আনোয়ারুল হক
ডাকসুতে বিজয়ীরা রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে
শতবর্ষ প্রাচীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এই প্রথম ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবির বা কোনো ধর্মীয় ছাত্রসংগঠনের সমর্থিত প্যানেল ভিপি, জিএস, এজিএসসহ বেশির ভাগ আসনে নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে। কোনো ধর্মীয় ছাত্র সংগঠন জনপ্রিয়তা পেতেই পারে। কিন্তু দুনিয়ার ইতিহাসে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও তার ছাত্র সংগঠন ছাড়া এমন কোনো ধর্মীয় রাজনৈতিক সংগঠন নেই, যে সংগঠন নিজ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করে দখলদার বাহিনীর পক্ষে সক্রিয় অবস্থান নিয়েছে। স্বাধীন দেশে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সেই ধরনের সংগঠনের বিজয় কিছুটা বিষ্ময়ের ব্যাপার বটে। ডাকসু নির্বাচনে আমরা দেখলাম পুরোনো বা প্রচলিত কোনো হিসাব-নিকাশ কাজ করেনি। আমাদের এই উপমহাদেশেও এ ঘটনা ব্যতিক্রমী। তাইতো সবার আগে জামায়াত ইসলামের পাকিস্তান শাখার আমির হাফিজ নাইমুর রহমান নির্বাচনী ফলাফল বের হওয়ার সাথে সাথেই অতি উৎসাহে ইসলামী ছাত্র শিবিরকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তাদের ছাত্র শাখা ‘ইসলামি জমিয়ত ই তালেবার’ সভাপতি হাসান বিল্লাল হাশমী বার্তা না দিয়ে এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামের আমীরের আগেই সরাসরি পাকিস্তান জামায়াতের আমির অভিনন্দন বার্তা পাঠানোয় মনে সন্দেহ জাগে, এখনই কি হেড কোয়ার্টার লাহোরের মুলতান রোডে!
আবার অন্যদিকে ছাত্র শিবির সমর্থিত প্যানেলের বিজয়ী পুরুষ সদস্যরা তাদেরই পূর্বসূরী ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতৃত্বাধীন আলবদর আলশামস বাহিনীর সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কতৃক মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পূর্বমুহূর্তে দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকা-ের স্মারক রায়েরবাজারের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে গিয়ে দোয়া ও মোনাজাত করে অনেককে টাসকি লাগিয়ে দিয়েছেন। এতকাল তো জামাত শিবির শহীদ এসব বুদ্ধিজীবীদের ‘পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্রে’ ভারতীয় দোসর মনে করতো। এবং সেই ‘অপরাধেই’ তাদের হত্যা করা হয়েছিলো। ছাত্র শিবিরের এ কর্মসূচী পালনে মুলতান রোডস্থ হেডকোয়ার্টারের প্রতিক্রিয়া কী হয় সেটা লক্ষ্য করার বিষয়। অবশ্য শহীদ স্মৃতিসৌধে বিজয়ী কোনো নারীকে নিয়ে তারা যাননি। এমনকি শিবিরকে লিবারেল চেহারাদানকারী নারী প্রার্থীকেও যেতে দেয়া হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক হিসেবে বিজয়ী প্রার্থী কি নারী বলেই তিনি তার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্মসূচিতে থাকতে পারলেন না! তবে এ কর্মসূচি পালন শিবিরের নীতিগত সিদ্ধান্ত বা কৌশল যাই হোক না কেনো সামগ্রিকভাবে এটা একটা ইতিবাচক ঘটনা। এ প্রসঙ্গে পরবর্তীতে আলোচনা করা যাবে।
কথা হচ্ছিল ডাকসু নির্বাচন নিয়ে। হল সংসদের পুরো নির্বাচনী ফলাফলে বিজয়ীদের পরিচয় শুধুমাত্র স্বতন্ত্র হিসেবে থাকায় খুব গভীরে যেয়ে বিশ্লেষণ করা কঠিন। মোটা দাগে ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে মন্তব্য করা যেতে পারে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের নয় মাস ছাড়া পাকিস্তান আমলের ২৫ বছর এবং বাংলাদেশের ৫৪ বছরে জামাত ও ছাত্র সংঘ (পরবর্তী নামকরন ছাত্র শিবির) কখনো গত ১৪ মাসের মত এমন রাষ্ট্রীয় আনুকল্য পায়নি। যে পাকিস্তানের জন্য তাদের এত আফসোস সেই পাকিস্তানের শাসকেরা কিন্তু জামায়াতকে সমাজে ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী হিসেবেই দেখতো। জামায়াত নিজে থেকে পাকিস্তান রক্ষার নামে ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া খানের কাছে ধরা দেয় এবং পূর্ব পাকিস্তানের দখলদার মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে শান্তি বাহিনী ও রাজাকার আলবদর গঠন করে গণহত্যা, সংখ্যালঘু নিধন, নারী ধর্ষণ প্রভৃতি অপরাধে নিজেকে যুক্ত করে। ঐ নয়মাস তারা সরকারের মন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় থাকলেও প্রতি মুহূর্তে ‘মুক্তির’ হাতে নিধনের ভয় ছিলো। সেদিক থেকে বিগত ১৪ মাসের মতো স্বাধীনতা আর ক্ষমতা জামায়াত আর কখনোই পায়নি।
দেশের জন্মযুদ্ধের বিরোধী গোষ্ঠী হিসাবে তারা স্বাধীন দেশে বেআইনি হয়ে যায়। রাজনৈতিক ভারসাম্য নিজের অনুকূলে আনতে জেনারেল জিয়া ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার সুযোগ করে দিলেও এ বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গী ছিলো “ধর্মের অবদান থাকতে পারে রাজনীতিতে, কিন্তু রাজনৈতিক দল ধর্মকে কেন্দ্র করে হতে পারে না”। তাই জামায়াত বা শিবির বাড়াবাড়ি করলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে মাঠে নামিয়ে দেওয়া হতো। খালেদা জিয়া মন্ত্রী সভায় স্থান দিলেও প্রয়োজনে একই পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। তাই কি পাকিস্তান কি বাংলাদেশ কোনো আমলেই জামায়াত একেবারে স্বাধীনভাবে চলতে পারেনি। যুদ্ধাপরাধী হওয়ার কারণে তাদের সবসময় মাথা নীচু করেই থাকতে হয়েছে। এই প্রথম ড. ইউনূস সরকারের আমলে তারা এই ভূখন্ডে শুধু ‘আজাদী’ নয় বিশেষ রাষ্টীয় আনুকূল্য পাচ্ছেন এবং তারা তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করছেন।
ছাত্রশিবির ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে থেকে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন হল, ফ্যাকাল্টি ও আশপাশের বিভিন্ন ছাত্রাবাসে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে। তারা শুধু ছাত্রলীগের আশেপাশে থাকেননি, অনেকেই ছাত্রলীগের কমিটিতেও থেকেছেন, বিশ্বা যোগ্যতা অর্জনের জন্য গণরুম অত্যাচারের সাথে অভিনয় করে হলেও সংশ্লিষ্ট থেকেছেন। তারাসহ আজকের এনসিপির অনেক নেতাও মহাসমারোহে মুজিব শতবর্ষ উদযাপন করেছেন। কারো কারো তো গণভবনেও যাতায়াত ছিলো। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সাথে তাদের ছবি সোশাল মিডিয়ায় এখনও দেখা যায়। শিবিরের এ কৌশলকে অনৈতিক বা দ্বিচারিতা যাই বলা হোক, তাদের কৌশলে তারা বিজয়ী হয়েছে। কোটা আন্দোলনের এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীদের উপর হামলা করে ছাত্র প্রতিরোধের মুখে ছাত্রলীগ ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হয় এবং হলের দখল নিয়ে নেয় ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা ছাত্র শিবির। হলের বাইরে থাকা প্রকাশ্য শিবিরও হলে উঠে পড়ে। হলগুলোতে কায়েম হয় শিবিরের আধিপত্য ও দখলদারিত্ব। দখলদারিত্ব এ অর্থে যে, তারা আওয়াজ তোলে হলে ছাত্র সংগঠনের নামে কোনোরকম কার্যক্রম চলবে না। সাধারণ ছাত্ররা ছাত্ররাজনীতির নামে হলগুলোতে ছাত্রলীগের যে কার্যক্রম দেখেছে এবং বিএনপি আমলে ছাত্রদলের যে কার্যক্রমের গল্প শুনেছে বা জেনেছে তাতে ছাত্র রাজনীতির দলীয় কার্যক্রমমুক্ত হলের পরিবেশের প্রতি তারা সমর্থন জানায়। শিবিরের রাজনৈতিক কার্যক্রম প্রকাশ্য ছিলো না। অপ্রকাশ্য নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ছাত্র শিবির মূলত সাধারণ শিক্ষার্থীদের আর্থিক, পড়ালেখা, চিকিৎসা, কোচিংসহ নানাভাবে সহযোগিতার কাজ করে আসছিল এবং আগের মতোই তা অব্যাহত রাখে। ডাকসু নির্বাচনের প্রস্তুতিও তাদের প্রায় এক বছরের। প্রথাগত ধর্মীয় রাজনীতির বাইরে এসে লিবারেল ধারায় প্যানেল গঠন এবং ধর্মভিত্তিক বক্তব্য না দিয়ে মধ্যপন্থী জায়গা থেকে তারা প্রচার চালিয়েছে। ফলে ছাত্রদের কাছে শিবির কর্মীদের পরিচিতি শিবির হিসাবে নয়, অনেকটা ছাত্রবান্ধব একটা সামাজিক সংগঠন হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় এবং এ ধরনের কর্মকৌশল তাদের জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। একই রকম ফল জাকসুতেও হয়েছে।
অন্যদিকে ছাত্রদল ১৫ বছর যাবত ক্যাম্পাস ছাড়া। কয়েক দফা মধুর ক্যান্টিন বা ক্যাম্পাসে মহড়া দিতে এসে টিকতে না পেরে তাদের কার্যক্রম নয়াপল্টনে বিএনপির দলীয় কার্যালয় এবং দীর্ঘ সময়ের বিএনপির আন্দোলনকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। নেতৃস্থানীয়রা একের পর এক মামলায় দৌড়ের উপর ছিলেন। হল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রদের থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। হলে থাকা যখন সম্ভব হচ্ছে না তখন পাড়া-মহল্লাকেন্দ্রিক কিছু সাংগঠনিক কাজ ছাড়া নেতৃস্থানীয় কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ব-স্ব বিভাগে ক্লাস করার সুযোগে ছাত্রদের সাথে যোগাযোগ ও সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানো বা অন্তত ধরে রাখার কোনো প্রচেষ্টাই নেননি। তারা হয়তোবা আগের মতো অপেক্ষায় ছিলেন যেদিন সরকার পরিবর্তন হবে সেদিন রাত থেকেই তো সেই পূর্বের মতো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে।
সরকার পরিবর্তনের পরে হল ও ক্যাম্পাস তাদের কাছে অপরিচিত মনে হলো। তারপরেও তারা আশা করছিলেন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে ডাকসু নির্বাচন হবে এবং নির্বাচনের পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে শক্তি ভারসাম্যের পরিবর্তন হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্বাচন যখন দোরগোড়ায় এসে পড়লো তখন তারা তাড়াহুড়ো করে নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করলেন। কিন্তু প্রথমেই ধাক্কা খেলেন হলে হলে ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা করে। ছাত্রদেরকে উষ্কে দেয়া হলো যে, আবার হলে হলে দলীয় ছাত্র রাজনীতি নিয়ে আসা হচ্ছে এবং সাধারণ ছাত্রদেরকে ডাক দিয়ে কার্যত ছাত্রদলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নামানো হলো। বিগত ১৫ বছরের দখলদারিত্বের দুঃসহ সময় আবার ক্যাম্পাসে ফিরে আসুক তা শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই চায় না। কিন্তু এ ব্যাপারে শিক্ষার্থীরা সম্ভবত ছাত্রদলের ওপর ভরসা করতে পারেনি। কারণ ছাত্রদলের ইতিহাসও এ ক্ষেত্রে খুব ভালো নয়। উপরন্তু ৫ আগস্টের পরে এ পরিস্থিতিতে ছাত্রদলের বক্তব্য মেসেজ শিক্ষার্থীদের কাছে ঠিকমতো পৌঁছায়নি। ছাত্রদলের সাংগঠনিক ভিত্তি অপেক্ষাকৃত দূর্বল থাকলেও তারা ভেবেছিলেন জাতীয় রাজনীতির আবহ দিয়ে বাজিমাত করা ফেলবেন।
এনসিপি সমর্থক ছাত্র সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক যে রাজনীতি করেছে তা শিবিরকেই শক্তিশালী করেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও এবারের গণঅভ্যুত্থানে তারা সামনের সারিতে থাকলেও ছাত্রদের মধ্যে সংগঠন হিসেবে তাদের ভিত্তি দূর্বল। সরকারসমর্থিত দল হিসেবে পরিচিতি ভোটের বাক্সে তাদের বাড়তি কোনো সুযোগ দেয়নি। জাতীয় রাজনীতিতেও এনসিপি যত হাকডাক দিক না কেনো ভোটের ময়দানে তাদের গুরুত্ব যে খুবই সীমিত সেটা পরিষ্কার। ক্ষমতার খেলায় তারা জামায়াত বা বিএনপির আনুকূল্য পেলে হয়তোবা কিছুটা জায়গা পেতে পারে।
ডাকসুর ইতিহাসে সর্বাধিকবার নির্বাচিত হয়েছে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনসমূহ। স্বাধীন দেশেও প্রথম ডাকসু নির্বাচনে একচেটিয়া জয়লাভ করেছে ছাত্র ইউনিয়ন। তারপরে পরপর তিনবার জাসদ ও বাসদ সমর্থিত বামধারার ছাত্র সংগঠন। এরপরে আরও একবার ডাকসুতে বিজয়ী হয়েছে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনসমূহের নেতৃত্বাধীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। আবার ’৭৪ সালে ভ-ুল হওয়া নির্বাচনেও ভোট গণনায় এগিয়ে ছিলো বামধারার জাসদ ছাত্রলীগ। সেদিক থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে ইতিপূর্বে অনুষ্ঠিত আটটি নির্বাচনের মধ্যে ছয়টিতেই বামধারার ছাত্র সংগঠনগুলোই বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বামপন্থী ধারা ছাত্রদের মধ্যে দুর্বল হয়ে পড়েছে। বাম ধারার প্রধান প্রধান সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্র মৈত্রী এই সময়ে বিভক্ত হয়েছে। যা প্রতিটি সংগঠনকেই দুর্বল করে দিয়েছে। আর বিভক্ত হওয়ার পর একটা সময় কাটে সংগঠন বিকাশের কার্যক্রম বাদ দিয়ে দুই অংশের একে অপরের থেকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার হাস্যকর প্রতিযোগিতায় এবং পারস্পরিক আক্রমণ ও সমালোচনায়।
