মিহির কুমার রায়
একবিংশ শতকে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বড় সামাজিক-অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলির একটি হলো যুব বেকারত্ব। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ শিক্ষা শেষ করেও কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে না। শুধু কর্মসংস্থানের অভাব নয়, তারা যেসব কাজ পাচ্ছে তার বেশিরভাগই অপ্রতুল, অস্থায়ী বা শোভনহীন। এর ফলে তরুণদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে এবং রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই সংকট আরও তীব্র। আমাদের জনসংখ্যার বড় অংশ তরুণ; এরা দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী জনমিতিক সম্পদ হতে পারত। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা, দক্ষতার ঘাটতি, প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারা এবং কর্মসংস্থানের সীমিত ক্ষেত্রÑএসব কারণে এই সম্পদ এখন অনেকাংশে বোঝায় পরিণত হচ্ছে।
সম্প্রতি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনের ফাঁকে অনুষ্ঠিত ‘ওয়ার্ল্ড প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন ফর ইয়ুথ’-এর ৩০তম বার্ষিকী সভায় বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস যুব বেকারত্বকে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেন। তার বক্তব্য শুধু বৈশ্বিক বাস্তবতার প্রতিধ্বনি নয়, বরং বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটকেও সামনে আনে।
প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্যে স্পষ্ট করে বলেন, তরুণরা পরিবর্তনের প্রধান চালিকাশক্তি। বাংলাদেশের তরুণরা স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অবসানে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এই তরুণরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বৈষম্য, সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রোটেকশনিজম ও ডিজিটাল বিভাজনে।
তিনি উল্লেখ করেন, তরুণদের বেকারত্বের হার প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় চার গুণ বেশি, বিশেষ করে স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে। তাই শুধুমাত্র চাকরির সুযোগ নয়, বরং উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশের জাতীয় যুব উদ্যোক্তা নীতি সেই দিকেই একটি পদক্ষেপ, যার মাধ্যমে তরুণরা অর্থায়ন, দক্ষতা ও বাজারে প্রবেশাধিকার পাচ্ছে।
ইউনূস আরও বলেন, যুব ক্ষমতায়ন কেবল কোনো দেশের একার দায়িত্ব নয়; বরং বৈশ্বিক সহযোগিতার মাধ্যমেই টেকসই সমাধান সম্ভব। অন্যথায় হতাশা দ্রুত অশান্তিতে রূপ নেবে, যা আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।
বর্তমান বিশ্বে কর্মসংস্থান দ্রুত বদলে যাচ্ছে। প্রযুক্তি, অটোমেশন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বহু পেশাকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম’-এর ফিউচার অব জবস ২০২৫ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী পাঁচ বছরে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৯ কোটি ২০ লাখ চাকরি বিলুপ্ত হতে পারে, বিশেষ করে পুনরাবৃত্তিমূলক হাতের কাজ ও দাপ্তরিক পেশায়।
অন্যদিকে এআই, ডেটা অ্যানালিটিক্স, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, সাইবার সিকিউরিটি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, বায়োটেকনোলজিÑএসব ক্ষেত্রে নতুন করে প্রায় ১৭ কোটি কর্মসংস্থান তৈরি হবে। কিন্তু সমস্যা হলোÑএই নতুন চাকরির জন্য যে ধরনের দক্ষতা দরকার, তা উন্নয়নশীল দেশের অধিকাংশ তরুণের নেই। ফলে একদিকে চাকরির সংকোচন, অন্যদিকে সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হওয়ার বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে।
এছাড়া বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোতে বৈষম্য আরও প্রকট। ইউরোপ-আমেরিকার তরুণরা যেখানে টেকভিত্তিক কাজ পাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার তরুণদের বড় অংশ এখনও প্রথাগত চাকরির বাজারেই আটকে আছে।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। এর মধ্যে প্রায় ৪ কোটি ৬০ লাখ তরুণ (১৫-২৯ বছর বয়সী)। অর্থাৎ জনসংখ্যার প্রায় ২৭ শতাংশই তরুণ। এত বড় কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী একটি বিশাল জনমিতিক সুফল হতে পারত, যদি তাদের দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা যেত।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৩) তথ্য অনুযায়ী, দেশের বেকারত্বের হার যেখানে ৩.৫ শতাংশ, সেখানে যুব বেকারত্বের হার ৭.২ শতাংশ। অর্থাৎ জাতীয় গড়ের দ্বিগুণেরও বেশি। দেশে প্রায় ১ কোটি ৯৪ লাখ তরুণ বর্তমানে বেকার।
এর মধ্যে আবার শহরাঞ্চলে বেকারত্ব বেশি। বিশেষ করে নারী তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার উদ্বেগজনক। অনেক নারী উচ্চশিক্ষিত হয়েও কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছেন নাÑসামাজিক বাধা, নিরাপত্তাহীনতা ও কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের কারণে।
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৯ লাখ শিক্ষার্থী স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। কিন্তু চাকরির বাজারে তাদের জায়গা খুব সীমিত। ২০২২ সালের জরিপে দেখা গেছেÑউচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার প্রায় ১২ শতাংশ।
বিশেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের অবস্থা বেশি খারাপ। প্রতি বছর প্রায় ৬ লাখ শিক্ষার্থী পাশ করলেও তাদের মাত্র ২১ শতাংশ চাকরি পায়। বাকি অংশকে দীর্ঘ সময় বেকার থাকতে হয়।
কারণ হলো শিক্ষাব্যবস্থা শ্রমবাজারের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে যা শেখানো হচ্ছে, তার বেশিরভাগই চাকরির বাজারে প্রয়োগযোগ্য নয়। সফট স্কিলস (যোগাযোগ, নেতৃত্ব, দলগত কাজ) এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার ঘাটতি প্রকট।
ফলে শিক্ষিত যুবকেরাও বেকার থেকে যাচ্ছে, যা সমাজে হতাশা ও অস্থিরতা বাড়াচ্ছে।
বাংলাদেশের যুব বেকারত্বের একটি বড় অংশ হলো নারী। শহরাঞ্চলে শিক্ষিত নারীদের একটি বড় অংশ বেকার। এর পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে: সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধা, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা, মাতৃত্বজনিত সাপোর্ট সিস্টেমের অভাব, সমান মজুরি না পাওয়া।
জাতীয়ভাবে কর্মক্ষম বয়সী নারীদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ এখনও শ্রমবাজারের বাইরে। অর্থাৎ শিক্ষিত হয়েও তারা চাকরিতে আসছে না। এভাবে একটি বড় অংশ কর্মশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
তবে হতাশার মাঝেও নতুন সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশের তরুণরা ফ্রিল্যান্সিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, কনটেন্ট ক্রিয়েশন, গেম ডেভেলপমেন্ট, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং, ডেটা অ্যানালিটিক্স, ই-কমার্স ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে প্রবেশ করছে।
বাংলাদেশ আইসিটি ডিভিশনের তথ্যমতে, বর্তমানে প্রায় ৬ লাখ ফ্রিল্যান্সার আন্তর্জাতিক বাজারে কাজ করছে, যা বছরে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছে।
এছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানি, পর্যটন, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি–প্রযুক্তিÑএসব খাতে তরুণদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি হচ্ছে। তবে এগুলোর জন্য দরকার পরিকল্পিত বিনিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামো।
কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো বিনিয়োগ। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি ও নীতি-অসংগতির কারণে দেশে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ আসছে না। ফলে শিল্পকারখানা বন্ধ হচ্ছে, নতুন চাকরি তৈরি হচ্ছে না।
শুধু বিদেশি বিনিয়োগ নয়, দেশীয় উদ্যোক্তারাও অনিশ্চয়তার কারণে বড় বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না। এর প্রভাব সরাসরি পড়ছে তরুণদের ওপর।
সমাধানের পথ খুঁজতে করতে হবে স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা হতে পারে: বেকার যুবকদের তালিকা করে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি চালু করা, ক্ষুদ্রঋণ ও উদ্যোক্তা সহায়তা প্রকল্প সম্প্রসারণ, নারী যুবকদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও সাপোর্ট সিস্টেম নিশ্চিত করা।
মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা হতে পারে: বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম শ্রমবাজারভিত্তিক করা, শিল্পখাতে ইন্টার্নশিপ, এ্যাপ্রেনটিশশীপ চালু করা, প্রযুক্তিগত ও ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ সম্প্রসারণ।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হতে পারে: শিক্ষা, শিল্প ও দক্ষতা উন্নয়ন নীতির সমন্বয়; পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ ও কার্যকর বাস্তবায়ন; টেকসই বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি করা; আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
কেবল সরকার নয়, তরুণদের নিজেদেরও ভূমিকা রাখতে হবে। উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা, উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগানো, সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা রাখাÑএসবের মাধ্যমে তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরাই গড়ে তুলতে পারে।
বাংলাদেশের সামনে আজ এক দ্বিধাবিভক্ত পথ। একদিকে আছে বিশাল যুব জনসংখ্যাÑযদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তবে এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকা হতে পারে। অন্যদিকে যদি তাদের বেকারত্ব ও হতাশায় ডুবে যেতে দেওয়া হয়, তবে তা সমাজে অস্থিরতা, অপরাধ ও উন্নয়ন ব্যর্থতায় রূপ নেবে।
এখনই সময়Ñসরকার, শিল্পখাত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যৌথ প্রচেষ্টায় যুবকদের জন্য শোভন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার।
তরুণরাই ভবিষ্যৎ। তাদের অবহেলা করা মানে দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া। তাই যুব বেকারত্বের সমাধান শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি জাতীয় টিকে থাকারও প্রশ্ন।
[লেখক : সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিট]
মিহির কুমার রায়
শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫
একবিংশ শতকে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বড় সামাজিক-অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলির একটি হলো যুব বেকারত্ব। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ শিক্ষা শেষ করেও কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে না। শুধু কর্মসংস্থানের অভাব নয়, তারা যেসব কাজ পাচ্ছে তার বেশিরভাগই অপ্রতুল, অস্থায়ী বা শোভনহীন। এর ফলে তরুণদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে এবং রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই সংকট আরও তীব্র। আমাদের জনসংখ্যার বড় অংশ তরুণ; এরা দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী জনমিতিক সম্পদ হতে পারত। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা, দক্ষতার ঘাটতি, প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারা এবং কর্মসংস্থানের সীমিত ক্ষেত্রÑএসব কারণে এই সম্পদ এখন অনেকাংশে বোঝায় পরিণত হচ্ছে।
সম্প্রতি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনের ফাঁকে অনুষ্ঠিত ‘ওয়ার্ল্ড প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন ফর ইয়ুথ’-এর ৩০তম বার্ষিকী সভায় বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস যুব বেকারত্বকে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেন। তার বক্তব্য শুধু বৈশ্বিক বাস্তবতার প্রতিধ্বনি নয়, বরং বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটকেও সামনে আনে।
প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্যে স্পষ্ট করে বলেন, তরুণরা পরিবর্তনের প্রধান চালিকাশক্তি। বাংলাদেশের তরুণরা স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অবসানে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এই তরুণরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বৈষম্য, সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রোটেকশনিজম ও ডিজিটাল বিভাজনে।
তিনি উল্লেখ করেন, তরুণদের বেকারত্বের হার প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় চার গুণ বেশি, বিশেষ করে স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে। তাই শুধুমাত্র চাকরির সুযোগ নয়, বরং উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশের জাতীয় যুব উদ্যোক্তা নীতি সেই দিকেই একটি পদক্ষেপ, যার মাধ্যমে তরুণরা অর্থায়ন, দক্ষতা ও বাজারে প্রবেশাধিকার পাচ্ছে।
ইউনূস আরও বলেন, যুব ক্ষমতায়ন কেবল কোনো দেশের একার দায়িত্ব নয়; বরং বৈশ্বিক সহযোগিতার মাধ্যমেই টেকসই সমাধান সম্ভব। অন্যথায় হতাশা দ্রুত অশান্তিতে রূপ নেবে, যা আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।
বর্তমান বিশ্বে কর্মসংস্থান দ্রুত বদলে যাচ্ছে। প্রযুক্তি, অটোমেশন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বহু পেশাকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম’-এর ফিউচার অব জবস ২০২৫ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী পাঁচ বছরে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৯ কোটি ২০ লাখ চাকরি বিলুপ্ত হতে পারে, বিশেষ করে পুনরাবৃত্তিমূলক হাতের কাজ ও দাপ্তরিক পেশায়।
অন্যদিকে এআই, ডেটা অ্যানালিটিক্স, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, সাইবার সিকিউরিটি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, বায়োটেকনোলজিÑএসব ক্ষেত্রে নতুন করে প্রায় ১৭ কোটি কর্মসংস্থান তৈরি হবে। কিন্তু সমস্যা হলোÑএই নতুন চাকরির জন্য যে ধরনের দক্ষতা দরকার, তা উন্নয়নশীল দেশের অধিকাংশ তরুণের নেই। ফলে একদিকে চাকরির সংকোচন, অন্যদিকে সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হওয়ার বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে।
এছাড়া বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোতে বৈষম্য আরও প্রকট। ইউরোপ-আমেরিকার তরুণরা যেখানে টেকভিত্তিক কাজ পাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার তরুণদের বড় অংশ এখনও প্রথাগত চাকরির বাজারেই আটকে আছে।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। এর মধ্যে প্রায় ৪ কোটি ৬০ লাখ তরুণ (১৫-২৯ বছর বয়সী)। অর্থাৎ জনসংখ্যার প্রায় ২৭ শতাংশই তরুণ। এত বড় কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী একটি বিশাল জনমিতিক সুফল হতে পারত, যদি তাদের দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা যেত।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৩) তথ্য অনুযায়ী, দেশের বেকারত্বের হার যেখানে ৩.৫ শতাংশ, সেখানে যুব বেকারত্বের হার ৭.২ শতাংশ। অর্থাৎ জাতীয় গড়ের দ্বিগুণেরও বেশি। দেশে প্রায় ১ কোটি ৯৪ লাখ তরুণ বর্তমানে বেকার।
এর মধ্যে আবার শহরাঞ্চলে বেকারত্ব বেশি। বিশেষ করে নারী তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার উদ্বেগজনক। অনেক নারী উচ্চশিক্ষিত হয়েও কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছেন নাÑসামাজিক বাধা, নিরাপত্তাহীনতা ও কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের কারণে।
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৯ লাখ শিক্ষার্থী স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। কিন্তু চাকরির বাজারে তাদের জায়গা খুব সীমিত। ২০২২ সালের জরিপে দেখা গেছেÑউচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার প্রায় ১২ শতাংশ।
বিশেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের অবস্থা বেশি খারাপ। প্রতি বছর প্রায় ৬ লাখ শিক্ষার্থী পাশ করলেও তাদের মাত্র ২১ শতাংশ চাকরি পায়। বাকি অংশকে দীর্ঘ সময় বেকার থাকতে হয়।
কারণ হলো শিক্ষাব্যবস্থা শ্রমবাজারের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে যা শেখানো হচ্ছে, তার বেশিরভাগই চাকরির বাজারে প্রয়োগযোগ্য নয়। সফট স্কিলস (যোগাযোগ, নেতৃত্ব, দলগত কাজ) এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার ঘাটতি প্রকট।
ফলে শিক্ষিত যুবকেরাও বেকার থেকে যাচ্ছে, যা সমাজে হতাশা ও অস্থিরতা বাড়াচ্ছে।
বাংলাদেশের যুব বেকারত্বের একটি বড় অংশ হলো নারী। শহরাঞ্চলে শিক্ষিত নারীদের একটি বড় অংশ বেকার। এর পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে: সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধা, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা, মাতৃত্বজনিত সাপোর্ট সিস্টেমের অভাব, সমান মজুরি না পাওয়া।
জাতীয়ভাবে কর্মক্ষম বয়সী নারীদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ এখনও শ্রমবাজারের বাইরে। অর্থাৎ শিক্ষিত হয়েও তারা চাকরিতে আসছে না। এভাবে একটি বড় অংশ কর্মশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
তবে হতাশার মাঝেও নতুন সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশের তরুণরা ফ্রিল্যান্সিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, কনটেন্ট ক্রিয়েশন, গেম ডেভেলপমেন্ট, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং, ডেটা অ্যানালিটিক্স, ই-কমার্স ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে প্রবেশ করছে।
বাংলাদেশ আইসিটি ডিভিশনের তথ্যমতে, বর্তমানে প্রায় ৬ লাখ ফ্রিল্যান্সার আন্তর্জাতিক বাজারে কাজ করছে, যা বছরে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছে।
এছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানি, পর্যটন, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি–প্রযুক্তিÑএসব খাতে তরুণদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি হচ্ছে। তবে এগুলোর জন্য দরকার পরিকল্পিত বিনিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামো।
কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো বিনিয়োগ। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি ও নীতি-অসংগতির কারণে দেশে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ আসছে না। ফলে শিল্পকারখানা বন্ধ হচ্ছে, নতুন চাকরি তৈরি হচ্ছে না।
শুধু বিদেশি বিনিয়োগ নয়, দেশীয় উদ্যোক্তারাও অনিশ্চয়তার কারণে বড় বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না। এর প্রভাব সরাসরি পড়ছে তরুণদের ওপর।
সমাধানের পথ খুঁজতে করতে হবে স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা হতে পারে: বেকার যুবকদের তালিকা করে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি চালু করা, ক্ষুদ্রঋণ ও উদ্যোক্তা সহায়তা প্রকল্প সম্প্রসারণ, নারী যুবকদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও সাপোর্ট সিস্টেম নিশ্চিত করা।
মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা হতে পারে: বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম শ্রমবাজারভিত্তিক করা, শিল্পখাতে ইন্টার্নশিপ, এ্যাপ্রেনটিশশীপ চালু করা, প্রযুক্তিগত ও ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ সম্প্রসারণ।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হতে পারে: শিক্ষা, শিল্প ও দক্ষতা উন্নয়ন নীতির সমন্বয়; পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ ও কার্যকর বাস্তবায়ন; টেকসই বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি করা; আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
কেবল সরকার নয়, তরুণদের নিজেদেরও ভূমিকা রাখতে হবে। উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা, উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগানো, সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা রাখাÑএসবের মাধ্যমে তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরাই গড়ে তুলতে পারে।
বাংলাদেশের সামনে আজ এক দ্বিধাবিভক্ত পথ। একদিকে আছে বিশাল যুব জনসংখ্যাÑযদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তবে এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকা হতে পারে। অন্যদিকে যদি তাদের বেকারত্ব ও হতাশায় ডুবে যেতে দেওয়া হয়, তবে তা সমাজে অস্থিরতা, অপরাধ ও উন্নয়ন ব্যর্থতায় রূপ নেবে।
এখনই সময়Ñসরকার, শিল্পখাত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যৌথ প্রচেষ্টায় যুবকদের জন্য শোভন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার।
তরুণরাই ভবিষ্যৎ। তাদের অবহেলা করা মানে দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া। তাই যুব বেকারত্বের সমাধান শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি জাতীয় টিকে থাকারও প্রশ্ন।
[লেখক : সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিট]