এম এ হোসাইন
রোহিঙ্গা সংকট বহু বছর ধরেই বিশ্বের ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের অন্যতম হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশের মতো ছোট উন্নয়নশীল দেশের জন্য এটি সমাজ, অর্থনীতি ও পরিবেশের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেছে। বৈশ্বিক দাতাগোষ্ঠীর বাজেট কমতি, অভ্যুত্থান পরিবর্তী ভঙ্গুর অর্থনীতি, ঋণের বোঝা, রোহিঙ্গা শিবিরে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি, কক্সবাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং পরিবেশ নিধন দক্ষিণ পূর্বএশিয়ার ছোট্ট দেশটির উন্নয়নের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
শত প্রজন্মের আদি নিবাস রাখাইন থেকেই নির্বাসিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। জাতিগত নিধনের নীলনকশা বাস্তবায়ন মায়ানমারের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায়। মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর পাশবিক নির্যাতনে ১৯৭৮ সালে দুই লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলো, এরপর ১৯৯১ সালে আবার ঢল নামে, সবমিলিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের তথ্য মতে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বসবাস করে আসছিলো । ২০১৭ সালে মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর রোহিঙ্গা বিতাড়নের সাজানো সামরিক অভিযানে বাংলাদেশে ১৩ লক্ষ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয়। তাছাড়া, প্রতি বছর ৩২ হাজার শিশু রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নতুন জীবন শুরু করছে।
১৯৮২ সালে নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে অবৈধ বাঙালি অভিবাসী হিসেবে আখ্যা দেয়া নীল নকশার একটি পর্যায় মাত্র। পরবর্তীতে ২০১৪ সালের আদমশুমারিতে রোহিঙ্গাদের বাদ দেয়া হয় এবং একইসাথে নাগরিকত্ব প্রদানে অস্বীকৃতি জানায় মায়ানমার সরকার। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন (ইউএনএইচআরসি) ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মায়ানমারের মুসলিম রোহিঙ্গাদের প্রতি নৃশংস আচরণকে জাতিগত নিধনের পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত করে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এটি মানুষের তৈরি এক দুর্যোগÑযা হয়তো সহানুভূতি জাগায়, কিন্তু সমাধানের ক্ষেত্র খুব সামান্যই অগ্রগতি হয়ে থাকে। এই আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জীবন কেটে যাচ্ছে অস্থায়ী আশ্রয় ও স্থায়ী রাষ্ট্রহীনতার অনিশ্চয়তার এক দোলা চলে। কৃত্রিম এই মানবিক সংকট বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আর্থিক ও সামাজিক সংকট, মাদক ব্যবসা, বাংলাদেশী পাসপোর্ট জালিয়াতি, চুরি, ডাকাতি, মানব পাচার, চাঁদাবাজির মত অপরাধ কর্মকে উৎসাহিত করছে।
ত্রাণের অপ্রতুলতা, অনিশ্চিত ও অনিরাপদ প্রত্যাবর্তন সম্ভবনা এই পরিস্থিতিকে আরো ঘোলাটে করে তুলছে। জাতিসংঘের মায়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত জুলি বিশপ বলেন, ‘মায়ানমারের সেনাবাহিনী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্য চলমান সংঘর্ষ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের পথে একটি অদম্য অন্তরায় প্রমাণিত হচ্ছে।’ তিনি আরো মনে করেন, ‘ত্রাণ সংকট এড়ানোর জন্য , ওআইসির দেশ গুলোর ত্রাণ সহায়তা বাড়ানো উচিত।’
২০১৭ সালের আগস্টের পর মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছে। তারপর আরাকান আর্মির উত্থান এবং গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে “মায়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি” শীর্ষক এক উচ্চপর্যায়ের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস হতাশার আলোচনাকে সমাধানের পথে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি সাত দফা প্রস্তাবনা তুলে ধরেন, যা শুধু স্বচ্ছতার জন্যই নয়, বরং সংকটটির উৎসÑমায়ানমারের ভেতরেÑসমাধান করার দৃঢ় অবস্থানের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্ব এখনো ব্যর্থ কেন? কারণ পরাশক্তিগুলো মানবিক বিবেচনার চেয়ে ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বৈশ্বিক শক্তিগুলোর মায়ানমারে নিজস্ব স্বার্থ আছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো ভৌগোলিক সান্নিধ্য ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংবেদনশীলতার কারণে প্রায়শই নিজেকে সরিয়ে রাখার পথ বেছে নিয়েছে, যার প্রতিফলন দেখা গেছে সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে তাদের অনুপস্থিতিতে।
কিন্তু এই সংকটকে প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তির প্রক্সি যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ দেওয়া অন্যায্য হবে। এটি মানবিক ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংকট হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। দেরি হওয়ার আগে ইউনুস বৈশ্বিক শক্তি ও আঞ্চলিক অংশীদারদের বাস্তববাদী সমাধান খুঁজে বের করার আহ্বান জানান, যাতে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়।
ইউনুসের প্রস্তাবের মূল হচ্ছে প্রত্যাবাসনই একমাত্র টেকসই সমাধান। তার মতে, আন্তর্জাতিক সুরক্ষা অব্যাহত রাখা যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি অপ্রতুলও। অর্থ সংকট ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গাদের সহায়তা সীমিত করে দিয়েছে।
ইউনুস যে সাত দফা প্রস্তাব দেন, তা হলো: নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য কার্যকর রূপরেখা তৈরি। মায়ানমারের সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির ওপর সহিংসতা বন্ধে কার্যকর চাপ সৃষ্টি। রাখাইনে বেসামরিক পর্যবেক্ষক নিয়োগসহ আন্তর্জাতিক সহায়তা অব্যাহত রাখা। রোহিঙ্গাদের রাখাইন সমাজ ও শাসনব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তির জন্য আস্থা তৈরির পদক্ষেপ গ্রহণ। যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত অর্থায়ন নিশ্চিত করা। অতীতের নৃশংসতার জন্য দায়বদ্ধতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। মাদক অর্থনীতি ধ্বংস ও সীমান্ত অপরাধ দমন।
অবশ্যই, এসব পদক্ষেপ এক রাতেই সংকট সমাধান করবে না। তবে সমন্বিতভাবে এগুলো মানবিক দায়বদ্ধতাকে রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে একটি বাস্তববাদী ও মানবিক কৌশল তৈরি করবে।
জাতিসংঘের জন্য রোহিঙ্গা সংকট একটি বিশ্বাসযোগ্যতার পরীক্ষা। এটি কেবল বৈশ্বিক সম্মেলনের পার্শ্ব ইস্যু হয়ে থাকতে পারে না, যখন বড় বড় যুদ্ধ মঞ্চ দখল করে নিয়েছে। জাতিসংঘ তিনটি উপায়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে।
প্রথমত, নিরাপত্তা পরিষদকে একজন বিশেষ দূত নিয়োগ করতে হবে, যিনি মায়ানমারের সেনাবাহিনী, আরাকান আর্মি ও আঞ্চলিক অংশীদারদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার কার্যকরি ক্ষমতা রাখবেন। কারন ক্ষমতাহীন মধ্যস্থতা এক অর্থহীন কালক্ষেপণ মাত্র।
দ্বিতীয়ত, জাতিসংঘকে আসিয়ান সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করে রাখাইনে একটি যৌথ পর্যবেক্ষণ মিশন গঠন করতে হবে, যা নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন তদারকি করবে।
তৃতীয়ত, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারকে শুধু বক্তব্যে সীমাবদ্ধ থাকা যাবে না। কারিগরি দক্ষতা ও আর্থিক সহায়তা আরও বাড়াতে হবে, শুধু বাংলাদেশের শিবিরের জন্য নয়, রাখাইনেও পুনর্বাসন শুরু হলে তা কার্যকর করতে হবে। শুধু ঘোষণা দিয়ে বাস্তবায়ন না করলে বিপর্যয় আরও গভীর হবে।
তবে জাতিসংঘকে এ অঞ্চলের প্রভাবশালী এক শক্তিÑচীনের ওপর ভরসা করতে হবে। মায়ানমারের সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির ওপর তাদের বিশেষ প্রভাব রয়েছে। আগেও বেইজিং ত্রিপক্ষীয় আলোচনার মধ্যস্থতা করেছে। বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সহায়তায় চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে, যাতে প্রত্যাবাসন ও অস্ত্রবিরতি উভয়ই সম্ভব হয়।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে প্রতীকী পদক্ষেপের প্রলোভন থেকে বিরত থাকতে হবে। নিষেধাজ্ঞার নিজস্ব গুরুত্ব আছে, তবে সেগুলো সংশ্লিষ্ট দেশকে বিপরীত ব্লকের দিকে ঠেলে দিতে পারে। বরং তাদের মানবিক সহায়তার জন্য অর্থায়ন এবং মায়ানমারের ভেতরে আস্থা তৈরির প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে হবে।
অন্য মুসলিম-অধ্যুষিত দেশগুলোÑযেমন সৌদি আরব, তুরস্ক ও মালয়েশিয়াÑধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের পাশে থেকেছে এবং এই সংকটকে বৈশ্বিক পর্যায়ে তুলে ধরতে সাহায্য করেছে। এখন তাদের ভূমিকা কথার বাইরে গিয়ে অর্থায়নের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনায় অর্থায়ন একটি স্থিতিশীলতায় বিনিয়োগ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
আর বাংলাদেশ কেবল সহানুভূতির চেয়েও বেশি কিছু প্রাপ্য। দীর্ঘদিন ধরে দেশটি নিজস্ব সামাজিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার বিনিময়ে এই ভার বহন করছে। বিশ্ব নেতারা যদি এই সংকটকে অবহেলা করে চলেন, তবে এর প্রভাব শুধু শরণার্থীদের ওপরই পড়বে না, বরং দক্ষিণ এশিয়ার ভারসাম্য রক্ষাকারী একটি দেশকেও অস্থিতিশীল করে তুলবে।
ভবিষ্যতের পথ মোটেই সহজ নয়। মায়ানমার ভেতর থেকে প্রায় ভেঙে পড়েছে। বাহ্যিক নিশ্চয়তা ছাড়া আরাকান আর্মির আপস করার প্রেরণা সামান্যই আছে। রোহিঙ্গা ও রাখাইন বৌদ্ধদের মধ্যে সহিংসতার ক্ষত এখনো গভীর। আর বাংলাদেশের ধৈর্যও সীমাহীন নয়।
কিন্তু এমন সংকটের স্থবিরতা নীরব থাকে না; তা ক্ষয়িষ্ণু প্রভাব নিয়ে বিস্ফোরিত হয়। ইতিহাসের অনুরূপ অন্ধকার ছবি গুলো বার বার তুলে ধরে। ফিলিস্তিনি শিবিরগুলো হতাশা ও চরমপন্থার উর্বর ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে; পশ্চিম সাহারায় সাহারাভি শরণার্থীরা বিশ্বনেতাদের কাছে প্রায় বিস্মৃত। যে কোনো সম্প্রদায়ের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি মানবিক সংকট তো বটেই, একইসঙ্গে তা ভূরাজনৈতিক বিভাজনরেখায় রূপ নেয়।
অবশেষে রোহিঙ্গা সংকট একটি নিপীড়িত সংখ্যালঘুর ইস্যুর বাইরে গিয়ে সমগ্র সভ্যতার জন্য এক পরীক্ষার ক্ষেত্র। এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য একটি অগ্নিপরীক্ষাÑতারা কি বিভাজনের যুগেও কোনো নৈতিক কারণে একত্রে পদক্ষেপ নিতে সক্ষম? চীন ও পশ্চিম কি অন্তত কিছুক্ষণের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভুলে মানবিক সমাধানে এগোতে পারে? আসিয়ান কি তার নিষ্ক্রিয়তার অভ্যাস ভাঙতে পারবে? মুসলিম রাষ্ট্রগুলো কি তাদের সংহতিকে বাস্তব সহায়তায় রূপ দিতে পারবে?
বাংলাদেশ তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে। তারা সমাধান ও সহযোগিতা চায়। এখন বিশ্বের প্রতিক্রিয়াই নির্ধারণ করবেÑএই সংকট কি অনন্ত ক্ষত হয়ে থাকবে, নাকি পারস্পরিক কূটনৈতিক সমন্বয়ের এক সফল গল্পে পরিণত হবে। বিশ্ব নেতাদের সামনে পছন্দের পথটি স্পষ্ট। আর তা নির্বাচনের সময় এখনই।
[লেখক: প্রাবন্ধিক]
এম এ হোসাইন
রোববার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫
রোহিঙ্গা সংকট বহু বছর ধরেই বিশ্বের ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের অন্যতম হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশের মতো ছোট উন্নয়নশীল দেশের জন্য এটি সমাজ, অর্থনীতি ও পরিবেশের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেছে। বৈশ্বিক দাতাগোষ্ঠীর বাজেট কমতি, অভ্যুত্থান পরিবর্তী ভঙ্গুর অর্থনীতি, ঋণের বোঝা, রোহিঙ্গা শিবিরে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি, কক্সবাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং পরিবেশ নিধন দক্ষিণ পূর্বএশিয়ার ছোট্ট দেশটির উন্নয়নের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
শত প্রজন্মের আদি নিবাস রাখাইন থেকেই নির্বাসিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। জাতিগত নিধনের নীলনকশা বাস্তবায়ন মায়ানমারের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায়। মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর পাশবিক নির্যাতনে ১৯৭৮ সালে দুই লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলো, এরপর ১৯৯১ সালে আবার ঢল নামে, সবমিলিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের তথ্য মতে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বসবাস করে আসছিলো । ২০১৭ সালে মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর রোহিঙ্গা বিতাড়নের সাজানো সামরিক অভিযানে বাংলাদেশে ১৩ লক্ষ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয়। তাছাড়া, প্রতি বছর ৩২ হাজার শিশু রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নতুন জীবন শুরু করছে।
১৯৮২ সালে নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে অবৈধ বাঙালি অভিবাসী হিসেবে আখ্যা দেয়া নীল নকশার একটি পর্যায় মাত্র। পরবর্তীতে ২০১৪ সালের আদমশুমারিতে রোহিঙ্গাদের বাদ দেয়া হয় এবং একইসাথে নাগরিকত্ব প্রদানে অস্বীকৃতি জানায় মায়ানমার সরকার। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন (ইউএনএইচআরসি) ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মায়ানমারের মুসলিম রোহিঙ্গাদের প্রতি নৃশংস আচরণকে জাতিগত নিধনের পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত করে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এটি মানুষের তৈরি এক দুর্যোগÑযা হয়তো সহানুভূতি জাগায়, কিন্তু সমাধানের ক্ষেত্র খুব সামান্যই অগ্রগতি হয়ে থাকে। এই আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জীবন কেটে যাচ্ছে অস্থায়ী আশ্রয় ও স্থায়ী রাষ্ট্রহীনতার অনিশ্চয়তার এক দোলা চলে। কৃত্রিম এই মানবিক সংকট বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আর্থিক ও সামাজিক সংকট, মাদক ব্যবসা, বাংলাদেশী পাসপোর্ট জালিয়াতি, চুরি, ডাকাতি, মানব পাচার, চাঁদাবাজির মত অপরাধ কর্মকে উৎসাহিত করছে।
ত্রাণের অপ্রতুলতা, অনিশ্চিত ও অনিরাপদ প্রত্যাবর্তন সম্ভবনা এই পরিস্থিতিকে আরো ঘোলাটে করে তুলছে। জাতিসংঘের মায়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত জুলি বিশপ বলেন, ‘মায়ানমারের সেনাবাহিনী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্য চলমান সংঘর্ষ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের পথে একটি অদম্য অন্তরায় প্রমাণিত হচ্ছে।’ তিনি আরো মনে করেন, ‘ত্রাণ সংকট এড়ানোর জন্য , ওআইসির দেশ গুলোর ত্রাণ সহায়তা বাড়ানো উচিত।’
২০১৭ সালের আগস্টের পর মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছে। তারপর আরাকান আর্মির উত্থান এবং গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে “মায়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি” শীর্ষক এক উচ্চপর্যায়ের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস হতাশার আলোচনাকে সমাধানের পথে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি সাত দফা প্রস্তাবনা তুলে ধরেন, যা শুধু স্বচ্ছতার জন্যই নয়, বরং সংকটটির উৎসÑমায়ানমারের ভেতরেÑসমাধান করার দৃঢ় অবস্থানের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্ব এখনো ব্যর্থ কেন? কারণ পরাশক্তিগুলো মানবিক বিবেচনার চেয়ে ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বৈশ্বিক শক্তিগুলোর মায়ানমারে নিজস্ব স্বার্থ আছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো ভৌগোলিক সান্নিধ্য ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংবেদনশীলতার কারণে প্রায়শই নিজেকে সরিয়ে রাখার পথ বেছে নিয়েছে, যার প্রতিফলন দেখা গেছে সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে তাদের অনুপস্থিতিতে।
কিন্তু এই সংকটকে প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তির প্রক্সি যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ দেওয়া অন্যায্য হবে। এটি মানবিক ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংকট হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। দেরি হওয়ার আগে ইউনুস বৈশ্বিক শক্তি ও আঞ্চলিক অংশীদারদের বাস্তববাদী সমাধান খুঁজে বের করার আহ্বান জানান, যাতে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়।
ইউনুসের প্রস্তাবের মূল হচ্ছে প্রত্যাবাসনই একমাত্র টেকসই সমাধান। তার মতে, আন্তর্জাতিক সুরক্ষা অব্যাহত রাখা যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি অপ্রতুলও। অর্থ সংকট ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গাদের সহায়তা সীমিত করে দিয়েছে।
ইউনুস যে সাত দফা প্রস্তাব দেন, তা হলো: নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য কার্যকর রূপরেখা তৈরি। মায়ানমারের সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির ওপর সহিংসতা বন্ধে কার্যকর চাপ সৃষ্টি। রাখাইনে বেসামরিক পর্যবেক্ষক নিয়োগসহ আন্তর্জাতিক সহায়তা অব্যাহত রাখা। রোহিঙ্গাদের রাখাইন সমাজ ও শাসনব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তির জন্য আস্থা তৈরির পদক্ষেপ গ্রহণ। যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত অর্থায়ন নিশ্চিত করা। অতীতের নৃশংসতার জন্য দায়বদ্ধতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। মাদক অর্থনীতি ধ্বংস ও সীমান্ত অপরাধ দমন।
অবশ্যই, এসব পদক্ষেপ এক রাতেই সংকট সমাধান করবে না। তবে সমন্বিতভাবে এগুলো মানবিক দায়বদ্ধতাকে রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে একটি বাস্তববাদী ও মানবিক কৌশল তৈরি করবে।
জাতিসংঘের জন্য রোহিঙ্গা সংকট একটি বিশ্বাসযোগ্যতার পরীক্ষা। এটি কেবল বৈশ্বিক সম্মেলনের পার্শ্ব ইস্যু হয়ে থাকতে পারে না, যখন বড় বড় যুদ্ধ মঞ্চ দখল করে নিয়েছে। জাতিসংঘ তিনটি উপায়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে।
প্রথমত, নিরাপত্তা পরিষদকে একজন বিশেষ দূত নিয়োগ করতে হবে, যিনি মায়ানমারের সেনাবাহিনী, আরাকান আর্মি ও আঞ্চলিক অংশীদারদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার কার্যকরি ক্ষমতা রাখবেন। কারন ক্ষমতাহীন মধ্যস্থতা এক অর্থহীন কালক্ষেপণ মাত্র।
দ্বিতীয়ত, জাতিসংঘকে আসিয়ান সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করে রাখাইনে একটি যৌথ পর্যবেক্ষণ মিশন গঠন করতে হবে, যা নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন তদারকি করবে।
তৃতীয়ত, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারকে শুধু বক্তব্যে সীমাবদ্ধ থাকা যাবে না। কারিগরি দক্ষতা ও আর্থিক সহায়তা আরও বাড়াতে হবে, শুধু বাংলাদেশের শিবিরের জন্য নয়, রাখাইনেও পুনর্বাসন শুরু হলে তা কার্যকর করতে হবে। শুধু ঘোষণা দিয়ে বাস্তবায়ন না করলে বিপর্যয় আরও গভীর হবে।
তবে জাতিসংঘকে এ অঞ্চলের প্রভাবশালী এক শক্তিÑচীনের ওপর ভরসা করতে হবে। মায়ানমারের সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির ওপর তাদের বিশেষ প্রভাব রয়েছে। আগেও বেইজিং ত্রিপক্ষীয় আলোচনার মধ্যস্থতা করেছে। বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সহায়তায় চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে, যাতে প্রত্যাবাসন ও অস্ত্রবিরতি উভয়ই সম্ভব হয়।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে প্রতীকী পদক্ষেপের প্রলোভন থেকে বিরত থাকতে হবে। নিষেধাজ্ঞার নিজস্ব গুরুত্ব আছে, তবে সেগুলো সংশ্লিষ্ট দেশকে বিপরীত ব্লকের দিকে ঠেলে দিতে পারে। বরং তাদের মানবিক সহায়তার জন্য অর্থায়ন এবং মায়ানমারের ভেতরে আস্থা তৈরির প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে হবে।
অন্য মুসলিম-অধ্যুষিত দেশগুলোÑযেমন সৌদি আরব, তুরস্ক ও মালয়েশিয়াÑধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের পাশে থেকেছে এবং এই সংকটকে বৈশ্বিক পর্যায়ে তুলে ধরতে সাহায্য করেছে। এখন তাদের ভূমিকা কথার বাইরে গিয়ে অর্থায়নের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনায় অর্থায়ন একটি স্থিতিশীলতায় বিনিয়োগ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
আর বাংলাদেশ কেবল সহানুভূতির চেয়েও বেশি কিছু প্রাপ্য। দীর্ঘদিন ধরে দেশটি নিজস্ব সামাজিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার বিনিময়ে এই ভার বহন করছে। বিশ্ব নেতারা যদি এই সংকটকে অবহেলা করে চলেন, তবে এর প্রভাব শুধু শরণার্থীদের ওপরই পড়বে না, বরং দক্ষিণ এশিয়ার ভারসাম্য রক্ষাকারী একটি দেশকেও অস্থিতিশীল করে তুলবে।
ভবিষ্যতের পথ মোটেই সহজ নয়। মায়ানমার ভেতর থেকে প্রায় ভেঙে পড়েছে। বাহ্যিক নিশ্চয়তা ছাড়া আরাকান আর্মির আপস করার প্রেরণা সামান্যই আছে। রোহিঙ্গা ও রাখাইন বৌদ্ধদের মধ্যে সহিংসতার ক্ষত এখনো গভীর। আর বাংলাদেশের ধৈর্যও সীমাহীন নয়।
কিন্তু এমন সংকটের স্থবিরতা নীরব থাকে না; তা ক্ষয়িষ্ণু প্রভাব নিয়ে বিস্ফোরিত হয়। ইতিহাসের অনুরূপ অন্ধকার ছবি গুলো বার বার তুলে ধরে। ফিলিস্তিনি শিবিরগুলো হতাশা ও চরমপন্থার উর্বর ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে; পশ্চিম সাহারায় সাহারাভি শরণার্থীরা বিশ্বনেতাদের কাছে প্রায় বিস্মৃত। যে কোনো সম্প্রদায়ের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি মানবিক সংকট তো বটেই, একইসঙ্গে তা ভূরাজনৈতিক বিভাজনরেখায় রূপ নেয়।
অবশেষে রোহিঙ্গা সংকট একটি নিপীড়িত সংখ্যালঘুর ইস্যুর বাইরে গিয়ে সমগ্র সভ্যতার জন্য এক পরীক্ষার ক্ষেত্র। এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য একটি অগ্নিপরীক্ষাÑতারা কি বিভাজনের যুগেও কোনো নৈতিক কারণে একত্রে পদক্ষেপ নিতে সক্ষম? চীন ও পশ্চিম কি অন্তত কিছুক্ষণের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভুলে মানবিক সমাধানে এগোতে পারে? আসিয়ান কি তার নিষ্ক্রিয়তার অভ্যাস ভাঙতে পারবে? মুসলিম রাষ্ট্রগুলো কি তাদের সংহতিকে বাস্তব সহায়তায় রূপ দিতে পারবে?
বাংলাদেশ তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে। তারা সমাধান ও সহযোগিতা চায়। এখন বিশ্বের প্রতিক্রিয়াই নির্ধারণ করবেÑএই সংকট কি অনন্ত ক্ষত হয়ে থাকবে, নাকি পারস্পরিক কূটনৈতিক সমন্বয়ের এক সফল গল্পে পরিণত হবে। বিশ্ব নেতাদের সামনে পছন্দের পথটি স্পষ্ট। আর তা নির্বাচনের সময় এখনই।
[লেখক: প্রাবন্ধিক]