alt

উপ-সম্পাদকীয়

নবান্ন এবং বিশেষ কিছু ধানের কথা

জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস

: শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

এক সময় অগ্রহায়ণ মাসে নতুন বছর শুরু হতো। আমন ধান ঘরে তোলা হতো একই সময়ে। তাই নতুন বছরে নতুন ধান ঘরে তোলার সময় নবান্ন উৎসব পালন করা হতো। এখন নতুন বছর শুরু হয় বৈশাখ মাসে। তবুও আগের ঐতিহ্য বজায় রেখে নবান্ন উৎযাপন করা হয় অগ্রহায়ণ মাসেই।

সনাতনী সমাজে এ উৎসব কিছুটা তাদের মতো করে করা হয়। নতুন ধানের পায়েস বা সামর্থ্য মতো তৈরি করে আকর্ষণীয় কোনো খাবার গৃহদেবতা বা পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্য নিবেদন করা হয়। তারপরে নিজেরা হই-হুল্লোড় করে বাকি খাবারগুলো উপভোগ করে। মুসলিম সমাজও তাদের নিজস্ব ধর্মীয় আবেগ বজায় রেখে নতুন ধানের তৈরি করা সিন্নি মসজিদে দিয়ে থাকে। তারপরে অবশিষ্ট খাবার তোবারক হিসেবে পরিবারের সবাই মিলে উপভোগ করে। তবে এটা যে সব গৃহস্থ একই দিনে করে এমন নয়। যার যার সুবিধে মতো দিন দেখে নবান্ন উৎসব পালন করে থাকে।

একইভাবে পৌষ-পার্বণও পালন করা হয়ে থাকে। এ সমস্ত উৎসবে সাধারণত সরু এবং সুগন্ধি চালের খুবই কদর। এদের সুগন্ধ থাকতে পারে আবার নাও পারে। হাজার ধানের দেশ বাংলাদেশে জায়গা বিশেষে এক সময় এ ধরনের ধানের বেশ আবাদ করা হতো। সময়ের প্রয়োজনে এ ধরনের আবাদ কমে গেলেও এখনও বেশ কিছু জাত আগের মতোই চাষ হয়ে থাকে। যেমন কাটারিভোগ, চিনিগুঁড়া ইত্যাদি। কাটারিভোগের চিড়া প্রসিদ্ধ। হয়তো সেই কারণেই জাতিটি মাঠে এখনও টিকে আছে। প্রকৃত চিনিগুঁড়ার ফলন কম। তবে প্রায় একই রকম দেখতে বাজারে চিনিগুঁড়া হিসেবে বিক্রি করার জন্য ব্রি ধান-৩৪ এর আবাদ করা হয়। ব্রি ধান-৩৪ আবার যশোর অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা দেশি জাত খাসকানিতে উন্নত সংস্করণ। বাদশাভোগের উন্নত সংস্করণ হলো বিআর-৫ বা দুলাভোগ। স্বাদে-গন্ধে দুলাভোগ চিনিগুঁড়া থেকে কোনো অংশে কম না হলেও দুলাভোগ তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। সরু এবং সুগন্ধি চাল সাধারণত আমন বা শাইল মৌসুমে জন্মানো হয়।

কারণ এরা দিবালোক-সংবেদি; কিন্তু কিছু কিছু জাত আছে জন্মগতভাবেই বোরো মৌসুমের উপযোগী। যেমন টেপি বোরো (হবিগঞ্জ বোরো-২), পশুশাইল (হবিগঞ্জ বোরো-৬), রাতা বোরো ইত্যাদি। এগুলো এখনও হাওর অঞ্চলে বেশ জনপ্রিয়। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। অনেকে আফসোস করে থাকেন যে আধুনিক ধানের প্রতাপে পুরোনো দিনের মজাদার জাতগুলো নেই। আসলে প্রকৃতপক্ষে জাতগুলো মাঠে নেই; কিন্তু ব্রির জিন-ব্যাঙ্কে ঠিকই আছে। সেগুলোর কয়েকটি হচ্ছে- সাকর, সাগরদানা, নুনিয়া, চিনি সাগর, মেনি, তিলকাপুর, বিন্নাফুল, কালোভোগ, জাবসিরি, কালোগচি, চিনি সাক্কর, চিনি আতব, নয়নমণি, সাউবাইল, চিনিগুরি, কালোমালা, বেগুনমালা, গোপালভোগ, তুলসীমালা, জিরাবুটি, খিরসাবুটি, রাজবুট, সরুকামিনা, কামিনা সরু, দৈয়ারগুরু, প্রেমফুল, বেগুনবিচি, ইলাই, গুয়া মাসুরি, লুইনা, লাল সরু, চিনি কানাই, কালিজিরা (খাটো দানা), রাজভোগ, ফিলিপিন কাটারিভোগ, বাওইভোগ, বাওইঝাকি, জিরাভোগ (মোটা), চিনিগুঁড়া, তুলসীমালা, বাসমতি ৩৭০, উকনিমধু প্রভৃতি।

আরেকটি বিশেষায়িত ধানের গোষ্ঠী হলো বিন্নি ধান। পিঠে-পায়েস-ফিরনির জন্য বিশেষ উপযোগী হলো বিন্নি ধান। বিন্নি চালের ভাত আঠালো হয়ে থাকে। সিলেট অঞ্চলে এ ধানকে বিরইন বলা হয়। সমতল ও আদিবাসী সবাই এ ধানের চাল থেকে প্রস্তুত খাদ্যসামগ্রী পছন্দ করে থাকে। বিন্নি ধানের খই বেশ পরিচিত। এছাড়াও এই চালের কিছু ঔষধি গুণ আছে। আমাশয় নিরাময়ে বিন্নি চালের ভাত উপকারি। কালো বিন্নি অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট উপাদানসমৃদ্ধ। তাতশিল্পীরা কাপড়ের মাড় দেয়ার কাজে বিন্নি ধানের খই থেকে প্রস্তুতকৃত ম- ব্যবহার করে থাকে। সুগন্ধি ধানের মতো বিন্নি ধানও নিশ্চয়ই মাঠ থেকে হারিয়ে যাওয়ার পথে। তবে ব্রি-এর জিন-ব্যাঙ্কে হারিয়ে যাওয়া জাতগুলো সংরক্ষিত আছে। ব্রি-জিন ব্যাঙ্কে সংরক্ষিত বিন্নি ধানের জাতগুলো-বাইশ বিন্নি, কাইশা বিন্নি, কোহা বিন্নি, লাল বিন্নি, কালা বিন্নি, পুরা বিন্নি, কাশিয়া বিন্নি, বিন্নি ধান, খাগা বিন্নি, কাইক বিন্নি, শাইল বিন্নি, নেথা বিন্নি, আউশ গারা বিন্নি, নতা বিন্নি, সোহাগ বিন্নি, গারো বিন্নি, বিন্নি, আসি বিন্নি, আগুইন্যা বিন্নি, কুইচ্চা বিন্নি, লেদা বিন্নি, কাকইয়া বিন্নি, চন্দন বিন্নি, আঠা বিন্নি, গোহাটি বিন্নি, নেদ্রা বিন্নি, রাঙ্গা বিন্নি, দেশি বিন্নি, সোনা বিন্নি, সাদা বিন্নি, লতা বিন্নি, মারাকা বিন্নি, পাঙ্গা বিন্নি, বিন্নি পাগরে, খাশিয়া বিন্নি, চায়শা বিন্নি, ছিদিরা বিন্নি, ১১ বিন্নি, লালমোনা, মে মে বিন্নি, কালা বিন্নি, কুটকুট্টা বিন্নি, হরিণ বিন্নি, বিন্নি-১১, মর্তা ধান, ভাপই বিন্নি ধান, হরিণা বিন্নি, কালি বিন্নি, শর বিন্নি, রসা বিন্নি, মধু বিন্নি, হাইট্টা বিন্নি, শিনি বিন্নি, সাতকাটা বিন্নি, রসাইয়া বিন্নি, বর্ষাল বিন্নি, চান্দা বিন্নি, পুটি বিন্নি, আয়লা বিন্নি, বিন্নি ধান বাশরি, গরম বিন্নি, বিন্নি সাদা, কাঙ্গিরি বিন্নি, সাদা বিন্নি, বিন্নি ল্যাঙমেনো, বাক বিন্নি, লক্ষ্মী বিন্নি, খইয়া বিন্নি, রেঙ্গুই বিন্নি ধান, খযম বিন্নি, উচ্ছা বিন্নি, বিন্নি ধান সাদামোটা, জাকতন বিন্নি, লঙ্গাপুরা বিন্নি, হরি বিন্নি মোটা লাল, চলোক্কা বিন্নি, কুত্তসা বিন্নি, নোলা বিন্নি ধান, আশি বিন্নি, লঙ্কা পুরা বিন্নি, মেমে ব্লাক বিন্নি, লামু বিন্নি ধান, বিন্নি লঙ মোনা, সুন্দরী বিন্নি (মোট ৮৬টি)।

ব্রি থেকে বিন্নি জাতীয় কোনো ধানের জাত এখনও উদ্ভাবন করা সক্ষম হয়নি। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলায় জুম চাষের উপযোগী কিছু জাত নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে। এবারে বরিশালের বালাম চালের প্রসঙ্গ। বালাম চাল বরিশালের একেবারেই নিজস্ব বলে বলে মনে করা হয়। সরু এবং ক্ষেত্রবিশেষে সুগন্ধি এ চাল বৃহত্তর বরিশালের অহঙ্কারের সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত। মধ্যযুগের কবি বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গলে সুস্বাদু বালাম চালের কথা আছে। তবে ‘বালাম‘ নামটি প্রকৃত বাংলা নাম নয়। কারো কারো মতে বালাম শব্দটি পারসি ‘বালান্দ’ শব্দ থেকে এসেছে। বালান্দ অর্থ উঁচু। এ ধরনের সুদৃশ্য এবং সুস্বাদু ধানের আবাদ উঁচু জমিতে সীমাবদ্ধ ছিল। সেজন্যই বোধ হয় বালান্দের পরিবর্তিত উচ্চারণে বালাম বলে পরিচিতি পায়। মতান্তরে এই চাল বালাম নামক বেত- বাঁধাই নৌকায় করে চন্দ্রদ্বীপ (বরিশালের প্রাচীন নাম) থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হতো বলে বালাম চাল বলে পরিচিতি পায়। মজার কথা হলো বালাম নামে নির্দিষ্ট কোনো ধানের জাত নেই। এটি একটি গোষ্ঠীগত নাম। ব্রি-জিনব্যাঙ্কে প্রায় সাতষট্টি জাতের বালাম ধান আছে। এর মধ্যে চল্লিশটি শুধু বালাম আর সাতাশটি যেশো বালাম নামে রেকর্ড-খাতায় লিপিবদ্ধ করা আছে।

চল্লিশটি বালামের আবার বেশ কিছুর আলাদা আলাদা নাম আছে। যেমন খিরাইজলি, বাঁশফুল। সুদৃশ্য এবং সুস্বাদু হওয়ায় বালাম চালের প্রতি বিজ্ঞানীদের আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। তাই ধান-গবেষণার প্রথম লগ্নেই বালাম নিয়ে গবেষণার শুরু হয়। আমার জানামতে প্রথমে ঢাকায় এবং কিছু পরে বরিশালের সাগরদী গবেষণা খামারে প্রথম বালাম নিয়ে কাজ শুরু হয় সম্ভবত ১৯১৭ সালের দিকে। বরিশাল থেকে সংগ্রহ করা বালাম থেকে বাছাই করে ঢাকায় প্রথম যে জাত অবমুক্ত করা হয় সেটা হলো ঢাকা নং-১১। প্রচলিত নাম যেশো বালাম। এখন এই যেশো বালাম নামে বেশ কিছু বালাম জাত ব্রির সংগ্রহে আছে। এরপর বরিশাল থেকে বরিশাল নং-১, বরিশাল নং-২, বরিশাল নং-৩, বরিশাল নং-৪, বরিশাল নং-৫ ও বরিশাল নং-৬ ধানের জাত অবমুক্ত করা হয়। এগুলোর মধ্যে বরিশাল নং-১, বরিশাল নং-৩ এবং বরিশাল নং-৫ যথাক্রমে চিংড়িঘুশি (নাকি চিংড়িভূষি), খিরাইজলি এবং বাঁশফুল থেকে পিউর-লাইন সিলেকশনের মাধ্যমে উদ্ভাবন করা হয়। এগুলোই স্থানীয় উন্নত জাতের বালাম।

জাতগুলোর ফলন তুলনামূলক ভালো, হেক্টরে ৩.৫০ টন (বিঘাপ্রতি ১২ মণ)। কিন্তু আবাদের জন্য বরাদ্দকৃত সময় হলো জুন থেকে ডিসেম্বর। বেশ লম্বা সময়। তাই আধুনিক জাতের সাথে প্রতিযোগিতায় বালাম তার কৌলিন্য বজায় রাখতে পারেনি। সাথে সাথে বালাম নিয়ে গবেষণায় ভাটা পড়ে বা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর আবার সময় আসে বালাম নিয়ে কিছু করার। তাই এ সময়ের বিজ্ঞানীরা কিছু কিছু করে কাজ শুরু করে। তাই সূক্ষ্মভাবে এসব জাতের প্রথমে উদ্ভিদতাত্ত্বিক, পরে কৌলিতাত্ত্বিক বিস্তারিত গবেষণা করা হয়। এজন্য বায়োটেকনোলজির আধুনিকতম প্রযুক্তি (ডিএনএ ফিঙ্গার প্রিন্টিং) ও জটিল সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। দেখা গেছে সংগৃহীত অধিকাংশ বালাম বা যেশোবালাম জাতগুলোর মধ্যে কৌলিতাত্ত্বিক ব্যবধান আছে যা চাক্ষুস নির্ণয় করা অনেক সময় সম্ভব নয়।

যাই হোক, ব্রি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে বালাম জাতীয় ধানের জাতীয় ধান উদ্ভাবনের চেষ্টা ছিল। ফলে ১৯৭৭ সালে বোরো এবং আউশ মৌসুমে আবাদের জন্য ইরি-উদ্ভাবিত একটি কৌলিক সারি ওজ২০৫৩-৮৭-৩-১ বিআর৭ বা ব্রি বালাম নামে অবমুক্ত করা হয়। ফলন ছিল বোরো এবং আউশ মৌসুমের জন্য যথাক্রমে বিঘাপ্রতি ১৬ মণ এবং ১২ মণ। সময়ের প্রেক্ষাপটে মোটামুটি বালামের মতো দেখতে হলেও জাতটি কৃষকরা গ্রহণ করেনি।

২০১৫ সালের দিকে উদ্ভাবিত সরু ধানের জাত ব্রি ধান-৬৩ অনেকটা বালাম ধানের মতো বলে সরু বালাম বলে অভিহিত করা হয়। সম্প্রতি (২০২৪) বালাম-সংক্রান্ত গবেষণায় বেশ চমক এসেছে বলা যায়। নতুন উদ্ভাবিত জাত ব্রি ধান ১০৭, প্রিমিয়াম কোয়ালিটি সম্পন্ন উফশী বালাম জাতের বোরো ধান। জাতটি ২০১৫ সালে মাঠ থেকে সংগ্রহ করা জাত থেকে পিউর-লাইন সিলেকশনের প্রক্রিয়ায় উদ্ভাবিত।

বিশেষ এ ধান সবই দেশি জাতের। স্বাভাবিকভাবেই ফলন কম। সুখের কথা হলো বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার এগ্রিকালচার (বিনা), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বেশ কিছু উচ্চ ফলনশীল এবং সুদৃশ্য এবং সুগন্ধিযুক্ত উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। যেমন ব্রি উদ্ভাবিত ব্রি ধান-৫০ ইতোমধ্যেই বাংলামতী হিসেবে জনপ্রিয়তা হয়েছে। এছাড়াও ব্রি ধান-৭৫, ব্রি ধান-১০৩, ব্রি ধান-১০৪ এগুলো সরু এবং সুগন্ধিযুক্ত। বিনা উদ্ভাবিত বিনা ধান-২৫ অবিকল বাসমতির মতো দেখতে। ব্রি ধান-১০৩ এবং ব্রি ধান-১০৪ একই ধরনের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভাবিত একমাত্র হাইব্রিড ধানের জাতটি সুগন্ধিযুক্ত। ব্রি ধান-৮১ ব্রি ধান-১০৮ জিরাশাইলের মতো দেখতে।

এছাড়াও নবান্নের দিনে অনেকে মুড়ি, খই এবং চিড়ার উপযোগী ধানের খোঁজ করে থাকেন। এমনকি পিঠাপুলি, বিস্কুট ও নডুলস তৈরির উপযোগী ধানের জাত যে নেই তা নয়। উল্লেখ্য, নতুন স্বাদের নতুন রূপের জাতগুলো উদ্ভাবনের প্রয়োজনে জিনব্যাঙ্কে সংরক্ষিত জাতগুলো কাজে লাগানো হয়। তাই আধুনিক ধানের কারণে ঐতিহ্যবাহী জাতগুলো মাঠ থেকে হারিয়ে গেলেও সেগুলো কিন্তু নতুন প্রজন্মের কাছে নতুনরূপে ফিরে আসছে। তাই আমরা এখন থেকে না হয় নতুন সুদৃশ্য ও সুগন্ধি এবং উচ্চ ফলনশীল জাতগুলো দিয়েই নবান্ন উৎসব পালন করবো।

[লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট; সাবেক মহাপরিচালক, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন]

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

একটি সফর, একাধিক সংকেত : কে পেল কোন বার্তা?

দেশের কারা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ইসলামী ব্যাংক একীভূতকরণ : আস্থা ফেরাতে সংস্কার, না দায়মুক্তির প্রহসন?

রম্যগদ্য : চাঁদাবাজি চলছে, চলবে

বায়ুদূষণ : নীরব ঘাতক

ইসরায়েলের কৌশলগত ঔদ্ধত্য

পরিবার : সুনাগরিক ও সুশাসক তৈরির ভিত্তিমূল

শিল্পে গ্যাস সংকট : দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিন

আমাদের লড়াইটা আমাদের লড়তে দিন

ব্যাকবেঞ্চারদের পৃথিবী : ব্যর্থতার গায়ে সাফল্যের ছাপ

আমের অ্যানথ্রাকনোজ ও বোঁটা পঁচা রোগ

শিশুদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি : স্কুল ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা ও সংকট

প্রশিক্ষণ থেকে কেন বাদ নারী কৃষকরা?

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

tab

উপ-সম্পাদকীয়

নবান্ন এবং বিশেষ কিছু ধানের কথা

জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস

শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

এক সময় অগ্রহায়ণ মাসে নতুন বছর শুরু হতো। আমন ধান ঘরে তোলা হতো একই সময়ে। তাই নতুন বছরে নতুন ধান ঘরে তোলার সময় নবান্ন উৎসব পালন করা হতো। এখন নতুন বছর শুরু হয় বৈশাখ মাসে। তবুও আগের ঐতিহ্য বজায় রেখে নবান্ন উৎযাপন করা হয় অগ্রহায়ণ মাসেই।

সনাতনী সমাজে এ উৎসব কিছুটা তাদের মতো করে করা হয়। নতুন ধানের পায়েস বা সামর্থ্য মতো তৈরি করে আকর্ষণীয় কোনো খাবার গৃহদেবতা বা পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্য নিবেদন করা হয়। তারপরে নিজেরা হই-হুল্লোড় করে বাকি খাবারগুলো উপভোগ করে। মুসলিম সমাজও তাদের নিজস্ব ধর্মীয় আবেগ বজায় রেখে নতুন ধানের তৈরি করা সিন্নি মসজিদে দিয়ে থাকে। তারপরে অবশিষ্ট খাবার তোবারক হিসেবে পরিবারের সবাই মিলে উপভোগ করে। তবে এটা যে সব গৃহস্থ একই দিনে করে এমন নয়। যার যার সুবিধে মতো দিন দেখে নবান্ন উৎসব পালন করে থাকে।

একইভাবে পৌষ-পার্বণও পালন করা হয়ে থাকে। এ সমস্ত উৎসবে সাধারণত সরু এবং সুগন্ধি চালের খুবই কদর। এদের সুগন্ধ থাকতে পারে আবার নাও পারে। হাজার ধানের দেশ বাংলাদেশে জায়গা বিশেষে এক সময় এ ধরনের ধানের বেশ আবাদ করা হতো। সময়ের প্রয়োজনে এ ধরনের আবাদ কমে গেলেও এখনও বেশ কিছু জাত আগের মতোই চাষ হয়ে থাকে। যেমন কাটারিভোগ, চিনিগুঁড়া ইত্যাদি। কাটারিভোগের চিড়া প্রসিদ্ধ। হয়তো সেই কারণেই জাতিটি মাঠে এখনও টিকে আছে। প্রকৃত চিনিগুঁড়ার ফলন কম। তবে প্রায় একই রকম দেখতে বাজারে চিনিগুঁড়া হিসেবে বিক্রি করার জন্য ব্রি ধান-৩৪ এর আবাদ করা হয়। ব্রি ধান-৩৪ আবার যশোর অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা দেশি জাত খাসকানিতে উন্নত সংস্করণ। বাদশাভোগের উন্নত সংস্করণ হলো বিআর-৫ বা দুলাভোগ। স্বাদে-গন্ধে দুলাভোগ চিনিগুঁড়া থেকে কোনো অংশে কম না হলেও দুলাভোগ তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। সরু এবং সুগন্ধি চাল সাধারণত আমন বা শাইল মৌসুমে জন্মানো হয়।

কারণ এরা দিবালোক-সংবেদি; কিন্তু কিছু কিছু জাত আছে জন্মগতভাবেই বোরো মৌসুমের উপযোগী। যেমন টেপি বোরো (হবিগঞ্জ বোরো-২), পশুশাইল (হবিগঞ্জ বোরো-৬), রাতা বোরো ইত্যাদি। এগুলো এখনও হাওর অঞ্চলে বেশ জনপ্রিয়। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। অনেকে আফসোস করে থাকেন যে আধুনিক ধানের প্রতাপে পুরোনো দিনের মজাদার জাতগুলো নেই। আসলে প্রকৃতপক্ষে জাতগুলো মাঠে নেই; কিন্তু ব্রির জিন-ব্যাঙ্কে ঠিকই আছে। সেগুলোর কয়েকটি হচ্ছে- সাকর, সাগরদানা, নুনিয়া, চিনি সাগর, মেনি, তিলকাপুর, বিন্নাফুল, কালোভোগ, জাবসিরি, কালোগচি, চিনি সাক্কর, চিনি আতব, নয়নমণি, সাউবাইল, চিনিগুরি, কালোমালা, বেগুনমালা, গোপালভোগ, তুলসীমালা, জিরাবুটি, খিরসাবুটি, রাজবুট, সরুকামিনা, কামিনা সরু, দৈয়ারগুরু, প্রেমফুল, বেগুনবিচি, ইলাই, গুয়া মাসুরি, লুইনা, লাল সরু, চিনি কানাই, কালিজিরা (খাটো দানা), রাজভোগ, ফিলিপিন কাটারিভোগ, বাওইভোগ, বাওইঝাকি, জিরাভোগ (মোটা), চিনিগুঁড়া, তুলসীমালা, বাসমতি ৩৭০, উকনিমধু প্রভৃতি।

আরেকটি বিশেষায়িত ধানের গোষ্ঠী হলো বিন্নি ধান। পিঠে-পায়েস-ফিরনির জন্য বিশেষ উপযোগী হলো বিন্নি ধান। বিন্নি চালের ভাত আঠালো হয়ে থাকে। সিলেট অঞ্চলে এ ধানকে বিরইন বলা হয়। সমতল ও আদিবাসী সবাই এ ধানের চাল থেকে প্রস্তুত খাদ্যসামগ্রী পছন্দ করে থাকে। বিন্নি ধানের খই বেশ পরিচিত। এছাড়াও এই চালের কিছু ঔষধি গুণ আছে। আমাশয় নিরাময়ে বিন্নি চালের ভাত উপকারি। কালো বিন্নি অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট উপাদানসমৃদ্ধ। তাতশিল্পীরা কাপড়ের মাড় দেয়ার কাজে বিন্নি ধানের খই থেকে প্রস্তুতকৃত ম- ব্যবহার করে থাকে। সুগন্ধি ধানের মতো বিন্নি ধানও নিশ্চয়ই মাঠ থেকে হারিয়ে যাওয়ার পথে। তবে ব্রি-এর জিন-ব্যাঙ্কে হারিয়ে যাওয়া জাতগুলো সংরক্ষিত আছে। ব্রি-জিন ব্যাঙ্কে সংরক্ষিত বিন্নি ধানের জাতগুলো-বাইশ বিন্নি, কাইশা বিন্নি, কোহা বিন্নি, লাল বিন্নি, কালা বিন্নি, পুরা বিন্নি, কাশিয়া বিন্নি, বিন্নি ধান, খাগা বিন্নি, কাইক বিন্নি, শাইল বিন্নি, নেথা বিন্নি, আউশ গারা বিন্নি, নতা বিন্নি, সোহাগ বিন্নি, গারো বিন্নি, বিন্নি, আসি বিন্নি, আগুইন্যা বিন্নি, কুইচ্চা বিন্নি, লেদা বিন্নি, কাকইয়া বিন্নি, চন্দন বিন্নি, আঠা বিন্নি, গোহাটি বিন্নি, নেদ্রা বিন্নি, রাঙ্গা বিন্নি, দেশি বিন্নি, সোনা বিন্নি, সাদা বিন্নি, লতা বিন্নি, মারাকা বিন্নি, পাঙ্গা বিন্নি, বিন্নি পাগরে, খাশিয়া বিন্নি, চায়শা বিন্নি, ছিদিরা বিন্নি, ১১ বিন্নি, লালমোনা, মে মে বিন্নি, কালা বিন্নি, কুটকুট্টা বিন্নি, হরিণ বিন্নি, বিন্নি-১১, মর্তা ধান, ভাপই বিন্নি ধান, হরিণা বিন্নি, কালি বিন্নি, শর বিন্নি, রসা বিন্নি, মধু বিন্নি, হাইট্টা বিন্নি, শিনি বিন্নি, সাতকাটা বিন্নি, রসাইয়া বিন্নি, বর্ষাল বিন্নি, চান্দা বিন্নি, পুটি বিন্নি, আয়লা বিন্নি, বিন্নি ধান বাশরি, গরম বিন্নি, বিন্নি সাদা, কাঙ্গিরি বিন্নি, সাদা বিন্নি, বিন্নি ল্যাঙমেনো, বাক বিন্নি, লক্ষ্মী বিন্নি, খইয়া বিন্নি, রেঙ্গুই বিন্নি ধান, খযম বিন্নি, উচ্ছা বিন্নি, বিন্নি ধান সাদামোটা, জাকতন বিন্নি, লঙ্গাপুরা বিন্নি, হরি বিন্নি মোটা লাল, চলোক্কা বিন্নি, কুত্তসা বিন্নি, নোলা বিন্নি ধান, আশি বিন্নি, লঙ্কা পুরা বিন্নি, মেমে ব্লাক বিন্নি, লামু বিন্নি ধান, বিন্নি লঙ মোনা, সুন্দরী বিন্নি (মোট ৮৬টি)।

ব্রি থেকে বিন্নি জাতীয় কোনো ধানের জাত এখনও উদ্ভাবন করা সক্ষম হয়নি। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলায় জুম চাষের উপযোগী কিছু জাত নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে। এবারে বরিশালের বালাম চালের প্রসঙ্গ। বালাম চাল বরিশালের একেবারেই নিজস্ব বলে বলে মনে করা হয়। সরু এবং ক্ষেত্রবিশেষে সুগন্ধি এ চাল বৃহত্তর বরিশালের অহঙ্কারের সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত। মধ্যযুগের কবি বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গলে সুস্বাদু বালাম চালের কথা আছে। তবে ‘বালাম‘ নামটি প্রকৃত বাংলা নাম নয়। কারো কারো মতে বালাম শব্দটি পারসি ‘বালান্দ’ শব্দ থেকে এসেছে। বালান্দ অর্থ উঁচু। এ ধরনের সুদৃশ্য এবং সুস্বাদু ধানের আবাদ উঁচু জমিতে সীমাবদ্ধ ছিল। সেজন্যই বোধ হয় বালান্দের পরিবর্তিত উচ্চারণে বালাম বলে পরিচিতি পায়। মতান্তরে এই চাল বালাম নামক বেত- বাঁধাই নৌকায় করে চন্দ্রদ্বীপ (বরিশালের প্রাচীন নাম) থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হতো বলে বালাম চাল বলে পরিচিতি পায়। মজার কথা হলো বালাম নামে নির্দিষ্ট কোনো ধানের জাত নেই। এটি একটি গোষ্ঠীগত নাম। ব্রি-জিনব্যাঙ্কে প্রায় সাতষট্টি জাতের বালাম ধান আছে। এর মধ্যে চল্লিশটি শুধু বালাম আর সাতাশটি যেশো বালাম নামে রেকর্ড-খাতায় লিপিবদ্ধ করা আছে।

চল্লিশটি বালামের আবার বেশ কিছুর আলাদা আলাদা নাম আছে। যেমন খিরাইজলি, বাঁশফুল। সুদৃশ্য এবং সুস্বাদু হওয়ায় বালাম চালের প্রতি বিজ্ঞানীদের আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। তাই ধান-গবেষণার প্রথম লগ্নেই বালাম নিয়ে গবেষণার শুরু হয়। আমার জানামতে প্রথমে ঢাকায় এবং কিছু পরে বরিশালের সাগরদী গবেষণা খামারে প্রথম বালাম নিয়ে কাজ শুরু হয় সম্ভবত ১৯১৭ সালের দিকে। বরিশাল থেকে সংগ্রহ করা বালাম থেকে বাছাই করে ঢাকায় প্রথম যে জাত অবমুক্ত করা হয় সেটা হলো ঢাকা নং-১১। প্রচলিত নাম যেশো বালাম। এখন এই যেশো বালাম নামে বেশ কিছু বালাম জাত ব্রির সংগ্রহে আছে। এরপর বরিশাল থেকে বরিশাল নং-১, বরিশাল নং-২, বরিশাল নং-৩, বরিশাল নং-৪, বরিশাল নং-৫ ও বরিশাল নং-৬ ধানের জাত অবমুক্ত করা হয়। এগুলোর মধ্যে বরিশাল নং-১, বরিশাল নং-৩ এবং বরিশাল নং-৫ যথাক্রমে চিংড়িঘুশি (নাকি চিংড়িভূষি), খিরাইজলি এবং বাঁশফুল থেকে পিউর-লাইন সিলেকশনের মাধ্যমে উদ্ভাবন করা হয়। এগুলোই স্থানীয় উন্নত জাতের বালাম।

জাতগুলোর ফলন তুলনামূলক ভালো, হেক্টরে ৩.৫০ টন (বিঘাপ্রতি ১২ মণ)। কিন্তু আবাদের জন্য বরাদ্দকৃত সময় হলো জুন থেকে ডিসেম্বর। বেশ লম্বা সময়। তাই আধুনিক জাতের সাথে প্রতিযোগিতায় বালাম তার কৌলিন্য বজায় রাখতে পারেনি। সাথে সাথে বালাম নিয়ে গবেষণায় ভাটা পড়ে বা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর আবার সময় আসে বালাম নিয়ে কিছু করার। তাই এ সময়ের বিজ্ঞানীরা কিছু কিছু করে কাজ শুরু করে। তাই সূক্ষ্মভাবে এসব জাতের প্রথমে উদ্ভিদতাত্ত্বিক, পরে কৌলিতাত্ত্বিক বিস্তারিত গবেষণা করা হয়। এজন্য বায়োটেকনোলজির আধুনিকতম প্রযুক্তি (ডিএনএ ফিঙ্গার প্রিন্টিং) ও জটিল সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। দেখা গেছে সংগৃহীত অধিকাংশ বালাম বা যেশোবালাম জাতগুলোর মধ্যে কৌলিতাত্ত্বিক ব্যবধান আছে যা চাক্ষুস নির্ণয় করা অনেক সময় সম্ভব নয়।

যাই হোক, ব্রি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে বালাম জাতীয় ধানের জাতীয় ধান উদ্ভাবনের চেষ্টা ছিল। ফলে ১৯৭৭ সালে বোরো এবং আউশ মৌসুমে আবাদের জন্য ইরি-উদ্ভাবিত একটি কৌলিক সারি ওজ২০৫৩-৮৭-৩-১ বিআর৭ বা ব্রি বালাম নামে অবমুক্ত করা হয়। ফলন ছিল বোরো এবং আউশ মৌসুমের জন্য যথাক্রমে বিঘাপ্রতি ১৬ মণ এবং ১২ মণ। সময়ের প্রেক্ষাপটে মোটামুটি বালামের মতো দেখতে হলেও জাতটি কৃষকরা গ্রহণ করেনি।

২০১৫ সালের দিকে উদ্ভাবিত সরু ধানের জাত ব্রি ধান-৬৩ অনেকটা বালাম ধানের মতো বলে সরু বালাম বলে অভিহিত করা হয়। সম্প্রতি (২০২৪) বালাম-সংক্রান্ত গবেষণায় বেশ চমক এসেছে বলা যায়। নতুন উদ্ভাবিত জাত ব্রি ধান ১০৭, প্রিমিয়াম কোয়ালিটি সম্পন্ন উফশী বালাম জাতের বোরো ধান। জাতটি ২০১৫ সালে মাঠ থেকে সংগ্রহ করা জাত থেকে পিউর-লাইন সিলেকশনের প্রক্রিয়ায় উদ্ভাবিত।

বিশেষ এ ধান সবই দেশি জাতের। স্বাভাবিকভাবেই ফলন কম। সুখের কথা হলো বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার এগ্রিকালচার (বিনা), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বেশ কিছু উচ্চ ফলনশীল এবং সুদৃশ্য এবং সুগন্ধিযুক্ত উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। যেমন ব্রি উদ্ভাবিত ব্রি ধান-৫০ ইতোমধ্যেই বাংলামতী হিসেবে জনপ্রিয়তা হয়েছে। এছাড়াও ব্রি ধান-৭৫, ব্রি ধান-১০৩, ব্রি ধান-১০৪ এগুলো সরু এবং সুগন্ধিযুক্ত। বিনা উদ্ভাবিত বিনা ধান-২৫ অবিকল বাসমতির মতো দেখতে। ব্রি ধান-১০৩ এবং ব্রি ধান-১০৪ একই ধরনের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভাবিত একমাত্র হাইব্রিড ধানের জাতটি সুগন্ধিযুক্ত। ব্রি ধান-৮১ ব্রি ধান-১০৮ জিরাশাইলের মতো দেখতে।

এছাড়াও নবান্নের দিনে অনেকে মুড়ি, খই এবং চিড়ার উপযোগী ধানের খোঁজ করে থাকেন। এমনকি পিঠাপুলি, বিস্কুট ও নডুলস তৈরির উপযোগী ধানের জাত যে নেই তা নয়। উল্লেখ্য, নতুন স্বাদের নতুন রূপের জাতগুলো উদ্ভাবনের প্রয়োজনে জিনব্যাঙ্কে সংরক্ষিত জাতগুলো কাজে লাগানো হয়। তাই আধুনিক ধানের কারণে ঐতিহ্যবাহী জাতগুলো মাঠ থেকে হারিয়ে গেলেও সেগুলো কিন্তু নতুন প্রজন্মের কাছে নতুনরূপে ফিরে আসছে। তাই আমরা এখন থেকে না হয় নতুন সুদৃশ্য ও সুগন্ধি এবং উচ্চ ফলনশীল জাতগুলো দিয়েই নবান্ন উৎসব পালন করবো।

[লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট; সাবেক মহাপরিচালক, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন]

back to top