গাজী তারেক আজিজ
আইন পেশায় নিয়োজিত থাকার আগে একটি শব্দ আগে মাঝেমধ্যে শুনতে পেতাম, দেশের উচ্চ আদালত তথা বিচারক ‘বিব্রত’ হয়েছেন। এই বিব্রত বোধ করার অর্থ হচ্ছে তিনি বা তার আদালতে নির্দিষ্ট মামলাটি আর শুনানি কিংবা রায় ও আদেশ প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। এর অর্থ হচ্ছে নিজেকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এবং হাইকোর্ট বিভাগ এর ক্ষেত্রে এই অবারিত স্বাধীনতা রয়েছে। কোন মামলা শোনার বা না শোনার। অতীতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ক্ষেত্রে তেমনটা দেখা গেছে। এই অবস্থায়ও বিচারবিভাগ মর্যাদার আসনে সমুন্নত ছিল, যা ছিল গর্বের ও গৌরবের। ব্যক্তিজীবনে আমাদের সামনে অনেক ঘটনার অবতারণা ঘটে যাতে আমরাও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। সেক্ষেত্রে যিনি মনে করছেন বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক বিবেচনায় বিব্রতকর তিনি স্থান ত্যাগ করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। মনোদৈহিক চাপ হালকা করতে তিনি ঘটনা এড়িয়ে যেতেন। বাংলাদেশে ঘটনাবহুল অনেককিছু রয়েছে যে পরিস্থিতিতে বিব্রত হওয়ার বোধবুদ্ধি কাজ করে না। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে যায় কি করলে সে পরিস্থিতি এড়ানো যায়। তারপরও মানুষ বিব্রত হতেন। আমরা বিব্রত হতাম। এই যেমন সরকারি চাকরিজীবী কিংবা সাংবিধানিক পদসমূহে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিও যখন দলীয় লেজুড়বৃত্তির অংশ হয়ে রাজনীতিবিদদের সন্তুষ্ট করে চলেন তখন বিষয়টি বেশ বিব্রতকর। যদিও তার বোধদয় হয় না, আদতে তিনি কী করছেন! এ জাতীয় ব্যক্তির কিংবা ব্যক্তিবর্গের দেখাদেখি আরও অনেকেই তেমন আচরণ করেন। অনেকক্ষেত্রে করতে বাধ্যও হয়ে থাকেন। কারণ পদ-পদবি কিংবা আরেক অনাহুত পরিস্থিতি এড়ানোর লক্ষ্যে কেউ কেউ একটু আধটু তোষামোদি করেন বটে। যেমনÑ একজন রাজনীতিক এমপি-মন্ত্রী হয়ে যখন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকেন সেক্ষেত্রে উক্ত প্রতিষ্ঠান প্রধান যদি কথিত সেই নেতার বিরাগভাজন হন তবে তার জন্য কাজ করা দুরূহ। আর ঠিক এই সুযোগ নিয়ে অন্য একজন অপেক্ষাকৃত অযোগ্য লোক স্থলাভিষিক্ত হয়ে যান। আর তিনি পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে রাখতে যাচ্ছেতাই লোক দিয়ে ভদ্র নম্র ও নিরীহ গোচের লোকদের অপমান-অপদস্ত করতেও ছাড়েন না। ক্রমেই পরিস্থিতি জটিল হতে থাকে। সবার মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন। সেই বিব্রতকর পরিস্থিতি সামাল দিতে। এই সামাল দিতে দিতে মানুষও সয়ে যায়। অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। একসময় এটাই আবার রীতি হয়ে যায়। ধারাবাহিকতায় নজির বা প্রথা মনে করতে থাকে, যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য মান্য হয়ে যায়। যদিও অনেকেই তেমন প্রথা মানতে চান না। যারা মানতে চান না তাদের আবার বিপ্লবী আখ্যা দেয়া হয়। বিপ্লবী