alt

opinion » post-editorial

সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ সংস্কৃতি: আসক্তি নাকি নতুন যোগাযোগ?

মতিউর রহমান

: সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫

আধুনিক ডিজিটাল সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ সংস্কৃতি, যা একাধারে যোগাযোগের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে এবং একই সঙ্গে মানব মনস্তত্ত্বে এক গভীর আসক্তির বীজ বপন করেছে। আপাতদৃষ্টিতে একটি ‘লাইক’ নিছকই একটি ডিজিটাল প্রতিক্রিয়া, কিন্তু এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী; এটি আমাদের স্ব-সত্তা, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, এমনকি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেও প্রভাবিত করছে।

‘লাইক’ প্রথাকে যোগাযোগের একটি বৈপ্লবিক মাধ্যম হিসেবে দেখা যায়, যা তাৎক্ষণিকতা এবং সঙ্কোচন নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। মানব ইতিহাসজুড়েই মানুষ সর্বদা অন্যের স্বীকৃতি এবং অনুমোদন প্রত্যাশা করেছেÑআগে যা শারীরিক উপস্থিতি, প্রশংসা বা সম্মতির দীর্ঘ প্রক্রিয়া দ্বারা নির্ধারিত হতো, আজ তা একটি মাত্র ক্লিক বা স্পর্শের মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে। ‘লাইক’ হলো এই মানবিক প্রয়োজনের এক ডিজিটাল প্রতিরূপ, যা সময়ের ব্যবধান ও ভৌগোলিক দূরত্বকে তুচ্ছ করে মুহূর্তের মধ্যে সমর্থন বা একাত্মতার বার্তা পৌঁছে দেয়।

এটি কেবল একটি ‘শর্টহ্যান্ড কমিউনিকেশন’ নয়, বরং এটি একটি কার্যকরী সামাজিক মুদ্রা। কোনো পোস্টের ‘লাইক’ সংখ্যা সেই পোস্টের গুরুত্ব, জনপ্রিয়তা এবং বৈধতা নির্ধারণ করে, যা বার্তাটিকে একটি বৃহত্তর পরিসরে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। বিশেষ করে ব্যস্ত জীবনে, যখন দীর্ঘ মন্তব্য বা ব্যক্তিগত যোগাযোগের সময় থাকে না, তখন ‘লাইক’ একটি স্বীকৃতির সেতু তৈরি করে, যা ভার্চুয়াল সম্পর্কগুলোকে বাঁচিয়ে রাখে। এই অর্থে, ‘লাইক’ অবশ্যই যোগাযোগের সম্প্রসারণ এবং সামাজিক সংহতি রক্ষার একটি নতুন হাতিয়ার।

যোগাযোগের সুবিধাজনক দিক থাকা সত্ত্বেও, ‘লাইক’ সংস্কৃতির সবচেয়ে গভীর এবং বিপজ্জনক প্রভাব নিহিত আছে এর আসক্তি-সৃষ্টিকারী মনস্তত্ত্বে। এই আসক্তির মূলে রয়েছে মস্তিষ্কের জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়া। যখন একজন ব্যবহারকারী তাদের পোস্ট বা ছবিতে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া বা ‘লাইক’ পান, তখন মস্তিষ্কের পুরস্কার ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং ডোপামিন নামক নিউরোট্রান্সমিটার নির্গত হয়।

এই রাসায়নিক ক্ষরণ আনন্দ, প্রেরণা এবং পুনরাবৃত্তির আকাক্সক্ষা সৃষ্টি করে। এটি একটি ‘তাৎক্ষণিক তৃপ্তির চক্র’ তৈরি করে, যেখানে ডোপামিনের ঢেউ পাওয়ার জন্য ব্যবহারকারী বাধ্য হয়ে বারবার ফোন বা প্ল্যাটফর্ম চেক করতে থাকে। এই আচরণগত প্যাটার্ন একসময় স্বেচ্ছামূলক ক্রিয়া থেকে বাধ্যতামূলক আসক্তিতে রূপান্তরিত হয়, ঠিক যেমন জুয়া বা অন্যান্য আসক্তির ক্ষেত্রে ঘটে। সময়ের সাথে সাথে, মস্তিষ্ক এই বাহ্যিক উদ্দীপকের ওপর নির্ভর করে ফেলে, যার ফলে বাস্তব জীবনের স্বাভাবিক অর্জন থেকে প্রাপ্ত আনন্দও ফ্যাকাশে মনে হতে থাকে।

এই আসক্তির ফলস্বরূপ, মানুষের পরিচয় নির্মাণ প্রক্রিয়া গভীর সংকটে পড়ে। ‘লাইক’ এর সংখ্যা ক্রমশ আত্মসম্মান এবং আত্ম-মূল্যায়নের মাপকাঠি হয়ে ওঠে। ব্যক্তি তার অন্তর্নিহিত মূল্য ভুলে গিয়ে বহিরাগত অনুমোদনের ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কম ‘লাইক’ পেলে তীব্র উদ্বেগ, হতাশা, এবং সামাজিক বর্জন-এর ভয় জন্ম নেয়Ñযা ‘সোশ্যাল ডিসভ্যালুয়েশন’ নামে পরিচিত। এই মানসিক চাপ থেকে বাঁচতে, ব্যবহারকারীরা নিজেদের অনন্যতা বা বাস্তবতা বিসর্জন দিয়ে কেবল সেই কনটেন্ট তৈরি করে যা আলগরিদমের দৃষ্টিতে অনুকূল এবং বেশি ‘লাইক’ পেতে সাহায্য করবে। এইভাবে, ব্যক্তি তার নিজের জীবনের পরিচালক হওয়ার পরিবর্তে, সোশ্যাল মিডিয়ার অনুসারীতে পরিণত হয়।

‘লাইক’ সংস্কৃতি ঐতিহ্যবাহী সামাজিক মূলধন এবং সম্পর্কের সংজ্ঞাকে পরিবর্তন করেছে। আগে সামাজিক মূলধন তৈরি হতো ব্যক্তিগত আস্থা, পারস্পরিক সহযোগিতা এবং গভীর সম্পর্কের মাধ্যমে, যা ছিল মূলত দৃঢ় বন্ধন । কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে, ‘লাইক’ এবং অনুসারীর সংখ্যা অগভীর বন্ধন-এর ওপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া এক ধরনের পরিমাণগত সামাজিক মূলধন সৃষ্টি করেছে। এই মূলধন আপাতদৃষ্টিতে ক্ষমতা বা জনপ্রিয়তা দেখালেও, এর ভিত্তি দুর্বল এবং ভঙ্গুর।

এর একটি অন্যতম নেতিবাচক প্রভাব হলো অকৃত্রিমতার বিলুপ্তি এবং কৃত্রিম জীবনযাত্রা প্রদর্শন। ‘লাইক’ পাওয়ার তাড়না মানুষকে বাধ্য করে নিজেদের জীবনের কেবল ‘নিখুঁত’ বা ‘আকর্ষণীয়’ দিকগুলি প্রদর্শন করতে। এর ফলস্বরূপ, সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে ওঠে এক ধরনের উপভোগের মঞ্চ, যেখানে কষ্ট, সংগ্রাম বা ব্যর্থতার কোনো স্থান নেই। এই কৃত্রিম প্রদর্শনী সমাজে এক মিথ্যা মানদ- তৈরি করে, যা ক্রমাগত অন্যদের মধ্যে হীনমন্যতা, ঈর্ষা এবং উদ্বেগ সৃষ্টি করে।

