জিয়াউদ্দীন আহমেদ
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি ল-ন সফর করে ফেরত এসেছেন। ল-নে গিয়েছিলেন বাহ্যত ‘কিং চার্লস তৃতীয় হারমনি অ্যাওয়ার্ড ২০২৫’ সম্মাননা গ্রহণ করতে। তার সফরসঙ্গী ছিলেন ৩৯ জন। তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এবং দুদকের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন। দুদকের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অশুভ লক্ষ্যে দুদকের চেয়ারম্যানকে সফরসঙ্গী করা হয়েছে মর্মে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। এগুলো সমালোচকদের একমুখী ভাবনা, অহেতুক বিতর্কের সৃষ্টি করা। সরকারের কথামতো কাজ করাতে কোন প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী প্রধানকে সফরসঙ্গী করার প্রয়োজন হয় না, তারা বিনা টিপসে ক্ষমতাসীন সরকারের আদেশ-নির্দেশ পরিপালনে উন্মুখ থাকেন। আমি তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ছোটখাটো কর্মকর্তা, আর মুন্সীগঞ্জের কামালউদ্দিন আহমেদ ডেপুটি গভর্নর। তার নির্দেশে একজন ব্যক্তির অনুকূলে আমাকে একটি নোটিং লিখে উপস্থাপন করতে হয়েছিল। নোটিংয়ে লিখিত বক্তব্যের সঙ্গে মৌখিকভাবে দ্বিমত করায় তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি আপনাকে নির্দেশ দিয়েছি, কিন্তু আমি কার কাছ থেকে নির্দেশ পেয়েছি তা তো জানেন না।’ কাজটির জন্য অনুরোধ করেছিলেন জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের উপনেতা ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী। ডেপুটি গভর্নর তার কাছে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ ছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকে ডেপুটি গভর্নর নিয়োগে কামালউদ্দিন সাহেবের প্রতি যেন কোনরূপ অন্যায় না হয় তা দেখতে তিনি সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে অনুরোধ করেছিলেন, এই অনুরোধেই তিনি ডেপুটি গভর্নর হয়েছিলেন।
বিচার বিভাগ সম্পর্কে আমার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা জিরো। দ্বিতীয়ত, স্পর্শকাতর বিধায় ধর্ম এবং বিচার বিভাগ নিয়ে মনে কোন প্রশ্ন জাগলেও তা আপনাআপনি মনের ভেতরই মিলিয়ে যায়। কিন্তু দুদক, নির্বাচন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রভৃতি স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে মানুষের ধারণা ভালো নয়। দুদক তাদের বিধি অনুযায়ী স্বাধীনভাবে কাজ করলে প্রতিটি দলীয় সরকারের আমলে বাংলাদেশ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বারবার চিহ্নিত হতো না। তাই প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দুদক চেয়ারম্যানের বিদেশ ভ্রমণে দুদকের স্বাধীনতা ও আনুগত্যের কোন হেরফের হয়েছে বলে মনে হয় না। নির্বাচন কমিশনের প্রধান সম্ভবত কখনো সরকার প্রধানের সঙ্গে বিদেশ সফর করেননি, কিন্তু অধিকাংশ নির্বাচনে তাদের ভূমিকা ছিল সরকারের অনুগত কর্মচারীর মতো। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়ে লিখতে বিব্রত বোধ করি, কারণ আমি নিজেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লোক ছিলাম। কয়েকজন গভর্নর যদি সরকারের অলিখিত আদেশ-নির্দেশ পরিপালনে দাসানুদাস না হতেন তাহলে ব্যাংকিং জগতে এত অরাজকতার সৃষ্টি হতো না।
সফরসঙ্গী আরও দুইজনের কথা উল্লেখ না করলে লেখা অপূর্ণ থেকে যাবে। এই দুইজন হচ্ছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল ইসলাম। বিএনপির এক নেতা ড. খলিলুর রহমানের নাগরিকত্ব নিয়ে সন্দেহ পোষণ করায় ড. খলিলও বলেন, ‘আমাকে যদি আজকে বলা হয়, আপনি বিদেশি নাগরিক। তাহলে তো কালকে তারেক রহমানকে বলা হবে, আপনি বিদেশি নাগরিক’। ড. খলিলুর রহমানের এই কথা বিএনপির পক্ষে হজম করা কঠিন, বিএনপি থেকে দাবি ওঠল, ড. খলিলুর রহমানকে পদত্যাগ করতে হবে। ‘রাজাকার’ নামে খ্যাত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান সংসদে বলেছিলেন, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। কারণ বিএনপি যার পদত্যাগ চাইল তিনিই তারেক রহমানকে লন্ডনে গাড়ি থেকে নামার পর রিসিভ করলেন, হ্যান্ডশেক করলেন, তার সঙ্গে সৌহার্দ পরিবেশে বৈঠক করলেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীও ড. খলিলুর রহমানের পাশে বসে যৌথ বিবৃতির অংশীজন হয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ইতোমধ্যে ‘গণশত্রু’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। কয়েকজন আড্ডাবাজ তরুণ তাকে এই উপাধি দিয়েছে- কথাটি তার মুখে শোনা। তিনি লন্ডন সফরে গিয়ে একটি বেফাঁস কথা বলে ফেঁসে যান। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে ড. ইউনূসের দেখা না হওয়ার একটি যুক্তি দাঁড় করাতে গিয়ে তিনি বলে দিলেন যে, প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার কানাডায় গিয়েছেন। এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সমালোচনার ঝড়। কারণ কিয়ার স্টারমার কানাডায় যাননি, লন্ডনেই ছিলেন। পরে প্রেস সচিব ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বললেন যে, তিনি একজন ব্রিটিশ এমপির কথার উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন মাত্র, এছাড়াও তিনি ‘সম্ভবত’ শব্দটিও উচ্চারণ করেছিলেন। শেখ হাসিনার মতো বেশি কথা বলার রোগে ধরেছে প্রেস সচিব শফিকুল আলমকেও। নিশ্চিত না হয়ে একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান নিয়ে সেই দেশে বসে মিথ্যা তথ্য পরিবেশনের কি খুব দরকার ছিল? সরকার প্রধান যাওয়ার আগে সব সফরসঙ্গীকে যুক্তরাজ্য ও তার প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে লিখিত একটি নোট পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরবরাহ করার কথা। নোটটির মধ্যে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান সম্পর্কেও তথ্য থাকার কথা। কিন্তু কেউ পড়েন না, কারণ সরকারি সফরে অনেকে বিদেশে যান শুধু বাজার করতে। একবার প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সফরসঙ্গী হয়েছিলেন আমার কূটনৈতিক ভাই মহিউদ্দিন আহমেদ, যে দেশে যাচ্ছিলেন সেই দেশ ও সরকারের পরিচিতিমূলক একটি নোট তিনি বিমানে সবাইকে পড়ার জন্য সরবরাহ করেন, কিন্তু জিয়াউর রহমান ছাড়া আর কেউ নোটটি পড়ার গরজ বোধ করেননি।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার প্রয়োজন হলে তা দেশ ত্যাগের আগেই ঠিক করা উচিত ছিল। কোন নির্দিষ্ট এজেন্ডা ছাড়া বৈঠক করার সময় ও আগ্রহ কোন প্রধানমন্ত্রীর থাকার কথা নয়। তাদের সময়ের অনেক মূল্য। নির্ধারিত সময়ের পরে আগমনের কারণে মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ইংরেজ প্রশাসনের এক বড় কর্মকর্তার সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করে দিয়েছিলেন। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাৎক্ষণিক সূচি দিয়ে দেখা করা একটু কঠিন। সম্পর্ক ভালো হলে ভিন্ন কথা। মনে হচ্ছে টিউলিপ সিদ্দিক সম্পর্ক নষ্ট করে দিয়েছে। দেখতে বাচ্চা মনে হলেও ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ওপর তার একটা প্রভাব রয়েছে। ২০১৫ সাল থেকেই টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নির্বাচিত সদস্য। ২০২৪ সালের নির্বাচনে লেবার পার্টি ক্ষমতায় আসার পর টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার মন্ত্রীও হন। প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে টিউলিপ সিদ্দিকের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব। ব্রিটেনে টিউলিপের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ার প্রাক্কালেও প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের স্পষ্ট উক্তি ছিল, ‘টিউলিপের প্রতি আমার আস্থা আছে’। তাই প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে টিউলিপের সাক্ষাতের আবেদন প্রত্যাখ্যান এবং প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সাক্ষাতের অনুরোধ গৃহীত না হওয়ার মধ্যে একটা যোগসূত্র থাকলেও থাকতে পারে।
বিশ্লেষকদের ধারণা, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করাই ড. ইউনূসের লন্ডন সফরের মূল লক্ষ্য ছিল। পুরস্কার আনতে ৩৯ জনের বিরাট বাহিনী নিয়ে ড. ইউনূসের লন্ডন যাওয়ার দরকার ছিল না, তার তরফ থেকে যে কোন একজন উপযুক্ত প্রতিনিধি গিয়ে এই পুরস্কার নিয়ে আসতে পারতেন। কারণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হওয়ার পর এই পুরস্কার ড. ইউনূসের জন্য খুব বেশি গুরুত্ব বহন করে না। কিন্তু তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করা ছিল ‘ফরজ’। কারণ আওয়ামী লীগবিহীন নির্বাচনে বিএনপির ক্ষমতায় আসা যে নিশ্চিত তা ড. ইউনূস ইতোমধ্যে বুঝে গেছেন। তাই নির্বাচনের আগে দেশের ‘ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে একটা সমঝোতার অপরিহার্যতা অনুভূত হওয়া স্বাভাবিক। এই সফর থেকে আরেকটি মেসেজ দেয়া হয়েছে জামায়াতে ইসলাম এবং জাতীয় নাগরিক পার্টিকে। এই দুটি দল ইতোমধ্যে বুঝে গেছে যে, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তাদের গুরুত্ব আগের মতো আর নেই, সরকারের টিকে থাকা এবং ঝামেলামুক্ত এক্সিটের জন্য বিএনপির প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য ও বিকল্পহীন। এই সফরে আরেকটি মেসেজ গেছে ভোটারদের কাছে, ভোট দিতে হবে বিএনপিকেই। বিএনপির সন্ত্রাসী কর্মকা- ও চাঁদাবাজি এক লহমায় মুছে গেল। তারেক রহমানের মুখের হাসি দেখেই অন্তর্বর্তী সরকারের সব সদস্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সম্ভবত বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ’। ক্ষমতার অবসায়নেও আর ভয় নেই। বিএনপির নেতাকর্মীরাও খুশি।
তবে খেলতে গেলে ট্রাম্পকার্ড লাগে। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্ত তারেক রহমানের খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষকে আপিলের অনুমতি দিয়েছেন আপিল বিভাগ এবং পহেলা জুলাইতে আপিল শুনানির জন্য দিন ধার্য করা হয়েছে। ট্রাম্পকার্ডের খেলাটা কোথায়? জিয়াউর রহমান নিজে সৎ ছিলেন, কিন্তু তার প্রতিদ্বন্দ্বী অন্যদের দুর্নীতি করার সুযোগ দিতেন। ঘুষখোর এবং দুর্নীতিবাজ প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করলেই তাকে গোপনে তার দুর্নীতির নথি পড়তে দিতেন। একই কাজ নাকি এরশাদ সাহেবও করতেন। রাজনীতিতে এই চাণক্যনীতি এখনো বহাল তবিয়তে আছে। তাই ড. ইউনূসের এই সফরের সফলতার পরিমাণ তার দশ মাস মেয়াদের এগারোটি বিদেশ সফরে অর্জিত সফলতার চেয়েও বেশি। তিনি কোন্ বিমানে গেলেন, বিমানবন্দরে কে রিসিভ করল, ৩৭টি কক্ষে ৩৯ জন কিভাবে থাকলেন, কত ব্যয়বহুল হোটেল বুকিং দিলেন, আওয়ামী লীগ কী পরিমাণ বিক্ষোভ দেখাল, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার দেখা করল কী করল না, পুরস্কারের সঙ্গে রাজপরিবারের সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক, পুরস্কার রাজা অথবা অখ্যাত নারীর হাত থেকে আসুক- এগুলো বিবেচ্য বিষয় নয়, বিবেচ্য বিষয় নয় নির্বাচনের দিন তারিখও। বিবেচ্য বিষয় কী? চলুন একটু কল্পনা করি।
কল্পনায় তাদের দুজনের আলাপের আলোচ্য বিষয় কেন জানি বারবার আওয়ামী লীগবিহীন নির্বাচনের কথাই ভেসে ওঠে। সম্ভবত ড. ইউনূস এবং বিএনপি উভয়ই চাচ্ছে শুধু একটি সংস্কার-আওয়ামী লীগ শূন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সংস্কার। বিএনপি চাচ্ছে এই সংস্কারটি ড. ইউনূসের হাতেই হোক। আর অন্তর্বর্তী সরকার চাচ্ছে আওয়ামী লীগ নির্মূলের এই সংস্কার নির্বাচনোত্তর কালেও অনবচ্ছিন্ন থাকুক। নির্বাচনের পরে এই সংস্কার অব্যাহত রাখবে বিএনপি। ঐকমত্যের এই আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের সঙ্গে আমরাও উদ্বেলিত, আমরাও সফল, আমরাও পেতে যাচ্ছি নতুন বাংলাদেশে পুরাতন রাজনীতি আর স্বৈরশাসনের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা। তবে কল্পনা তো কল্পনাই।
[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ]
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
শনিবার, ২১ জুন ২০২৫
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি ল-ন সফর করে ফেরত এসেছেন। ল-নে গিয়েছিলেন বাহ্যত ‘কিং চার্লস তৃতীয় হারমনি অ্যাওয়ার্ড ২০২৫’ সম্মাননা গ্রহণ করতে। তার সফরসঙ্গী ছিলেন ৩৯ জন। তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এবং দুদকের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন। দুদকের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অশুভ লক্ষ্যে দুদকের চেয়ারম্যানকে সফরসঙ্গী করা হয়েছে মর্মে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। এগুলো সমালোচকদের একমুখী ভাবনা, অহেতুক বিতর্কের সৃষ্টি করা। সরকারের কথামতো কাজ করাতে কোন প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী প্রধানকে সফরসঙ্গী করার প্রয়োজন হয় না, তারা বিনা টিপসে ক্ষমতাসীন সরকারের আদেশ-নির্দেশ পরিপালনে উন্মুখ থাকেন। আমি তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ছোটখাটো কর্মকর্তা, আর মুন্সীগঞ্জের কামালউদ্দিন আহমেদ ডেপুটি গভর্নর। তার নির্দেশে একজন ব্যক্তির অনুকূলে আমাকে একটি নোটিং লিখে উপস্থাপন করতে হয়েছিল। নোটিংয়ে লিখিত বক্তব্যের সঙ্গে মৌখিকভাবে দ্বিমত করায় তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি আপনাকে নির্দেশ দিয়েছি, কিন্তু আমি কার কাছ থেকে নির্দেশ পেয়েছি তা তো জানেন না।’ কাজটির জন্য অনুরোধ করেছিলেন জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের উপনেতা ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী। ডেপুটি গভর্নর তার কাছে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ ছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকে ডেপুটি গভর্নর নিয়োগে কামালউদ্দিন সাহেবের প্রতি যেন কোনরূপ অন্যায় না হয় তা দেখতে তিনি সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে অনুরোধ করেছিলেন, এই অনুরোধেই তিনি ডেপুটি গভর্নর হয়েছিলেন।
বিচার বিভাগ সম্পর্কে আমার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা জিরো। দ্বিতীয়ত, স্পর্শকাতর বিধায় ধর্ম এবং বিচার বিভাগ নিয়ে মনে কোন প্রশ্ন জাগলেও তা আপনাআপনি মনের ভেতরই মিলিয়ে যায়। কিন্তু দুদক, নির্বাচন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রভৃতি স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে মানুষের ধারণা ভালো নয়। দুদক তাদের বিধি অনুযায়ী স্বাধীনভাবে কাজ করলে প্রতিটি দলীয় সরকারের আমলে বাংলাদেশ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বারবার চিহ্নিত হতো না। তাই প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দুদক চেয়ারম্যানের বিদেশ ভ্রমণে দুদকের স্বাধীনতা ও আনুগত্যের কোন হেরফের হয়েছে বলে মনে হয় না। নির্বাচন কমিশনের প্রধান সম্ভবত কখনো সরকার প্রধানের সঙ্গে বিদেশ সফর করেননি, কিন্তু অধিকাংশ নির্বাচনে তাদের ভূমিকা ছিল সরকারের অনুগত কর্মচারীর মতো। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়ে লিখতে বিব্রত বোধ করি, কারণ আমি নিজেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লোক ছিলাম। কয়েকজন গভর্নর যদি সরকারের অলিখিত আদেশ-নির্দেশ পরিপালনে দাসানুদাস না হতেন তাহলে ব্যাংকিং জগতে এত অরাজকতার সৃষ্টি হতো না।
সফরসঙ্গী আরও দুইজনের কথা উল্লেখ না করলে লেখা অপূর্ণ থেকে যাবে। এই দুইজন হচ্ছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল ইসলাম। বিএনপির এক নেতা ড. খলিলুর রহমানের নাগরিকত্ব নিয়ে সন্দেহ পোষণ করায় ড. খলিলও বলেন, ‘আমাকে যদি আজকে বলা হয়, আপনি বিদেশি নাগরিক। তাহলে তো কালকে তারেক রহমানকে বলা হবে, আপনি বিদেশি নাগরিক’। ড. খলিলুর রহমানের এই কথা বিএনপির পক্ষে হজম করা কঠিন, বিএনপি থেকে দাবি ওঠল, ড. খলিলুর রহমানকে পদত্যাগ করতে হবে। ‘রাজাকার’ নামে খ্যাত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান সংসদে বলেছিলেন, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। কারণ বিএনপি যার পদত্যাগ চাইল তিনিই তারেক রহমানকে লন্ডনে গাড়ি থেকে নামার পর রিসিভ করলেন, হ্যান্ডশেক করলেন, তার সঙ্গে সৌহার্দ পরিবেশে বৈঠক করলেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীও ড. খলিলুর রহমানের পাশে বসে যৌথ বিবৃতির অংশীজন হয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ইতোমধ্যে ‘গণশত্রু’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। কয়েকজন আড্ডাবাজ তরুণ তাকে এই উপাধি দিয়েছে- কথাটি তার মুখে শোনা। তিনি লন্ডন সফরে গিয়ে একটি বেফাঁস কথা বলে ফেঁসে যান। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে ড. ইউনূসের দেখা না হওয়ার একটি যুক্তি দাঁড় করাতে গিয়ে তিনি বলে দিলেন যে, প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার কানাডায় গিয়েছেন। এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সমালোচনার ঝড়। কারণ কিয়ার স্টারমার কানাডায় যাননি, লন্ডনেই ছিলেন। পরে প্রেস সচিব ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বললেন যে, তিনি একজন ব্রিটিশ এমপির কথার উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন মাত্র, এছাড়াও তিনি ‘সম্ভবত’ শব্দটিও উচ্চারণ করেছিলেন। শেখ হাসিনার মতো বেশি কথা বলার রোগে ধরেছে প্রেস সচিব শফিকুল আলমকেও। নিশ্চিত না হয়ে একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান নিয়ে সেই দেশে বসে মিথ্যা তথ্য পরিবেশনের কি খুব দরকার ছিল? সরকার প্রধান যাওয়ার আগে সব সফরসঙ্গীকে যুক্তরাজ্য ও তার প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে লিখিত একটি নোট পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরবরাহ করার কথা। নোটটির মধ্যে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান সম্পর্কেও তথ্য থাকার কথা। কিন্তু কেউ পড়েন না, কারণ সরকারি সফরে অনেকে বিদেশে যান শুধু বাজার করতে। একবার প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সফরসঙ্গী হয়েছিলেন আমার কূটনৈতিক ভাই মহিউদ্দিন আহমেদ, যে দেশে যাচ্ছিলেন সেই দেশ ও সরকারের পরিচিতিমূলক একটি নোট তিনি বিমানে সবাইকে পড়ার জন্য সরবরাহ করেন, কিন্তু জিয়াউর রহমান ছাড়া আর কেউ নোটটি পড়ার গরজ বোধ করেননি।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার প্রয়োজন হলে তা দেশ ত্যাগের আগেই ঠিক করা উচিত ছিল। কোন নির্দিষ্ট এজেন্ডা ছাড়া বৈঠক করার সময় ও আগ্রহ কোন প্রধানমন্ত্রীর থাকার কথা নয়। তাদের সময়ের অনেক মূল্য। নির্ধারিত সময়ের পরে আগমনের কারণে মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ইংরেজ প্রশাসনের এক বড় কর্মকর্তার সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করে দিয়েছিলেন। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাৎক্ষণিক সূচি দিয়ে দেখা করা একটু কঠিন। সম্পর্ক ভালো হলে ভিন্ন কথা। মনে হচ্ছে টিউলিপ সিদ্দিক সম্পর্ক নষ্ট করে দিয়েছে। দেখতে বাচ্চা মনে হলেও ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ওপর তার একটা প্রভাব রয়েছে। ২০১৫ সাল থেকেই টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নির্বাচিত সদস্য। ২০২৪ সালের নির্বাচনে লেবার পার্টি ক্ষমতায় আসার পর টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার মন্ত্রীও হন। প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে টিউলিপ সিদ্দিকের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব। ব্রিটেনে টিউলিপের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ার প্রাক্কালেও প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের স্পষ্ট উক্তি ছিল, ‘টিউলিপের প্রতি আমার আস্থা আছে’। তাই প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে টিউলিপের সাক্ষাতের আবেদন প্রত্যাখ্যান এবং প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সাক্ষাতের অনুরোধ গৃহীত না হওয়ার মধ্যে একটা যোগসূত্র থাকলেও থাকতে পারে।
বিশ্লেষকদের ধারণা, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করাই ড. ইউনূসের লন্ডন সফরের মূল লক্ষ্য ছিল। পুরস্কার আনতে ৩৯ জনের বিরাট বাহিনী নিয়ে ড. ইউনূসের লন্ডন যাওয়ার দরকার ছিল না, তার তরফ থেকে যে কোন একজন উপযুক্ত প্রতিনিধি গিয়ে এই পুরস্কার নিয়ে আসতে পারতেন। কারণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হওয়ার পর এই পুরস্কার ড. ইউনূসের জন্য খুব বেশি গুরুত্ব বহন করে না। কিন্তু তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করা ছিল ‘ফরজ’। কারণ আওয়ামী লীগবিহীন নির্বাচনে বিএনপির ক্ষমতায় আসা যে নিশ্চিত তা ড. ইউনূস ইতোমধ্যে বুঝে গেছেন। তাই নির্বাচনের আগে দেশের ‘ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে একটা সমঝোতার অপরিহার্যতা অনুভূত হওয়া স্বাভাবিক। এই সফর থেকে আরেকটি মেসেজ দেয়া হয়েছে জামায়াতে ইসলাম এবং জাতীয় নাগরিক পার্টিকে। এই দুটি দল ইতোমধ্যে বুঝে গেছে যে, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তাদের গুরুত্ব আগের মতো আর নেই, সরকারের টিকে থাকা এবং ঝামেলামুক্ত এক্সিটের জন্য বিএনপির প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য ও বিকল্পহীন। এই সফরে আরেকটি মেসেজ গেছে ভোটারদের কাছে, ভোট দিতে হবে বিএনপিকেই। বিএনপির সন্ত্রাসী কর্মকা- ও চাঁদাবাজি এক লহমায় মুছে গেল। তারেক রহমানের মুখের হাসি দেখেই অন্তর্বর্তী সরকারের সব সদস্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সম্ভবত বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ’। ক্ষমতার অবসায়নেও আর ভয় নেই। বিএনপির নেতাকর্মীরাও খুশি।
তবে খেলতে গেলে ট্রাম্পকার্ড লাগে। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্ত তারেক রহমানের খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষকে আপিলের অনুমতি দিয়েছেন আপিল বিভাগ এবং পহেলা জুলাইতে আপিল শুনানির জন্য দিন ধার্য করা হয়েছে। ট্রাম্পকার্ডের খেলাটা কোথায়? জিয়াউর রহমান নিজে সৎ ছিলেন, কিন্তু তার প্রতিদ্বন্দ্বী অন্যদের দুর্নীতি করার সুযোগ দিতেন। ঘুষখোর এবং দুর্নীতিবাজ প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করলেই তাকে গোপনে তার দুর্নীতির নথি পড়তে দিতেন। একই কাজ নাকি এরশাদ সাহেবও করতেন। রাজনীতিতে এই চাণক্যনীতি এখনো বহাল তবিয়তে আছে। তাই ড. ইউনূসের এই সফরের সফলতার পরিমাণ তার দশ মাস মেয়াদের এগারোটি বিদেশ সফরে অর্জিত সফলতার চেয়েও বেশি। তিনি কোন্ বিমানে গেলেন, বিমানবন্দরে কে রিসিভ করল, ৩৭টি কক্ষে ৩৯ জন কিভাবে থাকলেন, কত ব্যয়বহুল হোটেল বুকিং দিলেন, আওয়ামী লীগ কী পরিমাণ বিক্ষোভ দেখাল, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার দেখা করল কী করল না, পুরস্কারের সঙ্গে রাজপরিবারের সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক, পুরস্কার রাজা অথবা অখ্যাত নারীর হাত থেকে আসুক- এগুলো বিবেচ্য বিষয় নয়, বিবেচ্য বিষয় নয় নির্বাচনের দিন তারিখও। বিবেচ্য বিষয় কী? চলুন একটু কল্পনা করি।
কল্পনায় তাদের দুজনের আলাপের আলোচ্য বিষয় কেন জানি বারবার আওয়ামী লীগবিহীন নির্বাচনের কথাই ভেসে ওঠে। সম্ভবত ড. ইউনূস এবং বিএনপি উভয়ই চাচ্ছে শুধু একটি সংস্কার-আওয়ামী লীগ শূন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সংস্কার। বিএনপি চাচ্ছে এই সংস্কারটি ড. ইউনূসের হাতেই হোক। আর অন্তর্বর্তী সরকার চাচ্ছে আওয়ামী লীগ নির্মূলের এই সংস্কার নির্বাচনোত্তর কালেও অনবচ্ছিন্ন থাকুক। নির্বাচনের পরে এই সংস্কার অব্যাহত রাখবে বিএনপি। ঐকমত্যের এই আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের সঙ্গে আমরাও উদ্বেলিত, আমরাও সফল, আমরাও পেতে যাচ্ছি নতুন বাংলাদেশে পুরাতন রাজনীতি আর স্বৈরশাসনের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা। তবে কল্পনা তো কল্পনাই।
[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ]