নাজমূল হাসান
আজ ৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবস। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) উদ্যোগে ১৯৭৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী পালিত এই দিবসের মূল উদ্দেশ্য হলো পরিবেশ দূষণের কারণ চিহ্নিত করা, প্রতিরোধের উপায় খোঁজা এবং জনগণকে সচেতন করা। এবারের প্রতিপাদ্য ‘প্লাস্টিক দূষণ আর নয়’ এবং সেøাগান ‘প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করার এখনই সময়’ আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করছে। কারণ, বর্তমানে প্লাস্টিক দূষণ একটি বৈশ্বিক পরিবেশগত সংকট। এর মধ্যে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক, অর্থাৎ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেয়া প্লাস্টিক, সবচেয়ে বড় সমস্যা। স্ট্র, প্লাস্টিক কাপ, পলিথিন ব্যাগ, খাদ্য প্যাকেজিং, বেলুনের কাঠি ইত্যাদি পণ্যের আয়ু মাত্র কয়েক মিনিট, অথচ এটি শত শত বছর ধরে পরিবেশে থেকে যায়। প্লাস্টিকের ব্যবহার দিন দিন বাড়লেও এর অপচয় রোধ ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের সক্ষমতা সীমিত। ফলে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য জমে যাচ্ছে প্রকৃতিতে। গবেষণায় জানা যায়, প্রতিবছর বিশ্ব মহাসাগরে ৮০ লাখ টনের বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হয়, যার বড় অংশ আসে অব্যবস্থাপনায় ব্যবহৃত একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক থেকে।
বাংলাদেশ ২০০২ সালে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে পলিথিন নিষিদ্ধ করে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। তবে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাব ও কার্যকর বাস্তবায়নের ঘাটতির ফলে বর্তমানে রাজধানীসহ সারাদেশে প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে পুনর্ব্যবহারযোগ্য নয় এমন মাল্টি-লেয়ার প্যাকেজিং ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও নদনদীতে জমে পানি নিষ্কাশনে বাধা সৃষ্টি করছে, যা নগরাঞ্চলের জলাবদ্ধতার অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে। প্লাস্টিক শুধু পরিবেশে জমে থেকেই ক্ষতির কারণ নয়; এর উৎপাদন প্রক্রিয়াতেও জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার হয়, যা গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনে ভূমিকা রাখে। প্লাস্টিক পুড়িয়ে ফেললেও পরিবেশে প্রচুর কার্বন ডাই-অক্সাইড ও বিষাক্ত গ্যাস ছড়ায়, ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের গতি বাড়ে। প্লাস্টিক ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়, যা মানবদেহে প্রবেশ করে ক্যান্সার, হৃদরোগ, হরমোন ভারসাম্যহীনতাসহ নানা জটিল রোগের কারণ হতে পারে। খাবারের সঙ্গে, পানির মাধ্যমে এমনকি বায়ুর মাধ্যমেও এই মাইক্রোপ্লাস্টিক মানব শরীরে প্রবেশ করছে। দেশের নদ-নদীগুলোতে প্লাস্টিক ও শিল্পবর্জ্যরে আধিক্যে নাব্য কমেছে, জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়েছে। যেসব নদীতে এক সময় প্রচুর মাছ পাওয়া যেত, আজ সেখান থেকে আহরিত মাছ দেশের মোট মাছ উৎপাদনের মাত্র দেড় শতাংশেরও কম।
ঢাকার পাশ দিয়ে প্রবাহিত বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা নদী দখল ও দূষণের কারণে প্রায় মৃত অবস্থায় পৌঁছেছে। বিশেষ করে ডায়িং ও ট্যানারিসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানা যথাযথভাবে এফ্ললুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) ব্যবহার না করে সরাসরি বর্জ্য নদীতে ফেলছে, যা পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান উৎস। এর ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও নিরাপদ পানির সরবরাহ চরমভাবে হুমকির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশের সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও উন্নয়ন নীতিতে পরিবেশ সুরক্ষার গুরুত্ব স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সংবিধানের ১৮ (ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ এছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে অন্তত তিনটি লক্ষ্য রয়েছে, যেমন লক্ষ্য ১৩ (জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা), লক্ষ্য ১৪ (জলজ জীবন সংরক্ষণ) এবং লক্ষ্য ১৫ (স্থলজ জীবন রক্ষা), যেগুলো প্লাস্টিক দূষণের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু বাস্তবে প্লাস্টিক দূষণ এসব লক্ষ্যের বাস্তবায়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতিমাত্রায় প্লাস্টিক উৎপাদন ও ব্যবহার বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে এবং আমাদের মূল্যবান জীববৈচিত্র্যকে চরম ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
বাংলাদেশে ২০২১ সালে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালার আওতায় সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার নিষিদ্ধের লক্ষ্যে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। পাশাপাশি, ‘মাল্টিসেক্টোরাল অ্যাকশন প্ল্যান ফর সাসটেইনেবল প্লাস্টিক ম্যানেজমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ প্রকল্পের মাধ্যমে একটি টেকসই প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনার রোডম্যাপ তৈরি করা হয়েছে। এর লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে প্লাস্টিক উৎপাদনে ভার্জিন উপাদানের ব্যবহার ৩০ শতাংশ কমানো, ২০২৬ সালের মধ্যে ৯০ শতাংশ সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক বন্ধ করা এবং ২০২৫ সালের মধ্যে প্লাস্টিক বর্জ্যরে পুনর্ব্যবহার ৫০ শতাংশে উন্নীত করা। এছাড়াও, ২০৩০ সালের মধ্যে পুনর্ব্যবহার হার ৮০ শতাংশে উন্নীত করা এবং বার্ষিক প্লাস্টিক বর্জ্যরে উৎপাদন ৩০ শতাংশ হ্রাস করা হবে। তবে দুঃখজনকভাবে, এসব পরিকল্পনা এখনো মূলত নীতিমালার কাগজে সীমাবদ্ধ। বাস্তবায়নে গতি অত্যন্ত ধীর, যার ফলে প্রত্যাশিত পরিবেশগত অগ্রগতি অর্জন করা যাচ্ছে না। প্লাস্টিক দূষণ মোকাবিলায় বাংলাদেশের জন্য সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতা এবং নিরবচ্ছিন্ন ও সমন্বিত প্রচেষ্টা। এমন উদ্যোগই দেশকে আরও পরিবেশবান্ধব ও স্থিতিশীল ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে নিতে পারে।
পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় হাইকোর্ট পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যাগের উৎপাদন, বিপণন, ব্যবহার ও পরিবহণ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধে কঠোর নির্দেশনা জারি করেছে। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলের হোটেল-মোটেল ও রেস্তোরাঁগুলোতে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এই নির্দেশনার ভিত্তিতে পরিবেশ অধিদপ্তর ‘আসুন সবাই মিলে প্লাস্টিক দূষণ রোধ করি, বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য টেকসই পরিবেশ গড়ি’ এই সেøাগানকে সামনে রেখে নানামুখী কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এ কার্যক্রমগুলোর মধ্যে রয়েছে পলিথিন ও সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহারে নিরুৎসাহ করা, মাল্টি-লেয়ার পলিথিন মোড়কের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব প্যাকেজিং ব্যবহারের পরামর্শ, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহকে বিকল্প উপকরণ ব্যবহারে উৎসাহ প্রদান। এছাড়াও, ১ অক্টোবর ২০২৪ থেকে সুপারশপে পলিথিন ও পলিপ্রপাইলিন ব্যাগ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হয়েছে এবং ১ নভেম্বর ২০২৪ থেকে অবৈধ পলিথিনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী অভিযান শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে জনগণকে এ ধরনের ব্যাগ ব্যবহার বা বহন না করার আহ্বান জানানো হয়েছে, যাতে সম্মিলিতভাবে একটি পরিবেশবান্ধব সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হয়।
২০২৫ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত বিমসটেক যুব নেতৃত্বাধীন জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণের সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন দেশের যুব প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে বুঝেছি পরিবেশ রক্ষায় তরুণদের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। প্লাস্টিক দূষণ, বন উজাড়, জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার প্রসঙ্গে নানান উদ্ভাবনী ধারণা উঠে এসেছে। আমরা একমত হয়েছি যে, যদি বর্তমান প্রজন্ম পরিবেশ সচেতনতায় এগিয়ে না আসে, তবে শুধু নীতিমালা ও প্রকল্প দিয়ে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। পরিবেশ রক্ষায় তরুণদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে প্রয়োজন সচেতনতা, শিক্ষা ও সক্ষমতা। যুবসমাজ প্রযুক্তি ব্যবহারে পারদর্শী, তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার চালাতে পারে। তরুণরাই পারে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বর্জন করতে; রিফিউজ, রিডিউস, রিইউজ, রিসাইক্লিং নীতির বাস্তবায়নে কাজ করতে; স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ গ্রহণ করতে এবং স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ ক্লাব গঠন করে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করতে।
সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সম্মিলিতভাবে পরিবেশ রক্ষায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও বাস্তবধর্মী উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে: এক. সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের উৎপাদন, বিক্রয়, ব্যবহার ও বাজারজাতকরণ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এর পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব বিকল্প যেমন কাপড়ের ব্যাগ, পাটজাত বা কাগজের মোড়ক ব্যবহারে প্রণোদনা প্রদান করা জরুরি। পাশাপাশি সুপারশপ, হোটেল ও রেস্তোরাঁয় এসব আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। দুই. পরিবেশবান্ধব বিকল্প উপকরণ উদ্ভাবনে গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। স্থানীয় উদ্ভাবন ও উদ্যোগসমূহকে সরকারি সহায়তা, প্রণোদনা ও নীতিগত সহযোগিতা দিয়ে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। তিন. যেকোনো পরিবেশ-সংশ্লিষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় স্থানীয় জনগণের মতামত, অভিজ্ঞতা ও প্রাকৃতিক জ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এতে প্রকল্পগুলো আরও টেকসই, কার্যকর ও বাস্তবভিত্তিক হবে। চার. শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এফ্ললুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। যারা এই বিধান লঙ্ঘন করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে পরিবেশ দূষণকারীরা শাস্তির বাইরে না থাকে।
পরিবেশ সুরক্ষায় তরুণ প্রজন্মের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করে প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব। তরুণরা শুধু নিজেরাই সচেতন হয়ে প্লাস্টিকের বিকল্প ব্যবহার করবে না, বরং পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে পারে। এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আমাদের সংকল্প হোকÑ‘প্লাস্টিক দূষণ নয়, পরিবেশবান্ধব ভবিষ্যতের পথ তৈরি করি।’
[লেখক : রোভার স্কাউট লিডার, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এয়ার রোভার স্কাউট গ্রুপ ]
নাজমূল হাসান
বুধবার, ০৪ জুন ২০২৫
আজ ৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবস। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) উদ্যোগে ১৯৭৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী পালিত এই দিবসের মূল উদ্দেশ্য হলো পরিবেশ দূষণের কারণ চিহ্নিত করা, প্রতিরোধের উপায় খোঁজা এবং জনগণকে সচেতন করা। এবারের প্রতিপাদ্য ‘প্লাস্টিক দূষণ আর নয়’ এবং সেøাগান ‘প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করার এখনই সময়’ আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করছে। কারণ, বর্তমানে প্লাস্টিক দূষণ একটি বৈশ্বিক পরিবেশগত সংকট। এর মধ্যে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক, অর্থাৎ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেয়া প্লাস্টিক, সবচেয়ে বড় সমস্যা। স্ট্র, প্লাস্টিক কাপ, পলিথিন ব্যাগ, খাদ্য প্যাকেজিং, বেলুনের কাঠি ইত্যাদি পণ্যের আয়ু মাত্র কয়েক মিনিট, অথচ এটি শত শত বছর ধরে পরিবেশে থেকে যায়। প্লাস্টিকের ব্যবহার দিন দিন বাড়লেও এর অপচয় রোধ ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের সক্ষমতা সীমিত। ফলে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য জমে যাচ্ছে প্রকৃতিতে। গবেষণায় জানা যায়, প্রতিবছর বিশ্ব মহাসাগরে ৮০ লাখ টনের বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হয়, যার বড় অংশ আসে অব্যবস্থাপনায় ব্যবহৃত একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক থেকে।
বাংলাদেশ ২০০২ সালে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে পলিথিন নিষিদ্ধ করে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। তবে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাব ও কার্যকর বাস্তবায়নের ঘাটতির ফলে বর্তমানে রাজধানীসহ সারাদেশে প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে পুনর্ব্যবহারযোগ্য নয় এমন মাল্টি-লেয়ার প্যাকেজিং ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও নদনদীতে জমে পানি নিষ্কাশনে বাধা সৃষ্টি করছে, যা নগরাঞ্চলের জলাবদ্ধতার অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে। প্লাস্টিক শুধু পরিবেশে জমে থেকেই ক্ষতির কারণ নয়; এর উৎপাদন প্রক্রিয়াতেও জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার হয়, যা গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনে ভূমিকা রাখে। প্লাস্টিক পুড়িয়ে ফেললেও পরিবেশে প্রচুর কার্বন ডাই-অক্সাইড ও বিষাক্ত গ্যাস ছড়ায়, ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের গতি বাড়ে। প্লাস্টিক ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়, যা মানবদেহে প্রবেশ করে ক্যান্সার, হৃদরোগ, হরমোন ভারসাম্যহীনতাসহ নানা জটিল রোগের কারণ হতে পারে। খাবারের সঙ্গে, পানির মাধ্যমে এমনকি বায়ুর মাধ্যমেও এই মাইক্রোপ্লাস্টিক মানব শরীরে প্রবেশ করছে। দেশের নদ-নদীগুলোতে প্লাস্টিক ও শিল্পবর্জ্যরে আধিক্যে নাব্য কমেছে, জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়েছে। যেসব নদীতে এক সময় প্রচুর মাছ পাওয়া যেত, আজ সেখান থেকে আহরিত মাছ দেশের মোট মাছ উৎপাদনের মাত্র দেড় শতাংশেরও কম।
ঢাকার পাশ দিয়ে প্রবাহিত বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা নদী দখল ও দূষণের কারণে প্রায় মৃত অবস্থায় পৌঁছেছে। বিশেষ করে ডায়িং ও ট্যানারিসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানা যথাযথভাবে এফ্ললুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) ব্যবহার না করে সরাসরি বর্জ্য নদীতে ফেলছে, যা পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান উৎস। এর ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও নিরাপদ পানির সরবরাহ চরমভাবে হুমকির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশের সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও উন্নয়ন নীতিতে পরিবেশ সুরক্ষার গুরুত্ব স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সংবিধানের ১৮ (ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ এছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে অন্তত তিনটি লক্ষ্য রয়েছে, যেমন লক্ষ্য ১৩ (জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা), লক্ষ্য ১৪ (জলজ জীবন সংরক্ষণ) এবং লক্ষ্য ১৫ (স্থলজ জীবন রক্ষা), যেগুলো প্লাস্টিক দূষণের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু বাস্তবে প্লাস্টিক দূষণ এসব লক্ষ্যের বাস্তবায়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতিমাত্রায় প্লাস্টিক উৎপাদন ও ব্যবহার বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে এবং আমাদের মূল্যবান জীববৈচিত্র্যকে চরম ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
বাংলাদেশে ২০২১ সালে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালার আওতায় সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার নিষিদ্ধের লক্ষ্যে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। পাশাপাশি, ‘মাল্টিসেক্টোরাল অ্যাকশন প্ল্যান ফর সাসটেইনেবল প্লাস্টিক ম্যানেজমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ প্রকল্পের মাধ্যমে একটি টেকসই প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনার রোডম্যাপ তৈরি করা হয়েছে। এর লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে প্লাস্টিক উৎপাদনে ভার্জিন উপাদানের ব্যবহার ৩০ শতাংশ কমানো, ২০২৬ সালের মধ্যে ৯০ শতাংশ সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক বন্ধ করা এবং ২০২৫ সালের মধ্যে প্লাস্টিক বর্জ্যরে পুনর্ব্যবহার ৫০ শতাংশে উন্নীত করা। এছাড়াও, ২০৩০ সালের মধ্যে পুনর্ব্যবহার হার ৮০ শতাংশে উন্নীত করা এবং বার্ষিক প্লাস্টিক বর্জ্যরে উৎপাদন ৩০ শতাংশ হ্রাস করা হবে। তবে দুঃখজনকভাবে, এসব পরিকল্পনা এখনো মূলত নীতিমালার কাগজে সীমাবদ্ধ। বাস্তবায়নে গতি অত্যন্ত ধীর, যার ফলে প্রত্যাশিত পরিবেশগত অগ্রগতি অর্জন করা যাচ্ছে না। প্লাস্টিক দূষণ মোকাবিলায় বাংলাদেশের জন্য সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতা এবং নিরবচ্ছিন্ন ও সমন্বিত প্রচেষ্টা। এমন উদ্যোগই দেশকে আরও পরিবেশবান্ধব ও স্থিতিশীল ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে নিতে পারে।
পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় হাইকোর্ট পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যাগের উৎপাদন, বিপণন, ব্যবহার ও পরিবহণ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধে কঠোর নির্দেশনা জারি করেছে। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলের হোটেল-মোটেল ও রেস্তোরাঁগুলোতে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এই নির্দেশনার ভিত্তিতে পরিবেশ অধিদপ্তর ‘আসুন সবাই মিলে প্লাস্টিক দূষণ রোধ করি, বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য টেকসই পরিবেশ গড়ি’ এই সেøাগানকে সামনে রেখে নানামুখী কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এ কার্যক্রমগুলোর মধ্যে রয়েছে পলিথিন ও সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহারে নিরুৎসাহ করা, মাল্টি-লেয়ার পলিথিন মোড়কের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব প্যাকেজিং ব্যবহারের পরামর্শ, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহকে বিকল্প উপকরণ ব্যবহারে উৎসাহ প্রদান। এছাড়াও, ১ অক্টোবর ২০২৪ থেকে সুপারশপে পলিথিন ও পলিপ্রপাইলিন ব্যাগ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হয়েছে এবং ১ নভেম্বর ২০২৪ থেকে অবৈধ পলিথিনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী অভিযান শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে জনগণকে এ ধরনের ব্যাগ ব্যবহার বা বহন না করার আহ্বান জানানো হয়েছে, যাতে সম্মিলিতভাবে একটি পরিবেশবান্ধব সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হয়।
২০২৫ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত বিমসটেক যুব নেতৃত্বাধীন জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণের সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন দেশের যুব প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে বুঝেছি পরিবেশ রক্ষায় তরুণদের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। প্লাস্টিক দূষণ, বন উজাড়, জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার প্রসঙ্গে নানান উদ্ভাবনী ধারণা উঠে এসেছে। আমরা একমত হয়েছি যে, যদি বর্তমান প্রজন্ম পরিবেশ সচেতনতায় এগিয়ে না আসে, তবে শুধু নীতিমালা ও প্রকল্প দিয়ে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। পরিবেশ রক্ষায় তরুণদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে প্রয়োজন সচেতনতা, শিক্ষা ও সক্ষমতা। যুবসমাজ প্রযুক্তি ব্যবহারে পারদর্শী, তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার চালাতে পারে। তরুণরাই পারে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বর্জন করতে; রিফিউজ, রিডিউস, রিইউজ, রিসাইক্লিং নীতির বাস্তবায়নে কাজ করতে; স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ গ্রহণ করতে এবং স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ ক্লাব গঠন করে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করতে।
সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সম্মিলিতভাবে পরিবেশ রক্ষায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও বাস্তবধর্মী উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে: এক. সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের উৎপাদন, বিক্রয়, ব্যবহার ও বাজারজাতকরণ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এর পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব বিকল্প যেমন কাপড়ের ব্যাগ, পাটজাত বা কাগজের মোড়ক ব্যবহারে প্রণোদনা প্রদান করা জরুরি। পাশাপাশি সুপারশপ, হোটেল ও রেস্তোরাঁয় এসব আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। দুই. পরিবেশবান্ধব বিকল্প উপকরণ উদ্ভাবনে গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। স্থানীয় উদ্ভাবন ও উদ্যোগসমূহকে সরকারি সহায়তা, প্রণোদনা ও নীতিগত সহযোগিতা দিয়ে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। তিন. যেকোনো পরিবেশ-সংশ্লিষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় স্থানীয় জনগণের মতামত, অভিজ্ঞতা ও প্রাকৃতিক জ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এতে প্রকল্পগুলো আরও টেকসই, কার্যকর ও বাস্তবভিত্তিক হবে। চার. শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এফ্ললুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। যারা এই বিধান লঙ্ঘন করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে পরিবেশ দূষণকারীরা শাস্তির বাইরে না থাকে।
পরিবেশ সুরক্ষায় তরুণ প্রজন্মের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করে প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব। তরুণরা শুধু নিজেরাই সচেতন হয়ে প্লাস্টিকের বিকল্প ব্যবহার করবে না, বরং পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে পারে। এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আমাদের সংকল্প হোকÑ‘প্লাস্টিক দূষণ নয়, পরিবেশবান্ধব ভবিষ্যতের পথ তৈরি করি।’
[লেখক : রোভার স্কাউট লিডার, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এয়ার রোভার স্কাউট গ্রুপ ]