alt

উপ-সম্পাদকীয়

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

সুদীপ্ত শামীম

: শনিবার, ২১ জুন ২০২৫

তিস্তা নদীর বুক চিরে গড়ে ওঠা চরগুলো যেন প্রকৃতির এক বিচিত্র খেয়ালের প্রতিচিত্র। কোথাও বিস্তীর্ণ ধানখেত, কোথাও সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ, কোথাও আবার কেবল বালুর স্তূপÑচারপাশে নদীর জলরাশি আর এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতছানি। বছরের বেশিরভাগ সময় চরের মানুষরা দিন কাটায় নিস্তরঙ্গ শান্তির মধ্যে, কিন্তু বর্ষার স্রোতে সেই শান্তি মুহূর্তেই দুঃস্বপ্নে রূপ নেয়।

তিস্তার চর : জীবন যেখানে যুদ্ধ : তিস্তার চরাঞ্চল মানেই এক অনিশ্চিত জীবনযুদ্ধ। নদীর খেয়ালে কখনো নতুন চর জাগে, আবার কখনো চোখের পলকে পুরো গ্রাম নদীতে হারিয়ে যায়। এই ভাঙনের ভয় নিয়েই বছরের পর বছর বেঁচে থাকে চরের মানুষ। তবু তারা টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যায়, নতুন করে সব গড়ে তোলার সংকল্প নেয়। প্রবীণ হাজি করিম উদ্দিন একদিন বলেছিলেন, ‘এই নদী আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, আবার কখনো সব কেড়ে নেয়। তবু আমরা এখানেই রয়ে গেছি, নদীর মতোই ভাঙি, গড়ি, আবার বাঁচার চেষ্টা করি।’ তার কণ্ঠে ছিল হারানোর বেদনা, কিন্তু হাল ছাড়ার মনোভাব নয়।

তিস্তা মহাপরিকল্পনা : প্রতিশ্রুতি না বাস্তবতা? : তিস্তা নদীর ভয়াবহ ভাঙন ঠেকাতে এবং চরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’র কথা বহুবার শোনা গেছে। প্রতিবার বর্ষার আগে নতুন করে প্রতিশ্রুতি আসেÑতিস্তার ভাঙন রোধে মেগা প্রকল্প হবে, নদীর গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করা হবে, বাঁধ নির্মাণ হবে। কিন্তু বছরের পর বছর চলে যায়, প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি হয় সামান্যই। চরবাসীর স্বপ্ন ছিল, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে তাদের দুর্দশার অবসান হবে। তারা ভাবতে শুরু করেছিলÑহয়তো এবার ভাঙন থামবে, হয়তো এবার আর ফসলি জমি হারাতে হবে না, হয়তো এবার আর উদ্বাস্তু হতে হবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কাগজে-কলমে মহাপরিকল্পনা থাকলেও চরের মানুষের জীবনসংগ্রাম কমেনি, বরং প্রতিবার নতুন আশার আলো দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত অন্ধকারেই ফেলে রাখা হয়েছে তাদের।

বর্ষার ভয়ংকর রাতগুলো : চরাঞ্চলের মানুষের কাছে বর্ষার রাত মানেই এক দুঃস্বপ্নের নাম। সারা বছর ধরে একটু একটু করে গড়ে তোলা সংসার যে এক রাতেই বিলীন হয়ে যেতে পারে, সেই আশঙ্কা তাদের ঘুম কেড়ে নেয়। নদীর গর্জন, বাতাসের হাহাকার, আর চারপাশে ভেসে যাওয়া ঘরবাড়ির দৃশ্যÑসব মিলিয়ে এক ভয়াবহ বিভীষিকা। রাত যত গভীর হয়, তত অনিশ্চয়তা বাড়তে থাকে। প্রবীণ হাজি করিম উদ্দিন বলেছিলেন, ‘রাতে কখনো ঘুমাই না বাবা! কখন যে নদী সব নিয়ে যায়, কেউ জানে না। পায়ের নিচের মাটিটা সরে যাচ্ছে কি না, সেটাই বুঝতে পারি না মাঝরাতে।’ মায়েরা সন্তানদের বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে রাখে, যেন নদী সব নিয়ে গেলেও সন্তানটাকে অন্তত বাঁচিয়ে রাখতে পারে।

পুরুষেরা জেগে থাকে, দূর থেকে আসা নদীর গর্জন শুনে আন্দাজ করার চেষ্টা করেÑভাঙন কতটা কাছে এল! সেই ভয়ংকর রাতগুলোতে চরের বাতাস কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে। কোনো কোনো রাতে আশপাশের ঘর থেকে হাহাকারের শব্দ ভেসে আসেÑকারও বসতভিটা নদীর পেটে চলে গেছে, কারও গোয়ালঘর ভেসে গেছে, কেউ আবার পরিবারের সদস্যদের নিয়েই নদীতে তলিয়ে গেছে। সকালে উঠে দেখা যায়, গতরাতে যে ঘরটি ঠিকঠাক ছিল, সেটির অস্তিত্ব নেই। কোথায় গেল সেই ঘর, কোথায় গেল সেই সংসারÑকেউ জানে না। ত্রাণ আর আশ্বাসে এই দুর্দশা কমে না। বছর বছর ধরে একই নাটক চলেÑবর্ষার আগে প্রতিশ্রুতি আসে, ভাঙন শুরু হলে কেউ এসে দেখে, সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু কিছুদিন পর সব ভুলে যায়। চরবাসীর জীবনে প্রকৃত পরিবর্তন আনতে হলে দরকার স্থায়ী সমাধানÑনদীশাসনের কার্যকর ব্যবস্থা, টেকসই বাঁধ নির্মাণ, ও বাস্তবসম্মত পুনর্বাসন পরিকল্পনা। অন্যথায়, বর্ষার রাতগুলো তাদের জন্য চিরদিনের দুঃস্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে।

চরের মানুষের কঠিন বাস্তবতা : চরবাসীর জীবন শুধু নদীভাঙনের ভয়েই বিপর্যস্ত নয়, প্রতিদিনের জীবনযাপনেও অসংখ্য সংকট লুকিয়ে আছে। তাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত সংগ্রামের, প্রতিটি পদক্ষেপ কঠিন বাস্তবতার সামনে টিকে থাকার এক যুদ্ধ।

শিক্ষার অভাব : চরের অধিকাংশ শিশু স্কুলে যেতে পারে না। অনেক এলাকায় স্কুল থাকলেও বর্ষাকালে পানিতে তলিয়ে যায়, শুকনো মৌসুমে শিক্ষকরা আসতে চান না। ফলে শিশুরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। অনেক পরিবার শিশুকে পড়াশোনার বদলে কৃষিকাজ বা গৃহস্থালির কাজে লাগাতে বাধ্য হয়।

চিকিৎসার সংকট : চরাঞ্চলে উন্নত চিকিৎসাকেন্দ্র নেই। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্যও মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিতে হয়। জরুরি অবস্থায় নদী পার হয়ে হাসপাতালে পৌঁছাতে গিয়ে অনেক রোগীর মৃত্যু হয়। গর্ভবতী নারীদের জন্য এই সংকট আরও ভয়াবহ।

কর্মসংস্থানের অভাব : কৃষিকাজই চরবাসীর প্রধান জীবিকা, তবে বর্ষাকালে কৃষিকাজ বন্ধ থাকলে তারা শহরমুখী হতে বাধ্য হয়। অনেকে ভ্যান চালানো, দিনমজুরি বা রিকশা চালানোর জন্য শহরে যায়। ফলে চর এলাকায় কর্মসংস্থানের অভাব দিন দিন বাড়ছে।

পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দুরবস্থা : বর্ষাকালে নদী পারাপার হয়ে শহরে যাওয়া অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। নৌকা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই, আর নদীর স্রোত তীব্র হলে নৌপথও বিপজ্জনক হয়ে যায়। বর্ষা শেষে যখন নদীর পানি কমে, তখন কাদা মাড়িয়ে চলতে হয়, ফলে চিকিৎসা ও শিক্ষার সুযোগ আরও সীমিত হয়ে পড়ে।

এই সংকটগুলো নিরসনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও টেকসই উন্নয়ন প্রকল্প প্রয়োজন। শুধু চরবাসীর সংকট নিয়ে আলোচনা করলেই হবে না, কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে তারা নিরাপদ ও সম্মানজনক জীবনযাপনের সুযোগ পায়।

ভবিষ্যতের স্বপ্ন : এই লড়াই কি শেষ হবে? : প্রতিবার যখন তিস্তার চরের কোনো গ্রাম নদীর গহ্বরে হারিয়ে যায়, তখন সেখানে শুধু ঘরবাড়ি নয়, স্বপ্ন, স্মৃতি আর ভালোবাসার গল্পও হারিয়ে যায়। কান্নার শব্দ ভেসে আসে রাতের আঁধারে, সন্তানহারা মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ, স্বপ্নভঙ্গ হওয়া কৃষকের বোবা দীর্ঘশ্বাসÑসব মিশে যায় নদীর গর্জনে। তবু সেই কান্নার মধ্যেও একদিন মানুষ আবার ঘর তোলে, নতুন স্বপ্ন দেখে। মাটির গন্ধে তাদের শেকড় গাঁথা, নদীর পাড়ে তাদের ভালোবাসার বন্ধন। আমি যখন চরের কোনো প্রবীণের সঙ্গে কথা বলি, তারা বলেÑ‘এখান থেকে যাব কোথায়? আমরা নদীর মানুষ, নদীর সঙ্গেই আমাদের জীবন বাঁধা। যতই ভাঙুক, আমরা আবার গড়ব।’

[ লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ]

একটি সফর, একাধিক সংকেত : কে পেল কোন বার্তা?

দেশের কারা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ইসলামী ব্যাংক একীভূতকরণ : আস্থা ফেরাতে সংস্কার, না দায়মুক্তির প্রহসন?

রম্যগদ্য : চাঁদাবাজি চলছে, চলবে

বায়ুদূষণ : নীরব ঘাতক

ইসরায়েলের কৌশলগত ঔদ্ধত্য

পরিবার : সুনাগরিক ও সুশাসক তৈরির ভিত্তিমূল

শিল্পে গ্যাস সংকট : দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিন

আমাদের লড়াইটা আমাদের লড়তে দিন

ব্যাকবেঞ্চারদের পৃথিবী : ব্যর্থতার গায়ে সাফল্যের ছাপ

আমের অ্যানথ্রাকনোজ ও বোঁটা পঁচা রোগ

শিশুদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি : স্কুল ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা ও সংকট

প্রশিক্ষণ থেকে কেন বাদ নারী কৃষকরা?

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

লই গো বুক পেতে অনল-বাণ!

সরকারি হাসপাতালের পরিবেশ

আমেরিকার অলিগার্কি পতনের আখ্যান

রম্যগদ্য : ‘উহু উহু, তোরে মাফ করা যায় না...’

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট : সংকোচন, সংকট ও সম্ভাবনার প্রতিফলন

আম রপ্তানি : বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

ছবি

সামাজিকমাধ্যম গুরুত্বহীন নয়

জমির শ্রেণী চেনার উপায় ও পরিবর্তনের নিয়ম-কানুন

বাংলাদেশ : “রক্তে জন্ম আর পানিতে মরণ”

নতুন নোট, নতুন বিতর্ক

রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের হতাশা ও উপজেলা পর্যায়ের অদক্ষতা : কে নেবে দায়িত্ব?

তরল সম্পর্কের গোলকধাঁধা

পরিবার থেকে রাষ্ট্র : ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের উপায়

বাজেটে বৈষম্য কমানোর কোনো স্পষ্ট প্রতিফলন আছে কি

চোখের নজর কম হলে আর কাজল দিয়ে কী হবে

রম্যগদ্য : ‘নির্বাচন, না নীর-বচন...’

প্লাস্টিক দূষণ নয়, প্রকৃতির পাশে দাঁড়ান

কোরবানির পর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

ত্যাগের মহিমায় ঈদুল আজহা

নাম ও মর্যাদা : অর্থবহ নামকরণে বৈষম্য রোধের আহ্বান

ডিজিটাল পুঁজিবাদের যুগে নগর বাংলাদেশের শ্রেণী কাঠামো

পারিবারিক শিক্ষা ও রাষ্ট্রসংস্কার : ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের পথরেখা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

সুদীপ্ত শামীম

শনিবার, ২১ জুন ২০২৫

তিস্তা নদীর বুক চিরে গড়ে ওঠা চরগুলো যেন প্রকৃতির এক বিচিত্র খেয়ালের প্রতিচিত্র। কোথাও বিস্তীর্ণ ধানখেত, কোথাও সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ, কোথাও আবার কেবল বালুর স্তূপÑচারপাশে নদীর জলরাশি আর এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতছানি। বছরের বেশিরভাগ সময় চরের মানুষরা দিন কাটায় নিস্তরঙ্গ শান্তির মধ্যে, কিন্তু বর্ষার স্রোতে সেই শান্তি মুহূর্তেই দুঃস্বপ্নে রূপ নেয়।

তিস্তার চর : জীবন যেখানে যুদ্ধ : তিস্তার চরাঞ্চল মানেই এক অনিশ্চিত জীবনযুদ্ধ। নদীর খেয়ালে কখনো নতুন চর জাগে, আবার কখনো চোখের পলকে পুরো গ্রাম নদীতে হারিয়ে যায়। এই ভাঙনের ভয় নিয়েই বছরের পর বছর বেঁচে থাকে চরের মানুষ। তবু তারা টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যায়, নতুন করে সব গড়ে তোলার সংকল্প নেয়। প্রবীণ হাজি করিম উদ্দিন একদিন বলেছিলেন, ‘এই নদী আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, আবার কখনো সব কেড়ে নেয়। তবু আমরা এখানেই রয়ে গেছি, নদীর মতোই ভাঙি, গড়ি, আবার বাঁচার চেষ্টা করি।’ তার কণ্ঠে ছিল হারানোর বেদনা, কিন্তু হাল ছাড়ার মনোভাব নয়।

তিস্তা মহাপরিকল্পনা : প্রতিশ্রুতি না বাস্তবতা? : তিস্তা নদীর ভয়াবহ ভাঙন ঠেকাতে এবং চরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’র কথা বহুবার শোনা গেছে। প্রতিবার বর্ষার আগে নতুন করে প্রতিশ্রুতি আসেÑতিস্তার ভাঙন রোধে মেগা প্রকল্প হবে, নদীর গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করা হবে, বাঁধ নির্মাণ হবে। কিন্তু বছরের পর বছর চলে যায়, প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি হয় সামান্যই। চরবাসীর স্বপ্ন ছিল, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে তাদের দুর্দশার অবসান হবে। তারা ভাবতে শুরু করেছিলÑহয়তো এবার ভাঙন থামবে, হয়তো এবার আর ফসলি জমি হারাতে হবে না, হয়তো এবার আর উদ্বাস্তু হতে হবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কাগজে-কলমে মহাপরিকল্পনা থাকলেও চরের মানুষের জীবনসংগ্রাম কমেনি, বরং প্রতিবার নতুন আশার আলো দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত অন্ধকারেই ফেলে রাখা হয়েছে তাদের।

বর্ষার ভয়ংকর রাতগুলো : চরাঞ্চলের মানুষের কাছে বর্ষার রাত মানেই এক দুঃস্বপ্নের নাম। সারা বছর ধরে একটু একটু করে গড়ে তোলা সংসার যে এক রাতেই বিলীন হয়ে যেতে পারে, সেই আশঙ্কা তাদের ঘুম কেড়ে নেয়। নদীর গর্জন, বাতাসের হাহাকার, আর চারপাশে ভেসে যাওয়া ঘরবাড়ির দৃশ্যÑসব মিলিয়ে এক ভয়াবহ বিভীষিকা। রাত যত গভীর হয়, তত অনিশ্চয়তা বাড়তে থাকে। প্রবীণ হাজি করিম উদ্দিন বলেছিলেন, ‘রাতে কখনো ঘুমাই না বাবা! কখন যে নদী সব নিয়ে যায়, কেউ জানে না। পায়ের নিচের মাটিটা সরে যাচ্ছে কি না, সেটাই বুঝতে পারি না মাঝরাতে।’ মায়েরা সন্তানদের বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে রাখে, যেন নদী সব নিয়ে গেলেও সন্তানটাকে অন্তত বাঁচিয়ে রাখতে পারে।

পুরুষেরা জেগে থাকে, দূর থেকে আসা নদীর গর্জন শুনে আন্দাজ করার চেষ্টা করেÑভাঙন কতটা কাছে এল! সেই ভয়ংকর রাতগুলোতে চরের বাতাস কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে। কোনো কোনো রাতে আশপাশের ঘর থেকে হাহাকারের শব্দ ভেসে আসেÑকারও বসতভিটা নদীর পেটে চলে গেছে, কারও গোয়ালঘর ভেসে গেছে, কেউ আবার পরিবারের সদস্যদের নিয়েই নদীতে তলিয়ে গেছে। সকালে উঠে দেখা যায়, গতরাতে যে ঘরটি ঠিকঠাক ছিল, সেটির অস্তিত্ব নেই। কোথায় গেল সেই ঘর, কোথায় গেল সেই সংসারÑকেউ জানে না। ত্রাণ আর আশ্বাসে এই দুর্দশা কমে না। বছর বছর ধরে একই নাটক চলেÑবর্ষার আগে প্রতিশ্রুতি আসে, ভাঙন শুরু হলে কেউ এসে দেখে, সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু কিছুদিন পর সব ভুলে যায়। চরবাসীর জীবনে প্রকৃত পরিবর্তন আনতে হলে দরকার স্থায়ী সমাধানÑনদীশাসনের কার্যকর ব্যবস্থা, টেকসই বাঁধ নির্মাণ, ও বাস্তবসম্মত পুনর্বাসন পরিকল্পনা। অন্যথায়, বর্ষার রাতগুলো তাদের জন্য চিরদিনের দুঃস্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে।

চরের মানুষের কঠিন বাস্তবতা : চরবাসীর জীবন শুধু নদীভাঙনের ভয়েই বিপর্যস্ত নয়, প্রতিদিনের জীবনযাপনেও অসংখ্য সংকট লুকিয়ে আছে। তাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত সংগ্রামের, প্রতিটি পদক্ষেপ কঠিন বাস্তবতার সামনে টিকে থাকার এক যুদ্ধ।

শিক্ষার অভাব : চরের অধিকাংশ শিশু স্কুলে যেতে পারে না। অনেক এলাকায় স্কুল থাকলেও বর্ষাকালে পানিতে তলিয়ে যায়, শুকনো মৌসুমে শিক্ষকরা আসতে চান না। ফলে শিশুরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। অনেক পরিবার শিশুকে পড়াশোনার বদলে কৃষিকাজ বা গৃহস্থালির কাজে লাগাতে বাধ্য হয়।

চিকিৎসার সংকট : চরাঞ্চলে উন্নত চিকিৎসাকেন্দ্র নেই। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্যও মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিতে হয়। জরুরি অবস্থায় নদী পার হয়ে হাসপাতালে পৌঁছাতে গিয়ে অনেক রোগীর মৃত্যু হয়। গর্ভবতী নারীদের জন্য এই সংকট আরও ভয়াবহ।

কর্মসংস্থানের অভাব : কৃষিকাজই চরবাসীর প্রধান জীবিকা, তবে বর্ষাকালে কৃষিকাজ বন্ধ থাকলে তারা শহরমুখী হতে বাধ্য হয়। অনেকে ভ্যান চালানো, দিনমজুরি বা রিকশা চালানোর জন্য শহরে যায়। ফলে চর এলাকায় কর্মসংস্থানের অভাব দিন দিন বাড়ছে।

পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দুরবস্থা : বর্ষাকালে নদী পারাপার হয়ে শহরে যাওয়া অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। নৌকা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই, আর নদীর স্রোত তীব্র হলে নৌপথও বিপজ্জনক হয়ে যায়। বর্ষা শেষে যখন নদীর পানি কমে, তখন কাদা মাড়িয়ে চলতে হয়, ফলে চিকিৎসা ও শিক্ষার সুযোগ আরও সীমিত হয়ে পড়ে।

এই সংকটগুলো নিরসনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও টেকসই উন্নয়ন প্রকল্প প্রয়োজন। শুধু চরবাসীর সংকট নিয়ে আলোচনা করলেই হবে না, কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে তারা নিরাপদ ও সম্মানজনক জীবনযাপনের সুযোগ পায়।

ভবিষ্যতের স্বপ্ন : এই লড়াই কি শেষ হবে? : প্রতিবার যখন তিস্তার চরের কোনো গ্রাম নদীর গহ্বরে হারিয়ে যায়, তখন সেখানে শুধু ঘরবাড়ি নয়, স্বপ্ন, স্মৃতি আর ভালোবাসার গল্পও হারিয়ে যায়। কান্নার শব্দ ভেসে আসে রাতের আঁধারে, সন্তানহারা মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ, স্বপ্নভঙ্গ হওয়া কৃষকের বোবা দীর্ঘশ্বাসÑসব মিশে যায় নদীর গর্জনে। তবু সেই কান্নার মধ্যেও একদিন মানুষ আবার ঘর তোলে, নতুন স্বপ্ন দেখে। মাটির গন্ধে তাদের শেকড় গাঁথা, নদীর পাড়ে তাদের ভালোবাসার বন্ধন। আমি যখন চরের কোনো প্রবীণের সঙ্গে কথা বলি, তারা বলেÑ‘এখান থেকে যাব কোথায়? আমরা নদীর মানুষ, নদীর সঙ্গেই আমাদের জীবন বাঁধা। যতই ভাঙুক, আমরা আবার গড়ব।’

[ লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ]

back to top