শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
দীর্ঘ শতাব্দীর অগণিত লড়াই-সংগ্রামের ফসল বাংলার স্বাধীনতা। প্রতিটি লড়াই, সংগ্রাম ও আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বৈষম্য রোধ করা। বাংলা জনপদের হাজার বছরের সংগ্রামের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, প্রতিটি লড়াই ছিল অধিকার আদায়ের। এক রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলা জনপদ স্বাধীন হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশটিতে আজও বৈষম্য রোধ হয়নি। উপরন্তু দেখা যায়, জাতপাতের বৈষম্য এখন প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠছে।
স্বাধীন দেশের ১৯৭২ সালে রচিত সংবিধানে নাগরিকদের অধিকারগুলোর মধ্যে ছিলÑ ১. আইনের চোখে সকল নাগরিক সমান। ২. ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো বৈষম্য করা যাবে না। ৩. নারী ও পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়। ৪. সরকারি চাকরি বা নিয়োগের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের সমান সুযোগ থাকবে। ৫. প্রত্যেকের জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার রয়েছে। ৬. আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে। ৭. সংবিধানে গ্রেপ্তার ও আটকের ক্ষেত্রে কিছু রক্ষাকবচ প্রদান করা হয়। ৮. জবরদস্তিমূলক শ্রম থেকে নাগরিকদের রক্ষা করা হয়। ৯. বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়। ১০. নাগরিকদের সম্পত্তি ক্রয়, ধারণ, হস্তান্তর ও বিলি-ব্যবস্থা করার স্বাধীনতা প্রদান করা হয়। ১১. ধর্ম পালন এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করার অধিকার। ১২. আইনানুযায়ী সর্বজনীন, গণমুখী, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার অধিকার। ১৩. নাগরিকদের সমিতি বা সংঘ গঠনের অধিকার ছিল, যা জনশৃঙ্খলা বা নৈতিকতা-বিরোধী নয়।
১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের নাগরিকরা সমঅধিকার ভোগ করতে পারছে না। কারণ এর পর বারবার সংবিধানকে সংশোধন করে বৈষম্য ব্যবস্থাটাকে পুনর্বহাল করা হয়। আজও জাতপাত প্রথা অনুসারে সৃষ্টি হচ্ছে শ্রমবাজার। মেথর, মুচি, ধোপা, জেলে, নাপিতসহ নিম্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে বংশপরম্পরায় জাত-পেশার কাজটিই করতে হচ্ছে। এই সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রের অনেক সুযোগ-সুবিধা ও নিয়ম থেকে বঞ্চিত করা হয়। এই বর্ণ বা জন্মগত পেশার মানুষ নিজ জাতের পেশায় কাজ করলেও ন্যায্য মজুরি পায় না।
যেমনÑবংশানুক্রমিকভাবে চা-শ্রমিকরা হয়। বাংলাদেশের চা-শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা, যা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত। এই মজুরিতে বর্তমান মূল্যস্ফীতির বাজারে জীবনযাপন করা অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু তার কোনো প্রতিকার নেই। হাজার বছরের লড়াই-সংগ্রামের ফলে অর্জিত স্বাধীন দেশে এখনো জাতপাত বিচারের ভিত্তিতেই কাজ ও মজুরি নির্ধারণ করা হয়।
জাতপাত ব্যবস্থাটা কীভাবে এই জনপদে উৎপত্তি হলো, তা জানা দরকার। কারণ আর্যরা আসার আগে এই জনপদে কোনো জাতপাত প্রথা ছিল নাÑসকল নাগরিকের ছিল সমঅধিকার। জাত প্রথার উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন তত্ত্ব রয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত হলো বর্ণভিত্তিক তত্ত্ব ও পেশাভিত্তিক তত্ত্ব।
বর্ণভিত্তিক তত্ত্ব অনুসারে, এটি আর্যদের আগমনের সঙ্গে শুরু হয়েছিল এবং সমাজকে চারটি প্রধান বর্ণেÑব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রÑবিভক্ত করে, যার ভিত্তিতে পরবর্তীতে জাত গঠিত হয়। পেশাভিত্তিক তত্ত্ব অনুসারে, নির্দিষ্ট পেশা ও কাজের উপর ভিত্তি করে সমাজের বিভাজন তৈরি করা হয়, যা পরবর্তীতে বংশগত ও জন্মভিত্তিক হয়ে ওঠে। এই তত্ত্ব অনুসারে, বর্ণ (যার অর্থ ‘রং’) নামক একটি সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস থেকে জাত প্রথার উদ্ভব হয়েছে। যেহেতু অনার্যদের গাত্রবর্ণ ছিল শ্যাম, তাই তাদেরকে নিচু জাতের হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
এটি সমাজের মানুষকে চারটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করেÑব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র। প্রাচীন সমাজে বিভিন্ন পেশা ও কাজের ভিত্তিতে বিভাজন শুরু হয়। সময়ের সাথে সাথে এই পেশাভিত্তিক বিভাজনগুলো বংশগত ও কঠোর হয়ে ওঠে, এবং নির্দিষ্ট পেশার অধীনে থাকা গোষ্ঠীগুলো ‘জাত’ নামে পরিচিতি পায়। সৃষ্ট এই ব্যবস্থাকে ধর্মীয় প্রলেপে নিয়ে আসা হয়। কিছু কিছু ধর্মের ব্যাখ্যা অনুসারে, আল্লাহ, ঈশ্বর বা ব্রহ্মা এই প্রথা সৃষ্টি করেছেনÑধর্মগ্রন্থগুলোতে এর ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ শতক থেকে বর্ণ বা জাত প্রথা শুরু হয়। আর্য-অনার্য গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংগ্রাম ও আত্মীকরণের মধ্য দিয়ে এই ব্যবস্থাটি এগিয়ে চলে। ফলে এমন উদাহরণও পাওয়া যায়, যেখানে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিম্নবর্ণের সদস্য উচ্চবর্ণে উন্নীত হয়েছে, আবার তার উল্টোটাও ঘটেছে। তবে এই প্রথাকে দৃঢ় করার লক্ষ্যে জন্মের ভিত্তিতে পেশা নির্ধারণ করা হয়, তাছাড়া অসবর্ণ বিবাহও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এই ব্যবস্থাটি উচ্চবর্ণের (তৎকালীন সময়ের শোষকশ্রেণির) দিক থেকে চালু করা হয়েছিল। ব্যবস্থাটিকে দৃঢ় করতে শাসকশ্রেণী বিভিন্ন শাস্ত্র ও সংস্কৃতিতেও তার প্রকাশ ঘটায়। পরবর্তী সময়ে, বিশেষত চতুর্থ শতক থেকে যে জাতিবর্ণ ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে, সেটি সপ্তম শতক নাগাদ একটি কঠোর সামাজিক বিভাজনের রূপ নেয়।
জাতিবর্ণ ব্যবস্থায় বর্ণগুলিকে বিশেষত শূদ্রবর্ণকে পেশার ভিত্তিতে আবার বহু জাতিতে ভাগ করা হয়, যেমন কামার, কুমোর, তাঁতী, জেলে, গোয়ালা ইত্যাদি। এই ব্যবস্থার বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলি হলোÑ প্রতিটি জাতির জন্য পেশা নির্দিষ্ট; জাতির বাইরে বিয়ে নিষিদ্ধ; জাতি পরিচয় ঠিক হয় জন্ম দিয়ে।
এই প্রথা অনুসারে শূদ্রজাতি সমাজের নিচের স্তরে অবস্থান করে। তাছাড়া বিরাট জনসমষ্টি, যাদের অতিশূদ্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, সমাজে এদের স্থান থাকে প্রায় দাসের স্তরে। ধর্মীয় আইনে এরা কোনো সম্পত্তির মালিক হতে পারে না। এদের দায়িত্ব হলো গোটা গ্রামের সেবায় সবচেয়ে কষ্টকর কাজগুলি করা এবং একইসঙ্গে অস্পৃশ্য হিসেবে গ্রামের বাইরে বাস করা।
সাত থেকে আটশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাংলায় ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব ঘটে। এই সময় দেখা যায়, বহু নিম্নবর্ণের মানুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। তবে ইসলাম প্রচারকারীরাই শাসকশ্রেণী হয়ে যান, অপরদিকে নবদীক্ষিত মুসলমানরা আগের অবস্থাতেই থেকে যান। মুসলিম শাসকরাও আর্যদের ন্যায় বর্ণপ্রথা চালু রাখেন।
তাই জাতিবর্ণ ব্যবস্থার যে বিশেষ বৈশিষ্ট্যটা বিদ্যমান তা জানা দরকারÑএই সমাজে একজন কাপড় বোনে বলে তার পরিচয় তাঁতী নয়; সে তাঁতী এই কারণে যে সে তাঁতী জাতির ঘরে জন্ম নিয়েছে, এবং সেই জন্মের মধ্য দিয়েই তার পেশাও নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। এই ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ বা শাসকশ্রেণীর মুসলিম সন্তান বিদ্যাচর্চায় অনুৎসাহী হলেও সে ব্রাহ্মণ এবং উচ্চবংশীয় মুসলমান হয়ে থাকে। সে কখনই কৃষিকাজসহ শূদ্রদের বা দরিদ্র মুসলিমদের নির্দিষ্ট পেশায় অংশ নিতে পারবে না।
ব্যবস্থায় শূদ্র ও অতিশূদ্র জাতিগুলোর বিদ্যাচর্চার কোনো অধিকার ছিল না। নিম্ন জাতিবর্ণের মানুষের সঙ্গে উচ্চবর্ণের মানুষের জৈবিক (মস্তিষ্কের গঠনগত বা জিনগত) কোনো পার্থক্য নেই, তবু সামাজিক ধারণা তৈরি করা হয়েছে যে নিম্নবর্ণের মানুষের মেধা প্রকৃতিগতভাবেই কম।
এর কারণ, নিম্নবর্ণের মানুষকে দীর্ঘকাল ধরে শিক্ষা ও উন্নতির সব সুযোগ থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। এই বঞ্চনাকে যুক্তিসঙ্গত করতে ধর্ম, কর্মফলসহ নানা সংস্কারকে শক্তিশালী করা হয়েছে, ফলে নিম্নবর্ণের মানুষ জাতিভেদকে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়ম বলে মনে করেছে।
জাতিভেদ প্রথার অস্তিত্বের কারণে নিম্নবর্ণের মানুষ সামগ্রিক গণতান্ত্রিক লড়াইয়েও অংশ নিতে পারে না। তাদের নানা নিয়ম-কানুনের ফ্রেমে আটকে রেখে দমন করা হয়। বর্তমানে নিম্নবর্ণের মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি হচ্ছে। তাই তারা সামাজিক মর্যাদার জন্য সংগ্রামকে বিকশিত করার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু পূর্বের ন্যায় বর্তমানেও শাসকশ্রেণীভুক্তরা শোষিত নিম্নবর্ণের মানুষ যাতে লড়াই-সংগ্রাম করতে না পারে, তার জন্য গণতান্ত্রিক অনুশীলনের পথ বারবার বন্ধ করছে। স্বাধীনতার পর অনেকবার দেখা গেছে, অনেকগুলো একনায়ক স্বৈরাচারী সরকারের জন্ম হয়েছে। তাদের পতনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে শোষিত শ্রেণির মানুষগুলো। কিন্তু আন্দোলনের বিজয় অর্জনের পর তারা তাদের কাক্সিক্ষত ফল পায়নি।
২৪-এর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে একনায়ক হাসিনার সরকারের পতন হয়। এই পতনের পর সকল প্রকার বৈষম্য নিরোধের লক্ষ্যে ‘জাত বিলোপ জোট’ গঠিত হয়েছে। এই জোট কিছু দাবি জাতির সামনে তুলে ধরে, তা হলোÑ বৈষম্য বিলোপ কমিশন গঠন করা ও বৈষম্য বিলোপ আইন পাস করা; আদিবাসী, দলিত, হরিজন ও চা-শ্রমিকদের ভূমি-অধিকার নিশ্চিত করা; সকল পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও চা-শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ৮০০ টাকা নির্ধারণ করা; অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর তালিকা সংবিধানের তফসিলে যুক্ত করা; অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর ছাত্রছাত্রীদের জন্য ১০ কোটি টাকার বৃত্তির ব্যবস্থা করা এবং উচ্চশিক্ষা ও চাকরিতে তাদের জন্য ৬ শতাংশ আসন সংরক্ষণ করা; রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে জাতীয় সংসদে জনসংখ্যানুপাতিক আসন রাখা, এবং সকল স্থানীয় সরকারে একজন করে দলিত ও নিম্নবর্ণের জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধির আসন সংরক্ষণ করা।
জাতপাত বিলোপ করে শোষণ ও বৈষম্যহীন সমাজ গড়া এখন সময়ের দাবি। তাই এই দাবিগুলো যুক্তিযুক্তÑকারণ হাজার হাজার বছর ধরে নিম্নবর্ণের মানুষকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। ফলে তারা মূল ধারায় কখনো আসতে পারেনি। এই জনগোষ্ঠীকে মূল ধারায় আনতে হলে এই দাবিগুলো অবশ্যই পূরণ করা জরুরি।
সবারই মনে রাখা দরকারÑকোনো জনগোষ্ঠীকে পশ্চাৎপদ রেখে বৈষম্যহীন সমাজ গড়া সম্ভব নয়। তাছাড়া ২৪-এর আন্দোলনের মূল স্পিরিট হলো সকল প্রকার বৈষম্য দূর করা। তাই জাতপাত বিলোপ করাটা জরুরি।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: উন্নয়নকর্মী]
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
রোববার, ১২ অক্টোবর ২০২৫
দীর্ঘ শতাব্দীর অগণিত লড়াই-সংগ্রামের ফসল বাংলার স্বাধীনতা। প্রতিটি লড়াই, সংগ্রাম ও আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বৈষম্য রোধ করা। বাংলা জনপদের হাজার বছরের সংগ্রামের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, প্রতিটি লড়াই ছিল অধিকার আদায়ের। এক রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলা জনপদ স্বাধীন হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশটিতে আজও বৈষম্য রোধ হয়নি। উপরন্তু দেখা যায়, জাতপাতের বৈষম্য এখন প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠছে।
স্বাধীন দেশের ১৯৭২ সালে রচিত সংবিধানে নাগরিকদের অধিকারগুলোর মধ্যে ছিলÑ ১. আইনের চোখে সকল নাগরিক সমান। ২. ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো বৈষম্য করা যাবে না। ৩. নারী ও পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়। ৪. সরকারি চাকরি বা নিয়োগের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের সমান সুযোগ থাকবে। ৫. প্রত্যেকের জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার রয়েছে। ৬. আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে। ৭. সংবিধানে গ্রেপ্তার ও আটকের ক্ষেত্রে কিছু রক্ষাকবচ প্রদান করা হয়। ৮. জবরদস্তিমূলক শ্রম থেকে নাগরিকদের রক্ষা করা হয়। ৯. বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়। ১০. নাগরিকদের সম্পত্তি ক্রয়, ধারণ, হস্তান্তর ও বিলি-ব্যবস্থা করার স্বাধীনতা প্রদান করা হয়। ১১. ধর্ম পালন এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করার অধিকার। ১২. আইনানুযায়ী সর্বজনীন, গণমুখী, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার অধিকার। ১৩. নাগরিকদের সমিতি বা সংঘ গঠনের অধিকার ছিল, যা জনশৃঙ্খলা বা নৈতিকতা-বিরোধী নয়।
১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের নাগরিকরা সমঅধিকার ভোগ করতে পারছে না। কারণ এর পর বারবার সংবিধানকে সংশোধন করে বৈষম্য ব্যবস্থাটাকে পুনর্বহাল করা হয়। আজও জাতপাত প্রথা অনুসারে সৃষ্টি হচ্ছে শ্রমবাজার। মেথর, মুচি, ধোপা, জেলে, নাপিতসহ নিম্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে বংশপরম্পরায় জাত-পেশার কাজটিই করতে হচ্ছে। এই সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রের অনেক সুযোগ-সুবিধা ও নিয়ম থেকে বঞ্চিত করা হয়। এই বর্ণ বা জন্মগত পেশার মানুষ নিজ জাতের পেশায় কাজ করলেও ন্যায্য মজুরি পায় না।
যেমনÑবংশানুক্রমিকভাবে চা-শ্রমিকরা হয়। বাংলাদেশের চা-শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা, যা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত। এই মজুরিতে বর্তমান মূল্যস্ফীতির বাজারে জীবনযাপন করা অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু তার কোনো প্রতিকার নেই। হাজার বছরের লড়াই-সংগ্রামের ফলে অর্জিত স্বাধীন দেশে এখনো জাতপাত বিচারের ভিত্তিতেই কাজ ও মজুরি নির্ধারণ করা হয়।
জাতপাত ব্যবস্থাটা কীভাবে এই জনপদে উৎপত্তি হলো, তা জানা দরকার। কারণ আর্যরা আসার আগে এই জনপদে কোনো জাতপাত প্রথা ছিল নাÑসকল নাগরিকের ছিল সমঅধিকার। জাত প্রথার উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন তত্ত্ব রয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত হলো বর্ণভিত্তিক তত্ত্ব ও পেশাভিত্তিক তত্ত্ব।
বর্ণভিত্তিক তত্ত্ব অনুসারে, এটি আর্যদের আগমনের সঙ্গে শুরু হয়েছিল এবং সমাজকে চারটি প্রধান বর্ণেÑব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রÑবিভক্ত করে, যার ভিত্তিতে পরবর্তীতে জাত গঠিত হয়। পেশাভিত্তিক তত্ত্ব অনুসারে, নির্দিষ্ট পেশা ও কাজের উপর ভিত্তি করে সমাজের বিভাজন তৈরি করা হয়, যা পরবর্তীতে বংশগত ও জন্মভিত্তিক হয়ে ওঠে। এই তত্ত্ব অনুসারে, বর্ণ (যার অর্থ ‘রং’) নামক একটি সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস থেকে জাত প্রথার উদ্ভব হয়েছে। যেহেতু অনার্যদের গাত্রবর্ণ ছিল শ্যাম, তাই তাদেরকে নিচু জাতের হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
এটি সমাজের মানুষকে চারটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করেÑব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র। প্রাচীন সমাজে বিভিন্ন পেশা ও কাজের ভিত্তিতে বিভাজন শুরু হয়। সময়ের সাথে সাথে এই পেশাভিত্তিক বিভাজনগুলো বংশগত ও কঠোর হয়ে ওঠে, এবং নির্দিষ্ট পেশার অধীনে থাকা গোষ্ঠীগুলো ‘জাত’ নামে পরিচিতি পায়। সৃষ্ট এই ব্যবস্থাকে ধর্মীয় প্রলেপে নিয়ে আসা হয়। কিছু কিছু ধর্মের ব্যাখ্যা অনুসারে, আল্লাহ, ঈশ্বর বা ব্রহ্মা এই প্রথা সৃষ্টি করেছেনÑধর্মগ্রন্থগুলোতে এর ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ শতক থেকে বর্ণ বা জাত প্রথা শুরু হয়। আর্য-অনার্য গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংগ্রাম ও আত্মীকরণের মধ্য দিয়ে এই ব্যবস্থাটি এগিয়ে চলে। ফলে এমন উদাহরণও পাওয়া যায়, যেখানে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিম্নবর্ণের সদস্য উচ্চবর্ণে উন্নীত হয়েছে, আবার তার উল্টোটাও ঘটেছে। তবে এই প্রথাকে দৃঢ় করার লক্ষ্যে জন্মের ভিত্তিতে পেশা নির্ধারণ করা হয়, তাছাড়া অসবর্ণ বিবাহও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এই ব্যবস্থাটি উচ্চবর্ণের (তৎকালীন সময়ের শোষকশ্রেণির) দিক থেকে চালু করা হয়েছিল। ব্যবস্থাটিকে দৃঢ় করতে শাসকশ্রেণী বিভিন্ন শাস্ত্র ও সংস্কৃতিতেও তার প্রকাশ ঘটায়। পরবর্তী সময়ে, বিশেষত চতুর্থ শতক থেকে যে জাতিবর্ণ ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে, সেটি সপ্তম শতক নাগাদ একটি কঠোর সামাজিক বিভাজনের রূপ নেয়।
জাতিবর্ণ ব্যবস্থায় বর্ণগুলিকে বিশেষত শূদ্রবর্ণকে পেশার ভিত্তিতে আবার বহু জাতিতে ভাগ করা হয়, যেমন কামার, কুমোর, তাঁতী, জেলে, গোয়ালা ইত্যাদি। এই ব্যবস্থার বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলি হলোÑ প্রতিটি জাতির জন্য পেশা নির্দিষ্ট; জাতির বাইরে বিয়ে নিষিদ্ধ; জাতি পরিচয় ঠিক হয় জন্ম দিয়ে।
এই প্রথা অনুসারে শূদ্রজাতি সমাজের নিচের স্তরে অবস্থান করে। তাছাড়া বিরাট জনসমষ্টি, যাদের অতিশূদ্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, সমাজে এদের স্থান থাকে প্রায় দাসের স্তরে। ধর্মীয় আইনে এরা কোনো সম্পত্তির মালিক হতে পারে না। এদের দায়িত্ব হলো গোটা গ্রামের সেবায় সবচেয়ে কষ্টকর কাজগুলি করা এবং একইসঙ্গে অস্পৃশ্য হিসেবে গ্রামের বাইরে বাস করা।
সাত থেকে আটশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাংলায় ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব ঘটে। এই সময় দেখা যায়, বহু নিম্নবর্ণের মানুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। তবে ইসলাম প্রচারকারীরাই শাসকশ্রেণী হয়ে যান, অপরদিকে নবদীক্ষিত মুসলমানরা আগের অবস্থাতেই থেকে যান। মুসলিম শাসকরাও আর্যদের ন্যায় বর্ণপ্রথা চালু রাখেন।
তাই জাতিবর্ণ ব্যবস্থার যে বিশেষ বৈশিষ্ট্যটা বিদ্যমান তা জানা দরকারÑএই সমাজে একজন কাপড় বোনে বলে তার পরিচয় তাঁতী নয়; সে তাঁতী এই কারণে যে সে তাঁতী জাতির ঘরে জন্ম নিয়েছে, এবং সেই জন্মের মধ্য দিয়েই তার পেশাও নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। এই ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ বা শাসকশ্রেণীর মুসলিম সন্তান বিদ্যাচর্চায় অনুৎসাহী হলেও সে ব্রাহ্মণ এবং উচ্চবংশীয় মুসলমান হয়ে থাকে। সে কখনই কৃষিকাজসহ শূদ্রদের বা দরিদ্র মুসলিমদের নির্দিষ্ট পেশায় অংশ নিতে পারবে না।
ব্যবস্থায় শূদ্র ও অতিশূদ্র জাতিগুলোর বিদ্যাচর্চার কোনো অধিকার ছিল না। নিম্ন জাতিবর্ণের মানুষের সঙ্গে উচ্চবর্ণের মানুষের জৈবিক (মস্তিষ্কের গঠনগত বা জিনগত) কোনো পার্থক্য নেই, তবু সামাজিক ধারণা তৈরি করা হয়েছে যে নিম্নবর্ণের মানুষের মেধা প্রকৃতিগতভাবেই কম।
এর কারণ, নিম্নবর্ণের মানুষকে দীর্ঘকাল ধরে শিক্ষা ও উন্নতির সব সুযোগ থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। এই বঞ্চনাকে যুক্তিসঙ্গত করতে ধর্ম, কর্মফলসহ নানা সংস্কারকে শক্তিশালী করা হয়েছে, ফলে নিম্নবর্ণের মানুষ জাতিভেদকে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়ম বলে মনে করেছে।
জাতিভেদ প্রথার অস্তিত্বের কারণে নিম্নবর্ণের মানুষ সামগ্রিক গণতান্ত্রিক লড়াইয়েও অংশ নিতে পারে না। তাদের নানা নিয়ম-কানুনের ফ্রেমে আটকে রেখে দমন করা হয়। বর্তমানে নিম্নবর্ণের মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি হচ্ছে। তাই তারা সামাজিক মর্যাদার জন্য সংগ্রামকে বিকশিত করার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু পূর্বের ন্যায় বর্তমানেও শাসকশ্রেণীভুক্তরা শোষিত নিম্নবর্ণের মানুষ যাতে লড়াই-সংগ্রাম করতে না পারে, তার জন্য গণতান্ত্রিক অনুশীলনের পথ বারবার বন্ধ করছে। স্বাধীনতার পর অনেকবার দেখা গেছে, অনেকগুলো একনায়ক স্বৈরাচারী সরকারের জন্ম হয়েছে। তাদের পতনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে শোষিত শ্রেণির মানুষগুলো। কিন্তু আন্দোলনের বিজয় অর্জনের পর তারা তাদের কাক্সিক্ষত ফল পায়নি।
২৪-এর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে একনায়ক হাসিনার সরকারের পতন হয়। এই পতনের পর সকল প্রকার বৈষম্য নিরোধের লক্ষ্যে ‘জাত বিলোপ জোট’ গঠিত হয়েছে। এই জোট কিছু দাবি জাতির সামনে তুলে ধরে, তা হলোÑ বৈষম্য বিলোপ কমিশন গঠন করা ও বৈষম্য বিলোপ আইন পাস করা; আদিবাসী, দলিত, হরিজন ও চা-শ্রমিকদের ভূমি-অধিকার নিশ্চিত করা; সকল পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও চা-শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ৮০০ টাকা নির্ধারণ করা; অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর তালিকা সংবিধানের তফসিলে যুক্ত করা; অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর ছাত্রছাত্রীদের জন্য ১০ কোটি টাকার বৃত্তির ব্যবস্থা করা এবং উচ্চশিক্ষা ও চাকরিতে তাদের জন্য ৬ শতাংশ আসন সংরক্ষণ করা; রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে জাতীয় সংসদে জনসংখ্যানুপাতিক আসন রাখা, এবং সকল স্থানীয় সরকারে একজন করে দলিত ও নিম্নবর্ণের জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধির আসন সংরক্ষণ করা।
জাতপাত বিলোপ করে শোষণ ও বৈষম্যহীন সমাজ গড়া এখন সময়ের দাবি। তাই এই দাবিগুলো যুক্তিযুক্তÑকারণ হাজার হাজার বছর ধরে নিম্নবর্ণের মানুষকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। ফলে তারা মূল ধারায় কখনো আসতে পারেনি। এই জনগোষ্ঠীকে মূল ধারায় আনতে হলে এই দাবিগুলো অবশ্যই পূরণ করা জরুরি।
সবারই মনে রাখা দরকারÑকোনো জনগোষ্ঠীকে পশ্চাৎপদ রেখে বৈষম্যহীন সমাজ গড়া সম্ভব নয়। তাছাড়া ২৪-এর আন্দোলনের মূল স্পিরিট হলো সকল প্রকার বৈষম্য দূর করা। তাই জাতপাত বিলোপ করাটা জরুরি।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: উন্নয়নকর্মী]