alt

উপ-সম্পাদকীয়

বিনিময় কৌশল নাকি বাণিজ্য যুদ্ধ?

এম এ হোসাইন

: বৃহস্পতিবার, ০৬ মার্চ ২০২৫
image

ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকে এলন মাস্ক আমেরিকার অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের একটি গুরুতর দুর্বলতা তুলে ধরেন, যেখানে তিনি ২ ট্রিলিয়ন ডলারের ভয়াবহ আর্থিক সংকটের কথা উল্লেখ করেন

মার্কিন অর্থনীতি যখন সম্ভাব্য মন্দার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে, তখন ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কনীতি এমন এক গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা হয়তো দেশীয় প্রবৃদ্ধিকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে অথবা ধ্বংসাত্মক এক বাণিজ্য যুদ্ধের সূচনা ঘটাতে পারে। ২০২৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট ঘোষণা করেন যে, যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে একটি ‘বেসরকারি খাতে মন্দার’ সম্মুখীন, যা অর্থনীতির ভঙ্গুর অবস্থাকে আরও স্পষ্ট করেছে। তিনি এই মন্দার জন্য পূর্ববর্তী প্রশাসনের অতিরিক্ত সরকারি ব্যয় ও অতিরিক্ত বিধিনিষেধকে দায়ী করেন, যা অর্থনীতিকে ‘ভেতর থেকে ভঙ্গুর’ করে তুলেছে। বর্তমান প্রশাসন অর্থনীতিকে পুনরায় ‘বেসরকারিকরণের’ লক্ষ্য স্থির করলেও ভবিষ্যৎ পথ এখনও অনিশ্চিত। এরই মধ্যে, শুল্কনীতি একদিকে যেমন দর-কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, অন্যদিকে এটি বড় ধরনের অর্থনৈতিক ঝুঁকির ইঙ্গিতও দিচ্ছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকে এলন মাস্ক আমেরিকার অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের একটি গুরুতর দুর্বলতা তুলে ধরেন, যেখানে তিনি ২ ট্রিলিয়ন ডলারের ভয়াবহ আর্থিক সংকটের কথা উল্লেখ করেন। সরকারি অপচয় কমানোর দায়িত্বে থাকা মাস্ককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে- এমন সমস্ত ব্যয় বাতিল করতে, যা মার্কিন নাগরিকদের সরাসরি উপকৃত করে না। পাশাপাশি ট্রাম্প শত শত বিলিয়ন ডলারের বিদেশি সামরিক সহায়তা বন্ধ করার পরিকল্পনা করছেন, যাতে আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতির পরিবর্তে দেশীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া যায়।

আমেরিকার অর্থনৈতিক সকল সূচকগুলো বিপদের সংকেত দিচ্ছে। বর্তমানে ভোক্তার আস্থা ২০২১ সালের পর সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে, পণ্য পরিবহনের পরিমাণ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে, এবং ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিকে ব্যবসায়িক সরঞ্জাম বিনিয়োগেও তীব্র পতন দেখা গেছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে, মুদ্রাস্ফীতি সমন্বয়ের পর খুচরা বিক্রি ০.৯% হ্রাস পেয়েছে, যা বাজারের দুর্বল চাহিদাকে আরও স্পষ্ট করেছে। এসব প্রবণতা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক, কারণ মার্কিন অর্থনীতিতে শীর্ষ ১০% আয়কারী ব্যক্তিরাই মোট ভোক্তা ব্যয়ের অর্ধেকের বেশি অংশ পরিচালনা করে। ফলে সাধারণ ভোক্তাদের হতাশাব্যঞ্জক মনোভাব থাকলেও অর্থনীতির সামগ্রিক গতিপথ নির্ভর করছে এই ধনী গোষ্ঠীর ব্যয় নীতির ওপর।

বেসরকারি বিনিয়োগ, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি, তাতেও ধস নেমেছে। ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিকে ব্যবসায়ীক বিনিয়োগ মোট জিডিপি প্রবৃদ্ধি থেকে প্রায় ০.৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যা ২০২১ সালের পর সবচেয়ে বাজে পারফরম্যান্স। যদিও জিডিপি তথ্য সাধারণত পরিবর্তনশীল, তবে বিনিয়োগে এই পতন উদ্বেগজনক। বাইডেন প্রশাসনের সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনের জন্য সহায়ক প্রণোদনা আইন, যা সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনে বড় ধরনের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করেছিল, তা হয়তো সাময়িকভাবে অর্থনীতির দুর্বলতাগুলো ঢেকে রেখেছিল। তবে যখন এই আইনের ভর্তুকি হ্রাস পেতে শুরু করে, তখন সরঞ্জাম বিনিয়োগ সংকুচিত হয়ে পড়ে, যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক মন্দার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ট্রাম্প প্রশাসনের বর্তমান শুল্কনীতি একটি দ্বিমুখী তলোয়ারের মতো। একদিকে, এটি বিদেশি বাণিজ্য অংশীদারদের উপর চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবে কাজ করতে পারে, যাতে তারা যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে। অন্যদিকে, এটি যদি নিয়ন্ত্রণহীন বাণিজ্য যুদ্ধে রূপ নেয়, তবে তা মুদ্রাস্ফীতি আরও বাড়িয়ে অর্থনীতিকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।

মার্কিন অর্থনীতি আমদানির ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল, বিশেষ করে মূলধনী পণ্যের ক্ষেত্রে। ২০২০ সালের পর থেকে প্রকৃত অর্থে এসব পণ্যের আমদানি প্রায় ৪০% বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র যে পরিমাণ মূলধনী পণ্য আমদানি করে, তার চেয়ে কম পরিমাণ দেশীয়ভাবে উৎপাদন হয়, যার মধ্যে রয়েছে আধা-প্রক্রিয়াজাত পণ্য ও অন্যান্য উৎপাদন উপকরণ। এই নির্ভরশীলতার ফলে স্থানীয় উৎপাদনকারীদের জন্য বিদেশি পণ্যের পরিবর্তে দেশীয় পণ্য ব্যবহার করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, এমনকি শুল্ক বৃদ্ধির পরও।

ট্রাম্প প্রশাসন চীনা আমদানির ওপর ২০% এবং ইউরোপীয় পণ্যের ওপর ২৫% শুল্ক আরোপের যে হুমকি দিয়েছে, তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে পারে। এই শুল্কের কতটুকু অংশ বিদেশি রপ্তানিকারকরা মূল্য হ্রাস বা মুদ্রার অবমূল্যায়নের মাধ্যমে সমন্বয় করবে এবং কতটুকু অংশ ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে, তা অনিশ্চিত। তবে প্রস্তাবিত শুল্কের আকার বিবেচনা করলে, মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি, যা ইতোমধ্যেই ভঙ্গুর অর্থনীতির ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করবে।

বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপট এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান ও চীন সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক হুমকির সামনে নীরব থাকবে না। যদি এই বাণিজ্য অংশীদাররা পাল্টা শুল্ক আরোপ করে, তবে তা একপ্রকার প্রতিশোধমূলক বাণিজ্য যুদ্ধের জন্ম দিতে পারে, যা বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন ব্যাহত করবে এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে স্থবিরতা আনবে। তবে, বিপরীতভাবে, যদি শুল্কের হুমকি এই দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করে, তাহলে তা যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

তবে এই দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি নিশ্চিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি যেহেতু বিদেশি উপকরণের ওপর নির্ভরশীল, তাই শুল্ক বৃদ্ধির ফলে দেশীয় শিল্পখাতে অসমপ্রতিরোধ্য চাপ সৃষ্টি হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, অর্থনৈতিক কার্যক্রমের নির্ভরযোগ্য সূচক ‘ক্যাস ফ্রেইট ভলিউম ইনডেক্স’-এর তথ্যানুযায়ী, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের তীব্র পতন দেখিয়েছে। যদিও প্রতিকূল আবহাওয়ার কিছুটা ভূমিকা থাকতে পারে, তবে সামগ্রিক প্রবণতা বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকা-ের মন্দাকেই ইঙ্গিত করে।

শুল্ক বৃদ্ধির সবচেয়ে তাৎক্ষণিক ঝুঁকির মধ্যে অন্যতম হলো মুদ্রাস্ফীতির প্রবণতা ত্বরান্বিত করা। আমদানি পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্কের ফলে ভোক্তা ও শিল্প খাতের ব্যয় বেড়ে যাবে, যার ফলে সর্বস্তরে দাম বাড়বে। এমন সময়ে যখন ফেডারেল রিজার্ভ ইতোমধ্যেই মুদ্রাস্ফীতির চাপে ভুগছে, তখন এই অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি অর্থনীতিতে আরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। মূল্যবৃদ্ধি ও স্থবির মজুরির সংমিশ্রণ ভোক্তার আস্থা ও ব্যয় কমিয়ে দিতে পারে, যা এক ভয়াবহ চক্র তৈরি করে মন্দাকে আরও গভীর করতে পারে।

এর পাশাপাশি, শুল্কের কারণে সৃষ্ট মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব সমানভাবে বণ্টিত হবে না। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবার, যারা তাদের আয়ের একটি বড় অংশ পণ্য ক্রয়ে ব্যয় করে, তারা মূল্যবৃদ্ধির প্রধান শিকার হবে। এটি আয় বৈষম্য এবং সামাজিক অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে, যা দেশের অর্থনৈতিক সংকটকে আরও জটিল করে তুলবে।

ট্রাম্পের শুল্কনীতি একটি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ। যদি এটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে বাণিজ্য অংশীদারদের আলোচনার টেবিলে আনতে এবং মার্কিন অর্থনীতির জন্য সুবিধাজনক শর্ত নিশ্চিত করতে পারে। তবে যদি ভুলভাবে পরিচালিত হয়, তাহলে এটি এমন এক বাণিজ্য যুদ্ধের সূত্রপাত করতে পারে, যা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে দুর্বল করবে এবং দেশের মন্দাকে আরও গভীর করবে।

এই সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রশাসনকে অবশ্যই একটি সুসংহত কৌশল গ্রহণ করতে হবে, যেখানে শুল্ককে দর-কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়ানোর দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। এর জন্য মিত্রদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সমন্বয়, বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনের বাস্তবতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা এবং প্রয়োজনে উত্তেজনা কমানোর কৌশল গ্রহণ করা অপরিহার্য। পাশাপাশি দেশীয় বিনিয়োগ ও উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করার জন্য পরিপূরক নীতিমালা গ্রহণ করা উচিত, যাতে দীর্ঘমেয়াদে বিদেশি আমদানির ওপর নির্ভরতা কমানো যায়।

ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কনীতি এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এটি হয়তো মার্কিন অর্থনীতির ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে, অথবা এমন এক অর্থনৈতিক বিস্ফোরক হয়ে উঠতে পারে, যা বর্তমান মন্দাকে আরও প্রকট করবে। এর ফলাফল নির্ভর করবে প্রশাসনের দক্ষতার ওপর- তারা বৈশ্বিক বাণিজ্যের জটিলতা কিভাবে সামাল দেয়, মুদ্রাস্ফীতির ঝুঁকি কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, এবং বিদেশি বাণিজ্য অংশীদারদের সহযোগিতা কতটা নিশ্চিত করতে পারে। যখন মার্কিন অর্থনীতি মন্দার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে, তখন ঝুঁকির মাত্রা সর্বোচ্চ পর্যায়ে। পুরো বিশ্ব তাকিয়ে আছেÑ ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক কৌশল কি এক অভূতপূর্ব সাফল্য হয়ে উঠবে, নাকি এক ভয়াবহ ভুল সিদ্ধান্ত, যা সুদূরপ্রসারী পরিণতি বয়ে আনবে?

[লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক]

জনতুষ্টিবাদীরা এগিয়ে আছে যেদিক থেকে

ভিক্ষাবৃত্তি : প্রয়োজন নাকি পেশা?

শিশু আদালতের বিচার-প্রক্রিয়ার আইনি ও বাস্তবিক দিক

জনদুর্ভোগের অপসংস্কৃতি ও জনশিক্ষা : আগামীর দিকনির্দেশনা

প্রসঙ্গ : নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি

হরিজনদের পদবি : ঐক্যের পথে বাধা

এল নিনো : দেশের কৃষির চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

আর কীভাবে আর্জি জানালে নিরাপত্তা পাওয়া যায়?

স্বপ্ন ভাঙল সাঁওতাল মুংলু বেসরার

কোনো স্কুলই খারাপ না

ঢাকার যানজটের টেকসই সমাধান কী

বই কেন পড়বেন

ডায়াবেটিসের জটিলতা বাড়ায় তামাক ও ধূমপান

জাতীয় বিমা দিবস

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থা

ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়া ভুল হয়ে থাকলে মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা সঠিক ছিল!

শিক্ষার গুণগত মান পরিবর্তনে শিক্ষকের মূল্যায়ন

দেশে প্রোগ্রামিংয়ের চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা

তর্কে সময়, সামর্থ্য এবং শক্তির অপচয় রোধ করুন

পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও দেশপ্রেমে জাতীয় অগ্রগতি

শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রাথমিকের লেখাপড়ায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে

ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের সংস্কার

বই পড়ে কী হবে

জনস্বাস্থ্যের আরেক আতঙ্কের নাম ডিমেনশিয়া

ভারতে সঙ্ঘের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য

রম্যগদ্য : “বঙ্গ হবে কলিঙ্গ”

আদিবাসী ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ নিন

ছবি

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি ও চেতনার অন্বেষণে

প্রযুক্তি, জলবায়ু ও জনসংখ্যার মোকাবিলায় উন্নয়নশীল অর্থনীতির

চাই একটি জাতীয় ভাষানীতি

অস্বাভাবিকের চেয়ে অস্বাভাবিক বায়ুদূষণ

আদিবাসীদের কাঁটাতারে বন্দি জীবন

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজন : বাংলাদেশের কৌশল

শিক্ষক আন্দোলন প্রসঙ্গে

আর জি কর ঘিরে শাসক কৌশল প্রসঙ্গে

নিজের পথে ইউরোপ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বিনিময় কৌশল নাকি বাণিজ্য যুদ্ধ?

এম এ হোসাইন

image

ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকে এলন মাস্ক আমেরিকার অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের একটি গুরুতর দুর্বলতা তুলে ধরেন, যেখানে তিনি ২ ট্রিলিয়ন ডলারের ভয়াবহ আর্থিক সংকটের কথা উল্লেখ করেন

বৃহস্পতিবার, ০৬ মার্চ ২০২৫

মার্কিন অর্থনীতি যখন সম্ভাব্য মন্দার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে, তখন ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কনীতি এমন এক গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা হয়তো দেশীয় প্রবৃদ্ধিকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে অথবা ধ্বংসাত্মক এক বাণিজ্য যুদ্ধের সূচনা ঘটাতে পারে। ২০২৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট ঘোষণা করেন যে, যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে একটি ‘বেসরকারি খাতে মন্দার’ সম্মুখীন, যা অর্থনীতির ভঙ্গুর অবস্থাকে আরও স্পষ্ট করেছে। তিনি এই মন্দার জন্য পূর্ববর্তী প্রশাসনের অতিরিক্ত সরকারি ব্যয় ও অতিরিক্ত বিধিনিষেধকে দায়ী করেন, যা অর্থনীতিকে ‘ভেতর থেকে ভঙ্গুর’ করে তুলেছে। বর্তমান প্রশাসন অর্থনীতিকে পুনরায় ‘বেসরকারিকরণের’ লক্ষ্য স্থির করলেও ভবিষ্যৎ পথ এখনও অনিশ্চিত। এরই মধ্যে, শুল্কনীতি একদিকে যেমন দর-কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, অন্যদিকে এটি বড় ধরনের অর্থনৈতিক ঝুঁকির ইঙ্গিতও দিচ্ছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকে এলন মাস্ক আমেরিকার অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের একটি গুরুতর দুর্বলতা তুলে ধরেন, যেখানে তিনি ২ ট্রিলিয়ন ডলারের ভয়াবহ আর্থিক সংকটের কথা উল্লেখ করেন। সরকারি অপচয় কমানোর দায়িত্বে থাকা মাস্ককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে- এমন সমস্ত ব্যয় বাতিল করতে, যা মার্কিন নাগরিকদের সরাসরি উপকৃত করে না। পাশাপাশি ট্রাম্প শত শত বিলিয়ন ডলারের বিদেশি সামরিক সহায়তা বন্ধ করার পরিকল্পনা করছেন, যাতে আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতির পরিবর্তে দেশীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া যায়।

আমেরিকার অর্থনৈতিক সকল সূচকগুলো বিপদের সংকেত দিচ্ছে। বর্তমানে ভোক্তার আস্থা ২০২১ সালের পর সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে, পণ্য পরিবহনের পরিমাণ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে, এবং ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিকে ব্যবসায়িক সরঞ্জাম বিনিয়োগেও তীব্র পতন দেখা গেছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে, মুদ্রাস্ফীতি সমন্বয়ের পর খুচরা বিক্রি ০.৯% হ্রাস পেয়েছে, যা বাজারের দুর্বল চাহিদাকে আরও স্পষ্ট করেছে। এসব প্রবণতা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক, কারণ মার্কিন অর্থনীতিতে শীর্ষ ১০% আয়কারী ব্যক্তিরাই মোট ভোক্তা ব্যয়ের অর্ধেকের বেশি অংশ পরিচালনা করে। ফলে সাধারণ ভোক্তাদের হতাশাব্যঞ্জক মনোভাব থাকলেও অর্থনীতির সামগ্রিক গতিপথ নির্ভর করছে এই ধনী গোষ্ঠীর ব্যয় নীতির ওপর।

বেসরকারি বিনিয়োগ, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি, তাতেও ধস নেমেছে। ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিকে ব্যবসায়ীক বিনিয়োগ মোট জিডিপি প্রবৃদ্ধি থেকে প্রায় ০.৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যা ২০২১ সালের পর সবচেয়ে বাজে পারফরম্যান্স। যদিও জিডিপি তথ্য সাধারণত পরিবর্তনশীল, তবে বিনিয়োগে এই পতন উদ্বেগজনক। বাইডেন প্রশাসনের সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনের জন্য সহায়ক প্রণোদনা আইন, যা সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনে বড় ধরনের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করেছিল, তা হয়তো সাময়িকভাবে অর্থনীতির দুর্বলতাগুলো ঢেকে রেখেছিল। তবে যখন এই আইনের ভর্তুকি হ্রাস পেতে শুরু করে, তখন সরঞ্জাম বিনিয়োগ সংকুচিত হয়ে পড়ে, যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক মন্দার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ট্রাম্প প্রশাসনের বর্তমান শুল্কনীতি একটি দ্বিমুখী তলোয়ারের মতো। একদিকে, এটি বিদেশি বাণিজ্য অংশীদারদের উপর চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবে কাজ করতে পারে, যাতে তারা যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে। অন্যদিকে, এটি যদি নিয়ন্ত্রণহীন বাণিজ্য যুদ্ধে রূপ নেয়, তবে তা মুদ্রাস্ফীতি আরও বাড়িয়ে অর্থনীতিকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।

মার্কিন অর্থনীতি আমদানির ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল, বিশেষ করে মূলধনী পণ্যের ক্ষেত্রে। ২০২০ সালের পর থেকে প্রকৃত অর্থে এসব পণ্যের আমদানি প্রায় ৪০% বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র যে পরিমাণ মূলধনী পণ্য আমদানি করে, তার চেয়ে কম পরিমাণ দেশীয়ভাবে উৎপাদন হয়, যার মধ্যে রয়েছে আধা-প্রক্রিয়াজাত পণ্য ও অন্যান্য উৎপাদন উপকরণ। এই নির্ভরশীলতার ফলে স্থানীয় উৎপাদনকারীদের জন্য বিদেশি পণ্যের পরিবর্তে দেশীয় পণ্য ব্যবহার করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, এমনকি শুল্ক বৃদ্ধির পরও।

ট্রাম্প প্রশাসন চীনা আমদানির ওপর ২০% এবং ইউরোপীয় পণ্যের ওপর ২৫% শুল্ক আরোপের যে হুমকি দিয়েছে, তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে পারে। এই শুল্কের কতটুকু অংশ বিদেশি রপ্তানিকারকরা মূল্য হ্রাস বা মুদ্রার অবমূল্যায়নের মাধ্যমে সমন্বয় করবে এবং কতটুকু অংশ ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে, তা অনিশ্চিত। তবে প্রস্তাবিত শুল্কের আকার বিবেচনা করলে, মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি, যা ইতোমধ্যেই ভঙ্গুর অর্থনীতির ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করবে।

বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপট এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান ও চীন সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক হুমকির সামনে নীরব থাকবে না। যদি এই বাণিজ্য অংশীদাররা পাল্টা শুল্ক আরোপ করে, তবে তা একপ্রকার প্রতিশোধমূলক বাণিজ্য যুদ্ধের জন্ম দিতে পারে, যা বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন ব্যাহত করবে এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে স্থবিরতা আনবে। তবে, বিপরীতভাবে, যদি শুল্কের হুমকি এই দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করে, তাহলে তা যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

তবে এই দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি নিশ্চিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি যেহেতু বিদেশি উপকরণের ওপর নির্ভরশীল, তাই শুল্ক বৃদ্ধির ফলে দেশীয় শিল্পখাতে অসমপ্রতিরোধ্য চাপ সৃষ্টি হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, অর্থনৈতিক কার্যক্রমের নির্ভরযোগ্য সূচক ‘ক্যাস ফ্রেইট ভলিউম ইনডেক্স’-এর তথ্যানুযায়ী, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের তীব্র পতন দেখিয়েছে। যদিও প্রতিকূল আবহাওয়ার কিছুটা ভূমিকা থাকতে পারে, তবে সামগ্রিক প্রবণতা বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকা-ের মন্দাকেই ইঙ্গিত করে।

শুল্ক বৃদ্ধির সবচেয়ে তাৎক্ষণিক ঝুঁকির মধ্যে অন্যতম হলো মুদ্রাস্ফীতির প্রবণতা ত্বরান্বিত করা। আমদানি পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্কের ফলে ভোক্তা ও শিল্প খাতের ব্যয় বেড়ে যাবে, যার ফলে সর্বস্তরে দাম বাড়বে। এমন সময়ে যখন ফেডারেল রিজার্ভ ইতোমধ্যেই মুদ্রাস্ফীতির চাপে ভুগছে, তখন এই অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি অর্থনীতিতে আরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। মূল্যবৃদ্ধি ও স্থবির মজুরির সংমিশ্রণ ভোক্তার আস্থা ও ব্যয় কমিয়ে দিতে পারে, যা এক ভয়াবহ চক্র তৈরি করে মন্দাকে আরও গভীর করতে পারে।

এর পাশাপাশি, শুল্কের কারণে সৃষ্ট মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব সমানভাবে বণ্টিত হবে না। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবার, যারা তাদের আয়ের একটি বড় অংশ পণ্য ক্রয়ে ব্যয় করে, তারা মূল্যবৃদ্ধির প্রধান শিকার হবে। এটি আয় বৈষম্য এবং সামাজিক অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে, যা দেশের অর্থনৈতিক সংকটকে আরও জটিল করে তুলবে।

ট্রাম্পের শুল্কনীতি একটি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ। যদি এটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে বাণিজ্য অংশীদারদের আলোচনার টেবিলে আনতে এবং মার্কিন অর্থনীতির জন্য সুবিধাজনক শর্ত নিশ্চিত করতে পারে। তবে যদি ভুলভাবে পরিচালিত হয়, তাহলে এটি এমন এক বাণিজ্য যুদ্ধের সূত্রপাত করতে পারে, যা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে দুর্বল করবে এবং দেশের মন্দাকে আরও গভীর করবে।

এই সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রশাসনকে অবশ্যই একটি সুসংহত কৌশল গ্রহণ করতে হবে, যেখানে শুল্ককে দর-কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়ানোর দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। এর জন্য মিত্রদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সমন্বয়, বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনের বাস্তবতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা এবং প্রয়োজনে উত্তেজনা কমানোর কৌশল গ্রহণ করা অপরিহার্য। পাশাপাশি দেশীয় বিনিয়োগ ও উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করার জন্য পরিপূরক নীতিমালা গ্রহণ করা উচিত, যাতে দীর্ঘমেয়াদে বিদেশি আমদানির ওপর নির্ভরতা কমানো যায়।

ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কনীতি এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এটি হয়তো মার্কিন অর্থনীতির ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে, অথবা এমন এক অর্থনৈতিক বিস্ফোরক হয়ে উঠতে পারে, যা বর্তমান মন্দাকে আরও প্রকট করবে। এর ফলাফল নির্ভর করবে প্রশাসনের দক্ষতার ওপর- তারা বৈশ্বিক বাণিজ্যের জটিলতা কিভাবে সামাল দেয়, মুদ্রাস্ফীতির ঝুঁকি কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, এবং বিদেশি বাণিজ্য অংশীদারদের সহযোগিতা কতটা নিশ্চিত করতে পারে। যখন মার্কিন অর্থনীতি মন্দার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে, তখন ঝুঁকির মাত্রা সর্বোচ্চ পর্যায়ে। পুরো বিশ্ব তাকিয়ে আছেÑ ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক কৌশল কি এক অভূতপূর্ব সাফল্য হয়ে উঠবে, নাকি এক ভয়াবহ ভুল সিদ্ধান্ত, যা সুদূরপ্রসারী পরিণতি বয়ে আনবে?

[লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক]

back to top