আবু নাসের অনীক
তামাক জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি ক্ষতিকর পণ্য। এটি নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অধিকতর শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যথারীতি নিয়মে এই উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য তামাক কোম্পানি অপতৎপরতা শুরু করেছে। আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জনস্বাস্থ্যকে অধিকতর সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে। এসডিজির মেয়াদ ২০১৬ থেকে ২০৩০ সাল। এতে মোট ১৭টি অভীষ্ট, ১৬৯টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা এবং ১৩৩টি নির্ধারক অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ১৭টি অভীষ্টের মধ্যে সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ (এসডিজি-৩) অন্যতম।
সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে হলে সর্বপ্রথম নিশ্চিত করতে হবে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে কোনোভাবেই সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। অসংক্রামক রোগ যেমনÑ ক্যান্সার, হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগ বর্তমানে বৈশ্বিক স্বাস্থ্যঝুঁকির অন্যতম প্রধান কারণ।
তামাক ব্যবহারের কারণে সৃষ্ট প্রধান অসংক্রামক রোগসমূহ:
হৃদ্রোগ: তামাক রক্তচাপ বাড়ায়, রক্তনালীর ক্ষতি করে এবং হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। ধূমপানের কারণে সিওপিডি, অ্যাজমা ও ব্রঙ্কাইটিস হয়। ফুসফুস, মুখ, গলা, খাদ্যনালী ও মূত্রথলির ক্যান্সারের প্রধান কারণ তামাক।
ডায়াবেটিস: ধূমপান ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়, যা টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়।
সরকারের পক্ষ থেকে তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য যখনই কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, তখনই তামাক কোম্পানির গাত্রদাহ শুরু হয়ে যায়। তারা বিভিন্ন ধরনের অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়। সরকার ও নীতিনির্ধারকদের নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করার জন্য নানা প্রচেষ্টা চালায়। আইন সংশোধনের প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে তারা জোরেসোরে কয়েকটি বিষয়ে আওয়াজ তুলছে। এর মধ্যে একটি হলোÑ স্টেকহোল্ডারদের মতামত গ্রহণ না করে মন্ত্রণালয় আইন সংশোধনের খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন করেছে। এই ‘বাদ পড়া’ স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে রয়েছে তামাক কোম্পানিগুলি।
তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়টি প্রত্যক্ষভাবে জনস্বাস্থ্য রক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত। জনস্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থেই দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন হয়েছে এবং সময়ের দাবিতে সংশোধনের খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে। তামাক কোম্পানি একইভাবে প্রত্যক্ষভাবে জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় ক্ষতির কারণ। সেক্ষেত্রে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন এবং তামাক কোম্পানির অবস্থান একে অপরের বিপরীতে। উভয়ের স্বার্থ রক্ষাও বিপরীতমুখী। সেখানে কোন যুক্তিতে তামাক কোম্পানি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের প্রস্তাবে স্টেকহোল্ডার হিসাবে বিবেচিত হবে? তাদের স্টেকহোল্ডার হিসাবে বিবেচিত হওয়ার ন্যূনতম কোনো যৌক্তিক কারণ নেইÑ অন্তত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন প্রক্রিয়ায়।
তামাক কোম্পানির দাবিটা হলোÑ আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে তাদের স্টেকহোল্ডার ধরা হোক এবং তাদের কথা শোনা হোক। তারা প্রস্তাবিত আইনের সংশোধনের বিভিন্ন ধারা বিরোধিতা করে প্রস্তাব দেওয়ার সুযোগ চায়, যাতে জনস্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত করার সুযোগ নিশ্চিত হয় এবং তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আইন বাধা না দেয়। কী চমৎকার দাবি তামাক কোম্পানির! এই দাবি ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য দেশের ভেতরেই একটি পক্ষ তামাক কোম্পানির পক্ষে কাজ করছে জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মধ্যে ফেলে। এটা তামাক কোম্পানির চরম দুঃসাহস। এভাবেই তারা প্রতিনিয়ত এফসিটিসির আর্টিকেল ৫.৩ ভঙ্গ করে অপতৎপরতা চালাচ্ছে। এই কাজে তারা কিছু অনুগত সঙ্গীও জোগাড় করেছে বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে।
বাংলাদেশ এফসিটিসিতে অনুস্বাক্ষরকারী দেশ। সেই অবস্থান থেকে বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অথবা তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য অন্য কোনো কৌশলপত্র নির্ধারণে তামাক কোম্পানির মতামত দেওয়ার ন্যূনতম কোনো সুযোগ নেই। তাদের মতামত গ্রহণ করা মানে এফসিটিসির আর্টিকেল ৫.৩ ভঙ্গ করা। সঙ্গত কারণেই আমাদের সরকার এবং সরকারের কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগ সেটা করতে পারে না।
বাংলাদেশ অসংক্রামক রোগ (এনসিডি) প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে আন্তঃমন্ত্রণালয় সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গত ২০ আগস্ট ২০২৫ তারিখে ৩৫টি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একটি যৌথ ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এই চুক্তি হয়েছে, যা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করে। ঘোষণাপত্রের প্রধান পাঁচটি প্রতিশ্রুতির মধ্যে (ক) নীতি প্রণয়নে অগ্রাধিকার অংশে বলা হয়েছেÑ প্রতিটি মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ তাদের নিজস্ব কর্মকৌশল ও নীতিমালা প্রণয়নের সময় ‘সব নীতিতে স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য’ দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করবে। অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে এবং প্রয়োজনে বিদ্যমান নীতিমালায় প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা হবে।
সরকারের যে ৩৫টি মন্ত্রণালয়/বিভাগ এই যৌথ ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছে, এনবিআর তার মধ্যে অন্যতম। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে আমরা লক্ষ করছি, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনকে সামনে নিয়ে এফসিটিসির আর্টিকেল ৫.৩ এবং এই যৌথ ঘোষণাকে উপেক্ষা করে এনবিআর তামাক কোম্পানিগুলির সঙ্গে সভা করার পরিকল্পনা করছে। এ ধরনের সভা অনুষ্ঠিত করা এফসিটিসি এবং যৌথ ঘোষণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এনবিআরের এই কাজ একেবারেই অনুচিত। সংশোধিত আইনের খসড়ায় লাইসেন্সিং ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় কোম্পানির গাত্রদাহ শুরু হয়েছে। এটা নতুন কিছু নয়। ‘স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকা’তে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা যুক্ত হওয়ার পর থেকেই তারা এটা বাতিলের জন্য অপতৎপরতা চালাচ্ছে।
তামাক নিয়ন্ত্রণের অন্যতম লক্ষ্য এর সহজপ্রাপ্যতা হ্রাস করা। এর মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে ব্যবহার কমানো। লাইসেন্সিং ব্যবস্থা এই উদ্দেশ্য পূরণে অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান থেকে তামাক বিক্রেতারা লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করছে। এলজিআই গাইডলাইন অনুযায়ী, ৪৩টি পৌরসভায় ৪১৫৫টি লাইসেন্স (নিবন্ধন) ইস্যু হয়েছে; যাতে সরকার ৮৩ লাখ ২০ হাজার টাকা রাজস্ব পেয়েছে, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান পেয়েছে ২০ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। দেশে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার সিগারেট/তামাক বিক্রেতা আছে; লাইসেন্স (নিবন্ধন) হলে সরকারের রাজস্ব আয়ে যোগ হবে ৩০ কোটি টাকা। একই সঙ্গে চোরাচালান ও অবৈধ কর ফাঁকি রোধ করা সম্ভব হবে।
প্রচার করা হচ্ছে, ১৫ লাখ নিম্ন আয়ের খুচরা বিক্রেতা আছে। এই তথ্যের কোনো সঠিকতা নেই। বলা হচ্ছে, লাইসেন্সিং ব্যবস্থা কার্যকর হলে এদের জীবন-জীবিকা বন্ধ হয়ে যাবে। কী হাস্যকর যুক্তি! এদের বক্তব্য অনুসারে মনে হয়, বাংলাদেশে ফেরি করে বিক্রির একমাত্র পণ্য সিগারেট। এটা ছাড়া অন্য কোনো পণ্য বিক্রি করে তারা জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে না! লাইসেন্সিং ব্যবস্থা গত তিন বছর ধরে চলমান। যারা দ্বৈত লাইসেন্স না নিয়ে তামাক বিক্রি বন্ধ করেছে তাদের কারো জীবন-জীবিকাই বন্ধ হয়নি। বরং ওই এলাকায় সিগারেট বিক্রি কমেছে।
সরকারের লক্ষ্যই হলো তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রি কমানো। এজন্যই আইন করে এই বিক্রিকে কঠিন করে তোলা উচিত যাতে সিগারেট বা অন্যান্য তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করতে বিক্রেতা নিরুৎসাহিত হয় এবং বিকল্প কিছু বিক্রি শুরু করে। এর জন্য তো আর পৃথক লাইসেন্স নেওয়ার কথা বলেনি সরকার। তামাক নিয়ন্ত্রণে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ (সংশোধিত ২০১৩)-এর সংশোধন এখন সময়ের দাবি। সেই দাবির প্রতিই সাড়া দিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নতুনভাবে আইনে যেসব সংশোধনী প্রস্তাবনা যুক্ত করেছে তা অত্যন্ত যুগোপযোগী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে ইতিমধ্যে এই ধারাগুলি যুক্ত হয়েছে এবং তারা এর সুফল পাচ্ছে।
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের লক্ষ্য তামাক কোম্পানির ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা করা নয়; জনস্বাস্থ্যকে তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করা। আর তামাক কোম্পানির লক্ষ্য তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার বৃদ্ধি, বাণিজ্য সম্প্রসারণ করাÑ যা শেষ পর্যন্ত জনস্বাস্থ্যকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলে। তামাক কোম্পানি তাদের অনুগতদের দিয়ে আইনের সংশোধন বিষয়ে যে নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছে তার উদ্দেশ্যই হলো আইনের নতুন ধারাগুলি যাতে যুক্ত না হয়। কারণ এই ধারাগুলি যুক্ত হলে তামাক কোম্পানির বাণিজ্য সম্প্রসারণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে। লাইসেন্সিং (নিবন্ধন) ধারা তার মধ্যে অন্যতম। এজন্য এই বিষয়ে তাদের বিরোধিতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে। আমাদের আগামী প্রজন্মকে তামাকের সর্বনাশা ছোবল থেকে রক্ষা করার জন্য প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব হলো তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী প্রস্তাবকে সমর্থন করা এবং তামাক কোম্পানির কূটকৌশল প্রতিহত করা।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: উন্নয়নকর্মী]
আবু নাসের অনীক
বুধবার, ০১ অক্টোবর ২০২৫
তামাক জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি ক্ষতিকর পণ্য। এটি নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অধিকতর শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যথারীতি নিয়মে এই উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য তামাক কোম্পানি অপতৎপরতা শুরু করেছে। আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জনস্বাস্থ্যকে অধিকতর সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে। এসডিজির মেয়াদ ২০১৬ থেকে ২০৩০ সাল। এতে মোট ১৭টি অভীষ্ট, ১৬৯টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা এবং ১৩৩টি নির্ধারক অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ১৭টি অভীষ্টের মধ্যে সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ (এসডিজি-৩) অন্যতম।
সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে হলে সর্বপ্রথম নিশ্চিত করতে হবে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে কোনোভাবেই সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। অসংক্রামক রোগ যেমনÑ ক্যান্সার, হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগ বর্তমানে বৈশ্বিক স্বাস্থ্যঝুঁকির অন্যতম প্রধান কারণ।
তামাক ব্যবহারের কারণে সৃষ্ট প্রধান অসংক্রামক রোগসমূহ:
হৃদ্রোগ: তামাক রক্তচাপ বাড়ায়, রক্তনালীর ক্ষতি করে এবং হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। ধূমপানের কারণে সিওপিডি, অ্যাজমা ও ব্রঙ্কাইটিস হয়। ফুসফুস, মুখ, গলা, খাদ্যনালী ও মূত্রথলির ক্যান্সারের প্রধান কারণ তামাক।
ডায়াবেটিস: ধূমপান ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়, যা টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়।
সরকারের পক্ষ থেকে তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য যখনই কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, তখনই তামাক কোম্পানির গাত্রদাহ শুরু হয়ে যায়। তারা বিভিন্ন ধরনের অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়। সরকার ও নীতিনির্ধারকদের নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করার জন্য নানা প্রচেষ্টা চালায়। আইন সংশোধনের প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে তারা জোরেসোরে কয়েকটি বিষয়ে আওয়াজ তুলছে। এর মধ্যে একটি হলোÑ স্টেকহোল্ডারদের মতামত গ্রহণ না করে মন্ত্রণালয় আইন সংশোধনের খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন করেছে। এই ‘বাদ পড়া’ স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে রয়েছে তামাক কোম্পানিগুলি।
তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়টি প্রত্যক্ষভাবে জনস্বাস্থ্য রক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত। জনস্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থেই দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন হয়েছে এবং সময়ের দাবিতে সংশোধনের খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে। তামাক কোম্পানি একইভাবে প্রত্যক্ষভাবে জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় ক্ষতির কারণ। সেক্ষেত্রে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন এবং তামাক কোম্পানির অবস্থান একে অপরের বিপরীতে। উভয়ের স্বার্থ রক্ষাও বিপরীতমুখী। সেখানে কোন যুক্তিতে তামাক কোম্পানি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের প্রস্তাবে স্টেকহোল্ডার হিসাবে বিবেচিত হবে? তাদের স্টেকহোল্ডার হিসাবে বিবেচিত হওয়ার ন্যূনতম কোনো যৌক্তিক কারণ নেইÑ অন্তত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন প্রক্রিয়ায়।
তামাক কোম্পানির দাবিটা হলোÑ আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে তাদের স্টেকহোল্ডার ধরা হোক এবং তাদের কথা শোনা হোক। তারা প্রস্তাবিত আইনের সংশোধনের বিভিন্ন ধারা বিরোধিতা করে প্রস্তাব দেওয়ার সুযোগ চায়, যাতে জনস্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত করার সুযোগ নিশ্চিত হয় এবং তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আইন বাধা না দেয়। কী চমৎকার দাবি তামাক কোম্পানির! এই দাবি ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য দেশের ভেতরেই একটি পক্ষ তামাক কোম্পানির পক্ষে কাজ করছে জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মধ্যে ফেলে। এটা তামাক কোম্পানির চরম দুঃসাহস। এভাবেই তারা প্রতিনিয়ত এফসিটিসির আর্টিকেল ৫.৩ ভঙ্গ করে অপতৎপরতা চালাচ্ছে। এই কাজে তারা কিছু অনুগত সঙ্গীও জোগাড় করেছে বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে।
বাংলাদেশ এফসিটিসিতে অনুস্বাক্ষরকারী দেশ। সেই অবস্থান থেকে বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অথবা তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য অন্য কোনো কৌশলপত্র নির্ধারণে তামাক কোম্পানির মতামত দেওয়ার ন্যূনতম কোনো সুযোগ নেই। তাদের মতামত গ্রহণ করা মানে এফসিটিসির আর্টিকেল ৫.৩ ভঙ্গ করা। সঙ্গত কারণেই আমাদের সরকার এবং সরকারের কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগ সেটা করতে পারে না।
বাংলাদেশ অসংক্রামক রোগ (এনসিডি) প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে আন্তঃমন্ত্রণালয় সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গত ২০ আগস্ট ২০২৫ তারিখে ৩৫টি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একটি যৌথ ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এই চুক্তি হয়েছে, যা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করে। ঘোষণাপত্রের প্রধান পাঁচটি প্রতিশ্রুতির মধ্যে (ক) নীতি প্রণয়নে অগ্রাধিকার অংশে বলা হয়েছেÑ প্রতিটি মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ তাদের নিজস্ব কর্মকৌশল ও নীতিমালা প্রণয়নের সময় ‘সব নীতিতে স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য’ দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করবে। অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে এবং প্রয়োজনে বিদ্যমান নীতিমালায় প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা হবে।
সরকারের যে ৩৫টি মন্ত্রণালয়/বিভাগ এই যৌথ ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছে, এনবিআর তার মধ্যে অন্যতম। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে আমরা লক্ষ করছি, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনকে সামনে নিয়ে এফসিটিসির আর্টিকেল ৫.৩ এবং এই যৌথ ঘোষণাকে উপেক্ষা করে এনবিআর তামাক কোম্পানিগুলির সঙ্গে সভা করার পরিকল্পনা করছে। এ ধরনের সভা অনুষ্ঠিত করা এফসিটিসি এবং যৌথ ঘোষণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এনবিআরের এই কাজ একেবারেই অনুচিত। সংশোধিত আইনের খসড়ায় লাইসেন্সিং ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় কোম্পানির গাত্রদাহ শুরু হয়েছে। এটা নতুন কিছু নয়। ‘স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকা’তে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা যুক্ত হওয়ার পর থেকেই তারা এটা বাতিলের জন্য অপতৎপরতা চালাচ্ছে।
তামাক নিয়ন্ত্রণের অন্যতম লক্ষ্য এর সহজপ্রাপ্যতা হ্রাস করা। এর মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে ব্যবহার কমানো। লাইসেন্সিং ব্যবস্থা এই উদ্দেশ্য পূরণে অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান থেকে তামাক বিক্রেতারা লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করছে। এলজিআই গাইডলাইন অনুযায়ী, ৪৩টি পৌরসভায় ৪১৫৫টি লাইসেন্স (নিবন্ধন) ইস্যু হয়েছে; যাতে সরকার ৮৩ লাখ ২০ হাজার টাকা রাজস্ব পেয়েছে, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান পেয়েছে ২০ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। দেশে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার সিগারেট/তামাক বিক্রেতা আছে; লাইসেন্স (নিবন্ধন) হলে সরকারের রাজস্ব আয়ে যোগ হবে ৩০ কোটি টাকা। একই সঙ্গে চোরাচালান ও অবৈধ কর ফাঁকি রোধ করা সম্ভব হবে।
প্রচার করা হচ্ছে, ১৫ লাখ নিম্ন আয়ের খুচরা বিক্রেতা আছে। এই তথ্যের কোনো সঠিকতা নেই। বলা হচ্ছে, লাইসেন্সিং ব্যবস্থা কার্যকর হলে এদের জীবন-জীবিকা বন্ধ হয়ে যাবে। কী হাস্যকর যুক্তি! এদের বক্তব্য অনুসারে মনে হয়, বাংলাদেশে ফেরি করে বিক্রির একমাত্র পণ্য সিগারেট। এটা ছাড়া অন্য কোনো পণ্য বিক্রি করে তারা জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে না! লাইসেন্সিং ব্যবস্থা গত তিন বছর ধরে চলমান। যারা দ্বৈত লাইসেন্স না নিয়ে তামাক বিক্রি বন্ধ করেছে তাদের কারো জীবন-জীবিকাই বন্ধ হয়নি। বরং ওই এলাকায় সিগারেট বিক্রি কমেছে।
সরকারের লক্ষ্যই হলো তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রি কমানো। এজন্যই আইন করে এই বিক্রিকে কঠিন করে তোলা উচিত যাতে সিগারেট বা অন্যান্য তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করতে বিক্রেতা নিরুৎসাহিত হয় এবং বিকল্প কিছু বিক্রি শুরু করে। এর জন্য তো আর পৃথক লাইসেন্স নেওয়ার কথা বলেনি সরকার। তামাক নিয়ন্ত্রণে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ (সংশোধিত ২০১৩)-এর সংশোধন এখন সময়ের দাবি। সেই দাবির প্রতিই সাড়া দিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নতুনভাবে আইনে যেসব সংশোধনী প্রস্তাবনা যুক্ত করেছে তা অত্যন্ত যুগোপযোগী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে ইতিমধ্যে এই ধারাগুলি যুক্ত হয়েছে এবং তারা এর সুফল পাচ্ছে।
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের লক্ষ্য তামাক কোম্পানির ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা করা নয়; জনস্বাস্থ্যকে তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করা। আর তামাক কোম্পানির লক্ষ্য তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার বৃদ্ধি, বাণিজ্য সম্প্রসারণ করাÑ যা শেষ পর্যন্ত জনস্বাস্থ্যকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলে। তামাক কোম্পানি তাদের অনুগতদের দিয়ে আইনের সংশোধন বিষয়ে যে নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছে তার উদ্দেশ্যই হলো আইনের নতুন ধারাগুলি যাতে যুক্ত না হয়। কারণ এই ধারাগুলি যুক্ত হলে তামাক কোম্পানির বাণিজ্য সম্প্রসারণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে। লাইসেন্সিং (নিবন্ধন) ধারা তার মধ্যে অন্যতম। এজন্য এই বিষয়ে তাদের বিরোধিতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে। আমাদের আগামী প্রজন্মকে তামাকের সর্বনাশা ছোবল থেকে রক্ষা করার জন্য প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব হলো তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী প্রস্তাবকে সমর্থন করা এবং তামাক কোম্পানির কূটকৌশল প্রতিহত করা।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: উন্নয়নকর্মী]