বামপন্থী প্যানেল বা প্রার্থীদের মধ্যে একমাত্র জিএস পদে মেঘমল্লার বসু প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে ছাত্রদের বিবেচনায় ছিলেন এবং ছাত্রদল প্রার্থীর কাছাকাছি বা প্রায় সমান সংখ্যক ভোট পেয়েছেন। নির্বাচনের আগে গুরুতর অসুস্থ হয়ে প্রায় এক সপ্তাহ নির্বাচনী মাঠে অনুপস্থিত না থাকলে হয়তোবা জিএস পদে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট তিনিই পেতেন। কিন্তু প্যানেল ভোটের দিকে তাকালেই বুঝা যায় বসু ভোট পেয়েছেন ব্যক্তিগত ক্যারিশমা, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রাখা দৃঢ় ভূমিকা, গণঅভ্যুত্থানোত্তোর পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তার সাহসী উচ্চারণÑ এসব বিবেচনায়। কিন্তু সংগঠন শক্তি খুবই দুর্বল। তাই প্যানেল ভোটও খুব কম। বামপন্থী তিনটি ছাত্র সংগঠন সমর্থিত ভিন্ন আরেকটি প্যানেলেও ভোটের খরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিতজনদের নিকট থেকে বাম ছাত্র সংগঠন বিশেষত ছাত্র ইউনিয়ন সম্পর্কে যা শুনি তা আশাপ্রদ নয়। অধিকাংশ হলে তাদের সাংগঠনিক কাঠামো নেই বা থাকলেও না থাকার মতো। সাংগঠনিক কাজ এবং সংগঠনের সমর্থক সংখ্যা ও বলয় বৃদ্ধির জন্য লেগে থেকে হলে, ক্যাম্পাসে যে ধরনের কাজ করতে হয় তা অপেক্ষা অ্যাক্টিভিজমই তাদের পছন্দ। নেতৃত্বের প্রতি শুভানুধ্যায়ীদের সমালোচনা যে, তারা বিভাগে ক্লাস, পরীক্ষায় নিয়মিত নন। সাধারণ ছাত্রদের সাথে নিয়মিত সংযোগও নেই। ভিন্ন মত ও ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিকে ধৈর্য্য নিয়ে জানা-বোঝার চেষ্টা না করা, জীবনাচরণের ক্ষেত্রে সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির প্রতি এক ধরনের উন্নাসিকতা এবং স্থান-কাল বিবেচনায় না নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করা সংগঠন গড়ে তোলা ও বিস্তৃত করার পথে অন্তরায়। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এবং চিন্তাভাবনার নবায়ন করে সংগঠন গড়ার কাজে ধৈর্য্য ও সাহসিকতার সঙ্গে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করেছে, ছাত্রদল থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে Ñ এ পরিস্থিতিতে উপযুক্ত কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হতে পারলে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের দ্রুত বিকাশ লাভ করার সম্ভাবনা রয়েছে।
বামপন্থীরা নির্বাচনে পরাজিত হলেও, যে শক্তি ডাকসু তে জয়লাভ করলো তাতে শুধু উদ্বেগ প্রকাশ নয় বরং বামপন্থীদের সক্রিয় দায়িত্ব আরো বেড়ে গেল। ভাষা সংগ্রাম থেকে স্বাধীনতার সংগ্রাম, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান থেকে চব্বিশের জুলাই জাগরণÑ সব ঐতিহ্য ইতিহাসের সাক্ষী ও সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেউ যাতে এই সুযোগে কুপমুন্ডুকতার শিকলে বেঁধে ফেলতে না পারে, সে জন্য উদার গণতন্ত্রীদের সাথে নিয়ে বামপন্থী ছাত্রদের থাকতে হবে সতর্ক প্রহরায়। সকল ধর্মবিশ্বাসীদের ধর্মীয় আচরণ, পোশাক ও জীবনাচরণের প্রতি সম্মান রেখে ধর্ম নিরপেক্ষ, মুক্ত চিন্তার উদার, মানবিক এবং শিক্ষায় ও সামাজিক ক্ষেত্রে বৈষম্যমুক্ত দেশ গড়ার কারিগর হিসাবে বামপন্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বুকে দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম মুখ মেঘমল্লার বসুর উপর এক বিরাট দায়িত্ব এসে পড়ল। সেই সাথে সারা দেশের ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীরা এবং প্রাক্তনীরা তাকিয়ে থাকবে তার দিকে Ñ এই ক্রান্তিকালে সকল সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে তিনি বিশেষ উদ্যোগ নেন কিনা ঐতিহ্যবাহী ছাত্র ইউনিয়নকে দ্বিখ-িত দশা থেকে মুক্ত করে ঐক্যবদ্ধ ছাত্র ইউনিয়নের নীল পতাকাকে উর্দ্ধে তুলে ধরার আয়োজন পর্ব সংঘটিত করতে। ঐকবদ্ধ সংগঠন শক্তি বিকশিত হলে সুড়ঙ্গ শেষের আলোর জন্য আর হাপিত্যেশ করতে হবে না; বরং সরাসরি সূর্যালোকে বামপন্থা উদ্ভাসিত হবে।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা]
আনোয়ারুল হক
ডাকসুতে বিজয়ীরা রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে
সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
শতবর্ষ প্রাচীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এই প্রথম ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবির বা কোনো ধর্মীয় ছাত্রসংগঠনের সমর্থিত প্যানেল ভিপি, জিএস, এজিএসসহ বেশির ভাগ আসনে নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে। কোনো ধর্মীয় ছাত্র সংগঠন জনপ্রিয়তা পেতেই পারে। কিন্তু দুনিয়ার ইতিহাসে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও তার ছাত্র সংগঠন ছাড়া এমন কোনো ধর্মীয় রাজনৈতিক সংগঠন নেই, যে সংগঠন নিজ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করে দখলদার বাহিনীর পক্ষে সক্রিয় অবস্থান নিয়েছে। স্বাধীন দেশে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সেই ধরনের সংগঠনের বিজয় কিছুটা বিষ্ময়ের ব্যাপার বটে। ডাকসু নির্বাচনে আমরা দেখলাম পুরোনো বা প্রচলিত কোনো হিসাব-নিকাশ কাজ করেনি। আমাদের এই উপমহাদেশেও এ ঘটনা ব্যতিক্রমী। তাইতো সবার আগে জামায়াত ইসলামের পাকিস্তান শাখার আমির হাফিজ নাইমুর রহমান নির্বাচনী ফলাফল বের হওয়ার সাথে সাথেই অতি উৎসাহে ইসলামী ছাত্র শিবিরকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তাদের ছাত্র শাখা ‘ইসলামি জমিয়ত ই তালেবার’ সভাপতি হাসান বিল্লাল হাশমী বার্তা না দিয়ে এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামের আমীরের আগেই সরাসরি পাকিস্তান জামায়াতের আমির অভিনন্দন বার্তা পাঠানোয় মনে সন্দেহ জাগে, এখনই কি হেড কোয়ার্টার লাহোরের মুলতান রোডে!
আবার অন্যদিকে ছাত্র শিবির সমর্থিত প্যানেলের বিজয়ী পুরুষ সদস্যরা তাদেরই পূর্বসূরী ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতৃত্বাধীন আলবদর আলশামস বাহিনীর সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কতৃক মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পূর্বমুহূর্তে দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকা-ের স্মারক রায়েরবাজারের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে গিয়ে দোয়া ও মোনাজাত করে অনেককে টাসকি লাগিয়ে দিয়েছেন। এতকাল তো জামাত শিবির শহীদ এসব বুদ্ধিজীবীদের ‘পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্রে’ ভারতীয় দোসর মনে করতো। এবং সেই ‘অপরাধেই’ তাদের হত্যা করা হয়েছিলো। ছাত্র শিবিরের এ কর্মসূচী পালনে মুলতান রোডস্থ হেডকোয়ার্টারের প্রতিক্রিয়া কী হয় সেটা লক্ষ্য করার বিষয়। অবশ্য শহীদ স্মৃতিসৌধে বিজয়ী কোনো নারীকে নিয়ে তারা যাননি। এমনকি শিবিরকে লিবারেল চেহারাদানকারী নারী প্রার্থীকেও যেতে দেয়া হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক হিসেবে বিজয়ী প্রার্থী কি নারী বলেই তিনি তার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্মসূচিতে থাকতে পারলেন না! তবে এ কর্মসূচি পালন শিবিরের নীতিগত সিদ্ধান্ত বা কৌশল যাই হোক না কেনো সামগ্রিকভাবে এটা একটা ইতিবাচক ঘটনা। এ প্রসঙ্গে পরবর্তীতে আলোচনা করা যাবে।
কথা হচ্ছিল ডাকসু নির্বাচন নিয়ে। হল সংসদের পুরো নির্বাচনী ফলাফলে বিজয়ীদের পরিচয় শুধুমাত্র স্বতন্ত্র হিসেবে থাকায় খুব গভীরে যেয়ে বিশ্লেষণ করা কঠিন। মোটা দাগে ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে মন্তব্য করা যেতে পারে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের নয় মাস ছাড়া পাকিস্তান আমলের ২৫ বছর এবং বাংলাদেশের ৫৪ বছরে জামাত ও ছাত্র সংঘ (পরবর্তী নামকরন ছাত্র শিবির) কখনো গত ১৪ মাসের মত এমন রাষ্ট্রীয় আনুকল্য পায়নি। যে পাকিস্তানের জন্য তাদের এত আফসোস সেই পাকিস্তানের শাসকেরা কিন্তু জামায়াতকে সমাজে ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী হিসেবেই দেখতো। জামায়াত নিজে থেকে পাকিস্তান রক্ষার নামে ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া খানের কাছে ধরা দেয় এবং পূর্ব পাকিস্তানের দখলদার মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে শান্তি বাহিনী ও রাজাকার আলবদর গঠন করে গণহত্যা, সংখ্যালঘু নিধন, নারী ধর্ষণ প্রভৃতি অপরাধে নিজেকে যুক্ত করে। ঐ নয়মাস তারা সরকারের মন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় থাকলেও প্রতি মুহূর্তে ‘মুক্তির’ হাতে নিধনের ভয় ছিলো। সেদিক থেকে বিগত ১৪ মাসের মতো স্বাধীনতা আর ক্ষমতা জামায়াত আর কখনোই পায়নি।
দেশের জন্মযুদ্ধের বিরোধী গোষ্ঠী হিসাবে তারা স্বাধীন দেশে বেআইনি হয়ে যায়। রাজনৈতিক ভারসাম্য নিজের অনুকূলে আনতে জেনারেল জিয়া ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার সুযোগ করে দিলেও এ বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গী ছিলো “ধর্মের অবদান থাকতে পারে রাজনীতিতে, কিন্তু রাজনৈতিক দল ধর্মকে কেন্দ্র করে হতে পারে না”। তাই জামায়াত বা শিবির বাড়াবাড়ি করলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে মাঠে নামিয়ে দেওয়া হতো। খালেদা জিয়া মন্ত্রী সভায় স্থান দিলেও প্রয়োজনে একই পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। তাই কি পাকিস্তান কি বাংলাদেশ কোনো আমলেই জামায়াত একেবারে স্বাধীনভাবে চলতে পারেনি। যুদ্ধাপরাধী হওয়ার কারণে তাদের সবসময় মাথা নীচু করেই থাকতে হয়েছে। এই প্রথম ড. ইউনূস সরকারের আমলে তারা এই ভূখন্ডে শুধু ‘আজাদী’ নয় বিশেষ রাষ্টীয় আনুকূল্য পাচ্ছেন এবং তারা তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করছেন।
ছাত্রশিবির ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে থেকে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন হল, ফ্যাকাল্টি ও আশপাশের বিভিন্ন ছাত্রাবাসে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে। তারা শুধু ছাত্রলীগের আশেপাশে থাকেননি, অনেকেই ছাত্রলীগের কমিটিতেও থেকেছেন, বিশ্বা যোগ্যতা অর্জনের জন্য গণরুম অত্যাচারের সাথে অভিনয় করে হলেও সংশ্লিষ্ট থেকেছেন। তারাসহ আজকের এনসিপির অনেক নেতাও মহাসমারোহে মুজিব শতবর্ষ উদযাপন করেছেন। কারো কারো তো গণভবনেও যাতায়াত ছিলো। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সাথে তাদের ছবি সোশাল মিডিয়ায় এখনও দেখা যায়। শিবিরের এ কৌশলকে অনৈতিক বা দ্বিচারিতা যাই বলা হোক, তাদের কৌশলে তারা বিজয়ী হয়েছে। কোটা আন্দোলনের এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীদের উপর হামলা করে ছাত্র প্রতিরোধের মুখে ছাত্রলীগ ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হয় এবং হলের দখল নিয়ে নেয় ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা ছাত্র শিবির। হলের বাইরে থাকা প্রকাশ্য শিবিরও হলে উঠে পড়ে। হলগুলোতে কায়েম হয় শিবিরের আধিপত্য ও দখলদারিত্ব। দখলদারিত্ব এ অর্থে যে, তারা আওয়াজ তোলে হলে ছাত্র সংগঠনের নামে কোনোরকম কার্যক্রম চলবে না। সাধারণ ছাত্ররা ছাত্ররাজনীতির নামে হলগুলোতে ছাত্রলীগের যে কার্যক্রম দেখেছে এবং বিএনপি আমলে ছাত্রদলের যে কার্যক্রমের গল্প শুনেছে বা জেনেছে তাতে ছাত্র রাজনীতির দলীয় কার্যক্রমমুক্ত হলের পরিবেশের প্রতি তারা সমর্থন জানায়। শিবিরের রাজনৈতিক কার্যক্রম প্রকাশ্য ছিলো না। অপ্রকাশ্য নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ছাত্র শিবির মূলত সাধারণ শিক্ষার্থীদের আর্থিক, পড়ালেখা, চিকিৎসা, কোচিংসহ নানাভাবে সহযোগিতার কাজ করে আসছিল এবং আগের মতোই তা অব্যাহত রাখে। ডাকসু নির্বাচনের প্রস্তুতিও তাদের প্রায় এক বছরের। প্রথাগত ধর্মীয় রাজনীতির বাইরে এসে লিবারেল ধারায় প্যানেল গঠন এবং ধর্মভিত্তিক বক্তব্য না দিয়ে মধ্যপন্থী জায়গা থেকে তারা প্রচার চালিয়েছে। ফলে ছাত্রদের কাছে শিবির কর্মীদের পরিচিতি শিবির হিসাবে নয়, অনেকটা ছাত্রবান্ধব একটা সামাজিক সংগঠন হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় এবং এ ধরনের কর্মকৌশল তাদের জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। একই রকম ফল জাকসুতেও হয়েছে।
অন্যদিকে ছাত্রদল ১৫ বছর যাবত ক্যাম্পাস ছাড়া। কয়েক দফা মধুর ক্যান্টিন বা ক্যাম্পাসে মহড়া দিতে এসে টিকতে না পেরে তাদের কার্যক্রম নয়াপল্টনে বিএনপির দলীয় কার্যালয় এবং দীর্ঘ সময়ের বিএনপির আন্দোলনকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। নেতৃস্থানীয়রা একের পর এক মামলায় দৌড়ের উপর ছিলেন। হল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রদের থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। হলে থাকা যখন সম্ভব হচ্ছে না তখন পাড়া-মহল্লাকেন্দ্রিক কিছু সাংগঠনিক কাজ ছাড়া নেতৃস্থানীয় কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ব-স্ব বিভাগে ক্লাস করার সুযোগে ছাত্রদের সাথে যোগাযোগ ও সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানো বা অন্তত ধরে রাখার কোনো প্রচেষ্টাই নেননি। তারা হয়তোবা আগের মতো অপেক্ষায় ছিলেন যেদিন সরকার পরিবর্তন হবে সেদিন রাত থেকেই তো সেই পূর্বের মতো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে।
সরকার পরিবর্তনের পরে হল ও ক্যাম্পাস তাদের কাছে অপরিচিত মনে হলো। তারপরেও তারা আশা করছিলেন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে ডাকসু নির্বাচন হবে এবং নির্বাচনের পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে শক্তি ভারসাম্যের পরিবর্তন হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্বাচন যখন দোরগোড়ায় এসে পড়লো তখন তারা তাড়াহুড়ো করে নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করলেন। কিন্তু প্রথমেই ধাক্কা খেলেন হলে হলে ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা করে। ছাত্রদেরকে উষ্কে দেয়া হলো যে, আবার হলে হলে দলীয় ছাত্র রাজনীতি নিয়ে আসা হচ্ছে এবং সাধারণ ছাত্রদেরকে ডাক দিয়ে কার্যত ছাত্রদলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নামানো হলো। বিগত ১৫ বছরের দখলদারিত্বের দুঃসহ সময় আবার ক্যাম্পাসে ফিরে আসুক তা শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই চায় না। কিন্তু এ ব্যাপারে শিক্ষার্থীরা সম্ভবত ছাত্রদলের ওপর ভরসা করতে পারেনি। কারণ ছাত্রদলের ইতিহাসও এ ক্ষেত্রে খুব ভালো নয়। উপরন্তু ৫ আগস্টের পরে এ পরিস্থিতিতে ছাত্রদলের বক্তব্য মেসেজ শিক্ষার্থীদের কাছে ঠিকমতো পৌঁছায়নি। ছাত্রদলের সাংগঠনিক ভিত্তি অপেক্ষাকৃত দূর্বল থাকলেও তারা ভেবেছিলেন জাতীয় রাজনীতির আবহ দিয়ে বাজিমাত করা ফেলবেন।
এনসিপি সমর্থক ছাত্র সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক যে রাজনীতি করেছে তা শিবিরকেই শক্তিশালী করেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও এবারের গণঅভ্যুত্থানে তারা সামনের সারিতে থাকলেও ছাত্রদের মধ্যে সংগঠন হিসেবে তাদের ভিত্তি দূর্বল। সরকারসমর্থিত দল হিসেবে পরিচিতি ভোটের বাক্সে তাদের বাড়তি কোনো সুযোগ দেয়নি। জাতীয় রাজনীতিতেও এনসিপি যত হাকডাক দিক না কেনো ভোটের ময়দানে তাদের গুরুত্ব যে খুবই সীমিত সেটা পরিষ্কার। ক্ষমতার খেলায় তারা জামায়াত বা বিএনপির আনুকূল্য পেলে হয়তোবা কিছুটা জায়গা পেতে পারে।
ডাকসুর ইতিহাসে সর্বাধিকবার নির্বাচিত হয়েছে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনসমূহ। স্বাধীন দেশেও প্রথম ডাকসু নির্বাচনে একচেটিয়া জয়লাভ করেছে ছাত্র ইউনিয়ন। তারপরে পরপর তিনবার জাসদ ও বাসদ সমর্থিত বামধারার ছাত্র সংগঠন। এরপরে আরও একবার ডাকসুতে বিজয়ী হয়েছে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনসমূহের নেতৃত্বাধীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। আবার ’৭৪ সালে ভ-ুল হওয়া নির্বাচনেও ভোট গণনায় এগিয়ে ছিলো বামধারার জাসদ ছাত্রলীগ। সেদিক থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে ইতিপূর্বে অনুষ্ঠিত আটটি নির্বাচনের মধ্যে ছয়টিতেই বামধারার ছাত্র সংগঠনগুলোই বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বামপন্থী ধারা ছাত্রদের মধ্যে দুর্বল হয়ে পড়েছে। বাম ধারার প্রধান প্রধান সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্র মৈত্রী এই সময়ে বিভক্ত হয়েছে। যা প্রতিটি সংগঠনকেই দুর্বল করে দিয়েছে। আর বিভক্ত হওয়ার পর একটা সময় কাটে সংগঠন বিকাশের কার্যক্রম বাদ দিয়ে দুই অংশের একে অপরের থেকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার হাস্যকর প্রতিযোগিতায় এবং পারস্পরিক আক্রমণ ও সমালোচনায়।
বামপন্থী প্যানেল বা প্রার্থীদের মধ্যে একমাত্র জিএস পদে মেঘমল্লার বসু প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে ছাত্রদের বিবেচনায় ছিলেন এবং ছাত্রদল প্রার্থীর কাছাকাছি বা প্রায় সমান সংখ্যক ভোট পেয়েছেন। নির্বাচনের আগে গুরুতর অসুস্থ হয়ে প্রায় এক সপ্তাহ নির্বাচনী মাঠে অনুপস্থিত না থাকলে হয়তোবা জিএস পদে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট তিনিই পেতেন। কিন্তু প্যানেল ভোটের দিকে তাকালেই বুঝা যায় বসু ভোট পেয়েছেন ব্যক্তিগত ক্যারিশমা, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রাখা দৃঢ় ভূমিকা, গণঅভ্যুত্থানোত্তোর পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তার সাহসী উচ্চারণÑ এসব বিবেচনায়। কিন্তু সংগঠন শক্তি খুবই দুর্বল। তাই প্যানেল ভোটও খুব কম। বামপন্থী তিনটি ছাত্র সংগঠন সমর্থিত ভিন্ন আরেকটি প্যানেলেও ভোটের খরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিতজনদের নিকট থেকে বাম ছাত্র সংগঠন বিশেষত ছাত্র ইউনিয়ন সম্পর্কে যা শুনি তা আশাপ্রদ নয়। অধিকাংশ হলে তাদের সাংগঠনিক কাঠামো নেই বা থাকলেও না থাকার মতো। সাংগঠনিক কাজ এবং সংগঠনের সমর্থক সংখ্যা ও বলয় বৃদ্ধির জন্য লেগে থেকে হলে, ক্যাম্পাসে যে ধরনের কাজ করতে হয় তা অপেক্ষা অ্যাক্টিভিজমই তাদের পছন্দ। নেতৃত্বের প্রতি শুভানুধ্যায়ীদের সমালোচনা যে, তারা বিভাগে ক্লাস, পরীক্ষায় নিয়মিত নন। সাধারণ ছাত্রদের সাথে নিয়মিত সংযোগও নেই। ভিন্ন মত ও ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিকে ধৈর্য্য নিয়ে জানা-বোঝার চেষ্টা না করা, জীবনাচরণের ক্ষেত্রে সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির প্রতি এক ধরনের উন্নাসিকতা এবং স্থান-কাল বিবেচনায় না নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করা সংগঠন গড়ে তোলা ও বিস্তৃত করার পথে অন্তরায়। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এবং চিন্তাভাবনার নবায়ন করে সংগঠন গড়ার কাজে ধৈর্য্য ও সাহসিকতার সঙ্গে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করেছে, ছাত্রদল থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে Ñ এ পরিস্থিতিতে উপযুক্ত কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হতে পারলে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের দ্রুত বিকাশ লাভ করার সম্ভাবনা রয়েছে।
বামপন্থীরা নির্বাচনে পরাজিত হলেও, যে শক্তি ডাকসু তে জয়লাভ করলো তাতে শুধু উদ্বেগ প্রকাশ নয় বরং বামপন্থীদের সক্রিয় দায়িত্ব আরো বেড়ে গেল। ভাষা সংগ্রাম থেকে স্বাধীনতার সংগ্রাম, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান থেকে চব্বিশের জুলাই জাগরণÑ সব ঐতিহ্য ইতিহাসের সাক্ষী ও সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেউ যাতে এই সুযোগে কুপমুন্ডুকতার শিকলে বেঁধে ফেলতে না পারে, সে জন্য উদার গণতন্ত্রীদের সাথে নিয়ে বামপন্থী ছাত্রদের থাকতে হবে সতর্ক প্রহরায়। সকল ধর্মবিশ্বাসীদের ধর্মীয় আচরণ, পোশাক ও জীবনাচরণের প্রতি সম্মান রেখে ধর্ম নিরপেক্ষ, মুক্ত চিন্তার উদার, মানবিক এবং শিক্ষায় ও সামাজিক ক্ষেত্রে বৈষম্যমুক্ত দেশ গড়ার কারিগর হিসাবে বামপন্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বুকে দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম মুখ মেঘমল্লার বসুর উপর এক বিরাট দায়িত্ব এসে পড়ল। সেই সাথে সারা দেশের ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীরা এবং প্রাক্তনীরা তাকিয়ে থাকবে তার দিকে Ñ এই ক্রান্তিকালে সকল সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে তিনি বিশেষ উদ্যোগ নেন কিনা ঐতিহ্যবাহী ছাত্র ইউনিয়নকে দ্বিখ-িত দশা থেকে মুক্ত করে ঐক্যবদ্ধ ছাত্র ইউনিয়নের নীল পতাকাকে উর্দ্ধে তুলে ধরার আয়োজন পর্ব সংঘটিত করতে। ঐকবদ্ধ সংগঠন শক্তি বিকশিত হলে সুড়ঙ্গ শেষের আলোর জন্য আর হাপিত্যেশ করতে হবে না; বরং সরাসরি সূর্যালোকে বামপন্থা উদ্ভাসিত হবে।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা]