মিথুশিলাক মুরমু
খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি আদিবাসীদের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী মারমা। গত ২৩ সেপ্টেম্বর নবম শ্রেণির এক মারমা ছাত্রী রাত ৯টার দিকে প্রাইভেট পড়া শেষে ফেরার পথে দুর্বৃত্তরা পথরোধ করে। পরে তাকে পাশের জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হয়। দীর্ঘ সময় পর, প্রায় রাত ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় ধানক্ষেত থেকে স্বজনরা তাকে উদ্ধার করেন।
স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসকেরা রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন, কিশোরী মারমা মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হননি; ধর্ষণের কোনো আলামতও পাওয়া যায়নি। কিন্তু এই রিপোর্ট পুলিশের কাছে পৌঁছানোর আগেই ছবিসহ লোকজনের হাতে ছড়িয়ে পড়ে। এতে মেয়েটির পরিবার চরম উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। আদিবাসী মেয়েটি ধর্ষণের কিংবা শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন কি নাÑসেই প্রশ্ন ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে বিতর্ক।
যদি সত্যিই ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানি না ঘটে থাকে, তবে কেন মেয়েটিকে অপহরণ করা হয়েছিল? ভয় দেখানো বা হুমকি দেওয়ার অন্য উপায়ও তো ছিল! তাহলে অজ্ঞান করে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা কোথায়? নিঃসন্দেহে অপহরণকারীদের কোনো না কোনো স্বার্থ ছিল, এবং সেই স্বার্থ হাসিলের পরই মেয়েটিকে ফেলে যাওয়া হয়েছে। অতীতের অনুরূপ ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে সহজেই অনুমান করা যায়Ñআদিবাসী মারমা মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হয়েই ধানক্ষেত থেকে উদ্ধার হয়েছিলেন।
ধর্ষণের প্রতিবাদে জুম্ম ছাত্র-জনতা অবরোধ ডাকলে পরিস্থিতি আরও অবনতি ঘটে। এতে তিনজন পাহাড়ি আদিবাসী নিহত হন, আহত হন অন্তত ১৫ জন, অর্ধশতাধিক বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয় এবং প্রায় ৪০টি দোকান ভস্মীভূত হয়। ঘটনার পর জাতীয় নাগরিক পার্টির সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ আগুনে ঘি ঢেলে মন্তব্য করেনÑ‘ভুয়া ধর্ষণ’। তার এই বক্তব্য ঘিরে সমালোচনার ঝড় ওঠে। পরে তিনি লিখেছেন, ‘ধর্ষণের মতো গর্হিত অপরাধ কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না; ধর্ষকের কঠোরতম শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’
মাসউদের ‘ভুয়া ধর্ষণ’ মন্তব্যের প্রতিবাদে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আদিবাসীদের একমাত্র প্রতিনিধি অলিক মৃ পদত্যাগ করেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে বারবার ঘটে চলা ধর্ষণ, সম্প্রীতি বিনষ্ট ও হত্যাকা-ের ঘটনায় আমরা দীর্ঘদিন ধরে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করে আসছি।
একটি বেসরকারি সংস্থার গবেষণায় দেখা যায়Ñপার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রায় ৬২ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। এর মধ্যে ৩৫ দশমিক ৮ শতাংশ চরম দরিদ্র। দুর্গম এলাকায় বসবাসরত বম, লুসাই, খিয়াং, খুমী, চাক, ম্রো ও মারমা জনগোষ্ঠীর মানুষ সবচেয়ে বেশি দরিদ্র ও পুষ্টিহীনতার শিকার। দরিদ্র জনগণের ৫৮ শতাংশ জুমচাষের ওপর নির্ভরশীল, ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ কৃষি-অকৃষি দিনমজুর, ৯ শতাংশ প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে নিয়োজিত, ৭ শতাংশ ক্ষুদ্র ব্যবসা বা সরকারি–বেসরকারি চাকরিতে কর্মরত।
দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় গত দশ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে। মানবাধিকার সংস্থা ‘কাপেং ফাউন্ডেশন’ এবং জাতীয় দৈনিকগুলোর তথ্য অনুযায়ীÑ
২০১৩-২০১৭ পর্যন্ত সময়ে ৩৬৪ জন আদিবাসী নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। এর মধ্যে ১০৬ জন শারীরিক নিপীড়নের, ১০০ জন ধর্ষণের এবং ৬৬ জন ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছেন।
২০১৫ সালে যৌন নির্যাতনের শিকার হন ৮৫ জন নারী ও কন্যাশিশু; এর মধ্যে ২৬ জন ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার, ৩ জনকে হত্যা করা হয়।
২০০৭-২০১৬ সময়কালে অন্তত ৪৬৬টি ঘটনায় আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হন; তাদের বয়স ছিল ৩ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে।
২০১৮ সালে ১০ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন, এর মধ্যে ৪ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়Ñসবিতা চাকমা, সুজাতা চাকমা, ছবি মারমা ও তুমাচিং মারমা। একই বছরে বান্দরবানের লামায় ম্যাহ্লাউ মারমাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়।
২০১৯ সালে নিপীড়নের ঘটনা ছিল ৩৩টি; এর মধ্যে ধর্ষণ ১০টি।
২০২০ সালে নিপীড়নের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬২টিতে; এর মধ্যে ২০টি ধর্ষণ ও দুইটি ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা।
২০২১ সালে পাহাড় ও সমতলে ২২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে; এর মধ্যে ৪ জন নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়।
২০২৫ সালের জানুয়ারি-জুন পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে ১০৩টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৩১৫ জন জুম্ম নাগরিকের অধিকার লঙ্ঘন, ৪৯ জন গ্রেপ্তার, ৩০ জন ম্রো শিশুকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা এবং ৩০০ একর ভূমি বেদখলের ঘটনা ঘটেছে। জুম্ম নারী ও শিশুর ওপর ১৫টি ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা এবং ১৬ জন নারী মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ওপর দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন অধ্যাপক মার্ক লেভিন। তিনি লিখেছেনÑ
“গণধর্ষণ, বিশেষ করে কমবয়সী মেয়েদের ধর্ষণসহ অঙ্গচ্ছেদ ও হত্যা ছিল একটি বিরামহীন নৃশংস কৌশল। এর উদ্দেশ্য ছিল গোটা জুম্ম জনগণকে শাস্তি দেওয়া ও কলঙ্কিত করা। ধর্ষিতাকে সমাজ ও পরিবার আর গ্রহণ করে না, ফলে তারা দীর্ঘস্থায়ী মানসিক আঘাতে (সাইকোলজিক্যাল ট্রমা) আক্রান্ত হয়। এটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত এক নির্মূলকরণ কর্মসূচির অংশ।”
২০১৮ সালে পাইচিংমং মারমা ডয়চে ভেলে-তে লিখেছিলেনÑ
“১৯৭৩ সালে দীঘিনালা হাইস্কুল মাঠে এক সামরিক কর্মকর্তা ঘোষণা দিয়েছিলেনÑ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যেক উপজাতি মহিলার গর্ভে একটা করে মুসলমান বাঙালি সন্তান জন্ম নেবে।’ এটি ছিল কাউন্টার-ইনসারজেন্সির অংশ।”
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত দেশে খুন হয়েছে ১,৫৫৪ জন; ডাকাতি ৬১০টি, দস্যুতা ১,৫২৬টি, দাঙ্গা ৯৭টি, ধর্ষণ ৪,১০৫টি, এসিড নিক্ষেপ ৫টি, নারী ও শিশু নির্যাতন ১২,৭২৬টি, অপহরণ ৮১৯টি, চুরি-ডাকাতিসহ অন্যান্য অপরাধে মামলা হয়েছে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৯৫৫টি। অর্থাৎ, বাংলাদেশ আজ দুর্বৃত্ত ও অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে।
সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছেÑ‘ধর্ষণে জড়ালেও শাস্তি হবে না’Ñএমন ধারণা পোষণ করে ২৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ আসামি। এই দায়মুক্তির সংস্কৃতিই অপরাধীদের আরও বেপরোয়া করে তুলছে। তারা খাগড়াছড়ির মেয়েটির মতো নিরপরাধ আদিবাসী কিশোরীদের ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাদের অসম্মান করে, পরিবারকে সামাজিকভাবে হেয় করে।
রাষ্ট্রের আইন যারা উপহাস করে, তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। একটি দৃষ্টান্তই আমাদের চলার পথকে মসৃণ করতে পারে। কেননা, পাহাড় হোক বা সমতলÑকোথাও আদিবাসী নারীরা আজ নিরাপদ নন।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: কলামিস্ট]
মিথুশিলাক মুরমু
সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫
খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি আদিবাসীদের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী মারমা। গত ২৩ সেপ্টেম্বর নবম শ্রেণির এক মারমা ছাত্রী রাত ৯টার দিকে প্রাইভেট পড়া শেষে ফেরার পথে দুর্বৃত্তরা পথরোধ করে। পরে তাকে পাশের জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হয়। দীর্ঘ সময় পর, প্রায় রাত ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় ধানক্ষেত থেকে স্বজনরা তাকে উদ্ধার করেন।
স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসকেরা রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন, কিশোরী মারমা মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হননি; ধর্ষণের কোনো আলামতও পাওয়া যায়নি। কিন্তু এই রিপোর্ট পুলিশের কাছে পৌঁছানোর আগেই ছবিসহ লোকজনের হাতে ছড়িয়ে পড়ে। এতে মেয়েটির পরিবার চরম উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। আদিবাসী মেয়েটি ধর্ষণের কিংবা শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন কি নাÑসেই প্রশ্ন ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে বিতর্ক।
যদি সত্যিই ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানি না ঘটে থাকে, তবে কেন মেয়েটিকে অপহরণ করা হয়েছিল? ভয় দেখানো বা হুমকি দেওয়ার অন্য উপায়ও তো ছিল! তাহলে অজ্ঞান করে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা কোথায়? নিঃসন্দেহে অপহরণকারীদের কোনো না কোনো স্বার্থ ছিল, এবং সেই স্বার্থ হাসিলের পরই মেয়েটিকে ফেলে যাওয়া হয়েছে। অতীতের অনুরূপ ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে সহজেই অনুমান করা যায়Ñআদিবাসী মারমা মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হয়েই ধানক্ষেত থেকে উদ্ধার হয়েছিলেন।
ধর্ষণের প্রতিবাদে জুম্ম ছাত্র-জনতা অবরোধ ডাকলে পরিস্থিতি আরও অবনতি ঘটে। এতে তিনজন পাহাড়ি আদিবাসী নিহত হন, আহত হন অন্তত ১৫ জন, অর্ধশতাধিক বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয় এবং প্রায় ৪০টি দোকান ভস্মীভূত হয়। ঘটনার পর জাতীয় নাগরিক পার্টির সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ আগুনে ঘি ঢেলে মন্তব্য করেনÑ‘ভুয়া ধর্ষণ’। তার এই বক্তব্য ঘিরে সমালোচনার ঝড় ওঠে। পরে তিনি লিখেছেন, ‘ধর্ষণের মতো গর্হিত অপরাধ কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না; ধর্ষকের কঠোরতম শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’
মাসউদের ‘ভুয়া ধর্ষণ’ মন্তব্যের প্রতিবাদে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আদিবাসীদের একমাত্র প্রতিনিধি অলিক মৃ পদত্যাগ করেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে বারবার ঘটে চলা ধর্ষণ, সম্প্রীতি বিনষ্ট ও হত্যাকা-ের ঘটনায় আমরা দীর্ঘদিন ধরে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করে আসছি।
একটি বেসরকারি সংস্থার গবেষণায় দেখা যায়Ñপার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রায় ৬২ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। এর মধ্যে ৩৫ দশমিক ৮ শতাংশ চরম দরিদ্র। দুর্গম এলাকায় বসবাসরত বম, লুসাই, খিয়াং, খুমী, চাক, ম্রো ও মারমা জনগোষ্ঠীর মানুষ সবচেয়ে বেশি দরিদ্র ও পুষ্টিহীনতার শিকার। দরিদ্র জনগণের ৫৮ শতাংশ জুমচাষের ওপর নির্ভরশীল, ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ কৃষি-অকৃষি দিনমজুর, ৯ শতাংশ প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে নিয়োজিত, ৭ শতাংশ ক্ষুদ্র ব্যবসা বা সরকারি–বেসরকারি চাকরিতে কর্মরত।
দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় গত দশ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে। মানবাধিকার সংস্থা ‘কাপেং ফাউন্ডেশন’ এবং জাতীয় দৈনিকগুলোর তথ্য অনুযায়ীÑ
২০১৩-২০১৭ পর্যন্ত সময়ে ৩৬৪ জন আদিবাসী নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। এর মধ্যে ১০৬ জন শারীরিক নিপীড়নের, ১০০ জন ধর্ষণের এবং ৬৬ জন ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছেন।
২০১৫ সালে যৌন নির্যাতনের শিকার হন ৮৫ জন নারী ও কন্যাশিশু; এর মধ্যে ২৬ জন ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার, ৩ জনকে হত্যা করা হয়।
২০০৭-২০১৬ সময়কালে অন্তত ৪৬৬টি ঘটনায় আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হন; তাদের বয়স ছিল ৩ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে।
২০১৮ সালে ১০ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন, এর মধ্যে ৪ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়Ñসবিতা চাকমা, সুজাতা চাকমা, ছবি মারমা ও তুমাচিং মারমা। একই বছরে বান্দরবানের লামায় ম্যাহ্লাউ মারমাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়।
২০১৯ সালে নিপীড়নের ঘটনা ছিল ৩৩টি; এর মধ্যে ধর্ষণ ১০টি।
২০২০ সালে নিপীড়নের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬২টিতে; এর মধ্যে ২০টি ধর্ষণ ও দুইটি ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা।
২০২১ সালে পাহাড় ও সমতলে ২২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে; এর মধ্যে ৪ জন নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়।
২০২৫ সালের জানুয়ারি-জুন পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে ১০৩টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৩১৫ জন জুম্ম নাগরিকের অধিকার লঙ্ঘন, ৪৯ জন গ্রেপ্তার, ৩০ জন ম্রো শিশুকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা এবং ৩০০ একর ভূমি বেদখলের ঘটনা ঘটেছে। জুম্ম নারী ও শিশুর ওপর ১৫টি ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা এবং ১৬ জন নারী মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ওপর দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন অধ্যাপক মার্ক লেভিন। তিনি লিখেছেনÑ
“গণধর্ষণ, বিশেষ করে কমবয়সী মেয়েদের ধর্ষণসহ অঙ্গচ্ছেদ ও হত্যা ছিল একটি বিরামহীন নৃশংস কৌশল। এর উদ্দেশ্য ছিল গোটা জুম্ম জনগণকে শাস্তি দেওয়া ও কলঙ্কিত করা। ধর্ষিতাকে সমাজ ও পরিবার আর গ্রহণ করে না, ফলে তারা দীর্ঘস্থায়ী মানসিক আঘাতে (সাইকোলজিক্যাল ট্রমা) আক্রান্ত হয়। এটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত এক নির্মূলকরণ কর্মসূচির অংশ।”
২০১৮ সালে পাইচিংমং মারমা ডয়চে ভেলে-তে লিখেছিলেনÑ
“১৯৭৩ সালে দীঘিনালা হাইস্কুল মাঠে এক সামরিক কর্মকর্তা ঘোষণা দিয়েছিলেনÑ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যেক উপজাতি মহিলার গর্ভে একটা করে মুসলমান বাঙালি সন্তান জন্ম নেবে।’ এটি ছিল কাউন্টার-ইনসারজেন্সির অংশ।”
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত দেশে খুন হয়েছে ১,৫৫৪ জন; ডাকাতি ৬১০টি, দস্যুতা ১,৫২৬টি, দাঙ্গা ৯৭টি, ধর্ষণ ৪,১০৫টি, এসিড নিক্ষেপ ৫টি, নারী ও শিশু নির্যাতন ১২,৭২৬টি, অপহরণ ৮১৯টি, চুরি-ডাকাতিসহ অন্যান্য অপরাধে মামলা হয়েছে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৯৫৫টি। অর্থাৎ, বাংলাদেশ আজ দুর্বৃত্ত ও অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে।
সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছেÑ‘ধর্ষণে জড়ালেও শাস্তি হবে না’Ñএমন ধারণা পোষণ করে ২৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ আসামি। এই দায়মুক্তির সংস্কৃতিই অপরাধীদের আরও বেপরোয়া করে তুলছে। তারা খাগড়াছড়ির মেয়েটির মতো নিরপরাধ আদিবাসী কিশোরীদের ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাদের অসম্মান করে, পরিবারকে সামাজিকভাবে হেয় করে।
রাষ্ট্রের আইন যারা উপহাস করে, তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। একটি দৃষ্টান্তই আমাদের চলার পথকে মসৃণ করতে পারে। কেননা, পাহাড় হোক বা সমতলÑকোথাও আদিবাসী নারীরা আজ নিরাপদ নন।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: কলামিস্ট]