আখ্যা দিয়ে মূল স্রোতধারা থেকে দূরে সরিয়ে বিচ্যুত রাখা হয়। কার্যত তাদের প্রখর আত্মসম্মানবোধের কারণে এমনটা হয়ে থাকে। আদতে তারা বিপ্লবী নয়। তবে বিপ্লবী চেতনার ধারক। এই বিপ্লবী চেতনা তারা খ-িতরূপে ধীরে ধীরে মানুষের মনে জাগিয়ে তোলেন। আর এতেই কাজ হয়। যুগে যুগে বিভিন্ন কবি, লেখক, রাজনীতিক তাদের লেখায় বক্তৃতায় তেমন করে মন্ত্রনা দিয়ে যান। বলেই আমরা পাই বিপ্লবী চেতনা। প্রথাসিদ্ধ পথ না মাড়িয়ে কিংবা অতি রক্ষণশীল মনোভাব ঝেড়ে ফেলে জয় করেছেন মানুষের মন। যেমনÑ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের খুদিরাম বসু, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। আরও রয়েছেন সামাজিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল প্রমুখ। তারা যে যার যার অবস্থান থেকে লড়াই চালিয়ে গেছেন। জাগরণ এনে দিয়েছেন। কোন ব্যক্তিগত দোষারোপ থেকে এই বিব্রত হওয়ার কথা বলছি না। এই বিব্রত হওয়া পরবর্তী অনিবার্য সংঘাত হওয়ার ধ্বংসাত্মক পরিণতি থেকে রক্ষা পাওয়ার নিমিত্ত। আমরা দেখেছি শাসকগোষ্ঠী যখন রাষ্ট্রের সবকিছু কুক্ষিগত করতে চায়, জনতা তখন বিপ্লবী হয়ে ওঠে। ফুঁসে ওঠে। বিধ্বংসী হয়ে ওঠে। তাদের প্রতিবাদের ভাষা ব্যকরণ মেনে হয় না। তার মাত্রা কখনো কখনো কখনো দীর্ঘ অর্জনকেও ধূলিসাৎ করে মাটিতে মিশিয়ে দেয়। গুঁড়িয়ে দেয় সমুদয় ঐতিহ্য। তবে এই অতি বিক্ষুব্ধ মনোভাবও কখনো কখনো কখনো দেখি হয় হঠকারী। যখন টার্গেটেড পিপলকে আক্রান্ত করে সুনির্দিষ্ট কিছু অর্জনেকে টার্গেট করে ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠে তখনই প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে বিপ্লবী চেতনা। আর ঠিক এই কারণেই আমাদের বিব্রত হওয়া প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়। যেটা অতিঅত্যাবশকীয়ও বটে। অর্থাৎ আমরা কী করব, আর কী করব না; কী করা উচিত আর কী করা অনুচিতÑ আমরা যদি এই হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হই তবে সব অর্জন বৃথা যায়। ঢাকা পড়ে যায় ঠিক সেই সময়টা। যখন বাঁচা-মরার লড়াই হয়ে ছিল নির্দিষ্ট সেই সময়টুকু। তখন সফলতার স্থান দখলে নেয় দমন-পীড়ন। এরই মধ্যে যত ত্যাগ মানুষ হয়তো ভুলতে শুরু করে। এখন আমরা ঠিকই বিব্রত হতে ভুলে যাচ্ছি। কেন আমরা এত এত বেপরোয়া আচরণে অভ্যস্ত হচ্ছি? কে এত এত অসহিষ্ণু হচ্ছি আমরা? যেখানে সভ্য সমাজের মানুষ বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিব্রত হয়। আমরা ঠিক তার উল্টো। আর কত শতাব্দীর পর আমরা নিজেদের সভ্য সমাজের অংশ বলে দাবি করতে পারব? আমরা কেন বারবার দাবি আদায়ে আন্দোলনে নামতে হয়? কেন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ করতে হয়? কেন গণতন্ত্রে অভ্যস্ত হতে পারছি না। কেন রাষ্ট্রে কোন স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পারছি না? কেন ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ভর করে আমাদের রাজনীতিকদের ভেতর? আমরা সর্বদা মোড়কনির্ভর রাজনীতিতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায়-ই বা কি? কে আমাদের পথ বাতলে দেবে? এই যে এত এত প্রশ্নে ঘুরপাক খাচ্ছি, খাবি খাচ্ছি তা কি নিছক প্রশ্ন হয়েই থেকে যাবে? নাকি উত্তর আমাদের জানা আছে? যদি জানা থাকে কেন-ই বা প্রয়োগ করতে এত দ্বিধা আমাদের? আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী যেমন লাগামহীন কথা বলেন। একইরকমভাবে লাগামছাড়া কথা বলেন মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে নেতা-পাতিনেতা যে কেউ-ই। সেই লাগামহীন কথার লাগাম টানাও যেন দুঃসাধ্য ছিল। আজও তা-ই আছে। আছে বলেই তেমনি করে সেই লাগামহীন কথারও ব্যাপক শ্রোতা রয়েছে। সেই শ্রোতাকূল আবার কথার মর্ম-ধর্ম অনুধাবন করতে পারুক আর না পারুক সমানতালে করতালি বাজিয়ে নিজের স্বতঃস্ফূর্ততা জানান দিতেও মরিয়া। এই যদি হয় অবস্থা তবে আম-জনতা কী করে আর নিজেদের বিবেচনাবোধ প্রয়োগ করবে? আর তা-ই হয় বলে মানুষ সংক্ষুব্ধ হয়, বিক্ষোভে ফেটে পড়ে, রাজনীতিবিদে অনীহা তৈরি হয় জনমানুষের মনে। এরই ধারাবাহিকতায় মানুষ রাষ্ট্রীয় অনাচার মেনে নিতে নিতে চরম বৈরী ভাবাপন্ন হয়। আর হয় বলেই নির্বাচন বয়কট করে। আইনকানুন তোয়াক্কা করে না। সবাই যে যারযার মতো মনগড়া কথা বলে। চলাফেরা করে বুক টানটান করে। মিথ্যাচারে শামিল হয়। গুজব রটিয়ে ফায়দা তোলে। লাগাতার আন্দোলন হয়। সরকার দমন-পীড়ন করে। মানুষের ভয় কেটে যায়। গুপ্তহত্যা হয়। লাশ গুম হয়। পক্ষ-বিপক্ষ ধ্বংসে মেতে ওঠে। মালামাল লুট হয়। ব্যক্তিস্বার্থের চরিতার্থে শত্রু নিধনযজ্ঞ চলে। শুধু লাশ আর লাশ। আগুন আর আগুন। তারপরও আমরা চোখের আশ্রু সরাতে পারি না। আমরা দেখেও না দেখার ভান করে চলি। কিন্তু এতকিছুর পরও বিব্রত হই না। কারণ আমাদের শির অনেক উঁচুতে! আমরা নত হতে শিখিনি। তা-ই বিব্রত হতে শিখিনি। সভ্য হতে শিখিনি। আমরা জীবন্ত মানুষ মেরে লাশ নিয়ে উদ্যাম নৃত্য করি। আগুনে পুড়িয়ে কাবাব বানাই মানুষের মাংসের কাবাব! এখন আমাদের কিছুটা বিব্রত হতে শিখতে হবে। কিছু অনাচার, দুরাচার, কিছু বৈষম্য, কিছু বিভেদ দূর করতে হলেও আমাদের চাই নিজেকে ফিরে পাওয়ার অধিকার। নিজেকে ফিরে পেয়ে আমরা বাঁচিয়ে রাখতে চাই সমুদয় সুসময়। এই বিব্রত হওয়া অন্য কারো দ্বারা নয়। নিজে নিজে বিব্রত হওয়া অনেকটুকু হলেও ব্যক্তিজীবনে স্বস্তি দিতে পারে। সে আলোকে আমরা আমাদের অবস্থান পরিবর্তন করে উদার মনোভাবের মাধ্যমে জানান দিতে হবে ব্যক্তিগত লক্ষ্যের চেয়েও জাতীয় স্বার্থ আমাদের জন্য, জনমানুষের জন্য অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তা-ই আমরা যা সবসময় করতে চাই দুঃসাহস নিয়ে তা যদি দূরবর্তী কোন ক্ষতি ডেকে আনে সে-ই অবস্থা স্বীয় বিবেচনাপ্রসূত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে হলেও বিব্রতবোধ করে দূরে সরে গেলে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো হয়তো সম্ভব হবে।
[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]
গাজী তারেক আজিজ
সোমবার, ১১ নভেম্বর ২০২৪
আইন পেশায় নিয়োজিত থাকার আগে একটি শব্দ আগে মাঝেমধ্যে শুনতে পেতাম, দেশের উচ্চ আদালত তথা বিচারক ‘বিব্রত’ হয়েছেন। এই বিব্রত বোধ করার অর্থ হচ্ছে তিনি বা তার আদালতে নির্দিষ্ট মামলাটি আর শুনানি কিংবা রায় ও আদেশ প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। এর অর্থ হচ্ছে নিজেকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এবং হাইকোর্ট বিভাগ এর ক্ষেত্রে এই অবারিত স্বাধীনতা রয়েছে। কোন মামলা শোনার বা না শোনার। অতীতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ক্ষেত্রে তেমনটা দেখা গেছে। এই অবস্থায়ও বিচারবিভাগ মর্যাদার আসনে সমুন্নত ছিল, যা ছিল গর্বের ও গৌরবের। ব্যক্তিজীবনে আমাদের সামনে অনেক ঘটনার অবতারণা ঘটে যাতে আমরাও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। সেক্ষেত্রে যিনি মনে করছেন বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক বিবেচনায় বিব্রতকর তিনি স্থান ত্যাগ করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। মনোদৈহিক চাপ হালকা করতে তিনি ঘটনা এড়িয়ে যেতেন। বাংলাদেশে ঘটনাবহুল অনেককিছু রয়েছে যে পরিস্থিতিতে বিব্রত হওয়ার বোধবুদ্ধি কাজ করে না। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে যায় কি করলে সে পরিস্থিতি এড়ানো যায়। তারপরও মানুষ বিব্রত হতেন। আমরা বিব্রত হতাম। এই যেমন সরকারি চাকরিজীবী কিংবা সাংবিধানিক পদসমূহে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিও যখন দলীয় লেজুড়বৃত্তির অংশ হয়ে রাজনীতিবিদদের সন্তুষ্ট করে চলেন তখন বিষয়টি বেশ বিব্রতকর। যদিও তার বোধদয় হয় না, আদতে তিনি কী করছেন! এ জাতীয় ব্যক্তির কিংবা ব্যক্তিবর্গের দেখাদেখি আরও অনেকেই তেমন আচরণ করেন। অনেকক্ষেত্রে করতে বাধ্যও হয়ে থাকেন। কারণ পদ-পদবি কিংবা আরেক অনাহুত পরিস্থিতি এড়ানোর লক্ষ্যে কেউ কেউ একটু আধটু তোষামোদি করেন বটে। যেমনÑ একজন রাজনীতিক এমপি-মন্ত্রী হয়ে যখন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকেন সেক্ষেত্রে উক্ত প্রতিষ্ঠান প্রধান যদি কথিত সেই নেতার বিরাগভাজন হন তবে তার জন্য কাজ করা দুরূহ। আর ঠিক এই সুযোগ নিয়ে অন্য একজন অপেক্ষাকৃত অযোগ্য লোক স্থলাভিষিক্ত হয়ে যান। আর তিনি পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে রাখতে যাচ্ছেতাই লোক দিয়ে ভদ্র নম্র ও নিরীহ গোচের লোকদের অপমান-অপদস্ত করতেও ছাড়েন না। ক্রমেই পরিস্থিতি জটিল হতে থাকে। সবার মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন। সেই বিব্রতকর পরিস্থিতি সামাল দিতে। এই সামাল দিতে দিতে মানুষও সয়ে যায়। অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। একসময় এটাই আবার রীতি হয়ে যায়। ধারাবাহিকতায় নজির বা প্রথা মনে করতে থাকে, যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য মান্য হয়ে যায়। যদিও অনেকেই তেমন প্রথা মানতে চান না। যারা মানতে চান না তাদের আবার বিপ্লবী আখ্যা দেয়া