সৈয়দ আমিরুজ্জামান
১৭৮৯ সালের ৫ অক্টোবরÑফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে এক গৌরবময় ও বেদনাবিধুর দিন। সকল যুগে ও সকল বিপ্লবের মূল বিষয় শ্রেণিসংগ্রাম। যুগে যুগে বিপ্লবীদের নেতৃত্বে জনগণই ইতিহাস সৃষ্টি করে।
ফরাসি, ইউরোপ এবং পশ্চিমা সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে শ্রেণিগত রাজনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম, গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা এবং বৈষম্য নিরসনের সামাজিক ন্যায্যতার লড়াই এই বিপ্লবের মধ্য দিয়েই নতুন মাত্রা পেয়েছিল। ২৩৬ বছর পর আজও ফরাসি বিপ্লব শুধু ইতিহাসের দলিল নয়, বরং সমকালীন লড়াই সংগ্রামে সমাজ-অর্থনীতির আমূল পরিবর্তন অভিমুখী নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এক অনন্ত প্রেরণা।
বিপ্লব: ধ্বংস নয়, সৃজনশীলতার প্রসববেদনা
ক্রান্তিকালের শ্রেষ্ঠ মত বিপ্লবীরা ধারণ করে। বিপ্লব ধ্বংসের তা-বলীলা নয়, প্রসববেদনা মাত্র। বিপ্লব কখনো কেবল ধ্বংসযজ্ঞ নয়; এটি হলো নতুন সমাজব্যবস্থার জন্ম। ইতিহাসের প্রতিটি মৌলিক পরিবর্তনের পেছনে জনগণের আত্মত্যাগ, সংগ্রাম ও শ্রেণিসংগ্রাম-সংঘাত কাজ করেছে। ফরাসি বিপ্লবও এর ব্যতিক্রম নয়। মধ্যযুগীয় রাজতান্ত্রিক শৃঙ্খল ভেঙে মানুষ নিজের নাগরিকত্ব, স্বাধীনতা ও মর্যাদা অর্জনের লড়াইয়ে নেমেছিলেন।
ফরাসি বিপ্লবের মূলনীতি
“স্বাধীনতা, সমতা, ভ্রাতৃত্বÑঅথবা মৃত্যু”Ñএই ছিল বিপ্লবীদের স্লোগান। এটি হয়ে ওঠে গণমানুষের মুক্তির ঘোষণাপত্র। আর্থ-রাজনৈতিক সংগ্রামের পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তিও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই নীতিই পশ্চিমা গণতন্ত্র ও আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে।
কেন হয়েছিল ফরাসি বিপ্লব?
ফরাসি বিপ্লবকে বোঝার জন্য এর নেপথ্যের কারণগুলো গভীরভাবে দেখা দরকার।
অর্থনৈতিক কারণ:
বিশাল জাতীয় ঋণ ও করের অন্যায্য চাপ।
খাদ্য সংকট, বেকারত্ব ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি।
রাজপ্রাসাদের বিলাসিতা ও রাজপরিবারের অপব্যয়।
সামাজিক বৈষম্য:
ফার্স্ট এস্টেট (যাজক) ও সেকেন্ড এস্টেট (অভিজাত) করমুক্ত থেকে বিশেষ সুবিধা ভোগ করত।
থার্ড এস্টেটÑঅর্থাৎ কৃষক, শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিÑকরভার বহন করত এবং শোষণের শিকার হত।
জমিদারতন্ত্র, সামন্তবাদ ও চার্চের গোঁড়ামি মানুষের ক্ষোভ বাড়ায়।
রাজনৈতিক কারণ:
নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র জনগণের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল।
আলোকায়নের যুগের দার্শনিকরাÑমন্টেস্কু, ভলতেয়ার, রুশো প্রমুখÑস্বাধীনতা ও মানবাধিকারের চিন্তা ছড়িয়ে দেন।
সম্রাট লুই ১৬-এর ব্যর্থতা এবং রানি মেরি অ্যান্টয়নেটের উদাসীনতা রাজতন্ত্রকে আরও অজনপ্রিয় করে তোলে।
প্রতীকী মুহূর্তগুলো
১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাইÑবাস্তিল দুর্গ আক্রমণÑফরাসি বিপ্লবের অগ্নিসংকেত। বন্দিদের মুক্তি ও দমননীতির বিরুদ্ধে জনতার ঐক্য আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আলোড়ন তোলে। পরে ৫ অক্টোবর প্যারিস থেকে ক্ষুধার্ত নারীরা “হাঙ্গার মার্চ” নিয়ে ভার্সাই প্রাসাদে পৌঁছান। তাদের দাবি ছিল কেবল রুটি, অথচ রাজপ্রাসাদের বিলাসিতায় নিমজ্জিত রাজপরিবার বাস্তবতা থেকে ছিল সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এই নারীমিছিলই প্রমাণ করে, বিপ্লব কেবল পুরুষের কাজ নয়; নারীরাও ইতিহাস সৃষ্টির অগ্রভাগে ছিলেন।
বিপ্লবের অর্জন
মানবাধিকার ঘোষণা (১৭৮৯)
জাতীয় পরিষদের ঘোষণাপত্রে স্বাধীনতা, সমতা, আইনের শাসন, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও জনগণের সার্বভৌমত্ব স্বীকৃতি পায়। এটি আধুনিক মানবাধিকারের ভিত্তিপত্র।
রাজতন্ত্রের অবসান
সংবিধানের বিরোধিতা ও দেশদ্রোহের কারণে ১৭৯৩ সালের ২১ জানুয়ারি রাজা ষোড়শ লুইকে এবং পরে রানি মেরিকেও গিলোটিনে মৃত্যুদ- দেয়া হয়। ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়।
সমাজ সংস্কার
চার্চ ও অভিজাতদের একচেটিয়া ক্ষমতা ভেঙে সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা শুরু হয়।
বিশ্ব ইতিহাসে প্রভাব
ফরাসি বিপ্লব শুধু ফ্রান্সে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি ইউরোপ জুড়ে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও মুক্তির আন্দোলনে অনুপ্রেরণা জাগায়। আমেরিকা থেকে এশিয়া পর্যন্ত উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামে এ বিপ্লব প্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে।
নেপোলিয়ন ও পরবর্তী ধাপ
বিপ্লব পরবর্তী অস্থিরতার মধ্যেই উঠে আসেন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। তিনি বিপ্লবের আদর্শকে সামরিক শক্তির মাধ্যমে ইউরোপে ছড়িয়ে দেন। যদিও পরবর্তী সময়ে তিনি সম্রাটে পরিণত হন, তবুও ফরাসি বিপ্লবের বীজকণা তার মাধ্যমেই বিশ্বব্যাপী বিস্তার লাভ করে।
ফরাসি বিপ্লবের শিক্ষা
শ্রেণিসংগ্রাম ইতিহাসের চালিকাশক্তিÑঅভিজাত বনাম নিপীড়িত জনগণ।
জনগণই ইতিহাস রচনা করেÑবাস্তিল আক্রমণ, হাঙ্গার মার্চ এর স্পষ্ট প্রমাণ।
আদর্শ ছাড়া বিপ্লব অসম্ভবÑস্বাধীনতা, সমতা, ভ্রাতৃত্বের শ্লোগান জনমানসে শক্তি জুগিয়েছে।
বিপ্লব সর্বজনীনÑজাতি, ধর্ম, লিঙ্গ নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিকতা
আজকের বাংলাদেশে ফরাসি বিপ্লবের শিক্ষা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক।
অর্থনৈতিক বৈষম্য: ক্ষুদ্র এক শ্রেণি বিপুল সম্পদ ভোগ করছে, আর বিপুল জনগণ দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও দ্রব্যমূল্যের চাপে।
সামাজিক ন্যায়বিচার: ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রশ্নবিদ্ধ।
রাজনৈতিক অংশগ্রহণ: জনগণের মতামত, ভোটাধিকার ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
নারীর ভূমিকা: ফরাসি নারীদের মতো বাংলাদেশের নারীরাও আজ পরিবর্তনের অগ্রভাগেÑতাদের মুক্তি ও সমতা নিশ্চিত না হলে সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।
ফরাসি বিপ্লব আমাদের শেখায়Ñকোনো অবিচার, বৈষম্য বা শোষণ চিরস্থায়ী নয়। জনগণের ঐক্য, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগই ইতিহাস বদলায়। স্বাধীনতা, সমতা, ভ্রাতৃত্বÑএই তিন নীতি আজও মানবসভ্যতার আলোকবর্তিকা।
২৩৬ বছর পর আমরা যখন ফরাসি বিপ্লবকে স্মরণ করি, তখন কেবল অতীতকে নয়, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকেও দেখতে হয়।
সমাজতন্ত্র অভিমুখী অসাম্প্রদায়িক জনগণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রত্যয়ে সমতা-ন্যায্যতার প্রশ্নে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনেই জনগণের নতুন ধারার এক আর্থসামাজিক বৈপ্লবিক ব্যবস্থা প্রবর্তনে বিশ্বজনীন মহান ও কীর্তিমান বিপ্লবীদের রাজনীতি, আত্মোৎসর্গ, জীবন সংগ্রাম, কীর্তি, ইতিহাস, তত্ত্ব ও অনুশীলন সম্পর্কে পাঠ প্রাসঙ্গিক ও জরুরী। কিংবদন্তী সকল বিপ্লবীসহ ইতিহাসের নির্মাতা ও চালিকাশক্তি জনগণের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা ও অভিবাদন!
বাংলাদেশের জন্য আজ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো একটি বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। সেই সমাজ নির্মাণের স্বপ্নেই আমাদের ফরাসি বিপ্লবের আদর্শকে ধারণ করতে হবে।
ইতিহাসের সেই মহাকাব্যিক সত্য আজও ধ্বনিত হয়Ñ “জনগণই ইতিহাসের নির্মাতা।”
[লেখক: কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জাতীয় কৃষক সমিতি]
সৈয়দ আমিরুজ্জামান
শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫
১৭৮৯ সালের ৫ অক্টোবরÑফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে এক গৌরবময় ও বেদনাবিধুর দিন। সকল যুগে ও সকল বিপ্লবের মূল বিষয় শ্রেণিসংগ্রাম। যুগে যুগে বিপ্লবীদের নেতৃত্বে জনগণই ইতিহাস সৃষ্টি করে।
ফরাসি, ইউরোপ এবং পশ্চিমা সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে শ্রেণিগত রাজনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম, গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা এবং বৈষম্য নিরসনের সামাজিক ন্যায্যতার লড়াই এই বিপ্লবের মধ্য দিয়েই নতুন মাত্রা পেয়েছিল। ২৩৬ বছর পর আজও ফরাসি বিপ্লব শুধু ইতিহাসের দলিল নয়, বরং সমকালীন লড়াই সংগ্রামে সমাজ-অর্থনীতির আমূল পরিবর্তন অভিমুখী নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এক অনন্ত প্রেরণা।
বিপ্লব: ধ্বংস নয়, সৃজনশীলতার প্রসববেদনা
ক্রান্তিকালের শ্রেষ্ঠ মত বিপ্লবীরা ধারণ করে। বিপ্লব ধ্বংসের তা-বলীলা নয়, প্রসববেদনা মাত্র। বিপ্লব কখনো কেবল ধ্বংসযজ্ঞ নয়; এটি হলো নতুন সমাজব্যবস্থার জন্ম। ইতিহাসের প্রতিটি মৌলিক পরিবর্তনের পেছনে জনগণের আত্মত্যাগ, সংগ্রাম ও শ্রেণিসংগ্রাম-সংঘাত কাজ করেছে। ফরাসি বিপ্লবও এর ব্যতিক্রম নয়। মধ্যযুগীয় রাজতান্ত্রিক শৃঙ্খল ভেঙে মানুষ নিজের নাগরিকত্ব, স্বাধীনতা ও মর্যাদা অর্জনের লড়াইয়ে নেমেছিলেন।
ফরাসি বিপ্লবের মূলনীতি
“স্বাধীনতা, সমতা, ভ্রাতৃত্বÑঅথবা মৃত্যু”Ñএই ছিল বিপ্লবীদের স্লোগান। এটি হয়ে ওঠে গণমানুষের মুক্তির ঘোষণাপত্র। আর্থ-রাজনৈতিক সংগ্রামের পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তিও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই নীতিই পশ্চিমা গণতন্ত্র ও আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে।
কেন হয়েছিল ফরাসি বিপ্লব?
ফরাসি বিপ্লবকে বোঝার জন্য এর নেপথ্যের কারণগুলো গভীরভাবে দেখা দরকার।
অর্থনৈতিক কারণ:
বিশাল জাতীয় ঋণ ও করের অন্যায্য চাপ।
খাদ্য সংকট, বেকারত্ব ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি।
রাজপ্রাসাদের বিলাসিতা ও রাজপরিবারের অপব্যয়।
সামাজিক বৈষম্য:
ফার্স্ট এস্টেট (যাজক) ও সেকেন্ড এস্টেট (অভিজাত) করমুক্ত থেকে বিশেষ সুবিধা ভোগ করত।
থার্ড এস্টেটÑঅর্থাৎ কৃষক, শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিÑকরভার বহন করত এবং শোষণের শিকার হত।
জমিদারতন্ত্র, সামন্তবাদ ও চার্চের গোঁড়ামি মানুষের ক্ষোভ বাড়ায়।
রাজনৈতিক কারণ:
নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র জনগণের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল।
আলোকায়নের যুগের দার্শনিকরাÑমন্টেস্কু, ভলতেয়ার, রুশো প্রমুখÑস্বাধীনতা ও মানবাধিকারের চিন্তা ছড়িয়ে দেন।
সম্রাট লুই ১৬-এর ব্যর্থতা এবং রানি মেরি অ্যান্টয়নেটের উদাসীনতা রাজতন্ত্রকে আরও অজনপ্রিয় করে তোলে।
প্রতীকী মুহূর্তগুলো
১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাইÑবাস্তিল দুর্গ আক্রমণÑফরাসি বিপ্লবের অগ্নিসংকেত। বন্দিদের মুক্তি ও দমননীতির বিরুদ্ধে জনতার ঐক্য আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আলোড়ন তোলে। পরে ৫ অক্টোবর প্যারিস থেকে ক্ষুধার্ত নারীরা “হাঙ্গার মার্চ” নিয়ে ভার্সাই প্রাসাদে পৌঁছান। তাদের দাবি ছিল কেবল রুটি, অথচ রাজপ্রাসাদের বিলাসিতায় নিমজ্জিত রাজপরিবার বাস্তবতা থেকে ছিল সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এই নারীমিছিলই প্রমাণ করে, বিপ্লব কেবল পুরুষের কাজ নয়; নারীরাও ইতিহাস সৃষ্টির অগ্রভাগে ছিলেন।
বিপ্লবের অর্জন
মানবাধিকার ঘোষণা (১৭৮৯)
জাতীয় পরিষদের ঘোষণাপত্রে স্বাধীনতা, সমতা, আইনের শাসন, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও জনগণের সার্বভৌমত্ব স্বীকৃতি পায়। এটি আধুনিক মানবাধিকারের ভিত্তিপত্র।
রাজতন্ত্রের অবসান
সংবিধানের বিরোধিতা ও দেশদ্রোহের কারণে ১৭৯৩ সালের ২১ জানুয়ারি রাজা ষোড়শ লুইকে এবং পরে রানি মেরিকেও গিলোটিনে মৃত্যুদ- দেয়া হয়। ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়।
সমাজ সংস্কার
চার্চ ও অভিজাতদের একচেটিয়া ক্ষমতা ভেঙে সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা শুরু হয়।
বিশ্ব ইতিহাসে প্রভাব
ফরাসি বিপ্লব শুধু ফ্রান্সে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি ইউরোপ জুড়ে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও মুক্তির আন্দোলনে অনুপ্রেরণা জাগায়। আমেরিকা থেকে এশিয়া পর্যন্ত উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামে এ বিপ্লব প্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে।
নেপোলিয়ন ও পরবর্তী ধাপ
বিপ্লব পরবর্তী অস্থিরতার মধ্যেই উঠে আসেন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। তিনি বিপ্লবের আদর্শকে সামরিক শক্তির মাধ্যমে ইউরোপে ছড়িয়ে দেন। যদিও পরবর্তী সময়ে তিনি সম্রাটে পরিণত হন, তবুও ফরাসি বিপ্লবের বীজকণা তার মাধ্যমেই বিশ্বব্যাপী বিস্তার লাভ করে।
ফরাসি বিপ্লবের শিক্ষা
শ্রেণিসংগ্রাম ইতিহাসের চালিকাশক্তিÑঅভিজাত বনাম নিপীড়িত জনগণ।
জনগণই ইতিহাস রচনা করেÑবাস্তিল আক্রমণ, হাঙ্গার মার্চ এর স্পষ্ট প্রমাণ।
আদর্শ ছাড়া বিপ্লব অসম্ভবÑস্বাধীনতা, সমতা, ভ্রাতৃত্বের শ্লোগান জনমানসে শক্তি জুগিয়েছে।
বিপ্লব সর্বজনীনÑজাতি, ধর্ম, লিঙ্গ নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিকতা
আজকের বাংলাদেশে ফরাসি বিপ্লবের শিক্ষা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক।
অর্থনৈতিক বৈষম্য: ক্ষুদ্র এক শ্রেণি বিপুল সম্পদ ভোগ করছে, আর বিপুল জনগণ দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও দ্রব্যমূল্যের চাপে।
সামাজিক ন্যায়বিচার: ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রশ্নবিদ্ধ।
রাজনৈতিক অংশগ্রহণ: জনগণের মতামত, ভোটাধিকার ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
নারীর ভূমিকা: ফরাসি নারীদের মতো বাংলাদেশের নারীরাও আজ পরিবর্তনের অগ্রভাগেÑতাদের মুক্তি ও সমতা নিশ্চিত না হলে সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।
ফরাসি বিপ্লব আমাদের শেখায়Ñকোনো অবিচার, বৈষম্য বা শোষণ চিরস্থায়ী নয়। জনগণের ঐক্য, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগই ইতিহাস বদলায়। স্বাধীনতা, সমতা, ভ্রাতৃত্বÑএই তিন নীতি আজও মানবসভ্যতার আলোকবর্তিকা।
২৩৬ বছর পর আমরা যখন ফরাসি বিপ্লবকে স্মরণ করি, তখন কেবল অতীতকে নয়, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকেও দেখতে হয়।
সমাজতন্ত্র অভিমুখী অসাম্প্রদায়িক জনগণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রত্যয়ে সমতা-ন্যায্যতার প্রশ্নে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনেই জনগণের নতুন ধারার এক আর্থসামাজিক বৈপ্লবিক ব্যবস্থা প্রবর্তনে বিশ্বজনীন মহান ও কীর্তিমান বিপ্লবীদের রাজনীতি, আত্মোৎসর্গ, জীবন সংগ্রাম, কীর্তি, ইতিহাস, তত্ত্ব ও অনুশীলন সম্পর্কে পাঠ প্রাসঙ্গিক ও জরুরী। কিংবদন্তী সকল বিপ্লবীসহ ইতিহাসের নির্মাতা ও চালিকাশক্তি জনগণের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা ও অভিবাদন!
বাংলাদেশের জন্য আজ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো একটি বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। সেই সমাজ নির্মাণের স্বপ্নেই আমাদের ফরাসি বিপ্লবের আদর্শকে ধারণ করতে হবে।
ইতিহাসের সেই মহাকাব্যিক সত্য আজও ধ্বনিত হয়Ñ “জনগণই ইতিহাসের নির্মাতা।”
[লেখক: কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জাতীয় কৃষক সমিতি]