মিথুশিলাক মুরমু
প্রশ্ন করা হল, মৌলিক অধিকার কয়টি। শিক্ষার্থীরা উত্তর দিলো: খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং বিনোদন। বছরখানেক আগে গাইবান্ধা, গোবিন্দগঞ্জের বাগদা ফার্মে অবস্থিত ‘শহীদ স্মৃতি শ্যামল-মঙ্গল-রমেশ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ পরিদর্শন করার সুযোগ হয়েছিল। আগেও বহুবার গিয়েছি, কিন্তু সাঁওতাল নেতাদের স্মরণে নির্মিত এই বিদ্যালয়টি আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। বিদ্যালয়ের প্রথম দর্শনে হয়তো পুরোপুরি উজ্জীবিত হতাম না, তবু হতাশও হইনি।
শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চেয়েছিলামÑআমাদের মৌলিক অধিকারগুলো কয়টি এবং কী কী? আদিবাসী সাঁওতাল শিশুদের চোখে-মুখে আত্মবিশ্বাসের ঝলক, দৃঢ় চেতনা এবং উৎফুল্ল চিত্তে তারা উত্তর দিয়েছে। এক ঝাঁক শিশুর দিকে দৃষ্টিপাত করে আমি আশান্বিত হলাম; আজকের শিশুরাই আগামীতে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসবে। স্কুলগামী শিশুরা প্রায়ই দেখেছে তাদের মাÑবাবা, ভাইÑবোনরা অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়েছেন; নিশ্চয়ই ন্যায্যতা, আইনগত বিষয় কিংবা জনস্বার্থের বিষয়গুলো এখানে সংশ্লিষ্ট রয়েছে। অধিকার আদায়ের সচেতনতায় দুর্বৃত্তরা শঙ্কিত হয়েছে; আদিবাসীদের নিরক্ষরতার সুযোগ আর কাজে লাগানো যাবে না। এই পরিস্থিতি বিশ্লেষণের পরই কিছু ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি বিদ্যালয় ও খেলার মাঠ দখল করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
আমরা অত্যন্ত সংক্ষুব্ধ যে, অবহেলিত ও পিছিয়েপড়া জাতিগোষ্ঠী সাঁওতালদের বিদ্যালয় ও খেলার মাঠকে স্থানীয় ভূমিদস্যুরা দখল করার পাঁয়তারা করছেন, এবং তা রোধ করতে আদিবাসীরা টিএনও’র (উপজেলা নির্বাহী অফিসার) কার্যালয়ে ধর্ণা দিচ্ছেন। বিস্ময়ের বিষয় হলো, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা থেকে খুবই দূরের ঘটনা নয়Ñপ্রশাসনের চোখের সামনে বিদ্যালয় লুণ্ঠিত হচ্ছে। তারপরও যেন কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙছে না। এটা কি অবহেলা, না প্রচ্ছন্ন সমর্থন? প্রকাশ্য দিবালোকে দখলবাজরা বিদ্যালয়ে তালা ঝুলিয়েছে। দুর্বৃত্তদের দাপটে বিদ্যালয়ের শিশুরা আতঙ্কিত, অভিভাবকরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। একদিকে মৌলিক অধিকারÑশিক্ষা ও বিনোদনসহ নানা দাবি; অন্যদিকে অর্থ-সম্পদ দখলের চক্রান্ত।
আদিবাসী নারী-পুরুষরা তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ বিবেচনায় টিএনওর কাছে স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে প্রদত্ত স্মারকলিপিতে বলা হয়েছেÑ‘স্থানীয় ভূমিদস্যু আতাউর রহমান সাবুর নেতৃত্বে তার সহযোগী সন্ত্রাসীরা আদিবাসী শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাওয়া-আসায় বাধা প্রদান করছে। ফলে শিশুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এমনকি সন্ত্রাসীরা মাঠে শিশুকে খেলারও নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। তারা স্কুলের আসবাবপত্র নষ্ট করছে এবং অভিভাবকদের হুমকিও দিচ্ছে।... ভূমিদস্যুদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ, আদিবাসী শিশুদের স্কুল ও খেলার মাঠ দখলমুক্ত করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জোর দাবি জানানো হয়েছে।’
ইতোপূর্বে ২০ সেপ্টেম্বর (শনিবার) জয়পুরপাড়াÑবাগদা ফার্ম এলাকায় অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা সমাবেশ করেছিলেন। আদিবাসী সাঁওতালরা সর্বশক্তি দিয়ে বিদ্যালয় ও খেলার মাঠ রক্ষার্থে রাজপথে নেমেছেন। ২৪ সেপ্টেম্বর টিএনও অফিস অভিমুখে যাত্রাকালে তাদের হাতে ছিল তীর-ধনুক, মাদল-ধঠমাসা, করতাল-বাঁশি এবং অসংখ্য বাদ্যযন্ত্রÑএগুলো ছিল তাদের আত্মমর্যাদা ও আত্মরক্ষার চিরস্থায়ী সম্বল। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বার্থ বিঘিœত হবার সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর নিরবতাও আমাদেরকে হতাশ করেছে। আমরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলাম। এখন যা ঘটছে তা হতাশাজনক। প্রান্তিক স্তরের আদিবাসীদের মূল প্রবাহের সঙ্গে মিলিয়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষা তো জাতির মেরুদ-। আমরা কি আদিবাসী সাঁওতালদের মেরুদ- ভেঙে দিতে বসেছি? বিদ্যালয়ের আশপাশের কয়েকটি গ্রামের শিশুরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছেÑতার নৈতিক দায়ভার আমরা কেউই এড়িয়ে যেতে পারি না। একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের নিরবতা এবং দুর্বৃত্তদের উত্থান আমাদের কাছে এক চরম শঙ্কার লক্ষণ।
২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৬ নভেম্বর সরকারি পুলিশবাহিনী প্রকাশ্যে, দিবালোকে পাখি শিকারের মতো গুলি চালায়; বাগদা ফার্মের আওতায় ১৮৪২.৩০ একর জমি আদিবাসীদের কাছ থেকে দখলমুক্ত করতে গিয়ে শ্যামল-মঙ্গল-রমেশ নামধারী কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। আদিবাসীদের শত শত ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের চুক্তি অনুযায়ী সরকার আদিবাসীদের রিকুইজিশনকৃত সম্পত্তি ফিরিয়ে দেয়নি। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ঐ চুক্তিতে উল্লেখ করেছিলÑ‘যদি আখচাষ বন্ধ হয় তবে জমিগুলো প্রকৃত মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হবে।’ ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে চিনিকল বন্ধ হয়ে গেলেও সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি। ১৯৬২ সালে মহিমাগঞ্জ সুগার মিলের জন্য ১৫টি আদিবাসী এবং ৫টি বাঙালি গ্রামকে উদ্বাস্তু হতে হয়েছিল। আদিবাসীদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ যেন থামছে না; অধিকার আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতি মুছে ফেলার ষড়যন্ত্রও নতুন করে জোড় পাচ্ছে।
আদিবাসীদের জীবনে রয়েছে বঞ্চনা, হতাশা, উচ্ছেদের আশঙ্কা, হত্যাÑধর্ষণ ও গুম হওয়ার হুমকি। আদিবাসী নেতা ডা. ফিলিমন বাস্কের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, গাইবান্ধার এই ভূমিসংঘাত শুধুমাত্র আঞ্চলিক নয়; এটি আইনের শাসন, মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের পরীক্ষা। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, প্রশাসনিক উদাসীনতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি এই সমস্যা বারবার ফিরিয়ে নিয়ে আসে। যদি এই চলমান সংকটের স্থায়ী সমাধান না করা হয়, ভবিষ্যতে আরও সংঘাতের ঝুঁকি বাড়বে।
গাইবান্ধার সাত উপজেলায় সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে প্রায় সাতশ’টির মতো স্কুলÑকলেজÑমাদ্রাসাÑকারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অনুমেয় যে, আদিবাসী ব্যাক্তিদের নামে ‘শহীদ স্মৃতি শ্যামল-মঙ্গল-রমেশ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ এক ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠান। এই ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব রয়েছে অত্র অঞ্চলের সর্বস্তরের জনসাধারণের ওপর। শিক্ষা বঞ্চিত আদিবাসীদের শিক্ষার আলোয় বিকশিত হতে যে পরিবেশ প্রয়োজন, তা স্থানীয় প্রশাসনের দ্বারা নিশ্চিত করা জরুরি। সার্বজনীন শিক্ষার শ্লোগানগুলোÑ‘শিক্ষা নিয়ে গড়বো দেশ, তোমারÑআমার বাংলাদেশ’, ‘শিক্ষাই আলো, ঘরে ঘরে জ্বালো’, ‘লেখাপড়ার বিকল্প নেই, চলো সবাই স্কুলে যাই’ এবং ‘একীভূত শিক্ষা, হোক মোদের দীক্ষা’Ñএসব আমাদেরকেও অনুপ্রাণিত করে।
আশা করি, বাগদা ফার্মের ‘শহীদ স্মৃতি শ্যামল-মঙ্গল-রমেশ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ থেকে আগামী একদিন শিক্ষিত, নীতি ও আদর্শবান নেতা বেরিয়ে আসবেন; তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে ন্যায্যতা। তাহলেই সাঁওতাল শহীদ শ্যামলÑমঙ্গলÑরমেশের বিদেহী আত্মা শান্তি পাবে।
[লেখক: কলামিস্ট]
মিথুশিলাক মুরমু
সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
প্রশ্ন করা হল, মৌলিক অধিকার কয়টি। শিক্ষার্থীরা উত্তর দিলো: খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং বিনোদন। বছরখানেক আগে গাইবান্ধা, গোবিন্দগঞ্জের বাগদা ফার্মে অবস্থিত ‘শহীদ স্মৃতি শ্যামল-মঙ্গল-রমেশ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ পরিদর্শন করার সুযোগ হয়েছিল। আগেও বহুবার গিয়েছি, কিন্তু সাঁওতাল নেতাদের স্মরণে নির্মিত এই বিদ্যালয়টি আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। বিদ্যালয়ের প্রথম দর্শনে হয়তো পুরোপুরি উজ্জীবিত হতাম না, তবু হতাশও হইনি।
শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চেয়েছিলামÑআমাদের মৌলিক অধিকারগুলো কয়টি এবং কী কী? আদিবাসী সাঁওতাল শিশুদের চোখে-মুখে আত্মবিশ্বাসের ঝলক, দৃঢ় চেতনা এবং উৎফুল্ল চিত্তে তারা উত্তর দিয়েছে। এক ঝাঁক শিশুর দিকে দৃষ্টিপাত করে আমি আশান্বিত হলাম; আজকের শিশুরাই আগামীতে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসবে। স্কুলগামী শিশুরা প্রায়ই দেখেছে তাদের মাÑবাবা, ভাইÑবোনরা অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়েছেন; নিশ্চয়ই ন্যায্যতা, আইনগত বিষয় কিংবা জনস্বার্থের বিষয়গুলো এখানে সংশ্লিষ্ট রয়েছে। অধিকার আদায়ের সচেতনতায় দুর্বৃত্তরা শঙ্কিত হয়েছে; আদিবাসীদের নিরক্ষরতার সুযোগ আর কাজে লাগানো যাবে না। এই পরিস্থিতি বিশ্লেষণের পরই কিছু ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি বিদ্যালয় ও খেলার মাঠ দখল করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
আমরা অত্যন্ত সংক্ষুব্ধ যে, অবহেলিত ও পিছিয়েপড়া জাতিগোষ্ঠী সাঁওতালদের বিদ্যালয় ও খেলার মাঠকে স্থানীয় ভূমিদস্যুরা দখল করার পাঁয়তারা করছেন, এবং তা রোধ করতে আদিবাসীরা টিএনও’র (উপজেলা নির্বাহী অফিসার) কার্যালয়ে ধর্ণা দিচ্ছেন। বিস্ময়ের বিষয় হলো, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা থেকে খুবই দূরের ঘটনা নয়Ñপ্রশাসনের চোখের সামনে বিদ্যালয় লুণ্ঠিত হচ্ছে। তারপরও যেন কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙছে না। এটা কি অবহেলা, না প্রচ্ছন্ন সমর্থন? প্রকাশ্য দিবালোকে দখলবাজরা বিদ্যালয়ে তালা ঝুলিয়েছে। দুর্বৃত্তদের দাপটে বিদ্যালয়ের শিশুরা আতঙ্কিত, অভিভাবকরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। একদিকে মৌলিক অধিকারÑশিক্ষা ও বিনোদনসহ নানা দাবি; অন্যদিকে অর্থ-সম্পদ দখলের চক্রান্ত।
আদিবাসী নারী-পুরুষরা তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ বিবেচনায় টিএনওর কাছে স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে প্রদত্ত স্মারকলিপিতে বলা হয়েছেÑ‘স্থানীয় ভূমিদস্যু আতাউর রহমান সাবুর নেতৃত্বে তার সহযোগী সন্ত্রাসীরা আদিবাসী শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাওয়া-আসায় বাধা প্রদান করছে। ফলে শিশুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এমনকি সন্ত্রাসীরা মাঠে শিশুকে খেলারও নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। তারা স্কুলের আসবাবপত্র নষ্ট করছে এবং অভিভাবকদের হুমকিও দিচ্ছে।... ভূমিদস্যুদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ, আদিবাসী শিশুদের স্কুল ও খেলার মাঠ দখলমুক্ত করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জোর দাবি জানানো হয়েছে।’
ইতোপূর্বে ২০ সেপ্টেম্বর (শনিবার) জয়পুরপাড়াÑবাগদা ফার্ম এলাকায় অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা সমাবেশ করেছিলেন। আদিবাসী সাঁওতালরা সর্বশক্তি দিয়ে বিদ্যালয় ও খেলার মাঠ রক্ষার্থে রাজপথে নেমেছেন। ২৪ সেপ্টেম্বর টিএনও অফিস অভিমুখে যাত্রাকালে তাদের হাতে ছিল তীর-ধনুক, মাদল-ধঠমাসা, করতাল-বাঁশি এবং অসংখ্য বাদ্যযন্ত্রÑএগুলো ছিল তাদের আত্মমর্যাদা ও আত্মরক্ষার চিরস্থায়ী সম্বল। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বার্থ বিঘিœত হবার সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর নিরবতাও আমাদেরকে হতাশ করেছে। আমরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলাম। এখন যা ঘটছে তা হতাশাজনক। প্রান্তিক স্তরের আদিবাসীদের মূল প্রবাহের সঙ্গে মিলিয়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষা তো জাতির মেরুদ-। আমরা কি আদিবাসী সাঁওতালদের মেরুদ- ভেঙে দিতে বসেছি? বিদ্যালয়ের আশপাশের কয়েকটি গ্রামের শিশুরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছেÑতার নৈতিক দায়ভার আমরা কেউই এড়িয়ে যেতে পারি না। একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের নিরবতা এবং দুর্বৃত্তদের উত্থান আমাদের কাছে এক চরম শঙ্কার লক্ষণ।
২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৬ নভেম্বর সরকারি পুলিশবাহিনী প্রকাশ্যে, দিবালোকে পাখি শিকারের মতো গুলি চালায়; বাগদা ফার্মের আওতায় ১৮৪২.৩০ একর জমি আদিবাসীদের কাছ থেকে দখলমুক্ত করতে গিয়ে শ্যামল-মঙ্গল-রমেশ নামধারী কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। আদিবাসীদের শত শত ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের চুক্তি অনুযায়ী সরকার আদিবাসীদের রিকুইজিশনকৃত সম্পত্তি ফিরিয়ে দেয়নি। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ঐ চুক্তিতে উল্লেখ করেছিলÑ‘যদি আখচাষ বন্ধ হয় তবে জমিগুলো প্রকৃত মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হবে।’ ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে চিনিকল বন্ধ হয়ে গেলেও সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি। ১৯৬২ সালে মহিমাগঞ্জ সুগার মিলের জন্য ১৫টি আদিবাসী এবং ৫টি বাঙালি গ্রামকে উদ্বাস্তু হতে হয়েছিল। আদিবাসীদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ যেন থামছে না; অধিকার আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতি মুছে ফেলার ষড়যন্ত্রও নতুন করে জোড় পাচ্ছে।
আদিবাসীদের জীবনে রয়েছে বঞ্চনা, হতাশা, উচ্ছেদের আশঙ্কা, হত্যাÑধর্ষণ ও গুম হওয়ার হুমকি। আদিবাসী নেতা ডা. ফিলিমন বাস্কের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, গাইবান্ধার এই ভূমিসংঘাত শুধুমাত্র আঞ্চলিক নয়; এটি আইনের শাসন, মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের পরীক্ষা। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, প্রশাসনিক উদাসীনতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি এই সমস্যা বারবার ফিরিয়ে নিয়ে আসে। যদি এই চলমান সংকটের স্থায়ী সমাধান না করা হয়, ভবিষ্যতে আরও সংঘাতের ঝুঁকি বাড়বে।
গাইবান্ধার সাত উপজেলায় সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে প্রায় সাতশ’টির মতো স্কুলÑকলেজÑমাদ্রাসাÑকারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অনুমেয় যে, আদিবাসী ব্যাক্তিদের নামে ‘শহীদ স্মৃতি শ্যামল-মঙ্গল-রমেশ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ এক ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠান। এই ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব রয়েছে অত্র অঞ্চলের সর্বস্তরের জনসাধারণের ওপর। শিক্ষা বঞ্চিত আদিবাসীদের শিক্ষার আলোয় বিকশিত হতে যে পরিবেশ প্রয়োজন, তা স্থানীয় প্রশাসনের দ্বারা নিশ্চিত করা জরুরি। সার্বজনীন শিক্ষার শ্লোগানগুলোÑ‘শিক্ষা নিয়ে গড়বো দেশ, তোমারÑআমার বাংলাদেশ’, ‘শিক্ষাই আলো, ঘরে ঘরে জ্বালো’, ‘লেখাপড়ার বিকল্প নেই, চলো সবাই স্কুলে যাই’ এবং ‘একীভূত শিক্ষা, হোক মোদের দীক্ষা’Ñএসব আমাদেরকেও অনুপ্রাণিত করে।
আশা করি, বাগদা ফার্মের ‘শহীদ স্মৃতি শ্যামল-মঙ্গল-রমেশ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ থেকে আগামী একদিন শিক্ষিত, নীতি ও আদর্শবান নেতা বেরিয়ে আসবেন; তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে ন্যায্যতা। তাহলেই সাঁওতাল শহীদ শ্যামলÑমঙ্গলÑরমেশের বিদেহী আত্মা শান্তি পাবে।
[লেখক: কলামিস্ট]