এস ডি সুব্রত
বায়ুদূষণÑমানুষের অস্তিত্বের জন্য এক নীরব ঘাতক। আমরা যেটি প্রতিদিন শ্বাস নিচ্ছি, সেই বাতাস ক্রমেই বিষাক্ত হয়ে উঠছে। অথচ এই ভয়াবহ বাস্তবতাকে কেন্দ্র করে যত আলোচনা হচ্ছে, বাস্তব পদক্ষেপ ততটাই নগণ্য। বিশেষজ্ঞরা বহু বছর ধরে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন, কিন্তু সরকারের নানা সংস্থা ও নাগরিকদের অসচেতনতা আমাদের ঠেলে দিচ্ছে এক ভয়ানক স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিপর্যয়ের দিকে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঢাকার বস্তুকণাজনিত দূষণের উৎস বিশ্লেষণে দেখা যায়Ñ ৫৮% দূষণ আসে ইটভাটা থেকে। ১৮% আসে রাস্তার ধুলা ও খোলা মাটি থেকে। ১০% যানবাহনের ধোঁয়া থেকে। ৪% অন্যান্য উৎস থেকে (কারখানা, বর্জ্য, খোলা জায়গায় ময়লা পোড়ানো ইত্যাদি)।
ঢাকার আশপাশে প্রায় ৫০ হাজার ইটভাটা সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। এদের বড় একটি অংশ এখনো পুরনো, পরিবেশবিধি না মানা পদ্ধতিতে কয়লা বা টায়ার পুড়িয়ে ইট পুড়ায়। এর ফলে কালো ধোঁয়া ও বিষাক্ত গ্যাস বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। পরিবেশ আইন অনুযায়ী, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারে বাধ্যতামূলক নির্দেশনা থাকলেও এর কার্যকর প্রয়োগ চোখে পড়ে না।
রাজধানীজুড়ে যেসব প্রকল্প চলছে, যেমন মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস, ওয়াটারলাইন বা গ্যাসলাইন সংস্কারÑএসব প্রকল্পে ঠিকমতো ধুলো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অনুসরণ করা হয় না। এক সংস্থা রাস্তা খুঁড়ে কাজ শেষ করার আগেই অন্য সংস্থা আবার সেই রাস্তা খুঁড়ে কাজ শুরু করে। এতে যেমন অপচয় হচ্ছে রাষ্ট্রীয় অর্থের, তেমনি ধুলাবালিতে পুরো শহরের বাতাস হয়ে উঠছে বিষাক্ত।
ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে। ঢাকায় লাখ লাখ গাড়ি চলাচল করে, যার একটি বড় অংশ ফিটনেস নবায়ন করে না। অথচ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) মাত্র একটি কেন্দ্রে ফিটনেস পরীক্ষা করে, যা চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপর্যাপ্ত।
বায়ুদূষণ একটি স্বাস্থ্যবিষয়ক জরুরি অবস্থা। শিশু, বৃদ্ধ, অন্তঃসত্ত্বা নারী এবং অসুস্থ ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে। বায়ুদূষণের কারণে বাড়ছে হাঁপানি ও শ্বাসকষ্ট।
বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে ১০ হাজার শিশু। ঢাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। নগরীর অভ্যন্তরে এবং উপকণ্ঠে এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে ময়লার স্তূপ নেই। সেগুলো থেকে দুর্গন্ধ ও বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। হাসপাতালগুলোর ৯০-৯৫%-এ বায়ুবাহিত সংক্রমণ প্রতিরোধের উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই। হাসপাতাল-পর্যায়ের বায়ুদূষণ এখন জনস্বাস্থ্য সমস্যার অন্যতম উৎসে পরিণত হয়েছে। শুধু মানুষ নয়Ñপাখি, প্রাণী, বৃক্ষরাজিও এই দূষণের শিকার। ঢাকার গাছপালা এখন ধুলোয় আচ্ছন্ন, পাতায় সবুজ নেই, ফুলের সুবাস নেই।
বাংলাদেশ গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলের একটি সমতল দেশ। শীত মৌসুমে হিমালয় অঞ্চল থেকে বিষাক্ত কণা ও ধুলা বাংলাদেশের দিকে নেমে আসে। এর সঙ্গে যোগ হয় দেশের নিজস্ব দূষণ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন ঋতুর স্বাভাবিকতাও হারাচ্ছে। গরমে অতিরিক্ত গরম, শীতে শীত নেই। এ পরিবেশে বায়ুদূষণের প্রভাব আরও তীব্র হয়।
একজন প্রাপ্তবয়স্ক বছরে গড়ে ৭৫০ কেজি অক্সিজেন গ্রহণ করে, যা ৭-৮টি পূর্ণবয়স্ক গাছ থেকে আসে। তাই শহরের প্রতিটি সড়কপাশ, আইল্যান্ড, পার্ক এবং বাসার খোলা জায়গায় গাছ লাগাতে হবে। নাগরিক উদ্যোগে ছাদবাগান সম্প্রসারণে করছাড়, প্রণোদনা ও প্রশিক্ষণ চালু করা উচিত।
নির্মাণকাজে বাধ্যতামূলকভাবে নেট বা পর্দা দিয়ে ঘেরা, সাইটে পানি ছিটানো, নির্মাণসামগ্রী ঢাকা রাখা। ইটভাটা আধুনিকায়ন ও নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা দরকার। অস্বাস্থ্যকর ভাটা অবিলম্বে বন্ধ করা দরকার।
বায়ুদূষণ একক কোনো সমস্যা নয়; এটি একটি বহুস্তরীয় সংকট, যা পরিবেশ, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। উন্নয়ন যদি মানবিকতা বিসর্জন দিয়ে হয়, তবে তা কেবল স্থাপনা নয়, ধ্বংস ডেকে আনে। ঢাকার বাতাস প্রতিনিয়ত মৃত্যুর দূত হয়ে উঠছে। এখনই পদক্ষেপ না নিলে একটি প্রজন্ম শুধু শ্বাসকষ্টেই নয়, ভবিষ্যৎহীনতার বেদনায়ও ধুঁকবে।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]
এস ডি সুব্রত
শনিবার, ২১ জুন ২০২৫
বায়ুদূষণÑমানুষের অস্তিত্বের জন্য এক নীরব ঘাতক। আমরা যেটি প্রতিদিন শ্বাস নিচ্ছি, সেই বাতাস ক্রমেই বিষাক্ত হয়ে উঠছে। অথচ এই ভয়াবহ বাস্তবতাকে কেন্দ্র করে যত আলোচনা হচ্ছে, বাস্তব পদক্ষেপ ততটাই নগণ্য। বিশেষজ্ঞরা বহু বছর ধরে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন, কিন্তু সরকারের নানা সংস্থা ও নাগরিকদের অসচেতনতা আমাদের ঠেলে দিচ্ছে এক ভয়ানক স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিপর্যয়ের দিকে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঢাকার বস্তুকণাজনিত দূষণের উৎস বিশ্লেষণে দেখা যায়Ñ ৫৮% দূষণ আসে ইটভাটা থেকে। ১৮% আসে রাস্তার ধুলা ও খোলা মাটি থেকে। ১০% যানবাহনের ধোঁয়া থেকে। ৪% অন্যান্য উৎস থেকে (কারখানা, বর্জ্য, খোলা জায়গায় ময়লা পোড়ানো ইত্যাদি)।
ঢাকার আশপাশে প্রায় ৫০ হাজার ইটভাটা সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। এদের বড় একটি অংশ এখনো পুরনো, পরিবেশবিধি না মানা পদ্ধতিতে কয়লা বা টায়ার পুড়িয়ে ইট পুড়ায়। এর ফলে কালো ধোঁয়া ও বিষাক্ত গ্যাস বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। পরিবেশ আইন অনুযায়ী, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারে বাধ্যতামূলক নির্দেশনা থাকলেও এর কার্যকর প্রয়োগ চোখে পড়ে না।
রাজধানীজুড়ে যেসব প্রকল্প চলছে, যেমন মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস, ওয়াটারলাইন বা গ্যাসলাইন সংস্কারÑএসব প্রকল্পে ঠিকমতো ধুলো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অনুসরণ করা হয় না। এক সংস্থা রাস্তা খুঁড়ে কাজ শেষ করার আগেই অন্য সংস্থা আবার সেই রাস্তা খুঁড়ে কাজ শুরু করে। এতে যেমন অপচয় হচ্ছে রাষ্ট্রীয় অর্থের, তেমনি ধুলাবালিতে পুরো শহরের বাতাস হয়ে উঠছে বিষাক্ত।
ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে। ঢাকায় লাখ লাখ গাড়ি চলাচল করে, যার একটি বড় অংশ ফিটনেস নবায়ন করে না। অথচ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) মাত্র একটি কেন্দ্রে ফিটনেস পরীক্ষা করে, যা চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপর্যাপ্ত।
বায়ুদূষণ একটি স্বাস্থ্যবিষয়ক জরুরি অবস্থা। শিশু, বৃদ্ধ, অন্তঃসত্ত্বা নারী এবং অসুস্থ ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে। বায়ুদূষণের কারণে বাড়ছে হাঁপানি ও শ্বাসকষ্ট।
বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে ১০ হাজার শিশু। ঢাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। নগরীর অভ্যন্তরে এবং উপকণ্ঠে এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে ময়লার স্তূপ নেই। সেগুলো থেকে দুর্গন্ধ ও বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। হাসপাতালগুলোর ৯০-৯৫%-এ বায়ুবাহিত সংক্রমণ প্রতিরোধের উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই। হাসপাতাল-পর্যায়ের বায়ুদূষণ এখন জনস্বাস্থ্য সমস্যার অন্যতম উৎসে পরিণত হয়েছে। শুধু মানুষ নয়Ñপাখি, প্রাণী, বৃক্ষরাজিও এই দূষণের শিকার। ঢাকার গাছপালা এখন ধুলোয় আচ্ছন্ন, পাতায় সবুজ নেই, ফুলের সুবাস নেই।
বাংলাদেশ গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলের একটি সমতল দেশ। শীত মৌসুমে হিমালয় অঞ্চল থেকে বিষাক্ত কণা ও ধুলা বাংলাদেশের দিকে নেমে আসে। এর সঙ্গে যোগ হয় দেশের নিজস্ব দূষণ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন ঋতুর স্বাভাবিকতাও হারাচ্ছে। গরমে অতিরিক্ত গরম, শীতে শীত নেই। এ পরিবেশে বায়ুদূষণের প্রভাব আরও তীব্র হয়।
একজন প্রাপ্তবয়স্ক বছরে গড়ে ৭৫০ কেজি অক্সিজেন গ্রহণ করে, যা ৭-৮টি পূর্ণবয়স্ক গাছ থেকে আসে। তাই শহরের প্রতিটি সড়কপাশ, আইল্যান্ড, পার্ক এবং বাসার খোলা জায়গায় গাছ লাগাতে হবে। নাগরিক উদ্যোগে ছাদবাগান সম্প্রসারণে করছাড়, প্রণোদনা ও প্রশিক্ষণ চালু করা উচিত।
নির্মাণকাজে বাধ্যতামূলকভাবে নেট বা পর্দা দিয়ে ঘেরা, সাইটে পানি ছিটানো, নির্মাণসামগ্রী ঢাকা রাখা। ইটভাটা আধুনিকায়ন ও নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা দরকার। অস্বাস্থ্যকর ভাটা অবিলম্বে বন্ধ করা দরকার।
বায়ুদূষণ একক কোনো সমস্যা নয়; এটি একটি বহুস্তরীয় সংকট, যা পরিবেশ, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। উন্নয়ন যদি মানবিকতা বিসর্জন দিয়ে হয়, তবে তা কেবল স্থাপনা নয়, ধ্বংস ডেকে আনে। ঢাকার বাতাস প্রতিনিয়ত মৃত্যুর দূত হয়ে উঠছে। এখনই পদক্ষেপ না নিলে একটি প্রজন্ম শুধু শ্বাসকষ্টেই নয়, ভবিষ্যৎহীনতার বেদনায়ও ধুঁকবে।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]