alt

উপ-সম্পাদকীয়

কে যাস রে ভাটির গাঙ বাইয়া

শেখর ভট্টাচার্য

: বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪
image

হাওর বা নদীর অপার সৌন্দর্যে মানুষ মুগ্ধ হয়, দার্শনিকও হয়ে ওঠেন কেউ কেউ

সুনামগঞ্জ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা সুরমা নদীর তীরে অনেক সন্ধ্যা কাটিয়েছি। ভাটির দেশ সুনামগঞ্জ। জল, জোৎস্নার জনপদ সুনামগঞ্জ। মানুষগুলোর মন বড় কোমল। সন্ধ্যা আর রাতের মাঝামাঝি সময়ে যখন দিগন্তে আলো-আঁধারির খেলা চলতে থাকে তখন সুরমা নদীর দিকে তাকিয়ে কেটে গেছে অনেক সন্ধ্যা। সন্ধ্যা কেটে রাত হয়েছে অগোচরেই। অফিসের কাজে ঘন ঘন যাওয়া হতো সুনামগঞ্জ, সারাদিন নানারকম মিটিং আর সন্ধ্যার পর সুরমা পারে একা একা বসে থাকা। সহকর্মীরা আমার জন্য অপেক্ষা করতেন, নৈশভোজে দেরি হতো বলে তারা কিছু বলতেন না, কিছুটা যে মন ক্ষুণœ হতেন তা আমি বুঝতে পারতাম।

নদীর পারেই মরমি কবি, সাধক ‘হাসন রাজা জাদুঘর’। সুনামগঞ্জের সুরমাকে অনেক তেজি, দুর্বিনীত মনে হয় তুলনায় সিলেটের সুরমা স্নিগ্ধ। সুনামগঞ্জে সুরমা প্রাণবন্ত । দুই শহর পারের সুরমার প্রকৃতি এবং সৌন্দর্যের দুটি অনন্য সত্বা রয়েছে। নদীর পারে বসে যখন মধ্য নদী এবং দুপারের কাছ ঘেঁষে ভেসে থাকা নৌকাগুলোর দিকে তাকাতাম, তখন প্রথম চোখে পড়ত ছৈয়ের ভেতরে থাকা কুপি বাতির দিকে। সিলেটি ভাষায় যার নাম ‘লেম’। মনে হয় ইংরেজি ‘ল্যাম্প’ শব্দ থেকে এসেছে। নৌকাগুলো এলোমেলোভাবে ভেসে থাকে, ভেসে থাকা নৌকার কুপির আলোতে জলের ভেতর আলোর মেলা। আকাশে যেমন তারার মেলা নদীর জলে তেমন কুপির আলোর মেলা।

বিভিন্ন হাওরের গ্রাম কিংবা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থকে আসা এসব নৌকার মাঝিদের দেখলেই মনে হয় সেই দূর গ্রামে বিয়ে হওয়া বোনের আকুতি মাখা সেই অমর সংগীতের কথা। যে বোন নদীর দিকে তাকিয়ে উদাসি হয়ে গান করে , প্রাণ আকুল করা গান, ‘কে যাস রে ভাটির গাঙ বাইয়া/আমার ভাইধন রে কইও নাইওর নিত বইলা............/তোরা কে যাস কে যাস/...’। সুনামগঞ্জের সুরমার পারে বসে মাঝিদের কাছ থেকে জানতে ইচ্ছে হয়, উজান দেশের কোন বোনের আকুতি কী তারা শুনেছে, কেউ কখনো। নিজ গ্রাম থেকে অনেক দূরের গ্রামে বিয়ে হওয়া বোনের ‘ভাইধনের’ বাড়িতে নাইওর আসার সেই আকুতি কী এখনো আছে, ঠিক জানি না।

জ্যোৎস্নায় সুরমার রূপ সৌন্দর্য আর আমাবস্যার অন্ধকারের সৌন্দর্যের মধ্যে অনেক তফাৎ আছে। সুরমার জলে জ্যোৎস্নার আলোর বন্যায় মন ভেসে যায় দূর হাওরের বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ কিংবা বর্ষাকালের থৈ থৈ উদাস করা জলে। জ্যোৎস্নার আলোয় হাওরের হিজল, করচ আর সুরমার জলে চাঁদের আলোর খেলা, মনে হয় স্বর্গীয় কোন দৃশ্য। চাঁদনি রাতে সুনামগঞ্জের শেষ প্রান্তে মেঘালয় পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে ছোট ছোট কুড়েঘরের ভেতরের কুপির আলো, মিটি মিটি তারার মতো চোখের সামনে এসে খেলা করে। নদী, হাওর, পাহাড়, হিজল, করচ, শিমুল গাছের সারি চাঁদের আলোয় এক সারিতে চলে আসে। চোখ খুলে যতটুকু দেখা যায় চোখ বন্ধ করে এর থেকে বেশি দেখা যায়। সৌন্দর্যে অবগাহন বলতে যা বুঝি সুনামগঞ্জের সুরমা পারে দিন কিংবা রাতে সেই অবগাহন ক্রমাগত চলতে থাকে।

আহা, কী অপরূপ জনপদ সুনামগঞ্জ। বর্ষায় সুরমার ছলাৎ, ছলাৎ স্রোতের শব্দের সঙ্গে এলোমেলো হাওয়ার পরশ। আকাশ জোড়া নকশি কাঁথায় সাজানো ফুলের মতো তারা। সেই তারা, আকাশ, চাঁদ আর হিজল করচের ছায়া খেলা করে নদীর জলে। সুরমা নদী যখন একটু এগিয়ে জাদু কাটা নদী হয়ে হাওরে মিশে যায় হাওরের বিস্তীর্ণ জলে জ্বলতে থাকে তারার ছায়া। এই অপরূপ দৃশ্য, সকাল, দুপুর, অপরাহ্ন হয়ে বিকেল, রাতে নানাভাবে পরিবর্তিত হতে থাকে। আমি শহুরে ভাগ্যবান মধ্যবিত্ত। বিভিন্ন ঋতু, বিভিন্ন সময়ে অসংখ্য হাওর, নদীতে প্রকৃতির নানা রূপকে কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। হাওর অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে এক বিশাল কর্মসূচির প্রধান হওয়ার কারণে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি হাওরে আমাকে যেতে হয়েছে। সুনামগঞ্জ থেকে পাড়ি দিতাম দিরাই, শাল্লা, তাহিরপুর হয়ে হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের অগণিত হাওরে। সুনামগঞ্জের নিকটবর্তী নদীগুলো যেমন দেখা হয়েছে একইভাবে চারটি হাওর জেলা সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জের সবগুলো হাওরকে দেখেছি মন, প্রাণ ভরে।

বিস্তীর্ণ জলরাশি দিয়ে ঘেরা এই জনপদে কেনো, এত মরমি কবি, সাধকের জন্ম হয়েছিলো। কুল, কিনারাহীন হাওরের মধ্য দিয়ে যখন নৌকা ভরা বর্ষায় এগোতে থাকে গন্তব্যে তখন এর উত্তর পাওয়া যায়। নিজেকে তখন একা লাগে না। মনে হয় বিশ্ব ব্রহ্মা-ের গ্রহ, নক্ষত্র, চন্দ্র, সূর্য সঙ্গে আছে। মনে নানা প্রশ্ন, কোন ‘মেস্তরি’ কোন ‘মহাজন’ এর কারিগর। সেই প্রশ্ন মানুষকে উদাস করে, ভাববাদী করে তোলে। ইহকালের এই জীবনকে বড় তুচ্ছ মনে হয়। ইহ জাগতিক নোংরা লোভ-লালসা, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, ধন-সম্পদ সব মনে হয় অর্থহীন। এসব কথা মনে আসাতেই লক্ষ একর জমির মালিক হাসন রাজা মানুষকে তার জমি, ধন-সম্পদ দান করে সন্তুষ্টি লাভ করেন। জীবন শূন্যে অবস্থানের মতন। শূন্যের ওপর ভেসে থাকা জীবন বড় নশ্বর। তখন তিনি গেয়ে উঠেছিলেন, ‘লোকে বলে বলেরে/ঘর-বাড়ি ভালা নাই আমার/কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরও মাঝার...’ এই যে জগত সম্পর্কে উদাসীনতা তার অনেক কিছু মরমি কবিরা লাভ করেন, প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য থেকে।

