alt

উপ-সম্পাদকীয়





























  • download

বহুমাত্রিক দ্বন্দ্বের ফেরে বিএনপি ও এনসিপি

গাজী তারেক আজিজ

: শনিবার, ১২ এপ্রিল ২০২৫

পাঁচ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর মূলধারার বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র মধ্যে যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও মতানৈক্যের স্ফুরণ ঘটেছে, তা বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এশটি নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করেছে। একদিকে ঐতিহ্যবাহী ও প্রথাগত রাজনীতি, অন্যদিকে আধুনিকতাবাদ ও কৌশলগত বাস্তবতার টানাপোড়েনÑএই দ্বৈত প্রেক্ষাপটেই চলছে বিএনপি ও এনসিপির দ্বন্দ্ব। জাতীয় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত তার রেশ ছড়িয়েছে। কর্মীরা জড়িয়েছে বাগযুদ্ধে। ক্ষেত্রবিশেষে হামলা পাল্টা হামলা মামলা পর্যন্ত গড়িয়েছে। যা এষনও ধারাবাহিকভাবে ঘটিয়ে চলেছে। আবার কখনো রাষ্ট্রপতি ইস্যু। কখনো সংবিধান ইস্যু। কখনো ভোট। কখনো সংস্কার এইসব নানা ইস্যুতে দাবার চালে খুঁটি গেঁড়ে বসার মতো অবস্থান ধরে রেখে কিছুটা হলেও নতুন দলটি বা তাদের অনুসারীদের চিন্তা চেতনায় বাদ সেধেছে। যদিও বিএনপি এই মুহূর্তে নির্বাচনের বিকল্প কিছু ভাবতে নারাজ। এতে করে দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হতে শুরু করে।

২০২৪-পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতা: ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন অনেক প্রশ্ন ও বিতর্কের জন্ম দেয় বলে দাবি করে আসছে রাজনৈতিক দলগুলো। বিরোধী জোটের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা, নির্বাচনকালীন সহিংসতা এবং ভোটার উপস্থিতি নিয়ে বিতর্কÑ সবমিলিয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রশ্নবিদ্ধতা রাজনৈতিক অঙ্গনে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। এই সময়েই, সাবেক সিভিল সোসাইটি ও সরকারের জাতীয় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তত্ত্বাবধানে গঠিত হয় এনসিপি, অভিযোগ বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলসমূহের। দলটির নেতৃত্বে থেকে যারা নিজেদের ‘অবিকল্প নাগরিক প্ল্যাটফর্ম’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কার্যত কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য কিংবা গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে সেটাই দেখার বিষয়। এনসিপি প্রথমদিকে গণআন্দোলনের শরিক হিসেবে বিএনপির ঘনিষ্ঠ ছিল। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তাদের অবস্থান পরিবর্তন, ‘রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া’র নামে সরকারের সাথে আলোচনায় বসা, জাতীয় সংলাপের পক্ষে অবস্থান নেওয়াÑএই সকল পদক্ষেপ বিএনপি ও তার শরিকদের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। ফলত, দুই পক্ষের মধ্যে শুরু হয় শীতল দ্বন্দ্ব, যা এখন ক্রমেই উষ্ণ হয়ে উঠেছে। এরই প্রেক্ষিতে দূরত্ব ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

আদর্শ বনাম কৌশল: দ্বন্দ্বের বুনিয়াদ:

বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে ‘শাসক দল হটাও’ ধ্যানধারণায় অনড় থেকেছে। তারা সংবিধানের পুনঃবিন্যাস, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও অবাধ নির্বাচনের দাবি তুলে আসছে। অপরদিকে এনসিপি, যারা রাজনীতিতে ‘সমঝোতা’ এবং ‘পলিসি বেইসড ডায়ালগ’-এর ধারক, তারা বর্তমান ব্যবস্থার মধ্যেই সংস্কার এবং অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের প্রসারে বিশ্বাস রাখে। বলেই প্রচার করে আসছে। যা দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতাদের বক্তব্যে ফুটেও ওঠেছে বিভিন্ন সময়ে। আদর্শগত ভিন্নতা থেকেই দ্বন্দ্বের সূচনা বলে মনে করা হচ্ছে। বিএনপি মনে করে, এনসিপির নরম কৌশল আসলে সরকারের জন্য ‘সেফ এক্সিট রুট’ তৈরি করছে, যেখানে গণতন্ত্রের আসল চেতনা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে এনসিপি বিএনপিকে ‘অবাস্তববাদী’, ‘অতীতকেন্দ্রিক’ এবং ‘সংঘাতপ্রবণ’ বলেও প্রচার করে। ফলে এই দ্বন্দ্ব শুধু কৌশলগত নয়, বরং আদর্শিক ও দৃষ্টিভঙ্গিরও।

মাঠ পর্যায়ের প্রতিফলন:

বিএনপির নেতাকর্মীরা এনসিপির সভা-সমাবেশ নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়। এনসিপি সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের

ওপর হামলা, সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচার এবং যৌথ কর্মসূচি থেকে সরে আসার মতো কার্যক্রম রাজনৈতিক

বিভাজনকে আরও তীব্র করে তুলেছে। এই দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে সামাজিক মাধ্যমেও দ্বিমুখী ভাষ্য গড়ে উঠেছেÑ একপক্ষে ‘সহনশীল পরিবর্তনের প্রবক্তা’ এনসিপি, অপরপক্ষে ‘ব্যবস্থা-বিরোধী বিপ্লবের পুরোধা’ বিএনপি। দুই পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে টুইটার, ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে ঘন ঘন সংঘাত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যার ফলে তৃণমূল সব সময় উত্তপ্ত থাকছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও পৃষ্ঠপোষকতা:

এই দ্বন্দ্ব আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ছায়া ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এনসিপির ‘ডায়ালগ’-ভিত্তিক

রাজনীতির প্রশংসা করেছে, যেখানে তারা গঠনমূলক অংশগ্রহণের কথা বলছে। অন্যদিকে, বিএনপির লাগাতার

আন্দোলন ও হরতালের হুমকি ধামকি কূটনৈতিক মহলে কিছুটা বিরক্তিরও কারণ হয়েছে। আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতায়

এনসিপির বাড়তি সুবিধা পাওয়া ও বিএনপির চিরাচরিত শক্তি হারানোর আশঙ্কা দুই পক্ষের মধ্যে সন্দেহের দেয়ালকে

আরও পোক্ত করছে।

মিডিয়া এবং জনমত:

গণমাধ্যমে এনসিপি তুলনামূলকভাবে ইতিবাচক প্রচার পাচ্ছে। বিভিন্ন টকশো ও সংবাদ বিশ্লেষণে তাদের ‘বিকল্প

শক্তি’ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। বিএনপি একে ‘গভর্নমেন্ট-ম্যানুফ্যাকচার্ড অপজিশন’ বলে সন্দেহ প্রকাশ করছে।

অন্যদিকে, এনসিপি অভিযোগ তোলে যে বিএনপি গত দশকে আন্দোলনের নামে একাধিক ভুল কৌশলে নিজেদের

গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। জনমতের দিক থেকেও বিভাজন স্পষ্ট। শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি অনেকাংশে এনসিপির ‘সুশীল

রাজনীতি’কে সমর্থন করছে, তবে গ্রামের মাঠে এখনও বিএনপির সাংগঠনিক ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা উল্লেখযোগ্য।

অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে কিছু ত্যাগী কর্মী সৃষ্টিতে দলটির নেতৃত্বের বেশ প্রশংসনীয় ছিল।

তরুণ সমাজের দ্বিধা:

বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই বিভক্তি আরও স্পষ্ট। একাংশ সুশৃঙ্খল পরিবর্তন চায়, যারা এনসিপিকে দেখছে

আশার আলো হিসেবে। আবার একাংশ বিশ্বাস করে, রাজপথেই গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা সম্ভব, যারা বিএনপির পক্ষে

আছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই বিভাজন আগামী রাজনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। বলেও ধারণা করা হচ্ছে।

যদি ভোটারের বয়স কমিয়ে ১৭ বছর করা হয় তবে, কি পরিমাণ ভোটার বাড়বে তা এখনই না বলা গেলেও, এই

বয়সী ভোটাররা নতুন দলের প্রতি সমর্থন জানাবে বলেই মনে করছে এনসিপি।

ভবিষ্যতের সম্ভাব্য গতি-প্রকৃতি:

বিএনপি ও এনসিপির দ্বন্দ্ব ভবিষ্যতে দুইটি প্রবণতা তৈরি করতে পারেÑ

১. একান্ত মেরুকরণ: বিরোধী রাজনীতি দুই শিবিরে ভাগ হয়ে যাবেÑএকটি বিপ্লবী, অপরটি কৌশলগত

সংস্কারপন্থী। এতে বিরোধী শক্তি একক ভাবে আর শক্তিশালী হয়ে উঠবে না, বরং পারস্পরিক সংঘাতেই দুর্বল হবে।

২. সম্ভাব্য সংলাপ ও ঐক্য: ভবিষ্যতের রাজনৈতিক চাপ ও জনমতের চাপে বিএনপি ও এনসিপি সীমিত কাঠামোয়

যৌথ কর্মসূচিতে আসতে বাধ্য হতে পারে। এতে বিরোধী আন্দোলন নতুন গতি পেতে পারে। তবে প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কর্মী সমর্থকদের বৃহদাংশই সংস্কার চায় দলে ও নেতৃত্বে। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে পাশ কাটিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ সে অর্থে থাকছে না। আর এতে করে নতুন দল আওয়ামী লীগের সমর্থকদের সমর্থন পেতেও মরিয়া। কারণ একটা নতুন দল গঠনের পর তাদের চিন্তা চেতনা আদর্শ কি হবে তা-ই নিয়েই সমর্থনের বিষয়টি আসে। দেশের অধিকাংশ জনগণ এখনো মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের রাজনীতি দেখতে চায়। দেশ পরিচালনা করুক তা চায়। এমনটাই বিশ্লেষকদের ধারণা।

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এনসিপির ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান নিয়ে যত বিতর্ক:

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে হঠাৎ করেই একটি স্লোগান ঘিরে শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্কÑ ইনকিলাব জিন্দাবাদ;। জাতীয়তাবাদী নাগরিক পার্টি (এনসিপি), একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তি, এই স্লোগানকে তাদের রাজনৈতিক সভা, মিছিল ও প্রচারণায় ব্যবহার করতে শুরু করার পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা ও প্রতিক্রিয়ার ঝড় উঠেছে।

স্লোগানের ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট:

ইনকিলাব জিন্দাবাদÑ উর্দু ভাষার এই স্লোগানের অর্থ বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। উপমহাদেশে এটি প্রথম জনপ্রিয় হয় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময়। ভারতীয় উপমহাদেশের বিপ্লবী সংগঠনগুলো যেমন ভগৎ সিং-এর হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন এই স্লোগান ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে। পরবর্তীতে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এর প্রবেশ ঘটে, যেখানে এটি ইসলামপন্থি ও রাষ্ট্রবিরোধী উগ্র রাজনীতির প্রতীক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে বলেও মনে করা হয়ে থাকে।

এনসিপির ব্যবহার ও যুক্তি:

এনসিপি দাবি করছে, তারা এই স্লোগানকে ‘বিপ্লবী চেতনা এবং ‘জনগণের পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা’র প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করছে। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, এটি একটি ্য়ঁড়ঃ;অপদার্থ রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনসাধারণের প্রতিরোধ প্রকাশের ভাষা।

বিএনপি ও বামপন্থীদের সমালোচনা:

বিএনপি বলছে, এনসিপির এই স্লোগান ব্যবহারের মাধ্যমে তারা রাজনৈতিক বিভ্রান্তি তৈরি করছে এবং উর্দুভাষার ঐতিহাসিক স্লোগানকে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে। অপরদিকে, বামপন্থী দলগুলো অভিযোগ করছে, এনসিপি এই বিপ্লবী শব্দকে খ-িত অর্থে ব্যবহার করছে, যেটি প্রকৃত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মূল উদ্দেশ্যকে বিকৃত করে।

আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া:

আওয়ামী লীগ এই স্লোগানকে ‘পাকিস্তানপন্থী মনোভাবের পুনরুত্থান’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। তারা মনে করছে,

“ইনকিলাব জিন্দাবাদ” স্লোগান দিয়ে এনসিপি একদিকে ইতিহাস বিকৃত করছে, অন্যদিকে রাজনৈতিক আবেগকে

উসকে দিচ্ছে।

বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজের প্রশ্ন:

অনেক বিশিষ্ট নাগরিক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রশ্ন তুলেছেনÑ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কেন একটি উর্দু

স্লোগানকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে? তাদের মতে, একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের দেশ বাংলাদেশে

উর্দুভাষার স্লোগান ব্যবহার অনৈতিক ও প্রতীকীভাবে বিপজ্জনক।

তরুণদের বিভক্ত প্রতিক্রিয়া:

তরুণদের একাংশ স্লোগানটিকে “আন্দোলনের শক্তিশালী বার্তা” হিসেবে দেখছে, আবার কেউ বলছে এটি “পপুলিজমের

ফাঁদ”। কেউ কেউ বলছে, ভাষা নয়, বরং বার্তা গুরুত্বপূর্ণÑ যদি তা গণমানুষের পক্ষ নেয়। আবার কেউ বলছে, রাজনীতিতে প্রতীকী শব্দের ব্যবহারে সংবেদনশীলতা থাকা জরুরি। “ইনকিলাব জিন্দাবাদ” স্লোগানকে ঘিরে বিতর্কটা কেবল শব্দচয়ন নিয়ে নয়, বরং এটি বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ, ইতিহাস চেতনা, ভাষাগত আত্মপরিচয় এবং রাজনৈতিক কৌশলের মধ্যকার গভীর দ্বন্দ্বকে সামনে নিয়ে এসেছে।

এনসিপি কীভাবে এই বিতর্ক সামলাবে, এবং তারা আদৌ এই স্লোগানে অনড় থাকবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়। যদিও তারা আরও আন্দোলন চলাকালীন দেওয়া নিজেদের স্লোগানকেও দলীয় বলে প্রচার করছে। বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এই দ্বন্দ্ব আশীর্বাদ না অভিশাপÑতা নির্ভর করছে ভবিষ্যতের কৌশলগত সিদ্ধান্ত ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার উপর। যদি দুই পক্ষই নিজেদের অবস্থান থেকে কিছুটা নমনীয় হয়, তবে একটি সুস্থ ও শক্তিশালী ধারার বিকাশ সম্ভব। অন্যথায়, এই দ্বন্দ্ব ক্ষমতাসীনদের আরও সুবিধা করে দেবে এবং জনগণের আস্থা বিরোধী রাজনীতির প্রতি আরও ক্ষয়প্রাপ্ত হতে পারে বলেও মনে হয়। ইস্যুভিত্তিক এইসব দ্বন্দ্বের জেরে বিএনপি কি রাজনৈতিক মাঠে নিজেদের অবস্থান হারাতে পারে? তা-ও সময়ই বলে দেবে। সবকিছু ছাপিয়ে নতুন দল এনসিপি যতটুকু মনযোগ আকৃষ্ট করবে বলে ধারণা করা হয়েছিল, তা কেন জানি হয়নি! এর পেছনে রয়েছে মাঠপর্যায়ে নেতাকর্মীদের বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকা-। তেমনটাই ধারণা করছেন বিশ্লেষকগণ। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে ব্যর্থ হলে দলটির অবস্থাও ১৫ আগস্ট পরবর্তী ফ্রিডম পার্টির মতো! তেমনটাও মনে করছেন কেউ কেউ।

[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

স্নায়ুরোগ চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন জরুরি

জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাব ও করণীয়

শাসনব্যবস্থা : জনগণের প্রত্যাশা ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব

বয়নামা দলিল কখন স্বত্বের দলিল হিসেবে পরিগণিত হয়?

বর্ষার আগেই নদীভাঙনের আতঙ্কে উপকূলবাসী

ছবি

ভূমিকম্প ঝুঁকিতে দেশ : মোকাবিলায় প্রস্তুতি প্রয়োজন

‘রিসেটের’ পরাকৌশল কী হওয়া প্রয়োজন

প্রসঙ্গ : জাতীয় বাজেট

ব্রুনোর শ্মশান মঞ্চ

দুর্নীতির অবিশ্বাস্য খতিয়ান

সাম্য, ন্যায়বিচার, সুশাসন, বহুত্ববাদ : সবকা সাথ্ সবকা বিকাশ!

পশ্চিমবঙ্গে ভয়াবহ সংকটে ধর্মনিরপেক্ষতা

পেশাগত দায় ও নৈতিকতা

বিনোদনের রূপান্তর : সংস্কৃতির সংকোচন ও নতুন পথ

রম্যগদ্য : ‘চোর চাই, চোর...’

শুভ-অশুভ বলে কিছু কি আছে

পহেলা বৈশাখের সঙ্গে মিশে আছে কৃষি ও কৃষক

বাংলাদেশে ঘটনা অঘটন: প্রায় সবক্ষেত্রেই ইস্যু নির্বাচন

ছবি

নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও বহুত্ববাদ

বৈসাবি : সম্মিলনের জাতীয় উৎসব

সংকট ও সংক্রান্তির শক্তি

ছবি

গাজার অশ্রু : ইসরায়েলের বর্বরতা ও বিশ্বের নীরবতা

দেশের কৃষি অর্থনীতির নীরব নায়িকারা

ফৌজদারি মামলায় অপরাধের আলামত উদ্ধারে আইন মানতে বাধা কোথায়?

জলবায়ুর নতুন ছকে বদলে যাচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ভারতে ওয়াকফ সংশোধনী আইন নিয়ে বিতর্ক

কীটনাশকের বিষচক্র : উন্নয়নের নামে শোষণ ও বিপর্যয়

বোরো ধান উৎপাদনে প্রধান অন্তরায় বিদ্যুৎ-বিভ্রাট

ঢাকার বাসিন্দাদের নিঃশ্বাসে এক বিপন্নতা

‘রিফাইন্ড’ আওয়ামী লীগ হলে ‘ওয়াশিং মেশিন পার্টি’ বেকার হয়ে পড়বে না তো!

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশে সংক্ষুব্ধ ‘আমরা’ কারা?

বাসন্তী পূজা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস : বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার চিত্র

মার্কিন নীতির পরিবর্তনে ইউক্রেনের পরিণতি

গাজা : ক্রমবর্ধমান মানবিক ও রাজনৈতিক সংকট

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বহুমাত্রিক দ্বন্দ্বের ফেরে বিএনপি ও এনসিপি

গাজী তারেক আজিজ

  • download

শনিবার, ১২ এপ্রিল ২০২৫

পাঁচ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর মূলধারার বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র মধ্যে যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও মতানৈক্যের স্ফুরণ ঘটেছে, তা বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এশটি নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করেছে। একদিকে ঐতিহ্যবাহী ও প্রথাগত রাজনীতি, অন্যদিকে আধুনিকতাবাদ ও কৌশলগত বাস্তবতার টানাপোড়েনÑএই দ্বৈত প্রেক্ষাপটেই চলছে বিএনপি ও এনসিপির দ্বন্দ্ব। জাতীয় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত তার রেশ ছড়িয়েছে। কর্মীরা জড়িয়েছে বাগযুদ্ধে। ক্ষেত্রবিশেষে হামলা পাল্টা হামলা মামলা পর্যন্ত গড়িয়েছে। যা এষনও ধারাবাহিকভাবে ঘটিয়ে চলেছে। আবার কখনো রাষ্ট্রপতি ইস্যু। কখনো সংবিধান ইস্যু। কখনো ভোট। কখনো সংস্কার এইসব নানা ইস্যুতে দাবার চালে খুঁটি গেঁড়ে বসার মতো অবস্থান ধরে রেখে কিছুটা হলেও নতুন দলটি বা তাদের অনুসারীদের চিন্তা চেতনায় বাদ সেধেছে। যদিও বিএনপি এই মুহূর্তে নির্বাচনের বিকল্প কিছু ভাবতে নারাজ। এতে করে দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হতে শুরু করে।

২০২৪-পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতা: ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন অনেক প্রশ্ন ও বিতর্কের জন্ম দেয় বলে দাবি করে আসছে রাজনৈতিক দলগুলো। বিরোধী জোটের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা, নির্বাচনকালীন সহিংসতা এবং ভোটার উপস্থিতি নিয়ে বিতর্কÑ সবমিলিয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রশ্নবিদ্ধতা রাজনৈতিক অঙ্গনে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। এই সময়েই, সাবেক সিভিল সোসাইটি ও সরকারের জাতীয় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তত্ত্বাবধানে গঠিত হয় এনসিপি, অভিযোগ বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলসমূহের। দলটির নেতৃত্বে থেকে যারা নিজেদের ‘অবিকল্প নাগরিক প্ল্যাটফর্ম’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কার্যত কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য কিংবা গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে সেটাই দেখার বিষয়। এনসিপি প্রথমদিকে গণআন্দোলনের শরিক হিসেবে বিএনপির ঘনিষ্ঠ ছিল। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তাদের অবস্থান পরিবর্তন, ‘রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া’র নামে সরকারের সাথে আলোচনায় বসা, জাতীয় সংলাপের পক্ষে অবস্থান নেওয়াÑএই সকল পদক্ষেপ বিএনপি ও তার শরিকদের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। ফলত, দুই পক্ষের মধ্যে শুরু হয় শীতল দ্বন্দ্ব, যা এখন ক্রমেই উষ্ণ হয়ে উঠেছে। এরই প্রেক্ষিতে দূরত্ব ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

আদর্শ বনাম কৌশল: দ্বন্দ্বের বুনিয়াদ:

বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে ‘শাসক দল হটাও’ ধ্যানধারণায় অনড় থেকেছে। তারা সংবিধানের পুনঃবিন্যাস, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও অবাধ নির্বাচনের দাবি তুলে আসছে। অপরদিকে এনসিপি, যারা রাজনীতিতে ‘সমঝোতা’ এবং ‘পলিসি বেইসড ডায়ালগ’-এর ধারক, তারা বর্তমান ব্যবস্থার মধ্যেই সংস্কার এবং অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের প্রসারে বিশ্বাস রাখে। বলেই প্রচার করে আসছে। যা দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতাদের বক্তব্যে ফুটেও ওঠেছে বিভিন্ন সময়ে। আদর্শগত ভিন্নতা থেকেই দ্বন্দ্বের সূচনা বলে মনে করা হচ্ছে। বিএনপি মনে করে, এনসিপির নরম কৌশল আসলে সরকারের জন্য ‘সেফ এক্সিট রুট’ তৈরি করছে, যেখানে গণতন্ত্রের আসল চেতনা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে এনসিপি বিএনপিকে ‘অবাস্তববাদী’, ‘অতীতকেন্দ্রিক’ এবং ‘সংঘাতপ্রবণ’ বলেও প্রচার করে। ফলে এই দ্বন্দ্ব শুধু কৌশলগত নয়, বরং আদর্শিক ও দৃষ্টিভঙ্গিরও।

মাঠ পর্যায়ের প্রতিফলন:

বিএনপির নেতাকর্মীরা এনসিপির সভা-সমাবেশ নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়। এনসিপি সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের

ওপর হামলা, সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচার এবং যৌথ কর্মসূচি থেকে সরে আসার মতো কার্যক্রম রাজনৈতিক

বিভাজনকে আরও তীব্র করে তুলেছে। এই দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে সামাজিক মাধ্যমেও দ্বিমুখী ভাষ্য গড়ে উঠেছেÑ একপক্ষে ‘সহনশীল পরিবর্তনের প্রবক্তা’ এনসিপি, অপরপক্ষে ‘ব্যবস্থা-বিরোধী বিপ্লবের পুরোধা’ বিএনপি। দুই পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে টুইটার, ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে ঘন ঘন সংঘাত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যার ফলে তৃণমূল সব সময় উত্তপ্ত থাকছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও পৃষ্ঠপোষকতা:

এই দ্বন্দ্ব আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ছায়া ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এনসিপির ‘ডায়ালগ’-ভিত্তিক

রাজনীতির প্রশংসা করেছে, যেখানে তারা গঠনমূলক অংশগ্রহণের কথা বলছে। অন্যদিকে, বিএনপির লাগাতার

আন্দোলন ও হরতালের হুমকি ধামকি কূটনৈতিক মহলে কিছুটা বিরক্তিরও কারণ হয়েছে। আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতায়

এনসিপির বাড়তি সুবিধা পাওয়া ও বিএনপির চিরাচরিত শক্তি হারানোর আশঙ্কা দুই পক্ষের মধ্যে সন্দেহের দেয়ালকে

আরও পোক্ত করছে।

মিডিয়া এবং জনমত:

গণমাধ্যমে এনসিপি তুলনামূলকভাবে ইতিবাচক প্রচার পাচ্ছে। বিভিন্ন টকশো ও সংবাদ বিশ্লেষণে তাদের ‘বিকল্প

শক্তি’ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। বিএনপি একে ‘গভর্নমেন্ট-ম্যানুফ্যাকচার্ড অপজিশন’ বলে সন্দেহ প্রকাশ করছে।

অন্যদিকে, এনসিপি অভিযোগ তোলে যে বিএনপি গত দশকে আন্দোলনের নামে একাধিক ভুল কৌশলে নিজেদের

গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। জনমতের দিক থেকেও বিভাজন স্পষ্ট। শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি অনেকাংশে এনসিপির ‘সুশীল

রাজনীতি’কে সমর্থন করছে, তবে গ্রামের মাঠে এখনও বিএনপির সাংগঠনিক ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা উল্লেখযোগ্য।

অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে কিছু ত্যাগী কর্মী সৃষ্টিতে দলটির নেতৃত্বের বেশ প্রশংসনীয় ছিল।

তরুণ সমাজের দ্বিধা:

বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই বিভক্তি আরও স্পষ্ট। একাংশ সুশৃঙ্খল পরিবর্তন চায়, যারা এনসিপিকে দেখছে

আশার আলো হিসেবে। আবার একাংশ বিশ্বাস করে, রাজপথেই গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা সম্ভব, যারা বিএনপির পক্ষে

আছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই বিভাজন আগামী রাজনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। বলেও ধারণা করা হচ্ছে।

যদি ভোটারের বয়স কমিয়ে ১৭ বছর করা হয় তবে, কি পরিমাণ ভোটার বাড়বে তা এখনই না বলা গেলেও, এই

বয়সী ভোটাররা নতুন দলের প্রতি সমর্থন জানাবে বলেই মনে করছে এনসিপি।

ভবিষ্যতের সম্ভাব্য গতি-প্রকৃতি:

বিএনপি ও এনসিপির দ্বন্দ্ব ভবিষ্যতে দুইটি প্রবণতা তৈরি করতে পারেÑ

১. একান্ত মেরুকরণ: বিরোধী রাজনীতি দুই শিবিরে ভাগ হয়ে যাবেÑএকটি বিপ্লবী, অপরটি কৌশলগত

সংস্কারপন্থী। এতে বিরোধী শক্তি একক ভাবে আর শক্তিশালী হয়ে উঠবে না, বরং পারস্পরিক সংঘাতেই দুর্বল হবে।

২. সম্ভাব্য সংলাপ ও ঐক্য: ভবিষ্যতের রাজনৈতিক চাপ ও জনমতের চাপে বিএনপি ও এনসিপি সীমিত কাঠামোয়

যৌথ কর্মসূচিতে আসতে বাধ্য হতে পারে। এতে বিরোধী আন্দোলন নতুন গতি পেতে পারে। তবে প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কর্মী সমর্থকদের বৃহদাংশই সংস্কার চায় দলে ও নেতৃত্বে। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে পাশ কাটিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ সে অর্থে থাকছে না। আর এতে করে নতুন দল আওয়ামী লীগের সমর্থকদের সমর্থন পেতেও মরিয়া। কারণ একটা নতুন দল গঠনের পর তাদের চিন্তা চেতনা আদর্শ কি হবে তা-ই নিয়েই সমর্থনের বিষয়টি আসে। দেশের অধিকাংশ জনগণ এখনো মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের রাজনীতি দেখতে চায়। দেশ পরিচালনা করুক তা চায়। এমনটাই বিশ্লেষকদের ধারণা।

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এনসিপির ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান নিয়ে যত বিতর্ক:

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে হঠাৎ করেই একটি স্লোগান ঘিরে শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্কÑ ইনকিলাব জিন্দাবাদ;। জাতীয়তাবাদী নাগরিক পার্টি (এনসিপি), একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তি, এই স্লোগানকে তাদের রাজনৈতিক সভা, মিছিল ও প্রচারণায় ব্যবহার করতে শুরু করার পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা ও প্রতিক্রিয়ার ঝড় উঠেছে।

স্লোগানের ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট:

ইনকিলাব জিন্দাবাদÑ উর্দু ভাষার এই স্লোগানের অর্থ বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। উপমহাদেশে এটি প্রথম জনপ্রিয় হয় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময়। ভারতীয় উপমহাদেশের বিপ্লবী সংগঠনগুলো যেমন ভগৎ সিং-এর হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন এই স্লোগান ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে। পরবর্তীতে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এর প্রবেশ ঘটে, যেখানে এটি ইসলামপন্থি ও রাষ্ট্রবিরোধী উগ্র রাজনীতির প্রতীক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে বলেও মনে করা হয়ে থাকে।

এনসিপির ব্যবহার ও যুক্তি:

এনসিপি দাবি করছে, তারা এই স্লোগানকে ‘বিপ্লবী চেতনা এবং ‘জনগণের পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা’র প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করছে। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, এটি একটি ্য়ঁড়ঃ;অপদার্থ রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনসাধারণের প্রতিরোধ প্রকাশের ভাষা।

বিএনপি ও বামপন্থীদের সমালোচনা:

বিএনপি বলছে, এনসিপির এই স্লোগান ব্যবহারের মাধ্যমে তারা রাজনৈতিক বিভ্রান্তি তৈরি করছে এবং উর্দুভাষার ঐতিহাসিক স্লোগানকে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে। অপরদিকে, বামপন্থী দলগুলো অভিযোগ করছে, এনসিপি এই বিপ্লবী শব্দকে খ-িত অর্থে ব্যবহার করছে, যেটি প্রকৃত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মূল উদ্দেশ্যকে বিকৃত করে।

আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া:

আওয়ামী লীগ এই স্লোগানকে ‘পাকিস্তানপন্থী মনোভাবের পুনরুত্থান’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। তারা মনে করছে,

“ইনকিলাব জিন্দাবাদ” স্লোগান দিয়ে এনসিপি একদিকে ইতিহাস বিকৃত করছে, অন্যদিকে রাজনৈতিক আবেগকে

উসকে দিচ্ছে।

বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজের প্রশ্ন:

অনেক বিশিষ্ট নাগরিক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রশ্ন তুলেছেনÑ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কেন একটি উর্দু

স্লোগানকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে? তাদের মতে, একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের দেশ বাংলাদেশে

উর্দুভাষার স্লোগান ব্যবহার অনৈতিক ও প্রতীকীভাবে বিপজ্জনক।

তরুণদের বিভক্ত প্রতিক্রিয়া:

তরুণদের একাংশ স্লোগানটিকে “আন্দোলনের শক্তিশালী বার্তা” হিসেবে দেখছে, আবার কেউ বলছে এটি “পপুলিজমের

ফাঁদ”। কেউ কেউ বলছে, ভাষা নয়, বরং বার্তা গুরুত্বপূর্ণÑ যদি তা গণমানুষের পক্ষ নেয়। আবার কেউ বলছে, রাজনীতিতে প্রতীকী শব্দের ব্যবহারে সংবেদনশীলতা থাকা জরুরি। “ইনকিলাব জিন্দাবাদ” স্লোগানকে ঘিরে বিতর্কটা কেবল শব্দচয়ন নিয়ে নয়, বরং এটি বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ, ইতিহাস চেতনা, ভাষাগত আত্মপরিচয় এবং রাজনৈতিক কৌশলের মধ্যকার গভীর দ্বন্দ্বকে সামনে নিয়ে এসেছে।

এনসিপি কীভাবে এই বিতর্ক সামলাবে, এবং তারা আদৌ এই স্লোগানে অনড় থাকবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়। যদিও তারা আরও আন্দোলন চলাকালীন দেওয়া নিজেদের স্লোগানকেও দলীয় বলে প্রচার করছে। বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এই দ্বন্দ্ব আশীর্বাদ না অভিশাপÑতা নির্ভর করছে ভবিষ্যতের কৌশলগত সিদ্ধান্ত ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার উপর। যদি দুই পক্ষই নিজেদের অবস্থান থেকে কিছুটা নমনীয় হয়, তবে একটি সুস্থ ও শক্তিশালী ধারার বিকাশ সম্ভব। অন্যথায়, এই দ্বন্দ্ব ক্ষমতাসীনদের আরও সুবিধা করে দেবে এবং জনগণের আস্থা বিরোধী রাজনীতির প্রতি আরও ক্ষয়প্রাপ্ত হতে পারে বলেও মনে হয়। ইস্যুভিত্তিক এইসব দ্বন্দ্বের জেরে বিএনপি কি রাজনৈতিক মাঠে নিজেদের অবস্থান হারাতে পারে? তা-ও সময়ই বলে দেবে। সবকিছু ছাপিয়ে নতুন দল এনসিপি যতটুকু মনযোগ আকৃষ্ট করবে বলে ধারণা করা হয়েছিল, তা কেন জানি হয়নি! এর পেছনে রয়েছে মাঠপর্যায়ে নেতাকর্মীদের বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকা-। তেমনটাই ধারণা করছেন বিশ্লেষকগণ। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে ব্যর্থ হলে দলটির অবস্থাও ১৫ আগস্ট পরবর্তী ফ্রিডম পার্টির মতো! তেমনটাও মনে করছেন কেউ কেউ।

[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]

back to top