আনোয়ারুল হক
১৯৭১-এর মার্চের শুরুতেই ছাত্র ইউনিয়নের যুদ্ধ প্রস্তুতি
দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগের পর ’৫২-এর ভাষা সংগ্রাম শুধু পূর্ববাংলা নয়, গোটা পাকিস্তানের জন্য ছিলো সবচেয়ে বড় ঘটনা। ছাত্র সমাজের নেতৃত্বে সূচিত এ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শুধু ছাত্র সমাজই নয়, দেশবাসীরও একটা বড় অংশের ‘পেয়ারা পাকিস্তান’ থেকে মোহমুক্তি ঘটে। উড়ন্ত পাখি দেখে যেমন মুক্তির অনুভূতি জেগে ওঠে, তেমনি ভাষা সংগ্রাম আরও বিস্তৃত স্বাধীনতার অনুভূতি সৃষ্টি করে। আর সেই অনুভূতি থেকেই ’৫২-এর সেই ঝড়ো হাওয়ায় ভাষা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী প্রগতিশীল অংশ ওই বছরেই গড়ে তুলেছিলেন অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন।
১৯৫২ সালের ২৬ এপ্রিল যাত্রা শুরু করা ছাত্র ইউনিয়নের ভোরটা সকাল হতে না হতেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর লৌহশাসনের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে বিরামহীন লড়াই। কখনও সাংস্কৃতিক মুক্তির লড়াই, কখনও শিক্ষা আন্দোলন, আবার কখনও বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান। সে অভিযাত্রায় অনেকগুলো উত্তাল পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। একদম মসৃণ ছিল না সে পথগুলো। তারপরও চুম্বক যেমন লৌহকে আকর্ষণ করে তেমনি ছাত্র ইউনিয়ন এসব কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে দ্রুত এবং খুবই দ্রুত ছাত্র সমাজ ও দেশবাসীকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছে এবং তাঁদের সমর্থনে পুষ্ট হয়েছে।
গোটা পাকিস্তান আমলেই গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সমান্তরালে ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে এবং এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রেখেছে ছাত্র ইউনিয়ন। তারা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী উপাদান আর শ্রমজীবীদের অধিকার এবং সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার দাবি যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত প্রস্তুতি পর্বেও সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি এবং সে চেতনা ছাত্র সমাজ ও দেশবাসীর মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব পালন করেছে। ছাত্র ইউনিয়ন সেই যুগের কর্মী-সমর্থকদের মুক্তিযুদ্ধের অংশী করেছে। ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সে যোগ দিয়ে যেমন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে আবার ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের মিলিত উদ্যোগে গঠিত বিশেষ গেরিলা বাহিনীর মাধ্যমেও সশস্ত্র সংগ্রামে শামিল থেকেছে। লাখো লাখো শহীদের রক্তের গ্রোত ধারায় ছাত্র ইউনিয়নের নেতা কর্মীদের রক্তও মিলিত হয়েছে।
প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী করার মধ্য দিয়ে ছাত্র সমাজ স্বাধীন দেশে ছাত্র ইউনিয়নকে বরণ করেছে। যদিও সে ধারা পরবর্তীতে রক্ষা করা যায়নি। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংহতি সংগ্রামে অংশ নিয়ে স্বাধীন দেশেও প্রথম শহীদ ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা। স্বাধীন দেশে নানা আশা আর হতাশার আবর্তে, দেশের নানা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ছাত্র ইউনিয়ন সব সময় নির্ভুল বা যথাযথ ভূমিকা রাখতে না পারলেও শিক্ষা ও গণতন্ত্রের সংগ্রামের যোদ্ধা হিসেবে অবিচল থেকেছে। এরশাদ আমলে সামরিক শাসন বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আয়োজন পর্ব ছাত্র ইউনিয়নকে ঘিরেই শুরু হয়েছিল এবং ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানেও রয়েছে ছাত্র ইউনিয়নের উজ্জ্বল ভূমিকা।
বাংলাদেশে এক দশক কালেরও অধিক সময় যাবত শেখ হাসিনার সরকার কর্তৃত্ববাদী ও ফ্যাসিবাদী প্রবণতার শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন। নিজ পরিবার, দল ও লুটেরা ধনিক গোষ্ঠীর জন্য লুন্ঠনের সব দুয়ার খুলে দেন এবং গোটা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে পরপর তিনটি তামাশার জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করেন। মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আর বেদনা স্বতঃস্ফূর্ত জনজাগরণে রূপান্তরিত হয় ছাত্রদের কোটাবিরোধী এক ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে। এই ভূখ-ে ’৬৯ এবং ’৯০-এ দুটি গণঅভ্যুত্থান আমরা দেখেছি। তখনও আন্দোলন দমনে নির্মমতা ও হত্যাকা- দেখেছি। কিন্তু এত মৃত্যু, এত রক্তপাত, এত নির্মমতা দেখিনি। এ সংগ্রামেও ছাত্র ইউনিয়ন শরিক থেকেছে। সংগঠনের দ্বিধাবিভক্তি যথাযথ ভূমিকা পালনের পথে বাঁধা হিসেবে থাকলেও উভয় অংশই সাধ্যমতো ও স্ব স্ব সংগঠনের কৌশল ও বিবেচনামতো স্বৈরাচারবিরোধী এ লড়াইয়ে শামিল থেকেছে। হাজারও শহীদের রক্তের সাথে ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীদের রক্তও মিশে আছে।
দীর্ঘ সময়ের কর্তৃত্ববাদী ও পরিবারতান্ত্রিক শাসনে জনমনে ক্ষোভ অন্যদিকে বাম প্রগতিশীল শক্তির বিভক্তি ও দুর্বল হয়ে পড়ার সুযোগে অন্ধকারের শক্তি নানা কায়দায় রাজনীতির মাঠে অবস্থানকে সংহত করে এবং কোটাবিরোধী আন্দোলনের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের বিজয়ের সাথে সাথে এক হিংস্র চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হয়। তারা ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থান দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এমনকি ’৫২, ’৬৯, ’৯০-সহ জাতির সব গৌরবগাথাকে আড়াল করতে মরিয়া প্রচেষ্টায় নিয়োজিত। মুক্তিযুদ্ধের সব স্মৃতি, প্রতীকের ওপর হামলা করে এক ধ্বংসলীলা সৃষ্টি করে। মুক্তচিন্তা ও নারী স্বাধীনতার ওপর নেমে আসছে আক্রমণ।
হাসিনা সরকার এসব অপশক্তির, ধর্মের নামে নারী স্বাধীনতার ওপর অমর্যাদাকর আক্রমণ ও বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রচারণার সাথে কখনো আপস করে আবার কখনো কঠোরতা প্রদর্শন করে জোড়াতালি দিয়ে কোনরকমে চলছিল। আর বর্তমানে এই গোষ্ঠী দাপটের সাথে তাদের মনমতো সমাজ নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত এবং কোথাও বাধা পেলেই চরম অসহিষ্ণু মব সৃষ্টি করছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি থেকে উত্তরণ ঘটেছিল সমাজে ও রাষ্ট্রে তার প্রত্যাবর্তন ঘটছে এবং তাকে স্থায়ী রূপ দিতে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী মরিয়া হয়ে উঠেছে। ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিও জটিল হয়ে উঠছে। এতকাল ভারতবর্ষ একচেটিয়া বাহাদুরি করেছে। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সরাসরি ছড়ি ঘুরাচ্ছে, চীনও বসে নেই আর পেয়ারে পাকিস্তান অমীমাংসিত ইস্যুসমূহ পাশ কাটিয়ে ‘হারিয়ে যাওয়া ভাই’কে ফিরে পেয়ে তার মাধ্যমে উপমহাদেশীয় স্বার্থ হাসিলের স্বপ্নে বিভোর। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দেশি-বিদেশি নানা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর হাতে বন্দি হয়ে পড়ছে জুলাই অভ্যুত্থানগাথা।
এ ধরনের জটিল পরিস্থিতিতে ছাত্র ইউনিয়নের দিকে তাকিয়ে আমরা প্রাক্তনীরা। আমরা সকলে রাজনৈতিক দল করি না, তবে সমাজ সচেতন রয়েছি। ছাত্র ইউনিয়ন জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল আমরা আজও তা লালন করি। ব্যতিক্রম ছাড়া আমরা সবাই ‘ছাত্র ইউনিয়নের পথেই’ আছি। ছাত্র ইউনিয়নের দিনগুলো নিয়ে আমাদেরÑ
‘এত কথা আছে, এত গান আছে, এত প্রাণ আছে মোর/ এত সুখ আছে, এত সাধ আছে- আজও প্রাণ হয়ে আছে ভোর’।
ছাত্র ইউনিয়ন নামটা শুনলেই কেমন এক অনুভূতির দোলা শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ে। গৌরবে আনন্দে আনন্দে চোখ ভিজে যায়। গুনগুন করে গেয়ে উঠি ‘এসো মিলি মুক্তির পতাকায়’!
তবে আজকের যুগের ছাত্র ইউনিয়ন তাদের মতো পথ করেই এগোবে। প্রাক্তনীরা প্রেসক্রিপশন দিতে চাইলে বা পথ প্রদর্শক হতে চাইলে ছাত্র ইউনিয়নের ক্ষতি করা হবে। হয়তোবা সেই ক্ষতি ইতোমধ্যে হয়েছে; যা হবার তাতো হয়েই গেছে। তবুও সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিনে আমাদের বড় সাধ জাগে দ্বিধাবিভক্ত ছাত্র ইউনিয়নকে আবার একত্রিত দেখার। বর্তমান জটিল ও কঠিন পরিস্থিতিতে সম্ভবত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির দাবিও তাই। দেখতে দেখতে ছাত্র ইউনিয়নের প্লাটিনাম জয়ন্তী (৭৫ বছর পূর্তি) এসে যাবে। তার আগেই ছাত্র আন্দোলনের বিশাল আকাশে এই ঝড়ের পাখি তার পূর্ণতা নিয়ে নিজের ডানা মেলে ধরুকÑ ঝড় কিন্তু বইছে আজও!
[লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন]
আনোয়ারুল হক
১৯৭১-এর মার্চের শুরুতেই ছাত্র ইউনিয়নের যুদ্ধ প্রস্তুতি
শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫
দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগের পর ’৫২-এর ভাষা সংগ্রাম শুধু পূর্ববাংলা নয়, গোটা পাকিস্তানের জন্য ছিলো সবচেয়ে বড় ঘটনা। ছাত্র সমাজের নেতৃত্বে সূচিত এ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শুধু ছাত্র সমাজই নয়, দেশবাসীরও একটা বড় অংশের ‘পেয়ারা পাকিস্তান’ থেকে মোহমুক্তি ঘটে। উড়ন্ত পাখি দেখে যেমন মুক্তির অনুভূতি জেগে ওঠে, তেমনি ভাষা সংগ্রাম আরও বিস্তৃত স্বাধীনতার অনুভূতি সৃষ্টি করে। আর সেই অনুভূতি থেকেই ’৫২-এর সেই ঝড়ো হাওয়ায় ভাষা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী প্রগতিশীল অংশ ওই বছরেই গড়ে তুলেছিলেন অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন।
১৯৫২ সালের ২৬ এপ্রিল যাত্রা শুরু করা ছাত্র ইউনিয়নের ভোরটা সকাল হতে না হতেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর লৌহশাসনের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে বিরামহীন লড়াই। কখনও সাংস্কৃতিক মুক্তির লড়াই, কখনও শিক্ষা আন্দোলন, আবার কখনও বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান। সে অভিযাত্রায় অনেকগুলো উত্তাল পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। একদম মসৃণ ছিল না সে পথগুলো। তারপরও চুম্বক যেমন লৌহকে আকর্ষণ করে তেমনি ছাত্র ইউনিয়ন এসব কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে দ্রুত এবং খুবই দ্রুত ছাত্র সমাজ ও দেশবাসীকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছে এবং তাঁদের সমর্থনে পুষ্ট হয়েছে।
গোটা পাকিস্তান আমলেই গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সমান্তরালে ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে এবং এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রেখেছে ছাত্র ইউনিয়ন। তারা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী উপাদান আর শ্রমজীবীদের অধিকার এবং সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার দাবি যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত প্রস্তুতি পর্বেও সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি এবং সে চেতনা ছাত্র সমাজ ও দেশবাসীর মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব পালন করেছে। ছাত্র ইউনিয়ন সেই যুগের কর্মী-সমর্থকদের মুক্তিযুদ্ধের অংশী করেছে। ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সে যোগ দিয়ে যেমন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে আবার ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের মিলিত উদ্যোগে গঠিত বিশেষ গেরিলা বাহিনীর মাধ্যমেও সশস্ত্র সংগ্রামে শামিল থেকেছে। লাখো লাখো শহীদের রক্তের গ্রোত ধারায় ছাত্র ইউনিয়নের নেতা কর্মীদের রক্তও মিলিত হয়েছে।
প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী করার মধ্য দিয়ে ছাত্র সমাজ স্বাধীন দেশে ছাত্র ইউনিয়নকে বরণ করেছে। যদিও সে ধারা পরবর্তীতে রক্ষা করা যায়নি। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংহতি সংগ্রামে অংশ নিয়ে স্বাধীন দেশেও প্রথম শহীদ ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা। স্বাধীন দেশে নানা আশা আর হতাশার আবর্তে, দেশের নানা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ছাত্র ইউনিয়ন সব সময় নির্ভুল বা যথাযথ ভূমিকা রাখতে না পারলেও শিক্ষা ও গণতন্ত্রের সংগ্রামের যোদ্ধা হিসেবে অবিচল থেকেছে। এরশাদ আমলে সামরিক শাসন বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আয়োজন পর্ব ছাত্র ইউনিয়নকে ঘিরেই শুরু হয়েছিল এবং ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানেও রয়েছে ছাত্র ইউনিয়নের উজ্জ্বল ভূমিকা।
বাংলাদেশে এক দশক কালেরও অধিক সময় যাবত শেখ হাসিনার সরকার কর্তৃত্ববাদী ও ফ্যাসিবাদী প্রবণতার শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন। নিজ পরিবার, দল ও লুটেরা ধনিক গোষ্ঠীর জন্য লুন্ঠনের সব দুয়ার খুলে দেন এবং গোটা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে পরপর তিনটি তামাশার জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করেন। মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আর বেদনা স্বতঃস্ফূর্ত জনজাগরণে রূপান্তরিত হয় ছাত্রদের কোটাবিরোধী এক ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে। এই ভূখ-ে ’৬৯ এবং ’৯০-এ দুটি গণঅভ্যুত্থান আমরা দেখেছি। তখনও আন্দোলন দমনে নির্মমতা ও হত্যাকা- দেখেছি। কিন্তু এত মৃত্যু, এত রক্তপাত, এত নির্মমতা দেখিনি। এ সংগ্রামেও ছাত্র ইউনিয়ন শরিক থেকেছে। সংগঠনের দ্বিধাবিভক্তি যথাযথ ভূমিকা পালনের পথে বাঁধা হিসেবে থাকলেও উভয় অংশই সাধ্যমতো ও স্ব স্ব সংগঠনের কৌশল ও বিবেচনামতো স্বৈরাচারবিরোধী এ লড়াইয়ে শামিল থেকেছে। হাজারও শহীদের রক্তের সাথে ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীদের রক্তও মিশে আছে।
দীর্ঘ সময়ের কর্তৃত্ববাদী ও পরিবারতান্ত্রিক শাসনে জনমনে ক্ষোভ অন্যদিকে বাম প্রগতিশীল শক্তির বিভক্তি ও দুর্বল হয়ে পড়ার সুযোগে অন্ধকারের শক্তি নানা কায়দায় রাজনীতির মাঠে অবস্থানকে সংহত করে এবং কোটাবিরোধী আন্দোলনের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের বিজয়ের সাথে সাথে এক হিংস্র চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হয়। তারা ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থান দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এমনকি ’৫২, ’৬৯, ’৯০-সহ জাতির সব গৌরবগাথাকে আড়াল করতে মরিয়া প্রচেষ্টায় নিয়োজিত। মুক্তিযুদ্ধের সব স্মৃতি, প্রতীকের ওপর হামলা করে এক ধ্বংসলীলা সৃষ্টি করে। মুক্তচিন্তা ও নারী স্বাধীনতার ওপর নেমে আসছে আক্রমণ।
হাসিনা সরকার এসব অপশক্তির, ধর্মের নামে নারী স্বাধীনতার ওপর অমর্যাদাকর আক্রমণ ও বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রচারণার সাথে কখনো আপস করে আবার কখনো কঠোরতা প্রদর্শন করে জোড়াতালি দিয়ে কোনরকমে চলছিল। আর বর্তমানে এই গোষ্ঠী দাপটের সাথে তাদের মনমতো সমাজ নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত এবং কোথাও বাধা পেলেই চরম অসহিষ্ণু মব সৃষ্টি করছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি থেকে উত্তরণ ঘটেছিল সমাজে ও রাষ্ট্রে তার প্রত্যাবর্তন ঘটছে এবং তাকে স্থায়ী রূপ দিতে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী মরিয়া হয়ে উঠেছে। ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিও জটিল হয়ে উঠছে। এতকাল ভারতবর্ষ একচেটিয়া বাহাদুরি করেছে। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সরাসরি ছড়ি ঘুরাচ্ছে, চীনও বসে নেই আর পেয়ারে পাকিস্তান অমীমাংসিত ইস্যুসমূহ পাশ কাটিয়ে ‘হারিয়ে যাওয়া ভাই’কে ফিরে পেয়ে তার মাধ্যমে উপমহাদেশীয় স্বার্থ হাসিলের স্বপ্নে বিভোর। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দেশি-বিদেশি নানা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর হাতে বন্দি হয়ে পড়ছে জুলাই অভ্যুত্থানগাথা।
এ ধরনের জটিল পরিস্থিতিতে ছাত্র ইউনিয়নের দিকে তাকিয়ে আমরা প্রাক্তনীরা। আমরা সকলে রাজনৈতিক দল করি না, তবে সমাজ সচেতন রয়েছি। ছাত্র ইউনিয়ন জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল আমরা আজও তা লালন করি। ব্যতিক্রম ছাড়া আমরা সবাই ‘ছাত্র ইউনিয়নের পথেই’ আছি। ছাত্র ইউনিয়নের দিনগুলো নিয়ে আমাদেরÑ
‘এত কথা আছে, এত গান আছে, এত প্রাণ আছে মোর/ এত সুখ আছে, এত সাধ আছে- আজও প্রাণ হয়ে আছে ভোর’।
ছাত্র ইউনিয়ন নামটা শুনলেই কেমন এক অনুভূতির দোলা শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ে। গৌরবে আনন্দে আনন্দে চোখ ভিজে যায়। গুনগুন করে গেয়ে উঠি ‘এসো মিলি মুক্তির পতাকায়’!
তবে আজকের যুগের ছাত্র ইউনিয়ন তাদের মতো পথ করেই এগোবে। প্রাক্তনীরা প্রেসক্রিপশন দিতে চাইলে বা পথ প্রদর্শক হতে চাইলে ছাত্র ইউনিয়নের ক্ষতি করা হবে। হয়তোবা সেই ক্ষতি ইতোমধ্যে হয়েছে; যা হবার তাতো হয়েই গেছে। তবুও সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিনে আমাদের বড় সাধ জাগে দ্বিধাবিভক্ত ছাত্র ইউনিয়নকে আবার একত্রিত দেখার। বর্তমান জটিল ও কঠিন পরিস্থিতিতে সম্ভবত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির দাবিও তাই। দেখতে দেখতে ছাত্র ইউনিয়নের প্লাটিনাম জয়ন্তী (৭৫ বছর পূর্তি) এসে যাবে। তার আগেই ছাত্র আন্দোলনের বিশাল আকাশে এই ঝড়ের পাখি তার পূর্ণতা নিয়ে নিজের ডানা মেলে ধরুকÑ ঝড় কিন্তু বইছে আজও!
[লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন]