alt

উপ-সম্পাদকীয়

ভারতব্যাপী সংঘ : বিজেপির নয়া কৌশল

গৌতম রায়

: রোববার, ১৬ মার্চ ২০২৫

দোল উৎসবকে কেন্দ্র করে এই মুহূর্তে ভারতজুড়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার পারদ চড়াতে চাইছে হিন্দু সম্প্রদায়িক শক্তি। বেশ কিছুদিন ধরেই উত্তর ভারতে কোনোরকম হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলেই, সেটা কুম্ভ মেলা হোক বা শ্রাবণ মাসে বাঁক নিয়ে তীর্থযাত্রাই হোক, হিন্দুত্ববাদীরা এই সময়ে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত আগ্রাসী ভূমিকা পালন করতে শুরু করে দিতে শুরু করেছে।

সাম্প্রতিক অতীতে আমরা দেখেছি এই ধরনের ধর্মীয় গণহিস্টিরিয়া তৈরির ক্ষেত্রে তারা আশপাশের মুসলমান সম্প্রদায়ের দোকানগুলোকে টার্গেট করে। তাদের রুটিরুজি বন্ধের জন্য নানা ধরনের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং বিশেষ করে প্রশাসনিক ষড়যন্ত্র শুরু করে দেয়। এমন একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে, যাতে উত্তর ভারতের বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্র গুলিতে পেটের দায়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষজন, যারা অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া, তারা যে সমস্ত খাবারের দোকান বা বিভিন্ন ধরনের মনোহারি সামগ্রীর দোকানপত্র করে, সেগুলো যাতে তারা না করে, না খোলে, তার জন্য অনেক দিন আগে থেকে শুরু হয়ে যায় মুসলমানদের ওপরে একটা সামাজিক হুমকি।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে ফতোয়া জারি করা হয়, দোকানের সাইনবোর্ডে দোকানের মালিকের নাম লিখতে হবে। অর্থাৎ; দোকানের মালিক হিন্দু না মুসলমান এটা জানানো বাধ্যতামূলক করা হয় প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে। আর স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানদের দোকান থেকে যাতে তীর্থযাত্রীরা কোনোরকম খাবার বা জিনিস না কেনে তার জন্য শুরু হয়ে যায় বিভিন্ন ধরনের চাপ সৃষ্টি করা।

সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে যদি কোনো মসজিদ থাকে , তাহলে ত্রিপল দিয়ে সেইসব মসজিদগুলোকে ঢেকে দেয়া হয়। হিন্দু তীর্থযাত্রীদের ধর্মাচরণের পথে যাতে কোনো মসজিদ চক্ষুগোচর না হয় সেই জন্য। মসজিদগুলোকে প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে এবং নিজেদের রাজনৈতিক শক্তি প্রয়োগ করে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দিয়ে, একটা ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করে, আরএসএস-বিজেপিসহ গোটা হিন্দু সম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি উত্তর ভারত জুড়ে তান্ডব করে। পশ্চিমবঙ্গের কোনো কোনো ক্ষেত্রেও এই ধরনের অভিযোগ শুনতে পাওয়া যায়।

বিশেষ করে মহরমের অল্প কিছুকাল আগে পরে যে রামনবমী পালন করে একাংশের হিন্দুরা, যাদের মধ্যে উত্তর ভারতের লোকজন বেশি ,তারা এই সময়কালে রামনবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে মসজিদ ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা পশ্চিমবঙ্গের বুকে চালায়। স্থানীয় মুসলমানদের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক হিন্দুদের এই অপকর্ম সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ প্রশাসনকে বারবার জানিয়েও খুব একটা সুফল গত কয়েক বছরে পাওয়া যায়নি।

দোল উৎসবকে কেন্দ্র করে গোটা উত্তরপ্রদেশজুড়ে এই ধরনের সাম্প্রদায়িক কর্মকা- সরাসরি সেখানকার বিজেপি সরকারের প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়ে শুরু করে হিন্দুত্ববাদীরা। উত্তরপ্রদেশের আলিগড় অঞ্চলের বিজেপি নেতা রঘুনাথ সিং হোলি ঘিরে ফতোয়া জারি করে, হোলির দিন মুসলমানদের ত্রিপলের হিজাব পড়ে বাইরে বের হতে হবে। এখানেই উত্তরপ্রদেশ সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান দপ্তরের উপদেষ্টা পদে কর্মরত রঘুনাথ সিং থেমে থাকেনি। সে আরো ফতোয়া জারি করে বলেছে, হোলির দিন ত্রিপল দিয়ে সমস্ত মসজিদ ঢেকে রাখতে হবে। যদি এভাবে ত্রিপল দিয়ে মসজিদ ঢেকে রাখা হয়, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। তা না হলে সমস্যা হতে পারে।

প্রসঙ্গত, উল্লেখ্য রঘুনাথ সিং যে পদটিতে রয়েছেন সেটি রাজ্যের একটি ক্যাবিনেট মন্ত্রীর পর্যায়ের পদ এবং ক্যাবিনেট মন্ত্রী যে ধরনের প্রশাসনিক সুযোগ-সুবিধা পান, ঠিক একই রকম সুযোগ-সুবিধা এই রঘুনাথ পেয়ে থাকে উত্তরপ্রদেশ সরকারের কাছ থেকে।

হোলিকে কেন্দ্র করে আলিগড় শহরে হিন্দুত্ববাদীদের নৃশংসতা কোন জায়গায় পৌঁছেছে তা বুঝতে পারা যায়, সেখানকার বিজেপি নেতাদের বিভিন্ন ফতোয়ার মধ্যে দিয়ে। মুসলমান সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে কিন্তু জুম্মাবারে হোলি পড়াতে, জুম্মার নামাজের সময়টাকে খানিকটা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে হিন্দুদের হোলি পালনের সময়ের সঙ্গে কোনো সংঘর্ষ না হয়। মুসলমান সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, হোলি উৎসব দুপুরে শেষ হওয়ার পরই তারা জুম্মার নামাজ আদায় করবেন। তা সত্ত্বেও কিন্তু হিন্দুত্ববাদীরা একযোগে উসকানি চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, মহিলাদের তো হিজাব পরা বাধ্যতামূলক। এমনকি পুরুষদেরও ত্রিপলের হিজাব পড়ে বের হতে হবে, যাতে তাদের টুপিতে কোনো রং না লাগে। সেই কারণে মুসলমান পুরুষদের চটের হিজাব দিয়ে নিজেদের টুপি ঢেকে রাখতে হবে বলে ফতোয়া জারি করেছে বিজেপি নেতা রঘুরাথ।

অর্থাৎ রং দেয়া কেন্দ্র করে যে একটা অশান্তি তৈরির চেষ্টা আরএসএস-বিজেপি বা তাদের সাঙ্গোপাঙ্গরা চালাবেরর এটাই বিজেপি নেতা রঘুরাথ সিংয়ের বক্তব্যের মধ্যে থেকে ইতিমধ্যেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। এখানেই থেমে থাকেনি হিন্দুত্ববাদীরা ।তারা আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রাম মন্দির বানানোর দাবি তুলতে শুরু করেছে। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বিজেপি নেতার রঘুনাথ সিং আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রাম মন্দির তৈরি করবার হিন্দুত্ববাদী শক্তির দাবিকে দুহাত তুলে সমর্থন জানাতে শুরু করেছে।

কেবলমাত্র আলীগড়ের যে দোলকে কেন্দ্র করে মসজিদগুলো ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে তা নয়। গোটা উত্তরপ্রদেশজুড়েই এই সামাজিক বিভৎসতা চালাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী শক্তি। বহু আলোচিত সম্ভোলে দশটি মসজিদ ইতোমধ্যে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। সম্ভলে যে দশটি মসজিদ ঢেকে দেয়া হয়েছে ত্রিপল দিয়ে তার মধ্যে সমীক্ষা-বিচারাধীন শাহী জামা মসজিদ টিকেও ঢেকে দেয়া হয়েছে।

উত্তরপ্রদেশের শাহজাহানপুরে গোটা জেলাজুড়ে প্রায় সাতষট্টিটি মসজিদ ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। শাহজাহানপুর জেলাতে ‘জুতা মার হোলি’ বলে দোল কে কেন্দ্র করে একটি মিছিল বেরোয়। সেই মিছিল যে সমস্ত পথ পরিক্রমা করবে, সেই সমস্ত পথে যে সাতষট্টিটি মসজিদ পড়ে, তার সব কটা ত্রিপল দিয়ে মুড়ে দেয়া হয়েছে। সংবেদনশীল এলাকার নাম করে গোটা শাহজাহানপুর জেলাজুড়ে পুলিশ ফ্লাগ মার্চ করেছে। সম্ভোল জেলার পুলিশ সুপার ইতোমধ্যেই প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছেন যে, কোনরকম জবরদস্তি বরদাস্ত করা হবে না। সেখানকার জামা মসজিদের বাইরে বিরাট পুলিশ বাহিনী নিয়োগ করা হয়েছে। শহরের দশটি মসজিদ ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে।সংবেদনশীল এলাকার নাম করে গোটা শহরজুড়ে পুলিশ সেখানে টহলদারি করছে।

সম্ভোলের জামা মসজিদের মৌলানা আফতাব, নামাজের সময় পিছিয়ে দুপুর দুটো করে দিয়েছেন, তাতেও কিন্তু হিন্দুত্ববাদীরা খুশি হতে পারছে না। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ,যাতে মসজিদে কোনোভাবে রং না পড়ে সেই জন্যই নাকি ত্রিপল দিয়ে মসজিদ গুলি ঢেকে দেয়া হচ্ছে ।জোনপুরে হোলি- জুম্মার নামাজ যাতে কোনো রকম সমস্যা না করে ,তার নাম করে বড় বড় মসজিদে জুম্মার নামাজের সময় পরিবর্তিত করে দেওয়া হয়েছে। ঠিক একই অবস্থা করা হয়েছে ললিতপুর , রাইয়ারয়েও কিভাবে হোলি কে কেন্দ্র করে জুমার নামাজের সময় পরিবর্তিত করে দেওয়া হয়েছে।

অতীতে মসজিদ যে সমস্ত অঞ্চলে আছে সেই সমস্ত এলাকার মধ্যে দিয়ে হোলির মিছিল যেতে না পারে বা গেলেও মসজিদগুলি রক্ষার ব্যাপারে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে অত্যন্ত দৃঢ় ভূমিকা পালন করা হতো। কিন্তু কেন্দ্র এবং রাজ্যে একই যোগে উত্তরপ্রদেশে ,বিজেপি ক্ষমতায় থাকার তরুণ অতীতের সেই সমস্ত ব্যবস্থা এখন একেবারে পাল্টে ফেলা হয়েছে। কিভাবে প্ররোচনা তৈরি করতে পারা যায়, তার জন্য একযোগে বিজেপি এবং রাজ্য প্রশাসন নিজেদের নিয়োজিত করে ।

এই অবস্থা যে কেবলমাত্র উত্তরপ্রদেশে, তাইই নয়। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাটসহ উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এবং সুদূর পশ্চিম ভারতের রাজস্থানেও এভাবে হোলিকে কেন্দ্র করে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের সঙ্গে পায়ে পা বাঁধীয়ে ঝগড়া বাধাবার একটা উপক্রম তৈরি করা হয়েছে।

রমজান মাসে প্রার্থনারত মুসলমানদের উপর , উপাসনারত মুসলমানদের উপর একেবারে পরিকল্পনামাফিক নানা ধরনের সামাজিক, আর্থিক ,সংস্কৃতিক চাপ সৃষ্টি করবার তাগিদ থেকে, গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির বিভিন্ন রাজ্যের প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে এভাবে ধ্বংসাত্মক মনোভাব নিয়ে চলেছে ।

সবথেকে নিন্দনীয় বিষয় হলো রমজান মাস এবং আসন্ন ঈদকে কেন্দ্র করে ছোটখাটো ব্যবসায়ীরা যে সমস্ত কর্মকা- করে, দোকানে নানা ধরনের জিনিসপত্র তোলে,ধার দেনা করে জিনিসপত্র তোলে- সেই সমস্ত জিনিসপত্রগুলিকে লুটপাট করবার তাগিদ থেকে হিন্দুত্ববাদী শক্তি অত্যন্ত লোভাতুর দৃষ্টিতে মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর এই পরিকল্পিত হামলা চালায় ।

সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচে ভারতের জয়লাভকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে এবং গুজরাটের গান্ধীনগর একইভাবে মসজিদগুলির উপর হামলা হয়েছে। মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় হামলা হয়েছে এবং গরিব মুসলমানদের ছোট ছোট দোকানে অবাধে লুটতরাজ চালিয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি গুলি। মসজিদে প্রার্থনারত মুসল্লিদের বাইক ভাঙ্গা হয়েছে। গাড়ি নষ্ট করা হয়েছে। অটোরিকশা নষ্ট করা হয়েছে ।বেছে বেছে মসজিদে প্রার্থনা করতে আসা মুসলমানদের যানবাহনের ওপর সুপরিকল্পিত হামলা চালিয়েছে বিজেপি আরএসএস এবং তাদের সমস্ত ধরনের সাঙ্গপাঙ্গেরা।

ভারতের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা যে খুব ভালো এমনটা দাবি করতে পারা যায় না। কারণ, রমজান মাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে ধরে একেবারে মুসলমানদের টার্গেট করে যেভাবে গোটা ভারতজুড়ে একটা সংকট তৈরি করতে চাইছে হিন্দু সম্প্রদায়িক শক্তি, সেই পর্যায়ক্রমটি পশ্চিমবঙ্গেও অত্যন্ত সবল, সফলভাবে তারা কার্যকরী করতে চাইছে। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা তথা বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী যেভাবে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ভেতরে বিধায়কদের হিন্দু-মুসলমানের নিরিখে বিভাজিত করছেন এবং তার উত্তরে যেভাবে খোদ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একদম সাম্প্রদায়িক প্ররোচনামূলক কথাবার্তা বলছেন, তা ঘিরে একটা গভীর আশঙ্কাদায়ক পরিস্থিতির উদ্ভব হতে শুরু করেছে ।

রমজান মাস উপলক্ষে একেবারে পরিকল্পিত উপায়ে পশ্চিমবঙ্গের ধর্মান্ধ সম্প্রদায়িক শক্তি বিজেপি আর তাদের দোসর প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িক শক্তি তৃণমূল কংগ্রেস পরস্পর পরস্পরের প্রতি যে ধরনের প্ররোচনামূলক কথাবার্তা বলতে শুরু করেছে,তার প্রভাব নানাভাবে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির উপরে পড়ছে । রমজান মাসের যে সিয়াম, যে আত্মত্যাগ, যে তিতিক্ষা-- তাকে বিপথে চালিত করবার জন্য আরএসএস তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি এবং তাদের স্বাভাবিক মিত্র তৃণমূল কংগ্রেস একইসঙ্গে ত্রিবিধ ধারায় এই রাজ্যে কার্যকরী করছে।

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা সংসদীয় রাজনীতির নিরিখে এই মুহূর্তে কোনো ক্ষমতা না রাখলেও জনগণের মধ্যে তাদের একটা বড় রকমের প্রভাব আছে। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে তাদের দৃঢ় অবস্থান পশ্চিমবঙ্গের ধর্মনিরপেক্ষ মানুষদের কাছে একটা বিশেষ রকমের আশা ভরসা জোগায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীদের মধ্যে একটা অংশকে, বিশেষভাবে প্ররোচিত এবং প্রভাবিত করবার চেষ্টা করছে ধর্মান্ধ হিন্দু সম্প্রদায়িক শক্তি বিজেপি, আরএসএস এবং তাদের স্বাভাবিক মিত্র, প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িক শক্তি তৃণমূল কংগ্রেস ।

গত তের বছর তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় থাকার ফলে যেভাবে ধর্মনিরপেক্ষ পশ্চিমবঙ্গ কে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক হিন্দু এবং রাজনৈতিক মুসলমানের বিভাজিত করবার চেষ্টা করা হচ্ছে, একটা অংশের বামপন্থীরা ,বুঝে হোক ,না বুঝে হোক ,সেই প্ররোচনায় পা দিয়ে ফেলছেন। ফলে যে নীতি-নিষ্ট ধর্ম নিরপেক্ষতার জায়গা থেকে সর্বস্তরের বামপন্থী নেতারা বা একটা বড় অংশের কর্মী সমর্থকরা ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি তাদের আস্থা জ্ঞাপন করতেন এবং ধর্মনিরপেক্ষতার মর্যাদা রক্ষা, সংখ্যালঘুর মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে আত্ম নিবেদিত থাকতেন, সেটা তাদের দলের সর্বত্র সমান মাত্রায় সঞ্চারিত হচ্ছে না।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

রূপকথার মতো মনে হলেও তিনি ছিলেন বাস্তবেরই নায়ক

গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইন প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্ত মত প্রকাশের গুরুত্ব

নিরাপদ অভিবাসন ও রেমিট্যান্স প্রবাহ

আর্থিক খাত নিয়ে অবিমৃষ্যকারী বক্তব্য

ভূমিকম্পের আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে

নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতেই হবে

মনে কী দ্বিধা রেখে নতুন প্রত্যাশায় নতুন দল!

ছবি

উন্নত বিশ্বের নাগরিকত্ব ও দুর্নীতি

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় : শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ির নিচে ছাত্র

নারীর অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন

আদালতের ভেতরে ভিডিও ধারণের আইনি দিক

আইনের শাসন না গণপিটুনি?

নারীর ভূমি ও কৃষি অধিকার : ন্যায়বিচারের পথে কতদূর?

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের হালচাল

জনতুষ্টিবাদীরা এগিয়ে আছে যেদিক থেকে

ভিক্ষাবৃত্তি : প্রয়োজন নাকি পেশা?

ছবি

বিনিময় কৌশল নাকি বাণিজ্য যুদ্ধ?

শিশু আদালতের বিচার-প্রক্রিয়ার আইনি ও বাস্তবিক দিক

জনদুর্ভোগের অপসংস্কৃতি ও জনশিক্ষা : আগামীর দিকনির্দেশনা

প্রসঙ্গ : নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি

হরিজনদের পদবি : ঐক্যের পথে বাধা

এল নিনো : দেশের কৃষির চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

আর কীভাবে আর্জি জানালে নিরাপত্তা পাওয়া যায়?

স্বপ্ন ভাঙল সাঁওতাল মুংলু বেসরার

কোনো স্কুলই খারাপ না

ঢাকার যানজটের টেকসই সমাধান কী

বই কেন পড়বেন

ডায়াবেটিসের জটিলতা বাড়ায় তামাক ও ধূমপান

জাতীয় বিমা দিবস

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থা

ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়া ভুল হয়ে থাকলে মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা সঠিক ছিল!

শিক্ষার গুণগত মান পরিবর্তনে শিক্ষকের মূল্যায়ন

দেশে প্রোগ্রামিংয়ের চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা

তর্কে সময়, সামর্থ্য এবং শক্তির অপচয় রোধ করুন

পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও দেশপ্রেমে জাতীয় অগ্রগতি

শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রাথমিকের লেখাপড়ায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ভারতব্যাপী সংঘ : বিজেপির নয়া কৌশল

গৌতম রায়

রোববার, ১৬ মার্চ ২০২৫

দোল উৎসবকে কেন্দ্র করে এই মুহূর্তে ভারতজুড়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার পারদ চড়াতে চাইছে হিন্দু সম্প্রদায়িক শক্তি। বেশ কিছুদিন ধরেই উত্তর ভারতে কোনোরকম হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলেই, সেটা কুম্ভ মেলা হোক বা শ্রাবণ মাসে বাঁক নিয়ে তীর্থযাত্রাই হোক, হিন্দুত্ববাদীরা এই সময়ে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত আগ্রাসী ভূমিকা পালন করতে শুরু করে দিতে শুরু করেছে।

সাম্প্রতিক অতীতে আমরা দেখেছি এই ধরনের ধর্মীয় গণহিস্টিরিয়া তৈরির ক্ষেত্রে তারা আশপাশের মুসলমান সম্প্রদায়ের দোকানগুলোকে টার্গেট করে। তাদের রুটিরুজি বন্ধের জন্য নানা ধরনের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং বিশেষ করে প্রশাসনিক ষড়যন্ত্র শুরু করে দেয়। এমন একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে, যাতে উত্তর ভারতের বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্র গুলিতে পেটের দায়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষজন, যারা অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া, তারা যে সমস্ত খাবারের দোকান বা বিভিন্ন ধরনের মনোহারি সামগ্রীর দোকানপত্র করে, সেগুলো যাতে তারা না করে, না খোলে, তার জন্য অনেক দিন আগে থেকে শুরু হয়ে যায় মুসলমানদের ওপরে একটা সামাজিক হুমকি।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে ফতোয়া জারি করা হয়, দোকানের সাইনবোর্ডে দোকানের মালিকের নাম লিখতে হবে। অর্থাৎ; দোকানের মালিক হিন্দু না মুসলমান এটা জানানো বাধ্যতামূলক করা হয় প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে। আর স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানদের দোকান থেকে যাতে তীর্থযাত্রীরা কোনোরকম খাবার বা জিনিস না কেনে তার জন্য শুরু হয়ে যায় বিভিন্ন ধরনের চাপ সৃষ্টি করা।

সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে যদি কোনো মসজিদ থাকে , তাহলে ত্রিপল দিয়ে সেইসব মসজিদগুলোকে ঢেকে দেয়া হয়। হিন্দু তীর্থযাত্রীদের ধর্মাচরণের পথে যাতে কোনো মসজিদ চক্ষুগোচর না হয় সেই জন্য। মসজিদগুলোকে প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে এবং নিজেদের রাজনৈতিক শক্তি প্রয়োগ করে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দিয়ে, একটা ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করে, আরএসএস-বিজেপিসহ গোটা হিন্দু সম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি উত্তর ভারত জুড়ে তান্ডব করে। পশ্চিমবঙ্গের কোনো কোনো ক্ষেত্রেও এই ধরনের অভিযোগ শুনতে পাওয়া যায়।

বিশেষ করে মহরমের অল্প কিছুকাল আগে পরে যে রামনবমী পালন করে একাংশের হিন্দুরা, যাদের মধ্যে উত্তর ভারতের লোকজন বেশি ,তারা এই সময়কালে রামনবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে মসজিদ ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা পশ্চিমবঙ্গের বুকে চালায়। স্থানীয় মুসলমানদের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক হিন্দুদের এই অপকর্ম সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ প্রশাসনকে বারবার জানিয়েও খুব একটা সুফল গত কয়েক বছরে পাওয়া যায়নি।

দোল উৎসবকে কেন্দ্র করে গোটা উত্তরপ্রদেশজুড়ে এই ধরনের সাম্প্রদায়িক কর্মকা- সরাসরি সেখানকার বিজেপি সরকারের প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়ে শুরু করে হিন্দুত্ববাদীরা। উত্তরপ্রদেশের আলিগড় অঞ্চলের বিজেপি নেতা রঘুনাথ সিং হোলি ঘিরে ফতোয়া জারি করে, হোলির দিন মুসলমানদের ত্রিপলের হিজাব পড়ে বাইরে বের হতে হবে। এখানেই উত্তরপ্রদেশ সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান দপ্তরের উপদেষ্টা পদে কর্মরত রঘুনাথ সিং থেমে থাকেনি। সে আরো ফতোয়া জারি করে বলেছে, হোলির দিন ত্রিপল দিয়ে সমস্ত মসজিদ ঢেকে রাখতে হবে। যদি এভাবে ত্রিপল দিয়ে মসজিদ ঢেকে রাখা হয়, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। তা না হলে সমস্যা হতে পারে।

প্রসঙ্গত, উল্লেখ্য রঘুনাথ সিং যে পদটিতে রয়েছেন সেটি রাজ্যের একটি ক্যাবিনেট মন্ত্রীর পর্যায়ের পদ এবং ক্যাবিনেট মন্ত্রী যে ধরনের প্রশাসনিক সুযোগ-সুবিধা পান, ঠিক একই রকম সুযোগ-সুবিধা এই রঘুনাথ পেয়ে থাকে উত্তরপ্রদেশ সরকারের কাছ থেকে।

হোলিকে কেন্দ্র করে আলিগড় শহরে হিন্দুত্ববাদীদের নৃশংসতা কোন জায়গায় পৌঁছেছে তা বুঝতে পারা যায়, সেখানকার বিজেপি নেতাদের বিভিন্ন ফতোয়ার মধ্যে দিয়ে। মুসলমান সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে কিন্তু জুম্মাবারে হোলি পড়াতে, জুম্মার নামাজের সময়টাকে খানিকটা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে হিন্দুদের হোলি পালনের সময়ের সঙ্গে কোনো সংঘর্ষ না হয়। মুসলমান সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, হোলি উৎসব দুপুরে শেষ হওয়ার পরই তারা জুম্মার নামাজ আদায় করবেন। তা সত্ত্বেও কিন্তু হিন্দুত্ববাদীরা একযোগে উসকানি চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, মহিলাদের তো হিজাব পরা বাধ্যতামূলক। এমনকি পুরুষদেরও ত্রিপলের হিজাব পড়ে বের হতে হবে, যাতে তাদের টুপিতে কোনো রং না লাগে। সেই কারণে মুসলমান পুরুষদের চটের হিজাব দিয়ে নিজেদের টুপি ঢেকে রাখতে হবে বলে ফতোয়া জারি করেছে বিজেপি নেতা রঘুরাথ।

অর্থাৎ রং দেয়া কেন্দ্র করে যে একটা অশান্তি তৈরির চেষ্টা আরএসএস-বিজেপি বা তাদের সাঙ্গোপাঙ্গরা চালাবেরর এটাই বিজেপি নেতা রঘুরাথ সিংয়ের বক্তব্যের মধ্যে থেকে ইতিমধ্যেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। এখানেই থেমে থাকেনি হিন্দুত্ববাদীরা ।তারা আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রাম মন্দির বানানোর দাবি তুলতে শুরু করেছে। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বিজেপি নেতার রঘুনাথ সিং আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রাম মন্দির তৈরি করবার হিন্দুত্ববাদী শক্তির দাবিকে দুহাত তুলে সমর্থন জানাতে শুরু করেছে।

কেবলমাত্র আলীগড়ের যে দোলকে কেন্দ্র করে মসজিদগুলো ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে তা নয়। গোটা উত্তরপ্রদেশজুড়েই এই সামাজিক বিভৎসতা চালাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী শক্তি। বহু আলোচিত সম্ভোলে দশটি মসজিদ ইতোমধ্যে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। সম্ভলে যে দশটি মসজিদ ঢেকে দেয়া হয়েছে ত্রিপল দিয়ে তার মধ্যে সমীক্ষা-বিচারাধীন শাহী জামা মসজিদ টিকেও ঢেকে দেয়া হয়েছে।

উত্তরপ্রদেশের শাহজাহানপুরে গোটা জেলাজুড়ে প্রায় সাতষট্টিটি মসজিদ ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। শাহজাহানপুর জেলাতে ‘জুতা মার হোলি’ বলে দোল কে কেন্দ্র করে একটি মিছিল বেরোয়। সেই মিছিল যে সমস্ত পথ পরিক্রমা করবে, সেই সমস্ত পথে যে সাতষট্টিটি মসজিদ পড়ে, তার সব কটা ত্রিপল দিয়ে মুড়ে দেয়া হয়েছে। সংবেদনশীল এলাকার নাম করে গোটা শাহজাহানপুর জেলাজুড়ে পুলিশ ফ্লাগ মার্চ করেছে। সম্ভোল জেলার পুলিশ সুপার ইতোমধ্যেই প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছেন যে, কোনরকম জবরদস্তি বরদাস্ত করা হবে না। সেখানকার জামা মসজিদের বাইরে বিরাট পুলিশ বাহিনী নিয়োগ করা হয়েছে। শহরের দশটি মসজিদ ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে।সংবেদনশীল এলাকার নাম করে গোটা শহরজুড়ে পুলিশ সেখানে টহলদারি করছে।

সম্ভোলের জামা মসজিদের মৌলানা আফতাব, নামাজের সময় পিছিয়ে দুপুর দুটো করে দিয়েছেন, তাতেও কিন্তু হিন্দুত্ববাদীরা খুশি হতে পারছে না। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ,যাতে মসজিদে কোনোভাবে রং না পড়ে সেই জন্যই নাকি ত্রিপল দিয়ে মসজিদ গুলি ঢেকে দেয়া হচ্ছে ।জোনপুরে হোলি- জুম্মার নামাজ যাতে কোনো রকম সমস্যা না করে ,তার নাম করে বড় বড় মসজিদে জুম্মার নামাজের সময় পরিবর্তিত করে দেওয়া হয়েছে। ঠিক একই অবস্থা করা হয়েছে ললিতপুর , রাইয়ারয়েও কিভাবে হোলি কে কেন্দ্র করে জুমার নামাজের সময় পরিবর্তিত করে দেওয়া হয়েছে।

অতীতে মসজিদ যে সমস্ত অঞ্চলে আছে সেই সমস্ত এলাকার মধ্যে দিয়ে হোলির মিছিল যেতে না পারে বা গেলেও মসজিদগুলি রক্ষার ব্যাপারে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে অত্যন্ত দৃঢ় ভূমিকা পালন করা হতো। কিন্তু কেন্দ্র এবং রাজ্যে একই যোগে উত্তরপ্রদেশে ,বিজেপি ক্ষমতায় থাকার তরুণ অতীতের সেই সমস্ত ব্যবস্থা এখন একেবারে পাল্টে ফেলা হয়েছে। কিভাবে প্ররোচনা তৈরি করতে পারা যায়, তার জন্য একযোগে বিজেপি এবং রাজ্য প্রশাসন নিজেদের নিয়োজিত করে ।

এই অবস্থা যে কেবলমাত্র উত্তরপ্রদেশে, তাইই নয়। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাটসহ উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এবং সুদূর পশ্চিম ভারতের রাজস্থানেও এভাবে হোলিকে কেন্দ্র করে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের সঙ্গে পায়ে পা বাঁধীয়ে ঝগড়া বাধাবার একটা উপক্রম তৈরি করা হয়েছে।

রমজান মাসে প্রার্থনারত মুসলমানদের উপর , উপাসনারত মুসলমানদের উপর একেবারে পরিকল্পনামাফিক নানা ধরনের সামাজিক, আর্থিক ,সংস্কৃতিক চাপ সৃষ্টি করবার তাগিদ থেকে, গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির বিভিন্ন রাজ্যের প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে এভাবে ধ্বংসাত্মক মনোভাব নিয়ে চলেছে ।

সবথেকে নিন্দনীয় বিষয় হলো রমজান মাস এবং আসন্ন ঈদকে কেন্দ্র করে ছোটখাটো ব্যবসায়ীরা যে সমস্ত কর্মকা- করে, দোকানে নানা ধরনের জিনিসপত্র তোলে,ধার দেনা করে জিনিসপত্র তোলে- সেই সমস্ত জিনিসপত্রগুলিকে লুটপাট করবার তাগিদ থেকে হিন্দুত্ববাদী শক্তি অত্যন্ত লোভাতুর দৃষ্টিতে মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর এই পরিকল্পিত হামলা চালায় ।

সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচে ভারতের জয়লাভকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে এবং গুজরাটের গান্ধীনগর একইভাবে মসজিদগুলির উপর হামলা হয়েছে। মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় হামলা হয়েছে এবং গরিব মুসলমানদের ছোট ছোট দোকানে অবাধে লুটতরাজ চালিয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি গুলি। মসজিদে প্রার্থনারত মুসল্লিদের বাইক ভাঙ্গা হয়েছে। গাড়ি নষ্ট করা হয়েছে। অটোরিকশা নষ্ট করা হয়েছে ।বেছে বেছে মসজিদে প্রার্থনা করতে আসা মুসলমানদের যানবাহনের ওপর সুপরিকল্পিত হামলা চালিয়েছে বিজেপি আরএসএস এবং তাদের সমস্ত ধরনের সাঙ্গপাঙ্গেরা।

ভারতের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা যে খুব ভালো এমনটা দাবি করতে পারা যায় না। কারণ, রমজান মাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে ধরে একেবারে মুসলমানদের টার্গেট করে যেভাবে গোটা ভারতজুড়ে একটা সংকট তৈরি করতে চাইছে হিন্দু সম্প্রদায়িক শক্তি, সেই পর্যায়ক্রমটি পশ্চিমবঙ্গেও অত্যন্ত সবল, সফলভাবে তারা কার্যকরী করতে চাইছে। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা তথা বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী যেভাবে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ভেতরে বিধায়কদের হিন্দু-মুসলমানের নিরিখে বিভাজিত করছেন এবং তার উত্তরে যেভাবে খোদ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একদম সাম্প্রদায়িক প্ররোচনামূলক কথাবার্তা বলছেন, তা ঘিরে একটা গভীর আশঙ্কাদায়ক পরিস্থিতির উদ্ভব হতে শুরু করেছে ।

রমজান মাস উপলক্ষে একেবারে পরিকল্পিত উপায়ে পশ্চিমবঙ্গের ধর্মান্ধ সম্প্রদায়িক শক্তি বিজেপি আর তাদের দোসর প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িক শক্তি তৃণমূল কংগ্রেস পরস্পর পরস্পরের প্রতি যে ধরনের প্ররোচনামূলক কথাবার্তা বলতে শুরু করেছে,তার প্রভাব নানাভাবে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির উপরে পড়ছে । রমজান মাসের যে সিয়াম, যে আত্মত্যাগ, যে তিতিক্ষা-- তাকে বিপথে চালিত করবার জন্য আরএসএস তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি এবং তাদের স্বাভাবিক মিত্র তৃণমূল কংগ্রেস একইসঙ্গে ত্রিবিধ ধারায় এই রাজ্যে কার্যকরী করছে।

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা সংসদীয় রাজনীতির নিরিখে এই মুহূর্তে কোনো ক্ষমতা না রাখলেও জনগণের মধ্যে তাদের একটা বড় রকমের প্রভাব আছে। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে তাদের দৃঢ় অবস্থান পশ্চিমবঙ্গের ধর্মনিরপেক্ষ মানুষদের কাছে একটা বিশেষ রকমের আশা ভরসা জোগায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীদের মধ্যে একটা অংশকে, বিশেষভাবে প্ররোচিত এবং প্রভাবিত করবার চেষ্টা করছে ধর্মান্ধ হিন্দু সম্প্রদায়িক শক্তি বিজেপি, আরএসএস এবং তাদের স্বাভাবিক মিত্র, প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িক শক্তি তৃণমূল কংগ্রেস ।

গত তের বছর তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় থাকার ফলে যেভাবে ধর্মনিরপেক্ষ পশ্চিমবঙ্গ কে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক হিন্দু এবং রাজনৈতিক মুসলমানের বিভাজিত করবার চেষ্টা করা হচ্ছে, একটা অংশের বামপন্থীরা ,বুঝে হোক ,না বুঝে হোক ,সেই প্ররোচনায় পা দিয়ে ফেলছেন। ফলে যে নীতি-নিষ্ট ধর্ম নিরপেক্ষতার জায়গা থেকে সর্বস্তরের বামপন্থী নেতারা বা একটা বড় অংশের কর্মী সমর্থকরা ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি তাদের আস্থা জ্ঞাপন করতেন এবং ধর্মনিরপেক্ষতার মর্যাদা রক্ষা, সংখ্যালঘুর মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে আত্ম নিবেদিত থাকতেন, সেটা তাদের দলের সর্বত্র সমান মাত্রায় সঞ্চারিত হচ্ছে না।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

back to top