alt

opinion » post-editorial

জনমিতিক সুবিধা: স্বপ্নের দশক ও নীতিগত সংস্কারের অপরিহার্যতা

মতিউর রহমান

: বুধবার, ০১ অক্টোবর ২০২৫

বাংলাদেশ বর্তমানে এমন এক জনসংখ্যাগত কাঠামো উপভোগ করছে, যা দ্রুত ও টেকসই উন্নয়নের জন্য এক বিরল সুবিধা সৃষ্টি করেছে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউ.এন.এফ.পি.এ.)-এর তথ্যমতে, ১৭৫.৭ মিলিয়নেরও বেশি মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ ১১৫ মিলিয়নেরও অধিক মানুষ, ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী কর্মক্ষম গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।

নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীÑশিশু ও বয়স্কÑসাপেক্ষে এই বিশাল কর্মক্ষম জনশক্তির আনুপাতিক আধিক্যই হলো সেই ‘জনসংখ্যাগত সুবিধা’ বা ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’। যদি সঠিক নীতি ও যথাযথ বিনিয়োগের মাধ্যমে এই সুবিধা পুরোপুরি কাজে লাগানো যায়, তবে তা বাংলাদেশকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার পথে এক শক্তিশালী চালক হতে পারে। এই সুবিধা কেবল সংখ্যাগত নয়, বরং জাতীয় আকাক্সক্ষা, উদ্ভাবনী শক্তি এবং অর্থনৈতিক কাঠামোগত পরিবর্তনের একটি গতিশীল সম্ভাবনাকে নির্দেশ করে।

এই বিশাল জনসংখ্যাগত সুযোগের কেন্দ্রে রয়েছে দেশের বিপুল যুব সমাজ। প্রায় ৫০ মিলিয়ন ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সী এবং ৩৩ মিলিয়ন কিশোর-কিশোরী নিয়ে গঠিত এই যুবশক্তি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং সামাজিক আধুনিকীকরণের মূল চালিকাশক্তি। এই প্রজন্ম প্রযুক্তিগত পরিবর্তনকে দ্রুত গ্রহণ করতে সক্ষম এবং বৈশ্বিক প্রবণতাগুলোর সঙ্গে সহজেই মানিয়ে নিতে পারদর্শী। তারা কেবল শ্রমশক্তির জোগানদাতা নয়, বরং নতুন উদ্ভাবন, উদ্যোক্তা শক্তি এবং ডিজিটাল অর্থনীতিতে প্রবেশাধিকারের প্রতীক।

তথ্যপ্রযুক্তি, ডিজিটাল পরিষেবা এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির মতো উত্থানশীল খাতগুলিতে এই যুবশক্তির সক্রিয় অংশগ্রহণ দেশকে নতুন বৈশ্বিক মানচিত্রে প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

তবে, এই প্রাকৃতিক শক্তিকে উৎপাদনশীল পুঁজি বা ‘মানবসম্পদে’ রূপান্তরিত করার জন্য একটি কৌশলগত ও সুদূরপ্রসারী জাতীয় বিনিয়োগ পরিকল্পনা অপরিহার্য। এই সুবিধা অলৌকিকভাবে অর্জিত হবে না; এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং দক্ষতা উন্নয়নে লক্ষ্যভিত্তিক ও ধারাবাহিক সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগ।

যদি এই সম্ভাবনা অব্যবহৃত থেকে যায়, তবে জনসংখ্যাগত সুবিধা পরিণত হতে পারে বেকারত্ব, সামাজিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক স্থবিরতার এক ভয়াবহ বোঝায়, যা ‘সমাজ-অর্থনৈতিক চাপ’ সৃষ্টি করতে পারে।

জনসংখ্যাগত সুবিধা অর্জনের পথে বাংলাদেশের সামনে বেশ কিছু গুরুতর সামাজিক ও কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান, যা এই সম্ভাবনার সম্পূর্ণ বাস্তবায়নকে সীমিত করতে পারে।

দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রতিবন্ধকতা হলো বাল্যবিবাহ বা কমবয়সী বিবাহ। এটি বিশেষ করে গ্রামীণ ও নিম্ন আয়ের পরিবারগুলিতে মেয়েদের শিক্ষাগত এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে। আইনগত বয়সের আগেই মেয়েদের বিবাহিত হয়ে যাওয়া তাদের পূর্ণাঙ্গ শ্রমবাজারে অংশগ্রহণকে সীমিত করে এবং দারিদ্র্যের চক্রকে আরও শক্তিশালী করে। এই অচলায়তন ভাঙতে কঠোর আইন প্রয়োগ, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মেয়েদের জন্য অর্থনৈতিক প্রণোদনা অপরিহার্য।

একইসাথে, যুব সমাজের জন্য প্রজনন স্বাস্থ্যসেবায় সীমিত প্রবেশাধিকার এবং নিম্নমানের যৌনশিক্ষা একটি বড় সমস্যার সৃষ্টি করে। প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে সঠিক জ্ঞান ও সম্পদের অভাব তাদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যুব-বান্ধব চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির আধুনিকায়ন এবং মাধ্যমিক স্তরে কার্যকর যৌনশিক্ষার প্রবর্তন করে একটি স্বাস্থ্যবান ও উৎপাদনশীল যুব সমাজ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

মানবসম্পদ বিকাশের মূল ভিত্তি হলো শিক্ষা, কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষার হার বাড়লেও মানের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঘাটতি বিদ্যমান। সবচেয়ে বড় সংকট হলো, প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা দেশের ক্রমবর্ধমান ও পরিবর্তিত শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী যুবকদেরকে প্রস্তুত করতে পারছে না।

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বিপুল শিক্ষার্থীর চাপ, দুর্বল অবকাঠামো এবং প্রশিক্ষিত শিক্ষকের ঘাটতির শিকার। ফলস্বরূপ, শিক্ষার্থীরা এমন দক্ষতা নিয়ে স্নাতক হচ্ছে যা একবিংশ শতাব্দীর বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতিতে অপ্রয়োজনীয় বা অপ্রতুল।

কারিগরি ও পেশাগত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি (টি.ভি.ই.টি.) থাকলেও তা আধুনিক প্রযুক্তি, বিশেষত নবায়নযোগ্য শক্তি, ইলেকট্রনিক্স এবং তথ্যপ্রযুক্তি সেবা খাতের উচ্চ দক্ষতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই ‘দক্ষতার অভাব’ যুবকদেরকে উচ্চ বেতনের চাকরি এবং দেশের অর্থনীতিকে উচ্চ উৎপাদনশীলতার দিকে নিয়ে যেতে বাধা দেয়।

এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় শিক্ষা পাঠ্যসূচির আমূল পরিবর্তন, কারিগরি প্রশিক্ষণে ব্যাপক সরকারি বিনিয়োগ এবং শিল্প-শিক্ষার মধ্যে গভীর সহযোগিতা স্থাপন জরুরি।

জনসংখ্যাগত সুবিধা কার্যকরভাবে অর্জনের জন্য দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তন আনা অপরিহার্য। এই পরিবর্তন গতানুগতিক নিম্নমূল্যের উৎপাদনের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে উচ্চ উৎপাদনশীলতা, বৈচিত্র্য এবং উদ্ভাবনের দিকে মনোনিবেশ করবে। এর অর্থ হলো, শ্রমনির্ভর শিল্প থেকে সরে এসে এমন খাতগুলিতে গুরুত্ব দিতে হবে, যেখানে অধিক মূলধন বিনিয়োগ এবং উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার হয়। যেমনÑতথ্যপ্রযুক্তি, ইলেকট্রনিকস, হালকা প্রকৌশল এবং পরিবেশবান্ধব উৎপাদন।

এই রূপান্তর ঘটাতে হলে বেসরকারি খাতে প্রতিযোগিতা বাড়ানো, প্রশাসনিক জটিলতা কমানো এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে দক্ষতাভিত্তিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা প্রয়োজন। উৎপাদনশীলতা বাড়াতে এবং পণ্যের মান উন্নত করতে গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানো এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের জন্য বাণিজ্য নীতিতে সংস্কার আনা জরুরি। শুধুমাত্র শ্রমের সহজলভ্যতার ওপর নির্ভর না করে, শ্রমশক্তিকে উচ্চমূল্যের কাজে ব্যবহার করার মাধ্যমেই বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টেকসই করতে এবং উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে।

তৈরি পোশাক শিল্প (আর.এম.জি.) নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অর্থনীতির চালক হিসেবে লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। তবে, কেবল কম মজুরিভিত্তিক উৎপাদনের ওপর দীর্ঘমেয়াদী নির্ভরতা অর্থনীতির স্থায়িত্বের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বৈশ্বিক বাজারের অনিশ্চয়তা এবং স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির আবির্ভাব এই খাতের ভবিষ্যতকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।

জনসংখ্যাগত সুবিধা পুরোপুরি কাজে লাগাতে হলে দেশকে উচ্চ মান সংযোজনকারী শিল্পগুলির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে: ঔষধ শিল্প (ফার্মাসিউটিক্যালস), যেখানে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মান অর্জন করেছে; দ্রুত বর্ধনশীল তথ্যপ্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তি-ভিত্তিক পরিষেবা (আই.টি.ই.এস.); জাহাজ নির্মাণ শিল্প; এবং উদীয়মান সবুজ প্রযুক্তি ও নবায়নযোগ্য শক্তি খাত।

এই শিল্পগুলিতে যুবদেরকে দক্ষ করার জন্য বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং গবেষণা ও উন্নয়নে (আর অ্যান্ড ডি) সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি আবশ্যক। এর মাধ্যমে অর্থনীতিকে কেবল একটি খাতের ওপর নির্ভরশীলতার ঝুঁকি থেকে মুক্ত করা সম্ভব এবং একই সাথে উচ্চ উৎপাদনশীল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

কর্মসংস্থান সৃষ্টির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শুধু চাকরির বাজার সম্প্রসারণই যথেষ্ট নয়, বরং দেশজুড়ে উদ্যোক্তা সংস্কৃতিকে উৎসাহ দিতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এস.এম.ই.) হলো কর্মসংস্থান সৃষ্টির সবচেয়ে শক্তিশালী উৎস। যুব উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ, ঝুঁকি মূলধন বা উদ্যোগ মূলধন (ভেঞ্চার ক্যাপিটাল)-এ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা, পরামর্শ প্রদান এবং বাজার সংযোগের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা প্রয়োজন।

বিশেষ করে প্রযুক্তি-ভিত্তিক ‘নতুন উদ্যোগের’ (স্টার্টআপ) সংস্কৃতিকে পৃষ্ঠপোষকতা করা জরুরি, যা উদ্ভাবনের মাধ্যমে অর্থনীতির নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। যুব সমাজকে চাকরির খোঁজে না ছুটে চাকরি সৃষ্টির দিকে মনোনিবেশ করতে উৎসাহিত করা এই জনসংখ্যাগত সুবিধার পূর্ণাঙ্গ ব্যবহারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

জনসংখ্যাগত সুবিধার পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে লিঙ্গ সমতা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিমালার মাধ্যমে একটি সহায়ক সামাজিক ও প্রশাসনিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

নারীদের শ্রমবাজারে পূর্ণ অংশগ্রহণ কেবল শ্রমশক্তির আকারই বাড়ায় না, বরং পরিবারের আয় বৃদ্ধি করে এবং সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি উন্নত করে। নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণের হার বাড়লেও সামাজিক বিধিনিষেধ, লিঙ্গভিত্তিক মজুরি বৈষম্য, শিশুপালন ও গৃহস্থালির কাজের বোঝা এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা উদ্বেগ তাদের পূর্ণ সক্ষমতা প্রকাশে বাধা দেয়।

এই বাধা অপসারণের জন্য নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আইনি সংস্কার, নারী-বান্ধব কর্মপরিবেশ সৃষ্টি, সাশ্রয়ী ও মানসম্মত শিশুর যতœ সুবিধার প্রসার এবং জেন্ডার সংবেদনশীল দক্ষতা উন্নয়ন উদ্যোগ প্রয়োজন। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক কাঠামো ভেঙে, তাদের জন্য সমান সুযোগ এবং নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত করার মাধ্যমেই দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়ন টেকসই করা সম্ভব।

মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জি.ডি.পি.) অনুপাতে বাজেট বরাদ্দ বর্তমানে আন্তর্জাতিক মানদ-ের তুলনায় যথেষ্ট কম। এই বাজেট বৃদ্ধি এবং অর্থের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। কাঠামোগত ঘাটতি পূরণের জন্য কেবল অর্থ ঢালা নয়, বরং সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং নীতি বাস্তবায়নের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি নিশ্চিত করবে যেন গ্রামীণ যুবক, নারী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং সমাজের প্রান্তিক অংশীদাররা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়। এই ক্ষেত্রে ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি একটি শক্তিশালী হাতিয়ার, যা অনলাইন শিক্ষা, ই-শাসন পরিষেবা এবং ডিজিটাল দক্ষতা প্রশিক্ষণকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে দিতে পারে। এর ফলে আঞ্চলিক বৈষম্য কমিয়ে আনা সম্ভব হবে এবং জনসংখ্যার সকল স্তরের অংশগ্রহণের মাধ্যমে জনসংখ্যাগত সুবিধার পূর্ণাঙ্গ সুফল লাভ করা যাবে।

যুবকদেরকে কেবল নীতি ও কর্মসূচির সুবিধাভোগী না ভেবে, বরং নীতি প্রণয়নের অংশীদার হিসেবে যুক্ত করা উচিত। যখন যুবকদের মতামত ও আকাক্সক্ষা অনুযায়ী কর্মসূচি তৈরি করা হয়, তখন তার কার্যকারিতা বহুগুণে বৃদ্ধি পায় এবং তা তাদের বাস্তব চাহিদা পূরণে অধিক সক্ষম হয়। যুব সংগঠন এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সাথে নিয়মিত আলোচনার মাধ্যমে একটি কার্যকর এবং প্রতিক্রিয়াশীল শাসন ব্যবস্থা তৈরি করা অপরিহার্য।

এই অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতি নিশ্চিত করবে যে, জনসংখ্যাগত সুবিধা অর্জনের কৌশলগুলি কেবল উপর থেকে চাপানো নয়, বরং সমাজের সবচেয়ে গতিশীল অংশের সক্রিয় সহযোগিতা ও সম্মতির ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে।

জনসংখ্যাগত সুবিধা স্থায়ী নয়; এটি একটি ‘সময়সীমাযুক্ত জানালা’ যা দ্রুত বন্ধ হয়ে আসছে। বাংলাদেশের জন্মহার হ্রাস পাওয়ায় এবং প্রবীণ জনগোষ্ঠীর অনুপাত বাড়তে থাকায়, বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন যে এই সুবিধার ‘স্বর্ণালী দশক’ ২০৪০ সালের কাছাকাছি সময়ে শেষ হয়ে যেতে পারে।

প্রবীণ জনগোষ্ঠীর অনুপাত ইতিমধ্যে প্রায় ৭%-এ পৌঁছেছে এবং তা দ্রুত বাড়ছে। এই প্রবণতা ইঙ্গিত দেয় যে, হাতে মাত্র ১৫ থেকে ২০ বছর সময় রয়েছে এই সুবিধার পূর্ণ ফসল ঘরে তোলার জন্য। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে যদি কৌশলগত পদক্ষেপ এবং বিনিয়োগ নিশ্চিত করা না যায়, তবে এই বিশাল সুযোগ কাজে লাগানো অসম্ভব হবে।

এই সীমিত সময়ের মধ্যে যদি দ্রুত, সমন্বিত এবং ধারাবাহিক পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে এই জনসংখ্যাগত সুবিধা হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। ব্যর্থতার অর্থ হবে বিপুল সংখ্যক যুবকের দীর্ঘমেয়াদী বেকারত্ব, সামাজিক চাপ এবং দেশের উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা।

তাই, মানবসম্পদ উন্নয়ন, অবকাঠামোতে কৌশলগত বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তির মতো মূল ক্ষেত্রগুলিতে জাতীয় অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিনিয়োগ প্রয়োজন। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি, সমাজ এবং গণতন্ত্রের স্থায়িত্ব নির্ভর করছে এই স্বর্ণালী দশকটিকে কীভাবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজে লাগানো হয় তার ওপর। এটি কেবল একটি অর্থনৈতিক সুযোগ নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব।

[লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় জনগণের ভূমিকা উপেক্ষিত

শ্রমজীবী মানুষের শোভন কর্মসংস্থান

মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় বাংলাদেশের বাস্তবতা

প্রবারণার আলোয় আলোকিত হোক মানবজাতি

অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে ওয়াশিংটনের শেষ সুযোগ?

পাহাড় থেকে সমতল: আদিবাসী নারীর নিরাপত্তা

সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ সংস্কৃতি: আসক্তি নাকি নতুন যোগাযোগ?

জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যু

মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক পরিবর্তন: আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি

রম্যগদ্য: “কেশ ফ্যালায় ভাই, কেশ ফ্যালায়...”

লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থীর অধিকার: বিসিএস ও শিক্ষা ক্যাডারের বৈষম্য

ন্যাশনাল গ্যালারি : রঙতুলির মহাসমুদ্রে একদিন

যুব শক্তি বনাম বেকারত্ব

প্রযুক্তি, আর্থিক পরিকল্পনা ও গণিতের ব্যবহার

ফরাসি বিপ্লব: বৈষম্য নিরসনে সামগ্রিক মুক্তির প্রেরণা

অন্তর্বর্তী সরকারের নিউইয়র্ক সফর

প্রবীণদের যত্ন: নৈতিক দায়িত্ব থেকে সামাজিক শক্তি নির্মাণ

জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের অপরিহার্যতা

বিদ্যালয় ও মাঠ দখলের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের সংগ্রাম

শিক্ষাসংস্কারে চাই সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা

ভারতে এসআইআর বিতর্ক

কীটনাশক: জনস্বাস্থ্যের হুমকি

কীটনাশক: জনস্বাস্থ্যের হুমকি

ব্যাংক একীভূতকরণ: আর্থিক খাতের সামনে নতুন বাস্তবতা

দায়িত্বশীল আচরণে গড়ে উঠুক দেশের পর্যটন খাত

এশিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় নতুন সমীকরণ

বাংলাদেশের গিগ অর্থনীতি: উন্নয়নের হাতিয়ার নাকি অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ?

জলাতঙ্ক: প্রতিরোধযোগ্য তবু প্রাণঘাতী

বেড়ে চলা বৈষম্যের দেওয়াল

নৃশংসতার ভিডিও, নীরব দর্শক আর হারিয়ে যাওয়া মানবতা

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা ও জনস্বাস্থ্যের সংকট

জেন জি’র অস্থির অভিযাত্রা

রম্যগদ্য: রবার্ট ব্রুস ও মাকড়শা

জাতিসংঘের নিউইয়র্ক সম্মেলন

বিশ্ব ফুসফুস দিবস: সুস্থ শ্বাসের অঙ্গীকার

সংখ্যার আড়ালে অর্থনীতির অদেখা বাস্তবতা

tab

opinion » post-editorial

জনমিতিক সুবিধা: স্বপ্নের দশক ও নীতিগত সংস্কারের অপরিহার্যতা

মতিউর রহমান

বুধবার, ০১ অক্টোবর ২০২৫

বাংলাদেশ বর্তমানে এমন এক জনসংখ্যাগত কাঠামো উপভোগ করছে, যা দ্রুত ও টেকসই উন্নয়নের জন্য এক বিরল সুবিধা সৃষ্টি করেছে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউ.এন.এফ.পি.এ.)-এর তথ্যমতে, ১৭৫.৭ মিলিয়নেরও বেশি মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ ১১৫ মিলিয়নেরও অধিক মানুষ, ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী কর্মক্ষম গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।

নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীÑশিশু ও বয়স্কÑসাপেক্ষে এই বিশাল কর্মক্ষম জনশক্তির আনুপাতিক আধিক্যই হলো সেই ‘জনসংখ্যাগত সুবিধা’ বা ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’। যদি সঠিক নীতি ও যথাযথ বিনিয়োগের মাধ্যমে এই সুবিধা পুরোপুরি কাজে লাগানো যায়, তবে তা বাংলাদেশকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার পথে এক শক্তিশালী চালক হতে পারে। এই সুবিধা কেবল সংখ্যাগত নয়, বরং জাতীয় আকাক্সক্ষা, উদ্ভাবনী শক্তি এবং অর্থনৈতিক কাঠামোগত পরিবর্তনের একটি গতিশীল সম্ভাবনাকে নির্দেশ করে।

এই বিশাল জনসংখ্যাগত সুযোগের কেন্দ্রে রয়েছে দেশের বিপুল যুব সমাজ। প্রায় ৫০ মিলিয়ন ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সী এবং ৩৩ মিলিয়ন কিশোর-কিশোরী নিয়ে গঠিত এই যুবশক্তি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং সামাজিক আধুনিকীকরণের মূল চালিকাশক্তি। এই প্রজন্ম প্রযুক্তিগত পরিবর্তনকে দ্রুত গ্রহণ করতে সক্ষম এবং বৈশ্বিক প্রবণতাগুলোর সঙ্গে সহজেই মানিয়ে নিতে পারদর্শী। তারা কেবল শ্রমশক্তির জোগানদাতা নয়, বরং নতুন উদ্ভাবন, উদ্যোক্তা শক্তি এবং ডিজিটাল অর্থনীতিতে প্রবেশাধিকারের প্রতীক।

তথ্যপ্রযুক্তি, ডিজিটাল পরিষেবা এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির মতো উত্থানশীল খাতগুলিতে এই যুবশক্তির সক্রিয় অংশগ্রহণ দেশকে নতুন বৈশ্বিক মানচিত্রে প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

তবে, এই প্রাকৃতিক শক্তিকে উৎপাদনশীল পুঁজি বা ‘মানবসম্পদে’ রূপান্তরিত করার জন্য একটি কৌশলগত ও সুদূরপ্রসারী জাতীয় বিনিয়োগ পরিকল্পনা অপরিহার্য। এই সুবিধা অলৌকিকভাবে অর্জিত হবে না; এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং দক্ষতা উন্নয়নে লক্ষ্যভিত্তিক ও ধারাবাহিক সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগ।

যদি এই সম্ভাবনা অব্যবহৃত থেকে যায়, তবে জনসংখ্যাগত সুবিধা পরিণত হতে পারে বেকারত্ব, সামাজিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক স্থবিরতার এক ভয়াবহ বোঝায়, যা ‘সমাজ-অর্থনৈতিক চাপ’ সৃষ্টি করতে পারে।

জনসংখ্যাগত সুবিধা অর্জনের পথে বাংলাদেশের সামনে বেশ কিছু গুরুতর সামাজিক ও কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান, যা এই সম্ভাবনার সম্পূর্ণ বাস্তবায়নকে সীমিত করতে পারে।

দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রতিবন্ধকতা হলো বাল্যবিবাহ বা কমবয়সী বিবাহ। এটি বিশেষ করে গ্রামীণ ও নিম্ন আয়ের পরিবারগুলিতে মেয়েদের শিক্ষাগত এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে। আইনগত বয়সের আগেই মেয়েদের বিবাহিত হয়ে যাওয়া তাদের পূর্ণাঙ্গ শ্রমবাজারে অংশগ্রহণকে সীমিত করে এবং দারিদ্র্যের চক্রকে আরও শক্তিশালী করে। এই অচলায়তন ভাঙতে কঠোর আইন প্রয়োগ, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মেয়েদের জন্য অর্থনৈতিক প্রণোদনা অপরিহার্য।

একইসাথে, যুব সমাজের জন্য প্রজনন স্বাস্থ্যসেবায় সীমিত প্রবেশাধিকার এবং নিম্নমানের যৌনশিক্ষা একটি বড় সমস্যার সৃষ্টি করে। প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে সঠিক জ্ঞান ও সম্পদের অভাব তাদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যুব-বান্ধব চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির আধুনিকায়ন এবং মাধ্যমিক স্তরে কার্যকর যৌনশিক্ষার প্রবর্তন করে একটি স্বাস্থ্যবান ও উৎপাদনশীল যুব সমাজ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

মানবসম্পদ বিকাশের মূল ভিত্তি হলো শিক্ষা, কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষার হার বাড়লেও মানের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঘাটতি বিদ্যমান। সবচেয়ে বড় সংকট হলো, প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা দেশের ক্রমবর্ধমান ও পরিবর্তিত শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী যুবকদেরকে প্রস্তুত করতে পারছে না।

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বিপুল শিক্ষার্থীর চাপ, দুর্বল অবকাঠামো এবং প্রশিক্ষিত শিক্ষকের ঘাটতির শিকার। ফলস্বরূপ, শিক্ষার্থীরা এমন দক্ষতা নিয়ে স্নাতক হচ্ছে যা একবিংশ শতাব্দীর বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতিতে অপ্রয়োজনীয় বা অপ্রতুল।

কারিগরি ও পেশাগত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি (টি.ভি.ই.টি.) থাকলেও তা আধুনিক প্রযুক্তি, বিশেষত নবায়নযোগ্য শক্তি, ইলেকট্রনিক্স এবং তথ্যপ্রযুক্তি সেবা খাতের উচ্চ দক্ষতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই ‘দক্ষতার অভাব’ যুবকদেরকে উচ্চ বেতনের চাকরি এবং দেশের অর্থনীতিকে উচ্চ উৎপাদনশীলতার দিকে নিয়ে যেতে বাধা দেয়।

এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় শিক্ষা পাঠ্যসূচির আমূল পরিবর্তন, কারিগরি প্রশিক্ষণে ব্যাপক সরকারি বিনিয়োগ এবং শিল্প-শিক্ষার মধ্যে গভীর সহযোগিতা স্থাপন জরুরি।

জনসংখ্যাগত সুবিধা কার্যকরভাবে অর্জনের জন্য দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তন আনা অপরিহার্য। এই পরিবর্তন গতানুগতিক নিম্নমূল্যের উৎপাদনের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে উচ্চ উৎপাদনশীলতা, বৈচিত্র্য এবং উদ্ভাবনের দিকে মনোনিবেশ করবে। এর অর্থ হলো, শ্রমনির্ভর শিল্প থেকে সরে এসে এমন খাতগুলিতে গুরুত্ব দিতে হবে, যেখানে অধিক মূলধন বিনিয়োগ এবং উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার হয়। যেমনÑতথ্যপ্রযুক্তি, ইলেকট্রনিকস, হালকা প্রকৌশল এবং পরিবেশবান্ধব উৎপাদন।

এই রূপান্তর ঘটাতে হলে বেসরকারি খাতে প্রতিযোগিতা বাড়ানো, প্রশাসনিক জটিলতা কমানো এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে দক্ষতাভিত্তিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা প্রয়োজন। উৎপাদনশীলতা বাড়াতে এবং পণ্যের মান উন্নত করতে গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানো এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের জন্য বাণিজ্য নীতিতে সংস্কার আনা জরুরি। শুধুমাত্র শ্রমের সহজলভ্যতার ওপর নির্ভর না করে, শ্রমশক্তিকে উচ্চমূল্যের কাজে ব্যবহার করার মাধ্যমেই বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টেকসই করতে এবং উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে।

তৈরি পোশাক শিল্প (আর.এম.জি.) নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অর্থনীতির চালক হিসেবে লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। তবে, কেবল কম মজুরিভিত্তিক উৎপাদনের ওপর দীর্ঘমেয়াদী নির্ভরতা অর্থনীতির স্থায়িত্বের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বৈশ্বিক বাজারের অনিশ্চয়তা এবং স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির আবির্ভাব এই খাতের ভবিষ্যতকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।

জনসংখ্যাগত সুবিধা পুরোপুরি কাজে লাগাতে হলে দেশকে উচ্চ মান সংযোজনকারী শিল্পগুলির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে: ঔষধ শিল্প (ফার্মাসিউটিক্যালস), যেখানে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মান অর্জন করেছে; দ্রুত বর্ধনশীল তথ্যপ্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তি-ভিত্তিক পরিষেবা (আই.টি.ই.এস.); জাহাজ নির্মাণ শিল্প; এবং উদীয়মান সবুজ প্রযুক্তি ও নবায়নযোগ্য শক্তি খাত।

এই শিল্পগুলিতে যুবদেরকে দক্ষ করার জন্য বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং গবেষণা ও উন্নয়নে (আর অ্যান্ড ডি) সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি আবশ্যক। এর মাধ্যমে অর্থনীতিকে কেবল একটি খাতের ওপর নির্ভরশীলতার ঝুঁকি থেকে মুক্ত করা সম্ভব এবং একই সাথে উচ্চ উৎপাদনশীল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

কর্মসংস্থান সৃষ্টির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শুধু চাকরির বাজার সম্প্রসারণই যথেষ্ট নয়, বরং দেশজুড়ে উদ্যোক্তা সংস্কৃতিকে উৎসাহ দিতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এস.এম.ই.) হলো কর্মসংস্থান সৃষ্টির সবচেয়ে শক্তিশালী উৎস। যুব উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ, ঝুঁকি মূলধন বা উদ্যোগ মূলধন (ভেঞ্চার ক্যাপিটাল)-এ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা, পরামর্শ প্রদান এবং বাজার সংযোগের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা প্রয়োজন।

বিশেষ করে প্রযুক্তি-ভিত্তিক ‘নতুন উদ্যোগের’ (স্টার্টআপ) সংস্কৃতিকে পৃষ্ঠপোষকতা করা জরুরি, যা উদ্ভাবনের মাধ্যমে অর্থনীতির নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। যুব সমাজকে চাকরির খোঁজে না ছুটে চাকরি সৃষ্টির দিকে মনোনিবেশ করতে উৎসাহিত করা এই জনসংখ্যাগত সুবিধার পূর্ণাঙ্গ ব্যবহারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

জনসংখ্যাগত সুবিধার পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে লিঙ্গ সমতা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিমালার মাধ্যমে একটি সহায়ক সামাজিক ও প্রশাসনিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

নারীদের শ্রমবাজারে পূর্ণ অংশগ্রহণ কেবল শ্রমশক্তির আকারই বাড়ায় না, বরং পরিবারের আয় বৃদ্ধি করে এবং সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি উন্নত করে। নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণের হার বাড়লেও সামাজিক বিধিনিষেধ, লিঙ্গভিত্তিক মজুরি বৈষম্য, শিশুপালন ও গৃহস্থালির কাজের বোঝা এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা উদ্বেগ তাদের পূর্ণ সক্ষমতা প্রকাশে বাধা দেয়।

এই বাধা অপসারণের জন্য নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আইনি সংস্কার, নারী-বান্ধব কর্মপরিবেশ সৃষ্টি, সাশ্রয়ী ও মানসম্মত শিশুর যতœ সুবিধার প্রসার এবং জেন্ডার সংবেদনশীল দক্ষতা উন্নয়ন উদ্যোগ প্রয়োজন। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক কাঠামো ভেঙে, তাদের জন্য সমান সুযোগ এবং নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত করার মাধ্যমেই দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়ন টেকসই করা সম্ভব।

মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জি.ডি.পি.) অনুপাতে বাজেট বরাদ্দ বর্তমানে আন্তর্জাতিক মানদ-ের তুলনায় যথেষ্ট কম। এই বাজেট বৃদ্ধি এবং অর্থের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। কাঠামোগত ঘাটতি পূরণের জন্য কেবল অর্থ ঢালা নয়, বরং সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং নীতি বাস্তবায়নের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি নিশ্চিত করবে যেন গ্রামীণ যুবক, নারী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং সমাজের প্রান্তিক অংশীদাররা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়। এই ক্ষেত্রে ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি একটি শক্তিশালী হাতিয়ার, যা অনলাইন শিক্ষা, ই-শাসন পরিষেবা এবং ডিজিটাল দক্ষতা প্রশিক্ষণকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে দিতে পারে। এর ফলে আঞ্চলিক বৈষম্য কমিয়ে আনা সম্ভব হবে এবং জনসংখ্যার সকল স্তরের অংশগ্রহণের মাধ্যমে জনসংখ্যাগত সুবিধার পূর্ণাঙ্গ সুফল লাভ করা যাবে।

যুবকদেরকে কেবল নীতি ও কর্মসূচির সুবিধাভোগী না ভেবে, বরং নীতি প্রণয়নের অংশীদার হিসেবে যুক্ত করা উচিত। যখন যুবকদের মতামত ও আকাক্সক্ষা অনুযায়ী কর্মসূচি তৈরি করা হয়, তখন তার কার্যকারিতা বহুগুণে বৃদ্ধি পায় এবং তা তাদের বাস্তব চাহিদা পূরণে অধিক সক্ষম হয়। যুব সংগঠন এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সাথে নিয়মিত আলোচনার মাধ্যমে একটি কার্যকর এবং প্রতিক্রিয়াশীল শাসন ব্যবস্থা তৈরি করা অপরিহার্য।

এই অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতি নিশ্চিত করবে যে, জনসংখ্যাগত সুবিধা অর্জনের কৌশলগুলি কেবল উপর থেকে চাপানো নয়, বরং সমাজের সবচেয়ে গতিশীল অংশের সক্রিয় সহযোগিতা ও সম্মতির ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে।

জনসংখ্যাগত সুবিধা স্থায়ী নয়; এটি একটি ‘সময়সীমাযুক্ত জানালা’ যা দ্রুত বন্ধ হয়ে আসছে। বাংলাদেশের জন্মহার হ্রাস পাওয়ায় এবং প্রবীণ জনগোষ্ঠীর অনুপাত বাড়তে থাকায়, বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন যে এই সুবিধার ‘স্বর্ণালী দশক’ ২০৪০ সালের কাছাকাছি সময়ে শেষ হয়ে যেতে পারে।

প্রবীণ জনগোষ্ঠীর অনুপাত ইতিমধ্যে প্রায় ৭%-এ পৌঁছেছে এবং তা দ্রুত বাড়ছে। এই প্রবণতা ইঙ্গিত দেয় যে, হাতে মাত্র ১৫ থেকে ২০ বছর সময় রয়েছে এই সুবিধার পূর্ণ ফসল ঘরে তোলার জন্য। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে যদি কৌশলগত পদক্ষেপ এবং বিনিয়োগ নিশ্চিত করা না যায়, তবে এই বিশাল সুযোগ কাজে লাগানো অসম্ভব হবে।

এই সীমিত সময়ের মধ্যে যদি দ্রুত, সমন্বিত এবং ধারাবাহিক পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে এই জনসংখ্যাগত সুবিধা হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। ব্যর্থতার অর্থ হবে বিপুল সংখ্যক যুবকের দীর্ঘমেয়াদী বেকারত্ব, সামাজিক চাপ এবং দেশের উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা।

তাই, মানবসম্পদ উন্নয়ন, অবকাঠামোতে কৌশলগত বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তির মতো মূল ক্ষেত্রগুলিতে জাতীয় অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিনিয়োগ প্রয়োজন। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি, সমাজ এবং গণতন্ত্রের স্থায়িত্ব নির্ভর করছে এই স্বর্ণালী দশকটিকে কীভাবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজে লাগানো হয় তার ওপর। এটি কেবল একটি অর্থনৈতিক সুযোগ নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব।

[লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

back to top