ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
ভৌগোলিকভাবে মালয়েশিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অবস্থানে রয়েছে। মালাক্কা প্রণালী, ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ চীন সাগরকে সংযুক্ত করে, বিশ্বের অন্যতম সবচেয়ে ব্যস্ত সামুদ্রিক পথ। এই পথটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চক্রাকার রাস্তা। এর ফলে মালয়েশিয়া কেবল রপ্তানির জন্য নয়, সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে সংযুক্ত করেছে, যা তাকে কৌশলগতভাবে বড় মর্যাদা দেয়। এছাড়া, এশিয়া প্যাসিফিক, চীন ও ভারত সমুন্নত দেশগুলোর সঙ্গে যুক্ত হতে পারার সুযোগ এটি আরও বাড়ায়। মালয়, চিনা, ভারতীয়, আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও বহুসম্প্রদায়ের দেশ মালয়েশিয়া। স্বাধীনতার পর থেকেই একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল কীভাবে এই সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সামাজিক শান্তি ও সহাবস্থান নিশ্চিত করা যায়। জাতীয় শিক্ষানীতি ও পরবর্তী নীতি পরিকল্পনাগুলো সেই উদ্দেশ্যেই তৈরি করা হয়েছিল।
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে যোগ দেওয়া হয়। দক্ষতার উন্নয়নে শিক্ষা খাত এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন গুরুত্ব পায়। রাজনৈতিকভাবে যদিও সবসময়ই চ্যালেঞ্জ ছিল প্রতিনিধিত্ব, সাম্য বিচার, নীতি তত্ত্বাদির উপর সম্প্রদায়ভিত্তিক বিরোধ তবুও বড় ধরনের সহিংস অভ্যুত্থান বা গৃহযুদ্ধ এড়িয়ে যেতে পেরেছে এবং সাধারণভাবে একটি সংবিধানভিত্তিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা রীতি বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে।
মালেশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি বহুসংস্কৃতিযুক্ত দেশ। এটি মালাক্কা প্রণালী এবং দক্ষিণ চীন সাগরের সংযোগস্থলে অবস্থিত, যা বিশ্ব বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। দেশটির অর্থনীতি প্রধানত কৃষি, শিল্প, এবং পরিষেবা খাতের সমন্বয়ে গঠিত। ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে মালেশিয়া ছিল একটি গরীব কৃষিভিত্তিক দেশ। কিন্তু তারপর থেকে মালেশিয়া ধারাবাহিকভাবে উন্নয়নের পথে এগিয়ে আসছে। আজকের মালেশিয়া একটি উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃত, যা এশিয়ার উন্নয়নের এক মডেল। ১৯৫৭ সালে স্বাধীনতার পর মালায়েশিয়া একটি কৃষিভিত্তিক, সম্পদনির্ভর অর্থনীতির দেশ ছিল, যেখানে কৃষি, রাবার, টিন, কাঠ, ফলমূল ও তামাক ইত্যাদি ছিল প্রধান রপ্তানি সামগ্রী। কিন্তু আজকের দিনে মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়া সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রধান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও কৌশলগত খেলোয়াড়ের মধ্যেই একটা মর্যাদাজনক অবস্থান পেয়েছে।
স্বাধীনতার পর প্রথম কয়েক দশকে সরকার মূলত দেশকে ভিত্তিমূলক উন্নয়ন ও মৌলিক সেবা নিশ্চিত করতে শুরু করে। সরকারি নীতি ছিল ‘উন্মুক্ত অর্থনীতি’। বিদেশী বিনিয়োগ গ্রহণ ও রপ্তানিমুখী শিল্প গঠন। বিশেষভাবে, পেনাংতে বিনিয়োগ প্রবল হয় ফ্রি ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন গঠন ও বৈদেশিক মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেশনের সুবিধাজনক নীতি গ্রহণের মাধ্যমে: উদাহরণস্বরূপ, ইলেকট্রনিক্স ফার্ম, অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্ট ইত্যাদি।
মালেশিয়ার অর্থনীতি বৈচিত্র্যময় এবং একে ‘মডেল অর্থনীতি’ হিসেবে ধরা হয়। ১৯৭০ এর দশকে দেশটি ‘নিউ ইকোনমিক পলিসি’ গ্রহণ করে, যার লক্ষ্য ছিল জাতিগত বৈষম্য কমানো এবং অর্থনৈতিক সুযোগ সম্প্রসারণ। এই নীতি মালেশিয়ার অর্থনৈতিক কাঠামোকে বৈচিত্র্যময় করে তুলতে সহায়তা করে। উদাহরণস্বরূপ, মালেশিয়া তেল, গ্যাস, পেট্রোকেমিক্যাল, ইলেকট্রনিক্স, এবং বৈদ্যুতি শিল্পের ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি করেছে। দেশটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ রবার উৎপাদক এবং এলইডি উৎপাদনে শীর্ষস্থানীয়। এছাড়া মালেশিয়ার বাণিজ্য খাত ও পরিষেবা খাতও দ্রুত বিকাশ লাভ করেছে, যা দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি মালেশিয়ার মানবসম্পদ উন্নয়নে ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করেছে। মালেশিয়ার সরকার শিক্ষায় বিনিয়োগ করে দক্ষ ও সু-প্রশিক্ষিত জনশক্তি তৈরিতে জোর দিয়েছে। এই শিক্ষাব্যবস্থা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্য বজায় রাখার পাশাপাশি প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি মনোযোগ বৃদ্ধি করেছে। স্বাস্থ্য খাতে উন্নতি মানে কেবল রোগপ্রতিরোধ নয়, বরং জীবন প্রত্যাশা ও জনস্বাস্থ্য সূচকেও উন্নতি হয়েছে। এই মানবসম্পদ উন্নয়ন মালেশিয়াকে দ্রুত উন্নয়নের রাস্তায় নিয়ে গেছে।
বর্তমান বিশ্বে উন্নয়ন শব্দটি একটি দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সামাজিক উন্নতি, এবং প্রযুক্তিগত বিকাশের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশেষ করে এশিয়া মহাদেশে উন্নয়ন সূচকে বিভিন্ন দেশ নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করছে। এই প্রসঙ্গে মালেশিয়া একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়, যা দ্রুতগতিতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে এশিয়ার রোল মডেল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। মালেশিয়ার এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে স্বচ্ছ নীতি, কার্যকর পরিকল্পনা, বৈচিত্র্যময় অর্থনৈতিক কাঠামো, এবং উন্নত মানবসম্পদ বিনিয়োগ।
প্রথমত, মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মূল চালিকা শক্তি ছিল তার বহুমুখী শিল্পায়ন ও বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশ। দ্বিতীয়ত, মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রেখেছে মানবসম্পদ উন্নয়ন ও শিক্ষার প্রসার। তৃতীয়ত, মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি প্রধান উপাদান ছিল অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রযুক্তি গ্রহণের গতি। চতুর্থত, মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক পরিবর্তন থেকে শিক্ষা নিতে হয় নতুন উদ্যোগ ও উদ্যোক্তা মনোভাব গড়ে তোলার গুরুত্ব। পঞ্চমত, মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নে সামাজিক সম্প্রীতি ও নীতি নির্ভর ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব স্পষ্ট। ষষ্ঠত, মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক পরিবর্তন থেকে আমাদের শিখতে হবে পরিবেশগত স্থায়িত্বের গুরুত্ব।
সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা মালেশিয়ার আরেকটি বড় শক্তি। মালেশিয়ার নানা জাতি ও ধর্মের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রেখে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-ের ওপর কোনও নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। দেশটি বহুজাতিক ও বহুধর্মীয় হওয়া সত্ত্বেও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করেছে। এ ধরনের সামাজিক স্থিতিশীলতা উন্নয়ন কর্মকা-ের জন্য অত্যন্ত জরুরি, কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সামাজিক সংঘাত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় বাধা সৃষ্টি করে। মালেশিয়ার মডেল প্রমাণ করে যে, সমাজে সমতা ও সহিষ্ণুতা বজায় রাখলে উন্নয়ন সম্ভব। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন মালেশিয়ার আরেকটি শক্তিশালী স্তম্ভ।
পরিবেশ সংরক্ষণ ও টেকসই উন্নয়নেও মালেশিয়া যথেষ্ট অগ্রসর। বিশ্বব্যাপী পরিবেশগত অবক্ষয়ের মধ্যেও মালেশিয়া নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে যাতে দেশের বনাঞ্চল সংরক্ষণ, জীববৈচিত্র্য রক্ষা, এবং কার্বন নিঃসরণ কমানো যায়। টেকসই উন্নয়নের নীতি অনুসরণ করে মালেশিয়া পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ উন্নয়ন নিশ্চিত করতে চায়, যা আগামী প্রজন্মের জন্যও উন্নয়ন সম্ভাবনা বজায় রাখে। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি মালেশিয়াকে একটি জ্ঞানভিত্তিক, সবুজ অর্থনীতির দিকে ধাবিত করছে, যা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। মালেশিয়ার এই উন্নয়ন মডেল বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। মালেশিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায় যে, সুশাসন, অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য, মানবসম্পদ উন্নয়ন, সামাজিক সংহতি এবং টেকসই নীতি গ্রহণ করলেই দ্রুত ও টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। মালেশিয়ার উদাহরণ প্রমাণ করে উন্নয়ন মানে কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, বরং মানুষের জীবনের মান উন্নয়ন, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, এবং পরিবেশের রক্ষাও অন্তর্ভুক্ত। দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়নের মধ্যেও মালয়েশিয়া পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। বনভূমি সংরক্ষণ, জৈববৈচিত্র্য রক্ষা ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আজকের বিশ্বে অর্থনৈতিক উন্নয়ন শুধু অর্থনৈতিক সূচকে সীমাবদ্ধ নয়; পরিবেশ ও সামাজিক উপাদানও সমান গুরুত্ব পায়। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর উচিত উন্নয়ন পরিকল্পনায় পরিবেশগত ও সামাজিক টেকসই নিশ্চিত করা, যাতে দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন সম্ভব হয়।
মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক পরিবর্তন ও উন্নয়নের ইতিহাস আমাদের শেখায় যে দ্রুত উন্নয়ন সম্ভব, যদি সরকারের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, মানবসম্পদ উন্নয়ন, বৈশ্বিক বাজারের সঙ্গে সংযোগ এবং সামাজিক সমতা বজায় রাখা হয়। বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য মালয়েশিয়া একটি অনুপ্রেরণার উৎস, যেখান থেকে উন্নয়ন রূপরেখা গ্রহণ করে দেশকে আধুনিক ও প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতিতে পরিণত করা যায়। মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক পরিবর্তন থেকে সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো পরিকল্পিত ও বাস্তবায়নক্ষম নীতি গ্রহণের গুরুত্ব। শুধু উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরিই যথেষ্ট নয়, তা বাস্তবায়ন করতে হবে। মালয়েশিয়ার সরকার নানা সময়ে ধারাবাহিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করেছে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনকে সফল করেছে। বাংলাদেশও উন্নয়নের পথে এগোতে চাইলে শুধু পরিকল্পনা নয়, কার্যকর বাস্তবায়নে মনোযোগ দিতে হবে এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
মালয়েশিয়া একটি উদাহরণ যে কীভাবে সুসংগঠিত নীতি, কৌশলগত বিনিয়োগ, কূটনৈতিক দক্ষতা এবং বহুমাত্রিক উন্নয়ন রুদ্ধ‐সীমায় থাকা দেশকে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে, সামাজিক সহাবস্থান নিশ্চিত করে, বিদেশে ও অভ্যন্তরে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে নতুন সুযোগ ধরার মাধ্যমে মালয়েশিয়া আজ একটি “মিডল পাওয়ার” স্তরে অবস্থান করে। ভবিষ্যতে যদি সে নীতি ও প্রশাসনে আরও স্বচ্ছতা, প্রযুক্তিতে আরও অগ্রগতি, পরিবেশ ও সামাজিক ন্যায় নিশ্চিত করতে পারে Ñ তবে তার প্রভাব দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আরও বাড়বে; হয়তো অঞ্চলের অন্যতম নেতৃস্থানীয় শক্তি হিসেবে। উপসংহারে বলা যায়, মালেশিয়া আজকের এশিয়ার উন্নয়ন সূচকে এক অনন্য মডেল। এটি একটি বহুমাত্রিক উন্নয়নের প্রমাণ, যা অর্থনীতি, সমাজ, প্রযুক্তি, এবং পরিবেশের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। মালেশিয়ার এই সাফল্য পৃথিবীর অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি প্রেরণা হিসেবে কাজ করছে। ভবিষ্যতে মালেশিয়া আরও আধুনিক, সমৃদ্ধ, এবং টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে বলে আশা করা যায়।
[লেখক: সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]
ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
রোববার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫
ভৌগোলিকভাবে মালয়েশিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অবস্থানে রয়েছে। মালাক্কা প্রণালী, ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ চীন সাগরকে সংযুক্ত করে, বিশ্বের অন্যতম সবচেয়ে ব্যস্ত সামুদ্রিক পথ। এই পথটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চক্রাকার রাস্তা। এর ফলে মালয়েশিয়া কেবল রপ্তানির জন্য নয়, সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে সংযুক্ত করেছে, যা তাকে কৌশলগতভাবে বড় মর্যাদা দেয়। এছাড়া, এশিয়া প্যাসিফিক, চীন ও ভারত সমুন্নত দেশগুলোর সঙ্গে যুক্ত হতে পারার সুযোগ এটি আরও বাড়ায়। মালয়, চিনা, ভারতীয়, আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও বহুসম্প্রদায়ের দেশ মালয়েশিয়া। স্বাধীনতার পর থেকেই একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল কীভাবে এই সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সামাজিক শান্তি ও সহাবস্থান নিশ্চিত করা যায়। জাতীয় শিক্ষানীতি ও পরবর্তী নীতি পরিকল্পনাগুলো সেই উদ্দেশ্যেই তৈরি করা হয়েছিল।
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে যোগ দেওয়া হয়। দক্ষতার উন্নয়নে শিক্ষা খাত এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন গুরুত্ব পায়। রাজনৈতিকভাবে যদিও সবসময়ই চ্যালেঞ্জ ছিল প্রতিনিধিত্ব, সাম্য বিচার, নীতি তত্ত্বাদির উপর সম্প্রদায়ভিত্তিক বিরোধ তবুও বড় ধরনের সহিংস অভ্যুত্থান বা গৃহযুদ্ধ এড়িয়ে যেতে পেরেছে এবং সাধারণভাবে একটি সংবিধানভিত্তিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা রীতি বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে।
মালেশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি বহুসংস্কৃতিযুক্ত দেশ। এটি মালাক্কা প্রণালী এবং দক্ষিণ চীন সাগরের সংযোগস্থলে অবস্থিত, যা বিশ্ব বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। দেশটির অর্থনীতি প্রধানত কৃষি, শিল্প, এবং পরিষেবা খাতের সমন্বয়ে গঠিত। ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে মালেশিয়া ছিল একটি গরীব কৃষিভিত্তিক দেশ। কিন্তু তারপর থেকে মালেশিয়া ধারাবাহিকভাবে উন্নয়নের পথে এগিয়ে আসছে। আজকের মালেশিয়া একটি উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃত, যা এশিয়ার উন্নয়নের এক মডেল। ১৯৫৭ সালে স্বাধীনতার পর মালায়েশিয়া একটি কৃষিভিত্তিক, সম্পদনির্ভর অর্থনীতির দেশ ছিল, যেখানে কৃষি, রাবার, টিন, কাঠ, ফলমূল ও তামাক ইত্যাদি ছিল প্রধান রপ্তানি সামগ্রী। কিন্তু আজকের দিনে মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়া সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রধান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও কৌশলগত খেলোয়াড়ের মধ্যেই একটা মর্যাদাজনক অবস্থান পেয়েছে।
স্বাধীনতার পর প্রথম কয়েক দশকে সরকার মূলত দেশকে ভিত্তিমূলক উন্নয়ন ও মৌলিক সেবা নিশ্চিত করতে শুরু করে। সরকারি নীতি ছিল ‘উন্মুক্ত অর্থনীতি’। বিদেশী বিনিয়োগ গ্রহণ ও রপ্তানিমুখী শিল্প গঠন। বিশেষভাবে, পেনাংতে বিনিয়োগ প্রবল হয় ফ্রি ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন গঠন ও বৈদেশিক মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেশনের সুবিধাজনক নীতি গ্রহণের মাধ্যমে: উদাহরণস্বরূপ, ইলেকট্রনিক্স ফার্ম, অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্ট ইত্যাদি।
মালেশিয়ার অর্থনীতি বৈচিত্র্যময় এবং একে ‘মডেল অর্থনীতি’ হিসেবে ধরা হয়। ১৯৭০ এর দশকে দেশটি ‘নিউ ইকোনমিক পলিসি’ গ্রহণ করে, যার লক্ষ্য ছিল জাতিগত বৈষম্য কমানো এবং অর্থনৈতিক সুযোগ সম্প্রসারণ। এই নীতি মালেশিয়ার অর্থনৈতিক কাঠামোকে বৈচিত্র্যময় করে তুলতে সহায়তা করে। উদাহরণস্বরূপ, মালেশিয়া তেল, গ্যাস, পেট্রোকেমিক্যাল, ইলেকট্রনিক্স, এবং বৈদ্যুতি শিল্পের ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি করেছে। দেশটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ রবার উৎপাদক এবং এলইডি উৎপাদনে শীর্ষস্থানীয়। এছাড়া মালেশিয়ার বাণিজ্য খাত ও পরিষেবা খাতও দ্রুত বিকাশ লাভ করেছে, যা দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি মালেশিয়ার মানবসম্পদ উন্নয়নে ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করেছে। মালেশিয়ার সরকার শিক্ষায় বিনিয়োগ করে দক্ষ ও সু-প্রশিক্ষিত জনশক্তি তৈরিতে জোর দিয়েছে। এই শিক্ষাব্যবস্থা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্য বজায় রাখার পাশাপাশি প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি মনোযোগ বৃদ্ধি করেছে। স্বাস্থ্য খাতে উন্নতি মানে কেবল রোগপ্রতিরোধ নয়, বরং জীবন প্রত্যাশা ও জনস্বাস্থ্য সূচকেও উন্নতি হয়েছে। এই মানবসম্পদ উন্নয়ন মালেশিয়াকে দ্রুত উন্নয়নের রাস্তায় নিয়ে গেছে।
বর্তমান বিশ্বে উন্নয়ন শব্দটি একটি দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সামাজিক উন্নতি, এবং প্রযুক্তিগত বিকাশের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশেষ করে এশিয়া মহাদেশে উন্নয়ন সূচকে বিভিন্ন দেশ নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করছে। এই প্রসঙ্গে মালেশিয়া একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়, যা দ্রুতগতিতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে এশিয়ার রোল মডেল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। মালেশিয়ার এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে স্বচ্ছ নীতি, কার্যকর পরিকল্পনা, বৈচিত্র্যময় অর্থনৈতিক কাঠামো, এবং উন্নত মানবসম্পদ বিনিয়োগ।
প্রথমত, মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মূল চালিকা শক্তি ছিল তার বহুমুখী শিল্পায়ন ও বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশ। দ্বিতীয়ত, মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রেখেছে মানবসম্পদ উন্নয়ন ও শিক্ষার প্রসার। তৃতীয়ত, মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি প্রধান উপাদান ছিল অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রযুক্তি গ্রহণের গতি। চতুর্থত, মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক পরিবর্তন থেকে শিক্ষা নিতে হয় নতুন উদ্যোগ ও উদ্যোক্তা মনোভাব গড়ে তোলার গুরুত্ব। পঞ্চমত, মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নে সামাজিক সম্প্রীতি ও নীতি নির্ভর ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব স্পষ্ট। ষষ্ঠত, মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক পরিবর্তন থেকে আমাদের শিখতে হবে পরিবেশগত স্থায়িত্বের গুরুত্ব।
সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা মালেশিয়ার আরেকটি বড় শক্তি। মালেশিয়ার নানা জাতি ও ধর্মের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রেখে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-ের ওপর কোনও নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। দেশটি বহুজাতিক ও বহুধর্মীয় হওয়া সত্ত্বেও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করেছে। এ ধরনের সামাজিক স্থিতিশীলতা উন্নয়ন কর্মকা-ের জন্য অত্যন্ত জরুরি, কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সামাজিক সংঘাত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় বাধা সৃষ্টি করে। মালেশিয়ার মডেল প্রমাণ করে যে, সমাজে সমতা ও সহিষ্ণুতা বজায় রাখলে উন্নয়ন সম্ভব। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন মালেশিয়ার আরেকটি শক্তিশালী স্তম্ভ।
পরিবেশ সংরক্ষণ ও টেকসই উন্নয়নেও মালেশিয়া যথেষ্ট অগ্রসর। বিশ্বব্যাপী পরিবেশগত অবক্ষয়ের মধ্যেও মালেশিয়া নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে যাতে দেশের বনাঞ্চল সংরক্ষণ, জীববৈচিত্র্য রক্ষা, এবং কার্বন নিঃসরণ কমানো যায়। টেকসই উন্নয়নের নীতি অনুসরণ করে মালেশিয়া পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ উন্নয়ন নিশ্চিত করতে চায়, যা আগামী প্রজন্মের জন্যও উন্নয়ন সম্ভাবনা বজায় রাখে। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি মালেশিয়াকে একটি জ্ঞানভিত্তিক, সবুজ অর্থনীতির দিকে ধাবিত করছে, যা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। মালেশিয়ার এই উন্নয়ন মডেল বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। মালেশিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায় যে, সুশাসন, অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য, মানবসম্পদ উন্নয়ন, সামাজিক সংহতি এবং টেকসই নীতি গ্রহণ করলেই দ্রুত ও টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। মালেশিয়ার উদাহরণ প্রমাণ করে উন্নয়ন মানে কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, বরং মানুষের জীবনের মান উন্নয়ন, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, এবং পরিবেশের রক্ষাও অন্তর্ভুক্ত। দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়নের মধ্যেও মালয়েশিয়া পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। বনভূমি সংরক্ষণ, জৈববৈচিত্র্য রক্ষা ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আজকের বিশ্বে অর্থনৈতিক উন্নয়ন শুধু অর্থনৈতিক সূচকে সীমাবদ্ধ নয়; পরিবেশ ও সামাজিক উপাদানও সমান গুরুত্ব পায়। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর উচিত উন্নয়ন পরিকল্পনায় পরিবেশগত ও সামাজিক টেকসই নিশ্চিত করা, যাতে দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন সম্ভব হয়।
মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক পরিবর্তন ও উন্নয়নের ইতিহাস আমাদের শেখায় যে দ্রুত উন্নয়ন সম্ভব, যদি সরকারের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, মানবসম্পদ উন্নয়ন, বৈশ্বিক বাজারের সঙ্গে সংযোগ এবং সামাজিক সমতা বজায় রাখা হয়। বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য মালয়েশিয়া একটি অনুপ্রেরণার উৎস, যেখান থেকে উন্নয়ন রূপরেখা গ্রহণ করে দেশকে আধুনিক ও প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতিতে পরিণত করা যায়। মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক পরিবর্তন থেকে সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো পরিকল্পিত ও বাস্তবায়নক্ষম নীতি গ্রহণের গুরুত্ব। শুধু উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরিই যথেষ্ট নয়, তা বাস্তবায়ন করতে হবে। মালয়েশিয়ার সরকার নানা সময়ে ধারাবাহিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করেছে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনকে সফল করেছে। বাংলাদেশও উন্নয়নের পথে এগোতে চাইলে শুধু পরিকল্পনা নয়, কার্যকর বাস্তবায়নে মনোযোগ দিতে হবে এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
মালয়েশিয়া একটি উদাহরণ যে কীভাবে সুসংগঠিত নীতি, কৌশলগত বিনিয়োগ, কূটনৈতিক দক্ষতা এবং বহুমাত্রিক উন্নয়ন রুদ্ধ‐সীমায় থাকা দেশকে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে, সামাজিক সহাবস্থান নিশ্চিত করে, বিদেশে ও অভ্যন্তরে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে নতুন সুযোগ ধরার মাধ্যমে মালয়েশিয়া আজ একটি “মিডল পাওয়ার” স্তরে অবস্থান করে। ভবিষ্যতে যদি সে নীতি ও প্রশাসনে আরও স্বচ্ছতা, প্রযুক্তিতে আরও অগ্রগতি, পরিবেশ ও সামাজিক ন্যায় নিশ্চিত করতে পারে Ñ তবে তার প্রভাব দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আরও বাড়বে; হয়তো অঞ্চলের অন্যতম নেতৃস্থানীয় শক্তি হিসেবে। উপসংহারে বলা যায়, মালেশিয়া আজকের এশিয়ার উন্নয়ন সূচকে এক অনন্য মডেল। এটি একটি বহুমাত্রিক উন্নয়নের প্রমাণ, যা অর্থনীতি, সমাজ, প্রযুক্তি, এবং পরিবেশের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। মালেশিয়ার এই সাফল্য পৃথিবীর অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি প্রেরণা হিসেবে কাজ করছে। ভবিষ্যতে মালেশিয়া আরও আধুনিক, সমৃদ্ধ, এবং টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে বলে আশা করা যায়।
[লেখক: সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]