হয়। বিপ্লবী আখ্যা দিয়ে মূল স্রোতধারা থেকে দূরে সরিয়ে বিচ্যুত রাখা হয়। কার্যত তাদের প্রখর আত্মসম্মানবোধের কারণে এমনটা হয়ে থাকে। আদতে তারা বিপ্লবী নয়। তবে বিপ্লবী চেতনার ধারক। এই বিপ্লবী চেতনা তারা খ-িতরূপে ধীরে ধীরে মানুষের মনে জাগিয়ে তোলেন। আর এতেই কাজ হয়। যুগে যুগে বিভিন্ন কবি, লেখক, রাজনীতিক তাদের লেখায় বক্তৃতায় তেমন করে মন্ত্রনা দিয়ে যান। বলেই আমরা পাই বিপ্লবী চেতনা। প্রথাসিদ্ধ পথ না মাড়িয়ে কিংবা অতি রক্ষণশীল মনোভাব ঝেড়ে ফেলে জয় করেছেন মানুষের মন। যেমনÑ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের খুদিরাম বসু, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। আরও রয়েছেন সামাজিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল প্রমুখ। তারা যে যার যার অবস্থান থেকে লড়াই চালিয়ে গেছেন। জাগরণ এনে দিয়েছেন। কোন ব্যক্তিগত দোষারোপ থেকে এই বিব্রত হওয়ার কথা বলছি না। এই বিব্রত হওয়া পরবর্তী অনিবার্য সংঘাত হওয়ার ধ্বংসাত্মক পরিণতি থেকে রক্ষা পাওয়ার নিমিত্ত। আমরা দেখেছি শাসকগোষ্ঠী যখন রাষ্ট্রের সবকিছু কুক্ষিগত করতে চায়, জনতা তখন বিপ্লবী হয়ে ওঠে। ফুঁসে ওঠে। বিধ্বংসী হয়ে ওঠে। তাদের প্রতিবাদের ভাষা ব্যকরণ মেনে হয় না। তার মাত্রা কখনো কখনো কখনো দীর্ঘ অর্জনকেও ধূলিসাৎ করে মাটিতে মিশিয়ে দেয়। গুঁড়িয়ে দেয় সমুদয় ঐতিহ্য। তবে এই অতি বিক্ষুব্ধ মনোভাবও কখনো কখনো কখনো দেখি হয় হঠকারী। যখন টার্গেটেড পিপলকে আক্রান্ত করে সুনির্দিষ্ট কিছু অর্জনেকে টার্গেট করে ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠে তখনই প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে বিপ্লবী চেতনা। আর ঠিক এই কারণেই আমাদের বিব্রত হওয়া প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়। যেটা অতিঅত্যাবশকীয়ও বটে। অর্থাৎ আমরা কী করব, আর কী করব না; কী করা উচিত আর কী করা অনুচিতÑ আমরা যদি এই হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হই তবে সব অর্জন বৃথা যায়। ঢাকা পড়ে যায় ঠিক সেই সময়টা। যখন বাঁচা-মরার লড়াই হয়ে ছিল নির্দিষ্ট সেই সময়টুকু। তখন সফলতার স্থান দখলে নেয় দমন-পীড়ন। এরই মধ্যে যত ত্যাগ মানুষ হয়তো ভুলতে শুরু করে। এখন আমরা ঠিকই বিব্রত হতে ভুলে যাচ্ছি। কেন আমরা এত এত বেপরোয়া আচরণে অভ্যস্ত হচ্ছি? কে এত এত অসহিষ্ণু হচ্ছি আমরা? যেখানে সভ্য সমাজের মানুষ বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিব্রত হয়। আমরা ঠিক তার উল্টো। আর কত শতাব্দীর পর আমরা নিজেদের সভ্য সমাজের অংশ বলে দাবি করতে পারব? আমরা কেন বারবার দাবি আদায়ে আন্দোলনে নামতে হয়? কেন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ করতে হয়? কেন গণতন্ত্রে অভ্যস্ত হতে পারছি না। কেন রাষ্ট্রে কোন স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পারছি না? কেন ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ভর করে আমাদের রাজনীতিকদের ভেতর? আমরা সর্বদা মোড়কনির্ভর রাজনীতিতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায়-ই বা কি? কে আমাদের পথ বাতলে দেবে? এই যে এত এত প্রশ্নে ঘুরপাক খাচ্ছি, খাবি খাচ্ছি তা কি নিছক প্রশ্ন হয়েই থেকে যাবে? নাকি উত্তর আমাদের জানা আছে? যদি জানা থাকে কেন-ই বা প্রয়োগ করতে এত দ্বিধা আমাদের? আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী যেমন লাগামহীন কথা বলেন। একইরকমভাবে লাগামছাড়া কথা বলেন মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে নেতা-পাতিনেতা যে কেউ-ই। সেই লাগামহীন কথার লাগাম টানাও যেন দুঃসাধ্য ছিল। আজও তা-ই আছে। আছে বলেই তেমনি করে সেই লাগামহীন কথারও ব্যাপক শ্রোতা রয়েছে। সেই শ্রোতাকূল আবার কথার মর্ম-ধর্ম অনুধাবন করতে পারুক আর না পারুক সমানতালে করতালি বাজিয়ে নিজের স্বতঃস্ফূর্ততা জানান দিতেও মরিয়া। এই যদি হয় অবস্থা তবে আম-জনতা কী করে আর নিজেদের বিবেচনাবোধ প্রয়োগ করবে? আর তা-ই হয় বলে মানুষ সংক্ষুব্ধ হয়, বিক্ষোভে ফেটে পড়ে, রাজনীতিবিদে অনীহা তৈরি হয় জনমানুষের মনে। এরই ধারাবাহিকতায় মানুষ রাষ্ট্রীয় অনাচার মেনে নিতে নিতে চরম বৈরী ভাবাপন্ন হয়। আর হয় বলেই নির্বাচন বয়কট করে। আইনকানুন তোয়াক্কা করে না। সবাই যে যারযার মতো মনগড়া কথা বলে। চলাফেরা করে বুক টানটান করে। মিথ্যাচারে শামিল হয়। গুজব রটিয়ে ফায়দা তোলে। লাগাতার আন্দোলন হয়। সরকার দমন-পীড়ন করে। মানুষের ভয় কেটে যায়। গুপ্তহত্যা হয়। লাশ গুম হয়। পক্ষ-বিপক্ষ ধ্বংসে মেতে ওঠে। মালামাল লুট হয়। ব্যক্তিস্বার্থের চরিতার্থে শত্রু নিধনযজ্ঞ চলে। শুধু লাশ আর লাশ। আগুন আর আগুন। তারপরও আমরা চোখের আশ্রু সরাতে পারি না। আমরা দেখেও না দেখার ভান করে চলি। কিন্তু এতকিছুর পরও বিব্রত হই না। কারণ আমাদের শির অনেক উঁচুতে! আমরা নত হতে শিখিনি। তা-ই বিব্রত হতে শিখিনি। সভ্য হতে শিখিনি। আমরা জীবন্ত মানুষ মেরে লাশ নিয়ে উদ্যাম নৃত্য করি। আগুনে পুড়িয়ে কাবাব বানাই মানুষের মাংসের কাবাব! এখন আমাদের কিছুটা বিব্রত হতে শিখতে হবে। কিছু অনাচার, দুরাচার, কিছু বৈষম্য, কিছু বিভেদ দূর করতে হলেও আমাদের চাই নিজেকে ফিরে পাওয়ার অধিকার। নিজেকে ফিরে পেয়ে আমরা বাঁচিয়ে রাখতে চাই সমুদয় সুসময়। এই বিব্রত হওয়া অন্য কারো দ্বারা নয়। নিজে নিজে বিব্রত হওয়া অনেকটুকু হলেও ব্যক্তিজীবনে স্বস্তি দিতে পারে। সে আলোকে আমরা আমাদের অবস্থান পরিবর্তন করে উদার মনোভাবের মাধ্যমে জানান দিতে হবে ব্যক্তিগত লক্ষ্যের চেয়েও জাতীয় স্বার্থ আমাদের জন্য, জনমানুষের জন্য অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তা-ই আমরা যা সবসময় করতে চাই দুঃসাহস নিয়ে তা যদি দূরবর্তী কোন ক্ষতি ডেকে আনে সে-ই অবস্থা স্বীয় বিবেচনাপ্রসূত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে হলেও বিব্রতবোধ করে দূরে সরে গেলে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো হয়তো সম্ভব হবে।
[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]