আনোয়ারুল হক
টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলায় ‘অভয়ারণ্য’ নামের একটি পাঠাগার থেকে ‘ধর্মবিরোধী’ অভিযোগ তুলে নজরুল-রবীন্দ্রনাথের বইসহ পাঁচ শতাধিক বই সরিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে ১৫-২০ জনের একদল যুবক তাওহিদী জনতা পরিচয়ে পাঠাগারে ঢুকে এ কা- ঘটায়।
সংবাদটি ছোট কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রাজত্ব নয় মাস পার হওয়ার পরেও এ ধরনের মব সৃষ্টি করে রবীন্দ্র নজরুল সাহিত্যের ওপর হামলার ঘটনার গুরুত্ব অনেক বড়। একই কায়দায় এরা ময়মনসিংহে সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র সাহিত্য সংসদের ওপর হামলা চালিয়েছে।
এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা ঘটেই চলেছে। আরো বড় ঘটনা হলো সপ্তাহজুড়ে উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীর নানা কিসিমের সৈনিকেরা, নারী সংস্কার কমিশন বাতিল এবং তার সদস্যদের বিচার দাবী করে ঢাকার রাজপথে রে রে করে তেড়ে উঠেছেন এবং গত ৩০ এপ্রিল জামায়াতে ইসলামীর আমিরসহ ধর্মাশ্রয়ী দলসমূহ রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এক সমাবেশ থেকে একই দাবি উত্থাপন করে বলেছেন দাবি না মানলে সরকার ফেলে দিতে তাদের পাঁচ মিনিট সময়ও লাগবে না।
স্বৈরশাসনবিরোধী অভ্যুত্থান বিজয়ী হওয়ার সাথে সাথে ছাত্র সমন্বয়কদের একাংশ বুঝে না বুঝে এবং আন্দোলন দমনে হাসিনা সরকারের নির্দয় দমন পীড়ন এবং নির্বিচার হত্যাকা-ের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় যে ক্রোধ, প্রতিহিংসা ও ঘৃণার সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেন, তার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় যারা হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা ও সমর্থন করেছিলেন তারা এক হিংগ্র চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হলেন। কিন্ত এটা বড়ই পরিতাপের বিষয় ড. ইউনুস সরকারের বয়স প্রায় নয় মাস পার হলেও এখনও সেই উগ্র মৌলবাদী আস্ফালন দেখতে হচ্ছে নারী স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে, বাঙালির শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে।
উগ্র মৌলবাদীদের আক্রোশ প্রথম দেখলাম শিল্পকলা একাডেমির নাট্য অনুষ্ঠান কেন্দ্র করে, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো মহিলা সমিতি মিলনায়তনের নাট্য অনুষ্ঠান ঘিরে। প্রতিনিয়ত দেখছি ছায়ানট আর উদীচীর বিরুদ্ধে তথাকথিত ইনসাফ ওয়ালাদের হুমকি ধামকি আর সোশ্যাল মিডিয়ায় অব্যাহত অপপ্রচার আর হিংসা ছড়ানোর উৎসব। ষাটের দশকে পাক-সামরিক সরকার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া এবং বেতার বা টেলিভিশনে সম্প্রচার নিষিদ্ধ করে। এ পটভূমিতে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী পালনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে ছায়ানট। কোনো রাজনৈতিক দল সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই বাঙালি সংস্কৃতির নিরবচ্ছিন্ন সাধনা, উদ্ভাস, প্রকাশ, বিকাশের সাথে জড়িয়ে আছে ছায়ানট। আর উদীচী ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান আর ’৭১-এর অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোতে বিদ্রোহের গান গাইতে গাইতেই এর বিকাশ ও ব্যাপ্তিলাভ। উদীচীর কর্মীরা প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নেয়। ছায়ানট বাঙালি সংস্কৃতি বিকাশে দায়বদ্ধ থেকে, জাগরণের গান গেয়ে স্বাধীনতার পটভূমি সৃষ্টিতে অবদান রেখেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তির গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেছে আর উদীচী শিকল ভাঙার গান গেয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আশির দশকের স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে এবং এবারের জুলাই অভ্যুত্থানেও উদীচী কারফিউ ভেঙে বিদ্রোহের গান নিয়ে রাজপথে ছিলো।
কোনো কোনো পত্রিকার বিরুদ্ধে ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী অবিরাম মিথ্যা প্রচারণার তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। এসব পত্রিকা সাধারণত দায়বদ্ধতা থেকে সরে এসে, চাপে পড়ে কিংবা লোভে পড়ে জনবিচ্ছিন্ন ক্ষমতাবানদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সাংবাদিকতা করে না। সাংবাদিকতায় সততা এবং উদার ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের প্রতি নির্মোহ দায়বদ্ধতার জন্য তারা উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর চক্ষুশূল। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কোনো কোনো মহল উন্মাদের মতো এবং কখনো এরা আসলে কারা? ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচীর জাতীয় সম্মেলনে, ২০০৫ সালে নেত্রকোনায় উদীচী কার্যালয়ে এবং ২০০১ সালে ঢাকার পল্টনে সিপিবির জনসভায় এবং রমনা বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে গ্রেনেড হামলা করে যারা নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল সেই ফ্যাসিস্ট দানবীয় শক্তিই ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধীতার’ আবরণে চড়াও হয়েছে আমাদের শিল্প সংস্কৃতির বিরুদ্ধে, দেশের প্রগতিশীল পত্রপত্রিকাগুলোর বিরুদ্ধে।
১৯৭১-এর পরাজয়ের গ্লানি এদের সব সময়ে এক প্রতিশোধ স্পৃহায় তাড়িত করে। ওরা জানে বুঝে যে বাংগালির শিল্প সাহিত্য চর্চা, প্রগতিশীল পত্রপত্রিকার লেখনি মুক্তিযুদ্ধের আয়োজন পর্বে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। আজও ফ্যাসিবাদ বিরোধিতার আবরনে তারা যে বহুত্ববাদবিরোধী কুপম-ুক সমাজ সৃষ্টি করতে চায় তার পথে বাঁধা ছায়ানট, উদীচী বা এ ধরনের সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং উদার মানসিকতা লালনকারী পত্রিকা সমূহ। উদীচী ছায়ানটের বিরুদ্ধে হুংকার দিয়ে ওরা সকল প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠনকেই হুঁশিয়ারি জানাচ্ছে। তাদের নিয়ন্ত্রিত দেশে-বিদেশে অবস্থানরত পেইড অনলাইন এক্টিভিস্ট ও ইউটিউবারদের মাধ্যমে ওরা সকল উদার ও প্রগতিশীল পত্রপত্রিকাকে ভয় দেখাচ্ছে, সেল্ফ সেন্সরশিপ আরোপে বাধ্য করছে।
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন যে সুপারিশ সমূহ পেশ করেছেন তার সব সুপারিশে সবাই একমত নাও হতে পারেন। অন্যান্য যে সব সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোর অনেক সুপারিশের সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল দ্বিমত পোষণ করেছে বা সংশোধনী প্রস্তাব দিয়েছে বা আরও আলোচনার প্রয়োজন আছে বলেছে; কিন্তু উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী ও ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির কা-ারিরা, ইসলামের একমাত্র হেফাজত ওয়ালারা নারী সংস্কার কমিশন বাতিল এবং তার সদস্যদের বিচার দাবি করছেন। তারা ঘোষণা দিচ্ছেন পরিবারে, সমাজে, সম্পত্তিতে, কর্মক্ষেত্রে তাঁরা নারীর সমানাধিকারে বিশ্বাস করেন না। দেশ গঠনের কাজ বাদ দিয়ে তারা এখন তাদের মত করে ‘নারী গঠনের’ জন্য ঢাকা মার্চ করছেন। মার্চওয়ালারা রাজু ভাস্কর্যের সামনে নারী প্রতিকৃতি ঝুলিয়ে যেভাবে অবমাননা করলেন দেখে মনে হলো এই কুপম-ুকদের কি কোনো মাতৃজঠরে জন্ম হয়েছে? আর দেশে আদৌ কি কোনো সরকার আছে?
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাসহ অনেক উপদেষ্টাই বারবার বলছেন কথায় কথায় খুনের মামলা করা যাবে না; কিন্তু কে শোনে কার কথা। একেকটা খুনের মামলায় শত শত নিরপরাধ মানুষকে, আর যাই হোক অন্তত খুনের সাথে বা হত্যা প্রচেষ্টার সাথে জড়িত নয় এমনতর মানুষকে, শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, অভিনেতা, অভিনেত্রী, কবি, সাহিত্যিক, কন্ঠশিল্পীÑ একেকজনের নামে ১০-২০টা করে মামলা সাজানো হয়েছে এবং আরো হচ্ছে। বাদী চেনে না আসামিকে, আসামি চেনে না বাদীকে। সংশ্লিষ্ট থানার ওসি বা রাষ্ট্র পক্ষের উকিলকে মামলা বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে মুচকি মুচকি হাসেন। এক অদ্ভুত পরিস্থিতি! এবং অধিকাংশ মামলাই যে প্রতিহিংসামূলক এবং হীন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ তো বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি, কৃষক আন্দোলনের নেত্রী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির চক্ষুশূল জুলাই অভ্যুত্থানের সমর্থনে রাজপথে সরব লাকি আক্তারের বিরুদ্ধে এক হাস্যকর হত্যাপ্রচেষ্টা মামলা দায়ের করা।
এসব দেখে মনে হচ্ছে দেশটা মগের মুল্লুক হয়ে গেল নাকি। এসব করে কিন্তু ছাত্র গণআন্দোলন দমনে যে পৈশাচিক হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে তাকে হালকা করে দেয়া হচ্ছে। যত মামলা আর যত ট্রাইব্যুনাল হোক না কেন ১০টা ন্যায্য মামলার পাশে হাজারটা মিথ্যা মামলা রুজুর ফলে বিচার নিয়ে মানুষের মনোজগতে যে পরিবর্তন আসছে তাতে করে ন্যায়বিচার করা কঠিন হয়ে উঠবে। মাঝে-মধ্যে মনে হয় শেখ হাসিনা এত অপরাধ করার পরও তার যাওয়ার জায়গা ছিল বা আছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের হয়তো কোনো আশ্রয় মিলবে। প্রধান উপদেষ্টা তো বলেই দিয়েছেন তার দায়িত্ব শেষ হলে তিনি পুরানো কাজে ফিরে যাবেন। উপদেষ্টাদের জন্যও হয়তো অনেক দুয়ার খোলা থাকবে। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের ‘মানবিক করিডোর সফল’ হলে হয়তো রোহিঙ্গাদেরও যাওয়ার জায়গা হবে, কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ যাবো কোথায়?
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যর্থতায় এই বারুদের খনির উপর বসে থাকা ছাড়া আমাদের তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই! সার্বিক পরিস্থিতি দেখে কারোই বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীলতা থেকে বহু দূরে অথবা এক গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। আর তাই প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো অন্তত এ বিপজ্জনক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দ্রুত নির্বাচন দাবি করছে। অথচ গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য এবং ভবিষ্যতে স্বৈরাচারী প্রবণতাকে ও পরিবারতন্ত্রকে আটকে দেয়ার জন্য অন্তত নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থায় এবং আমাদের পার্লামেন্টারি পদ্ধতিতে ‘বিজয়ীর জন্যই সব’Ñ এটা রোধকল্পে এবং স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংস্কার খুবই জরুরি ছিল; কিন্তু নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা নব্য ফ্যাসিস্টদের কারণে সংস্কারও বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। কারন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসব শক্তির উচ্ছৃঙ্খল সহিংসতা এবং নীতি পুলিশি ভূমিকা দমনে সক্ষমতা দেখাতে না পারায় এবং সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টার ‘মানুষ এই সরকারকে আরও পাঁচ বছর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে দেখতে চাইছে’, ‘অন্তত পাঁচ-দশ বছর তোমরা আমাদের নেতা থাকো’ বা ‘আমরা অনির্বাচিত, এই কথা কে বলল?’-এসব বয়ান আওড়ানোয় সংস্কারে আগ্রহীরাও বলছেন ‘ভিক্ষা চাই না, কুকুর সামলাও’!
অর্থাৎ তারা মনে করছেন দ্রুত নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। কন্ঠে স্বৈরাচার স্বৈরাচার বলে চিৎকার, অথচ নিজ মনের মধ্যে ভয়ংকর স্বৈরাচারী অসহিষ্ণুতা সম্পন্ন উচ্ছৃঙ্খল মানুষদের হাত থেকে দেশ রেহাই পাবে। ড. ইউনূস রাজনীতির লোক না হলেও এর আগে এক-এগারোর সময়ে স্বল্প দিনের জন্য রাজনীতির মাঠে নেমেছিলেন; কিন্তু দ্রুতই এসব থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন। তিনি একজন অসাম্প্রদায়িক, নারী ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী ও দারিদ্র্যর বিপরীতে সামাজিকভাবে মানুষের আর্থিক সুরক্ষায় বিশ্বাসী ব্যক্তিত্ব হিসেবে দুনিয়াজুড়ে পরিচিত। শেখ হাসিনা বিদ্বেষপ্রসূত তাকে ‘সুদখোর’ বলতেন। আর জামায়াতসহ মৌলবাদী গোষ্ঠী তাকে প্রকৃত অর্থেই সুদখোর এবং নারীদের পর্দার অন্তরাল থেকে বের করার অপরাধে অভিযুক্ত করতো। মুহাম্মদ ইউনূসের মতো বিশ্বখ্যাত একজন কীর্তিপুরুষ কি বুঝতে পারছেন না তিনি এই মৌলবাদী গোষ্ঠীর হাতে বন্দি হয়ে পড়ছেন?
প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টকে সম্প্রতি দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস মৌলবাদী উত্থান সম্পর্কে প্রশ্নকর্তাকে আশ্বস্ত করে বলেনÑ ‘এমন কিছু ঘটতে যাচ্ছে না। দেশের তরুণেরা খুবই উদ্যমী। ধর্মের বিষয়ে তারা খুবই
নিরপেক্ষ।’ কিন্তু এই তরুণেরা কারা? তারাই যারা এবারের আন্দোলনকে রাজনৈতিক দলের প্রভাবমুক্ত ভেবে লাখে লাখে রাজপথে নেমে এসেছিল। তারা কিন্তু ক্লাস রুমে বা কর্মক্ষেত্রে ফিরে গেছেন। ড. ইউনূসকে ঘিরে যে ছদ্মবেশীরা রয়েছে তাদের একটা বড় অংশই বর্ণচোরা ও ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিতে পুষ্ট। তাদের উসকানি আর সহযোগিতায় দেশে এক ঘৃণার রাজত্ব কায়েম করা হচ্ছে। ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে আবহমান বাংলার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির বিরুদ্ধে, ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে নারী স্বাধীনতা ও নারী ক্ষমতায়নের বিরুদ্ধে, ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে গণহারে মুক্তমনা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে, ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে মুক্তচিন্তা ও বাকস্বাধীনতার বিরুদ্ধে, ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধের সব স্মৃতির বিরুদ্ধে।
তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ? এত মৃত্যু, এত অশ্রু, এত বীরত্বগাথায় সৃষ্ট তারুণ্যের অভ্যুত্থানের পরেও বুক ভেঙে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসে প্রশ্ন জাগে মানবজমিন কি রইবে পতিত!
[লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা]
আনোয়ারুল হক
সোমবার, ০৫ মে ২০২৫
টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলায় ‘অভয়ারণ্য’ নামের একটি পাঠাগার থেকে ‘ধর্মবিরোধী’ অভিযোগ তুলে নজরুল-রবীন্দ্রনাথের বইসহ পাঁচ শতাধিক বই সরিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে ১৫-২০ জনের একদল যুবক তাওহিদী জনতা পরিচয়ে পাঠাগারে ঢুকে এ কা- ঘটায়।
সংবাদটি ছোট কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রাজত্ব নয় মাস পার হওয়ার পরেও এ ধরনের মব সৃষ্টি করে রবীন্দ্র নজরুল সাহিত্যের ওপর হামলার ঘটনার গুরুত্ব অনেক বড়। একই কায়দায় এরা ময়মনসিংহে সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র সাহিত্য সংসদের ওপর হামলা চালিয়েছে।
এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা ঘটেই চলেছে। আরো বড় ঘটনা হলো সপ্তাহজুড়ে উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীর নানা কিসিমের সৈনিকেরা, নারী সংস্কার কমিশন বাতিল এবং তার সদস্যদের বিচার দাবী করে ঢাকার রাজপথে রে রে করে তেড়ে উঠেছেন এবং গত ৩০ এপ্রিল জামায়াতে ইসলামীর আমিরসহ ধর্মাশ্রয়ী দলসমূহ রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এক সমাবেশ থেকে একই দাবি উত্থাপন করে বলেছেন দাবি না মানলে সরকার ফেলে দিতে তাদের পাঁচ মিনিট সময়ও লাগবে না।
স্বৈরশাসনবিরোধী অভ্যুত্থান বিজয়ী হওয়ার সাথে সাথে ছাত্র সমন্বয়কদের একাংশ বুঝে না বুঝে এবং আন্দোলন দমনে হাসিনা সরকারের নির্দয় দমন পীড়ন এবং নির্বিচার হত্যাকা-ের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় যে ক্রোধ, প্রতিহিংসা ও ঘৃণার সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেন, তার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় যারা হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা ও সমর্থন করেছিলেন তারা এক হিংগ্র চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হলেন। কিন্ত এটা বড়ই পরিতাপের বিষয় ড. ইউনুস সরকারের বয়স প্রায় নয় মাস পার হলেও এখনও সেই উগ্র মৌলবাদী আস্ফালন দেখতে হচ্ছে নারী স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে, বাঙালির শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে।
উগ্র মৌলবাদীদের আক্রোশ প্রথম দেখলাম শিল্পকলা একাডেমির নাট্য অনুষ্ঠান কেন্দ্র করে, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো মহিলা সমিতি মিলনায়তনের নাট্য অনুষ্ঠান ঘিরে। প্রতিনিয়ত দেখছি ছায়ানট আর উদীচীর বিরুদ্ধে তথাকথিত ইনসাফ ওয়ালাদের হুমকি ধামকি আর সোশ্যাল মিডিয়ায় অব্যাহত অপপ্রচার আর হিংসা ছড়ানোর উৎসব। ষাটের দশকে পাক-সামরিক সরকার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া এবং বেতার বা টেলিভিশনে সম্প্রচার নিষিদ্ধ করে। এ পটভূমিতে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী পালনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে ছায়ানট। কোনো রাজনৈতিক দল সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই বাঙালি সংস্কৃতির নিরবচ্ছিন্ন সাধনা, উদ্ভাস, প্রকাশ, বিকাশের সাথে জড়িয়ে আছে ছায়ানট। আর উদীচী ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান আর ’৭১-এর অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোতে বিদ্রোহের গান গাইতে গাইতেই এর বিকাশ ও ব্যাপ্তিলাভ। উদীচীর কর্মীরা প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নেয়। ছায়ানট বাঙালি সংস্কৃতি বিকাশে দায়বদ্ধ থেকে, জাগরণের গান গেয়ে স্বাধীনতার পটভূমি সৃষ্টিতে অবদান রেখেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তির গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেছে আর উদীচী শিকল ভাঙার গান গেয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আশির দশকের স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে এবং এবারের জুলাই অভ্যুত্থানেও উদীচী কারফিউ ভেঙে বিদ্রোহের গান নিয়ে রাজপথে ছিলো।
কোনো কোনো পত্রিকার বিরুদ্ধে ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী অবিরাম মিথ্যা প্রচারণার তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। এসব পত্রিকা সাধারণত দায়বদ্ধতা থেকে সরে এসে, চাপে পড়ে কিংবা লোভে পড়ে জনবিচ্ছিন্ন ক্ষমতাবানদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সাংবাদিকতা করে না। সাংবাদিকতায় সততা এবং উদার ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের প্রতি নির্মোহ দায়বদ্ধতার জন্য তারা উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর চক্ষুশূল। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কোনো কোনো মহল উন্মাদের মতো এবং কখনো এরা আসলে কারা? ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচীর জাতীয় সম্মেলনে, ২০০৫ সালে নেত্রকোনায় উদীচী কার্যালয়ে এবং ২০০১ সালে ঢাকার পল্টনে সিপিবির জনসভায় এবং রমনা বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে গ্রেনেড হামলা করে যারা নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল সেই ফ্যাসিস্ট দানবীয় শক্তিই ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধীতার’ আবরণে চড়াও হয়েছে আমাদের শিল্প সংস্কৃতির বিরুদ্ধে, দেশের প্রগতিশীল পত্রপত্রিকাগুলোর বিরুদ্ধে।
১৯৭১-এর পরাজয়ের গ্লানি এদের সব সময়ে এক প্রতিশোধ স্পৃহায় তাড়িত করে। ওরা জানে বুঝে যে বাংগালির শিল্প সাহিত্য চর্চা, প্রগতিশীল পত্রপত্রিকার লেখনি মুক্তিযুদ্ধের আয়োজন পর্বে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। আজও ফ্যাসিবাদ বিরোধিতার আবরনে তারা যে বহুত্ববাদবিরোধী কুপম-ুক সমাজ সৃষ্টি করতে চায় তার পথে বাঁধা ছায়ানট, উদীচী বা এ ধরনের সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং উদার মানসিকতা লালনকারী পত্রিকা সমূহ। উদীচী ছায়ানটের বিরুদ্ধে হুংকার দিয়ে ওরা সকল প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠনকেই হুঁশিয়ারি জানাচ্ছে। তাদের নিয়ন্ত্রিত দেশে-বিদেশে অবস্থানরত পেইড অনলাইন এক্টিভিস্ট ও ইউটিউবারদের মাধ্যমে ওরা সকল উদার ও প্রগতিশীল পত্রপত্রিকাকে ভয় দেখাচ্ছে, সেল্ফ সেন্সরশিপ আরোপে বাধ্য করছে।
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন যে সুপারিশ সমূহ পেশ করেছেন তার সব সুপারিশে সবাই একমত নাও হতে পারেন। অন্যান্য যে সব সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোর অনেক সুপারিশের সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল দ্বিমত পোষণ করেছে বা সংশোধনী প্রস্তাব দিয়েছে বা আরও আলোচনার প্রয়োজন আছে বলেছে; কিন্তু উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী ও ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির কা-ারিরা, ইসলামের একমাত্র হেফাজত ওয়ালারা নারী সংস্কার কমিশন বাতিল এবং তার সদস্যদের বিচার দাবি করছেন। তারা ঘোষণা দিচ্ছেন পরিবারে, সমাজে, সম্পত্তিতে, কর্মক্ষেত্রে তাঁরা নারীর সমানাধিকারে বিশ্বাস করেন না। দেশ গঠনের কাজ বাদ দিয়ে তারা এখন তাদের মত করে ‘নারী গঠনের’ জন্য ঢাকা মার্চ করছেন। মার্চওয়ালারা রাজু ভাস্কর্যের সামনে নারী প্রতিকৃতি ঝুলিয়ে যেভাবে অবমাননা করলেন দেখে মনে হলো এই কুপম-ুকদের কি কোনো মাতৃজঠরে জন্ম হয়েছে? আর দেশে আদৌ কি কোনো সরকার আছে?
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাসহ অনেক উপদেষ্টাই বারবার বলছেন কথায় কথায় খুনের মামলা করা যাবে না; কিন্তু কে শোনে কার কথা। একেকটা খুনের মামলায় শত শত নিরপরাধ মানুষকে, আর যাই হোক অন্তত খুনের সাথে বা হত্যা প্রচেষ্টার সাথে জড়িত নয় এমনতর মানুষকে, শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, অভিনেতা, অভিনেত্রী, কবি, সাহিত্যিক, কন্ঠশিল্পীÑ একেকজনের নামে ১০-২০টা করে মামলা সাজানো হয়েছে এবং আরো হচ্ছে। বাদী চেনে না আসামিকে, আসামি চেনে না বাদীকে। সংশ্লিষ্ট থানার ওসি বা রাষ্ট্র পক্ষের উকিলকে মামলা বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে মুচকি মুচকি হাসেন। এক অদ্ভুত পরিস্থিতি! এবং অধিকাংশ মামলাই যে প্রতিহিংসামূলক এবং হীন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ তো বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি, কৃষক আন্দোলনের নেত্রী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির চক্ষুশূল জুলাই অভ্যুত্থানের সমর্থনে রাজপথে সরব লাকি আক্তারের বিরুদ্ধে এক হাস্যকর হত্যাপ্রচেষ্টা মামলা দায়ের করা।
এসব দেখে মনে হচ্ছে দেশটা মগের মুল্লুক হয়ে গেল নাকি। এসব করে কিন্তু ছাত্র গণআন্দোলন দমনে যে পৈশাচিক হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে তাকে হালকা করে দেয়া হচ্ছে। যত মামলা আর যত ট্রাইব্যুনাল হোক না কেন ১০টা ন্যায্য মামলার পাশে হাজারটা মিথ্যা মামলা রুজুর ফলে বিচার নিয়ে মানুষের মনোজগতে যে পরিবর্তন আসছে তাতে করে ন্যায়বিচার করা কঠিন হয়ে উঠবে। মাঝে-মধ্যে মনে হয় শেখ হাসিনা এত অপরাধ করার পরও তার যাওয়ার জায়গা ছিল বা আছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের হয়তো কোনো আশ্রয় মিলবে। প্রধান উপদেষ্টা তো বলেই দিয়েছেন তার দায়িত্ব শেষ হলে তিনি পুরানো কাজে ফিরে যাবেন। উপদেষ্টাদের জন্যও হয়তো অনেক দুয়ার খোলা থাকবে। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের ‘মানবিক করিডোর সফল’ হলে হয়তো রোহিঙ্গাদেরও যাওয়ার জায়গা হবে, কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ যাবো কোথায়?
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যর্থতায় এই বারুদের খনির উপর বসে থাকা ছাড়া আমাদের তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই! সার্বিক পরিস্থিতি দেখে কারোই বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীলতা থেকে বহু দূরে অথবা এক গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। আর তাই প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো অন্তত এ বিপজ্জনক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দ্রুত নির্বাচন দাবি করছে। অথচ গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য এবং ভবিষ্যতে স্বৈরাচারী প্রবণতাকে ও পরিবারতন্ত্রকে আটকে দেয়ার জন্য অন্তত নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থায় এবং আমাদের পার্লামেন্টারি পদ্ধতিতে ‘বিজয়ীর জন্যই সব’Ñ এটা রোধকল্পে এবং স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংস্কার খুবই জরুরি ছিল; কিন্তু নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা নব্য ফ্যাসিস্টদের কারণে সংস্কারও বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। কারন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসব শক্তির উচ্ছৃঙ্খল সহিংসতা এবং নীতি পুলিশি ভূমিকা দমনে সক্ষমতা দেখাতে না পারায় এবং সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টার ‘মানুষ এই সরকারকে আরও পাঁচ বছর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে দেখতে চাইছে’, ‘অন্তত পাঁচ-দশ বছর তোমরা আমাদের নেতা থাকো’ বা ‘আমরা অনির্বাচিত, এই কথা কে বলল?’-এসব বয়ান আওড়ানোয় সংস্কারে আগ্রহীরাও বলছেন ‘ভিক্ষা চাই না, কুকুর সামলাও’!
অর্থাৎ তারা মনে করছেন দ্রুত নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। কন্ঠে স্বৈরাচার স্বৈরাচার বলে চিৎকার, অথচ নিজ মনের মধ্যে ভয়ংকর স্বৈরাচারী অসহিষ্ণুতা সম্পন্ন উচ্ছৃঙ্খল মানুষদের হাত থেকে দেশ রেহাই পাবে। ড. ইউনূস রাজনীতির লোক না হলেও এর আগে এক-এগারোর সময়ে স্বল্প দিনের জন্য রাজনীতির মাঠে নেমেছিলেন; কিন্তু দ্রুতই এসব থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন। তিনি একজন অসাম্প্রদায়িক, নারী ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী ও দারিদ্র্যর বিপরীতে সামাজিকভাবে মানুষের আর্থিক সুরক্ষায় বিশ্বাসী ব্যক্তিত্ব হিসেবে দুনিয়াজুড়ে পরিচিত। শেখ হাসিনা বিদ্বেষপ্রসূত তাকে ‘সুদখোর’ বলতেন। আর জামায়াতসহ মৌলবাদী গোষ্ঠী তাকে প্রকৃত অর্থেই সুদখোর এবং নারীদের পর্দার অন্তরাল থেকে বের করার অপরাধে অভিযুক্ত করতো। মুহাম্মদ ইউনূসের মতো বিশ্বখ্যাত একজন কীর্তিপুরুষ কি বুঝতে পারছেন না তিনি এই মৌলবাদী গোষ্ঠীর হাতে বন্দি হয়ে পড়ছেন?
প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টকে সম্প্রতি দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস মৌলবাদী উত্থান সম্পর্কে প্রশ্নকর্তাকে আশ্বস্ত করে বলেনÑ ‘এমন কিছু ঘটতে যাচ্ছে না। দেশের তরুণেরা খুবই উদ্যমী। ধর্মের বিষয়ে তারা খুবই
নিরপেক্ষ।’ কিন্তু এই তরুণেরা কারা? তারাই যারা এবারের আন্দোলনকে রাজনৈতিক দলের প্রভাবমুক্ত ভেবে লাখে লাখে রাজপথে নেমে এসেছিল। তারা কিন্তু ক্লাস রুমে বা কর্মক্ষেত্রে ফিরে গেছেন। ড. ইউনূসকে ঘিরে যে ছদ্মবেশীরা রয়েছে তাদের একটা বড় অংশই বর্ণচোরা ও ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিতে পুষ্ট। তাদের উসকানি আর সহযোগিতায় দেশে এক ঘৃণার রাজত্ব কায়েম করা হচ্ছে। ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে আবহমান বাংলার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির বিরুদ্ধে, ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে নারী স্বাধীনতা ও নারী ক্ষমতায়নের বিরুদ্ধে, ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে গণহারে মুক্তমনা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে, ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে মুক্তচিন্তা ও বাকস্বাধীনতার বিরুদ্ধে, ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধের সব স্মৃতির বিরুদ্ধে।
তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ? এত মৃত্যু, এত অশ্রু, এত বীরত্বগাথায় সৃষ্ট তারুণ্যের অভ্যুত্থানের পরেও বুক ভেঙে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসে প্রশ্ন জাগে মানবজমিন কি রইবে পতিত!
[লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা]