীতির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, ধরন ও পরিধি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরকে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করা জরুরি হয়ে পড়েছে। ছাত্ররাজনীতির মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবিগুলো আদায়ে আলোচনা-পর্যালোচনা ও সংলাপের মাধ্যমে জনমত গঠন ও সেগুলো আর্জনে কর্তৃপক্ষের উপর চাপপ্রয়োগ করা। ছাত্ররাজনীতির লক্ষ্য হবে শিক্ষার্থীদের নিজেদের সুশিক্ষার স্বার্থে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ও শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে সংঘশক্তিকে কাজে লাগানো। আর ছাত্ররাজনীতির ধরন হবে জাতীয় উন্নয়নের রাজনীতির সপক্ষে দলীয় রাজনীতির প্রভাব বলয়ের বাইরে থেকে স্বাধীন চিন্তাশক্তির বিকাশ ও প্রকাশের জন্যে শিক্ষার্থীদের দ্বারা গঠিত, শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত ও শিক্ষার্থীদের স্বার্থে কাজ করা সংঘশক্তি। ছাত্ররাজনীতির পরিধিটা সীমিত থাকা উচিত তাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের পরিমন্ডলে ও স্থানীয় পর্যায়ে যদি সেটা তাদের পড়ালেখায় প্রভাব ফেলে বা জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজন পড়ে। আর জাতীয় দুর্দিনেই কেবল তারা জাতীয় পর্যায়ে সম্পৃক্ত হবে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন আভ্যন্তরীণ নীতিমালা ও প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকা-ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দলীয় রাজনীতির কুপ্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন করার কলাকৌশল অবলম্বন করে ছাত্ররাজনীতির নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক কল্যাণমুখী ছাত্ররাজনীতির নানা কর্মকা-ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক অগ্রগতির সাথে সাথে তাদের মাঝে রাষ্ট্রের দর্শনের ভিত্তিতে জাতীয় মূল্যবোধ গড়ে তোলা এবং তাদেরকে নৈতিক দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষাপ্রদানের পাশাপাশি ব্যক্তিক ও সামষ্টিক উন্নয়নের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। রাজনৈতিক সহিংসতা পরিহার এবং দলীয় স্বার্থের বাইরে এসে দেশের প্রতিটি নাগরিকের মানবিক অধিকার নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজন সমতা, সততা, এবং জাতীয় স্বার্থে কাজ করার শিক্ষা নেয়া। জাতীয় পর্যায়ের দলগুলোর রাজনৈতিক আদর্শ ও উদ্দেশ্যের তলফিবাহক না হয়ে ছাত্রসংগঠনগুলোকে শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিম-লে একাডেমিক ও সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করতে হবে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা স্তরে প্রচলিত বর্তমান ছাত্ররাজনীতি নিয়ন্ত্রণ ও শিক্ষার পরিবেশ উন্নয়ন ব্যতিত শিক্ষাসংস্কারের কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যাবে না। তাই ছাত্ররাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব দূর করতে প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ, রাজনৈতিক সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি করা। ছাত্রসংগঠনগুলোকে সহিংসতা ও ক্ষমতার লড়াইয়ের বদলে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ও সামাজিক উন্নয়নে উৎসাহিত করতে হবে। এ বিষয়ে সরকার, দেশের সব রাজনৈতিক দল এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একযোগে কাজ করা প্রয়োজন।

৩. পেশাগত নীতি ও নৈতিক দায় থেকে কোন পেশার লোকজনই কোনরকম দলীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারে না। দলীয় পক্ষপাতিত্ব পেশাজীবীকে পেশাগত নিরপেক্ষতা বজায় রাখার পরিপন্থি। তাই পেশাজীবী হিসেবে শিক্ষকদের রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটা করে সেল গঠন করে তার মাধ্যম নজরদারি করে শিক্ষকদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নির্মূল করতে হবে। তাদের শিক্ষাদান ও গবেষণার দায়িত্বের প্রতি আরও বেশি করে মনোনিবেশ করতে উতসাহিত করার পাশাপাশি অব্যাহত পেশাগত উন্নয়নের অংশ হিসেবে পেশাগত নৈতিকতা ও পেশাগত আত্মসম্মানবোধ সম্পর্কে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক বিবেচনায় বা দুর্নীতির মাধ্যমে যারা নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছে তাদের সম্পর্কে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে কেউ ঐপথে আর না হাটে। আগামী নিয়োগগুলোতে যেন যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার ভিত্তিতেই কেবল সঠিক জনবল নিয়োগ করা হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের দায়িত্বশীলতা ও পেশাদারিত্ব বৃদ্ধির জন্য অব্যাহত প্রশিক্ষণ এবং নৈতিক দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে নির্দেশনা প্রদান করতে হবে। শিক্ষকদের নিয়োগ, পদোন্নতি এবং দায়িত্ব বণ্টনে রাজনৈতিক বিবেচনা বা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করতে হবে। শিক্ষকদের পেশাদারিত্ব ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ এবং মূল্যায়ন প্রক্রিয়া চালু করতে হবে, যা শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে সহায়ক হবে।

৪. শিক্ষাব্যবস্থার প্রাণশক্তি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রয়োজনীয় কার্যকর নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে শিক্ষা খাতে দলীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব অনেকাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। যদিও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কখনোই রাষ্ট্রীয় ও শাসক দলের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নয়, সরকারের উচিত শিক্ষার গুণগতমান উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদী নীতিমালা প্রণয়ন করা, যা সরকার পরিচালনাকারী শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও আদর্শ তথা প্রত্যক্ষ প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে। এসব নীতিমালায় শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধিসহ শিক্ষা প্রশাসক ও শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছ্বতা ও নিরপেক্ষতার বিধান, তাদের পেশাগত উন্নয়নে অব্যাহত প্রশিক্ষণের সুযোগ, শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ও শ্রেণীকক্ষে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো, গবেষণা ও উদ্ভাবনের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে শিক্ষাকে জীবনমুখী যুগোপযোগী করার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত, যা শিক্ষার্থীদের প্রত্যহিক জীবন, নিজস্ব কর্মসংস্থান ও জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে সহায়তা করবে। সমন্বিত নীতিমালার মাধ্যমে অব্যাহত উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় শিক্ষার আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া রোধ করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে বিগত বছরগুলোতে শিক্ষার রাজনীতিকীকরণ ও তার নেতিবাচক প্রভাবে শিক্ষার মানের ক্রমাবনতি বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মানের সাথে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দিয়েছে। ফলে আমাদের শিক্ষার্থীরা বৈশ্বিক চাকরির বাজারে এবং উচ্চশিক্ষার আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। উচ্চশিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান নানা সমস্যার কারণে বৈশ্বিক র‌্যাঙ্কিংয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিম্ন অবস্থানে রয়েছে, যা প্রকারান্তরে আন্তর্জাতিক পরিম-লে দেশের শিক্ষার মানের নিম্নগতি নির্দেশ করে।

৫. সর্বোপরি, দুদর্শাকবলিত শিক্ষা খাতকে ঢেলে সাজিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্যে জীবনমুখী যুগোপযোগী শিক্ষার সুযোগ করে দিতে বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন আবশ্যক হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রসংস্কারের অঙ্গীকার নিয়ে সরকার পরিচালনার দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের শিক্ষার উন্নয়নে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে এখন পর্যন্ত কোন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়নি। এটা জাতির জন্যে খুবই হতাশাব্যঞ্জক। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চলমান শিক্ষাব্যবস্থার নানা সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা ও সেসবের সামাধানের পাশাপাশি একটি নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীদের জন্য কর্মমুখী ও সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ‘বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত’ কল্যাণমুখী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যে আমাদের প্রত্যাশা প্রকৃত শিক্ষাসেবীদের অন্তর্ভুক্ত করে সরকার রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন ও শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি গঠনসহ চলমান নানাস্তরের নানামুখী সমস্যাগুলো সমাধানের জন্যে বিভিন্ন কমিটি উপকমিটি গঠনের করে শিক্ষাসংস্কারের কাজকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিবে। সরকার এ পদক্ষেপগুলো নিয়ে শিক্ষার মৌলিক কাঠামোকে শক্তিশালী করবে এবং গবেষণার ভিত্তিতে পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় অব্যাহত উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করবে যাতে কোন দল বা গোষ্ঠীর পক্ষে সেখানে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো সহজ না হয়। আগের দুটো লেখায় তুলে ধরা হয়েছে যে, বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে দলীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব একটি ব্যাপক অবক্ষয়ী ব্যাধি ও গভীর সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে যা থেকে আমাদের শিক্ষা খাতকে মুক্ত করা ছাড়া শিক্ষা সংস্কারে সফলতা লাভ করা অসম্ভব। শিক্ষায় ব্যাপক রাজনীতিকীকরণ সমস্যার সমাধান রাতারাতি করা সম্ভব না হলেও নানা পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এ অবস্থা থেকে ক্রমান্বয়ে উত্তরণ করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে এ সমস্যার সমাধানে কেবল সরকারের নানা পদক্ষেপ ও আইনি প্রচেষ্টাই যথেষ্ট নয়। সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালিয়েই সেটা করা সম্ভব। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো রাষ্ট্রীয় পরিসীমায় ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ তৈরির রাষ্ট্রীয় আদর্শের অঙ্গীকারে জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে ‘দায় ও দরদ’র নানা প্রচেষ্টার মাধ্যমে একটি শক্তিশালী জাতি হিসেবে আমাদেরকে বিশ্বসভায় আসন করে নেয়া। আর সেটা করতে হলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে দলীয় রাজনীতির থেকে মুক্ত রেখে দ্রুত শিক্ষা সংস্কারের মধ্য দিয়েই ক্রমাগত উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিক্ষাকে দলীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত করে আমাদের একটি সুষ্ঠু, উন্নত এবং সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি ‘বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত’ রাষ্ট্রব্যবস্থা ও কাঠামো উপহার দেবে। আর সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণে শিক্ষাই জাতীয় উন্নয়নের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।

[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]

হাওয়া লেগেছে রেমিট্যান্সের পালে

যুব সম্প্রদায়ের শহরমুখিতা

ছবি

‘ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া খোদার আসন আরশ ছেদিয়া’ জেগেছিল যে চির-বিস্ময়, তা কি নৈরাজ্যে হারিয়ে যাবে

পে-স্কেল যেন একটি দীর্ঘশ্বাস

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চিঠি ও খ্রিস্টান চার্চ

বর্ষা পেরিয়ে যাওয়ার পরও ডেঙ্গু আতঙ্ক

বিদ্যুৎ সংকটের সমাধান কোন পথে

ধূমপান ছেড়ে দিলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে

প্রসঙ্গ : শিক্ষা জাতীয়করণ

ছবি

বিশ্ববাসীর নজর আমেরিকায়, কিন্তু কেন?

মূল্যস্ফীতি কমাতে কেন কোনো ফর্মুলাই কাজ করছে না?

ছবি

তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বের সৌন্দর্যের সন্ধানে

মধ্যপ্রাচ্য সংকট

গাজায় মানবিক সংকট

প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন গ্রেডে সংস্কার দরকার

ফিকে হচ্ছে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়ন, এআই এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন পথ

অতীতটা হয়ে যাক দূর

রম্যগদ্য: নিমক-হারাম

হ্যালোইনে আমি একা

প্রসঙ্গ : প্রতিযোগিতামূলক দর

ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ, ফ্যাসিবাদী প্রবণতা কি বন্ধ হয়েছে

ঢাবি অধিভুক্ত সাত কলেজের সমস্যা

মানুষ গড়ার কারিগর

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও মানসিক স্বাস্থ্য সংকট

‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’

বাদ, প্রতিবাদ ও সম্বাদ

জলবায়ুর পরিবর্তন নির্ণয়ে প্রযুক্তি

অটিজম প্রতিরোধ ও প্রতিকারে করণীয়

বাজারে কৃষিপণ্যের দাম কেন বেশি?

জাতিসংঘ ভবন

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ

ধর্মভিত্তিক জোট কোন পথে

ছবি

বিদায় অগ্নিকন্যা

রিমান্ড সংস্কৃতি : আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে একটি মানবাধিকার পরিপ্রেক্ষিত

ছবি

ডেঙ্গুজ্বর : সচেতনতার বিকল্প নেই

tab

উপ-সম্পাদকীয়

শিক্ষাকে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করার উপায়

মাহরুফ চৌধুরী

বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪

বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে নানা সমস্যার মূলে আছে শিক্ষার রাজনীতিকীকরণের প্রত্যক্ষ নেতিবাচক প্রভাব। আগের দুটো লেখাতে আমরা শিক্ষা খাতে দলীয় রাজনীতির উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রভাবের নানাদিক নিয়ে আলোচনা করেছি। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর বর্তমান প্রবণতা যে জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে, সেখান থেকে সংস্কারের মাধ্যমে বেরিয়ে আসা খুব একটা সহজ কাজ হবে বলে মনে হয় না। দুর্বৃত্তায়ণের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি দেশে দীর্ঘদিন ধরে চালু আছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চার অভাব ও বিভিন্ন দলের কিছু কিছু নেতা কর্মীদের বর্তমান আচার-আচরণের আলামত দেখে প্রচলিত রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি থেকে অতিসহজে বেরিয়ে আসা যাবে ভাবাটা হবে আমাদের অবাস্তব প্রত্যাশা। কিন্তু তাই বলে আমাদের আশা ছেড়ে দিলে চলবে না; অব্যাহত প্রচেষ্টা চালাতে হবে শিক্ষাকে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করতে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে হাজার হাজার মানুষের রক্তদান আর শত শত শহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে যে সুযোগ জাতির হাতে এসেছে সেটাকে হাতছাড়া করা নেহায়েত বোকমি ছাড়া আর কিছু নয়। বর্তমান এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টিতে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের পাশাপাশি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। সে যাই হোক, আমাদের সদ্বিচ্ছা থাকলে শিক্ষা খাতে দলীয় রাজনীতির সক্রিয় প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসা অসম্ভব কিছুও নয়। কিছু কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে আমরা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে শিক্ষার পরিবেশকে সুস্থ ও উন্নত করে গড়ে তুলতে শিক্ষার মান উন্নয়নে মাধ্যমে ‘বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত’ কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠন করতে পারি। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রাথমিকভাবে নিচের উদ্যোগগুলো গ্রহণ করা গেলে দলীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব থেকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কিছুটা হলেও মুক্ত করা সম্ভব।

১. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো সামাজিক প্রতিষ্ঠান। সমাজের প্রয়োজন পূরণ ও সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই হলো এপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ। সমাজের সামগ্রিক ও সার্বিক কল্যাণে কাজ করতে এদের স্বাধীনভাবে কাজ করা তথা স্বায়ত্তশাসন প্রয়োজন। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা গেলে দলীয় রাজনীতির প্রভাব কিছুটা হলেও কমিয়ে আনা সম্ভব। একদিকে স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ পেলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে তাদের নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতে পারবে। ফলে জাতীয় রাজনীতি বা দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে। অপরদিকে বৈষম্য দূর করে সমতা ফিরিয়ে আনতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিয়োগ, নীতিমালা প্রণয়ন, এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে সক্ষম হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে, যেখানে কোন দল বা ব্যক্তির রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ থাকবে না। বিশেষ করে প্রশাসনিক নিয়োগ এবং নীতিমালা প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক বিবেচনার বাইরে থেকে যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একটি কার্যকর স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গতিশীলতা বৃদ্ধি ও শিক্ষার গুণগত মান উন্নত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

২. গোষ্ঠিস্বার্থে ছাত্ররাজনীতিকে নানাভাবে ব্যবহারের ফলে শব্দের অর্থের অপচিতির মাধ্যমে ‘ছাত্ররাজনীতি’র এক সংকীর্ণ ধারণায় আমরা উপনীত হয়েছি। বর্তমান আলাপ-আলোচনা ও সংলাপে এসংকীর্ণ ধারণা থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে এসে ছাত্ররাজনীতির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, ধরন ও পরিধি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরকে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করা জরুরি হয়ে পড়েছে। ছাত্ররাজনীতির মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবিগুলো আদায়ে আলোচনা-পর্যালোচনা ও সংলাপের মাধ্যমে জনমত গঠন ও সেগুলো আর্জনে কর্তৃপক্ষের উপর চাপপ্রয়োগ করা। ছাত্ররাজনীতির লক্ষ্য হবে শিক্ষার্থীদের নিজেদের সুশিক্ষার স্বার্থে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ও শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে সংঘশক্তিকে কাজে লাগানো। আর ছাত্ররাজনীতির ধরন হবে জাতীয় উন্নয়নের রাজনীতির সপক্ষে দলীয় রাজনীতির প্রভাব বলয়ের বাইরে থেকে স্বাধীন চিন্তাশক্তির বিকাশ ও প্রকাশের জন্যে শিক্ষার্থীদের দ্বারা গঠিত, শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত ও শিক্ষার্থীদের স্বার্থে কাজ করা সংঘশক্তি। ছাত্ররাজনীতির পরিধিটা সীমিত থাকা উচিত তাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের পরিমন্ডলে ও স্থানীয় পর্যায়ে যদি সেটা তাদের পড়ালেখায় প্রভাব ফেলে বা জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজন পড়ে। আর জাতীয় দুর্দিনেই কেবল তারা জাতীয় পর্যায়ে সম্পৃক্ত হবে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন আভ্যন্তরীণ নীতিমালা ও প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকা-ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দলীয় রাজনীতির কুপ্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন করার কলাকৌশল অবলম্বন করে ছাত্ররাজনীতির নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক কল্যাণমুখী ছাত্ররাজনীতির নানা কর্মকা-ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক অগ্রগতির সাথে সাথে তাদের মাঝে রাষ্ট্রের দর্শনের ভিত্তিতে জাতীয় মূল্যবোধ গড়ে তোলা এবং তাদেরকে নৈতিক দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষাপ্রদানের পাশাপাশি ব্যক্তিক ও সামষ্টিক উন্নয়নের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। রাজনৈতিক সহিংসতা পরিহার এবং দলীয় স্বার্থের বাইরে এসে দেশের প্রতিটি নাগরিকের মানবিক অধিকার নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজন সমতা, সততা, এবং জাতীয় স্বার্থে কাজ করার শিক্ষা নেয়া। জাতীয় পর্যায়ের দলগুলোর রাজনৈতিক আদর্শ ও উদ্দেশ্যের তলফিবাহক না হয়ে ছাত্রসংগঠনগুলোকে শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিম-লে একাডেমিক ও সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করতে হবে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা স্তরে প্রচলিত বর্তমান ছাত্ররাজনীতি নিয়ন্ত্রণ ও শিক্ষার পরিবেশ উন্নয়ন ব্যতিত শিক্ষাসংস্কারের কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যাবে না। তাই ছাত্ররাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব দূর করতে প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ, রাজনৈতিক সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি করা। ছাত্রসংগঠনগুলোকে সহিংসতা ও ক্ষমতার লড়াইয়ের বদলে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ও সামাজিক উন্নয়নে উৎসাহিত করতে হবে। এ বিষয়ে সরকার, দেশের সব রাজনৈতিক দল এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একযোগে কাজ করা প্রয়োজন।

৩. পেশাগত নীতি ও নৈতিক দায় থেকে কোন পেশার লোকজনই কোনরকম দলীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারে না। দলীয় পক্ষপাতিত্ব পেশাজীবীকে পেশাগত নিরপেক্ষতা বজায় রাখার পরিপন্থি। তাই পেশাজীবী হিসেবে শিক্ষকদের রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটা করে সেল গঠন করে তার মাধ্যম নজরদারি করে শিক্ষকদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নির্মূল করতে হবে। তাদের শিক্ষাদান ও গবেষণার দায়িত্বের প্রতি আরও বেশি করে মনোনিবেশ করতে উতসাহিত করার পাশাপাশি অব্যাহত পেশাগত উন্নয়নের অংশ হিসেবে পেশাগত নৈতিকতা ও পেশাগত আত্মসম্মানবোধ সম্পর্কে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক বিবেচনায় বা দুর্নীতির মাধ্যমে যারা নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছে তাদের সম্পর্কে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে কেউ ঐপথে আর না হাটে। আগামী নিয়োগগুলোতে যেন যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার ভিত্তিতেই কেবল সঠিক জনবল নিয়োগ করা হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের দায়িত্বশীলতা ও পেশাদারিত্ব বৃদ্ধির জন্য অব্যাহত প্রশিক্ষণ এবং নৈতিক দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে নির্দেশনা প্রদান করতে হবে। শিক্ষকদের নিয়োগ, পদোন্নতি এবং দায়িত্ব বণ্টনে রাজনৈতিক বিবেচনা বা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করতে হবে। শিক্ষকদের পেশাদারিত্ব ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ এবং মূল্যায়ন প্রক্রিয়া চালু করতে হবে, যা শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে সহায়ক হবে।

৪. শিক্ষাব্যবস্থার প্রাণশক্তি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রয়োজনীয় কার্যকর নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে শিক্ষা খাতে দলীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব অনেকাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। যদিও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কখনোই রাষ্ট্রীয় ও শাসক দলের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নয়, সরকারের উচিত শিক্ষার গুণগতমান উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদী নীতিমালা প্রণয়ন করা, যা সরকার পরিচালনাকারী শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও আদর্শ তথা প্রত্যক্ষ প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে। এসব নীতিমালায় শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধিসহ শিক্ষা প্রশাসক ও শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছ্বতা ও নিরপেক্ষতার বিধান, তাদের পেশাগত উন্নয়নে অব্যাহত প্রশিক্ষণের সুযোগ, শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ও শ্রেণীকক্ষে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো, গবেষণা ও উদ্ভাবনের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে শিক্ষাকে জীবনমুখী যুগোপযোগী করার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত, যা শিক্ষার্থীদের প্রত্যহিক জীবন, নিজস্ব কর্মসংস্থান ও জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে সহায়তা করবে। সমন্বিত নীতিমালার মাধ্যমে অব্যাহত উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় শিক্ষার আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া রোধ করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে বিগত বছরগুলোতে শিক্ষার রাজনীতিকীকরণ ও তার নেতিবাচক প্রভাবে শিক্ষার মানের ক্রমাবনতি বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মানের সাথে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দিয়েছে। ফলে আমাদের শিক্ষার্থীরা বৈশ্বিক চাকরির বাজারে এবং উচ্চশিক্ষার আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। উচ্চশিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান নানা সমস্যার কারণে বৈশ্বিক র‌্যাঙ্কিংয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিম্ন অবস্থানে রয়েছে, যা প্রকারান্তরে আন্তর্জাতিক পরিম-লে দেশের শিক্ষার মানের নিম্নগতি নির্দেশ করে।

৫. সর্বোপরি, দুদর্শাকবলিত শিক্ষা খাতকে ঢেলে সাজিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্যে জীবনমুখী যুগোপযোগী শিক্ষার সুযোগ করে দিতে বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন আবশ্যক হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রসংস্কারের অঙ্গীকার নিয়ে সরকার পরিচালনার দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের শিক্ষার উন্নয়নে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে এখন পর্যন্ত কোন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়নি। এটা জাতির জন্যে খুবই হতাশাব্যঞ্জক। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চলমান শিক্ষাব্যবস্থার নানা সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা ও সেসবের সামাধানের পাশাপাশি একটি নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীদের জন্য কর্মমুখী ও সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ‘বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত’ কল্যাণমুখী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যে আমাদের প্রত্যাশা প্রকৃত শিক্ষাসেবীদের অন্তর্ভুক্ত করে সরকার রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন ও শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি গঠনসহ চলমান নানাস্তরের নানামুখী সমস্যাগুলো সমাধানের জন্যে বিভিন্ন কমিটি উপকমিটি গঠনের করে শিক্ষাসংস্কারের কাজকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিবে। সরকার এ পদক্ষেপগুলো নিয়ে শিক্ষার মৌলিক কাঠামোকে শক্তিশালী করবে এবং গবেষণার ভিত্তিতে পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় অব্যাহত উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করবে যাতে কোন দল বা গোষ্ঠীর পক্ষে সেখানে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো সহজ না হয়। আগের দুটো লেখায় তুলে ধরা হয়েছে যে, বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে দলীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব একটি ব্যাপক অবক্ষয়ী ব্যাধি ও গভীর সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে যা থেকে আমাদের শিক্ষা খাতকে মুক্ত করা ছাড়া শিক্ষা সংস্কারে সফলতা লাভ করা অসম্ভব। শিক্ষায় ব্যাপক রাজনীতিকীকরণ সমস্যার সমাধান রাতারাতি করা সম্ভব না হলেও নানা পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এ অবস্থা থেকে ক্রমান্বয়ে উত্তরণ করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে এ সমস্যার সমাধানে কেবল সরকারের নানা পদক্ষেপ ও আইনি প্রচেষ্টাই যথেষ্ট নয়। সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালিয়েই সেটা করা সম্ভব। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো রাষ্ট্রীয় পরিসীমায় ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ তৈরির রাষ্ট্রীয় আদর্শের অঙ্গীকারে জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে ‘দায় ও দরদ’র নানা প্রচেষ্টার মাধ্যমে একটি শক্তিশালী জাতি হিসেবে আমাদেরকে বিশ্বসভায় আসন করে নেয়া। আর সেটা করতে হলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে দলীয় রাজনীতির থেকে মুক্ত রেখে দ্রুত শিক্ষা সংস্কারের মধ্য দিয়েই ক্রমাগত উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিক্ষাকে দলীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত করে আমাদের একটি সুষ্ঠু, উন্নত এবং সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি ‘বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত’ রাষ্ট্রব্যবস্থা ও কাঠামো উপহার দেবে। আর সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণে শিক্ষাই জাতীয় উন্নয়নের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।

[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]

back to top