রেজাউল করিম খোকন
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কাঠামোগত হস্তক্ষেপের উদ্যোগ হিসেবে পাঁচটি শরিয়াহভিত্তিক বেসরকারি ব্যাংককে একীভূত করে একটি বৃহৎ ইসলামী ব্যাংক গঠনের পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই পাঁচটি ব্যাংক হলোÑ ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংক। অর্থনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত এ পাঁচ প্রতিষ্ঠান একীভূত হয়ে একটি ‘নতুন’ ব্যাংকে রূপ নেবে, যেখানে প্রাথমিক মূলধন জোগান দেবে সরকার এবং পরে যুক্ত হবে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীরাও।
এই প্রক্রিয়াকে কেউ দেখছেন অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে, কেউ দেখছেন রাজনৈতিক অর্থনীতির পরিণত ঘূর্ণাবর্ত হিসেবেÑ যেখানে সংস্কারের চেয়ে দায়মুক্তির পথটাই সহজতর। প্রশ্ন উঠছে, একীভূতকরণের এই প্রক্রিয়া কতটা আর্থিক স্থিতিশীলতা আনবে, আর কতটা রাজনৈতিক ও আর্থিক দায় আড়াল করবে?
বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে একীভূতকরণ প্রক্রিয়া তিন বছর মেয়াদে সম্পন্ন হওয়ার কথা। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক পাঁচ ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের ডেকে একীভূতকরণের রূপরেখা দিয়েছে। নতুন ব্যাংকের অধীনে পুরোনো ব্যাংকগুলোর আমানত, সম্পদ, দায় ও শাখা কার্যক্রম স্থানান্তরিত হবে। শুরুতে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় থাকবে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি পৃথক কমিটি এবং পরবর্তীতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের হাতে শেয়ার হস্তান্তরের মাধ্যমে নতুন ব্যাংকটি পুরোপুরি বেসরকারি মালিকানায় যাবে।
বর্তমানে পাঁচ ব্যাংকের সম্মিলিত শাখা সংখ্যা ৭৭৯টি, উপশাখা ৬৯৮টি, এজেন্ট ৫০০ ও এটিএম বুথ ১ হাজারের বেশি। জনবল রয়েছে প্রায় ১৫ হাজার, গ্রাহকসংখ্যা ৯২ লাখ। আমানত প্রায় ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা হলেও ঋণ বিতরণ করা হয়েছে প্রায় ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। এই বিশাল ঋণ ব্যবধান ঘাটতি নয়, বরং মূলত ‘নিজেদের লোকদের’ অস্বাভাবিক ঋণ প্রদানের ফল। বিশেষ করে গ্লোবাল ও ইউনিয়ন ব্যাংকের ৯০ শতাংশ ঋণ এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে; ফার্স্ট সিকিউরিটির ৭০ শতাংশ এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ২০ শতাংশ ঋণও এই গ্রুপের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এক্সিম ব্যাংকের ১০ শতাংশ ঋণ সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট।
উল্লেখ্য যে, এই ব্যাংকগুলোর মালিকানায় রয়েছে আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর এস আলম গ্রুপ ও নজরুল ইসলাম মজুমদারের মতো ব্যবসায়ীরা ব্যাংকগুলোতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। সিস্টেমেটিক ব্যাংক লুটের উদাহরণ হিসেবে এই ব্যাংকগুলো বারবার আলোচিত হয়েছে। লভ্যাংশ ছাড়াই কয়েক বছরের ব্যবধানে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ ‘গ্রুপ এক্সপোজার’ সীমা লঙ্ঘন করে নেওয়া হয়েছে; কিন্তু তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের নীরবতা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। এখন যখন রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে, তখন সেই লুণ্ঠিত ব্যাংকগুলোকে একীভূত করে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় আবার ‘শুদ্ধি’ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
একটি প্রশ্ন জাগেÑ এতদিন বাংলাদেশ ব্যাংক কি কিছুই জানত না? নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকি ব্যর্থতার দায় কে নেবে? যারা এসব ব্যাংককে এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়েই যদি নতুনভাবে ‘ব্যবস্থাপনায়’ সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে তা কি দায়মুক্তির অন্য নাম নয়?
