alt

উপ-সম্পাদকীয়

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ

ওয়াহিদুল ইসলাম ডিফেন্স

: শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫

২৪ এপ্রিল ২০১৩। সকালে সাভারে রানা প্লাজা নামের একটি ভবন ধসে পড়ে, মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে যায় বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতের মুখচ্ছবি। বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত দিন। সাভারের রানা প্লাজা নামের একটি অপরিকল্পিত বহুতল ভবন ধসে পড়েছিল সেদিন। ১,১৩৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু, হাজারো আহত, অসংখ্য পরিবার চিরতরে ভেঙে পড়েছিল। এটি শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি ছিল একটি পদ্ধতিগত ব্যর্থতা, দায়িত্বহীনতা ও লোভের নির্মম পরিণতি। আজ এক যুগ পার হয়ে গেলেও রানা প্লাজার সেই স্মৃতি এখনও আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই দশ বছরে আমরা কি প্রকৃতই কোনো শিক্ষা নিয়েছি? শ্রমিকদের নিরাপত্তা, ভবন নির্মাণের মান ও শিল্প খাতের দায়বদ্ধতা কতটুকু উন্নত হয়েছে?

এক দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে, কিন্তু রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে যে প্রশ্নগুলো উঠে এসেছিল, সেগুলোর উত্তর এখনও পুরোপুরি মেলেনি। আমরা কতটা বদলাতে পেরেছি? শ্রমিকের জীবন এখন কতটা নিরাপদ? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, কিছু অগ্রগতি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কাঠামোগত পরিবর্তন ও মানসিকতায় বদল এখনও অনেকটা বাকি।

রানা প্লাজা কেন ধসেছিল?

রানা প্লাজা ছিল একটি নয় তলা বাণিজ্যিক ভবন, যার নিচের তলাগুলোতে বিভিন্ন দোকান ও উপরের তলাগুলোতে পাঁচটি গার্মেন্টস কারখানা ছিল। ভবনটির নির্মাণে ছিল মারাত্মক ত্রুটি:

অবৈধভাবে অতিরিক্ত তলা নির্মাণ: মূল ডিজাইনে ভবনটি ছিল পাঁচ তলা, কিন্তু পরে অবৈধভাবে আরও চার তলা তোলা হয়।

নি¤œমানের নির্মাণসামগ্রী: দুর্বল কংক্রিট ও রড ব্যবহার করা হয়েছিল, যা ভবনের কাঠামোগত অখ-তা নষ্ট করেছিল।

সতর্কতা উপেক্ষা: ধসের আগের দিনই ভবনে বড় ধরনের ফাটল দেখা দেয়, কিন্তু মালিকপক্ষ শ্রমিকদের কারখানায় ঢুকতে বাধ্য করেছিল।

ফলে এর এক দিন পরেই ধসে পড়ে পুরো ভবন। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, এটি নিছক দুর্ঘটনা নয়, বরং অবহেলা, লোভ, এবং মানবজীবনের প্রতি চরম অবজ্ঞার ফল।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ ঘটনার দায় এখনো পুরোপুরি নির্ধারিত হয়নি। মূল অভিযুক্ত সোহেল রানা এবং প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হলেও বিচার প্রক্রিয়া চলছে দীর্ঘসূত্রতায়। এত বড় একটি ঘটনা যেখানে হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, সেখানে এক যুগ পরও বিচার অসমাপ্ত থাকা আমাদের বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থায় বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দেয়।

রানা প্লাজার ঘটনার পর আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ এবং ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতের নিরাপত্তা ও শ্রমিক অধিকার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। এর ফলে গঠিত হয় ‘অ্যাকর্ড’ এবং ‘অ্যালায়েন্স’ নামক দুটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ, যার মাধ্যমে দেশের শত শত কারখানায় নিরাপত্তা পরিদর্শন, সংস্কার ও বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

বাংলাদেশ সরকার ও উদ্যোক্তারা অবশ্যই কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। শিল্প পুলিশ গঠন, শ্রম আইন সংশোধন, শ্রমিক কল্যাণ তহবিল প্রবর্তনÑ এসব পদক্ষেপ ইতিবাচক। তবে অধিকাংশ উদ্যোগই এসেছে বিদেশি চাপের মুখে, নিজের দায়বদ্ধতা থেকে নয়। দেশের অনেক উদ্যোক্তা এখনও শ্রমিক নিরাপত্তাকে ব্যয় হিসেবে দেখেন, বিনিয়োগ হিসেবে নয়।

আজও গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি যথেষ্ট নয়। দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, অতিরিক্ত কাজের চাপ, বকেয়া বেতন, ছুটি না পাওয়া, মাতৃত্বকালীন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়াÑ এসব সমস্যা এখনও অনেক কারখানায় বিদ্যমান। অনেক জায়গায় শ্রমিকরা এখনও ইউনিয়ন গঠনের অধিকার চর্চা করতে পারেন না।

বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের অবস্থান অত্যন্ত নাজুক। তারা যেমন উৎপাদনে বড় ভূমিকা রাখেন, তেমনি যৌন হয়রানি, কাজের অনিরাপত্তা ও পারিবারিক সহিংসতার শিকার হন দ্বিগুণ হারে। এই বাস্তবতা আমাদের শ্রম নীতিকে নারীবান্ধব ও সুরক্ষিত করতে আরও উদ্যোগী হতে বাধ্য করে।

রানা প্লাজার ঘটনায় একটি বিষয় খুব নজরে আসে; তা হলোÑ মিডিয়া ও নাগরিক সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল ওই ঘটনায়। দুর্ঘটনার সময় রক্তদান, উদ্ধারকাজে স্বেচ্ছাসেবীদের অংশগ্রহণ, প্রতিবাদ মিছিল ও স্মারকলিপি পেশÑ এসব ছিল জাতীয় একাত্মতার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই সক্রিয়তা কি ধরে রাখা গেছে?

স্থায়ী পরিবর্তন আনতে হলে শুধু তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ নয়, প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন, সচেতনতা বৃদ্ধি ও নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে চাপ সৃষ্টি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের নাগরিক সমাজ ও মিডিয়ার অনেক ক্ষেত্রেই এই ধারাবাহিকতা অনুপস্থিত।

রানা প্লাজার শিক্ষা যদি আমরা সত্যিই আত্মস্থ করতে চাই, তাহলে কিছু জরুরি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। দ্রুত ও কার্যকর বিচারপ্রক্রিয়া নিশ্চিত করা- এক যুগেও বিচার অসম্পূর্ণ থাকা অগ্রহণযোগ্য। দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা শুধু আইনগত দায়িত্ব নয়, এটি একটি মানবিক দায়ও।

কারখানা পরিদর্শন ব্যবস্থাকে জোরদার করা- নিয়মিত ও নিরপেক্ষ পরিদর্শন ছাড়া শ্রমিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অসম্ভব।

শ্রমিকদের সংগঠনের অধিকার নিশ্চিত করা- ইউনিয়ন গঠন ও অধিকার আদায়ের সুযোগ থাকা মানেই শ্রমিকের কণ্ঠস্বর থাকা।

ন্যায্য মজুরি এবং জীবনমান উন্নয়ন- শ্রমিকের ন্যূনতম জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করতে হবে মজুরি কাঠামো পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে।

নারীবান্ধব ও সুরক্ষিত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা- নারী শ্রমিকদের জন্য আলাদা স্বাস্থ্যসেবা, মাতৃত্বকালীন ছুটি ও সুরক্ষা ব্যবস্থা জরুরি।

রানা প্লাজার এক যুগ পেরিয়ে আমরা আজ যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখানে আমাদের প্রশ্ন করা উচিতÑ এত প্রাণের বিনিময়ে আমরা আসলে কী শিখেছি? যদি সত্যিই শিখে থাকি, তবে তা কেবল স্মরণে নয়, কর্মে প্রতিফলিত হওয়া দরকার।

বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি গার্মেন্টস খাত। অথচ এই শিল্পের মূল চালক শ্রমিকরা বছরের পর বছর নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। আমরা যদি সত্যিই আর কোনো রানা প্লাজা দেখতে না চাই, তবে তার জন্য চাই আন্তরিকতা, নীতি ও দায়িত্বশীলতাÑ শুধু আন্তর্জাতিক চাপ নয়, বরং নিজের বিবেকবোধ থেকেই।

রানা প্লাজা যেন স্মৃতির মধ্যে হারিয়ে না যায়, বরং এটি হয়ে উঠুক একটি জাতির জেগে ওঠার প্রতীক।

ট্র্যাজেডির পর ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ক্ষতিপূরণ ও ন্যায়বিচারের দাবি উঠলেও, অনেক পরিবার আজও পূর্ণ সুবিচার পায়নি। বিভিন্ন সংগঠন আজ স্মরণসভা ও মানববন্ধনের মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে।

১২ বছর পরও রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। আজও এই দিনে বেদনা ধ্বনিত হয় শত শত পরিবারের হৃদয়ে, যারা প্রতিদিন হারানোর ব্যথা নিয়ে বেঁচে আছে। তাদের যেন শেষ হয় না প্রেম, শেষ হয় না ভালোবাসা-শুধু অপেক্ষা দীর্ঘ হয়।

[লেখক : সাধারণ সম্পাদক, ফুলবাড়ী প্রেসক্লাব, দিনাজপুর]

অতীতের ছায়ায় নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি, উগ্রপন্থা ও সরকারের দায়

সাইবার নিরাপত্তা : অদৃশ্য যুদ্ধের সামনে আমাদের প্রস্তুতি

ছবি

বাহান্নর গর্ভে জন্ম নেয়া এক ঝড়ের পাখি

প্রবাসী শ্রমিক : অর্থের যন্ত্র নয়, রাষ্ট্রের সহযোদ্ধা

ভোগবাদের বিরুদ্ধে পোপ ফ্রান্সিসের জলবায়ু বার্তা

রম্যগদ্য : হাসি নিষেধ...

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন : দাবি ও সমাধানের পথ

সিরিয়ার পতন কিভাবে আমেরিকার স্বার্থকে হুমকিতে ফেলছে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার সন্ধানে

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

স্নায়ুরোগ চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন জরুরি

জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাব ও করণীয়

শাসনব্যবস্থা : জনগণের প্রত্যাশা ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব

বয়নামা দলিল কখন স্বত্বের দলিল হিসেবে পরিগণিত হয়?

বর্ষার আগেই নদীভাঙনের আতঙ্কে উপকূলবাসী

ছবি

ভূমিকম্প ঝুঁকিতে দেশ : মোকাবিলায় প্রস্তুতি প্রয়োজন

‘রিসেটের’ পরাকৌশল কী হওয়া প্রয়োজন

প্রসঙ্গ : জাতীয় বাজেট

ব্রুনোর শ্মশান মঞ্চ

দুর্নীতির অবিশ্বাস্য খতিয়ান

সাম্য, ন্যায়বিচার, সুশাসন, বহুত্ববাদ : সবকা সাথ্ সবকা বিকাশ!

পশ্চিমবঙ্গে ভয়াবহ সংকটে ধর্মনিরপেক্ষতা

পেশাগত দায় ও নৈতিকতা

বিনোদনের রূপান্তর : সংস্কৃতির সংকোচন ও নতুন পথ

রম্যগদ্য : ‘চোর চাই, চোর...’

শুভ-অশুভ বলে কিছু কি আছে

পহেলা বৈশাখের সঙ্গে মিশে আছে কৃষি ও কৃষক

বাংলাদেশে ঘটনা অঘটন: প্রায় সবক্ষেত্রেই ইস্যু নির্বাচন

ছবি

নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও বহুত্ববাদ

বৈসাবি : সম্মিলনের জাতীয় উৎসব

সংকট ও সংক্রান্তির শক্তি

ছবি

গাজার অশ্রু : ইসরায়েলের বর্বরতা ও বিশ্বের নীরবতা

দেশের কৃষি অর্থনীতির নীরব নায়িকারা

বহুমাত্রিক দ্বন্দ্বের ফেরে বিএনপি ও এনসিপি

ফৌজদারি মামলায় অপরাধের আলামত উদ্ধারে আইন মানতে বাধা কোথায়?

জলবায়ুর নতুন ছকে বদলে যাচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ

ওয়াহিদুল ইসলাম ডিফেন্স

শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫

২৪ এপ্রিল ২০১৩। সকালে সাভারে রানা প্লাজা নামের একটি ভবন ধসে পড়ে, মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে যায় বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতের মুখচ্ছবি। বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত দিন। সাভারের রানা প্লাজা নামের একটি অপরিকল্পিত বহুতল ভবন ধসে পড়েছিল সেদিন। ১,১৩৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু, হাজারো আহত, অসংখ্য পরিবার চিরতরে ভেঙে পড়েছিল। এটি শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি ছিল একটি পদ্ধতিগত ব্যর্থতা, দায়িত্বহীনতা ও লোভের নির্মম পরিণতি। আজ এক যুগ পার হয়ে গেলেও রানা প্লাজার সেই স্মৃতি এখনও আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই দশ বছরে আমরা কি প্রকৃতই কোনো শিক্ষা নিয়েছি? শ্রমিকদের নিরাপত্তা, ভবন নির্মাণের মান ও শিল্প খাতের দায়বদ্ধতা কতটুকু উন্নত হয়েছে?

এক দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে, কিন্তু রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে যে প্রশ্নগুলো উঠে এসেছিল, সেগুলোর উত্তর এখনও পুরোপুরি মেলেনি। আমরা কতটা বদলাতে পেরেছি? শ্রমিকের জীবন এখন কতটা নিরাপদ? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, কিছু অগ্রগতি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কাঠামোগত পরিবর্তন ও মানসিকতায় বদল এখনও অনেকটা বাকি।

রানা প্লাজা কেন ধসেছিল?

রানা প্লাজা ছিল একটি নয় তলা বাণিজ্যিক ভবন, যার নিচের তলাগুলোতে বিভিন্ন দোকান ও উপরের তলাগুলোতে পাঁচটি গার্মেন্টস কারখানা ছিল। ভবনটির নির্মাণে ছিল মারাত্মক ত্রুটি:

অবৈধভাবে অতিরিক্ত তলা নির্মাণ: মূল ডিজাইনে ভবনটি ছিল পাঁচ তলা, কিন্তু পরে অবৈধভাবে আরও চার তলা তোলা হয়।

নি¤œমানের নির্মাণসামগ্রী: দুর্বল কংক্রিট ও রড ব্যবহার করা হয়েছিল, যা ভবনের কাঠামোগত অখ-তা নষ্ট করেছিল।

সতর্কতা উপেক্ষা: ধসের আগের দিনই ভবনে বড় ধরনের ফাটল দেখা দেয়, কিন্তু মালিকপক্ষ শ্রমিকদের কারখানায় ঢুকতে বাধ্য করেছিল।

ফলে এর এক দিন পরেই ধসে পড়ে পুরো ভবন। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, এটি নিছক দুর্ঘটনা নয়, বরং অবহেলা, লোভ, এবং মানবজীবনের প্রতি চরম অবজ্ঞার ফল।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ ঘটনার দায় এখনো পুরোপুরি নির্ধারিত হয়নি। মূল অভিযুক্ত সোহেল রানা এবং প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হলেও বিচার প্রক্রিয়া চলছে দীর্ঘসূত্রতায়। এত বড় একটি ঘটনা যেখানে হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, সেখানে এক যুগ পরও বিচার অসমাপ্ত থাকা আমাদের বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থায় বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দেয়।

রানা প্লাজার ঘটনার পর আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ এবং ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতের নিরাপত্তা ও শ্রমিক অধিকার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। এর ফলে গঠিত হয় ‘অ্যাকর্ড’ এবং ‘অ্যালায়েন্স’ নামক দুটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ, যার মাধ্যমে দেশের শত শত কারখানায় নিরাপত্তা পরিদর্শন, সংস্কার ও বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

বাংলাদেশ সরকার ও উদ্যোক্তারা অবশ্যই কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। শিল্প পুলিশ গঠন, শ্রম আইন সংশোধন, শ্রমিক কল্যাণ তহবিল প্রবর্তনÑ এসব পদক্ষেপ ইতিবাচক। তবে অধিকাংশ উদ্যোগই এসেছে বিদেশি চাপের মুখে, নিজের দায়বদ্ধতা থেকে নয়। দেশের অনেক উদ্যোক্তা এখনও শ্রমিক নিরাপত্তাকে ব্যয় হিসেবে দেখেন, বিনিয়োগ হিসেবে নয়।

আজও গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি যথেষ্ট নয়। দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, অতিরিক্ত কাজের চাপ, বকেয়া বেতন, ছুটি না পাওয়া, মাতৃত্বকালীন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়াÑ এসব সমস্যা এখনও অনেক কারখানায় বিদ্যমান। অনেক জায়গায় শ্রমিকরা এখনও ইউনিয়ন গঠনের অধিকার চর্চা করতে পারেন না।

বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের অবস্থান অত্যন্ত নাজুক। তারা যেমন উৎপাদনে বড় ভূমিকা রাখেন, তেমনি যৌন হয়রানি, কাজের অনিরাপত্তা ও পারিবারিক সহিংসতার শিকার হন দ্বিগুণ হারে। এই বাস্তবতা আমাদের শ্রম নীতিকে নারীবান্ধব ও সুরক্ষিত করতে আরও উদ্যোগী হতে বাধ্য করে।

রানা প্লাজার ঘটনায় একটি বিষয় খুব নজরে আসে; তা হলোÑ মিডিয়া ও নাগরিক সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল ওই ঘটনায়। দুর্ঘটনার সময় রক্তদান, উদ্ধারকাজে স্বেচ্ছাসেবীদের অংশগ্রহণ, প্রতিবাদ মিছিল ও স্মারকলিপি পেশÑ এসব ছিল জাতীয় একাত্মতার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই সক্রিয়তা কি ধরে রাখা গেছে?

স্থায়ী পরিবর্তন আনতে হলে শুধু তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ নয়, প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন, সচেতনতা বৃদ্ধি ও নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে চাপ সৃষ্টি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের নাগরিক সমাজ ও মিডিয়ার অনেক ক্ষেত্রেই এই ধারাবাহিকতা অনুপস্থিত।

রানা প্লাজার শিক্ষা যদি আমরা সত্যিই আত্মস্থ করতে চাই, তাহলে কিছু জরুরি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। দ্রুত ও কার্যকর বিচারপ্রক্রিয়া নিশ্চিত করা- এক যুগেও বিচার অসম্পূর্ণ থাকা অগ্রহণযোগ্য। দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা শুধু আইনগত দায়িত্ব নয়, এটি একটি মানবিক দায়ও।

কারখানা পরিদর্শন ব্যবস্থাকে জোরদার করা- নিয়মিত ও নিরপেক্ষ পরিদর্শন ছাড়া শ্রমিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অসম্ভব।

শ্রমিকদের সংগঠনের অধিকার নিশ্চিত করা- ইউনিয়ন গঠন ও অধিকার আদায়ের সুযোগ থাকা মানেই শ্রমিকের কণ্ঠস্বর থাকা।

ন্যায্য মজুরি এবং জীবনমান উন্নয়ন- শ্রমিকের ন্যূনতম জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করতে হবে মজুরি কাঠামো পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে।

নারীবান্ধব ও সুরক্ষিত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা- নারী শ্রমিকদের জন্য আলাদা স্বাস্থ্যসেবা, মাতৃত্বকালীন ছুটি ও সুরক্ষা ব্যবস্থা জরুরি।

রানা প্লাজার এক যুগ পেরিয়ে আমরা আজ যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখানে আমাদের প্রশ্ন করা উচিতÑ এত প্রাণের বিনিময়ে আমরা আসলে কী শিখেছি? যদি সত্যিই শিখে থাকি, তবে তা কেবল স্মরণে নয়, কর্মে প্রতিফলিত হওয়া দরকার।

বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি গার্মেন্টস খাত। অথচ এই শিল্পের মূল চালক শ্রমিকরা বছরের পর বছর নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। আমরা যদি সত্যিই আর কোনো রানা প্লাজা দেখতে না চাই, তবে তার জন্য চাই আন্তরিকতা, নীতি ও দায়িত্বশীলতাÑ শুধু আন্তর্জাতিক চাপ নয়, বরং নিজের বিবেকবোধ থেকেই।

রানা প্লাজা যেন স্মৃতির মধ্যে হারিয়ে না যায়, বরং এটি হয়ে উঠুক একটি জাতির জেগে ওঠার প্রতীক।

ট্র্যাজেডির পর ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ক্ষতিপূরণ ও ন্যায়বিচারের দাবি উঠলেও, অনেক পরিবার আজও পূর্ণ সুবিচার পায়নি। বিভিন্ন সংগঠন আজ স্মরণসভা ও মানববন্ধনের মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে।

১২ বছর পরও রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। আজও এই দিনে বেদনা ধ্বনিত হয় শত শত পরিবারের হৃদয়ে, যারা প্রতিদিন হারানোর ব্যথা নিয়ে বেঁচে আছে। তাদের যেন শেষ হয় না প্রেম, শেষ হয় না ভালোবাসা-শুধু অপেক্ষা দীর্ঘ হয়।

[লেখক : সাধারণ সম্পাদক, ফুলবাড়ী প্রেসক্লাব, দিনাজপুর]

back to top