এই প্রক্রিয়াটি সামাজিক তুলনার তত্ত্বকে শক্তিশালী করেÑঅর্থাৎ, মানুষ ক্রমাগত নিজেদের অন্য সকলের কৃত্রিমভাবে নিখুঁত জীবনের সঙ্গে তুলনা করে। উপরন্তু, ‘লাইক’ নির্ভর সম্পর্কগুলো প্রায়শই অগভীর হয়; হাজার হাজার ভার্চুয়াল বন্ধু থাকলেও, বাস্তবে প্রকৃত সহানুভূতি বা মানসিক সমর্থন প্রদানকারী মানুষ কমে আসে, যা সামাজিক বিচ্ছিন্নতা-কে আরও তীব্র করে।

‘লাইক’ প্রথা কেবল সামাজিক বা মনস্তাত্ত্বিক নয়, এর একটি সুগভীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি রয়েছে। আমরা বর্তমানে মনোযোগের অর্থনীতি নামক এক যুগে বাস করছি, যেখানে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো ব্যবহারকারীর মনোযোগ এবং সময়। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি ডিজাইন করাই হয় ব্যবহারকারীদের আসক্ত করে তাদের মনোযোগকে পণ্যে পরিণত করার জন্য। ‘লাইক’ হলো এই অর্থনীতির মুদ্রা। যত বেশি ‘লাইক’ বা ইন্টারঅ্যাকশন হয়, তত বেশি সময় ব্যবহারকারী প্ল্যাটফর্মে ব্যয় করে, ফলে প্ল্যাটফর্মগুলি তত বেশি ব্যক্তিগত ডেটা সংগ্রহ করতে পারে এবং তত বেশি লক্ষ্যভিত্তিক বিজ্ঞাপন দেখাতে পারে।

এই অর্থনৈতিক মডেলের কারণে, আলগরিদমগুলি এমনভাবে কাজ করে যাতে ব্যবহারকারীদের আসক্তি চক্রটি বজায় থাকে। আলগরিদমগুলি কেবল জনপ্রিয় বা ‘লাইক’ প্রাপ্ত কনটেন্টকেই প্রাধান্য দেয়, যা কনটেন্ট নির্মাতাদের আরও বেশি সেনসেশনাল, পোলারাইজিং বা ক্লিকবেইট কনটেন্ট তৈরি করতে বাধ্য করে।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, ‘লাইক’ সংস্কৃতি গণতন্ত্র এবং জনমতকে প্রভাবিত করছে। আলগরিদমগুলো ‘লাইক’ এবং শেয়ারের ওপর ভিত্তি করে ব্যবহারকারীদের ফিল্টার বাবল বা ইকো চেম্বারের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলে। এই পরিস্থিতিতে, মানুষ কেবল সেই তথ্য এবং মতবাদই দেখতে পায় যা তার নিজস্ব গোষ্ঠীর দ্বারা অনুমোদিত বা লাইকপ্রাপ্ত। এর ফলে ভিন্ন মতবাদ বা সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার সুযোগ কমে যায়, যা রাজনৈতিক মেরুকরণকে তীব্র করে তোলে। জনপ্রিয়তা এবং ভাইরাল হওয়া প্রায়শই সত্য বা গুণগত মানের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, যা সমাজে মিথ্যা তথ্য এবং ভুল ধারণা ছড়িয়ে দিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

এই পুরো বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে একটি দার্শনিক সংকটÑভার্চুয়াল অস্তিত্ব কি বাস্তব অস্তিত্বের বিকল্প হতে পারে? ‘লাইক’ সংস্কৃতি মানুষকে এমন একটি দ্বৈত জীবনে ঠেলে দিচ্ছে, যেখানে ভার্চুয়াল ‘স্বীকৃতি’ বা ‘সাফল্য’ বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা, সম্পর্ক এবং অর্জনের চেয়ে বেশি মূল্য বহন করে। আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি যেখানে ‘যা ছবি তোলা হয়নি, তা ঘটেনি’Ñএই মনোভাব কাজ করে। অভিজ্ঞতাকে উপভোগ করার চেয়ে তাকে রেকর্ড ও প্রচার করাই মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়, যা মানব অস্তিত্বের উপস্থিতি ও নিমগ্নতাকে বিলুপ্ত করে দিচ্ছে।

‘লাইক’ সংস্কৃতি আমাদের স্ব-সত্তার ওপর প্রশ্ন তোলে: আমরা কি আমাদের নিজস্ব জীবন যাপন করছি, নাকি এমন একটি জীবন যা অন্যেরা দেখতে বা অনুমোদন করতে চায়? যদি আমাদের আনন্দ এবং মূল্যবোধ সম্পূর্ণরূপে একটি বাহ্যিক সংখ্যা বা প্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়, তবে আমরা এক ধরনের প্রযুক্তিগত পরাধীনতার মধ্যে বাস করছি।

সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ সংস্কৃতিকে বিচ্ছিন্নভাবে ‘ভালো’ বা ‘খারাপ’ কোনো একটি পাল্লায় রাখা সম্ভব নয়। এটি যোগাযোগ ও সামাজিক সংযোগের এক শক্তিশালী ইঞ্জিন, তবে একই সঙ্গে এটি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য একটি গভীর ফাঁদ। যতক্ষণ পর্যন্ত ‘লাইক’ একটি সহজ ও দ্রুত যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে, ততক্ষণ তা উপকারী। কিন্তু যখন এটি আমাদের আত্মমর্যাদার মাপকাঠি, মনোযোগের অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক বিভাজনের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তখনই তা আসক্তিতে রূপান্তরিত হয়।

এর সমাধান নিহিত আছে সচেতনতা, ডিজিটাল স্বাক্ষরতা এবং ব্যক্তিগত স্বায়ত্তশাসন পুনরুদ্ধারে। আমাদের বুঝতে হবে যে, প্রযুক্তির নকশা আমাদের আসক্ত করার জন্যেই তৈরি হয়েছে। তাই ব্যবহারকারী হিসেবে আমাদের নিজেদেরকেই সেই নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে নিতে হবে, যেখানে আমরা প্রযুক্তিকে ব্যবহার করব, প্রযুক্তি যেন আমাদের ব্যবহার করতে না পারে।

প্রকৃত জীবনের গভীর সম্পর্ক, অর্থপূর্ণ কাজ এবং ব্যক্তিগত শান্তিÑএগুলিই হলো জীবনের আসল এবং অপরিবর্তনীয় মূল্যবোধ। ‘লাইক’ সংস্কৃতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য, সমাজকে অবশ্যই ভার্চুয়াল এবং বাস্তব জীবনের মধ্যে একটি সুস্থ, নৈতিক এবং মানবিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

[লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় জনগণের ভূমিকা উপেক্ষিত

শ্রমজীবী মানুষের শোভন কর্মসংস্থান

মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় বাংলাদেশের বাস্তবতা

প্রবারণার আলোয় আলোকিত হোক মানবজাতি

অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে ওয়াশিংটনের শেষ সুযোগ?

পাহাড় থেকে সমতল: আদিবাসী নারীর নিরাপত্তা

জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যু

মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক পরিবর্তন: আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি

রম্যগদ্য: “কেশ ফ্যালায় ভাই, কেশ ফ্যালায়...”

লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থীর অধিকার: বিসিএস ও শিক্ষা ক্যাডারের বৈষম্য

ন্যাশনাল গ্যালারি : রঙতুলির মহাসমুদ্রে একদিন

যুব শক্তি বনাম বেকারত্ব

প্রযুক্তি, আর্থিক পরিকল্পনা ও গণিতের ব্যবহার

ফরাসি বিপ্লব: বৈষম্য নিরসনে সামগ্রিক মুক্তির প্রেরণা

অন্তর্বর্তী সরকারের নিউইয়র্ক সফর

প্রবীণদের যত্ন: নৈতিক দায়িত্ব থেকে সামাজিক শক্তি নির্মাণ

জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের অপরিহার্যতা

জনমিতিক সুবিধা: স্বপ্নের দশক ও নীতিগত সংস্কারের অপরিহার্যতা

বিদ্যালয় ও মাঠ দখলের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের সংগ্রাম

শিক্ষাসংস্কারে চাই সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা

ভারতে এসআইআর বিতর্ক

কীটনাশক: জনস্বাস্থ্যের হুমকি

কীটনাশক: জনস্বাস্থ্যের হুমকি

ব্যাংক একীভূতকরণ: আর্থিক খাতের সামনে নতুন বাস্তবতা

দায়িত্বশীল আচরণে গড়ে উঠুক দেশের পর্যটন খাত

এশিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় নতুন সমীকরণ

বাংলাদেশের গিগ অর্থনীতি: উন্নয়নের হাতিয়ার নাকি অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ?

জলাতঙ্ক: প্রতিরোধযোগ্য তবু প্রাণঘাতী

বেড়ে চলা বৈষম্যের দেওয়াল

নৃশংসতার ভিডিও, নীরব দর্শক আর হারিয়ে যাওয়া মানবতা

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা ও জনস্বাস্থ্যের সংকট

জেন জি’র অস্থির অভিযাত্রা

রম্যগদ্য: রবার্ট ব্রুস ও মাকড়শা

জাতিসংঘের নিউইয়র্ক সম্মেলন

বিশ্ব ফুসফুস দিবস: সুস্থ শ্বাসের অঙ্গীকার

সংখ্যার আড়ালে অর্থনীতির অদেখা বাস্তবতা

tab

opinion » post-editorial

সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ সংস্কৃতি: আসক্তি নাকি নতুন যোগাযোগ?

মতিউর রহমান

সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫

আধুনিক ডিজিটাল সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ সংস্কৃতি, যা একাধারে যোগাযোগের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে এবং একই সঙ্গে মানব মনস্তত্ত্বে এক গভীর আসক্তির বীজ বপন করেছে। আপাতদৃষ্টিতে একটি ‘লাইক’ নিছকই একটি ডিজিটাল প্রতিক্রিয়া, কিন্তু এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী; এটি আমাদের স্ব-সত্তা, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, এমনকি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেও প্রভাবিত করছে।

‘লাইক’ প্রথাকে যোগাযোগের একটি বৈপ্লবিক মাধ্যম হিসেবে দেখা যায়, যা তাৎক্ষণিকতা এবং সঙ্কোচন নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। মানব ইতিহাসজুড়েই মানুষ সর্বদা অন্যের স্বীকৃতি এবং অনুমোদন প্রত্যাশা করেছেÑআগে যা শারীরিক উপস্থিতি, প্রশংসা বা সম্মতির দীর্ঘ প্রক্রিয়া দ্বারা নির্ধারিত হতো, আজ তা একটি মাত্র ক্লিক বা স্পর্শের মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে। ‘লাইক’ হলো এই মানবিক প্রয়োজনের এক ডিজিটাল প্রতিরূপ, যা সময়ের ব্যবধান ও ভৌগোলিক দূরত্বকে তুচ্ছ করে মুহূর্তের মধ্যে সমর্থন বা একাত্মতার বার্তা পৌঁছে দেয়।

এটি কেবল একটি ‘শর্টহ্যান্ড কমিউনিকেশন’ নয়, বরং এটি একটি কার্যকরী সামাজিক মুদ্রা। কোনো পোস্টের ‘লাইক’ সংখ্যা সেই পোস্টের গুরুত্ব, জনপ্রিয়তা এবং বৈধতা নির্ধারণ করে, যা বার্তাটিকে একটি বৃহত্তর পরিসরে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। বিশেষ করে ব্যস্ত জীবনে, যখন দীর্ঘ মন্তব্য বা ব্যক্তিগত যোগাযোগের সময় থাকে না, তখন ‘লাইক’ একটি স্বীকৃতির সেতু তৈরি করে, যা ভার্চুয়াল সম্পর্কগুলোকে বাঁচিয়ে রাখে। এই অর্থে, ‘লাইক’ অবশ্যই যোগাযোগের সম্প্রসারণ এবং সামাজিক সংহতি রক্ষার একটি নতুন হাতিয়ার।

যোগাযোগের সুবিধাজনক দিক থাকা সত্ত্বেও, ‘লাইক’ সংস্কৃতির সবচেয়ে গভীর এবং বিপজ্জনক প্রভাব নিহিত আছে এর আসক্তি-সৃষ্টিকারী মনস্তত্ত্বে। এই আসক্তির মূলে রয়েছে মস্তিষ্কের জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়া। যখন একজন ব্যবহারকারী তাদের পোস্ট বা ছবিতে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া বা ‘লাইক’ পান, তখন মস্তিষ্কের পুরস্কার ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং ডোপামিন নামক নিউরোট্রান্সমিটার নির্গত হয়।

এই রাসায়নিক ক্ষরণ আনন্দ, প্রেরণা এবং পুনরাবৃত্তির আকাক্সক্ষা সৃষ্টি করে। এটি একটি ‘তাৎক্ষণিক তৃপ্তির চক্র’ তৈরি করে, যেখানে ডোপামিনের ঢেউ পাওয়ার জন্য ব্যবহারকারী বাধ্য হয়ে বারবার ফোন বা প্ল্যাটফর্ম চেক করতে থাকে। এই আচরণগত প্যাটার্ন একসময় স্বেচ্ছামূলক ক্রিয়া থেকে বাধ্যতামূলক আসক্তিতে রূপান্তরিত হয়, ঠিক যেমন জুয়া বা অন্যান্য আসক্তির ক্ষেত্রে ঘটে। সময়ের সাথে সাথে, মস্তিষ্ক এই বাহ্যিক উদ্দীপকের ওপর নির্ভর করে ফেলে, যার ফলে বাস্তব জীবনের স্বাভাবিক অর্জন থেকে প্রাপ্ত আনন্দও ফ্যাকাশে মনে হতে থাকে।

এই আসক্তির ফলস্বরূপ, মানুষের পরিচয় নির্মাণ প্রক্রিয়া গভীর সংকটে পড়ে। ‘লাইক’ এর সংখ্যা ক্রমশ আত্মসম্মান এবং আত্ম-মূল্যায়নের মাপকাঠি হয়ে ওঠে। ব্যক্তি তার অন্তর্নিহিত মূল্য ভুলে গিয়ে বহিরাগত অনুমোদনের ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কম ‘লাইক’ পেলে তীব্র উদ্বেগ, হতাশা, এবং সামাজিক বর্জন-এর ভয় জন্ম নেয়Ñযা ‘সোশ্যাল ডিসভ্যালুয়েশন’ নামে পরিচিত। এই মানসিক চাপ থেকে বাঁচতে, ব্যবহারকারীরা নিজেদের অনন্যতা বা বাস্তবতা বিসর্জন দিয়ে কেবল সেই কনটেন্ট তৈরি করে যা আলগরিদমের দৃষ্টিতে অনুকূল এবং বেশি ‘লাইক’ পেতে সাহায্য করবে। এইভাবে, ব্যক্তি তার নিজের জীবনের পরিচালক হওয়ার পরিবর্তে, সোশ্যাল মিডিয়ার অনুসারীতে পরিণত হয়।

‘লাইক’ সংস্কৃতি ঐতিহ্যবাহী সামাজিক মূলধন এবং সম্পর্কের সংজ্ঞাকে পরিবর্তন করেছে। আগে সামাজিক মূলধন তৈরি হতো ব্যক্তিগত আস্থা, পারস্পরিক সহযোগিতা এবং গভীর সম্পর্কের মাধ্যমে, যা ছিল মূলত দৃঢ় বন্ধন । কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে, ‘লাইক’ এবং অনুসারীর সংখ্যা অগভীর বন্ধন-এর ওপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া এক ধরনের পরিমাণগত সামাজিক মূলধন সৃষ্টি করেছে। এই মূলধন আপাতদৃষ্টিতে ক্ষমতা বা জনপ্রিয়তা দেখালেও, এর ভিত্তি দুর্বল এবং ভঙ্গুর।

এর একটি অন্যতম নেতিবাচক প্রভাব হলো অকৃত্রিমতার বিলুপ্তি এবং কৃত্রিম জীবনযাত্রা প্রদর্শন। ‘লাইক’ পাওয়ার তাড়না মানুষকে বাধ্য করে নিজেদের জীবনের কেবল ‘নিখুঁত’ বা ‘আকর্ষণীয়’ দিকগুলি প্রদর্শন করতে। এর ফলস্বরূপ, সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে ওঠে এক ধরনের উপভোগের মঞ্চ, যেখানে কষ্ট, সংগ্রাম বা ব্যর্থতার কোনো স্থান নেই। এই কৃত্রিম প্রদর্শনী সমাজে এক মিথ্যা মানদ- তৈরি করে, যা ক্রমাগত অন্যদের মধ্যে হীনমন্যতা, ঈর্ষা এবং উদ্বেগ সৃষ্টি করে।

এই প্রক্রিয়াটি সামাজিক তুলনার তত্ত্বকে শক্তিশালী করেÑঅর্থাৎ, মানুষ ক্রমাগত নিজেদের অন্য সকলের কৃত্রিমভাবে নিখুঁত জীবনের সঙ্গে তুলনা করে। উপরন্তু, ‘লাইক’ নির্ভর সম্পর্কগুলো প্রায়শই অগভীর হয়; হাজার হাজার ভার্চুয়াল বন্ধু থাকলেও, বাস্তবে প্রকৃত সহানুভূতি বা মানসিক সমর্থন প্রদানকারী মানুষ কমে আসে, যা সামাজিক বিচ্ছিন্নতা-কে আরও তীব্র করে।

‘লাইক’ প্রথা কেবল সামাজিক বা মনস্তাত্ত্বিক নয়, এর একটি সুগভীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি রয়েছে। আমরা বর্তমানে মনোযোগের অর্থনীতি নামক এক যুগে বাস করছি, যেখানে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো ব্যবহারকারীর মনোযোগ এবং সময়। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি ডিজাইন করাই হয় ব্যবহারকারীদের আসক্ত করে তাদের মনোযোগকে পণ্যে পরিণত করার জন্য। ‘লাইক’ হলো এই অর্থনীতির মুদ্রা। যত বেশি ‘লাইক’ বা ইন্টারঅ্যাকশন হয়, তত বেশি সময় ব্যবহারকারী প্ল্যাটফর্মে ব্যয় করে, ফলে প্ল্যাটফর্মগুলি তত বেশি ব্যক্তিগত ডেটা সংগ্রহ করতে পারে এবং তত বেশি লক্ষ্যভিত্তিক বিজ্ঞাপন দেখাতে পারে।

এই অর্থনৈতিক মডেলের কারণে, আলগরিদমগুলি এমনভাবে কাজ করে যাতে ব্যবহারকারীদের আসক্তি চক্রটি বজায় থাকে। আলগরিদমগুলি কেবল জনপ্রিয় বা ‘লাইক’ প্রাপ্ত কনটেন্টকেই প্রাধান্য দেয়, যা কনটেন্ট নির্মাতাদের আরও বেশি সেনসেশনাল, পোলারাইজিং বা ক্লিকবেইট কনটেন্ট তৈরি করতে বাধ্য করে।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, ‘লাইক’ সংস্কৃতি গণতন্ত্র এবং জনমতকে প্রভাবিত করছে। আলগরিদমগুলো ‘লাইক’ এবং শেয়ারের ওপর ভিত্তি করে ব্যবহারকারীদের ফিল্টার বাবল বা ইকো চেম্বারের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলে। এই পরিস্থিতিতে, মানুষ কেবল সেই তথ্য এবং মতবাদই দেখতে পায় যা তার নিজস্ব গোষ্ঠীর দ্বারা অনুমোদিত বা লাইকপ্রাপ্ত। এর ফলে ভিন্ন মতবাদ বা সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার সুযোগ কমে যায়, যা রাজনৈতিক মেরুকরণকে তীব্র করে তোলে। জনপ্রিয়তা এবং ভাইরাল হওয়া প্রায়শই সত্য বা গুণগত মানের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, যা সমাজে মিথ্যা তথ্য এবং ভুল ধারণা ছড়িয়ে দিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

এই পুরো বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে একটি দার্শনিক সংকটÑভার্চুয়াল অস্তিত্ব কি বাস্তব অস্তিত্বের বিকল্প হতে পারে? ‘লাইক’ সংস্কৃতি মানুষকে এমন একটি দ্বৈত জীবনে ঠেলে দিচ্ছে, যেখানে ভার্চুয়াল ‘স্বীকৃতি’ বা ‘সাফল্য’ বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা, সম্পর্ক এবং অর্জনের চেয়ে বেশি মূল্য বহন করে। আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি যেখানে ‘যা ছবি তোলা হয়নি, তা ঘটেনি’Ñএই মনোভাব কাজ করে। অভিজ্ঞতাকে উপভোগ করার চেয়ে তাকে রেকর্ড ও প্রচার করাই মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়, যা মানব অস্তিত্বের উপস্থিতি ও নিমগ্নতাকে বিলুপ্ত করে দিচ্ছে।

‘লাইক’ সংস্কৃতি আমাদের স্ব-সত্তার ওপর প্রশ্ন তোলে: আমরা কি আমাদের নিজস্ব জীবন যাপন করছি, নাকি এমন একটি জীবন যা অন্যেরা দেখতে বা অনুমোদন করতে চায়? যদি আমাদের আনন্দ এবং মূল্যবোধ সম্পূর্ণরূপে একটি বাহ্যিক সংখ্যা বা প্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়, তবে আমরা এক ধরনের প্রযুক্তিগত পরাধীনতার মধ্যে বাস করছি।

সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ সংস্কৃতিকে বিচ্ছিন্নভাবে ‘ভালো’ বা ‘খারাপ’ কোনো একটি পাল্লায় রাখা সম্ভব নয়। এটি যোগাযোগ ও সামাজিক সংযোগের এক শক্তিশালী ইঞ্জিন, তবে একই সঙ্গে এটি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য একটি গভীর ফাঁদ। যতক্ষণ পর্যন্ত ‘লাইক’ একটি সহজ ও দ্রুত যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে, ততক্ষণ তা উপকারী। কিন্তু যখন এটি আমাদের আত্মমর্যাদার মাপকাঠি, মনোযোগের অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক বিভাজনের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তখনই তা আসক্তিতে রূপান্তরিত হয়।

এর সমাধান নিহিত আছে সচেতনতা, ডিজিটাল স্বাক্ষরতা এবং ব্যক্তিগত স্বায়ত্তশাসন পুনরুদ্ধারে। আমাদের বুঝতে হবে যে, প্রযুক্তির নকশা আমাদের আসক্ত করার জন্যেই তৈরি হয়েছে। তাই ব্যবহারকারী হিসেবে আমাদের নিজেদেরকেই সেই নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে নিতে হবে, যেখানে আমরা প্রযুক্তিকে ব্যবহার করব, প্রযুক্তি যেন আমাদের ব্যবহার করতে না পারে।

প্রকৃত জীবনের গভীর সম্পর্ক, অর্থপূর্ণ কাজ এবং ব্যক্তিগত শান্তিÑএগুলিই হলো জীবনের আসল এবং অপরিবর্তনীয় মূল্যবোধ। ‘লাইক’ সংস্কৃতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য, সমাজকে অবশ্যই ভার্চুয়াল এবং বাস্তব জীবনের মধ্যে একটি সুস্থ, নৈতিক এবং মানবিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

[লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

back to top