সেলিম রানা
দেশের নগর, বন্দর, শিল্প-কারখানা এলাকার রাস্তার পাড়ের বসতবাড়ি ও গ্রামাঞ্চলের ঘরবাড়িÑ সর্বত্রই বর্তমানে মশার উপদ্রব এক মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য মফস্বল শহরে মশার ব্যাপক বিস্তার জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে উঠেছে। মশাবাহিত রোগ যেমন ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া এবং ফাইলেরিয়াসিস প্রতিনিয়ত নাগরিকদের জীবনের ঝুঁকিতে ফেলছে।
সন্ধ্যার পর নগরজীবন কার্যত এক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়, যেখানে মানুষ মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। এমনকি দিনের বেলাতেও মানুষ মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। এর ফলে শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকা- ব্যাহত হচ্ছে। তবে এ সমস্যা দীর্ঘদিনের হলেও বর্তমানে এটি প্রকট আকার ধারণ করছে।
সরকার এবং সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলো মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বললেও বাস্তব পরিস্থিতি ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছে। গবেষণা বলছে, প্রতি বছর মশার ঘনত্ব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর ফলে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে।
সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, রাজধানী ঢাকায় পার ম্যান পার আওয়ার মশার ঘনত্ব ৩০০-এর বেশি, যেখানে গত বছর এটি ২৫-এর নিচে ছিল। অর্থাৎ মশার ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১২ গুণ। এছাড়া মশার লার্ভার ঘনত্ব প্রতি ডিপে (ঘনত্ব পরিমাপের একক) ৮৭-এরও বেশি, যেখানে গত বছরে এটি ছিল ১২ থেকে ১৭টি। গবেষকদের মতে, এই ঘনত্ব ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।
মশার কামড় শুধুমাত্র অস্বস্তিকর নয়, এটি বহুবিধ সংক্রামক রোগের বাহক। ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া, ফাইলেরিয়াসিসের মতো রোগগুলোর সংক্রমণ ব্যাপকভাবে বাড়ছে। বিশেষত, ডেঙ্গুর প্রকোপ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মহামারির আকার ধারণ করেছে।
বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাজার হাজার মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এবং মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
শিশুরা মশার কামড়ের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের তুলনামূলকভাবে কম প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকায় মশার কামড় থেকে অ্যালার্জি, চুলকানি, চামড়ার রোগ, এমনকি মারাত্মক জ্বর দেখা দিতে পারে।
গর্ভবতী নারীদের জন্য মশাবাহিত রোগ বিশেষত বিপজ্জনক। ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গু গর্ভপাত, অকাল প্রসব এবং শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করতে পারে। বয়স্কদের জন্যও মশার কামড় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।
মশাবাহিত রোগের চিকিৎসা ব্যয়, হাসপাতালের চাপ এবং কর্মক্ষমতা হ্রাসÑ এসব কারণে দেশের অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। মশাবাহিত রোগের চিকিৎসার জন্য প্রতি বছর সরকার ও জনগণকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়।
অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে ড্রেন, নর্দমা, খাল-বিল ও জলাশয় অপরিচ্ছন্ন থাকে এবং সেখানে মশার জন্ম হয়। ঢাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং জলাশয় পরিষ্কার না করার ফলে মশার ঘনত্ব বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সিটি করপোরেশন যে কীটনাশক ব্যবহার করছে তা কার্যকর হচ্ছে না। মশা কীটনাশকের প্রতি সহনশীল হয়ে উঠেছে, ফলে নিয়মিত কীটনাশক প্রয়োগ করেও মশা দমন করা সম্ভব হচ্ছে না।
অনেক বাড়ির মালিক নিজেদের বাসস্থান পরিষ্কার রাখলেও আশপাশের পরিবেশ সম্পর্কে উদাসীন থাকেন। বাড়ির আঙিনায় জমে থাকা পানি, পরিত্যক্ত টায়ার, ফুলের টব, ড্রেনের পাশে জমে থাকা পানিতে মশার বংশবৃদ্ধি ঘটে।
সরকারের করণীয় : কার্যকর কীটনাশক নির্ধারণ ও তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা। নিয়মিত ড্রেন ও জলাশয় পরিষ্কার করা। জলাবদ্ধতা দূর করতে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ করা। বিনামূল্যে চিকিৎসা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া।
সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার ভূমিকা : কীটনাশকের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। প্রতিটি ওয়ার্ডে আলাদা পর্যবেক্ষণ টিম গঠন করা। নাগরিকদের সচেতন করতে প্রচারণা চালানো।
জনগণের করণীয় : মশা জন্ম ও বিস্তারের মাধ্যমে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া এবং অন্যান্য মশাবাহিত রোগ ছড়াতে পারে। তাই, জনগণের সচেতনতা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। নিচে মশার বিস্তার রোধে কিছু গুরুত্বপূর্ণ করণীয় তুলে ধরা হলোÑ
বাড়ির আশপাশে জমে থাকা পানি অপসারণ। মশা সাধারণত স্বচ্ছ, স্থির পানিতে ডিম পাড়ে। তাই বাড়ির আশপাশে জমে থাকা পানি দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হবে। ফুলের টব, বালতি, ড্রাম, গামলা, প্লাস্টিক বা কাচের বোতলে পানি জমতে দেওয়া যাবে না।
ফ্রিজ বা এয়ার কন্ডিশনারের নিচে জমে থাকা পানি নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। বাড়ির ছাদ, বারান্দা ও আঙিনার যে কোনো কোণে পানি জমতে দেওয়া যাবে না। ফুলের টব, পরিত্যক্ত টায়ার, ড্রেনের পাশে জমে থাকা পানিতে মশার জন্ম প্রতিরোধ। ফুলের টবে পানি জমে থাকলে তা প্রতিদিন পরিবর্তন করতে হবে।
ব্যবহৃত বা পরিত্যক্ত টায়ার, নারকেলের খোলা, প্লাস্টিকের কৌটা ও পাত্রে পানি জমতে না দেওয়া উচিত। ড্রেন ও জলাশয়ের পানি চলমান রাখতে হবে এবং সেগুলোতে পর্যাপ্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে।
বাগানের গাছপালার পাত্রে মশার জন্ম প্রতিরোধের জন্য বালি বা ছোট পাথর রাখা যেতে পারে।
ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। জানালা ও দরজায় মশার জাল লাগাতে হবে যাতে মশা ঘরে প্রবেশ করতে না পারে। নিয়মিত ফ্লোর, বাথরুম ও রান্নাঘর পরিষ্কার করতে হবে। ঘরের আসবাবপত্র, পর্দা ও অন্যান্য কোণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা উচিত।
কাপড় ও বিছানার চাদর পরিষ্কার রাখা এবং ধুলাবালি কমাতে নিয়মিত ঝাড়– দিতে হবে।
মশা নিয়ন্ত্রণে শুধু রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করলেই হবে না, বরং পরিবেশবান্ধব ও বৈজ্ঞানিক উপায় গ্রহণ করতে হবে। বাড়ির চারপাশে তুলসী, নিম, লেবু ঘাস, গাঁদা ফুলের গাছ লাগানো যেতে পারে, যা মশা প্রতিরোধে কার্যকর। মশার প্রজনন রোধে ব্যাঙ, মাছ (যেমন: গাপ্পি মাছ), এবং ড্রাগনফ্লাই-এর লার্ভা বাড়ানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। নিয়মিত ফগিং বা ধোঁয়া স্প্রে করা যেতে পারে, তবে তা অতিরিক্ত না করাই ভালো, কারণ এতে পরিবেশের ক্ষতি হতে পারে। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে ইলেকট্রনিক মশা ধরার যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে।
মশার উপদ্রব শুধুমাত্র একটি মৌসুমী সমস্যা নয়, এটি বর্তমানে জনস্বাস্থ্যের জন্য এক মহাসংকট। নগর ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, জলাবদ্ধতা, অকার্যকর কীটনাশক প্রয়োগ এবং জনসচেতনতার অভাবে মশার দৌরাত্ম্য বাড়ছে। এ সমস্যার সমাধানে সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
নগরবাসীকে রক্ষায় সিটি করপোরেশন, স্থানীয় প্রশাসন এবং সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এখন সময়ের দাবি। অন্যথায়, মশার উপদ্রব শুধুমাত্র জনস্বাস্থ্যই নয়, অর্থনীতি ও সামগ্রিক জীবনযাত্রাকেও বিপর্যস্ত করে তুলবে।
[লেখক : গণমাধ্যম কর্মী]
সেলিম রানা
সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫
দেশের নগর, বন্দর, শিল্প-কারখানা এলাকার রাস্তার পাড়ের বসতবাড়ি ও গ্রামাঞ্চলের ঘরবাড়িÑ সর্বত্রই বর্তমানে মশার উপদ্রব এক মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য মফস্বল শহরে মশার ব্যাপক বিস্তার জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে উঠেছে। মশাবাহিত রোগ যেমন ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া এবং ফাইলেরিয়াসিস প্রতিনিয়ত নাগরিকদের জীবনের ঝুঁকিতে ফেলছে।
সন্ধ্যার পর নগরজীবন কার্যত এক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়, যেখানে মানুষ মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। এমনকি দিনের বেলাতেও মানুষ মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। এর ফলে শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকা- ব্যাহত হচ্ছে। তবে এ সমস্যা দীর্ঘদিনের হলেও বর্তমানে এটি প্রকট আকার ধারণ করছে।
সরকার এবং সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলো মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বললেও বাস্তব পরিস্থিতি ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছে। গবেষণা বলছে, প্রতি বছর মশার ঘনত্ব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর ফলে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে।
সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, রাজধানী ঢাকায় পার ম্যান পার আওয়ার মশার ঘনত্ব ৩০০-এর বেশি, যেখানে গত বছর এটি ২৫-এর নিচে ছিল। অর্থাৎ মশার ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১২ গুণ। এছাড়া মশার লার্ভার ঘনত্ব প্রতি ডিপে (ঘনত্ব পরিমাপের একক) ৮৭-এরও বেশি, যেখানে গত বছরে এটি ছিল ১২ থেকে ১৭টি। গবেষকদের মতে, এই ঘনত্ব ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।
মশার কামড় শুধুমাত্র অস্বস্তিকর নয়, এটি বহুবিধ সংক্রামক রোগের বাহক। ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া, ফাইলেরিয়াসিসের মতো রোগগুলোর সংক্রমণ ব্যাপকভাবে বাড়ছে। বিশেষত, ডেঙ্গুর প্রকোপ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মহামারির আকার ধারণ করেছে।
বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাজার হাজার মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এবং মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
শিশুরা মশার কামড়ের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের তুলনামূলকভাবে কম প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকায় মশার কামড় থেকে অ্যালার্জি, চুলকানি, চামড়ার রোগ, এমনকি মারাত্মক জ্বর দেখা দিতে পারে।
গর্ভবতী নারীদের জন্য মশাবাহিত রোগ বিশেষত বিপজ্জনক। ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গু গর্ভপাত, অকাল প্রসব এবং শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করতে পারে। বয়স্কদের জন্যও মশার কামড় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।
মশাবাহিত রোগের চিকিৎসা ব্যয়, হাসপাতালের চাপ এবং কর্মক্ষমতা হ্রাসÑ এসব কারণে দেশের অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। মশাবাহিত রোগের চিকিৎসার জন্য প্রতি বছর সরকার ও জনগণকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়।
অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে ড্রেন, নর্দমা, খাল-বিল ও জলাশয় অপরিচ্ছন্ন থাকে এবং সেখানে মশার জন্ম হয়। ঢাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং জলাশয় পরিষ্কার না করার ফলে মশার ঘনত্ব বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সিটি করপোরেশন যে কীটনাশক ব্যবহার করছে তা কার্যকর হচ্ছে না। মশা কীটনাশকের প্রতি সহনশীল হয়ে উঠেছে, ফলে নিয়মিত কীটনাশক প্রয়োগ করেও মশা দমন করা সম্ভব হচ্ছে না।
অনেক বাড়ির মালিক নিজেদের বাসস্থান পরিষ্কার রাখলেও আশপাশের পরিবেশ সম্পর্কে উদাসীন থাকেন। বাড়ির আঙিনায় জমে থাকা পানি, পরিত্যক্ত টায়ার, ফুলের টব, ড্রেনের পাশে জমে থাকা পানিতে মশার বংশবৃদ্ধি ঘটে।
সরকারের করণীয় : কার্যকর কীটনাশক নির্ধারণ ও তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা। নিয়মিত ড্রেন ও জলাশয় পরিষ্কার করা। জলাবদ্ধতা দূর করতে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ করা। বিনামূল্যে চিকিৎসা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া।
সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার ভূমিকা : কীটনাশকের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। প্রতিটি ওয়ার্ডে আলাদা পর্যবেক্ষণ টিম গঠন করা। নাগরিকদের সচেতন করতে প্রচারণা চালানো।
জনগণের করণীয় : মশা জন্ম ও বিস্তারের মাধ্যমে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া এবং অন্যান্য মশাবাহিত রোগ ছড়াতে পারে। তাই, জনগণের সচেতনতা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। নিচে মশার বিস্তার রোধে কিছু গুরুত্বপূর্ণ করণীয় তুলে ধরা হলোÑ
বাড়ির আশপাশে জমে থাকা পানি অপসারণ। মশা সাধারণত স্বচ্ছ, স্থির পানিতে ডিম পাড়ে। তাই বাড়ির আশপাশে জমে থাকা পানি দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হবে। ফুলের টব, বালতি, ড্রাম, গামলা, প্লাস্টিক বা কাচের বোতলে পানি জমতে দেওয়া যাবে না।
ফ্রিজ বা এয়ার কন্ডিশনারের নিচে জমে থাকা পানি নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। বাড়ির ছাদ, বারান্দা ও আঙিনার যে কোনো কোণে পানি জমতে দেওয়া যাবে না। ফুলের টব, পরিত্যক্ত টায়ার, ড্রেনের পাশে জমে থাকা পানিতে মশার জন্ম প্রতিরোধ। ফুলের টবে পানি জমে থাকলে তা প্রতিদিন পরিবর্তন করতে হবে।
ব্যবহৃত বা পরিত্যক্ত টায়ার, নারকেলের খোলা, প্লাস্টিকের কৌটা ও পাত্রে পানি জমতে না দেওয়া উচিত। ড্রেন ও জলাশয়ের পানি চলমান রাখতে হবে এবং সেগুলোতে পর্যাপ্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে।
বাগানের গাছপালার পাত্রে মশার জন্ম প্রতিরোধের জন্য বালি বা ছোট পাথর রাখা যেতে পারে।
ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। জানালা ও দরজায় মশার জাল লাগাতে হবে যাতে মশা ঘরে প্রবেশ করতে না পারে। নিয়মিত ফ্লোর, বাথরুম ও রান্নাঘর পরিষ্কার করতে হবে। ঘরের আসবাবপত্র, পর্দা ও অন্যান্য কোণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা উচিত।
কাপড় ও বিছানার চাদর পরিষ্কার রাখা এবং ধুলাবালি কমাতে নিয়মিত ঝাড়– দিতে হবে।
মশা নিয়ন্ত্রণে শুধু রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করলেই হবে না, বরং পরিবেশবান্ধব ও বৈজ্ঞানিক উপায় গ্রহণ করতে হবে। বাড়ির চারপাশে তুলসী, নিম, লেবু ঘাস, গাঁদা ফুলের গাছ লাগানো যেতে পারে, যা মশা প্রতিরোধে কার্যকর। মশার প্রজনন রোধে ব্যাঙ, মাছ (যেমন: গাপ্পি মাছ), এবং ড্রাগনফ্লাই-এর লার্ভা বাড়ানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। নিয়মিত ফগিং বা ধোঁয়া স্প্রে করা যেতে পারে, তবে তা অতিরিক্ত না করাই ভালো, কারণ এতে পরিবেশের ক্ষতি হতে পারে। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে ইলেকট্রনিক মশা ধরার যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে।
মশার উপদ্রব শুধুমাত্র একটি মৌসুমী সমস্যা নয়, এটি বর্তমানে জনস্বাস্থ্যের জন্য এক মহাসংকট। নগর ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, জলাবদ্ধতা, অকার্যকর কীটনাশক প্রয়োগ এবং জনসচেতনতার অভাবে মশার দৌরাত্ম্য বাড়ছে। এ সমস্যার সমাধানে সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
নগরবাসীকে রক্ষায় সিটি করপোরেশন, স্থানীয় প্রশাসন এবং সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এখন সময়ের দাবি। অন্যথায়, মশার উপদ্রব শুধুমাত্র জনস্বাস্থ্যই নয়, অর্থনীতি ও সামগ্রিক জীবনযাত্রাকেও বিপর্যস্ত করে তুলবে।
[লেখক : গণমাধ্যম কর্মী]