ইসরাত জাহান
২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের জন্য জাতীয় বাজেট প্রণয়নের প্রাথমিক কাজ প্রায় শেষ র্পযায়ে। জাতীয় বাজেট একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা এবং রাষ্ট্রের আর্থিক পরিকল্পনা। সরকার কর্তৃক উপস্থাপিত বাজেট একটি রাষ্ট্রীয় দলিল। জাতীয় সংসদ কার্যকর না থাকায় জুনের প্রথম সপ্তাহে প্রস্তাবিত বাজেট অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের কাছে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। সাধারনত প্রতি বছরই বাজেট জাতীয় সংসদের মাধ্যমে অনুমোদিত হয়েছে। তবে সামরিক শাসনামল এবং ২০০৭-২০০৮ ও ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ হয় নাই। রাজনৈতিক সরকারের বাজেট, সামরিক শাসনামলের বাজেট এবং অন্তর্বর্তী সরকার বাজেট চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে একেকটি বাজেট একেক ধরনের।
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন ট্যাক্স আদায় হয়। বর্তমানে দেশে ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। বাজেট অর্থায়নের জন্য স্থানীয় সূত্র থেকে অর্থ সংগ্রহের ওপর বেশি মাত্রায় নির্ভর করতে হয়। আগামী বাজেটে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরোপিত করের হার কমিয়ে করের পরিধি বাড়ানোর উদ্যোগ নিলে রাজস্ব আদায় বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অটোমেশন নিশ্চিত করে তথ্যপ্রযুক্তির ওপরে আরও গুরুত্ব দিয়ে অনলাইনের ব্যবস্থা করলে রাজস্ব আদায় বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।উচ্চ মাত্রায় কর নির্ধারণ করলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা বাড়ে। অভ্যন্তরীণ সুশাসনের অভাবে রাজস্ব আদায় যেভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা তা হচ্ছে না। মফস্বলে কর দেয়ার মতো অনেক ব্যবসায়ী আছেন। তাদের করের আওতায় আনা যায় কিনা তা ভাবা দরকার।
রাজনৈতিক সরকারের আমলে দলীয় বিবেচনায় অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করা হতো। প্রতি বছর দেখা যায়, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয় তার বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয় এবং ব্যয় বৃদ্ধি পায়। এ প্রবণতা রোধ করা দরকার। কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যদি নির্দিষ্ট সময়ে প্রাক্কলিত ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তার দায়ভার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকেই বহন করতে হবে। জনগণ কেন তার দায়ভার বহন করবে? প্রকল্প বিলম্বিত হওয়া এবং ব্যয়বৃদ্ধির বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে জরিমানা আকারে আদায় করা যেতে পারে।
আগামী অর্থবছর জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর দিকে মনোযোগ না দিয়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা ফেরানো, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা জরুরি। এ সময় অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা না থাকলে অর্থনীতিতে আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
কর পরিশোধিত আয় থেকে একজন ব্যক্তি ব্যাংকে টাকা জমা রাখলে মুনাফার ওপর ১০-১৫ শতাংশ কর কাটা হয়। আবার ব্যাংকের জমা স্থিতির ভিত্তিতে আবগরী শুল্ক কাটা হয়। এমনিতেই মানুষের সঞ্চয় সক্ষমতা কমেছে। আবার বিভিন্ন ভীতির কারণে অনেকে ব্যাংকে টাকা রাখতে চাইছেন না। এরকম অবস্থায় ৫-১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জমার ওপর আবগরী শুল্ক প্রত্যাহার এবং মুনাফার ওপর কর কমানো যেতে পারে। আগামী অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি কমানোর দিকে সর্বোচ্চ মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনায় নিয়ে করমুক্ত আয়সীমা অন্তত ৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা। যেখানে ভারতে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ে কোনও কর দিতে হয় না।
শিক্ষা হচ্ছে একটি জাতির সবচেয়ে মূল্যবান ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ। শিক্ষা খাতের ওপর যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে অধীত শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটানো না গেলে কোনোদিনই টেকসই উন্নয়ন অর্জন করা সম্ভব হবে না। বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে সরকারি বরাদ্দ (জিডিপির অনুপাতে) গত ২০ বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্য সর্বনিম্ন। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতি বছরই বাজেটে শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেখানো হয়। কিন্তু সেখানে শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে। শিক্ষা খাতের সঙ্গে আরও দু-একটি খাতকে অন্তর্ভুক্ত করে ব্যয় বরাদ্দ দেওয়া হয়। শিক্ষা খাতে বাজেটের বড় অংশই অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যয়িত হয়। ফলে শিক্ষা গবেষণা খাতের জন্য অর্থ সংকুলান করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
ইউনেস্কোর মতে, একটি দেশের মোট জিডিপির অন্তত ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে প্রতি বছর বাজেটে শিক্ষা খাতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়, তার পরিমাণ জিডিপির ২ শতাংশের কম। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যাতে গবেষণা কাজে বেশি অর্থ বরাদ্দ করা হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষায়িত অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেখানে সাধারণ বিষয়ও পড়ানো হচ্ছে। এতে শিক্ষার মানের অবনতি ঘটছে। দেশে বর্তমানে ৫৫টি সরকারি এবং ১১৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের শিক্ষার মানের অবনতি ঘটতে শুরু করে। এখন তা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। বিগত সরকারের আমলে শিক্ষার মানোন্নয়নের চেয়ে শিক্ষিতের হার বেশি দেখানোর প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। অনেকের ধারণা, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার জন্য শিক্ষার মানের অবনতি ঘটানো হচ্ছে। বর্তমানে যারা উচ্চশিক্ষা অর্জন করছেন, তারা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে গুণগত মান নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষা খাতে প্রতি বছর যে বাজেট বরাদ্দ, এর কত অংশ গবেষণা খাতে ব্যয় করতে হবে, এটা নির্দিষ্ট করে দেয়া যেতে পারে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বা শুধু তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষাদানে নিয়োজিত বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। শিক্ষার ওপর কর কোনোভাবেই কাম্য নয়; বরং সংবিধান পরিপন্থি। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির ১৫তম অনুচ্ছেদে মৌলিক চাহিদা হিসেবে নাগরিকের জন্য শিক্ষা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া কর আরোপিত হয় বাণিজ্যিক পণ্য বা সেবার ওপর। শিক্ষা প্রথমত পণ্য নয়। দ্বিতীয়ত, বেসরকারি উদ্যোগের উচ্চশিক্ষা কোনো বাণিজ্যিক তৎপরতাও নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী ট্রাস্টের অধীন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত। ট্রাস্ট আইন ১৮৮২ অনুযায়ী ট্রাস্টের অধীন পরিচালিত হওয়ায় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান করযোগ্য নয়। কোম্পানি আইন ১৯৯৪-এর আওতায় লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সঙ্গে ট্রাস্ট আইনে অলাভজনক হিসেবে পরিচালিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর একই আওতায় সমভাবে আয়কর আরোপের প্রস্তাবনা আইনের পরিপন্থি এবং তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আরোপিত করের বোঝার সিংহভাগই শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে এসে পড়বে, এমনকি কর যদি সরাসরি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে না নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও নেওয়া হয়। দেশে ১১৫টি অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। বাড়তি করের চাপ একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের পরিবারের ওপর একটা অমানবিক বোঝা হয়ে দাঁড়াবে, অন্যদিকে দেশে উচ্চশিক্ষার প্রসারকে বাধাগ্রস্ত এবং নিরুৎসাহিত করবে।
বর্তমানে যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে, তাদের অধিকাংশেরই অবকাঠামো, গবেষণাগার, নিজস্ব শিক্ষকের স্বল্পতা রয়েছ। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের খ-কালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে থাকেন। এতে বেসরকারি ও সরকারিÑ উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বিঘিœত হচ্ছে। এ প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনেকের মাঝেই শিক্ষা বিস্তারের চেয়ে ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হওয়ার প্রবণতা কাজ করে, এর অন্যতম কারণ আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকা ফলে বিশ্ববিদ্যালয়কে সাধারণ ব্যবসার মতো বিবেচনা করে থাকেন। কেউ যাতে বিশ্ববিদ্যালয়কে সাধারণ ব্যবসার মতো মনে করতে না পারেন, সে বিষয়ে দৃষ্টি রাখতে হবে।
মানসম্পন্ন ও যুগোপযোগী কারিগরি শিক্ষাকে সহজলভ্য এবং যথাসম্ভব সাশ্রয়ী করতে হবে। দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ, প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বিদেশি বাংলাদেশের শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। অন্যদিকে, দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশিরা চাকরি পাচ্ছে না। প্রয়োজনে পিপিপির মাধ্যমে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বেসরকারি খাত উপযোগী জনবলকে দক্ষ করে তুলতে হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন খাতে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু কোন খাতে কোন ধরনের সংস্কার হবে, তার প্রভাব অর্থনীতি ও জনজীবনে কতটা পড়বেÑ সে সম্পর্কে কেউ ধারণা করতে পারছেন না। তাই সরকার তার মেয়াদে কোন কোন সংস্কার করতে আগ্রহী এবং তার সম্ভাব্য প্রভাব কি হবে, তা বাজেট বক্তব্যে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে গতি নেই। ফলে বর্ধিত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। বিভিন্ন শিল্প কারখানা বন্ধের কারণে লাখো শ্রমিক বেকার হয়েছে। কর্মসংস্থান ও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে বাজেটে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া দরকার। কর ছাড় দেয়ার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ও জবাবদিহি থাকতে হবে। প্রতি কর ছাড়ের আদেশ এর সঙ্গে কত রাজস্ব ক্ষতি হলো তার একটা প্রাক্কলন দেয়া।
বাজেট কাঠামো, বরাদ্দ এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। বাজেটকে একটি উদ্ভাবনী এবং ব্যবসাবান্ধব করার আকাক্সক্ষা সরকারের থাকলেও শেষ মুহূর্তের বিভিন্ন কারণে বিচ্যুতি ঘটে। যার ফলে অনেক হতাশার সঙ্গে, এটি কেবল সংখ্যার সমন্বয় সাধনের একটি এলোমেলো অনুশীলনে পরিণত হয়। সন্দেহ নেই আগামী ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট নানা কারণেই ভিন্নতর হবে। এবার বাজেট জনবান্ধব, জাতীয় স্বার্থ সামাজিক উন্নয়ন ও মূল্যস্ফীতি প্রাধান্য পাবে, এটাই প্রত্যাশিত।
[লেখক : অধ্যাপক ও ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ]
ইসরাত জাহান
শনিবার, ১০ মে ২০২৫
২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের জন্য জাতীয় বাজেট প্রণয়নের প্রাথমিক কাজ প্রায় শেষ র্পযায়ে। জাতীয় বাজেট একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা এবং রাষ্ট্রের আর্থিক পরিকল্পনা। সরকার কর্তৃক উপস্থাপিত বাজেট একটি রাষ্ট্রীয় দলিল। জাতীয় সংসদ কার্যকর না থাকায় জুনের প্রথম সপ্তাহে প্রস্তাবিত বাজেট অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের কাছে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। সাধারনত প্রতি বছরই বাজেট জাতীয় সংসদের মাধ্যমে অনুমোদিত হয়েছে। তবে সামরিক শাসনামল এবং ২০০৭-২০০৮ ও ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ হয় নাই। রাজনৈতিক সরকারের বাজেট, সামরিক শাসনামলের বাজেট এবং অন্তর্বর্তী সরকার বাজেট চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে একেকটি বাজেট একেক ধরনের।
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন ট্যাক্স আদায় হয়। বর্তমানে দেশে ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। বাজেট অর্থায়নের জন্য স্থানীয় সূত্র থেকে অর্থ সংগ্রহের ওপর বেশি মাত্রায় নির্ভর করতে হয়। আগামী বাজেটে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরোপিত করের হার কমিয়ে করের পরিধি বাড়ানোর উদ্যোগ নিলে রাজস্ব আদায় বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অটোমেশন নিশ্চিত করে তথ্যপ্রযুক্তির ওপরে আরও গুরুত্ব দিয়ে অনলাইনের ব্যবস্থা করলে রাজস্ব আদায় বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।উচ্চ মাত্রায় কর নির্ধারণ করলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা বাড়ে। অভ্যন্তরীণ সুশাসনের অভাবে রাজস্ব আদায় যেভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা তা হচ্ছে না। মফস্বলে কর দেয়ার মতো অনেক ব্যবসায়ী আছেন। তাদের করের আওতায় আনা যায় কিনা তা ভাবা দরকার।
রাজনৈতিক সরকারের আমলে দলীয় বিবেচনায় অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করা হতো। প্রতি বছর দেখা যায়, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয় তার বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয় এবং ব্যয় বৃদ্ধি পায়। এ প্রবণতা রোধ করা দরকার। কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যদি নির্দিষ্ট সময়ে প্রাক্কলিত ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তার দায়ভার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকেই বহন করতে হবে। জনগণ কেন তার দায়ভার বহন করবে? প্রকল্প বিলম্বিত হওয়া এবং ব্যয়বৃদ্ধির বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে জরিমানা আকারে আদায় করা যেতে পারে।
আগামী অর্থবছর জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর দিকে মনোযোগ না দিয়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা ফেরানো, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা জরুরি। এ সময় অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা না থাকলে অর্থনীতিতে আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
কর পরিশোধিত আয় থেকে একজন ব্যক্তি ব্যাংকে টাকা জমা রাখলে মুনাফার ওপর ১০-১৫ শতাংশ কর কাটা হয়। আবার ব্যাংকের জমা স্থিতির ভিত্তিতে আবগরী শুল্ক কাটা হয়। এমনিতেই মানুষের সঞ্চয় সক্ষমতা কমেছে। আবার বিভিন্ন ভীতির কারণে অনেকে ব্যাংকে টাকা রাখতে চাইছেন না। এরকম অবস্থায় ৫-১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জমার ওপর আবগরী শুল্ক প্রত্যাহার এবং মুনাফার ওপর কর কমানো যেতে পারে। আগামী অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি কমানোর দিকে সর্বোচ্চ মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনায় নিয়ে করমুক্ত আয়সীমা অন্তত ৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা। যেখানে ভারতে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ে কোনও কর দিতে হয় না।
শিক্ষা হচ্ছে একটি জাতির সবচেয়ে মূল্যবান ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ। শিক্ষা খাতের ওপর যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে অধীত শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটানো না গেলে কোনোদিনই টেকসই উন্নয়ন অর্জন করা সম্ভব হবে না। বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে সরকারি বরাদ্দ (জিডিপির অনুপাতে) গত ২০ বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্য সর্বনিম্ন। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতি বছরই বাজেটে শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেখানো হয়। কিন্তু সেখানে শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে। শিক্ষা খাতের সঙ্গে আরও দু-একটি খাতকে অন্তর্ভুক্ত করে ব্যয় বরাদ্দ দেওয়া হয়। শিক্ষা খাতে বাজেটের বড় অংশই অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যয়িত হয়। ফলে শিক্ষা গবেষণা খাতের জন্য অর্থ সংকুলান করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
ইউনেস্কোর মতে, একটি দেশের মোট জিডিপির অন্তত ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে প্রতি বছর বাজেটে শিক্ষা খাতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়, তার পরিমাণ জিডিপির ২ শতাংশের কম। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যাতে গবেষণা কাজে বেশি অর্থ বরাদ্দ করা হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষায়িত অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেখানে সাধারণ বিষয়ও পড়ানো হচ্ছে। এতে শিক্ষার মানের অবনতি ঘটছে। দেশে বর্তমানে ৫৫টি সরকারি এবং ১১৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের শিক্ষার মানের অবনতি ঘটতে শুরু করে। এখন তা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। বিগত সরকারের আমলে শিক্ষার মানোন্নয়নের চেয়ে শিক্ষিতের হার বেশি দেখানোর প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। অনেকের ধারণা, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার জন্য শিক্ষার মানের অবনতি ঘটানো হচ্ছে। বর্তমানে যারা উচ্চশিক্ষা অর্জন করছেন, তারা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে গুণগত মান নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষা খাতে প্রতি বছর যে বাজেট বরাদ্দ, এর কত অংশ গবেষণা খাতে ব্যয় করতে হবে, এটা নির্দিষ্ট করে দেয়া যেতে পারে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বা শুধু তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষাদানে নিয়োজিত বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। শিক্ষার ওপর কর কোনোভাবেই কাম্য নয়; বরং সংবিধান পরিপন্থি। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির ১৫তম অনুচ্ছেদে মৌলিক চাহিদা হিসেবে নাগরিকের জন্য শিক্ষা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া কর আরোপিত হয় বাণিজ্যিক পণ্য বা সেবার ওপর। শিক্ষা প্রথমত পণ্য নয়। দ্বিতীয়ত, বেসরকারি উদ্যোগের উচ্চশিক্ষা কোনো বাণিজ্যিক তৎপরতাও নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী ট্রাস্টের অধীন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত। ট্রাস্ট আইন ১৮৮২ অনুযায়ী ট্রাস্টের অধীন পরিচালিত হওয়ায় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান করযোগ্য নয়। কোম্পানি আইন ১৯৯৪-এর আওতায় লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সঙ্গে ট্রাস্ট আইনে অলাভজনক হিসেবে পরিচালিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর একই আওতায় সমভাবে আয়কর আরোপের প্রস্তাবনা আইনের পরিপন্থি এবং তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আরোপিত করের বোঝার সিংহভাগই শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে এসে পড়বে, এমনকি কর যদি সরাসরি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে না নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও নেওয়া হয়। দেশে ১১৫টি অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। বাড়তি করের চাপ একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের পরিবারের ওপর একটা অমানবিক বোঝা হয়ে দাঁড়াবে, অন্যদিকে দেশে উচ্চশিক্ষার প্রসারকে বাধাগ্রস্ত এবং নিরুৎসাহিত করবে।
বর্তমানে যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে, তাদের অধিকাংশেরই অবকাঠামো, গবেষণাগার, নিজস্ব শিক্ষকের স্বল্পতা রয়েছ। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের খ-কালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে থাকেন। এতে বেসরকারি ও সরকারিÑ উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বিঘিœত হচ্ছে। এ প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনেকের মাঝেই শিক্ষা বিস্তারের চেয়ে ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হওয়ার প্রবণতা কাজ করে, এর অন্যতম কারণ আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকা ফলে বিশ্ববিদ্যালয়কে সাধারণ ব্যবসার মতো বিবেচনা করে থাকেন। কেউ যাতে বিশ্ববিদ্যালয়কে সাধারণ ব্যবসার মতো মনে করতে না পারেন, সে বিষয়ে দৃষ্টি রাখতে হবে।
মানসম্পন্ন ও যুগোপযোগী কারিগরি শিক্ষাকে সহজলভ্য এবং যথাসম্ভব সাশ্রয়ী করতে হবে। দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ, প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বিদেশি বাংলাদেশের শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। অন্যদিকে, দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশিরা চাকরি পাচ্ছে না। প্রয়োজনে পিপিপির মাধ্যমে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বেসরকারি খাত উপযোগী জনবলকে দক্ষ করে তুলতে হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন খাতে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু কোন খাতে কোন ধরনের সংস্কার হবে, তার প্রভাব অর্থনীতি ও জনজীবনে কতটা পড়বেÑ সে সম্পর্কে কেউ ধারণা করতে পারছেন না। তাই সরকার তার মেয়াদে কোন কোন সংস্কার করতে আগ্রহী এবং তার সম্ভাব্য প্রভাব কি হবে, তা বাজেট বক্তব্যে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে গতি নেই। ফলে বর্ধিত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। বিভিন্ন শিল্প কারখানা বন্ধের কারণে লাখো শ্রমিক বেকার হয়েছে। কর্মসংস্থান ও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে বাজেটে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া দরকার। কর ছাড় দেয়ার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ও জবাবদিহি থাকতে হবে। প্রতি কর ছাড়ের আদেশ এর সঙ্গে কত রাজস্ব ক্ষতি হলো তার একটা প্রাক্কলন দেয়া।
বাজেট কাঠামো, বরাদ্দ এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। বাজেটকে একটি উদ্ভাবনী এবং ব্যবসাবান্ধব করার আকাক্সক্ষা সরকারের থাকলেও শেষ মুহূর্তের বিভিন্ন কারণে বিচ্যুতি ঘটে। যার ফলে অনেক হতাশার সঙ্গে, এটি কেবল সংখ্যার সমন্বয় সাধনের একটি এলোমেলো অনুশীলনে পরিণত হয়। সন্দেহ নেই আগামী ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট নানা কারণেই ভিন্নতর হবে। এবার বাজেট জনবান্ধব, জাতীয় স্বার্থ সামাজিক উন্নয়ন ও মূল্যস্ফীতি প্রাধান্য পাবে, এটাই প্রত্যাশিত।
[লেখক : অধ্যাপক ও ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ]