মিথুশিলাক মুরমু
সাঁওতালসহ আদিবাসীদের জমিজমা নিয়ে বিরোধের অন্ত নেই। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান কাপেং ফাউন্ডেশনের তথ্যানুযায়ী, ২০০৭-২০১৫ খ্রি. পর্যন্ত আট বছর সাঁওতালদের সঙ্গে ভূমিকেন্দ্রিক ৯০টি সংঘর্ষ হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ১৩০ জন আহত এবং ১৬ জন সাঁওতাল নিহত হয়েছেন। এরপর আরও অনেক বছর পেরিয়েছে, সংঘর্ষও হয়েছে। এবং হত্যার শিকারও হয়েছেন ৫-৭ জন। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ৬ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ জয়পুর-মাদারপুর সাঁওতাল পল্লীতে সংঘর্ষে ৩ জন শ্যামল, মঙ্গল ও রমেশ হত্যার শিকার হন। ২০২১ খ্রি. রাজশাহী
পুঠিয়া আটভাগ গ্রামের মেরিনা মার্ডীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। মৃতের স্বামী নরেন মারা-ী অনুমান করেছে, হত্যাকা-ের মূলে রয়েছে সম্পত্তির প্রাপ্তি প্রত্যাশা।
২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ২২ মার্চ রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার নিমঘুটু গ্রামের দুই আদিবাসী সাঁওতাল কৃষক অভিনাথ মার্ডী এবং রবি মার্ডী ধানখেতে পানি না পাওয়ায় কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করেন। গভীর নলকূপের অপারেটর সাখাওয়াত হোসেনের বিরুদ্ধে আত্মহত্যা প্ররোচনার মামলা করা হয়। আদিবাসী সাঁওতাল কৃষককে আত্মহত্যার মতো করুণ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছেন সাখাওয়াতসহ প্রতিবেশীরা। সর্বশেষ আদিবাসী সাঁওতাল হত্যার তালিকায় যুক্ত হলেন কান্দন সরেন, ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর উপজেলার ৪নং
ডাংগীপাড়া ইউনিয়নের শিহিপুর দামোল গ্রামের অধিবাসী।
আর কত রক্ত ঝরবে আদিবাসীদের সহায়-সম্পত্তি, জায়গা-জমি বা বসতভিটা রক্ষার্থে, আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে ন্যায় বিচার প্রাপ্তিতে; কিংবা আর কয়টি বসন্ত পেরুলে সাঁওতালসহ আদিবাসীরা পৈতৃক ভিটাতে শান্তিতে, নিরাপদে আনন্দে উচ্ছ্বাসে দিনাতিপাত করবে!
সর্ব উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁও, হরিপুর উপজেলার শিহিপুর দামোলে গত ২৭ নভেম্বর ভরদুপুরে দু’পক্ষের সংঘর্ষে জমিতেই মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েন কান্দন সরেন ।
জানা গেছে, কান্দন সরেন দাবি করেন জমিটি তার পৈতৃক সম্পত্তি। জমির সিএস রেকর্ডীয় মালিক ছিলেনÑ বিনোদন মুরমু, মসু হাঁসদা। খতিয়ান নং ১১৫ ও ১১৭; দাগ নং ১১৬, ১১৮, ১১৪, ১১৯, ১২১, ১২২; জমির পরিমাণ ৩৯ বিঘা। তবে এস এ খতিয়ানে রেকর্ডীয় মালিকের নামে রয়েছে অনিল কুমার কুন্ডু ও সুশীল কুমার কুন্ডু। উল্লেখিত জমির মালিকানা দাবি করেন বুধু হাঁসদা এবং কানদান সরেন। এসএ খতিয়ান মালিকানা ব্যক্তি দীর্ঘদিন অনুপস্থিতি কারণে সরকার অর্পিত সম্পত্তির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের বুধু হাঁসদা ও কান্দন সরেন বাংলাদেশ সরকার বাহাদুরের বিরুদ্ধে আদালতে মালিকানা দাবি করে মামলা রুজু করেন। দীর্ঘদিন মামলা পরিচালনার পর মামলার রায় ও ডিক্রি পান, অপরদিকে সরকার মামলা হাইকোর্টে আপিল করে। এরইমধ্যে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্থানীয় ভূমিহীন লোকজন সুদীর্ঘ বছর ধরে জমি চাষাবাদ ও ভোগদখল করতে থাকে। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় দলিল দস্তাবেজ ছাড়াই ৫০-৬০টি পরিবার নির্বিঘেœ সম্পত্তির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হোন।
২৭ নভেম্বর (বুধবার) শিহিপুর ও দামোল গ্রামের আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজন সমবেত হয়ে ওই জমি উদ্ধারের চেষ্টা চালালে বিবদমান গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। সম্পত্তির ওপর ঘর নির্মাণ করে থাকা ভূমিহীনরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালালে আদিবাসী সাঁওতালরা তীর-ধনুক ব্যবহারে উদ্যত হয়। দিবালোকের সংঘর্ষে কান্দন সরেন ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন, উভয়পক্ষের নারী-পুরুষ হতাহত হোন। আদিবাসী সাঁওতালরা জানান, দুই দুইবার কোর্ট থেকে রায় আনার পরেও তারা জমির দখল ছাড়েনি, আমরা বাধ্য হয়ে জমি দখলে যাই এবং এই ঘটনা ঘটে। মৃত কান্দন সরেন-এর পরিবারের সদস্য জানান, আমরা রেকর্ডীয় সূত্রে জমির মালিক যার কাগজ আমাদের কাছে রয়েছে কিন্তু গায়ের জোরে তারা জবর দখল করে খাচ্ছে। এই ঘটনার আমরা সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায় বিচার চাই।’ হরিপুর থানার ওসি মুহ. শরীফুল ইসলাম জানান, ‘বিতর্কের জমিটি অর্পিত সম্পত্তি। স্থানীয় ভূমিহীনরা ওই জমি দীর্ঘদিন যাবত ভোগ দখলে ছিলেন। আজকে আদিবাসী লোকজন জমির দখল নিতে আসলে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। লাশের সুরতহাল করা হয়েছে। কোনো পক্ষ এখনো অভিযোগ দেয়নি। লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, স্থানীয় থানায় মামলা হয়েছে।
আদিবাসী সাঁওতাল নারী-পুরুষ ও মালিকানা দাবিকারী বুধু হাঁসদা-এর সঙ্গে কথা বলে ধারণা হয়েছে যে, হত্যাকা- কিংবা সংঘর্ষ এড়ানো যেত নিশ্চিন্তে। জমির বিষয়ে দফায় দফায় থানা-পুলিশ, জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারের অফিসে যোগাযোগ করেছেন; প্রত্যেকেই আশ^স্ত করেছেন কিন্তু জমি বুঝিয়ে দেয়ার কাজে কেউই এগিয়ে আসেনি। আদিবাসী সাঁওতাল কৃষকের প্রতি ঔদাসীন্যতা যেমন প্রতীয়মান হয়েছে, সঠিক দায়িত্ব ও নৈতিকতার দিক থেকেও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারেন না। উত্তরবঙ্গে বসবাসরত ত্রিশোর্ধ্ব আদিবাসীরা বারংবার স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে
অভিযোগ উত্থাপন করে আসছে, সর্বদা উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। মনে করা হয়, আদিবাসীদের পশ্চাৎপদতা, নিরক্ষরতা, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টহীনতা বা অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার অভাবে কারও বিষয়েই কোনো কিছুই ফায়দা করতে পারবে না। এই বদ্ধ ধারণাটি প্রতিবেশীদের যেমন রয়েছে, প্রশাসনের ক্ষেত্রেও বোধকরি বিদ্যমান। উপযুক্ত সময়ে বিবদমান দুপক্ষের মধ্যে আলোচনা, বৈঠক কিংবা জমি বুঝিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা প্রক্রিয়াধীন থাকলে; অবশ্যই সংঘর্ষ এড়ানো যেতো; ঝরে পড়ত না কান্দন সরেনের জীবন। পৈতৃক জমিতে কান্দন সরেনের পড়ে থাকা নিথর মৃতদেহের ছবি সমগ্র উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের আতঙ্কগ্রস্ত ও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আবুল বারকাত গবেষণা করে বলেছেন, গত তিন প্রজন্মে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সাড়ে তিন লাখ বিঘা জমি বেহাত হয়ে গেছে যার বর্তমান বাজার মূল্য ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। ২০১৪ সালের মূল্যমানে দশ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ জমি-যাতি সমতল ভূমির আদিবাসীর হাত থেকে চলে গেছে অন্যের হাতে। তার মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকার উপরে ৫৩% হচ্ছে সাঁওতালদের। জমির ওপর তাদের গোষ্ঠীগত মালিকানা ছিল। জমির ওপর যখন ব্যক্তিগত মালিকানা না থাকে, তাহলে দলিল থাকার কথা না। দলিল নাই জমি আছে। এই জমি এক সময় বেশি দাম ছিল না। জমি দুষ্প্রাপ্য হওয়া শুরু করল তখন অ-আদিবাসী যারা তারা বুঝল যে এই জমির দলিল বানাইতে পারলে জমির মালিক হওয়া যায়। জাল দলিল ভুয়া দলির ইত্যাদি একটা বড় কারণ।’
সময়ের প্রেক্ষিতে আদিবাসীদের সুরক্ষায় প্রশাসনের সুদৃষ্টি ও বিশেষ যতœ নেয়া দরকার। অতীতের ইতিহাস ও আদিবাসীদের বৈশিষ্ট্যগুলো পর্যালোচনাপূর্বক এখনই উদ্যোগ গ্রহণ না করলে; আদিবাসীরা হারিয়ে যাবে। দেশের ও দশের স্বার্থেই, মানবাধিকার ও মানবিকতার স্বার্থেই আদিবাসীদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। ভূমিপুত্র আদিবাসীদের নিয়ে কবি টোকন ঠাকুর ‘টুডু সাঁওতাল’ কবিতায় লিখেছেনÑ‘দেহটা মাটিই, চোখ দুুটো রক্তজবা লাল/ এতদিন পর আমি কনফেস করিÑ/... বাঙালি জানে না, আমার চোখ দুটো কেন রক্তজবা লাল’।
[লেখক : কলামিস্ট ]
মিথুশিলাক মুরমু
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪
সাঁওতালসহ আদিবাসীদের জমিজমা নিয়ে বিরোধের অন্ত নেই। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান কাপেং ফাউন্ডেশনের তথ্যানুযায়ী, ২০০৭-২০১৫ খ্রি. পর্যন্ত আট বছর সাঁওতালদের সঙ্গে ভূমিকেন্দ্রিক ৯০টি সংঘর্ষ হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ১৩০ জন আহত এবং ১৬ জন সাঁওতাল নিহত হয়েছেন। এরপর আরও অনেক বছর পেরিয়েছে, সংঘর্ষও হয়েছে। এবং হত্যার শিকারও হয়েছেন ৫-৭ জন। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ৬ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ জয়পুর-মাদারপুর সাঁওতাল পল্লীতে সংঘর্ষে ৩ জন শ্যামল, মঙ্গল ও রমেশ হত্যার শিকার হন। ২০২১ খ্রি. রাজশাহী
পুঠিয়া আটভাগ গ্রামের মেরিনা মার্ডীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। মৃতের স্বামী নরেন মারা-ী অনুমান করেছে, হত্যাকা-ের মূলে রয়েছে সম্পত্তির প্রাপ্তি প্রত্যাশা।
২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ২২ মার্চ রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার নিমঘুটু গ্রামের দুই আদিবাসী সাঁওতাল কৃষক অভিনাথ মার্ডী এবং রবি মার্ডী ধানখেতে পানি না পাওয়ায় কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করেন। গভীর নলকূপের অপারেটর সাখাওয়াত হোসেনের বিরুদ্ধে আত্মহত্যা প্ররোচনার মামলা করা হয়। আদিবাসী সাঁওতাল কৃষককে আত্মহত্যার মতো করুণ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছেন সাখাওয়াতসহ প্রতিবেশীরা। সর্বশেষ আদিবাসী সাঁওতাল হত্যার তালিকায় যুক্ত হলেন কান্দন সরেন, ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর উপজেলার ৪নং
ডাংগীপাড়া ইউনিয়নের শিহিপুর দামোল গ্রামের অধিবাসী।
আর কত রক্ত ঝরবে আদিবাসীদের সহায়-সম্পত্তি, জায়গা-জমি বা বসতভিটা রক্ষার্থে, আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে ন্যায় বিচার প্রাপ্তিতে; কিংবা আর কয়টি বসন্ত পেরুলে সাঁওতালসহ আদিবাসীরা পৈতৃক ভিটাতে শান্তিতে, নিরাপদে আনন্দে উচ্ছ্বাসে দিনাতিপাত করবে!
সর্ব উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁও, হরিপুর উপজেলার শিহিপুর দামোলে গত ২৭ নভেম্বর ভরদুপুরে দু’পক্ষের সংঘর্ষে জমিতেই মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েন কান্দন সরেন ।
জানা গেছে, কান্দন সরেন দাবি করেন জমিটি তার পৈতৃক সম্পত্তি। জমির সিএস রেকর্ডীয় মালিক ছিলেনÑ বিনোদন মুরমু, মসু হাঁসদা। খতিয়ান নং ১১৫ ও ১১৭; দাগ নং ১১৬, ১১৮, ১১৪, ১১৯, ১২১, ১২২; জমির পরিমাণ ৩৯ বিঘা। তবে এস এ খতিয়ানে রেকর্ডীয় মালিকের নামে রয়েছে অনিল কুমার কুন্ডু ও সুশীল কুমার কুন্ডু। উল্লেখিত জমির মালিকানা দাবি করেন বুধু হাঁসদা এবং কানদান সরেন। এসএ খতিয়ান মালিকানা ব্যক্তি দীর্ঘদিন অনুপস্থিতি কারণে সরকার অর্পিত সম্পত্তির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের বুধু হাঁসদা ও কান্দন সরেন বাংলাদেশ সরকার বাহাদুরের বিরুদ্ধে আদালতে মালিকানা দাবি করে মামলা রুজু করেন। দীর্ঘদিন মামলা পরিচালনার পর মামলার রায় ও ডিক্রি পান, অপরদিকে সরকার মামলা হাইকোর্টে আপিল করে। এরইমধ্যে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্থানীয় ভূমিহীন লোকজন সুদীর্ঘ বছর ধরে জমি চাষাবাদ ও ভোগদখল করতে থাকে। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় দলিল দস্তাবেজ ছাড়াই ৫০-৬০টি পরিবার নির্বিঘেœ সম্পত্তির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হোন।
২৭ নভেম্বর (বুধবার) শিহিপুর ও দামোল গ্রামের আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজন সমবেত হয়ে ওই জমি উদ্ধারের চেষ্টা চালালে বিবদমান গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। সম্পত্তির ওপর ঘর নির্মাণ করে থাকা ভূমিহীনরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালালে আদিবাসী সাঁওতালরা তীর-ধনুক ব্যবহারে উদ্যত হয়। দিবালোকের সংঘর্ষে কান্দন সরেন ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন, উভয়পক্ষের নারী-পুরুষ হতাহত হোন। আদিবাসী সাঁওতালরা জানান, দুই দুইবার কোর্ট থেকে রায় আনার পরেও তারা জমির দখল ছাড়েনি, আমরা বাধ্য হয়ে জমি দখলে যাই এবং এই ঘটনা ঘটে। মৃত কান্দন সরেন-এর পরিবারের সদস্য জানান, আমরা রেকর্ডীয় সূত্রে জমির মালিক যার কাগজ আমাদের কাছে রয়েছে কিন্তু গায়ের জোরে তারা জবর দখল করে খাচ্ছে। এই ঘটনার আমরা সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায় বিচার চাই।’ হরিপুর থানার ওসি মুহ. শরীফুল ইসলাম জানান, ‘বিতর্কের জমিটি অর্পিত সম্পত্তি। স্থানীয় ভূমিহীনরা ওই জমি দীর্ঘদিন যাবত ভোগ দখলে ছিলেন। আজকে আদিবাসী লোকজন জমির দখল নিতে আসলে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। লাশের সুরতহাল করা হয়েছে। কোনো পক্ষ এখনো অভিযোগ দেয়নি। লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, স্থানীয় থানায় মামলা হয়েছে।
