গৌতম রায়
দীর্ঘদিন ধরেই শতবর্ষপূর্তিকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ অনেক ধরনের পরিকল্পনা করছে। ভারতের চিরাচরিত মূল্যবোধকে, বৈচিত্র্যময় জীবনশৈলীকে নিজেদের কৌণিক বিন্দুতে স্থাপন করে যেভাবে একটা খ- ক্ষুদ্র করে এদেশকে দেখতে অভ্যস্ত হিন্দুত্ববাদীরা, সেভাবে নিজেদের সংগঠনের শতবর্ষ পূর্তিকে, তাদের সংজ্ঞায়িত ‘ভারতবোধে’র সঙ্গে একাত্ম করে দেখানো- এটাই ছিল আরএসএসের দীর্ঘদিনের একটা পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনাকে সামনে রেখেই তারা তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে পরিচালিত করেছে । সেই পরিচালনার ফসল হিসেবে ২০১৪ সালে বিজেপি একক ক্ষমতায় কেন্দ্রে সরকার গঠন করেছে। ২০১৯ সালে অতীতের শক্তিকে তারা আরো বৃদ্ধি করে সংসদে নিজেদের গরিষ্ঠতা বজায় রেখেছে। এই জায়গা থেকে আর আসতে বাধ্য হয়েছে ’২৪-এর লোকসভার ভোটের ফলাপলের জন্যে।
সংঘের ধারনা তৈরি হয়েছিল যে, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির সংসদে একক গরিষ্ঠতার জায়গাটি অটুট রাখতে পারবে। আর তার সুযোগ নিয়েই তারা তাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী ভারতীয়ত্বকে, রাজনৈতিক হিন্দু চিন্তা চেতনার জারুকে ভারতবাসীর উপর চাপিয়ে দেবে।
কিন্তু এই পরিকল্পনা তাদের সফল হয়নি। ২০২৪ এ তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি একক ক্ষমতায় কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করতে না পারায় , তাদের পরিকল্পনার সেই ধারা ভেস্তে গেছে। তা বলে আর এস এসের শতবর্ষ পালন ঘিরে হিন্দুত্ববাদীদের পরিকল্পনায় কোনও খামতি হয়নি। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আরএসএসের রাজনৈতিক চিন্তাকে , যাকে তারা সামাজিক চিন্তা চেতনার মোড়কে উপস্থাপিত করে, সেটির সঙ্গে, তাদের সংজ্ঞায়িত ভারতচেতনাকে কিভাবে মিশিয়ে দেওয়া যায় , সেদিকে তাদের চেষ্টায় ত্রুটি ছিল না। এই পরিকল্পনাকে সফল করবার জন্য সমস্ত রকমের কর্মকৌশল কে হিন্দুত্ববাদীরা ২০২৪ সাল একক ক্ষমতায় বিজেপি কেন্দ্রে সরকার গঠন করতেন না পারার সময় থেকেই করতে শুরু করে দেয়।
সেই পরিকল্পনারই একটা বড় অঙ্গ হলো; ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন, যার সঙ্গে নূন্যতম সংযোগ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কোনও ধারার ই ছিল না। সেই সংযোগের একটা কল্পিত মডেল নির্মাণ করা। যার ভেতর দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান স্রোত হিসেবে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ধারক- বাহকদের উপস্থাপিত করা ।আর এস এসের এটাই কাছে প্রথম এবং প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায় ।
একটা সময় ভারতের জাতীয় কংগ্রেস, স্বাধীনতার পর যেভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের অন্য সমস্ত ধারা উপধারাকে অস্বীকার করে , স্বাধীনতা আন্দোলন আর জাতীয় কংগ্রেসকে একত্ম করে দেখিয়ে , ভোট রাজনীতিতে জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষে একটা বিশেষ ধরনের সুবিধা আদায়ের কৌশলে গিয়েছিল । সেই পথ ধরে একটা বিকৃত ইতিহাস বোধের মধ্যে দিয়ে, ভারতের সাধারণ মানুষের মধ্যে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ধারক বাহকদের সম্পর্কে একটা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা- এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আরএসএস সহ গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবিরের, নিজেদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরির লক্ষ্যে সামাজিক কর্মসূচির আড়ালে এখন সবথেকে বড় রাজনৈতিক কর্মসূচি।
হিন্দুত্ববাদীরা যে কখনো কোনো অবস্থাতেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে ন্যূনতম সংযোগ রেখে চলেনি- এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। হিন্দুত্ববাদী ধারণাপ্রসূত জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাস রচয়িতা রমেশচন্দ্র মজুমদার বহু চেষ্টা করেও হিন্দুত্ববাদী কোনও ব্যক্তিত্বকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারেননি। কিছু কল্পিত ধ্যানধারণার কথা তিনি দিয়েছেন। সেই কল্পিত ধ্যান ধারণার মধ্যে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির যে অন্যতম প্রধান বক্তব্য মুসলমান বিদ্বেষ , তাকে প্রতিষ্ঠিত করে রমেশচন্দ্র মজুমদার, সাভারকারের মতো ব্যক্তিত্বকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা একজন স্বাধীনতা যোদ্ধা হিসেবে দেখাবার চেষ্টা করেও, সাভারকারের যে রাজনৈতিক বিবর্তন ব্রিটিশ শাসনকালেই দেখতে পাওয়া গিয়েছিল, সে সম্পর্কে কোনও রকম স্পষ্ট অভিমত ব্যক্ত করতে পারেননি।
সাভারকারের এই রাজনৈতিক দ্বৈততা এবং সরাসরি রাজনৈতিক হিন্দু চিন্তা চেতনার উপস্থাপন, তাকে কিন্তু জাতীয়তাবাদী ঘরানার ইতিহাসবিদ অমলেশ ত্রিপাঠীও সমর্থন করতে পারেননি। ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট থেকে ছাত্র পাঠ্য একটি বই আছে ।ভারতের জাতীয় আন্দোলন ঘিরে অমরেশ ত্রিপাঠী, বিপাণচন্দ্র এবং বরুণ দেরা যুগ্মভাবে এই গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন। সেখানেও কখনো কোনও অবস্থাতেই সাভারকারের রাজনৈতিক অভিসন্ধিকে গোপন করা হয়নি।
হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে কিভাবে প্রশ্রয় দিয়ে উনিশ শতকে শেষ দিকে অবিভক্ত পাঞ্জাবে, সেখানকার হিন্দু বণিক সম্প্রদায়, যারা ‘লালা’ সম্প্রদায় নামে সেখানে পরিচিত ছিল, তারা হিন্দু জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে, হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলির সম্মিলনে দেশভাগের ভাবনা ভেবেছিলেন তা ঘিরে আর সি মজুমদার নীরব থেকেছিলেন চিরদিপ। লাহোর থেকে প্রকাশিত ট্রিবিউন পত্রিকা কিভাবে দেশভাগের রূপরেখা ঘিরে উনিশ শতকে নিজেদের অভিমত ব্যক্ত করেছিল-- এগুলি কিন্তু জাতীয়তাবাদী ঘরানার রমেশচন্দ্র মজুমদার উত্তর কালের ইতিহাসবিদরা খুব গুরুত্ব না দিলেও , তাদের গবেষণায় সেগুলি উল্লেখ করতে ভোলেননি।
বিপানচন্দ্রের মতো আধুনিক , প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার ইতিহাসবিদের এত অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে এসব তথ্যাদি উল্লেখ করেছে । বরুণ দের সম্পর্কেও সে কথা বলা যায়।
সামাজিক কর্মসূচির আড়ালে আরএসএসের যে রাজনৈতিক মিশন, রাজনৈতিক হিন্দু ভারত নির্মাণ , সেই লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়ার পথে তাদের কাছে ভারতের জাতীয় আন্দোলনে , তাদের নেতিবাচক ভূমিকাটি একটা বড় রকমের প্রতিবন্ধকতার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে মার্ক্সীয় ঘরানার ইতিহাসবিদেরা তাদের নিরলস গবেষণার মধ্যে দিয়ে দেখিয়েছেন; ভারতের জাতীয় আন্দোলনে আরএসএসের কেবল নেতিবাচক ভূমিকাই নয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে ভূমিকাটিকেও। ব্রিটিশের সেবাদাস হিসেবে আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতা বিভিন্ন ব্যক্তিত্বদের যে অবস্থান , সে সম্পর্কে মার্কসীয় ঘরানার ইতিহাসবিদের যে মূল্যায়ন , সেটি কেবলমাত্র মার্কসবাদী চিন্তা চেতনার পাঠকদের মধ্যেই এখন আর সীমাবদ্ধ নেই। যারা প্রচলিত অর্থে মার্কসবাদী চিন্তা চেতনার সঙ্গে খুব একটা সাযুজ্য অনুভব করেন না, সেই সমস্ত মানুষদের মধ্যেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ঘিরে হিন্দুত্ববাদীদের ভূমিকা- সেটি এখন প্রায় দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে।
জাতীয় কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত বা বুর্জোয়া রাজনীতির বিভিন্ন ধারার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত , সেই সব মানুষদের একটা বড় অংশের কাছে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে আরএসএস যে কোনও ভাবেই অংশগ্রহণ করেনি- এই বিষয়টি এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য ।প্রতিটি দেশপ্রেমিক ভারতবাসীর কাছেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে আরএসএসের নেতিবাচক ভূমিকা এখন আর আলাদা করে জানবার বা জানানোর কোনও জায়গা নেই।
এইরকম একটা অবস্থায়, আরএসএস তাদের গোটা রাজনৈতিক পরিম-লের মধ্যে দিয়ে নিজেদের যে তথাকথিত দেশপ্রেম ঘিরে নানা ধরনের প্রচার চালায় , সেই প্রচার কার্যত এখন অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্নের মুখে পড়ছে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের নেতিবাচক অবস্থান ঘিরে নিজেদের মধ্যেই এখন প্রশানের মুখে সংঘ। তাই রাজনৈতিক হিন্দু ভারতের জিঘির তুলে আগামী লোকসভা নির্বাচনে (২০২৬) নিজেদের রাজনৈতিক সাফল্যকে ধরে রাখতে গেলে গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির কে এখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের পরাকাষ্ঠ হিসেবে দেখানো ছাড়া আরএসএস নেতৃত্বের কাছে অন্য কোনও গত্যন্তর নেই।
আপামর ভারতবাসীর কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্য করে তুলতে এখন তাই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রধান নায়ক হিসেবে সাভারকর , হেডগেওয়ার, গোলওয়ালকরের মত সংগঠনের তাত্ত্বিক ভিত্তির নির্মাতা বা প্রধান ব্যক্তিত্বদের তুলে ধরতে তৎপর হয়ে উঠেছে আরএসএস। তারা বুঝতে পারছে , যতই তারা নিজেদের সংগঠন বা সংগঠনের লোকেদের দেশপ্রেমিক হিসেবে দেখাতে চেষ্টা করুক না কেন , সাধারণ মানুষের কাছে ব্রিটিশ বিরোধী কর্মকা-ের সঙ্গে আর এস এসের সংযোগ ঘিরে ন্যূনতম বিশ্বাসযোগ্যতা সাধারণ মানুষের নিই। এমনকি যারা সংঘ ঘরানার কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত, তারাও কখনো কোনও অবস্থাতেই ব্রিটিশকে, ভারত থেকে বিতাড়িত করবার ক্ষেত্রে সংঘ বা হিন্দুত্ববাদী ভাবধারার লোকেদের কোনও ইতিবাচক অবদান ঘিরে বিশ্বাসী নয়।
কারণ প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে সংঘ তাদের এই প্রায় ১০০ বছরের পথ পরিক্রমার কালে যে তাত্ত্বিক মনভূমি নির্মাণের চেষ্টা করে গেছে, সেখানে কখনো কোনও অবস্থাতেই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা তো দূরের কথা। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে একটা শব্দও তাদের কর্মী সমর্থকদের কাছে তুলে ধরবার চেষ্টা করে তারা করে নি। বরংচ ব্রিটিশ শাসন যে ভারতবাসীর পক্ষে একটা ইতিবাচক ধ্যান ধারণা তৈরি করেছিল , ভারতের উন্নতি ঘটিয়েছিল -এটাকে মেলে ধরতেই আরএসএস গত ১০০ বছর ধরে যতœবান থেকেছে।
তার পাশাপাশি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের বিভিন্ন তরিকার যে নেতৃত্ব, তাদের সম্পর্কে কর্মী সমর্থকদের কাছে একটা অসত্য ধারণা তুলে ধরাই ছিল সংঘের আদর্শগত অবস্থান। কিন্তু তিন দফায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করবার পর, তাদের মূল মস্তিষ্ক আরএসএস এখন বুঝতে পারছে যে, উগ্র হিন্দুত্বের পাশা খেলা দিয়ে, হিন্দু- মুসলমানের বিভাজন ঘটিয়ে , নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা এখন আর আগের মতো সহজ নয়।
আগামী লোকসভা নির্বাচন যেটি ২০১৯ সালে ঘটতে চলেছে, সেখানে ভয়াবহ আকার ধারণ করবে তিন দফার মোদি সরকারের বিরুদ্ধে একটা প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা ।এই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা যে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে বিশেষ একটা সুবিধা করে উঠতে পারবে না -- এটা বুঝতে পেরেই কিন্তু সংঘের শতবর্ষ পালনকে উপলক্ষ করে দেশপ্রেমের নামে উগ্রতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সংঘ নেতৃত্ব -কর্মী -সমর্থকদের ইতিবাচক ভূমিকা এবং অবদানের এই অসত্য প্রচারে মেতেছে গোটা হিন্দুত্ববাদী শক্তি ।
[লেখক: ভারতীয়ী ইতিহাসবিদ]
গৌতম রায়
শনিবার, ১১ অক্টোবর ২০২৫
দীর্ঘদিন ধরেই শতবর্ষপূর্তিকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ অনেক ধরনের পরিকল্পনা করছে। ভারতের চিরাচরিত মূল্যবোধকে, বৈচিত্র্যময় জীবনশৈলীকে নিজেদের কৌণিক বিন্দুতে স্থাপন করে যেভাবে একটা খ- ক্ষুদ্র করে এদেশকে দেখতে অভ্যস্ত হিন্দুত্ববাদীরা, সেভাবে নিজেদের সংগঠনের শতবর্ষ পূর্তিকে, তাদের সংজ্ঞায়িত ‘ভারতবোধে’র সঙ্গে একাত্ম করে দেখানো- এটাই ছিল আরএসএসের দীর্ঘদিনের একটা পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনাকে সামনে রেখেই তারা তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে পরিচালিত করেছে । সেই পরিচালনার ফসল হিসেবে ২০১৪ সালে বিজেপি একক ক্ষমতায় কেন্দ্রে সরকার গঠন করেছে। ২০১৯ সালে অতীতের শক্তিকে তারা আরো বৃদ্ধি করে সংসদে নিজেদের গরিষ্ঠতা বজায় রেখেছে। এই জায়গা থেকে আর আসতে বাধ্য হয়েছে ’২৪-এর লোকসভার ভোটের ফলাপলের জন্যে।
সংঘের ধারনা তৈরি হয়েছিল যে, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির সংসদে একক গরিষ্ঠতার জায়গাটি অটুট রাখতে পারবে। আর তার সুযোগ নিয়েই তারা তাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী ভারতীয়ত্বকে, রাজনৈতিক হিন্দু চিন্তা চেতনার জারুকে ভারতবাসীর উপর চাপিয়ে দেবে।
কিন্তু এই পরিকল্পনা তাদের সফল হয়নি। ২০২৪ এ তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি একক ক্ষমতায় কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করতে না পারায় , তাদের পরিকল্পনার সেই ধারা ভেস্তে গেছে। তা বলে আর এস এসের শতবর্ষ পালন ঘিরে হিন্দুত্ববাদীদের পরিকল্পনায় কোনও খামতি হয়নি। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আরএসএসের রাজনৈতিক চিন্তাকে , যাকে তারা সামাজিক চিন্তা চেতনার মোড়কে উপস্থাপিত করে, সেটির সঙ্গে, তাদের সংজ্ঞায়িত ভারতচেতনাকে কিভাবে মিশিয়ে দেওয়া যায় , সেদিকে তাদের চেষ্টায় ত্রুটি ছিল না। এই পরিকল্পনাকে সফল করবার জন্য সমস্ত রকমের কর্মকৌশল কে হিন্দুত্ববাদীরা ২০২৪ সাল একক ক্ষমতায় বিজেপি কেন্দ্রে সরকার গঠন করতেন না পারার সময় থেকেই করতে শুরু করে দেয়।
সেই পরিকল্পনারই একটা বড় অঙ্গ হলো; ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন, যার সঙ্গে নূন্যতম সংযোগ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কোনও ধারার ই ছিল না। সেই সংযোগের একটা কল্পিত মডেল নির্মাণ করা। যার ভেতর দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান স্রোত হিসেবে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ধারক- বাহকদের উপস্থাপিত করা ।আর এস এসের এটাই কাছে প্রথম এবং প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায় ।
একটা সময় ভারতের জাতীয় কংগ্রেস, স্বাধীনতার পর যেভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের অন্য সমস্ত ধারা উপধারাকে অস্বীকার করে , স্বাধীনতা আন্দোলন আর জাতীয় কংগ্রেসকে একত্ম করে দেখিয়ে , ভোট রাজনীতিতে জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষে একটা বিশেষ ধরনের সুবিধা আদায়ের কৌশলে গিয়েছিল । সেই পথ ধরে একটা বিকৃত ইতিহাস বোধের মধ্যে দিয়ে, ভারতের সাধারণ মানুষের মধ্যে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ধারক বাহকদের সম্পর্কে একটা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা- এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আরএসএস সহ গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবিরের, নিজেদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরির লক্ষ্যে সামাজিক কর্মসূচির আড়ালে এখন সবথেকে বড় রাজনৈতিক কর্মসূচি।
হিন্দুত্ববাদীরা যে কখনো কোনো অবস্থাতেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে ন্যূনতম সংযোগ রেখে চলেনি- এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। হিন্দুত্ববাদী ধারণাপ্রসূত জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাস রচয়িতা রমেশচন্দ্র মজুমদার বহু চেষ্টা করেও হিন্দুত্ববাদী কোনও ব্যক্তিত্বকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারেননি। কিছু কল্পিত ধ্যানধারণার কথা তিনি দিয়েছেন। সেই কল্পিত ধ্যান ধারণার মধ্যে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির যে অন্যতম প্রধান বক্তব্য মুসলমান বিদ্বেষ , তাকে প্রতিষ্ঠিত করে রমেশচন্দ্র মজুমদার, সাভারকারের মতো ব্যক্তিত্বকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা একজন স্বাধীনতা যোদ্ধা হিসেবে দেখাবার চেষ্টা করেও, সাভারকারের যে রাজনৈতিক বিবর্তন ব্রিটিশ শাসনকালেই দেখতে পাওয়া গিয়েছিল, সে সম্পর্কে কোনও রকম স্পষ্ট অভিমত ব্যক্ত করতে পারেননি।
সাভারকারের এই রাজনৈতিক দ্বৈততা এবং সরাসরি রাজনৈতিক হিন্দু চিন্তা চেতনার উপস্থাপন, তাকে কিন্তু জাতীয়তাবাদী ঘরানার ইতিহাসবিদ অমলেশ ত্রিপাঠীও সমর্থন করতে পারেননি। ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট থেকে ছাত্র পাঠ্য একটি বই আছে ।ভারতের জাতীয় আন্দোলন ঘিরে অমরেশ ত্রিপাঠী, বিপাণচন্দ্র এবং বরুণ দেরা যুগ্মভাবে এই গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন। সেখানেও কখনো কোনও অবস্থাতেই সাভারকারের রাজনৈতিক অভিসন্ধিকে গোপন করা হয়নি।
হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে কিভাবে প্রশ্রয় দিয়ে উনিশ শতকে শেষ দিকে অবিভক্ত পাঞ্জাবে, সেখানকার হিন্দু বণিক সম্প্রদায়, যারা ‘লালা’ সম্প্রদায় নামে সেখানে পরিচিত ছিল, তারা হিন্দু জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে, হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলির সম্মিলনে দেশভাগের ভাবনা ভেবেছিলেন তা ঘিরে আর সি মজুমদার নীরব থেকেছিলেন চিরদিপ। লাহোর থেকে প্রকাশিত ট্রিবিউন পত্রিকা কিভাবে দেশভাগের রূপরেখা ঘিরে উনিশ শতকে নিজেদের অভিমত ব্যক্ত করেছিল-- এগুলি কিন্তু জাতীয়তাবাদী ঘরানার রমেশচন্দ্র মজুমদার উত্তর কালের ইতিহাসবিদরা খুব গুরুত্ব না দিলেও , তাদের গবেষণায় সেগুলি উল্লেখ করতে ভোলেননি।
বিপানচন্দ্রের মতো আধুনিক , প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার ইতিহাসবিদের এত অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে এসব তথ্যাদি উল্লেখ করেছে । বরুণ দের সম্পর্কেও সে কথা বলা যায়।
সামাজিক কর্মসূচির আড়ালে আরএসএসের যে রাজনৈতিক মিশন, রাজনৈতিক হিন্দু ভারত নির্মাণ , সেই লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়ার পথে তাদের কাছে ভারতের জাতীয় আন্দোলনে , তাদের নেতিবাচক ভূমিকাটি একটা বড় রকমের প্রতিবন্ধকতার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে মার্ক্সীয় ঘরানার ইতিহাসবিদেরা তাদের নিরলস গবেষণার মধ্যে দিয়ে দেখিয়েছেন; ভারতের জাতীয় আন্দোলনে আরএসএসের কেবল নেতিবাচক ভূমিকাই নয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে ভূমিকাটিকেও। ব্রিটিশের সেবাদাস হিসেবে আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতা বিভিন্ন ব্যক্তিত্বদের যে অবস্থান , সে সম্পর্কে মার্কসীয় ঘরানার ইতিহাসবিদের যে মূল্যায়ন , সেটি কেবলমাত্র মার্কসবাদী চিন্তা চেতনার পাঠকদের মধ্যেই এখন আর সীমাবদ্ধ নেই। যারা প্রচলিত অর্থে মার্কসবাদী চিন্তা চেতনার সঙ্গে খুব একটা সাযুজ্য অনুভব করেন না, সেই সমস্ত মানুষদের মধ্যেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ঘিরে হিন্দুত্ববাদীদের ভূমিকা- সেটি এখন প্রায় দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে।
জাতীয় কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত বা বুর্জোয়া রাজনীতির বিভিন্ন ধারার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত , সেই সব মানুষদের একটা বড় অংশের কাছে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে আরএসএস যে কোনও ভাবেই অংশগ্রহণ করেনি- এই বিষয়টি এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য ।প্রতিটি দেশপ্রেমিক ভারতবাসীর কাছেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে আরএসএসের নেতিবাচক ভূমিকা এখন আর আলাদা করে জানবার বা জানানোর কোনও জায়গা নেই।
এইরকম একটা অবস্থায়, আরএসএস তাদের গোটা রাজনৈতিক পরিম-লের মধ্যে দিয়ে নিজেদের যে তথাকথিত দেশপ্রেম ঘিরে নানা ধরনের প্রচার চালায় , সেই প্রচার কার্যত এখন অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্নের মুখে পড়ছে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের নেতিবাচক অবস্থান ঘিরে নিজেদের মধ্যেই এখন প্রশানের মুখে সংঘ। তাই রাজনৈতিক হিন্দু ভারতের জিঘির তুলে আগামী লোকসভা নির্বাচনে (২০২৬) নিজেদের রাজনৈতিক সাফল্যকে ধরে রাখতে গেলে গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির কে এখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের পরাকাষ্ঠ হিসেবে দেখানো ছাড়া আরএসএস নেতৃত্বের কাছে অন্য কোনও গত্যন্তর নেই।
আপামর ভারতবাসীর কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্য করে তুলতে এখন তাই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রধান নায়ক হিসেবে সাভারকর , হেডগেওয়ার, গোলওয়ালকরের মত সংগঠনের তাত্ত্বিক ভিত্তির নির্মাতা বা প্রধান ব্যক্তিত্বদের তুলে ধরতে তৎপর হয়ে উঠেছে আরএসএস। তারা বুঝতে পারছে , যতই তারা নিজেদের সংগঠন বা সংগঠনের লোকেদের দেশপ্রেমিক হিসেবে দেখাতে চেষ্টা করুক না কেন , সাধারণ মানুষের কাছে ব্রিটিশ বিরোধী কর্মকা-ের সঙ্গে আর এস এসের সংযোগ ঘিরে ন্যূনতম বিশ্বাসযোগ্যতা সাধারণ মানুষের নিই। এমনকি যারা সংঘ ঘরানার কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত, তারাও কখনো কোনও অবস্থাতেই ব্রিটিশকে, ভারত থেকে বিতাড়িত করবার ক্ষেত্রে সংঘ বা হিন্দুত্ববাদী ভাবধারার লোকেদের কোনও ইতিবাচক অবদান ঘিরে বিশ্বাসী নয়।
কারণ প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে সংঘ তাদের এই প্রায় ১০০ বছরের পথ পরিক্রমার কালে যে তাত্ত্বিক মনভূমি নির্মাণের চেষ্টা করে গেছে, সেখানে কখনো কোনও অবস্থাতেই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা তো দূরের কথা। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে একটা শব্দও তাদের কর্মী সমর্থকদের কাছে তুলে ধরবার চেষ্টা করে তারা করে নি। বরংচ ব্রিটিশ শাসন যে ভারতবাসীর পক্ষে একটা ইতিবাচক ধ্যান ধারণা তৈরি করেছিল , ভারতের উন্নতি ঘটিয়েছিল -এটাকে মেলে ধরতেই আরএসএস গত ১০০ বছর ধরে যতœবান থেকেছে।
তার পাশাপাশি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের বিভিন্ন তরিকার যে নেতৃত্ব, তাদের সম্পর্কে কর্মী সমর্থকদের কাছে একটা অসত্য ধারণা তুলে ধরাই ছিল সংঘের আদর্শগত অবস্থান। কিন্তু তিন দফায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করবার পর, তাদের মূল মস্তিষ্ক আরএসএস এখন বুঝতে পারছে যে, উগ্র হিন্দুত্বের পাশা খেলা দিয়ে, হিন্দু- মুসলমানের বিভাজন ঘটিয়ে , নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা এখন আর আগের মতো সহজ নয়।
আগামী লোকসভা নির্বাচন যেটি ২০১৯ সালে ঘটতে চলেছে, সেখানে ভয়াবহ আকার ধারণ করবে তিন দফার মোদি সরকারের বিরুদ্ধে একটা প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা ।এই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা যে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে বিশেষ একটা সুবিধা করে উঠতে পারবে না -- এটা বুঝতে পেরেই কিন্তু সংঘের শতবর্ষ পালনকে উপলক্ষ করে দেশপ্রেমের নামে উগ্রতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সংঘ নেতৃত্ব -কর্মী -সমর্থকদের ইতিবাচক ভূমিকা এবং অবদানের এই অসত্য প্রচারে মেতেছে গোটা হিন্দুত্ববাদী শক্তি ।
[লেখক: ভারতীয়ী ইতিহাসবিদ]