রেজাউল করিম খোকন
হঠাৎ করে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন সবাই। কোনো আলোচনা না করে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি অবিবেচনাপ্রসূত। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে। নতুন করে সংকটে পড়বে ব্যবসা-বাণিজ্য।
মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধনী) অধ্যাদেশ-২০২৫-এর খসড়া সংসদবিষয়ক বিভাগের ভেটিং সাপেক্ষে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। দুই বছরের বেশি সময় ধরে যেখানে উ”চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, সেখানে এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
অন্তর্র্বর্তী সরকার করের আওতা না বাড়িয়ে কিংবা কর ফাঁকি রোধ করার ব্যবস্থা না করে সরল রাস্তার সমাধান হিসেবে ভ্যাট বাড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এতে নিশ্চিত করেই সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর চাপ আরও বাড়বে।
সরকারের এ সিদ্ধান্তের কারণে তৈরি পোশাক, এসি রেস্তোরাঁ, মিষ্টি, নন-এসি হোটেলসহ ৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বেড়ে ১৫ শতাংশ হতে পারে। অর্থ উপদেষ্টা আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে বলেছেন, ভ্যাট বাড়লেও জিনিসপত্রের দামের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না। অত্যাবশ্যকীয় সব পণ্যের শুল্ক কমিয়ে জিরো (শূন্য) করে দেওয়া হয়েছে। বাস্তবতা হলো যেসব পণ্যের ওপর কর কমানো বা শূন্য করা হয়েছে, সেসব পণ্যের দামও তো তেমন কমেনি।
ঋণের শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সব ক্ষেত্রে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ করার শর্ত দিয়েছে। সরকারের রাজস্ব আদায়ের বড় মাধ্যম হচ্ছে ভ্যাট। বর্তমানে ভ্যাট নিবন্ধন নেওয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫ লাখ ২৫ হাজার। এর মধ্যে গড়ে সাড়ে তিন লাখ প্রতিষ্ঠান নিয়মিত ভ্যাট দিয়ে থাকে। এর বাইরে এখনো লাখ লাখ প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাটের আওতার আনতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কার্যকর উদ্যোগ কম। এমনকি ভ্যাট আদায় বাড়াতে প্রয়োজন অনুযায়ী ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) বসাতে পারেনি সংস্থাটি।
রাজস্ব আদায়ে অর্থবছরের শুরু থেকে ঘাটতির মুখে পড়েছে সরকার। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। গত নভেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার কোটি টাকা।
সম্প্রতি ঋণের শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ করার শর্ত দিয়েছে। বাংলাদেশকে দেওয়া ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারে চলমান ঋণ কর্মসূচির চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ঘুরে গেছে আইএমএফের প্রতিনিধি দল। তখন চলমান ঋণ কর্মসূচির আকার আরও ৭৫ কোটি ডলার বাড়ানোর অনুরোধ করে বাংলাদেশ। এই অর্থ দিতেও সম্মত হয় আইএমএফ। এ জন্য কর আদায় ও নীতি গ্রহণকারী সংস্থাকে আলাদা করাসহ রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর মতো কিছু কঠোর শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। সেই শর্ত পূরণেই ভ্যাট বাড়ানোর এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রাজস্ব আয় বাড়ানো ছাড়া এ মুহূর্তে সরকারের কাছে বিকল্প কোনো পথ নেই। প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বাড়ানো গেলে সবচেয়ে ভালো হতো। তবে সেটি কঠিন হওয়ায় ভ্যাট হার বাড়ানোর মতো সহজ পথে হেঁটেছে সরকার। পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলে ভ্যাট বাড়ালেও মানুষের কষ্ট তুলনামূলক কম হতো। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ব্যবসা-বাণিজ্য খাত বড় ধরনের ধাক্কা খায়। সেই লোকসান কাটিয়ে ওঠা যায়নি। উচ্চ মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এমন পরিস্থিতিতে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। ব্যবসা-বাণিজ্য ওলট-পালট করে দেওয়ার মতো এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন মনে করেনি সরকার।
দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে কেবল এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। দেশের কর-জিডিপির অনুপাত অনেক দিন ধরেই কম, এ নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছে; কিন্তু সরকার তা বাড়ানোর দুরূহ পথে না গিয়ে সহজ পথে হাঁটল। পরোক্ষ কর ধনী-গরিব সবার জন্যই সমান। পরোক্ষ কর বাড়লে ধনীদের সমস্যা হয় না, সমস্যা হয় গরিবদের। এতে অসমতা আরও বাড়বে। অর্থ বছরের মাঝামাঝি সময় হঠাৎ করে এভাবে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কিছুটা বিস্ময়কর। সরকার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের বিষয় ও বিতর্ক নিয়ে যতটা জড়িয়ে গেছে এবং অগ্রাধিকার দিচ্ছে, অর্থনৈতিক সংস্কারে ততটা দিচ্ছে না। সে কারণে অর্থনীতিতে সমন্বিত উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে একদিকে যখন বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়ে যাচ্ছে, অথচ অন্যদিকে এনবিআরও ভ্যাট বাড়াচ্ছে। অথচ সমন্বয় থাকলে কিছু ক্ষেত্রে উল্টো কর হ্রাসের কথা ছিল। এই বাস্তবতায় বলতে হয়, বিদ্যমান মূল্যস্ফীতির মতো জটিল সমস্যা সমাধানে শক্তিশালী অর্থনৈতিক নেতৃত্ব চোখে পড়ছে না। এই বাস্তবতায় আশঙ্কা জাগছে, অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়গুলো ধামাচাপা পড়ে যায় কিনা।
কর সংস্কারের কথা ধারাবাহিকভাবে বলে হচ্ছে; কিন্তু কিভাবে তা করা হবে, সেটাই মূল কথা। ধনীদের কর বাড়ানো থেকে শুরু করে কর ফাঁকি রোধ ও অর্থ পাচার রোধ করে এই সংস্কার করতে হবে। যেসব সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে কঠিন পথে হাঁটতে হবে। শুধু পরোক্ষ কর বাড়ানোর মতো সহজ পথে হাঁটলে গভীর সমস্যার সমাধান হবে না। তাই প্রয়োজন করের আওতা বাড়ানো, কর খাতে দুর্নীতি রোধ করা এবং কর ব্যবস্থার আধুনিকায়ন। গভীর সংস্কারের লক্ষ্যে যে পরিবেশ থাকা দরকার, অর্থাৎ আমলাতন্ত্র, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক শক্তিসহ সব অংশীজনের যেভাবে অংশগ্রহণ দরকার, সেই বাস্তবতার ক্ষেত্রে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। আমলাতন্ত্রে যে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে, তা নতুন সমস্যা সৃষ্টি করছে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যে দুটি ভাগ-আমদানিনির্ভর ট্রেডিং ব্যবসা আর বিনিয়োগনির্ভর উৎপাদন
খাত। বুনিয়াদি অর্থনীতিতে দ্বিতীয়টি যত শক্তশালী হবে, ততই দেশ ও জনগণ সুফল পাবেন। উৎপাদন খাত মজবুত করতে দরকার দেশের সার্বিক স্থিতিশীলতা। তা না হলে দীর্ঘ মেয়াদে দেশি বা বিদেশি বিনিয়োগ, কোনোটাই হবে না। তাতে শিক্ষিত বেকার কিংবা কর্মহীনতার সংখ্যা বাড়বে। উচ্ছৃঙ্খল সমাজ গড়ে ওঠার শঙ্কা তৈরি হবে। মূল্যস্ফীতি কমাতে সুদহার বাড়ানো হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয়, এক বছরের কম সময়ের মধ্যে কোনো দেশের ব্যাংকের সুদের হার দেড় গুণ বেড়ে যায়, তা যে আফ্রিকার দুর্বল দেশের বাইরে ঘটতে পারে, তা কল্পনাতীত। এতে উৎপাদনমুখী খাত মুষড়ে পড়বে, এটা বুঝেও নীতি-নির্ধারকেরা নির্বিকার থাকবেন নাÑ নতুন বছরে এমন প্রত্যাশা করছি।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]
রেজাউল করিম খোকন
শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫
হঠাৎ করে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন সবাই। কোনো আলোচনা না করে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি অবিবেচনাপ্রসূত। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে। নতুন করে সংকটে পড়বে ব্যবসা-বাণিজ্য।
মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধনী) অধ্যাদেশ-২০২৫-এর খসড়া সংসদবিষয়ক বিভাগের ভেটিং সাপেক্ষে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। দুই বছরের বেশি সময় ধরে যেখানে উ”চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, সেখানে এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
অন্তর্র্বর্তী সরকার করের আওতা না বাড়িয়ে কিংবা কর ফাঁকি রোধ করার ব্যবস্থা না করে সরল রাস্তার সমাধান হিসেবে ভ্যাট বাড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এতে নিশ্চিত করেই সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর চাপ আরও বাড়বে।
সরকারের এ সিদ্ধান্তের কারণে তৈরি পোশাক, এসি রেস্তোরাঁ, মিষ্টি, নন-এসি হোটেলসহ ৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বেড়ে ১৫ শতাংশ হতে পারে। অর্থ উপদেষ্টা আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে বলেছেন, ভ্যাট বাড়লেও জিনিসপত্রের দামের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না। অত্যাবশ্যকীয় সব পণ্যের শুল্ক কমিয়ে জিরো (শূন্য) করে দেওয়া হয়েছে। বাস্তবতা হলো যেসব পণ্যের ওপর কর কমানো বা শূন্য করা হয়েছে, সেসব পণ্যের দামও তো তেমন কমেনি।
ঋণের শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সব ক্ষেত্রে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ করার শর্ত দিয়েছে। সরকারের রাজস্ব আদায়ের বড় মাধ্যম হচ্ছে ভ্যাট। বর্তমানে ভ্যাট নিবন্ধন নেওয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫ লাখ ২৫ হাজার। এর মধ্যে গড়ে সাড়ে তিন লাখ প্রতিষ্ঠান নিয়মিত ভ্যাট দিয়ে থাকে। এর বাইরে এখনো লাখ লাখ প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাটের আওতার আনতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কার্যকর উদ্যোগ কম। এমনকি ভ্যাট আদায় বাড়াতে প্রয়োজন অনুযায়ী ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) বসাতে পারেনি সংস্থাটি।
রাজস্ব আদায়ে অর্থবছরের শুরু থেকে ঘাটতির মুখে পড়েছে সরকার। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। গত নভেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার কোটি টাকা।
সম্প্রতি ঋণের শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ করার শর্ত দিয়েছে। বাংলাদেশকে দেওয়া ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারে চলমান ঋণ কর্মসূচির চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ঘুরে গেছে আইএমএফের প্রতিনিধি দল। তখন চলমান ঋণ কর্মসূচির আকার আরও ৭৫ কোটি ডলার বাড়ানোর অনুরোধ করে বাংলাদেশ। এই অর্থ দিতেও সম্মত হয় আইএমএফ। এ জন্য কর আদায় ও নীতি গ্রহণকারী সংস্থাকে আলাদা করাসহ রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর মতো কিছু কঠোর শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। সেই শর্ত পূরণেই ভ্যাট বাড়ানোর এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রাজস্ব আয় বাড়ানো ছাড়া এ মুহূর্তে সরকারের কাছে বিকল্প কোনো পথ নেই। প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বাড়ানো গেলে সবচেয়ে ভালো হতো। তবে সেটি কঠিন হওয়ায় ভ্যাট হার বাড়ানোর মতো সহজ পথে হেঁটেছে সরকার। পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলে ভ্যাট বাড়ালেও মানুষের কষ্ট তুলনামূলক কম হতো। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ব্যবসা-বাণিজ্য খাত বড় ধরনের ধাক্কা খায়। সেই লোকসান কাটিয়ে ওঠা যায়নি। উচ্চ মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এমন পরিস্থিতিতে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। ব্যবসা-বাণিজ্য ওলট-পালট করে দেওয়ার মতো এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন মনে করেনি সরকার।
দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে কেবল এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। দেশের কর-জিডিপির অনুপাত অনেক দিন ধরেই কম, এ নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছে; কিন্তু সরকার তা বাড়ানোর দুরূহ পথে না গিয়ে সহজ পথে হাঁটল। পরোক্ষ কর ধনী-গরিব সবার জন্যই সমান। পরোক্ষ কর বাড়লে ধনীদের সমস্যা হয় না, সমস্যা হয় গরিবদের। এতে অসমতা আরও বাড়বে। অর্থ বছরের মাঝামাঝি সময় হঠাৎ করে এভাবে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কিছুটা বিস্ময়কর। সরকার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের বিষয় ও বিতর্ক নিয়ে যতটা জড়িয়ে গেছে এবং অগ্রাধিকার দিচ্ছে, অর্থনৈতিক সংস্কারে ততটা দিচ্ছে না। সে কারণে অর্থনীতিতে সমন্বিত উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে একদিকে যখন বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়ে যাচ্ছে, অথচ অন্যদিকে এনবিআরও ভ্যাট বাড়াচ্ছে। অথচ সমন্বয় থাকলে কিছু ক্ষেত্রে উল্টো কর হ্রাসের কথা ছিল। এই বাস্তবতায় বলতে হয়, বিদ্যমান মূল্যস্ফীতির মতো জটিল সমস্যা সমাধানে শক্তিশালী অর্থনৈতিক নেতৃত্ব চোখে পড়ছে না। এই বাস্তবতায় আশঙ্কা জাগছে, অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়গুলো ধামাচাপা পড়ে যায় কিনা।
কর সংস্কারের কথা ধারাবাহিকভাবে বলে হচ্ছে; কিন্তু কিভাবে তা করা হবে, সেটাই মূল কথা। ধনীদের কর বাড়ানো থেকে শুরু করে কর ফাঁকি রোধ ও অর্থ পাচার রোধ করে এই সংস্কার করতে হবে। যেসব সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে কঠিন পথে হাঁটতে হবে। শুধু পরোক্ষ কর বাড়ানোর মতো সহজ পথে হাঁটলে গভীর সমস্যার সমাধান হবে না। তাই প্রয়োজন করের আওতা বাড়ানো, কর খাতে দুর্নীতি রোধ করা এবং কর ব্যবস্থার আধুনিকায়ন। গভীর সংস্কারের লক্ষ্যে যে পরিবেশ থাকা দরকার, অর্থাৎ আমলাতন্ত্র, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক শক্তিসহ সব অংশীজনের যেভাবে অংশগ্রহণ দরকার, সেই বাস্তবতার ক্ষেত্রে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। আমলাতন্ত্রে যে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে, তা নতুন সমস্যা সৃষ্টি করছে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যে দুটি ভাগ-আমদানিনির্ভর ট্রেডিং ব্যবসা আর বিনিয়োগনির্ভর উৎপাদন
খাত। বুনিয়াদি অর্থনীতিতে দ্বিতীয়টি যত শক্তশালী হবে, ততই দেশ ও জনগণ সুফল পাবেন। উৎপাদন খাত মজবুত করতে দরকার দেশের সার্বিক স্থিতিশীলতা। তা না হলে দীর্ঘ মেয়াদে দেশি বা বিদেশি বিনিয়োগ, কোনোটাই হবে না। তাতে শিক্ষিত বেকার কিংবা কর্মহীনতার সংখ্যা বাড়বে। উচ্ছৃঙ্খল সমাজ গড়ে ওঠার শঙ্কা তৈরি হবে। মূল্যস্ফীতি কমাতে সুদহার বাড়ানো হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয়, এক বছরের কম সময়ের মধ্যে কোনো দেশের ব্যাংকের সুদের হার দেড় গুণ বেড়ে যায়, তা যে আফ্রিকার দুর্বল দেশের বাইরে ঘটতে পারে, তা কল্পনাতীত। এতে উৎপাদনমুখী খাত মুষড়ে পড়বে, এটা বুঝেও নীতি-নির্ধারকেরা নির্বিকার থাকবেন নাÑ নতুন বছরে এমন প্রত্যাশা করছি।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]