আদিবাসী সাঁওতাল নারী-পুরুষ ও মালিকানা দাবিকারী বুধু হাঁসদা-এর সঙ্গে কথা বলে ধারণা হয়েছে যে, হত্যাকা- কিংবা সংঘর্ষ এড়ানো যেত নিশ্চিন্তে। জমির বিষয়ে দফায় দফায় থানা-পুলিশ, জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারের অফিসে যোগাযোগ করেছেন; প্রত্যেকেই আশ^স্ত করেছেন কিন্তু জমি বুঝিয়ে দেয়ার কাজে কেউই এগিয়ে আসেনি। আদিবাসী সাঁওতাল কৃষকের প্রতি ঔদাসীন্যতা যেমন প্রতীয়মান হয়েছে, সঠিক দায়িত্ব ও নৈতিকতার দিক থেকেও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারেন না। উত্তরবঙ্গে বসবাসরত ত্রিশোর্ধ্ব আদিবাসীরা বারংবার স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে
অভিযোগ উত্থাপন করে আসছে, সর্বদা উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। মনে করা হয়, আদিবাসীদের পশ্চাৎপদতা, নিরক্ষরতা, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টহীনতা বা অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার অভাবে কারও বিষয়েই কোনো কিছুই ফায়দা করতে পারবে না। এই বদ্ধ ধারণাটি প্রতিবেশীদের যেমন রয়েছে, প্রশাসনের ক্ষেত্রেও বোধকরি বিদ্যমান। উপযুক্ত সময়ে বিবদমান দুপক্ষের মধ্যে আলোচনা, বৈঠক কিংবা জমি বুঝিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা প্রক্রিয়াধীন থাকলে; অবশ্যই সংঘর্ষ এড়ানো যেতো; ঝরে পড়ত না কান্দন সরেনের জীবন। পৈতৃক জমিতে কান্দন সরেনের পড়ে থাকা নিথর মৃতদেহের ছবি সমগ্র উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের আতঙ্কগ্রস্ত ও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আবুল বারকাত গবেষণা করে বলেছেন, গত তিন প্রজন্মে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সাড়ে তিন লাখ বিঘা জমি বেহাত হয়ে গেছে যার বর্তমান বাজার মূল্য ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। ২০১৪ সালের মূল্যমানে দশ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ জমি-যাতি সমতল ভূমির আদিবাসীর হাত থেকে চলে গেছে অন্যের হাতে। তার মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকার উপরে ৫৩% হচ্ছে সাঁওতালদের। জমির ওপর তাদের গোষ্ঠীগত মালিকানা ছিল। জমির ওপর যখন ব্যক্তিগত মালিকানা না থাকে, তাহলে দলিল থাকার কথা না। দলিল নাই জমি আছে। এই জমি এক সময় বেশি দাম ছিল না। জমি দুষ্প্রাপ্য হওয়া শুরু করল তখন অ-আদিবাসী যারা তারা বুঝল যে এই জমির দলিল বানাইতে পারলে জমির মালিক হওয়া যায়। জাল দলিল ভুয়া দলির ইত্যাদি একটা বড় কারণ।’
সময়ের প্রেক্ষিতে আদিবাসীদের সুরক্ষায় প্রশাসনের সুদৃষ্টি ও বিশেষ যতœ নেয়া দরকার। অতীতের ইতিহাস ও আদিবাসীদের বৈশিষ্ট্যগুলো পর্যালোচনাপূর্বক এখনই উদ্যোগ গ্রহণ না করলে; আদিবাসীরা হারিয়ে যাবে। দেশের ও দশের স্বার্থেই, মানবাধিকার ও মানবিকতার স্বার্থেই আদিবাসীদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। ভূমিপুত্র আদিবাসীদের নিয়ে কবি টোকন ঠাকুর ‘টুডু সাঁওতাল’ কবিতায় লিখেছেনÑ‘দেহটা মাটিই, চোখ দুুটো রক্তজবা লাল/ এতদিন পর আমি কনফেস করিÑ/... বাঙালি জানে না, আমার চোখ দুটো কেন রক্তজবা লাল’।
[লেখক : কলামিস্ট ]