শতদল বড়ুয়া
আজ শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য আজকের দিনটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি পূর্ণিমা তিথিই কোনো না কোনো কারণে বৌদ্ধ জাতির কাছে শুভময়; তবে আজকের পূর্ণিমা তিথি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
‘প্রবারণা’ শব্দের অর্থÑআশার তৃপ্তি, অভিলাষ পূরণ, ধ্যান বা শিক্ষার সমাপ্তি। অন্যদিকে এর আরেকটি অর্থ আত্মশুদ্ধি বা আত্মসমালোচনাও বটে। এ দিনে ভিক্ষুরা হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে চারিত্রিক শুদ্ধির জন্য একে অপরকে করজোড়ে বলেনÑ
“বন্ধু, আমার যদি কোনো দোষত্রুটি দেখে থাকো বা কারো মুখে শুনে থাকো, এবং সে কারণে যদি আমার প্রতি তোমার সন্দেহ হয়ে থাকে, তবে তা আমাকে বলো, আমি তার প্রতিকার করব।”
বিনয় পরিভাষায় এই প্রক্রিয়াকেই বলা হয় প্রবারণা।
এই শুভ তিথিতেই ভগবান বুদ্ধ দেবলোক থেকে সাংকশ্য নগরে অবতরণ করেছিলেন। আজকের দিনে ভিক্ষুদের ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রত সমাপ্ত হয়। তাই আশ্বিনী পূর্ণিমা বা প্রবারণা পূর্ণিমা বৌদ্ধদের পরম পবিত্র দিন।
উল্লেখযোগ্য যে, এই দিন থেকেই ভগবান বুদ্ধের আদেশে আদিষ্ট ভিক্ষুসঙ্ঘ বুদ্ধবাণী প্রচারের জন্য বেরিয়ে পড়েছিলেনÑ
“বহুজনের হিতের জন্য, বহুজনের সুখের জন্য।”
তখন বুদ্ধ এ-ও নির্দেশ দিয়েছিলেনÑএক স্থানে একজন ভিক্ষু যাবে।
কবির ভাষায়Ñ
“উদিল যেখানে বুদ্ধ আত্ম,/ মুক্ত করিতে মোক্ষদ্বার,/ আজিও জুড়িয়া অর্ধজগত,/ ভক্তি প্রণত চরণে তার।”
ফানুস : ঐতিহ্যের প্রতীক
আজকের দিনের কার্যসূচির সমাপ্তি ঘটে ‘ফানুস’ উড়ানোর মধ্য দিয়ে।
‘ফানুস’ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একটি পুণ্যময় ঐতিহ্যের প্রতীক।
মহামানব গৌতম বুদ্ধ ছিলেন রাজা শুদ্ধোধনের পুত্র। কপিলাবস্তুর পথে পরিভ্রমণকালে রাজপুত্র সিদ্ধার্থ দেখেছিলেন শবযাত্রা, রুগ্ন মানুষ, বৃদ্ধ ব্যক্তি ও সন্ন্যাসীÑমানবজীবনের দুঃখকষ্টের নানা দৃশ্য। তখন তার মনে হলো, মানবজীবন দুঃখময়; এর থেকে মুক্তির কোনো পথ নিশ্চয় আছে।
তিনি ভাবলেনÑ“আমি জীবের মুক্তির পথ খুঁজে বের করব, জীবের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করব।”
আড়াই হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে, সংসারের সব মায়া ত্যাগ করে স্ত্রী-পুত্রের বন্ধন ছিন্ন করে রাজপুত্র সিদ্ধার্থ গভীর রাতে গৃহত্যাগ করেন। অনোমা নদীর তীরে পৌঁছে তিনি রাজকীয় পোশাক খুলে ফেললেন। পরিশেষে স্বীয় তরবারি দিয়ে মাথার চুল কেটে এক সত্যক্রিয়া স্থাপন করলেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেনÑ
“যে উদ্দেশ্যে আমি রাজসুখ ত্যাগ করে সংসারমুক্ত হয়েছি, যদি তা সফল হয়, তবে এই কাটা চুলগুলো বাতাসে নিচে না পড়ে আকাশে উড়ে যাবে।”
তিনি চুলগুলো বাতাসে উড়িয়ে দিলেনÑএবং তা সত্যিই আকাশে মিলিয়ে গেল।
তথাগত বুদ্ধের সেই সত্যক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আজও প্রবারণা পূর্ণিমার রাতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকেরা ভক্তিভরে ফানুস উড়িয়ে বুদ্ধের চুলধাতুকে বন্দনা জানায়।
ফানুস তৈরির উপকরণ
ফানুস তৈরিতে ব্যবহৃত হয় পাতলা ম্যানিলা কাগজ, বাঁশের গোল চাকা, গুনা, মোম, মোটা সূতা, জুটের সলতে, অথবা পরিষ্কার সূতির কাপড় দিয়ে বানানো সলতে।
সলতে বলতে বোঝায় ক্ষুদ্র বস্ত্রখ- পাকিয়ে প্রদীপের জন্য প্রস্তুত করা পলিতাÑযাকে গ্রামীণ ভাষায় বাতি বলা হয়।
ফানুসের প্রকারভেদ
ফানুসের নানা ধরন দেখা যায়Ñমোটকা, পুলিশ, ডোল, হাতি, ড্রাম ইত্যাদি আকৃতিতে। এতে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই; যার যেভাবে ইচ্ছে, সেভাবেই তৈরি করতে পারে।
উৎসর্গ
ফানুস উড়ানোর আগে সলতে বা বাতি বিহারে নিয়ে গিয়ে ভিক্ষুকে দিতে হয়। তিনি ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী তা উৎসর্গ করেন। এরপর তাতে তেল-মোম মেখে জ্বালানোর উপযোগী করা হয়।
ফানুস উড়ানোর প্রক্রিয়া
চূড়ান্তভাবে উড়ানোর সময় শুকনো ঘাস, বাঁশকাঠ, লাকড়ি জ্বালিয়ে হালকা আগুন তৈরি করতে হয়। এখানে আগুনের চেয়ে ধোঁয়ার প্রয়োজন বেশি।
ফানুসটিকে আগুনের ওপরে সতর্কভাবে কয়েকজন মিলে ধরে রাখতে হয়। ধোঁয়ায় ফানুস ভরে গেলে গোল চাকায় লাগানো সলতে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। তখন ফানুসের ভেতরে ঊর্ধ্বচাপ সৃষ্টি হয় এবং সেটি আকাশের দিকে টান অনুভব করায়। সবাই মিলে ছেড়ে দিলে ফানুসটি বাতাসে ভেসে দূর আকাশে মিলিয়ে যায়।
সার্বজনীন উৎসবের রূপ
ফানুস উড়ানোর আনন্দ অনন্য। এ সময়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই অংশ নেয়। বৌদ্ধ পল্লিগুলো সারাদিন সরগরম থাকে। যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সে জন্য ইউনিয়ন পরিষদ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া হয় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
কোনো কাজ কারও জন্য থেমে থাকে না, সবকিছু নিজস্ব গতিতে চলে। পারলে শিকড়ের কথা ভাবুন; সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। মূল বাদ দিলে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। আজকের প্রবারণা পূর্ণিমা সবার জন্য মঙ্গল বয়ে আনুক। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য হিংসা-বিদ্বেষ-হানাহানি পরিহারের বিকল্প নেই। ফানুসের আলোয় আলোকিত হোক সকলের জীবন। জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]
শতদল বড়ুয়া
সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫
আজ শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য আজকের দিনটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি পূর্ণিমা তিথিই কোনো না কোনো কারণে বৌদ্ধ জাতির কাছে শুভময়; তবে আজকের পূর্ণিমা তিথি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
‘প্রবারণা’ শব্দের অর্থÑআশার তৃপ্তি, অভিলাষ পূরণ, ধ্যান বা শিক্ষার সমাপ্তি। অন্যদিকে এর আরেকটি অর্থ আত্মশুদ্ধি বা আত্মসমালোচনাও বটে। এ দিনে ভিক্ষুরা হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে চারিত্রিক শুদ্ধির জন্য একে অপরকে করজোড়ে বলেনÑ
“বন্ধু, আমার যদি কোনো দোষত্রুটি দেখে থাকো বা কারো মুখে শুনে থাকো, এবং সে কারণে যদি আমার প্রতি তোমার সন্দেহ হয়ে থাকে, তবে তা আমাকে বলো, আমি তার প্রতিকার করব।”
বিনয় পরিভাষায় এই প্রক্রিয়াকেই বলা হয় প্রবারণা।
এই শুভ তিথিতেই ভগবান বুদ্ধ দেবলোক থেকে সাংকশ্য নগরে অবতরণ করেছিলেন। আজকের দিনে ভিক্ষুদের ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রত সমাপ্ত হয়। তাই আশ্বিনী পূর্ণিমা বা প্রবারণা পূর্ণিমা বৌদ্ধদের পরম পবিত্র দিন।
উল্লেখযোগ্য যে, এই দিন থেকেই ভগবান বুদ্ধের আদেশে আদিষ্ট ভিক্ষুসঙ্ঘ বুদ্ধবাণী প্রচারের জন্য বেরিয়ে পড়েছিলেনÑ
“বহুজনের হিতের জন্য, বহুজনের সুখের জন্য।”
তখন বুদ্ধ এ-ও নির্দেশ দিয়েছিলেনÑএক স্থানে একজন ভিক্ষু যাবে।
কবির ভাষায়Ñ
“উদিল যেখানে বুদ্ধ আত্ম,/ মুক্ত করিতে মোক্ষদ্বার,/ আজিও জুড়িয়া অর্ধজগত,/ ভক্তি প্রণত চরণে তার।”
ফানুস : ঐতিহ্যের প্রতীক
আজকের দিনের কার্যসূচির সমাপ্তি ঘটে ‘ফানুস’ উড়ানোর মধ্য দিয়ে।
‘ফানুস’ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একটি পুণ্যময় ঐতিহ্যের প্রতীক।
মহামানব গৌতম বুদ্ধ ছিলেন রাজা শুদ্ধোধনের পুত্র। কপিলাবস্তুর পথে পরিভ্রমণকালে রাজপুত্র সিদ্ধার্থ দেখেছিলেন শবযাত্রা, রুগ্ন মানুষ, বৃদ্ধ ব্যক্তি ও সন্ন্যাসীÑমানবজীবনের দুঃখকষ্টের নানা দৃশ্য। তখন তার মনে হলো, মানবজীবন দুঃখময়; এর থেকে মুক্তির কোনো পথ নিশ্চয় আছে।
তিনি ভাবলেনÑ“আমি জীবের মুক্তির পথ খুঁজে বের করব, জীবের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করব।”
আড়াই হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে, সংসারের সব মায়া ত্যাগ করে স্ত্রী-পুত্রের বন্ধন ছিন্ন করে রাজপুত্র সিদ্ধার্থ গভীর রাতে গৃহত্যাগ করেন। অনোমা নদীর তীরে পৌঁছে তিনি রাজকীয় পোশাক খুলে ফেললেন। পরিশেষে স্বীয় তরবারি দিয়ে মাথার চুল কেটে এক সত্যক্রিয়া স্থাপন করলেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেনÑ
“যে উদ্দেশ্যে আমি রাজসুখ ত্যাগ করে সংসারমুক্ত হয়েছি, যদি তা সফল হয়, তবে এই কাটা চুলগুলো বাতাসে নিচে না পড়ে আকাশে উড়ে যাবে।”
তিনি চুলগুলো বাতাসে উড়িয়ে দিলেনÑএবং তা সত্যিই আকাশে মিলিয়ে গেল।
তথাগত বুদ্ধের সেই সত্যক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আজও প্রবারণা পূর্ণিমার রাতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকেরা ভক্তিভরে ফানুস উড়িয়ে বুদ্ধের চুলধাতুকে বন্দনা জানায়।
ফানুস তৈরির উপকরণ
ফানুস তৈরিতে ব্যবহৃত হয় পাতলা ম্যানিলা কাগজ, বাঁশের গোল চাকা, গুনা, মোম, মোটা সূতা, জুটের সলতে, অথবা পরিষ্কার সূতির কাপড় দিয়ে বানানো সলতে।
সলতে বলতে বোঝায় ক্ষুদ্র বস্ত্রখ- পাকিয়ে প্রদীপের জন্য প্রস্তুত করা পলিতাÑযাকে গ্রামীণ ভাষায় বাতি বলা হয়।
ফানুসের প্রকারভেদ
ফানুসের নানা ধরন দেখা যায়Ñমোটকা, পুলিশ, ডোল, হাতি, ড্রাম ইত্যাদি আকৃতিতে। এতে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই; যার যেভাবে ইচ্ছে, সেভাবেই তৈরি করতে পারে।
উৎসর্গ
ফানুস উড়ানোর আগে সলতে বা বাতি বিহারে নিয়ে গিয়ে ভিক্ষুকে দিতে হয়। তিনি ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী তা উৎসর্গ করেন। এরপর তাতে তেল-মোম মেখে জ্বালানোর উপযোগী করা হয়।
ফানুস উড়ানোর প্রক্রিয়া
চূড়ান্তভাবে উড়ানোর সময় শুকনো ঘাস, বাঁশকাঠ, লাকড়ি জ্বালিয়ে হালকা আগুন তৈরি করতে হয়। এখানে আগুনের চেয়ে ধোঁয়ার প্রয়োজন বেশি।
ফানুসটিকে আগুনের ওপরে সতর্কভাবে কয়েকজন মিলে ধরে রাখতে হয়। ধোঁয়ায় ফানুস ভরে গেলে গোল চাকায় লাগানো সলতে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। তখন ফানুসের ভেতরে ঊর্ধ্বচাপ সৃষ্টি হয় এবং সেটি আকাশের দিকে টান অনুভব করায়। সবাই মিলে ছেড়ে দিলে ফানুসটি বাতাসে ভেসে দূর আকাশে মিলিয়ে যায়।
সার্বজনীন উৎসবের রূপ
ফানুস উড়ানোর আনন্দ অনন্য। এ সময়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই অংশ নেয়। বৌদ্ধ পল্লিগুলো সারাদিন সরগরম থাকে। যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সে জন্য ইউনিয়ন পরিষদ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া হয় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
কোনো কাজ কারও জন্য থেমে থাকে না, সবকিছু নিজস্ব গতিতে চলে। পারলে শিকড়ের কথা ভাবুন; সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। মূল বাদ দিলে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। আজকের প্রবারণা পূর্ণিমা সবার জন্য মঙ্গল বয়ে আনুক। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য হিংসা-বিদ্বেষ-হানাহানি পরিহারের বিকল্প নেই। ফানুসের আলোয় আলোকিত হোক সকলের জীবন। জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]