সুনামগঞ্জে জন্ম নিয়েছেন কত মরমি সাধক। একটি জেলায় এত মানুষ কী করে বাউল সাধক, মরমি কবি হয়ে ওঠেন। এরা আমাদের রহস্যময় এই জীবনের লোভ, লালসা থেকে দূরে সরে থাকার উপায় বলে গেছেন। জাগতিক হিংসা, হানাহানি, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব যে অতি নগণ্য তা আমরা তাদের জীবন এবং সৃষ্টিকর্ম পাঠ করে অনুধাবন করতে পারি। পাহাড়, নদী, জল, জোছনার এই জনপদে হাসন রাজা, শাহ আব্দুল করিমের পাশাপাশি পাই, রাধারমণ দত্ত, দুর্বিন শাহ, সৈয়দ শাহ নূর, শাহ আছদ আলী পীরসহ আরও অনেক গুণীজন। ত্যাগ যাদের জীবনের আদর্শ, মানুষকে ভালোবেসে যারা ঈশ্বর সান্নিধ্য পেতে চান, ভোগবিলাস যাদের কাছে অপ্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ সেসব মানুষের দেশে আমরা কী করে ক্ষমতা, অর্থ, বিত্ত, সম্পদের জন্য নিজেদের মধ্যে হানাহানিতে ক্রমাগত লিপ্ত থাকি? এ প্রশ্ন যে কোন সংবেদনশীল মানুষের মনে ঘুরে ফিরে আসতে থাকে।

এই যে কিংবদন্তি শাহ আব্দুল করিম যার জন্ম দিরাই উপজেলার গহিন গ্রাম উজান ধলে। গত শতাব্দীর অর্থাৎ ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি তার গান কথা বলে সব অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। তিনি তার গানের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন প্রখ্যাত বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ, পুঞ্জু শাহ এবং দুদ্দু শাহ এর দর্শন থেকে। যদিও দারিদ্র তাকে বাধ্য করে কৃষিকাজে তার শ্রম ব্যয় করতে কিন্তু কোনো কিছু তাকে মরমি গানের সাধনা থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। তিনি শরিয়তি, মারফতি, নব্যুয়ত, বেলায়াসহ সব ধরনের বাউল গান এবং গানের অন্যান্য শাখার চর্চাও করেছেন।

হাসন রাজা এত বড় জমিদার নন্দন (জন্ম-২১ ডিসেম্বর, ১৮৫৪-মৃত্যু ৬ ডিসেম্বর, ১৯২২)। লক্ষ, লক্ষ একর জমি। তিনি মরমি কবি এবং বাউল শিল্পী। তার মরমি সাধনা বাংলাদেশে দর্শন চেতনার সঙ্গে সংগীতের এক অসামান্য সংযোগ ঘটিয়েছে। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে লালন শাহ্রে প্রধান পথিকৃৎ হলেন হাসন রাজা। হাসনের পাশাপাশি একই পথে যারা সাধনা করে গেছেন তারা হলেন দুদ্দু শাহ্, পাঞ্জ শাহ্, পাগলা কানাই, রাধারমণ, আরকুম শাহ্, জালাল খাঁ এবং আরও অনেকে। দর্শনচেতনার নিরিখে লালনের পর যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নামটি আসে, তা হাসন রাজার।

হাওরবেষ্টিত সুনামগঞ্জের মতো বিচিত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এদেশের অনেক মানুষকে দার্শনিক করে গড়ে তুলেছে। ভোগের আনন্দ থেকে ত্যাগের মহিমা মানুষকে মহান করে তুলে তা আমাদের মরমি কবি দার্শনিকরা তাদের সব সৃষ্টি কর্মের মাধ্যমে বলে গেছেন। হাওর কিংবা নদীর অপার সৌন্দর্য, মানুষকে মানুষের অন্তরের কাছাকাছি নিয়ে যায়, মানুষের হৃদয়ে উদারতা জন্ম নেয়। সুবর্ণ ভূমিতে তাই একসময় অনেক মানবিক মানুষ এসেছেন, তাদের ত্যাগের মহিমা ছড়িয়ে পড়েছিল গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। লোভ, লালসা, ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ভরা প্রাত্যাহিক জীবনে চাই মানবিক মানুষ। যারা ভালোবাসা ছড়িয়ে দিয়ে জীবনকে বাউলের মতো করে গড়ে তুলবেন। যে স্বপ্ন একসময় দেখেছিলেন শাহ করিম, বলেছিলেন একদিন পৃথিবীটা বাউলের পৃথিবী হবে। মানবিক বাউলের আসবেন কী এই সুবর্ণ ভূমিতে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

জ্ঞানই শক্তি

বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস : জোর দিতে হবে প্রতিরোধে

ঋণ ব্যবস্থা : তেলা মাথায় ঢালো তেল, ন্যাড়া মাথায় ভাঙো বেল

বিচারকের ওপর হামলা কেন

বৈশ্বিক নিষ্ক্রিয়তার কবলে রোহিঙ্গা ইস্যু

আন্তর্জাতিক দাসপ্রথা বিলোপ দিবস

বৈষম্য ঘোচাতে চাই একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়

রাজনীতির মূল লক্ষ্য জনকল্যাণ

সমস্যার সূতিকাগার

ছবি

বাংলাদেশে আলু চাষে আধুনিক উৎপাদন পদ্ধতি

দলীয় লেজুড়বৃত্তির শিক্ষক রাজনীতি বন্ধের পথ কী?

ব্যাংক সংস্কার : কাটবে কি অন্ধকার?

ছবি

নিত্যপণ্যের দামে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস

রম্যগদ্য: ম্যাড় ম্যাড়ে সোনা-কাহিনী

রাষ্ট্র সংস্কারে পাঠাগার

কেন এত ধ্বংস, কেন এত মৃত্যু

জলবায়ু সম্মেলন থেকে আমরা কী পেলাম

উচ্চশিক্ষায় মান বজায় রাখার চ্যালেঞ্জ

ছবি

যানজট আর্থ-সামাজিক বিড়ম্বনাকে প্রকট করে তুলছে

যাচ্ছে দিন, বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা

ছবি

স্বপ্ন দেখতে তো ভুল নেই

ছবি

আহমদুল কবির : সাংবাদিকতা এবং রাজনীতিতে

ইতিহাসের কাছে মানুষ কী চায়?

আর্থিক সংকট কতটা গভীর

আদিবাসী নেতাদের দেখে নেয়ার হুমকি

সম্পত্তিতে এতিম নাতি-নাতনির অংশ ও বাস্তবতা

দলীয় লেজুড়বৃত্তির শিক্ষক রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব

বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন তত্ত্বের শতবর্ষ

প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো বাঁচানো জরুরি

রঙ্গব্যঙ্গ : শাব্বাশ বিটিভি, জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ

নবজাগরণ : সত্যিই কি জাতি জেগেছে?

গ্রামভিত্তিক কর্মসংস্থানে জোর দিতে হবে

লটারিতে ভর্তি : কবে দূর হবে সরকারি স্কুলগুলোর ‘করোনা মহামারী’?

ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য নীতি খুব একটা পরিবর্তন হবে কি

অবমূল্যায়ন, মুদ্রাস্ফীতি, মূল্যস্ফীতি এবং প্রাসঙ্গিক কিছু চিন্তা

মুজিব কি কেবলই ছবি

tab

উপ-সম্পাদকীয়

কে যাস রে ভাটির গাঙ বাইয়া

শেখর ভট্টাচার্য

image

হাওর বা নদীর অপার সৌন্দর্যে মানুষ মুগ্ধ হয়, দার্শনিকও হয়ে ওঠেন কেউ কেউ

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

সুনামগঞ্জ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা সুরমা নদীর তীরে অনেক সন্ধ্যা কাটিয়েছি। ভাটির দেশ সুনামগঞ্জ। জল, জোৎস্নার জনপদ সুনামগঞ্জ। মানুষগুলোর মন বড় কোমল। সন্ধ্যা আর রাতের মাঝামাঝি সময়ে যখন দিগন্তে আলো-আঁধারির খেলা চলতে থাকে তখন সুরমা নদীর দিকে তাকিয়ে কেটে গেছে অনেক সন্ধ্যা। সন্ধ্যা কেটে রাত হয়েছে অগোচরেই। অফিসের কাজে ঘন ঘন যাওয়া হতো সুনামগঞ্জ, সারাদিন নানারকম মিটিং আর সন্ধ্যার পর সুরমা পারে একা একা বসে থাকা। সহকর্মীরা আমার জন্য অপেক্ষা করতেন, নৈশভোজে দেরি হতো বলে তারা কিছু বলতেন না, কিছুটা যে মন ক্ষুণœ হতেন তা আমি বুঝতে পারতাম।

নদীর পারেই মরমি কবি, সাধক ‘হাসন রাজা জাদুঘর’। সুনামগঞ্জের সুরমাকে অনেক তেজি, দুর্বিনীত মনে হয় তুলনায় সিলেটের সুরমা স্নিগ্ধ। সুনামগঞ্জে সুরমা প্রাণবন্ত । দুই শহর পারের সুরমার প্রকৃতি এবং সৌন্দর্যের দুটি অনন্য সত্বা রয়েছে। নদীর পারে বসে যখন মধ্য নদী এবং দুপারের কাছ ঘেঁষে ভেসে থাকা নৌকাগুলোর দিকে তাকাতাম, তখন প্রথম চোখে পড়ত ছৈয়ের ভেতরে থাকা কুপি বাতির দিকে। সিলেটি ভাষায় যার নাম ‘লেম’। মনে হয় ইংরেজি ‘ল্যাম্প’ শব্দ থেকে এসেছে। নৌকাগুলো এলোমেলোভাবে ভেসে থাকে, ভেসে থাকা নৌকার কুপির আলোতে জলের ভেতর আলোর মেলা। আকাশে যেমন তারার মেলা নদীর জলে তেমন কুপির আলোর মেলা।

বিভিন্ন হাওরের গ্রাম কিংবা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থকে আসা এসব নৌকার মাঝিদের দেখলেই মনে হয় সেই দূর গ্রামে বিয়ে হওয়া বোনের আকুতি মাখা সেই অমর সংগীতের কথা। যে বোন নদীর দিকে তাকিয়ে উদাসি হয়ে গান করে , প্রাণ আকুল করা গান, ‘কে যাস রে ভাটির গাঙ বাইয়া/আমার ভাইধন রে কইও নাইওর নিত বইলা............/তোরা কে যাস কে যাস/...’। সুনামগঞ্জের সুরমার পারে বসে মাঝিদের কাছ থেকে জানতে ইচ্ছে হয়, উজান দেশের কোন বোনের আকুতি কী তারা শুনেছে, কেউ কখনো। নিজ গ্রাম থেকে অনেক দূরের গ্রামে বিয়ে হওয়া বোনের ‘ভাইধনের’ বাড়িতে নাইওর আসার সেই আকুতি কী এখনো আছে, ঠিক জানি না।

জ্যোৎস্নায় সুরমার রূপ সৌন্দর্য আর আমাবস্যার অন্ধকারের সৌন্দর্যের মধ্যে অনেক তফাৎ আছে। সুরমার জলে জ্যোৎস্নার আলোর বন্যায় মন ভেসে যায় দূর হাওরের বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ কিংবা বর্ষাকালের থৈ থৈ উদাস করা জলে। জ্যোৎস্নার আলোয় হাওরের হিজল, করচ আর সুরমার জলে চাঁদের আলোর খেলা, মনে হয় স্বর্গীয় কোন দৃশ্য। চাঁদনি রাতে সুনামগঞ্জের শেষ প্রান্তে মেঘালয় পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে ছোট ছোট কুড়েঘরের ভেতরের কুপির আলো, মিটি মিটি তারার মতো চোখের সামনে এসে খেলা করে। নদী, হাওর, পাহাড়, হিজল, করচ, শিমুল গাছের সারি চাঁদের আলোয় এক সারিতে চলে আসে। চোখ খুলে যতটুকু দেখা যায় চোখ বন্ধ করে এর থেকে বেশি দেখা যায়। সৌন্দর্যে অবগাহন বলতে যা বুঝি সুনামগঞ্জের সুরমা পারে দিন কিংবা রাতে সেই অবগাহন ক্রমাগত চলতে থাকে।

আহা, কী অপরূপ জনপদ সুনামগঞ্জ। বর্ষায় সুরমার ছলাৎ, ছলাৎ স্রোতের শব্দের সঙ্গে এলোমেলো হাওয়ার পরশ। আকাশ জোড়া নকশি কাঁথায় সাজানো ফুলের মতো তারা। সেই তারা, আকাশ, চাঁদ আর হিজল করচের ছায়া খেলা করে নদীর জলে। সুরমা নদী যখন একটু এগিয়ে জাদু কাটা নদী হয়ে হাওরে মিশে যায় হাওরের বিস্তীর্ণ জলে জ্বলতে থাকে তারার ছায়া। এই অপরূপ দৃশ্য, সকাল, দুপুর, অপরাহ্ন হয়ে বিকেল, রাতে নানাভাবে পরিবর্তিত হতে থাকে। আমি শহুরে ভাগ্যবান মধ্যবিত্ত। বিভিন্ন ঋতু, বিভিন্ন সময়ে অসংখ্য হাওর, নদীতে প্রকৃতির নানা রূপকে কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। হাওর অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে এক বিশাল কর্মসূচির প্রধান হওয়ার কারণে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি হাওরে আমাকে যেতে হয়েছে। সুনামগঞ্জ থেকে পাড়ি দিতাম দিরাই, শাল্লা, তাহিরপুর হয়ে হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের অগণিত হাওরে। সুনামগঞ্জের নিকটবর্তী নদীগুলো যেমন দেখা হয়েছে একইভাবে চারটি হাওর জেলা সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জের সবগুলো হাওরকে দেখেছি মন, প্রাণ ভরে।

বিস্তীর্ণ জলরাশি দিয়ে ঘেরা এই জনপদে কেনো, এত মরমি কবি, সাধকের জন্ম হয়েছিলো। কুল, কিনারাহীন হাওরের মধ্য দিয়ে যখন নৌকা ভরা বর্ষায় এগোতে থাকে গন্তব্যে তখন এর উত্তর পাওয়া যায়। নিজেকে তখন একা লাগে না। মনে হয় বিশ্ব ব্রহ্মা-ের গ্রহ, নক্ষত্র, চন্দ্র, সূর্য সঙ্গে আছে। মনে নানা প্রশ্ন, কোন ‘মেস্তরি’ কোন ‘মহাজন’ এর কারিগর। সেই প্রশ্ন মানুষকে উদাস করে, ভাববাদী করে তোলে। ইহকালের এই জীবনকে বড় তুচ্ছ মনে হয়। ইহ জাগতিক নোংরা লোভ-লালসা, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, ধন-সম্পদ সব মনে হয় অর্থহীন। এসব কথা মনে আসাতেই লক্ষ একর জমির মালিক হাসন রাজা মানুষকে তার জমি, ধন-সম্পদ দান করে সন্তুষ্টি লাভ করেন। জীবন শূন্যে অবস্থানের মতন। শূন্যের ওপর ভেসে থাকা জীবন বড় নশ্বর। তখন তিনি গেয়ে উঠেছিলেন, ‘লোকে বলে বলেরে/ঘর-বাড়ি ভালা নাই আমার/কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরও মাঝার...’ এই যে জগত সম্পর্কে উদাসীনতা তার অনেক কিছু মরমি কবিরা লাভ করেন, প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য থেকে।

সুনামগঞ্জে জন্ম নিয়েছেন কত মরমি সাধক। একটি জেলায় এত মানুষ কী করে বাউল সাধক, মরমি কবি হয়ে ওঠেন। এরা আমাদের রহস্যময় এই জীবনের লোভ, লালসা থেকে দূরে সরে থাকার উপায় বলে গেছেন। জাগতিক হিংসা, হানাহানি, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব যে অতি নগণ্য তা আমরা তাদের জীবন এবং সৃষ্টিকর্ম পাঠ করে অনুধাবন করতে পারি। পাহাড়, নদী, জল, জোছনার এই জনপদে হাসন রাজা, শাহ আব্দুল করিমের পাশাপাশি পাই, রাধারমণ দত্ত, দুর্বিন শাহ, সৈয়দ শাহ নূর, শাহ আছদ আলী পীরসহ আরও অনেক গুণীজন। ত্যাগ যাদের জীবনের আদর্শ, মানুষকে ভালোবেসে যারা ঈশ্বর সান্নিধ্য পেতে চান, ভোগবিলাস যাদের কাছে অপ্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ সেসব মানুষের দেশে আমরা কী করে ক্ষমতা, অর্থ, বিত্ত, সম্পদের জন্য নিজেদের মধ্যে হানাহানিতে ক্রমাগত লিপ্ত থাকি? এ প্রশ্ন যে কোন সংবেদনশীল মানুষের মনে ঘুরে ফিরে আসতে থাকে।

এই যে কিংবদন্তি শাহ আব্দুল করিম যার জন্ম দিরাই উপজেলার গহিন গ্রাম উজান ধলে। গত শতাব্দীর অর্থাৎ ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি তার গান কথা বলে সব অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। তিনি তার গানের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন প্রখ্যাত বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ, পুঞ্জু শাহ এবং দুদ্দু শাহ এর দর্শন থেকে। যদিও দারিদ্র তাকে বাধ্য করে কৃষিকাজে তার শ্রম ব্যয় করতে কিন্তু কোনো কিছু তাকে মরমি গানের সাধনা থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। তিনি শরিয়তি, মারফতি, নব্যুয়ত, বেলায়াসহ সব ধরনের বাউল গান এবং গানের অন্যান্য শাখার চর্চাও করেছেন।

হাসন রাজা এত বড় জমিদার নন্দন (জন্ম-২১ ডিসেম্বর, ১৮৫৪-মৃত্যু ৬ ডিসেম্বর, ১৯২২)। লক্ষ, লক্ষ একর জমি। তিনি মরমি কবি এবং বাউল শিল্পী। তার মরমি সাধনা বাংলাদেশে দর্শন চেতনার সঙ্গে সংগীতের এক অসামান্য সংযোগ ঘটিয়েছে। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে লালন শাহ্রে প্রধান পথিকৃৎ হলেন হাসন রাজা। হাসনের পাশাপাশি একই পথে যারা সাধনা করে গেছেন তারা হলেন দুদ্দু শাহ্, পাঞ্জ শাহ্, পাগলা কানাই, রাধারমণ, আরকুম শাহ্, জালাল খাঁ এবং আরও অনেকে। দর্শনচেতনার নিরিখে লালনের পর যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নামটি আসে, তা হাসন রাজার।

হাওরবেষ্টিত সুনামগঞ্জের মতো বিচিত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এদেশের অনেক মানুষকে দার্শনিক করে গড়ে তুলেছে। ভোগের আনন্দ থেকে ত্যাগের মহিমা মানুষকে মহান করে তুলে তা আমাদের মরমি কবি দার্শনিকরা তাদের সব সৃষ্টি কর্মের মাধ্যমে বলে গেছেন। হাওর কিংবা নদীর অপার সৌন্দর্য, মানুষকে মানুষের অন্তরের কাছাকাছি নিয়ে যায়, মানুষের হৃদয়ে উদারতা জন্ম নেয়। সুবর্ণ ভূমিতে তাই একসময় অনেক মানবিক মানুষ এসেছেন, তাদের ত্যাগের মহিমা ছড়িয়ে পড়েছিল গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। লোভ, লালসা, ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ভরা প্রাত্যাহিক জীবনে চাই মানবিক মানুষ। যারা ভালোবাসা ছড়িয়ে দিয়ে জীবনকে বাউলের মতো করে গড়ে তুলবেন। যে স্বপ্ন একসময় দেখেছিলেন শাহ করিম, বলেছিলেন একদিন পৃথিবীটা বাউলের পৃথিবী হবে। মানবিক বাউলের আসবেন কী এই সুবর্ণ ভূমিতে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

back to top