alt

opinion » post-editorial

ভারতে এসআইআর বিতর্ক

গৌতম রায়

: সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ঠিক ১০০ বছর আগে, প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই আরএসএসের একান্ত নিজস্ব রাজনৈতিক লাইন হল- যে কোনও উপায়ে মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা ছড়ানো, বিদ্বেষ ছড়ানো। এক কথায় বলতে গেলে, মুসলমানদের শায়েস্তা করা। তাদের এই রাজনৈতিক চিন্তাটা খাতায়-কলমে অন্তর্ভুক্ত করে সংঘের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক গোলওয়ালকর। মুসলমানমুক্ত ভারতসংঘের এই তাত্ত্বিক অবস্থানকে গোলওয়ালকর ‘সংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’ নামক এক সোনার পাথরবাটির মধ্যে দিয়ে, হিন্দুত্ববাদী চিন্তা ধারার একটি গৃহীত রাজনৈতিক অবস্থান হিসেবে চিহ্নিত করে।

সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ নামক এই রাজনৈতিক অবস্থানই হলো নাগরিকত্ব আইন ঘিরে বিজেপির বিভিন্ন ধরনের কলাকৌশলের প্রধান বিষয়। ভোটার তালিকার সংযোজন-বিয়োজনের নাম করে আজ যে এসআইআর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে ভারতীয় নাগরিকদের উপরে, সেটি হল মূলত ; কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির রাজনৈতিক অবস্থানের একটি ফলশ্রুতি।

বর্তমান নির্বাচন কমিশন পক্ষপাত দোষে দুষ্ট। আরএসএস এবং তার রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি, হিন্দুত্ববাদী ধারায় ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থাকে ভোটারদের প্রভাবিত করবার লক্ষ্যে, ঠিক যেভাবে নির্বাচন কমিশনকে পরিচালিত করতে চায়, নির্বাচন কমিশন ও কমিশনার ঠিক সেইভাবে পরিচালিত হয়। এই নির্বাচন কমিশনের এবং নির্বাচন কমিশনারদের আদৌ কোনও নিরপেক্ষতা নেই ।

অতীতে নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগের ক্ষেত্রে দেশের প্রধানমন্ত্রী , দেশের বিরোধী দলের নেতা এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত কমিটির সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত। বিজেপি সরকার এই ব্যবস্থার পরিবর্তন এনেছে। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের প্যানেলে তারা দেশের প্রধান বিচারপতিকে আর রাখেনি। সেই জায়গায় প্রধানমন্ত্রী নিয়োজিত কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার একজন সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করবার সংস্থান রাখা হয়েছে।

ফলে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়া আর ভারতে দেখতে পাওয়া যায় না। কারণ বিরোধী দলনেতার যে অবস্থানই হোক না কেন, প্রধানমন্ত্রী এবং তার নিয়োজিত, তারই মন্ত্রিসভার সদস্যের অবস্থানের ফলে, নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ সংক্রান্ত কমিটিতে শাসকদলেরই থাকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা। সেখানে স্বাভাবিকভাবেই বিচারের আগেই রায় ঘোষণার মত, দেশের বিরোধীদল নেতার অভিমতটি হয়ে পরিত্যজ্য।

নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ সংক্রান্ত আইনে এই বদল এনে, আঁটঘাট বেঁধেই বিজেপি নির্বাচন কমিশনারকে দিয়ে এসআইআর-এর বিষয়টির অবতারণা করেছে। নানা ধরনের আইনগত সমস্যা, প্রয়োজনীয়তা- ছাপিয়ে তাই এসবের থেকেও যেটা বড় হয়ে উঠেছে; এই ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে গোলওয়ালকারের সংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ তত্ত্বে প্রতিষ্ঠা করবার লক্ষ্য। সরকারি তকমাকে ব্যবহার করে, নির্বাচন কমিশনারের দ্বারা, নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে ভারতকে মুসলমানশূন্য করবার একটা বীভৎস প্রবণতাই এই এসআইআর-এর একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে উঠেছে।

গোলওয়ালকর শুরু করেছিল; ভারতে অবস্থানরত মুসলমানদের ভারতে থাকতে হলে, হয় দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে থাকতে হবে। না হলে তাদের হিন্দুদের অধীনস্থ হয়ে থাকতে হবে। বস্তুতপক্ষে যে কয় বছর ভারতে, বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে, সেই সময়কালে ভারতে অবস্থানরত সহনাগরিক মুসলমানেরা কার্যত রাজনৈতিক হিন্দুদের জিম্মি হয়ে থেকেছেন। এখনও তা-ই থাকছেন। তাদের উপরে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রীত্ব কালে আমরা দেখেছি। সেই সময়, আজকের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ছিলেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। আর আজকের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার একজন বিশিষ্ট সদস্য।

নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আমরা দেখেছি দিল্লি গণহত্যা। এই দিল্লী গণহত্যার জেরে আজও ভারতের সহ নাগরিক বহু বিশিষ্ট মুসলমান মিথ্যা অপবাদে জেল খাটছেন। তরুণ ছাত্র উমর খালিদ হলেন এমনই একজন সহনাগরিক ।

দিল্লি গণহত্যায় আরএসএস - বিজেপি এবং তার সঙ্গী সাথীরা প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থেকেও, সর্বস্ব হারানো মুসলমান সমাজকেই এই গণহত্যার জন্য দায়ী করে, তাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের মামলা- মকদ্দমা ,পুলিশি সন্ত্রাস, আইনি হেনস্থা চালাচ্ছে।

এ সমস্ত গুলিই ছিল এন আর সি, সি এ এ বিরোধী আন্দোলনের একটা প্রতিক্রিয়া। এইযে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন গুলি, তার মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতে অবস্থানরত সহ নাগরিক মুসলমানদের নাগরিকত্ব হরণ করা। দিল্লি গণহত্যা কালে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা , দিল্লির তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিয়ালের নীরবতা - এ সমস্তই কিন্তু আজকে এস আই আর তৈরির পটভূমিকা নির্মাণ করেছে।

এস আই আর , ভোটার তালিকায় বৈজ্ঞানিক কারচুপি-- এই সমস্ত কিছুর পিছনে কিন্তু লুকিয়ে আছে আরএসএস- বিজেপির মুসলমান মুক্ত ভারত করবার রাজনৈতিক কর্মসূচি। মনে রাখা দরকার হিন্দুত্ববাদীরা যে তথাকথিত হিন্দু রাষ্ট্রের কথা বলছে; সেই হিন্দু রাষ্ট্র কিন্তু আপামর শাক্ত- শৈব- বৈষ্ণব ইত্যাদি তরিকায় বিশ্বাসী মানুষজন, যাদেরকে একটা ইউনিফর্ম প্লাটফর্ম হিসেবে হিন্দু বলে পরিগণিত করা হয়- সেইসব মানুষজনদের জন্য নয়। প্রচলিত অর্থে যাদের হিন্দু বলা হয়, তাদের বিভিন্ন তরিকার মানুষদের মধ্যে তাত্ত্বিক অবস্থান এবং ব্যবহারিক প্রয়োগের দিক থেকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরধর্মবিদ্বেষ নেই। পরমত অসহিষ্ণুতা নেই।

কিন্তু এই অংশের মানুষকে নিজেদের রাজনৈতিক সংজ্ঞা অনুযায়ী যাকে হিন্দু বলে দাগিয়ে দিচ্ছে হিন্দুত্ববাদী শক্তি , সেই রাজনৈতিক হিন্দুদের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে আরএসএস বিজেপি দেখে না ।কোনও হিন্দু যদি মুসলমান বিদ্বেষী না হয়, আরএসএস- বিজেপির কাছে সে প্রকৃত হিন্দু নয়। কোনও হিন্দু যদি পবিত্র ইসলামের প্রতি সম্মানজনক- মর্যাদাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলে, তবে সেই ব্যক্তিটি আরএসএসের কাছে, বিজেপির কাছে কখনোই তাদের রাজনৈতিক সংজ্ঞার হিন্দুর সমতুল্য হতে পারে না।

সার্বিক অর্থে আধ্যাত্মিক ধারার ‘হিন্দু’ শব্দটিকে গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির সংকীর্ণ দলীয় ধারার একটি রাজনৈতিক লব্জে পরিণত করেছে। তাদের উদ্দেশ্য হলো; এই রাজনৈতিক হিন্দুদের হাতেই পরিচালিত হোক ভারত। সেভাবে রাজনৈতিক হিন্দুদের দ্বারা ভারতকে পরিচালিত করতেই তারা ভারতের সংবিধানের সার্বিক খোলনোলচে বদলে দিতে চায় ।ভারতের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার সার্বিক পরিম-ল এস আই আর এর মধ্য দিয়ে মুছে দিতে চায়। বিজেপির এই সহনাগরিক মুসলমানদের বেনাগরিক করবার গোটা অভিসন্ধিই হল এস আই আর এর উদ্দেশ্য।

তাই ভোটার তালিকা সংশোধনের নাম করে, ভোটার তালিকা কে পরিচ্ছন্ন করবার নাম করে, সাধারণ মানুষের কাছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পুরনো মদকে নতুন বোতলে এনে পুড়ে পরিবেশন করা হচ্ছে।

বৃহত্তর বাম ঐক্যের প্রশ্নে যে সমস্ত বামপন্থীরা সমবেত হচ্ছে, গোটা হিন্দুত্ববাদী শক্তির অপচেষ্টাকে রুখে দেওয়ার সংকল্প করছে, তাদের মধ্যে সিপিআই(এম)। আর সিপিআইএমের লিবারেশন ছাড়া বামপন্থী দলগুলির পশ্চিমবঙ্গে কোনও জনভিত্তি নেই। এস ইউ সি আই ( কমিউনিস্ট) পশ্চিমবঙ্গ থেকে বামপন্থীদের বিতারিত করবার লক্ষ্যে মমতা ব্যানার্জির সাঙাত হিসেবে কাজ করেছে। মমতা ব্যানার্জির দাক্ষিণ্যে এই দল স্বাধীনতার প্রায় ৭৫ বছর পর প্রথম ভারতীয় সংসদে একজন প্রতিনিধি পাঠাতে সক্ষম হয়েছিল। তারা যখন এসে এই এস আই আর ইত্যাদি সম্পর্কে প্রতিষ্ঠিত বামপন্থীদের পাশে দাঁড়ায়, তখন তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ঘিরে অবশ্যই সন্দেহের অবকাশ থাকে। আর এস পি র মত রাজনৈতিক দল, যারা একটা সময়ে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে ব্যস্ত থেকেছে বামফ্রন্ট সরকার পরিচালনায় সিপিআই(এমে)র নিয়ন্ত্রণকে আলগা করতে। একাজ সম্পাদন করতে আরএসএস- বিজেপির স্বাভাবিক মিত্র মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে টেবিলের তলার সখ্যতা করতেও যারা দ্বিধা করেনি, আর যাই হোক এস আই আর ইত্যাদি ঘিরে বিজেপি বিরোধিতার প্রশ্নে, তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা কখনো প্রশ্নাতীত হতে পারে না।

হিন্দুত্ববাদী শক্তির আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে; গণতন্ত্রকে সঙ সাজিয়ে, ভারতের রাষ্ট্র ক্ষমতাকে, গণতন্ত্রের একটা লেবাস দিয়ে কুক্ষিগত করা। যেভাবে এককালে ইতালিতে মুসোলিনি করেছিল। জার্মানিতে হিটলার করেছিল- ঠিক সেভাবেই । নির্বাচন প্রক্রিয়া টিকেই এমন একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে তারা রূপান্তরিত করতে চায়; যেখানে তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ, আর নানা ধরনের প্রযুক্তির সাহায্যে ভোটারদের মতকে প্রভাবিত করবার ছাড়া দ্বিতীয় অন্য কোনও উপায় থাকবে না।

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির এই মডেলটি তাদের স্বাভাবিক মিত্র তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসবার পর থেকেই সফলভাবে প্রয়োগ করে ফেলেছে। লোকসভা, বিধানসভা ভোট গুলিতে তো এই পদ্ধতি তারা প্রয়োগ করছেই। পৌরসভা পঞ্চায়েত হয়ে, সমবায় সমিতি থেকে শুরু করে ক্লাবের নির্বাচন গুলিতে পর্যন্ত এভাবে ভোটারদের মতকে প্রযুক্তির সাহায্যে তারা বদলে দিচ্ছে। ফলে বিগত ১৫ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে সাধারণ নাগরিকদের মতামতের কোনও প্রতিফলন আমরা এই রাজ্যের কোনও নির্বাচনে একবারের জন্য দেখতে পাচ্ছি না।

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের রাজনৈতিক অবস্থা যত খারাপই হোক, লোকসভা- বিধানসভা থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসন, কোনও স্তরে তারা একজন প্রার্থীকে ও জিতিয়ে আনতে পারবে না- এতটা দুরবস্থা কিন্তু তাদের নয়। আজ গোটা ভারত জুড়ে এস আই আর এর নামে যেভাবে ভোটার তালিকার কারচুপি করছে বিজেপি, ঠিক সেই পদ্ধতিটাই অলিখিতভাবে এতকাল ধরে পশ্চিমবঙ্গের বুকে করে এসেছে তাদের স্বাভাবিক মিত্র তৃণমূল কংগ্রেস।

[লেখক: ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় জনগণের ভূমিকা উপেক্ষিত

শ্রমজীবী মানুষের শোভন কর্মসংস্থান

মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় বাংলাদেশের বাস্তবতা

প্রবারণার আলোয় আলোকিত হোক মানবজাতি

অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে ওয়াশিংটনের শেষ সুযোগ?

পাহাড় থেকে সমতল: আদিবাসী নারীর নিরাপত্তা

সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ সংস্কৃতি: আসক্তি নাকি নতুন যোগাযোগ?

জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যু

মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক পরিবর্তন: আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি

রম্যগদ্য: “কেশ ফ্যালায় ভাই, কেশ ফ্যালায়...”

লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থীর অধিকার: বিসিএস ও শিক্ষা ক্যাডারের বৈষম্য

ন্যাশনাল গ্যালারি : রঙতুলির মহাসমুদ্রে একদিন

যুব শক্তি বনাম বেকারত্ব

প্রযুক্তি, আর্থিক পরিকল্পনা ও গণিতের ব্যবহার

ফরাসি বিপ্লব: বৈষম্য নিরসনে সামগ্রিক মুক্তির প্রেরণা

অন্তর্বর্তী সরকারের নিউইয়র্ক সফর

প্রবীণদের যত্ন: নৈতিক দায়িত্ব থেকে সামাজিক শক্তি নির্মাণ

জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের অপরিহার্যতা

জনমিতিক সুবিধা: স্বপ্নের দশক ও নীতিগত সংস্কারের অপরিহার্যতা

বিদ্যালয় ও মাঠ দখলের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের সংগ্রাম

শিক্ষাসংস্কারে চাই সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা

কীটনাশক: জনস্বাস্থ্যের হুমকি

কীটনাশক: জনস্বাস্থ্যের হুমকি

ব্যাংক একীভূতকরণ: আর্থিক খাতের সামনে নতুন বাস্তবতা

দায়িত্বশীল আচরণে গড়ে উঠুক দেশের পর্যটন খাত

এশিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় নতুন সমীকরণ

বাংলাদেশের গিগ অর্থনীতি: উন্নয়নের হাতিয়ার নাকি অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ?

জলাতঙ্ক: প্রতিরোধযোগ্য তবু প্রাণঘাতী

বেড়ে চলা বৈষম্যের দেওয়াল

নৃশংসতার ভিডিও, নীরব দর্শক আর হারিয়ে যাওয়া মানবতা

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা ও জনস্বাস্থ্যের সংকট

জেন জি’র অস্থির অভিযাত্রা

রম্যগদ্য: রবার্ট ব্রুস ও মাকড়শা

জাতিসংঘের নিউইয়র্ক সম্মেলন

বিশ্ব ফুসফুস দিবস: সুস্থ শ্বাসের অঙ্গীকার

সংখ্যার আড়ালে অর্থনীতির অদেখা বাস্তবতা

tab

opinion » post-editorial

ভারতে এসআইআর বিতর্ক

গৌতম রায়

সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ঠিক ১০০ বছর আগে, প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই আরএসএসের একান্ত নিজস্ব রাজনৈতিক লাইন হল- যে কোনও উপায়ে মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা ছড়ানো, বিদ্বেষ ছড়ানো। এক কথায় বলতে গেলে, মুসলমানদের শায়েস্তা করা। তাদের এই রাজনৈতিক চিন্তাটা খাতায়-কলমে অন্তর্ভুক্ত করে সংঘের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক গোলওয়ালকর। মুসলমানমুক্ত ভারতসংঘের এই তাত্ত্বিক অবস্থানকে গোলওয়ালকর ‘সংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’ নামক এক সোনার পাথরবাটির মধ্যে দিয়ে, হিন্দুত্ববাদী চিন্তা ধারার একটি গৃহীত রাজনৈতিক অবস্থান হিসেবে চিহ্নিত করে।

সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ নামক এই রাজনৈতিক অবস্থানই হলো নাগরিকত্ব আইন ঘিরে বিজেপির বিভিন্ন ধরনের কলাকৌশলের প্রধান বিষয়। ভোটার তালিকার সংযোজন-বিয়োজনের নাম করে আজ যে এসআইআর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে ভারতীয় নাগরিকদের উপরে, সেটি হল মূলত ; কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির রাজনৈতিক অবস্থানের একটি ফলশ্রুতি।

বর্তমান নির্বাচন কমিশন পক্ষপাত দোষে দুষ্ট। আরএসএস এবং তার রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি, হিন্দুত্ববাদী ধারায় ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থাকে ভোটারদের প্রভাবিত করবার লক্ষ্যে, ঠিক যেভাবে নির্বাচন কমিশনকে পরিচালিত করতে চায়, নির্বাচন কমিশন ও কমিশনার ঠিক সেইভাবে পরিচালিত হয়। এই নির্বাচন কমিশনের এবং নির্বাচন কমিশনারদের আদৌ কোনও নিরপেক্ষতা নেই ।

অতীতে নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগের ক্ষেত্রে দেশের প্রধানমন্ত্রী , দেশের বিরোধী দলের নেতা এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত কমিটির সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত। বিজেপি সরকার এই ব্যবস্থার পরিবর্তন এনেছে। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের প্যানেলে তারা দেশের প্রধান বিচারপতিকে আর রাখেনি। সেই জায়গায় প্রধানমন্ত্রী নিয়োজিত কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার একজন সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করবার সংস্থান রাখা হয়েছে।

ফলে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়া আর ভারতে দেখতে পাওয়া যায় না। কারণ বিরোধী দলনেতার যে অবস্থানই হোক না কেন, প্রধানমন্ত্রী এবং তার নিয়োজিত, তারই মন্ত্রিসভার সদস্যের অবস্থানের ফলে, নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ সংক্রান্ত কমিটিতে শাসকদলেরই থাকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা। সেখানে স্বাভাবিকভাবেই বিচারের আগেই রায় ঘোষণার মত, দেশের বিরোধীদল নেতার অভিমতটি হয়ে পরিত্যজ্য।

নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ সংক্রান্ত আইনে এই বদল এনে, আঁটঘাট বেঁধেই বিজেপি নির্বাচন কমিশনারকে দিয়ে এসআইআর-এর বিষয়টির অবতারণা করেছে। নানা ধরনের আইনগত সমস্যা, প্রয়োজনীয়তা- ছাপিয়ে তাই এসবের থেকেও যেটা বড় হয়ে উঠেছে; এই ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে গোলওয়ালকারের সংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ তত্ত্বে প্রতিষ্ঠা করবার লক্ষ্য। সরকারি তকমাকে ব্যবহার করে, নির্বাচন কমিশনারের দ্বারা, নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে ভারতকে মুসলমানশূন্য করবার একটা বীভৎস প্রবণতাই এই এসআইআর-এর একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে উঠেছে।

গোলওয়ালকর শুরু করেছিল; ভারতে অবস্থানরত মুসলমানদের ভারতে থাকতে হলে, হয় দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে থাকতে হবে। না হলে তাদের হিন্দুদের অধীনস্থ হয়ে থাকতে হবে। বস্তুতপক্ষে যে কয় বছর ভারতে, বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে, সেই সময়কালে ভারতে অবস্থানরত সহনাগরিক মুসলমানেরা কার্যত রাজনৈতিক হিন্দুদের জিম্মি হয়ে থেকেছেন। এখনও তা-ই থাকছেন। তাদের উপরে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রীত্ব কালে আমরা দেখেছি। সেই সময়, আজকের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ছিলেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। আর আজকের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার একজন বিশিষ্ট সদস্য।

নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আমরা দেখেছি দিল্লি গণহত্যা। এই দিল্লী গণহত্যার জেরে আজও ভারতের সহ নাগরিক বহু বিশিষ্ট মুসলমান মিথ্যা অপবাদে জেল খাটছেন। তরুণ ছাত্র উমর খালিদ হলেন এমনই একজন সহনাগরিক ।

দিল্লি গণহত্যায় আরএসএস - বিজেপি এবং তার সঙ্গী সাথীরা প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থেকেও, সর্বস্ব হারানো মুসলমান সমাজকেই এই গণহত্যার জন্য দায়ী করে, তাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের মামলা- মকদ্দমা ,পুলিশি সন্ত্রাস, আইনি হেনস্থা চালাচ্ছে।

এ সমস্ত গুলিই ছিল এন আর সি, সি এ এ বিরোধী আন্দোলনের একটা প্রতিক্রিয়া। এইযে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন গুলি, তার মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতে অবস্থানরত সহ নাগরিক মুসলমানদের নাগরিকত্ব হরণ করা। দিল্লি গণহত্যা কালে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা , দিল্লির তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিয়ালের নীরবতা - এ সমস্তই কিন্তু আজকে এস আই আর তৈরির পটভূমিকা নির্মাণ করেছে।

এস আই আর , ভোটার তালিকায় বৈজ্ঞানিক কারচুপি-- এই সমস্ত কিছুর পিছনে কিন্তু লুকিয়ে আছে আরএসএস- বিজেপির মুসলমান মুক্ত ভারত করবার রাজনৈতিক কর্মসূচি। মনে রাখা দরকার হিন্দুত্ববাদীরা যে তথাকথিত হিন্দু রাষ্ট্রের কথা বলছে; সেই হিন্দু রাষ্ট্র কিন্তু আপামর শাক্ত- শৈব- বৈষ্ণব ইত্যাদি তরিকায় বিশ্বাসী মানুষজন, যাদেরকে একটা ইউনিফর্ম প্লাটফর্ম হিসেবে হিন্দু বলে পরিগণিত করা হয়- সেইসব মানুষজনদের জন্য নয়। প্রচলিত অর্থে যাদের হিন্দু বলা হয়, তাদের বিভিন্ন তরিকার মানুষদের মধ্যে তাত্ত্বিক অবস্থান এবং ব্যবহারিক প্রয়োগের দিক থেকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরধর্মবিদ্বেষ নেই। পরমত অসহিষ্ণুতা নেই।

কিন্তু এই অংশের মানুষকে নিজেদের রাজনৈতিক সংজ্ঞা অনুযায়ী যাকে হিন্দু বলে দাগিয়ে দিচ্ছে হিন্দুত্ববাদী শক্তি , সেই রাজনৈতিক হিন্দুদের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে আরএসএস বিজেপি দেখে না ।কোনও হিন্দু যদি মুসলমান বিদ্বেষী না হয়, আরএসএস- বিজেপির কাছে সে প্রকৃত হিন্দু নয়। কোনও হিন্দু যদি পবিত্র ইসলামের প্রতি সম্মানজনক- মর্যাদাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলে, তবে সেই ব্যক্তিটি আরএসএসের কাছে, বিজেপির কাছে কখনোই তাদের রাজনৈতিক সংজ্ঞার হিন্দুর সমতুল্য হতে পারে না।

সার্বিক অর্থে আধ্যাত্মিক ধারার ‘হিন্দু’ শব্দটিকে গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির সংকীর্ণ দলীয় ধারার একটি রাজনৈতিক লব্জে পরিণত করেছে। তাদের উদ্দেশ্য হলো; এই রাজনৈতিক হিন্দুদের হাতেই পরিচালিত হোক ভারত। সেভাবে রাজনৈতিক হিন্দুদের দ্বারা ভারতকে পরিচালিত করতেই তারা ভারতের সংবিধানের সার্বিক খোলনোলচে বদলে দিতে চায় ।ভারতের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার সার্বিক পরিম-ল এস আই আর এর মধ্য দিয়ে মুছে দিতে চায়। বিজেপির এই সহনাগরিক মুসলমানদের বেনাগরিক করবার গোটা অভিসন্ধিই হল এস আই আর এর উদ্দেশ্য।

তাই ভোটার তালিকা সংশোধনের নাম করে, ভোটার তালিকা কে পরিচ্ছন্ন করবার নাম করে, সাধারণ মানুষের কাছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পুরনো মদকে নতুন বোতলে এনে পুড়ে পরিবেশন করা হচ্ছে।

বৃহত্তর বাম ঐক্যের প্রশ্নে যে সমস্ত বামপন্থীরা সমবেত হচ্ছে, গোটা হিন্দুত্ববাদী শক্তির অপচেষ্টাকে রুখে দেওয়ার সংকল্প করছে, তাদের মধ্যে সিপিআই(এম)। আর সিপিআইএমের লিবারেশন ছাড়া বামপন্থী দলগুলির পশ্চিমবঙ্গে কোনও জনভিত্তি নেই। এস ইউ সি আই ( কমিউনিস্ট) পশ্চিমবঙ্গ থেকে বামপন্থীদের বিতারিত করবার লক্ষ্যে মমতা ব্যানার্জির সাঙাত হিসেবে কাজ করেছে। মমতা ব্যানার্জির দাক্ষিণ্যে এই দল স্বাধীনতার প্রায় ৭৫ বছর পর প্রথম ভারতীয় সংসদে একজন প্রতিনিধি পাঠাতে সক্ষম হয়েছিল। তারা যখন এসে এই এস আই আর ইত্যাদি সম্পর্কে প্রতিষ্ঠিত বামপন্থীদের পাশে দাঁড়ায়, তখন তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ঘিরে অবশ্যই সন্দেহের অবকাশ থাকে। আর এস পি র মত রাজনৈতিক দল, যারা একটা সময়ে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে ব্যস্ত থেকেছে বামফ্রন্ট সরকার পরিচালনায় সিপিআই(এমে)র নিয়ন্ত্রণকে আলগা করতে। একাজ সম্পাদন করতে আরএসএস- বিজেপির স্বাভাবিক মিত্র মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে টেবিলের তলার সখ্যতা করতেও যারা দ্বিধা করেনি, আর যাই হোক এস আই আর ইত্যাদি ঘিরে বিজেপি বিরোধিতার প্রশ্নে, তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা কখনো প্রশ্নাতীত হতে পারে না।

হিন্দুত্ববাদী শক্তির আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে; গণতন্ত্রকে সঙ সাজিয়ে, ভারতের রাষ্ট্র ক্ষমতাকে, গণতন্ত্রের একটা লেবাস দিয়ে কুক্ষিগত করা। যেভাবে এককালে ইতালিতে মুসোলিনি করেছিল। জার্মানিতে হিটলার করেছিল- ঠিক সেভাবেই । নির্বাচন প্রক্রিয়া টিকেই এমন একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে তারা রূপান্তরিত করতে চায়; যেখানে তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ, আর নানা ধরনের প্রযুক্তির সাহায্যে ভোটারদের মতকে প্রভাবিত করবার ছাড়া দ্বিতীয় অন্য কোনও উপায় থাকবে না।

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির এই মডেলটি তাদের স্বাভাবিক মিত্র তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসবার পর থেকেই সফলভাবে প্রয়োগ করে ফেলেছে। লোকসভা, বিধানসভা ভোট গুলিতে তো এই পদ্ধতি তারা প্রয়োগ করছেই। পৌরসভা পঞ্চায়েত হয়ে, সমবায় সমিতি থেকে শুরু করে ক্লাবের নির্বাচন গুলিতে পর্যন্ত এভাবে ভোটারদের মতকে প্রযুক্তির সাহায্যে তারা বদলে দিচ্ছে। ফলে বিগত ১৫ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে সাধারণ নাগরিকদের মতামতের কোনও প্রতিফলন আমরা এই রাজ্যের কোনও নির্বাচনে একবারের জন্য দেখতে পাচ্ছি না।

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের রাজনৈতিক অবস্থা যত খারাপই হোক, লোকসভা- বিধানসভা থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসন, কোনও স্তরে তারা একজন প্রার্থীকে ও জিতিয়ে আনতে পারবে না- এতটা দুরবস্থা কিন্তু তাদের নয়। আজ গোটা ভারত জুড়ে এস আই আর এর নামে যেভাবে ভোটার তালিকার কারচুপি করছে বিজেপি, ঠিক সেই পদ্ধতিটাই অলিখিতভাবে এতকাল ধরে পশ্চিমবঙ্গের বুকে করে এসেছে তাদের স্বাভাবিক মিত্র তৃণমূল কংগ্রেস।

[লেখক: ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

back to top