আনোয়ারুল হক
অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২৩ অক্টোবর ২৪ তারিখের এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ওই সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযোগ- বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ে তাদের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র হামলা পরিচালনা করে অসংখ্য আন্দোলনকারীকে হত্যা করে ও অনেকের জীবন বিপন্ন করে। ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনী দ্বারা ছাত্রছাত্রীদের আক্রান্ত হওয়া, আক্রান্ত ছাত্রীদের রক্তাক্ত চেহারা এবং অস্ত্র হাতে তাক করে গুলি করার ভিডিও ফুটেজ এবং স্থির চিত্র ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও সংবাদপত্রগুলোতে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়ই দেশবাসী দেখেছে।
ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে গণরুমকেন্দ্রিক নিপীড়ন, টেন্ডারবাজি, যৌন নির্যাতন ইত্যাদি। গণরুমকেন্দ্রিক নিপীড়ন ও বাধ্যতামূলকভাবে ছাত্রলীগের সভা-সমাবেশ মিছিলে অংশগ্রহণের মতো নিপীড়নের শিকার গত ১০-১৫ বছরে সারা দেশের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী। এ সত্যও দেশবাসী জেনে এসেছে।
এখন প্রশ্ন ১০-১৫ বছর ধরে বা সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রলীগ উপরে উল্লিখিত এই যে ‘মহান কর্মসূচি’গুলো পালন করে এসেছে তা এই সংগঠনের ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচিতে লিপিবদ্ধ আছে কি? যদি না থেকে থাকে তবে এ সব ‘মহান’ কর্তব্য যারা পালন করেছেন তাদেরকে আইন ও শাস্তির আওতায় আনতে হবে সর্বপ্রথম। প্রতিটা হত্যাকা-ের, প্রতিটা গুমের, প্রতিটা অপরাধের বিচার করে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে হবে যে বিচার সম্ভব, আইনের শাসন সম্ভব। কাজটা বেশ কঠিন। তাই সহজ পন্থা নিষিদ্ধ ঘোষণা করার ফ্যাসিবাদী পন্থা বেছে নেয়া হয়েছে।
আমার তো মনে হয় সবার আগে দায়ী বিগত সময়কালের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ‘বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স’ দ্বারা পরিচালিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যথেষ্ট ক্ষমতা ও স্বাধীনতা থাকলেও দলকানা ভিসি ও প্রশাসন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ছাত্রবিরোধী এবং অনৈতিক কর্মকা-ের বিরুদ্ধে কখনই কোন ব্যবস্থা না নিয়ে বরং নীরব সমর্থন জানিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের চেয়েও বেশি অপরাধ করেছেন।
সুদীর্ঘ ৭৫ বছরের অধিককাল ধরে ছাত্রলীগ সংগঠনটি পূর্ব বাংলা ও স্বাধীন বাংলাদেশে ক্রিয়াশীল। ভাষা সংগ্রাম, স্বাধিকার আন্দোলন, আইয়ুব খানের স্বৈরশাহীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং স্বাধীন দেশেও সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ছাত্রলীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এসব সংগ্রামে ও মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের অসংখ্য কর্মী আত্মাহুতি দিয়েছেন, কারা নির্যাতন ভোগ করেছেন। ছাত্রলীগ সংগঠনটির অনেক গৌরবের ইতিহাস রয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়কারী সারজিস আলমসহ আন্দোলনের অনেকেই নাকি ছাত্রলীগ করতেন। সারজিস আলম তো ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ১০-১২টি প্যানেলের মধ্যে ছাত্রলীগের প্যানেলটিই বেছে নিয়েছিলেন এবং ছাত্রলীগের হয়ে হল সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আগ পর্যন্ত তো তাকে ছাত্রলীগ সভাপতির পাশেই দেখা যেত। আবার ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হলে ‘ঈদ আনন্দ উদ্্যাপন’ করলেন।
জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান সিপাহসালার নিজেই জানিয়েছেন এক সময় তিনি ছাত্রলীগ করতেন। এমনকি ছাত্রলীগের রেডিক্যাল অংশ জাসদ ছাত্রলীগও তিনি ছাত্র জীবনে করেছেন (গণবাহিনীতেও ছিলেন কিনা সেটা অবশ্য উল্লেখ করেননি)। ছাত্রলীগ পচাগলা জিনিস হলে সারজিস আলম বা জামায়াত সিপাহসালার কি ওই সংগঠন করতেন!
তবে স্বাধীনতার পরে দেশ গঠনের কাজে ছাত্রলীগ যথাযত ভূমিকা রাখতে পারেনি। বরং দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল, খুনখারাবিসহ নানা নেতিবাচক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ে। যখনই আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকেছে (১৯৯৬-২০০১) বিশেষত বিগত ১০-১৫ বছর ছাত্রলীগ নেতৃত্বের আচরই ও কর্মকা- ছিল বেপরোয়া ও ছাত্রলীগের ঘোষিত আদর্শের বিরোধী। বিনা ভোটে, রাতের ভোটে, ডামি ভোটে রাষ্ট্র ক্ষমতা আগলে রাখা যায় এবং রাষ্ট্র শক্তি প্রয়োগ করে যে কোন বিরোধী আন্দোলন দমিয়ে রাখা যায়- এটা দেখে তারা হয়ে ওঠে আরও দুর্বিনীত। ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানে খুনির ভূমিকা নেয়ার পূর্বেই বুয়েটে আবরার হত্যাকা-, পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ হত্যাকা- সমাজে ছাত্রলীগ সম্পর্কে যে ঘৃণার সৃষ্টি করেছিল তা ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব অনুধাবন করতে পারেনি। ফলে এবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্দোলন দমনে পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগও লাঠিসোঁটা, পিস্তল, বন্দুক নিয়ে নামলে দেখা যায় ছাত্রছাত্রীদের প্রতিরোধের মুখে তারা টিকতে না পেরে হল ও ক্যাম্পাস ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলেই ক্যাম্পাসে জমিদারি প্রতিষ্ঠার উদাহরণ অতীতে ভিন্ন ছাত্র সংগঠনেরও আছে। এমনকি আশির দশকে ছাত্র শিবির নামক সংগঠন রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি ক্যাম্পাসে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ, ছাত্র মৈত্রী ও ছাত্রদলের কর্মীদের রগ কাটা ও হত্যার পৈশাচিক উদাহরণ সৃষ্টি করে। এ সবেরও দালিলিক প্রমাণ আছে। কিন্তু এবারের একনাগাড়ে পনের বছরের জমিদারি অন্য সময়ের তুলনায় আরও বীভৎস রূপ নিয়ে প্রকাশিত হয়। তারপরেও প্রশ্ন হচ্ছে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার যে কারণ, সেই কারণকে নির্মূল না করে নিষিদ্ধ ঘোষণায় কি এই সমস্যার সমাধান আসবে?
ছাত্রলীগের কয়েক লক্ষ কর্ম-সমর্থক রয়েছে। এর মাঝে সারা দেশে কয়েক হাজার বা দশ-বিশ হাজার নেতাকর্মী এবারের অপরাধমূলক কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। তাদেরকে বিচারের আওতায় এনে ছাত্রলীগসহ সহ ছাত্র সংগঠনের জন্য ক্যাম্পাসে সংগঠন পরিচালনার নীতিমালা প্রণয়ন ও তা কঠোরভাবে কার্যকর করলে ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানোত্তর পরিস্থিতিতে ছাত্র আন্দোলনে হয়তো বা এক নতুন সুস্থ ধারার সৃষ্টি হতে পারতো। যিনি বা যারাই নিয়ম ভঙ্গ করবেন বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ তাকে বা তাদেরকে প্রশাসনিক নিয়মে বেঁধে ফেলবেন, আইনের আওতায় নিয়ে আসবেন- নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে এ ধরনের কঠোরতাপ্রয়োগ করলে ছাত্র সংগঠনগুলোও বর্তমান সময়ের দাবির সঙ্গে মিলিয়ে স্বস্ব সংগঠনে প্রয়োজনীয় সংস্কার করত।
তা না করে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের লক্ষ লক্ষ কর্মীর জন্য সুযোগ রেখে দিলেন আইনি-বেআইনি নানা পন্থায় প্রচলিত ধারাতেই অগ্রসর হওয়ার এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ায় তাদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিরোধ ও প্রতিশোধ স্পৃহা কাজ করবে- যার নেতিবাচক প্রভাব ছাত্র আন্দলনে পড়তে পারে। অন্যদিকে অপরাধীদের বিচারের নামে যে পদ্ধতিতে মামলা হচ্ছে, মামলা হওয়ার পর বাদী সাংবাদিকদের বলছেন, আসামির নামও ইতঃপূর্বে শোনেননি, শুধু একটি কাগজে সই দিয়েছেন- ফলে মানুষ আর সুষ্ঠু বিচারও আশা করতে পারছেন না।
ক্যাম্পাসে আজ ছাত্রলীগ নেই। কিন্তু কেন জানি অনেক কিছুই আগের স্টাইলে চলছে। অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আন্দোলনকারী সাধারণ ছাত্ররা ক্লাস রুমে ফিরে গেছেন। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নতুন স্বাধীন বাংলাদেশের’ ছাত্র নেতারা আগের মতোই একাধিপত্য কায়েম করেছেন, রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে একতরফা কর্মসূচি পালন করে চলেছেন। তারা যুক্তি উপস্থাপন করছেন ছাত্র ঐক্য দৃশ্যমান রাখার স্বার্থে ক্যাম্পাসে অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের আপাতত পৃথকভাবে সক্রিয় কর্মসূচি নেয়া যাবে না। অথচ ওই সব ইস্যুতে অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের রাজনৈতিক বক্তব্য (যাকে এখন সবাই বয়ান বলে) ভিন্ন। আর একতরফাভাবে উপস্থাপিত তাদের ‘বয়ান’- এ ভাষা প্রয়োগ, উপস্থাপন ভঙ্গি বা শারীরিক ভাষার সঙ্গে পতিত ছাত্রলীগ নেতাদের (যারা ফ্যাসিবাদী) অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ছাত্র লীগ বিদায় হয়েছে, কিন্তু তার বিপজ্জনক ফ্যাসিবাদী প্রবণতা কি উৎসর্গ করে গিয়েছে বিজয়ী ছাত্র নেতাদের জন্য!
এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন স্বৈরাচার স্বেচ্ছাচার, দমন পীড়ন ও হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে নিঃশঙ্ক চিত্তে যে রাজপথে নেমে এল তার একটি প্রধান কারন ছিল তারা মনে করেছিল এই আন্দোলনে তথাকথিত রাজনীতি নেই, কোন রাজনৈতিক দলের খবরদারি বা স্বার্থান্বেষী ইন্ধন নেই। কিন্তু আজ যদি তারা দেখে ছাত্র রাজনীতির মধ্যে ‘পলিটিক্স’ ঢুকে গিয়েছে, নতুন ছাত্র নেতারা বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছেন তাহলে অচিরেই তারা ছাত্র সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন।
দেশে কোন্ কোন্ দল রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালনা করবে, কোন্ কোন্ দল নিষিদ্ধ হবে এ সিদ্ধান্ত যদি নতুন ছাত্র নেতারা নিতে চান তা হবে তাদের জন্য আত্মঘাতী। তা হবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সারবত্তাকে ধ্বংস করে বৈষম্যের বাংলাদেশ গড়ে তোলার এক ফ্যাসিবাদী প্রয়াস। অথচ তারা বলেছিলেন, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তারা ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের চেতনার সঙ্গে মিলিয়ে বৈষম্যমুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দায় ও দরদের সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। তা থেকে বিচ্যুতি নতুন করে বিভাজন ও ফ্যাসিবাদী প্রবণতার বিপদ সৃষ্টি করছে। তাই স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, প্রজাতন্ত্র, জাতীয় পতাকা এসব বিষয় নিয়ে বিতর্ক উত্থাপন না করাটাই তাদের জন্য সমীচীন হবে। মনে রাখতে হবে আন্দোলন হয়েছিল গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য গণতন্ত্র হরণ করার জন্য নয়।
ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের অনুরোধ করব, স্বৈরাচার পতনের পরে দেশের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের স্বার্থে একটু থেমে, কিছুটা পর্যালোচনা ও আত্ম-বিশ্লেষণ করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করুন। নতুন করে দেশের বুকে আরও বড় ফ্যাসিবাদের বিপদ ডেকে আনবেন না। সবারই এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন বাংলাদেশ কিন্তু জোয়ার-ভাটার দেশ! বিশ্বাসীদের আরও বেশি করে মনে রাখা প্রয়োজনÑসীমা লঙ্ঘনকারীকে সৃষ্টিকর্তাও পছন্দ করেন না।
[লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ]
আনোয়ারুল হক
বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৪
অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২৩ অক্টোবর ২৪ তারিখের এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ওই সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযোগ- বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ে তাদের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র হামলা পরিচালনা করে অসংখ্য আন্দোলনকারীকে হত্যা করে ও অনেকের জীবন বিপন্ন করে। ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনী দ্বারা ছাত্রছাত্রীদের আক্রান্ত হওয়া, আক্রান্ত ছাত্রীদের রক্তাক্ত চেহারা এবং অস্ত্র হাতে তাক করে গুলি করার ভিডিও ফুটেজ এবং স্থির চিত্র ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও সংবাদপত্রগুলোতে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়ই দেশবাসী দেখেছে।
ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে গণরুমকেন্দ্রিক নিপীড়ন, টেন্ডারবাজি, যৌন নির্যাতন ইত্যাদি। গণরুমকেন্দ্রিক নিপীড়ন ও বাধ্যতামূলকভাবে ছাত্রলীগের সভা-সমাবেশ মিছিলে অংশগ্রহণের মতো নিপীড়নের শিকার গত ১০-১৫ বছরে সারা দেশের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী। এ সত্যও দেশবাসী জেনে এসেছে।
এখন প্রশ্ন ১০-১৫ বছর ধরে বা সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রলীগ উপরে উল্লিখিত এই যে ‘মহান কর্মসূচি’গুলো পালন করে এসেছে তা এই সংগঠনের ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচিতে লিপিবদ্ধ আছে কি? যদি না থেকে থাকে তবে এ সব ‘মহান’ কর্তব্য যারা পালন করেছেন তাদেরকে আইন ও শাস্তির আওতায় আনতে হবে সর্বপ্রথম। প্রতিটা হত্যাকা-ের, প্রতিটা গুমের, প্রতিটা অপরাধের বিচার করে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে হবে যে বিচার সম্ভব, আইনের শাসন সম্ভব। কাজটা বেশ কঠিন। তাই সহজ পন্থা নিষিদ্ধ ঘোষণা করার ফ্যাসিবাদী পন্থা বেছে নেয়া হয়েছে।
আমার তো মনে হয় সবার আগে দায়ী বিগত সময়কালের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ‘বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স’ দ্বারা পরিচালিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যথেষ্ট ক্ষমতা ও স্বাধীনতা থাকলেও দলকানা ভিসি ও প্রশাসন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ছাত্রবিরোধী এবং অনৈতিক কর্মকা-ের বিরুদ্ধে কখনই কোন ব্যবস্থা না নিয়ে বরং নীরব সমর্থন জানিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের চেয়েও বেশি অপরাধ করেছেন।
সুদীর্ঘ ৭৫ বছরের অধিককাল ধরে ছাত্রলীগ সংগঠনটি পূর্ব বাংলা ও স্বাধীন বাংলাদেশে ক্রিয়াশীল। ভাষা সংগ্রাম, স্বাধিকার আন্দোলন, আইয়ুব খানের স্বৈরশাহীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং স্বাধীন দেশেও সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ছাত্রলীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এসব সংগ্রামে ও মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের অসংখ্য কর্মী আত্মাহুতি দিয়েছেন, কারা নির্যাতন ভোগ করেছেন। ছাত্রলীগ সংগঠনটির অনেক গৌরবের ইতিহাস রয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়কারী সারজিস আলমসহ আন্দোলনের অনেকেই নাকি ছাত্রলীগ করতেন। সারজিস আলম তো ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ১০-১২টি প্যানেলের মধ্যে ছাত্রলীগের প্যানেলটিই বেছে নিয়েছিলেন এবং ছাত্রলীগের হয়ে হল সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আগ পর্যন্ত তো তাকে ছাত্রলীগ সভাপতির পাশেই দেখা যেত। আবার ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হলে ‘ঈদ আনন্দ উদ্্যাপন’ করলেন।
জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান সিপাহসালার নিজেই জানিয়েছেন এক সময় তিনি ছাত্রলীগ করতেন। এমনকি ছাত্রলীগের রেডিক্যাল অংশ জাসদ ছাত্রলীগও তিনি ছাত্র জীবনে করেছেন (গণবাহিনীতেও ছিলেন কিনা সেটা অবশ্য উল্লেখ করেননি)। ছাত্রলীগ পচাগলা জিনিস হলে সারজিস আলম বা জামায়াত সিপাহসালার কি ওই সংগঠন করতেন!
তবে স্বাধীনতার পরে দেশ গঠনের কাজে ছাত্রলীগ যথাযত ভূমিকা রাখতে পারেনি। বরং দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল, খুনখারাবিসহ নানা নেতিবাচক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ে। যখনই আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকেছে (১৯৯৬-২০০১) বিশেষত বিগত ১০-১৫ বছর ছাত্রলীগ নেতৃত্বের আচরই ও কর্মকা- ছিল বেপরোয়া ও ছাত্রলীগের ঘোষিত আদর্শের বিরোধী। বিনা ভোটে, রাতের ভোটে, ডামি ভোটে রাষ্ট্র ক্ষমতা আগলে রাখা যায় এবং রাষ্ট্র শক্তি প্রয়োগ করে যে কোন বিরোধী আন্দোলন দমিয়ে রাখা যায়- এটা দেখে তারা হয়ে ওঠে আরও দুর্বিনীত। ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানে খুনির ভূমিকা নেয়ার পূর্বেই বুয়েটে আবরার হত্যাকা-, পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ হত্যাকা- সমাজে ছাত্রলীগ সম্পর্কে যে ঘৃণার সৃষ্টি করেছিল তা ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব অনুধাবন করতে পারেনি। ফলে এবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্দোলন দমনে পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগও লাঠিসোঁটা, পিস্তল, বন্দুক নিয়ে নামলে দেখা যায় ছাত্রছাত্রীদের প্রতিরোধের মুখে তারা টিকতে না পেরে হল ও ক্যাম্পাস ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলেই ক্যাম্পাসে জমিদারি প্রতিষ্ঠার উদাহরণ অতীতে ভিন্ন ছাত্র সংগঠনেরও আছে। এমনকি আশির দশকে ছাত্র শিবির নামক সংগঠন রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি ক্যাম্পাসে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ, ছাত্র মৈত্রী ও ছাত্রদলের কর্মীদের রগ কাটা ও হত্যার পৈশাচিক উদাহরণ সৃষ্টি করে। এ সবেরও দালিলিক প্রমাণ আছে। কিন্তু এবারের একনাগাড়ে পনের বছরের জমিদারি অন্য সময়ের তুলনায় আরও বীভৎস রূপ নিয়ে প্রকাশিত হয়। তারপরেও প্রশ্ন হচ্ছে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার যে কারণ, সেই কারণকে নির্মূল না করে নিষিদ্ধ ঘোষণায় কি এই সমস্যার সমাধান আসবে?
ছাত্রলীগের কয়েক লক্ষ কর্ম-সমর্থক রয়েছে। এর মাঝে সারা দেশে কয়েক হাজার বা দশ-বিশ হাজার নেতাকর্মী এবারের অপরাধমূলক কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। তাদেরকে বিচারের আওতায় এনে ছাত্রলীগসহ সহ ছাত্র সংগঠনের জন্য ক্যাম্পাসে সংগঠন পরিচালনার নীতিমালা প্রণয়ন ও তা কঠোরভাবে কার্যকর করলে ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানোত্তর পরিস্থিতিতে ছাত্র আন্দোলনে হয়তো বা এক নতুন সুস্থ ধারার সৃষ্টি হতে পারতো। যিনি বা যারাই নিয়ম ভঙ্গ করবেন বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ তাকে বা তাদেরকে প্রশাসনিক নিয়মে বেঁধে ফেলবেন, আইনের আওতায় নিয়ে আসবেন- নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে এ ধরনের কঠোরতাপ্রয়োগ করলে ছাত্র সংগঠনগুলোও বর্তমান সময়ের দাবির সঙ্গে মিলিয়ে স্বস্ব সংগঠনে প্রয়োজনীয় সংস্কার করত।
তা না করে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের লক্ষ লক্ষ কর্মীর জন্য সুযোগ রেখে দিলেন আইনি-বেআইনি নানা পন্থায় প্রচলিত ধারাতেই অগ্রসর হওয়ার এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ায় তাদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিরোধ ও প্রতিশোধ স্পৃহা কাজ করবে- যার নেতিবাচক প্রভাব ছাত্র আন্দলনে পড়তে পারে। অন্যদিকে অপরাধীদের বিচারের নামে যে পদ্ধতিতে মামলা হচ্ছে, মামলা হওয়ার পর বাদী সাংবাদিকদের বলছেন, আসামির নামও ইতঃপূর্বে শোনেননি, শুধু একটি কাগজে সই দিয়েছেন- ফলে মানুষ আর সুষ্ঠু বিচারও আশা করতে পারছেন না।
ক্যাম্পাসে আজ ছাত্রলীগ নেই। কিন্তু কেন জানি অনেক কিছুই আগের স্টাইলে চলছে। অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আন্দোলনকারী সাধারণ ছাত্ররা ক্লাস রুমে ফিরে গেছেন। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নতুন স্বাধীন বাংলাদেশের’ ছাত্র নেতারা আগের মতোই একাধিপত্য কায়েম করেছেন, রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে একতরফা কর্মসূচি পালন করে চলেছেন। তারা যুক্তি উপস্থাপন করছেন ছাত্র ঐক্য দৃশ্যমান রাখার স্বার্থে ক্যাম্পাসে অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের আপাতত পৃথকভাবে সক্রিয় কর্মসূচি নেয়া যাবে না। অথচ ওই সব ইস্যুতে অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের রাজনৈতিক বক্তব্য (যাকে এখন সবাই বয়ান বলে) ভিন্ন। আর একতরফাভাবে উপস্থাপিত তাদের ‘বয়ান’- এ ভাষা প্রয়োগ, উপস্থাপন ভঙ্গি বা শারীরিক ভাষার সঙ্গে পতিত ছাত্রলীগ নেতাদের (যারা ফ্যাসিবাদী) অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ছাত্র লীগ বিদায় হয়েছে, কিন্তু তার বিপজ্জনক ফ্যাসিবাদী প্রবণতা কি উৎসর্গ করে গিয়েছে বিজয়ী ছাত্র নেতাদের জন্য!
এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন স্বৈরাচার স্বেচ্ছাচার, দমন পীড়ন ও হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে নিঃশঙ্ক চিত্তে যে রাজপথে নেমে এল তার একটি প্রধান কারন ছিল তারা মনে করেছিল এই আন্দোলনে তথাকথিত রাজনীতি নেই, কোন রাজনৈতিক দলের খবরদারি বা স্বার্থান্বেষী ইন্ধন নেই। কিন্তু আজ যদি তারা দেখে ছাত্র রাজনীতির মধ্যে ‘পলিটিক্স’ ঢুকে গিয়েছে, নতুন ছাত্র নেতারা বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছেন তাহলে অচিরেই তারা ছাত্র সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন।
দেশে কোন্ কোন্ দল রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালনা করবে, কোন্ কোন্ দল নিষিদ্ধ হবে এ সিদ্ধান্ত যদি নতুন ছাত্র নেতারা নিতে চান তা হবে তাদের জন্য আত্মঘাতী। তা হবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সারবত্তাকে ধ্বংস করে বৈষম্যের বাংলাদেশ গড়ে তোলার এক ফ্যাসিবাদী প্রয়াস। অথচ তারা বলেছিলেন, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তারা ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের চেতনার সঙ্গে মিলিয়ে বৈষম্যমুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দায় ও দরদের সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। তা থেকে বিচ্যুতি নতুন করে বিভাজন ও ফ্যাসিবাদী প্রবণতার বিপদ সৃষ্টি করছে। তাই স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, প্রজাতন্ত্র, জাতীয় পতাকা এসব বিষয় নিয়ে বিতর্ক উত্থাপন না করাটাই তাদের জন্য সমীচীন হবে। মনে রাখতে হবে আন্দোলন হয়েছিল গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য গণতন্ত্র হরণ করার জন্য নয়।
ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের অনুরোধ করব, স্বৈরাচার পতনের পরে দেশের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের স্বার্থে একটু থেমে, কিছুটা পর্যালোচনা ও আত্ম-বিশ্লেষণ করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করুন। নতুন করে দেশের বুকে আরও বড় ফ্যাসিবাদের বিপদ ডেকে আনবেন না। সবারই এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন বাংলাদেশ কিন্তু জোয়ার-ভাটার দেশ! বিশ্বাসীদের আরও বেশি করে মনে রাখা প্রয়োজনÑসীমা লঙ্ঘনকারীকে সৃষ্টিকর্তাও পছন্দ করেন না।
[লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ]