ফয়সাল বিন লতিফ
বাংলাদেশ একটি নদী-নির্ভর দেশ। শত-সহস্র নদী-নালা, খাল-বিল জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গোটা দেশে। কিছুকাল আগ পর্যন্ত নদীই ছিল দেশবাসীর যোগাযোগের প্রধান পথ। নদীই ছিল ছোট্ট এই দেশটির বিচ্ছিন্নতা ও যোগাযোগের উপায়। সাধারণত পর্বত, উঁচু ভূমি, পাহাড়ের গিরিখাত থেকে সৃষ্ট ঝরণাধারা, বরফগলিত স্রোত কিংবা প্রাকৃতিক পরিবর্তন থেকে নদীর জন্ম। বাংলাদেশ হিমালয় থেকে প্রবাহিত নদীগুলোর মধ্য দিয়ে বাহিত পলি দ্বারা গঠিত একটি সক্রিয় ব-দ্বীপ। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ ‘নদীর দেশ’ নামে পরিচিত। তাই বাংলাদেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। অগণিত গ্রামীণ বাংলাদেশির জীবন-জীবিকা নদীর ওপর নির্ভরশীল। আমাদের দেশে মোট ৭০০টি নদী প্রবাহিত এবং এর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪ হাজার ১৪০ কিলোমিটার। এগুলো নদী, পাহাড়ি স্রোত, ঘূর্ণায়মান মৌসুমি খাড়ি এবং খাল নিয়ে গঠিত, যা দেশের মোট ভূপৃষ্ঠের প্রায় ৭ শতাংশ গঠন করে এবং এগুলো দেশের বেশিরভাগ অংশকে জলপথের বিচিত্র নেটওয়ার্ক দ্বারা সংযুক্ত করে। বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে ৫৮টি আন্তঃসীমান্ত নদী প্রবাহিত হয়েছে। এদেশের দীর্ঘতম ও বৃহত্তম নদী মেঘনা ও অন্যান্য বড় নদীগুলো হলো পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলী, তিস্তা ইত্যাদি।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় গত ৫০ বছরে হারিয়ে গেছে প্রায় ৫০০ নদী। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব বলছে, এ পর্যন্ত হারিয়ে গেছে আট হাজার খাল-বিল। দখল-দূষণ ও ভাঙনের কারণে জীবিকা হারিয়ে প্রতি বছর বাস্তুচ্যুত ও অভিবাসী হচ্ছে পাঁচ লাখ মানুষ- যারা প্রবেশ করছে ঢাকা ও অন্যান্য শহরে। চরাঞ্চলে বসবাসরত ১ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকাও হুমকির সম্মুখীন। অপরিকল্পিত বাঁধ ও উড়াল সড়ক নির্মাণের ফলে হুমকির মুখে পড়েছে হাওড় অঞ্চলও। ফলে, মৎস্য সম্পদের পরিমাণও কমে যাচ্ছে। কৃষি, প্রকৃতি ও পরিবেশ হচ্ছে বিপন্ন। নদী গবেষকদের মতে, নদী কখনো একা মরে না। নদীর মৃত্যু হলে পাড়ের জনপদও একটু একটু করে মরতে শুরু করে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ‘বিশ্ব নদী দিবস’ পালন করা হয়। নদী রক্ষায় বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হয় বিশ্ব নদী দিবস। দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য মানুষকে নদী রক্ষায় সচেতন করা। নদী রক্ষার তৎপরতা গোটা পৃথিবী জুড়েই এমন কার্যক্রম দেখা যায়। তবে আমাদের দেশে নদী ও মানুষের জীবন অবিচ্ছেদ্য হওয়ায় নদী নিয়ে পরিবেশবাদীসহ সাধারণ মানুষের উদ্বেগ রয়েছে।
নদী বিশেষজ্ঞ ইনামুল হক বলেন , ‘গ্রাম থেকে শুরু করে শহর পর্যন্ত সবখানেই আমরা ময়লা-আবর্জনা সব নদীতে ফেলছি। শিল্প-কারখানার বর্জ্য গিয়ে পড়ছে নদীতে। উজান থেকে নেমে আসা পলি এসে পড়ছে নদীতে।ময়লা-আবর্জনার কারণে একদিকে যেমন জলজ প্রাণী হুমকিতে পড়ছে। অন্যদিকে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী ও পানি সম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই নদী নিয়ে সবার উদাসীনতা ও দেশে সামগ্রিক নদী প্রশাসনের চিত্র যে খুব ঘোলাটে সে কথাই উল্লেখ করছেন। দেশে গণতন্ত্র না থাকলে যে নদী দখলদারেরা খুবই নিরাপদ বোধ করে এটা ও উল্লেখ করেছেন। চলমান নদী কমিশনের উদাসীনতাকে ও এর পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে আমি মনে করি।
বাংলাদেশের নদী কমিশনের প্রধান দায়িত্ব হলো দেশের নদীগুলোকে সুরক্ষিত রাখা, তাদের প্রবাহ স্বাভাবিক রাখা এবং নদী দখল ও দূষণ রোধ করা। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এই কমিশন তার কার্যক্রমে পুরোপুরি সফল হতে পারছে না। নদী কমিশনের ব্যর্থতার কিছু প্রধান কারণ হলো :
অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা : নদী কমিশনের বাজেট সীমিত এবং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের অভাব রয়েছে। পাশাপাশি প্রশাসনিক দক্ষতার অভাবও রয়েছে।
দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব : নদী দখল বা দূষণের মতো ইস্যুতে অনেক সময় রাজনৈতিক প্রভাব থাকে। ফলে, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অনেক সময় দখলদারি বজায় রাখতে পারে, এবং কমিশনের পদক্ষেপ কার্যকর হয় না।
আইন প্রয়োগের দুর্বলতা দেশের নদী রক্ষা সংক্রান্ত বিদ্যমান আইন থাকলেও তা প্রয়োগ দুর্বলতা রয়েছে। কমিশন অনেক সময় আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়, বিশেষ করে শক্তিশালী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।
জনসচেতনতার অভাব : জনগণের মাঝে নদী রক্ষা বা দূষণ প্রতিরোধের বিষয়ে পর্যাপ্ত সচেতনতা নেই। নদীর প্রতি মানুষের দায়িত্বশীল আচরণ বাড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত প্রচেষ্টা দেখা যায় না।
বহুবিধ সংস্থার সমন্বয়ের অভাব : নদী রক্ষার জন্য একাধিক সংস্থা কাজ করে, কিন্তু তাদের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় না থাকার ফলে কার্যক্রমে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং লক্ষ্য অর্জন হয় না।
নদী রক্ষা কমিশনের মতো একের পর প্রতিষ্ঠান গড়েছে সরকার, কিন্তু নদী রক্ষা করতে পারছে না। দিনে দিনে নদী, খাল-বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। যাতে করে অল্প বৃষ্টিতেই ছোট বড় সব শহর গ্রামে জলাবদ্ধতা ও জলোছ্বাস তৈরি হচ্ছে । এতে রাষ্ট্র কৃষিতে, অর্থনৈতিতে অবকাঠামো ও স্বাস্থ্যগত ভাবে অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে নদী কমিশনের করণীয়তাগুলো হওয়া উচিত ছিল নিম্নরূপ :
নদী ও খাল পুনঃখনন : জলাবদ্ধতা নিরসনে নদী ও খালের স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করা জরুরি। নদী কমিশনকে প্রয়োজনীয় এলাকায় নদী ও খাল পুনঃখননের ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে পানি দ্রুত নিষ্কাশিত হতে পারে।
নদী ও জলাশয় দখলমুক্ত করা : জলাবদ্ধতার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো নদী ও খাল দখল। নদী কমিশনকে এই দখলমুক্ত করতে তৎপর হতে হবে এবং পুনরায় দখল প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়ন : শহর ও গ্রামীণ এলাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থার সঙ্গে নদীর সঠিক সংযোগ স্থাপন করতে হবে, যাতে অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি দ্রুত নদীতে চলে যেতে পারে। নদী কমিশনকে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে।
নদী দূষণ নিয়ন্ত্রণ : নদীর পানি দূষণ হলে তার প্রবাহ ব্যাহত হয় এবং জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। নদী মিশনকে নদীর দূষণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে পানির প্রবাহ স্বাভাবিক থাকে।
সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা : নদী, খাল এবং জলাশয়গুলোর মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে পানি নিষ্কাশনের একটি সমন্বিত ব্যবস্থা গয়ে তোলা দরকার। এতে পানি দ্রুত নিষ্কাশিত হবে এবং জলাবদ্ধতার সমস্যা কমবে। নদী কমিশনকে এই ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে হবে।
বন্যা নিয়ন্ত্রণ : বন্যার সময় অতিরিক্ত পানি দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। নদী কমিশনকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এবং অন্যান্য প্রতিরোধমূলক অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করতে হবে।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি : নদী রক্ষার পাশাপাশি জলাবদ্ধতা প্রতিরোধে জনগণের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নদী কমিশনকে জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণকে নদী দখল ও দূষণ থেকে বিরত রাখতে হবে এবং তাদেরকে সচেতন করতে হবে। উপরোক্ত পদক্ষেপগুলোর মাধ্যমে নদী কমিশন জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।
এই ব্যর্থতাগুলো কাটিয়ে উঠতে কার্যকর আইন প্রয়োগ, সুশাসন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করা জরুরি। তা ছাড়া ও নদী রক্ষা কমিশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট, যৌথ নদী কমিশন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি টেকসই কর্মপরিকল্পনা হাতে নিতে হবে যাতে করে নদী তার আগের গতিপথ ফিরে পায় ।
দূষণ, দখল ও পয়ঃবর্জ্য নিষ্কাশন প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বাভাবিক নাব্য নদী ও নৌপথ গড়ে তুলতে হবে। দেশের মানুষ নদীর মালিকানা চায়, নদীর সব ব্যবহারকারীর কর্তৃত্ব সমন্বয়কারী চায়, জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা গ্রহণকারী চায়। নদীমাতৃক বাংলাদেশে জালের মতো বিছিয়ে থাকা নদীগুলো মালিকানার অভাবে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। আমার বিশ্বাস রাষ্ট্র নদী রক্ষায় উদ্যোগী হবে এবং কমিশনকে সংস্কার করবে।
[লেখক : ব্যাংকার ]
ফয়সাল বিন লতিফ
শনিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৪
বাংলাদেশ একটি নদী-নির্ভর দেশ। শত-সহস্র নদী-নালা, খাল-বিল জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গোটা দেশে। কিছুকাল আগ পর্যন্ত নদীই ছিল দেশবাসীর যোগাযোগের প্রধান পথ। নদীই ছিল ছোট্ট এই দেশটির বিচ্ছিন্নতা ও যোগাযোগের উপায়। সাধারণত পর্বত, উঁচু ভূমি, পাহাড়ের গিরিখাত থেকে সৃষ্ট ঝরণাধারা, বরফগলিত স্রোত কিংবা প্রাকৃতিক পরিবর্তন থেকে নদীর জন্ম। বাংলাদেশ হিমালয় থেকে প্রবাহিত নদীগুলোর মধ্য দিয়ে বাহিত পলি দ্বারা গঠিত একটি সক্রিয় ব-দ্বীপ। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ ‘নদীর দেশ’ নামে পরিচিত। তাই বাংলাদেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। অগণিত গ্রামীণ বাংলাদেশির জীবন-জীবিকা নদীর ওপর নির্ভরশীল। আমাদের দেশে মোট ৭০০টি নদী প্রবাহিত এবং এর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪ হাজার ১৪০ কিলোমিটার। এগুলো নদী, পাহাড়ি স্রোত, ঘূর্ণায়মান মৌসুমি খাড়ি এবং খাল নিয়ে গঠিত, যা দেশের মোট ভূপৃষ্ঠের প্রায় ৭ শতাংশ গঠন করে এবং এগুলো দেশের বেশিরভাগ অংশকে জলপথের বিচিত্র নেটওয়ার্ক দ্বারা সংযুক্ত করে। বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে ৫৮টি আন্তঃসীমান্ত নদী প্রবাহিত হয়েছে। এদেশের দীর্ঘতম ও বৃহত্তম নদী মেঘনা ও অন্যান্য বড় নদীগুলো হলো পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলী, তিস্তা ইত্যাদি।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় গত ৫০ বছরে হারিয়ে গেছে প্রায় ৫০০ নদী। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব বলছে, এ পর্যন্ত হারিয়ে গেছে আট হাজার খাল-বিল। দখল-দূষণ ও ভাঙনের কারণে জীবিকা হারিয়ে প্রতি বছর বাস্তুচ্যুত ও অভিবাসী হচ্ছে পাঁচ লাখ মানুষ- যারা প্রবেশ করছে ঢাকা ও অন্যান্য শহরে। চরাঞ্চলে বসবাসরত ১ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকাও হুমকির সম্মুখীন। অপরিকল্পিত বাঁধ ও উড়াল সড়ক নির্মাণের ফলে হুমকির মুখে পড়েছে হাওড় অঞ্চলও। ফলে, মৎস্য সম্পদের পরিমাণও কমে যাচ্ছে। কৃষি, প্রকৃতি ও পরিবেশ হচ্ছে বিপন্ন। নদী গবেষকদের মতে, নদী কখনো একা মরে না। নদীর মৃত্যু হলে পাড়ের জনপদও একটু একটু করে মরতে শুরু করে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ‘বিশ্ব নদী দিবস’ পালন করা হয়। নদী রক্ষায় বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হয় বিশ্ব নদী দিবস। দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য মানুষকে নদী রক্ষায় সচেতন করা। নদী রক্ষার তৎপরতা গোটা পৃথিবী জুড়েই এমন কার্যক্রম দেখা যায়। তবে আমাদের দেশে নদী ও মানুষের জীবন অবিচ্ছেদ্য হওয়ায় নদী নিয়ে পরিবেশবাদীসহ সাধারণ মানুষের উদ্বেগ রয়েছে।
নদী বিশেষজ্ঞ ইনামুল হক বলেন , ‘গ্রাম থেকে শুরু করে শহর পর্যন্ত সবখানেই আমরা ময়লা-আবর্জনা সব নদীতে ফেলছি। শিল্প-কারখানার বর্জ্য গিয়ে পড়ছে নদীতে। উজান থেকে নেমে আসা পলি এসে পড়ছে নদীতে।ময়লা-আবর্জনার কারণে একদিকে যেমন জলজ প্রাণী হুমকিতে পড়ছে। অন্যদিকে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী ও পানি সম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই নদী নিয়ে সবার উদাসীনতা ও দেশে সামগ্রিক নদী প্রশাসনের চিত্র যে খুব ঘোলাটে সে কথাই উল্লেখ করছেন। দেশে গণতন্ত্র না থাকলে যে নদী দখলদারেরা খুবই নিরাপদ বোধ করে এটা ও উল্লেখ করেছেন। চলমান নদী কমিশনের উদাসীনতাকে ও এর পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে আমি মনে করি।
বাংলাদেশের নদী কমিশনের প্রধান দায়িত্ব হলো দেশের নদীগুলোকে সুরক্ষিত রাখা, তাদের প্রবাহ স্বাভাবিক রাখা এবং নদী দখল ও দূষণ রোধ করা। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এই কমিশন তার কার্যক্রমে পুরোপুরি সফল হতে পারছে না। নদী কমিশনের ব্যর্থতার কিছু প্রধান কারণ হলো :
অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা : নদী কমিশনের বাজেট সীমিত এবং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের অভাব রয়েছে। পাশাপাশি প্রশাসনিক দক্ষতার অভাবও রয়েছে।
দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব : নদী দখল বা দূষণের মতো ইস্যুতে অনেক সময় রাজনৈতিক প্রভাব থাকে। ফলে, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অনেক সময় দখলদারি বজায় রাখতে পারে, এবং কমিশনের পদক্ষেপ কার্যকর হয় না।
আইন প্রয়োগের দুর্বলতা দেশের নদী রক্ষা সংক্রান্ত বিদ্যমান আইন থাকলেও তা প্রয়োগ দুর্বলতা রয়েছে। কমিশন অনেক সময় আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়, বিশেষ করে শক্তিশালী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।
জনসচেতনতার অভাব : জনগণের মাঝে নদী রক্ষা বা দূষণ প্রতিরোধের বিষয়ে পর্যাপ্ত সচেতনতা নেই। নদীর প্রতি মানুষের দায়িত্বশীল আচরণ বাড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত প্রচেষ্টা দেখা যায় না।
বহুবিধ সংস্থার সমন্বয়ের অভাব : নদী রক্ষার জন্য একাধিক সংস্থা কাজ করে, কিন্তু তাদের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় না থাকার ফলে কার্যক্রমে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং লক্ষ্য অর্জন হয় না।
নদী রক্ষা কমিশনের মতো একের পর প্রতিষ্ঠান গড়েছে সরকার, কিন্তু নদী রক্ষা করতে পারছে না। দিনে দিনে নদী, খাল-বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। যাতে করে অল্প বৃষ্টিতেই ছোট বড় সব শহর গ্রামে জলাবদ্ধতা ও জলোছ্বাস তৈরি হচ্ছে । এতে রাষ্ট্র কৃষিতে, অর্থনৈতিতে অবকাঠামো ও স্বাস্থ্যগত ভাবে অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে নদী কমিশনের করণীয়তাগুলো হওয়া উচিত ছিল নিম্নরূপ :
নদী ও খাল পুনঃখনন : জলাবদ্ধতা নিরসনে নদী ও খালের স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করা জরুরি। নদী কমিশনকে প্রয়োজনীয় এলাকায় নদী ও খাল পুনঃখননের ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে পানি দ্রুত নিষ্কাশিত হতে পারে।
নদী ও জলাশয় দখলমুক্ত করা : জলাবদ্ধতার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো নদী ও খাল দখল। নদী কমিশনকে এই দখলমুক্ত করতে তৎপর হতে হবে এবং পুনরায় দখল প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়ন : শহর ও গ্রামীণ এলাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থার সঙ্গে নদীর সঠিক সংযোগ স্থাপন করতে হবে, যাতে অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি দ্রুত নদীতে চলে যেতে পারে। নদী কমিশনকে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে।
নদী দূষণ নিয়ন্ত্রণ : নদীর পানি দূষণ হলে তার প্রবাহ ব্যাহত হয় এবং জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। নদী মিশনকে নদীর দূষণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে পানির প্রবাহ স্বাভাবিক থাকে।
সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা : নদী, খাল এবং জলাশয়গুলোর মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে পানি নিষ্কাশনের একটি সমন্বিত ব্যবস্থা গয়ে তোলা দরকার। এতে পানি দ্রুত নিষ্কাশিত হবে এবং জলাবদ্ধতার সমস্যা কমবে। নদী কমিশনকে এই ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে হবে।
বন্যা নিয়ন্ত্রণ : বন্যার সময় অতিরিক্ত পানি দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। নদী কমিশনকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এবং অন্যান্য প্রতিরোধমূলক অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করতে হবে।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি : নদী রক্ষার পাশাপাশি জলাবদ্ধতা প্রতিরোধে জনগণের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নদী কমিশনকে জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণকে নদী দখল ও দূষণ থেকে বিরত রাখতে হবে এবং তাদেরকে সচেতন করতে হবে। উপরোক্ত পদক্ষেপগুলোর মাধ্যমে নদী কমিশন জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।
এই ব্যর্থতাগুলো কাটিয়ে উঠতে কার্যকর আইন প্রয়োগ, সুশাসন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করা জরুরি। তা ছাড়া ও নদী রক্ষা কমিশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট, যৌথ নদী কমিশন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি টেকসই কর্মপরিকল্পনা হাতে নিতে হবে যাতে করে নদী তার আগের গতিপথ ফিরে পায় ।
দূষণ, দখল ও পয়ঃবর্জ্য নিষ্কাশন প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বাভাবিক নাব্য নদী ও নৌপথ গড়ে তুলতে হবে। দেশের মানুষ নদীর মালিকানা চায়, নদীর সব ব্যবহারকারীর কর্তৃত্ব সমন্বয়কারী চায়, জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা গ্রহণকারী চায়। নদীমাতৃক বাংলাদেশে জালের মতো বিছিয়ে থাকা নদীগুলো মালিকানার অভাবে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। আমার বিশ্বাস রাষ্ট্র নদী রক্ষায় উদ্যোগী হবে এবং কমিশনকে সংস্কার করবে।
[লেখক : ব্যাংকার ]