রেজাউল করিম খোকন
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত দীর্ঘদিন ধরেই নানা ধরনের সমস্যায় জর্জরিত। অপ্রতুল মূলধন, ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ, অনিয়ম ও দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনাÑএসব কারণে একের পর এক ব্যাংক জনআস্থা হারিয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো যেমন সংকটে পড়েছে, তেমনি কিছু বেসরকারি ব্যাংকও দাঁড়িয়েছে পতনের দ্বারপ্রান্তে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার এক অভূতপূর্ব পদক্ষেপ নিয়েছে। সম্প্রতি সরকার পাঁচটি দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করে একটি নতুন প্রতিষ্ঠান গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে “বাংলাদেশ কমার্শিয়াল ব্যাংক”। একই সঙ্গে চালু হয়েছে ব্যাংক রেজোল্যুশন অধ্যাদেশ ২০২৫, যার আওতায় এই একীভূতকরণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
এই সিদ্ধান্ত কেবল ব্যাংক খাত নয়, বরং পুরো অর্থনীতির জন্য একটি বড় ধরনের নীতিগত পরিবর্তন। কারণ, এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাংক সংকট মোকাবিলায় রেজোল্যুশন কাঠামো ব্যবহার করছে। এর আগে যদিও কয়েকটি দুর্বল ব্যাংককে বাঁচাতে সরকার ভর্তুকি দিয়েছে, মূলধন যোগ করেছে বা রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের ওপর দায়িত্ব চাপিয়েছে, কিন্তু এত বড় পরিসরে একীভূতকরণ কখনো হয়নি। তাই অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী এবং সাধারণ আমানতকারীÑসবার মধ্যে এ সিদ্ধান্ত নিয়ে তুমুল আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে।
একীভূত হওয়া ব্যাংকগুলো হলোÑআইসিবি ইসলামি ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, জাতীয় ব্যাংক, জনতা ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংক। এর মধ্যে প্রথম দুটি অপেক্ষাকৃত ছোট ও দীর্ঘদিনের সমস্যাগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান, আর বাকি তিনটি বড় ব্যাংক; বিশেষ করে জনতা ও রূপালী রাষ্ট্রীয় খাতের ব্যাংক হিসেবে বহুল পরিচিত। এসব ব্যাংকের মোট শাখা সংখ্যা ১২ শ’র বেশি এবং সম্মিলিতভাবে এদের আমানতের পরিমাণ প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা। ফলে এদের একীভূতকরণ কেবল কাগুজে বিষয় নয়, বরং কোটি কোটি আমানতকারী ও হাজারো কর্মচারীর জীবনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত।
সরকার যে কারণগুলো দেখিয়ে একীভূতকরণের পথে হাঁটছে, তার মধ্যে প্রধান হলোÑখেলাপি ঋণের বোঝা সামাল দেওয়া। বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা, যার বড় অংশ জড়িত রয়েছে এই দুর্বল ব্যাংকগুলোর সঙ্গে। বিশেষ করে জনতা ব্যাংক ও জাতীয় ব্যাংক বছরের পর বছর রাজনৈতিক প্রভাবিত ঋণ বিতরণের কারণে বিপুল পরিমাণ অযোগ্য ঋণ সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়া আইসিবি ইসলামি ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক বহু বছর ধরে আমানত ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়েছে, ফলে এদের প্রতি জনগণের আস্থা অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। সরকারের ধারণা, একীভূতকরণের মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকের দায়-দেনা একটি নতুন কাঠামোয় নিয়ে গিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।
নতুন “বাংলাদেশ কমার্শিয়াল ব্যাংক”-এর মূলধন গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখছে একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি বা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি (এএমসি)। এ প্রতিষ্ঠান খেলাপি ঋণ ও অনুৎপাদনশীল সম্পদ গ্রহণ করবে এবং সেগুলো পুনরুদ্ধার বা নিষ্পত্তির চেষ্টা করবে। এর ফলে নতুন ব্যাংক তার কার্যক্রম শুরু করতে পারবে তুলনামূলকভাবে পরিচ্ছন্ন ব্যালান্সশিট নিয়ে। একই সঙ্গে সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে সাধারণ আমানতকারীর অর্থ কোনোভাবেই ঝুঁকির মধ্যে পড়বে না। বরং আমানত সুরক্ষায় সরকার বিশেষ তহবিল গঠন করবে, যাতে ব্যাংকের স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
তবে এ সিদ্ধান্তকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নানা প্রশ্ন ও সংশয়। অনেক অর্থনীতিবিদ বলছেন, কেবল নাম পাল্টে বা কয়েকটি দুর্বল ব্যাংককে একত্র করে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। যদি একই পুরোনো ব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং ঋণ বিতরণের অনিয়ম চলতে থাকে, তাহলে নতুন ব্যাংকও কিছুদিন পর একই অবস্থায় পড়বে। তাদের মতে, মূলত গভর্ন্যান্স সংস্কার ছাড়া কোনো একীভূতকরণ টেকসই হবে না। অন্যদিকে কর্মচারীদের ভবিষ্যৎ নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। পাঁচটি ব্যাংকের মধ্যে একীভূতকরণের ফলে অপ্রয়োজনীয় শাখা বা পদ কমে আসতে পারে, যা চাকরির বাজারে নতুন চাপ সৃষ্টি করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে, একীভূতকরণ কোনো জাদুর কাঠি নয়। এটি একটি প্রক্রিয়া, যার সাফল্য নির্ভর করবে বাস্তবায়নের মান ও জবাবদিহির ওপর। যদি সুশাসন নিশ্চিত করা যায়, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে এটি সুফল বয়ে আনতে পারে। কিন্তু কেবল নাম পরিবর্তন বা দায় ঢাকার প্রচেষ্টা হলে এতে উল্টো নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।”
অন্যদিকে ব্যবসায়ী সমাজের মধ্যে এ সিদ্ধান্ত নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি (এফবিসিসিআই)-এর একাধিক নেতা জানিয়েছেন, তারা সরকারের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানাচ্ছেন, কারণ ব্যাংক খাতের প্রতি আস্থা পুনরুদ্ধার এখন জরুরি। তবে তারা এটিও বলেছেন, ব্যবসায়ী মহল চায় স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা। যদি একই প্রভাবশালী গোষ্ঠী আবারও সুবিধাভোগী হয়, তাহলে প্রকৃত ব্যবসায়ী ও আমানতকারীরা কোনো লাভ পাবে না।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার দিকে তাকালে দেখা যায়, বিভিন্ন দেশে দুর্বল ব্যাংক বাঁচাতে বা আর্থিক সংকট মোকাবিলায় একীভূতকরণ একটি পরিচিত কৌশল। ভারত ২০১৯ সালে একসঙ্গে ১০টি রাষ্ট্রীয় ব্যাংককে একীভূত করে চারটি বড় ব্যাংক গঠন করেছিল। এর ফলে সেখানে পরিচালন ব্যয় কমেছে, মূলধন শক্তিশালী হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বেড়েছে। মালয়েশিয়াও ১৯৯৭ সালের এশীয় আর্থিক সংকটের পর ৫৪টি ব্যাংককে একত্র করে ১০টি ব্যাংক গঠন করেছিল। তবে এসব দেশে একীভূতকরণের পাশাপাশি কঠোর নিয়ন্ত্রক সংস্কার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয়েছিল। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সেই শিক্ষা গ্রহণ করা জরুরি।
নতুন ব্যাংক গঠনের প্রক্রিয়া যেমন চ্যালেঞ্জিং, তেমনি দীর্ঘমেয়াদি। প্রথম কয়েক মাসেই হয়তো বড় কোনো পরিবর্তন চোখে পড়বে না। বরং এটি একটি ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়ার বিষয়। প্রাথমিকভাবে আইনি কাঠামো, মূলধন পুনর্গঠন, সম্পদ হস্তান্তর এবং ব্যবস্থাপনা নিয়োগের মতো কাজগুলো সম্পন্ন করতে হবে। এরপর শুরু হবে প্রকৃত পরীক্ষাÑগ্রাহকসেবা উন্নয়ন, আমানতকারীর আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার।
জনগণের মধ্যে এক ধরনের মানসিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে যাদের টাকা এসব ব্যাংকে রয়েছে। অনেকে আতঙ্কিত যে তাদের আমানত আটকে যেতে পারে। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার আশ্বস্ত করছে যে আমানতকারীদের অর্থ নিরাপদ। কিন্তু বাস্তবে আস্থা ফেরাতে শুধু আশ্বাস যথেষ্ট নয়; বরং সময়োপযোগী কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমনÑগ্রাহকদের স্বাভাবিকভাবে টাকা উত্তোলনের সুযোগ দেওয়া, ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা আধুনিক করা এবং আন্তর্জাতিক মানদ-ে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা জোরদার করা।
সর্বোপরি বলা যায়, পাঁচ ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের আর্থিক খাতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এটি সফল হলে ব্যাংক খাত থেকে শুরু করে গোটা অর্থনীতিই উপকৃত হবে। কারণ এতে একদিকে যেমন দুর্বল ব্যাংকের বোঝা হালকা হবে, অন্যদিকে গ্রাহকের আস্থাও ফিরতে পারে। তবে ব্যর্থ হলে এর মূল্য হবে ভয়াবহÑঅর্থনীতি আরও বড় সংকটে পড়বে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হবে এবং জনগণের আস্থা পুরোপুরি নষ্ট হবে। তাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এই রেজোল্যুশন প্রক্রিয়া যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা, সুশাসন নিশ্চিত করা এবং দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনা।
বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আস্থা পুনর্গঠন। ব্যাংক খাত কেবল একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয়, বরং এটি সমগ্র অর্থনীতির চালিকাশক্তি। যদি মানুষ বিশ্বাস করে তাদের টাকা নিরাপদ, তাহলে বিনিয়োগ বাড়বে, ব্যবসা সম্প্রসারিত হবে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। আর যদি আস্থা ভেঙে যায়, তাহলে কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনাই স্থায়ী সুফল দেবে না। সেই বাস্তবতা মাথায় রেখেই সরকার ও নীতিনির্ধারকদের উচিত এ একীভূতকরণকে কেবল সংকট এড়ানোর কৌশল হিসেবে নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের অংশ হিসেবে দেখা।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]
রেজাউল করিম খোকন
সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত দীর্ঘদিন ধরেই নানা ধরনের সমস্যায় জর্জরিত। অপ্রতুল মূলধন, ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ, অনিয়ম ও দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনাÑএসব কারণে একের পর এক ব্যাংক জনআস্থা হারিয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো যেমন সংকটে পড়েছে, তেমনি কিছু বেসরকারি ব্যাংকও দাঁড়িয়েছে পতনের দ্বারপ্রান্তে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার এক অভূতপূর্ব পদক্ষেপ নিয়েছে। সম্প্রতি সরকার পাঁচটি দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করে একটি নতুন প্রতিষ্ঠান গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে “বাংলাদেশ কমার্শিয়াল ব্যাংক”। একই সঙ্গে চালু হয়েছে ব্যাংক রেজোল্যুশন অধ্যাদেশ ২০২৫, যার আওতায় এই একীভূতকরণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
এই সিদ্ধান্ত কেবল ব্যাংক খাত নয়, বরং পুরো অর্থনীতির জন্য একটি বড় ধরনের নীতিগত পরিবর্তন। কারণ, এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাংক সংকট মোকাবিলায় রেজোল্যুশন কাঠামো ব্যবহার করছে। এর আগে যদিও কয়েকটি দুর্বল ব্যাংককে বাঁচাতে সরকার ভর্তুকি দিয়েছে, মূলধন যোগ করেছে বা রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের ওপর দায়িত্ব চাপিয়েছে, কিন্তু এত বড় পরিসরে একীভূতকরণ কখনো হয়নি। তাই অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী এবং সাধারণ আমানতকারীÑসবার মধ্যে এ সিদ্ধান্ত নিয়ে তুমুল আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে।
একীভূত হওয়া ব্যাংকগুলো হলোÑআইসিবি ইসলামি ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, জাতীয় ব্যাংক, জনতা ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংক। এর মধ্যে প্রথম দুটি অপেক্ষাকৃত ছোট ও দীর্ঘদিনের সমস্যাগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান, আর বাকি তিনটি বড় ব্যাংক; বিশেষ করে জনতা ও রূপালী রাষ্ট্রীয় খাতের ব্যাংক হিসেবে বহুল পরিচিত। এসব ব্যাংকের মোট শাখা সংখ্যা ১২ শ’র বেশি এবং সম্মিলিতভাবে এদের আমানতের পরিমাণ প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা। ফলে এদের একীভূতকরণ কেবল কাগুজে বিষয় নয়, বরং কোটি কোটি আমানতকারী ও হাজারো কর্মচারীর জীবনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত।
সরকার যে কারণগুলো দেখিয়ে একীভূতকরণের পথে হাঁটছে, তার মধ্যে প্রধান হলোÑখেলাপি ঋণের বোঝা সামাল দেওয়া। বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা, যার বড় অংশ জড়িত রয়েছে এই দুর্বল ব্যাংকগুলোর সঙ্গে। বিশেষ করে জনতা ব্যাংক ও জাতীয় ব্যাংক বছরের পর বছর রাজনৈতিক প্রভাবিত ঋণ বিতরণের কারণে বিপুল পরিমাণ অযোগ্য ঋণ সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়া আইসিবি ইসলামি ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক বহু বছর ধরে আমানত ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়েছে, ফলে এদের প্রতি জনগণের আস্থা অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। সরকারের ধারণা, একীভূতকরণের মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকের দায়-দেনা একটি নতুন কাঠামোয় নিয়ে গিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।
নতুন “বাংলাদেশ কমার্শিয়াল ব্যাংক”-এর মূলধন গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখছে একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি বা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি (এএমসি)। এ প্রতিষ্ঠান খেলাপি ঋণ ও অনুৎপাদনশীল সম্পদ গ্রহণ করবে এবং সেগুলো পুনরুদ্ধার বা নিষ্পত্তির চেষ্টা করবে। এর ফলে নতুন ব্যাংক তার কার্যক্রম শুরু করতে পারবে তুলনামূলকভাবে পরিচ্ছন্ন ব্যালান্সশিট নিয়ে। একই সঙ্গে সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে সাধারণ আমানতকারীর অর্থ কোনোভাবেই ঝুঁকির মধ্যে পড়বে না। বরং আমানত সুরক্ষায় সরকার বিশেষ তহবিল গঠন করবে, যাতে ব্যাংকের স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
তবে এ সিদ্ধান্তকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নানা প্রশ্ন ও সংশয়। অনেক অর্থনীতিবিদ বলছেন, কেবল নাম পাল্টে বা কয়েকটি দুর্বল ব্যাংককে একত্র করে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। যদি একই পুরোনো ব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং ঋণ বিতরণের অনিয়ম চলতে থাকে, তাহলে নতুন ব্যাংকও কিছুদিন পর একই অবস্থায় পড়বে। তাদের মতে, মূলত গভর্ন্যান্স সংস্কার ছাড়া কোনো একীভূতকরণ টেকসই হবে না। অন্যদিকে কর্মচারীদের ভবিষ্যৎ নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। পাঁচটি ব্যাংকের মধ্যে একীভূতকরণের ফলে অপ্রয়োজনীয় শাখা বা পদ কমে আসতে পারে, যা চাকরির বাজারে নতুন চাপ সৃষ্টি করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে, একীভূতকরণ কোনো জাদুর কাঠি নয়। এটি একটি প্রক্রিয়া, যার সাফল্য নির্ভর করবে বাস্তবায়নের মান ও জবাবদিহির ওপর। যদি সুশাসন নিশ্চিত করা যায়, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে এটি সুফল বয়ে আনতে পারে। কিন্তু কেবল নাম পরিবর্তন বা দায় ঢাকার প্রচেষ্টা হলে এতে উল্টো নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।”
অন্যদিকে ব্যবসায়ী সমাজের মধ্যে এ সিদ্ধান্ত নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি (এফবিসিসিআই)-এর একাধিক নেতা জানিয়েছেন, তারা সরকারের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানাচ্ছেন, কারণ ব্যাংক খাতের প্রতি আস্থা পুনরুদ্ধার এখন জরুরি। তবে তারা এটিও বলেছেন, ব্যবসায়ী মহল চায় স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা। যদি একই প্রভাবশালী গোষ্ঠী আবারও সুবিধাভোগী হয়, তাহলে প্রকৃত ব্যবসায়ী ও আমানতকারীরা কোনো লাভ পাবে না।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার দিকে তাকালে দেখা যায়, বিভিন্ন দেশে দুর্বল ব্যাংক বাঁচাতে বা আর্থিক সংকট মোকাবিলায় একীভূতকরণ একটি পরিচিত কৌশল। ভারত ২০১৯ সালে একসঙ্গে ১০টি রাষ্ট্রীয় ব্যাংককে একীভূত করে চারটি বড় ব্যাংক গঠন করেছিল। এর ফলে সেখানে পরিচালন ব্যয় কমেছে, মূলধন শক্তিশালী হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বেড়েছে। মালয়েশিয়াও ১৯৯৭ সালের এশীয় আর্থিক সংকটের পর ৫৪টি ব্যাংককে একত্র করে ১০টি ব্যাংক গঠন করেছিল। তবে এসব দেশে একীভূতকরণের পাশাপাশি কঠোর নিয়ন্ত্রক সংস্কার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয়েছিল। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সেই শিক্ষা গ্রহণ করা জরুরি।
নতুন ব্যাংক গঠনের প্রক্রিয়া যেমন চ্যালেঞ্জিং, তেমনি দীর্ঘমেয়াদি। প্রথম কয়েক মাসেই হয়তো বড় কোনো পরিবর্তন চোখে পড়বে না। বরং এটি একটি ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়ার বিষয়। প্রাথমিকভাবে আইনি কাঠামো, মূলধন পুনর্গঠন, সম্পদ হস্তান্তর এবং ব্যবস্থাপনা নিয়োগের মতো কাজগুলো সম্পন্ন করতে হবে। এরপর শুরু হবে প্রকৃত পরীক্ষাÑগ্রাহকসেবা উন্নয়ন, আমানতকারীর আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার।
জনগণের মধ্যে এক ধরনের মানসিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে যাদের টাকা এসব ব্যাংকে রয়েছে। অনেকে আতঙ্কিত যে তাদের আমানত আটকে যেতে পারে। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার আশ্বস্ত করছে যে আমানতকারীদের অর্থ নিরাপদ। কিন্তু বাস্তবে আস্থা ফেরাতে শুধু আশ্বাস যথেষ্ট নয়; বরং সময়োপযোগী কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমনÑগ্রাহকদের স্বাভাবিকভাবে টাকা উত্তোলনের সুযোগ দেওয়া, ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা আধুনিক করা এবং আন্তর্জাতিক মানদ-ে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা জোরদার করা।
সর্বোপরি বলা যায়, পাঁচ ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের আর্থিক খাতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এটি সফল হলে ব্যাংক খাত থেকে শুরু করে গোটা অর্থনীতিই উপকৃত হবে। কারণ এতে একদিকে যেমন দুর্বল ব্যাংকের বোঝা হালকা হবে, অন্যদিকে গ্রাহকের আস্থাও ফিরতে পারে। তবে ব্যর্থ হলে এর মূল্য হবে ভয়াবহÑঅর্থনীতি আরও বড় সংকটে পড়বে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হবে এবং জনগণের আস্থা পুরোপুরি নষ্ট হবে। তাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এই রেজোল্যুশন প্রক্রিয়া যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা, সুশাসন নিশ্চিত করা এবং দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনা।
বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আস্থা পুনর্গঠন। ব্যাংক খাত কেবল একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয়, বরং এটি সমগ্র অর্থনীতির চালিকাশক্তি। যদি মানুষ বিশ্বাস করে তাদের টাকা নিরাপদ, তাহলে বিনিয়োগ বাড়বে, ব্যবসা সম্প্রসারিত হবে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। আর যদি আস্থা ভেঙে যায়, তাহলে কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনাই স্থায়ী সুফল দেবে না। সেই বাস্তবতা মাথায় রেখেই সরকার ও নীতিনির্ধারকদের উচিত এ একীভূতকরণকে কেবল সংকট এড়ানোর কৌশল হিসেবে নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের অংশ হিসেবে দেখা।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]