মমিনুর রহমান
সামাজিক ও অনলাইন মিডিয়ায় সম্প্রতি দেখা গেছে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিচ্ছেনÑ“সাবজেক্ট যার, ক্যাডার তার।” এই স্লোগানটির মধ্যে লুকিয়ে আছে দ্বিমুখী অর্থ। ইতিবাচক দিকটি হলো, দীর্ঘ সময় ধরে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে অধ্যয়ন করা শিক্ষার্থী যদি সেই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ক্যাডারে সুযোগ পায়, তবে সেবার মান বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে নেতিবাচক দিকটি হলো, এভাবে কেবল কিছু বিভাগই সুবিধা পাবে। উদাহরণস্বরূপÑলোকপ্রশাসন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থীরা প্রশাসন ও পররাষ্ট্র ক্যাডারে একচেটিয়া সুযোগ দাবি করতে পারে। এভাবে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি কার্যকর হলে অন্যান্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা এসব ক্যাডারে প্রবেশ করতে পারবে না। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এটি বাস্তবায়ন করা কঠিন। কারণ দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর স্বপ্ন হলো প্রশাসন বা পররাষ্ট্র ক্যাডারে যোগ দেওয়া। দেশের মোট ২৬টি ক্যাডারের মধ্যে সবচেয়ে লোভনীয় ক্যাডার হলো প্রশাসন ও পররাষ্ট্র।
বর্তমানে যে কোনো বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাসকৃত শিক্ষার্থী বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে। মোট ২৬টি ক্যাডার আছেÑ১৪টি সাধারণ ও ১২টি প্রযুক্তিগত বা টেকনিক্যাল ক্যাডার। টেকনিক্যাল ক্যাডারে মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয় অন্তর্ভুক্ত, যেখানে শুধু সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরাই পরীক্ষা দিতে পারেন। ফলে টেকনিক্যাল ক্যাডার থেকে বঞ্চিত হয়ে যাচ্ছে লোকপ্রশাসনের শিক্ষার্থীরা।
উদাহরণস্বরূপ, ৩৮তম বিসিএসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২,১২৯ জন প্রার্থীর চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করে। সেখানে পররাষ্ট্র ক্যাডারে নির্বাচিত ২৫ জনের মধ্যে ২০ জনই ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার। এর মধ্যে ১৩ জন ইঞ্জিনিয়ার, যার ১০ জন বুয়েট থেকে এবং ৭ জন ডাক্তার। একইভাবে ৪০তম বিসিএসেও দেখা যায়Ñপররাষ্ট্র, প্রশাসন, পুলিশ, কাস্টমস, কর ও খাদ্য ক্যাডারে যারা শীর্ষে হয়েছেন, তারা সবাই ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
এখানে প্রশ্ন ওঠেÑডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়াররাই প্রশাসন বা কূটনীতির জন্য যোগ দেন, তবে এত বছর প্রযুক্তি ও চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনা কেন? তাদের শিক্ষা ও দক্ষতা গবেষণা, উদ্ভাবন বা স্বাস্থ্যসেবা খাতে কাজে লাগার কথা ছিল। একজন ডাক্তার দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূল স্তম্ভ, একজন ইঞ্জিনিয়ার দেশের অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ভিত্তি। কিন্তুতারা প্রশাসন বা পররাষ্ট্রে চলে গেলে দেশের এই মূল খাতগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অন্যদিকে, লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রব্যবস্থা, প্রশাসন, কূটনীতি, উন্নয়ননীতি ও জননীতি বিষয়ে সরাসরি শিক্ষা গ্রহণ করেন। বিভিন্ন সেমিস্টারে তাদের অ্যাসাইনমেন্ট ও গবেষণার বিষয় রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, পুলিশ ব্যবস্থাপনা বা পররাষ্ট্র নীতি সম্পর্কিত। ফলে তারা শুধু তাত্ত্বিকভাবে নয়, বাস্তবভাবে এই বিষয়ে পারদর্শী। তবুও বিসিএস কাঠামো এবং শিক্ষা ব্যবস্থার অযৌক্তিকতার কারণে তারা অবহেলিত।
এটি নিঃসন্দেহে একটি বৈপরীত্য। যারা প্রশাসন ও কূটনীতির জন্য প্রস্তুত, তারা সুযোগ পাচ্ছে না; আর যারা প্রযুক্তি বা চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত, তারা প্রশাসন বা পররাষ্ট্রে যাচ্ছেন। এর ফলে দুই ক্ষেত্রই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেÑস্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি খাত মেধাবী হারাচ্ছে, প্রশাসন খাত পাচ্ছে অনভিজ্ঞ কর্মকর্তাকে।
আমাদের দাবি একেবারেই যৌক্তিক ও ন্যায্য। স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে প্রায় ৫০টিরও অধিক কোর্সে আমরা বিভিন্ন বিষয় পড়ি। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ‘পৌরনীতি ও সুশাসন’ বিষয়টির সঙ্গে লোকপ্রশাসন বিভাগের সিলেবাসের শতভাগ সামঞ্জস্য রয়েছে। সংক্ষেপে উল্লেখ করা যাক:
স্নাতকের প্রথম সেমিস্টার: ‘রাজনীতি ও সরকার পরিচিতি’ কোর্সে রাজনীতি ও সরকারের মূল অঙ্গ যেমন আইন, শাসন, বিচার বিভাগ পড়ি। এটি উচ্চ মাধ্যমিকের ‘পৌরনীতি ও সুশাসন’ বিষয়টির প্রথম পত্রের ‘সরকার কাঠামো ও সরকারের অঙ্গসমূহ’ অধ্যায়ের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত।
দ্বিতীয় সেমিস্টার: ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’ কোর্সে বাংলাদেশের ইতিহাসÑ মৌর্য সাম্রাজ্য, পাল আমল, সেন আমল, মুসলিম শাসনামল, ব্রিটিশ শাসনামল, পাকিস্তানি শাসন আমল এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটÑপড়া হয়। এটি ‘পৌরনীতি ও সুশাসন’ দ্বিতীয় পত্রের ‘ব্রিটিশ ভারতের প্রতিনিধিত্বশীল শাসন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা’ অধ্যায়ের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাদৃশ্যপূর্ণ।
চতুর্থ সেমিস্টার: ‘বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার’ কোর্সে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা এবং জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে পড়ানো হয়। এটি দ্বিতীয় পত্রের ‘স্থানীয় শাসন’ অধ্যায়ের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত।
ষষ্ঠ সেমিস্টার: ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্ক’ কোর্সে বৈদেশিক নীতি শেখানো হয়। এটি দ্বিতীয় পত্রের ‘বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি’ অধ্যায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিলে।
সপ্তম সেমিস্টার: ‘প্রশাসনিক আইন’ কোর্সে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল, সরকারি কর্ম কমিশন ইত্যাদির গঠন ও কার্যাবলি শেখানো হয়, যা দ্বিতীয় পত্রের ‘সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান’ অধ্যায়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
স্নাতকোত্তর: ‘বিশ্বায়ন, প্রশাসন ও উন্নয়ন’ ও ‘মানবাধিকার ও বিচার প্রশাসন’ কোর্সে ই-গভার্নেন্স, সুশাসন, মানবাধিকার, আইন ও প্রশাসনিক কাঠামো শেখানো হয়।
প্রতিবছর এনটিআরসিএ হাজারো শিক্ষক নিয়োগ করে। ব্যাংক বা বিসিএসের তুলনায় অনেক বেশি কর্মসংস্থান তৈরি হয় এই খাতে। কিন্তু সেখানে লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থীরা আবেদন করতে পারেন না। সরকারি-বেসরকারি কলেজগুলোতে তাদের জন্য কোনো সুযোগ নেই। অথচ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা শিক্ষা ক্যাডারে সুযোগ পাচ্ছেন, যদিও তাদের পাঠ্যসূচি লোকপ্রশাসনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় এক হাজার লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন। কিন্তু তাদের জন্য কোনো নির্দিষ্ট ক্যাডার নেই। সিলেবাস শতভাগ মিল থাকা সত্ত্বেও তারা অবহেলিত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা শিক্ষা ক্যাডার ভোগ করছে, কিন্তু সমন্বয় থাকা সত্ত্বেও লোকপ্রশাসনের শিক্ষার্থীরা সুযোগ পাচ্ছে না।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাথে সমন্বয় করে লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যাডার তৈরি করা সম্ভব। এটি সহজ, ন্যায্য ও কার্যকর সমাধান। বিকল্পভাবে, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লোকপ্রশাসন সাবজেক্ট চালু করা যেতে পারে বা ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি প্রয়োগ করা সম্ভব। তবে রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক ও কার্যকর হবেÑরাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে সমন্বয় করা। এতে বৃহৎ অংশ শিক্ষার্থী ন্যায্যভাবে সুযোগ পাবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি শুধু একটি শিক্ষাগত বিষয় নয়, বরং একটি জাতীয় স্বার্থ। সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করলে লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থীরা দেশের প্রশাসনিক কাঠামোতে যোগ্য ও দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে স্থান নিতে পারবে। এতে বিসিএসের কাঠামোয় স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা ও যোগ্যতার সমন্বয় নিশ্চিত হবে।
যাদের জন্য এই ন্যায্য অধিকার নির্ধারণ করা হয়নি, তারা দীর্ঘদিন ধরে তাদের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অবহেলিত হয়ে আসছেন। এই বৈষম্য শুধুমাত্র শিক্ষার্থীর ক্ষতি করছে না, দেশের প্রশাসন ও উন্নয়নের মানকেও প্রভাবিত করছে। তাই সময় এসেছেÑশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকার ও নীতি নির্ধারকরা যৌথ উদ্যোগে এটি সমাধান করুন।
লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থীদের বিসিএসের শিক্ষা ক্যাডারে অন্তর্ভুক্তি শুধু ন্যায্যতা ও অধিকার প্রশ্ন নয়, বরং এটি দেশের প্রশাসনিক দক্ষতা, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং জাতির সামগ্রিক উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। সঠিক সমন্বয় ও ন্যায্য সুযোগ নিশ্চিত করা হলে বিসিএস ও সরকারি চাকরির কাঠামোয় যোগ্যতার যথাযথ প্রয়োগ সম্ভব। এভাবেই আমরা একটি কার্যকর, দক্ষ ও ন্যায্য প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করতে পারি।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়]
মমিনুর রহমান
শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫
সামাজিক ও অনলাইন মিডিয়ায় সম্প্রতি দেখা গেছে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিচ্ছেনÑ“সাবজেক্ট যার, ক্যাডার তার।” এই স্লোগানটির মধ্যে লুকিয়ে আছে দ্বিমুখী অর্থ। ইতিবাচক দিকটি হলো, দীর্ঘ সময় ধরে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে অধ্যয়ন করা শিক্ষার্থী যদি সেই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ক্যাডারে সুযোগ পায়, তবে সেবার মান বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে নেতিবাচক দিকটি হলো, এভাবে কেবল কিছু বিভাগই সুবিধা পাবে। উদাহরণস্বরূপÑলোকপ্রশাসন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থীরা প্রশাসন ও পররাষ্ট্র ক্যাডারে একচেটিয়া সুযোগ দাবি করতে পারে। এভাবে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি কার্যকর হলে অন্যান্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা এসব ক্যাডারে প্রবেশ করতে পারবে না। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এটি বাস্তবায়ন করা কঠিন। কারণ দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর স্বপ্ন হলো প্রশাসন বা পররাষ্ট্র ক্যাডারে যোগ দেওয়া। দেশের মোট ২৬টি ক্যাডারের মধ্যে সবচেয়ে লোভনীয় ক্যাডার হলো প্রশাসন ও পররাষ্ট্র।
বর্তমানে যে কোনো বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাসকৃত শিক্ষার্থী বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে। মোট ২৬টি ক্যাডার আছেÑ১৪টি সাধারণ ও ১২টি প্রযুক্তিগত বা টেকনিক্যাল ক্যাডার। টেকনিক্যাল ক্যাডারে মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয় অন্তর্ভুক্ত, যেখানে শুধু সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরাই পরীক্ষা দিতে পারেন। ফলে টেকনিক্যাল ক্যাডার থেকে বঞ্চিত হয়ে যাচ্ছে লোকপ্রশাসনের শিক্ষার্থীরা।
উদাহরণস্বরূপ, ৩৮তম বিসিএসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২,১২৯ জন প্রার্থীর চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করে। সেখানে পররাষ্ট্র ক্যাডারে নির্বাচিত ২৫ জনের মধ্যে ২০ জনই ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার। এর মধ্যে ১৩ জন ইঞ্জিনিয়ার, যার ১০ জন বুয়েট থেকে এবং ৭ জন ডাক্তার। একইভাবে ৪০তম বিসিএসেও দেখা যায়Ñপররাষ্ট্র, প্রশাসন, পুলিশ, কাস্টমস, কর ও খাদ্য ক্যাডারে যারা শীর্ষে হয়েছেন, তারা সবাই ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
এখানে প্রশ্ন ওঠেÑডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়াররাই প্রশাসন বা কূটনীতির জন্য যোগ দেন, তবে এত বছর প্রযুক্তি ও চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনা কেন? তাদের শিক্ষা ও দক্ষতা গবেষণা, উদ্ভাবন বা স্বাস্থ্যসেবা খাতে কাজে লাগার কথা ছিল। একজন ডাক্তার দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূল স্তম্ভ, একজন ইঞ্জিনিয়ার দেশের অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ভিত্তি। কিন্তুতারা প্রশাসন বা পররাষ্ট্রে চলে গেলে দেশের এই মূল খাতগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অন্যদিকে, লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রব্যবস্থা, প্রশাসন, কূটনীতি, উন্নয়ননীতি ও জননীতি বিষয়ে সরাসরি শিক্ষা গ্রহণ করেন। বিভিন্ন সেমিস্টারে তাদের অ্যাসাইনমেন্ট ও গবেষণার বিষয় রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, পুলিশ ব্যবস্থাপনা বা পররাষ্ট্র নীতি সম্পর্কিত। ফলে তারা শুধু তাত্ত্বিকভাবে নয়, বাস্তবভাবে এই বিষয়ে পারদর্শী। তবুও বিসিএস কাঠামো এবং শিক্ষা ব্যবস্থার অযৌক্তিকতার কারণে তারা অবহেলিত।
এটি নিঃসন্দেহে একটি বৈপরীত্য। যারা প্রশাসন ও কূটনীতির জন্য প্রস্তুত, তারা সুযোগ পাচ্ছে না; আর যারা প্রযুক্তি বা চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত, তারা প্রশাসন বা পররাষ্ট্রে যাচ্ছেন। এর ফলে দুই ক্ষেত্রই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেÑস্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি খাত মেধাবী হারাচ্ছে, প্রশাসন খাত পাচ্ছে অনভিজ্ঞ কর্মকর্তাকে।
আমাদের দাবি একেবারেই যৌক্তিক ও ন্যায্য। স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে প্রায় ৫০টিরও অধিক কোর্সে আমরা বিভিন্ন বিষয় পড়ি। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ‘পৌরনীতি ও সুশাসন’ বিষয়টির সঙ্গে লোকপ্রশাসন বিভাগের সিলেবাসের শতভাগ সামঞ্জস্য রয়েছে। সংক্ষেপে উল্লেখ করা যাক:
স্নাতকের প্রথম সেমিস্টার: ‘রাজনীতি ও সরকার পরিচিতি’ কোর্সে রাজনীতি ও সরকারের মূল অঙ্গ যেমন আইন, শাসন, বিচার বিভাগ পড়ি। এটি উচ্চ মাধ্যমিকের ‘পৌরনীতি ও সুশাসন’ বিষয়টির প্রথম পত্রের ‘সরকার কাঠামো ও সরকারের অঙ্গসমূহ’ অধ্যায়ের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত।
দ্বিতীয় সেমিস্টার: ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’ কোর্সে বাংলাদেশের ইতিহাসÑ মৌর্য সাম্রাজ্য, পাল আমল, সেন আমল, মুসলিম শাসনামল, ব্রিটিশ শাসনামল, পাকিস্তানি শাসন আমল এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটÑপড়া হয়। এটি ‘পৌরনীতি ও সুশাসন’ দ্বিতীয় পত্রের ‘ব্রিটিশ ভারতের প্রতিনিধিত্বশীল শাসন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা’ অধ্যায়ের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাদৃশ্যপূর্ণ।
চতুর্থ সেমিস্টার: ‘বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার’ কোর্সে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা এবং জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে পড়ানো হয়। এটি দ্বিতীয় পত্রের ‘স্থানীয় শাসন’ অধ্যায়ের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত।
ষষ্ঠ সেমিস্টার: ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্ক’ কোর্সে বৈদেশিক নীতি শেখানো হয়। এটি দ্বিতীয় পত্রের ‘বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি’ অধ্যায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিলে।
সপ্তম সেমিস্টার: ‘প্রশাসনিক আইন’ কোর্সে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল, সরকারি কর্ম কমিশন ইত্যাদির গঠন ও কার্যাবলি শেখানো হয়, যা দ্বিতীয় পত্রের ‘সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান’ অধ্যায়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
স্নাতকোত্তর: ‘বিশ্বায়ন, প্রশাসন ও উন্নয়ন’ ও ‘মানবাধিকার ও বিচার প্রশাসন’ কোর্সে ই-গভার্নেন্স, সুশাসন, মানবাধিকার, আইন ও প্রশাসনিক কাঠামো শেখানো হয়।
প্রতিবছর এনটিআরসিএ হাজারো শিক্ষক নিয়োগ করে। ব্যাংক বা বিসিএসের তুলনায় অনেক বেশি কর্মসংস্থান তৈরি হয় এই খাতে। কিন্তু সেখানে লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থীরা আবেদন করতে পারেন না। সরকারি-বেসরকারি কলেজগুলোতে তাদের জন্য কোনো সুযোগ নেই। অথচ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা শিক্ষা ক্যাডারে সুযোগ পাচ্ছেন, যদিও তাদের পাঠ্যসূচি লোকপ্রশাসনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় এক হাজার লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন। কিন্তু তাদের জন্য কোনো নির্দিষ্ট ক্যাডার নেই। সিলেবাস শতভাগ মিল থাকা সত্ত্বেও তারা অবহেলিত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা শিক্ষা ক্যাডার ভোগ করছে, কিন্তু সমন্বয় থাকা সত্ত্বেও লোকপ্রশাসনের শিক্ষার্থীরা সুযোগ পাচ্ছে না।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাথে সমন্বয় করে লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যাডার তৈরি করা সম্ভব। এটি সহজ, ন্যায্য ও কার্যকর সমাধান। বিকল্পভাবে, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লোকপ্রশাসন সাবজেক্ট চালু করা যেতে পারে বা ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি প্রয়োগ করা সম্ভব। তবে রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক ও কার্যকর হবেÑরাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে সমন্বয় করা। এতে বৃহৎ অংশ শিক্ষার্থী ন্যায্যভাবে সুযোগ পাবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি শুধু একটি শিক্ষাগত বিষয় নয়, বরং একটি জাতীয় স্বার্থ। সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করলে লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থীরা দেশের প্রশাসনিক কাঠামোতে যোগ্য ও দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে স্থান নিতে পারবে। এতে বিসিএসের কাঠামোয় স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা ও যোগ্যতার সমন্বয় নিশ্চিত হবে।
যাদের জন্য এই ন্যায্য অধিকার নির্ধারণ করা হয়নি, তারা দীর্ঘদিন ধরে তাদের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অবহেলিত হয়ে আসছেন। এই বৈষম্য শুধুমাত্র শিক্ষার্থীর ক্ষতি করছে না, দেশের প্রশাসন ও উন্নয়নের মানকেও প্রভাবিত করছে। তাই সময় এসেছেÑশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকার ও নীতি নির্ধারকরা যৌথ উদ্যোগে এটি সমাধান করুন।
লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থীদের বিসিএসের শিক্ষা ক্যাডারে অন্তর্ভুক্তি শুধু ন্যায্যতা ও অধিকার প্রশ্ন নয়, বরং এটি দেশের প্রশাসনিক দক্ষতা, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং জাতির সামগ্রিক উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। সঠিক সমন্বয় ও ন্যায্য সুযোগ নিশ্চিত করা হলে বিসিএস ও সরকারি চাকরির কাঠামোয় যোগ্যতার যথাযথ প্রয়োগ সম্ভব। এভাবেই আমরা একটি কার্যকর, দক্ষ ও ন্যায্য প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করতে পারি।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়]