ব্যাংক একীভূতকরণ সংক্রান্ত নীতিমালায় বলা হয়েছে, খারাপ ব্যাংকের পরিচালকেরা পাঁচ বছর পর নতুন ব্যাংকের পর্ষদে ফিরতে পারবেন, কিছু শর্তে। এ বিধান মূলত তাঁদের জন্য একপ্রকার সময়িক ছুটিÑশাস্তি নয়। বরং অনেকে একে পুরস্কার বলেই দেখছেন। বাস্তবিক অর্থে এটা এমন একটি বার্তা: আপনি ব্যাংক লুট করলেও পরে সুযোগ পাবেন আবার ফিরে আসার।
নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, একীভূত ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তিন বছরের মধ্যে ছাঁটাই করা যাবে না এবং তাদের বেতন-সুবিধাও অপরিবর্তিত থাকবে। ভালো ব্যাংকের কর্মীরা যেখানে প্রতি বছর পারফরম্যান্স মূল্যায়নের মুখে পড়েন, সেখানে দুর্বল বা অদক্ষ ব্যাংকের কর্মীদের জন্য গ্যারান্টিÑ এটা একধরনের প্রতিষ্ঠানিক বৈষম্য সৃষ্টি করছে।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এই নীতিমালার মাধ্যমে ভালো ব্যাংকের সংস্কৃতি দুর্বল ব্যাংকের দ্বারা আক্রান্ত হবে। এতে দীর্ঘমেয়াদে ‘মরাল হ্যাজার্ড’ তৈরি হবে। যে ব্যবস্থাপনায় লুণ্ঠন সম্ভব হয়, সেই ব্যবস্থাকে পুরস্কৃত করলে ভবিষ্যতে দুর্নীতি আরও উৎসাহ পাবে।
বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ইতোমধ্যে পরামর্শ দিয়েছেÑ এই একীভূতকরণ প্রক্রিয়া যেন আন্তর্জাতিক মানদ- ও প্রাতিষ্ঠানিক নীতিনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। তারা বলেছে, একীভূতকরণের আগে সম্পদের মান যাচাই, রিয়েল অডিট ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি। অথচ বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত এসব ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ হয়নি। এমনকি রেটিং এজেন্সির মূল্যায়নও সামনে আনা হয়নি।
পশ্চিমা দুনিয়ায় ব্যাংক পতনের ঘটনা হরহামেশা ঘটে। যেমন- ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর যুক্তরাষ্ট্রে শুধু ২০১০ সালেই ১৫৭টি ব্যাংক দেউলিয়া হয়; কিন্তু সেখানে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, নতুন ব্যবস্থাপনা ও তদারকি জোরদার করা হয়। আমাদের দেশে দায়ী ব্যক্তিরা রাজনীতি ও পুঁজির জোরে আবার ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ফিরে আসেন। এ ব্যবস্থায় কি আর্থিক খাতকে সত্যিকার অর্থে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব?
নতুন একটি বড় ইসলামী ব্যাংক গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা আনতে চাচ্ছেÑ এটা ইতিবাচক। যদি এটি সফল হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক লেনদেন, বৈদেশিক বাণিজ্যে ব্যাংকটির অবস্থান মজবুত হতে পারে। এছাড়া এসএমই খাতে সহজ শর্তে অর্থায়ন ব্যাংকটির প্রোফাইলকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।
কিন্তু এ সম্ভাবনা তখনই বাস্তব হবে, যখন নীতিনির্ধারকরা বাস্তবমুখী সংস্কার, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ভিত্তিতে এই ব্যাংক পরিচালনার উদ্যোগ নেবেন। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, দক্ষ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত একটি একীভূত ব্যাংক দেশের জন্য সম্পদ হতে পারে। কিন্তু যদি দুর্বল ব্যবস্থাপনার মধ্যেই একে ফেলে রাখা হয়, তাহলে এটি হয়ে উঠবে শুধু বড় আকারের একটি নতুন সমস্যা।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই ব্যাংকগুলোর দুর্বলতার জন্য যারা দায়ীÑতারা কি কোনো জবাবদিহির মুখে পড়বে? একীভূত ব্যাংকে আবার তাদের ফিরিয়ে আনার আয়োজন কি প্রাতিষ্ঠানিক ন্যায়বিচারের পরিপন্থি নয়? এই একীভূত ব্যাংক রাজনীতিমুক্ত, দক্ষ ও স্বাধীন পরিচালনার নিশ্চয়তা কিভাবে দেবে? কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেন এতদিন এসব ব্যাংক তদারকি করতে ব্যর্থ হলো? আমানতকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকৃত পরিকল্পনা কী?
বাংলাদেশ ব্যাংক একটি গুরুতর সংকট মোকাবিলায় ‘বড় ব্যাংক’ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এই সিদ্ধান্ত কতটা কার্যকর হবে, তা নির্ভর করবে নীতিনির্ধারকদের সাহস, স্বচ্ছতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। কোনো প্রকৃত সংস্কার ছাড়া কেবল ঢাকঢোল পিটিয়ে ব্যাংক একীভূত করা হলে তা কেবল সাজানো সমাধান হবেÑবিষয়ের মূল শিকড় থেকে পালিয়ে যাওয়ার আরেক উপায়।
আশা করা যায়, এ উদ্যোগটি দায়মুক্তির নয়, বরং অর্থনৈতিক ন্যায়ের পুনরুদ্ধারের পথ খুলে দেবে। নইলে যাদের হাতে ব্যাংকগুলো ধ্বংস হয়েছে, তাদের জন্য নতুন ব্যাংক গঠনের মানে হবেÑ দুর্নীতির ইনস্টিটিউশনাল লিগ্যালাইজেশন।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]
রেজাউল করিম খোকন
শনিবার, ২১ জুন ২০২৫
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কাঠামোগত হস্তক্ষেপের উদ্যোগ হিসেবে পাঁচটি শরিয়াহভিত্তিক বেসরকারি ব্যাংককে একীভূত করে একটি বৃহৎ ইসলামী ব্যাংক গঠনের পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই পাঁচটি ব্যাংক হলোÑ ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংক। অর্থনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত এ পাঁচ প্রতিষ্ঠান একীভূত হয়ে একটি ‘নতুন’ ব্যাংকে রূপ নেবে, যেখানে প্রাথমিক মূলধন জোগান দেবে সরকার এবং পরে যুক্ত হবে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীরাও।
এই প্রক্রিয়াকে কেউ দেখছেন অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে, কেউ দেখছেন রাজনৈতিক অর্থনীতির পরিণত ঘূর্ণাবর্ত হিসেবেÑ যেখানে সংস্কারের চেয়ে দায়মুক্তির পথটাই সহজতর। প্রশ্ন উঠছে, একীভূতকরণের এই প্রক্রিয়া কতটা আর্থিক স্থিতিশীলতা আনবে, আর কতটা রাজনৈতিক ও আর্থিক দায় আড়াল করবে?
বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে একীভূতকরণ প্রক্রিয়া তিন বছর মেয়াদে সম্পন্ন হওয়ার কথা। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক পাঁচ ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের ডেকে একীভূতকরণের রূপরেখা দিয়েছে। নতুন ব্যাংকের অধীনে পুরোনো ব্যাংকগুলোর আমানত, সম্পদ, দায় ও শাখা কার্যক্রম স্থানান্তরিত হবে। শুরুতে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় থাকবে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি পৃথক কমিটি এবং পরবর্তীতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের হাতে শেয়ার হস্তান্তরের মাধ্যমে নতুন ব্যাংকটি পুরোপুরি বেসরকারি মালিকানায় যাবে।
বর্তমানে পাঁচ ব্যাংকের সম্মিলিত শাখা সংখ্যা ৭৭৯টি, উপশাখা ৬৯৮টি, এজেন্ট ৫০০ ও এটিএম বুথ ১ হাজারের বেশি। জনবল রয়েছে প্রায় ১৫ হাজার, গ্রাহকসংখ্যা ৯২ লাখ। আমানত প্রায় ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা হলেও ঋণ বিতরণ করা হয়েছে প্রায় ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। এই বিশাল ঋণ ব্যবধান ঘাটতি নয়, বরং মূলত ‘নিজেদের লোকদের’ অস্বাভাবিক ঋণ প্রদানের ফল। বিশেষ করে গ্লোবাল ও ইউনিয়ন ব্যাংকের ৯০ শতাংশ ঋণ এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে; ফার্স্ট সিকিউরিটির ৭০ শতাংশ এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ২০ শতাংশ ঋণও এই গ্রুপের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এক্সিম ব্যাংকের ১০ শতাংশ ঋণ সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট।
উল্লেখ্য যে, এই ব্যাংকগুলোর মালিকানায় রয়েছে আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর এস আলম গ্রুপ ও নজরুল ইসলাম মজুমদারের মতো ব্যবসায়ীরা ব্যাংকগুলোতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। সিস্টেমেটিক ব্যাংক লুটের উদাহরণ হিসেবে এই ব্যাংকগুলো বারবার আলোচিত হয়েছে। লভ্যাংশ ছাড়াই কয়েক বছরের ব্যবধানে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ ‘গ্রুপ এক্সপোজার’ সীমা লঙ্ঘন করে নেওয়া হয়েছে; কিন্তু তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের নীরবতা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। এখন যখন রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে, তখন সেই লুণ্ঠিত ব্যাংকগুলোকে একীভূত করে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় আবার ‘শুদ্ধি’ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
একটি প্রশ্ন জাগেÑ এতদিন বাংলাদেশ ব্যাংক কি কিছুই জানত না? নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকি ব্যর্থতার দায় কে নেবে? যারা এসব ব্যাংককে এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়েই যদি নতুনভাবে ‘ব্যবস্থাপনায়’ সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে তা কি দায়মুক্তির অন্য নাম নয়?
ব্যাংক একীভূতকরণ সংক্রান্ত নীতিমালায় বলা হয়েছে, খারাপ ব্যাংকের পরিচালকেরা পাঁচ বছর পর নতুন ব্যাংকের পর্ষদে ফিরতে পারবেন, কিছু শর্তে। এ বিধান মূলত তাঁদের জন্য একপ্রকার সময়িক ছুটিÑশাস্তি নয়। বরং অনেকে একে পুরস্কার বলেই দেখছেন। বাস্তবিক অর্থে এটা এমন একটি বার্তা: আপনি ব্যাংক লুট করলেও পরে সুযোগ পাবেন আবার ফিরে আসার।
নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, একীভূত ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তিন বছরের মধ্যে ছাঁটাই করা যাবে না এবং তাদের বেতন-সুবিধাও অপরিবর্তিত থাকবে। ভালো ব্যাংকের কর্মীরা যেখানে প্রতি বছর পারফরম্যান্স মূল্যায়নের মুখে পড়েন, সেখানে দুর্বল বা অদক্ষ ব্যাংকের কর্মীদের জন্য গ্যারান্টিÑ এটা একধরনের প্রতিষ্ঠানিক বৈষম্য সৃষ্টি করছে।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এই নীতিমালার মাধ্যমে ভালো ব্যাংকের সংস্কৃতি দুর্বল ব্যাংকের দ্বারা আক্রান্ত হবে। এতে দীর্ঘমেয়াদে ‘মরাল হ্যাজার্ড’ তৈরি হবে। যে ব্যবস্থাপনায় লুণ্ঠন সম্ভব হয়, সেই ব্যবস্থাকে পুরস্কৃত করলে ভবিষ্যতে দুর্নীতি আরও উৎসাহ পাবে।
বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ইতোমধ্যে পরামর্শ দিয়েছেÑ এই একীভূতকরণ প্রক্রিয়া যেন আন্তর্জাতিক মানদ- ও প্রাতিষ্ঠানিক নীতিনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। তারা বলেছে, একীভূতকরণের আগে সম্পদের মান যাচাই, রিয়েল অডিট ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি। অথচ বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত এসব ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ হয়নি। এমনকি রেটিং এজেন্সির মূল্যায়নও সামনে আনা হয়নি।
পশ্চিমা দুনিয়ায় ব্যাংক পতনের ঘটনা হরহামেশা ঘটে। যেমন- ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর যুক্তরাষ্ট্রে শুধু ২০১০ সালেই ১৫৭টি ব্যাংক দেউলিয়া হয়; কিন্তু সেখানে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, নতুন ব্যবস্থাপনা ও তদারকি জোরদার করা হয়। আমাদের দেশে দায়ী ব্যক্তিরা রাজনীতি ও পুঁজির জোরে আবার ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ফিরে আসেন। এ ব্যবস্থায় কি আর্থিক খাতকে সত্যিকার অর্থে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব?
নতুন একটি বড় ইসলামী ব্যাংক গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা আনতে চাচ্ছেÑ এটা ইতিবাচক। যদি এটি সফল হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক লেনদেন, বৈদেশিক বাণিজ্যে ব্যাংকটির অবস্থান মজবুত হতে পারে। এছাড়া এসএমই খাতে সহজ শর্তে অর্থায়ন ব্যাংকটির প্রোফাইলকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।
কিন্তু এ সম্ভাবনা তখনই বাস্তব হবে, যখন নীতিনির্ধারকরা বাস্তবমুখী সংস্কার, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ভিত্তিতে এই ব্যাংক পরিচালনার উদ্যোগ নেবেন। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, দক্ষ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত একটি একীভূত ব্যাংক দেশের জন্য সম্পদ হতে পারে। কিন্তু যদি দুর্বল ব্যবস্থাপনার মধ্যেই একে ফেলে রাখা হয়, তাহলে এটি হয়ে উঠবে শুধু বড় আকারের একটি নতুন সমস্যা।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই ব্যাংকগুলোর দুর্বলতার জন্য যারা দায়ীÑতারা কি কোনো জবাবদিহির মুখে পড়বে? একীভূত ব্যাংকে আবার তাদের ফিরিয়ে আনার আয়োজন কি প্রাতিষ্ঠানিক ন্যায়বিচারের পরিপন্থি নয়? এই একীভূত ব্যাংক রাজনীতিমুক্ত, দক্ষ ও স্বাধীন পরিচালনার নিশ্চয়তা কিভাবে দেবে? কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেন এতদিন এসব ব্যাংক তদারকি করতে ব্যর্থ হলো? আমানতকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকৃত পরিকল্পনা কী?
বাংলাদেশ ব্যাংক একটি গুরুতর সংকট মোকাবিলায় ‘বড় ব্যাংক’ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এই সিদ্ধান্ত কতটা কার্যকর হবে, তা নির্ভর করবে নীতিনির্ধারকদের সাহস, স্বচ্ছতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। কোনো প্রকৃত সংস্কার ছাড়া কেবল ঢাকঢোল পিটিয়ে ব্যাংক একীভূত করা হলে তা কেবল সাজানো সমাধান হবেÑবিষয়ের মূল শিকড় থেকে পালিয়ে যাওয়ার আরেক উপায়।
আশা করা যায়, এ উদ্যোগটি দায়মুক্তির নয়, বরং অর্থনৈতিক ন্যায়ের পুনরুদ্ধারের পথ খুলে দেবে। নইলে যাদের হাতে ব্যাংকগুলো ধ্বংস হয়েছে, তাদের জন্য নতুন ব্যাংক গঠনের মানে হবেÑ দুর্নীতির ইনস্টিটিউশনাল লিগ্যালাইজেশন।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]