মাহতাব হোসাইন মাজেদ
মানবসভ্যতার ইতিহাস প্রকৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। প্রকৃতি মানুষকে দিয়েছে জীবন, খাদ্য, পানি, বাতাস, আলো ও সৌন্দর্য। কিন্তু এই প্রকৃতি মাঝেমধ্যে রূপ নেয় ভয়াল চেহারায়Ñভূমিকম্প, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, অগ্নিকা-, খরা কিংবা মহামারিÑযা মানুষের জীবন, সম্পদ ও সভ্যতাকে বিপর্যস্ত করে তোলে। এসব দুর্যোগ পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব না হলেও, পরিকল্পিত প্রস্তুতি, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও জনসচেতনতা মানুষের ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমাতে পারে। এই প্রক্রিয়াকেই বলা হয় দুর্যোগ প্রশমন, অর্থাৎ দুর্যোগের ক্ষতি আগেভাগেই কমিয়ে আনা। এই বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিয়ে জাতিসংঘ ১৯৮৯ সালে ঘোষণা করে যে, প্রতিবছর ১৩ অক্টোবর বিশ্বজুড়ে পালিত হবে আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস। এর উদ্দেশ্য হলোÑদুর্যোগের ঝুঁকি কমানো, মানুষকে সচেতন করা এবং একটি স্থিতিশীল, নিরাপদ ও টেকসই সমাজ গড়ে তোলা।
দুর্যোগ প্রশমন মানে কী? ‘প্রশমন’ মানে হলো ক্ষতি কমানো বা প্রভাব হ্রাস করা। অর্থাৎ, দুর্যোগ ঘটার আগে এমন প্রস্তুতি নেওয়া, যাতে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি যতটা সম্ভব কম হয়। চরম বন্যা, খরা, ঝড় ও তাপপ্রবাহের কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। পাশাপাশি এসব দুর্যোগে প্রতি বছর ৬৩ লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়। তাই দুর্যোগ প্রশমন মানে শুধু ত্রাণ নয়; বরং দুর্যোগের আগে থেকেই বুদ্ধিদীপ্ত প্রস্তুতি, পরিকল্পনা ও দায়িত্বশীলতা।
এই দিবসের মূল উদ্দেশ্য হলো দুর্যোগের ঝুঁকি কমিয়ে একটি সহনশীল ও টেকসই সমাজ গড়ে তোলা। এর লক্ষ্য হচ্ছে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, ঝুঁকি কমাতে পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানো, টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি করা এবং মানবিক দায়বদ্ধতা ও পরিবেশ-সচেতনতা জোরদার করা। দিবসটির মূল বার্তা সহজÑ“দুর্যোগের পর নয়, আগে থেকেই প্রস্তুত হও।”
জাতিসংঘের হিসাবে, প্রতিবছর গড়ে প্রায় চার শতাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে। এসব ঘটনায় কোটি কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অনেকে প্রাণ ও জীবিকা হারায়। ২০০৪ সালের ভারত মহাসাগরের সুনামিতে প্রায় দুই লাখ ত্রিশ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়; ২০১০ সালের হাইতি ভূমিকম্পে প্রায় দুই লাখ মানুষ প্রাণ হারায়; ২০২৩ সালে তুরস্ক ও মরক্কোর ভূমিকম্পে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি ঘটে। এসব উদাহরণ প্রমাণ করে, আগাম সতর্কতা ও প্রস্তুতির ঘাটতি থাকলে দুর্যোগ কতটা ভয়াবহ হতে পারে।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ দেশ। প্রায় প্রতিবছর বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, ভূমিধস, খরা ইত্যাদি ঘটে। তবুও বাংলাদেশ আজ দুর্যোগ মোকাবিলায় সফলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সরকার গ্রহণ করেছে বিভিন্ন উদ্যোগÑদুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন (২০১২), জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতি (২০১৫), ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি), ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল প্রতিরক্ষা আধুনিকীকরণ, কমিউনিটি ভিত্তিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং উপকূলে ১৪ হাজারেরও বেশি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ। এসব পদক্ষেপের ফলে সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়Ñসিডর, আইলা বা মোখাÑসময় প্রাণহানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
দুর্যোগ প্রশমনে শিক্ষা ও সচেতনতা অপরিহার্য। বিদ্যালয় পর্যায় থেকেই শিক্ষার্থীদের শেখানো দরকারÑনিরাপদ আশ্রয় চিহ্নিত করা, প্রাথমিক চিকিৎসা শেখা, উদ্ধারকাজের কৌশল জানা। বাংলাদেশে বর্তমানে স্কুল নিরাপত্তা কর্মসূচি ও দুর্যোগ শিক্ষা ক্লাব চালু রয়েছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সচেতন ও সাহসী করে তুলছে। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও স্থানীয় সংগঠনগুলোও জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
আজকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তিনির্ভর। উপগ্রহ প্রযুক্তির মাধ্যমে আগাম সতর্কতা দেওয়া যায়, ড্রোন ব্যবহার করে দুর্গম এলাকায় ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব। মোবাইল বার্তার মাধ্যমে দ্রুত খবর পৌঁছে দেওয়া যায়, মানচিত্রভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা নির্ধারণ সহজ হয়েছে। এসব প্রযুক্তির কারণে দুর্যোগ মোকাবিলা এখন অনেক বেশি দ্রুত, নির্ভুল ও কার্যকর।
[লেখক: প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি]
মাহতাব হোসাইন মাজেদ
রোববার, ১২ অক্টোবর ২০২৫
মানবসভ্যতার ইতিহাস প্রকৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। প্রকৃতি মানুষকে দিয়েছে জীবন, খাদ্য, পানি, বাতাস, আলো ও সৌন্দর্য। কিন্তু এই প্রকৃতি মাঝেমধ্যে রূপ নেয় ভয়াল চেহারায়Ñভূমিকম্প, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, অগ্নিকা-, খরা কিংবা মহামারিÑযা মানুষের জীবন, সম্পদ ও সভ্যতাকে বিপর্যস্ত করে তোলে। এসব দুর্যোগ পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব না হলেও, পরিকল্পিত প্রস্তুতি, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও জনসচেতনতা মানুষের ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমাতে পারে। এই প্রক্রিয়াকেই বলা হয় দুর্যোগ প্রশমন, অর্থাৎ দুর্যোগের ক্ষতি আগেভাগেই কমিয়ে আনা। এই বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিয়ে জাতিসংঘ ১৯৮৯ সালে ঘোষণা করে যে, প্রতিবছর ১৩ অক্টোবর বিশ্বজুড়ে পালিত হবে আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস। এর উদ্দেশ্য হলোÑদুর্যোগের ঝুঁকি কমানো, মানুষকে সচেতন করা এবং একটি স্থিতিশীল, নিরাপদ ও টেকসই সমাজ গড়ে তোলা।
দুর্যোগ প্রশমন মানে কী? ‘প্রশমন’ মানে হলো ক্ষতি কমানো বা প্রভাব হ্রাস করা। অর্থাৎ, দুর্যোগ ঘটার আগে এমন প্রস্তুতি নেওয়া, যাতে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি যতটা সম্ভব কম হয়। চরম বন্যা, খরা, ঝড় ও তাপপ্রবাহের কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। পাশাপাশি এসব দুর্যোগে প্রতি বছর ৬৩ লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়। তাই দুর্যোগ প্রশমন মানে শুধু ত্রাণ নয়; বরং দুর্যোগের আগে থেকেই বুদ্ধিদীপ্ত প্রস্তুতি, পরিকল্পনা ও দায়িত্বশীলতা।
এই দিবসের মূল উদ্দেশ্য হলো দুর্যোগের ঝুঁকি কমিয়ে একটি সহনশীল ও টেকসই সমাজ গড়ে তোলা। এর লক্ষ্য হচ্ছে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, ঝুঁকি কমাতে পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানো, টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি করা এবং মানবিক দায়বদ্ধতা ও পরিবেশ-সচেতনতা জোরদার করা। দিবসটির মূল বার্তা সহজÑ“দুর্যোগের পর নয়, আগে থেকেই প্রস্তুত হও।”
জাতিসংঘের হিসাবে, প্রতিবছর গড়ে প্রায় চার শতাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে। এসব ঘটনায় কোটি কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অনেকে প্রাণ ও জীবিকা হারায়। ২০০৪ সালের ভারত মহাসাগরের সুনামিতে প্রায় দুই লাখ ত্রিশ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়; ২০১০ সালের হাইতি ভূমিকম্পে প্রায় দুই লাখ মানুষ প্রাণ হারায়; ২০২৩ সালে তুরস্ক ও মরক্কোর ভূমিকম্পে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি ঘটে। এসব উদাহরণ প্রমাণ করে, আগাম সতর্কতা ও প্রস্তুতির ঘাটতি থাকলে দুর্যোগ কতটা ভয়াবহ হতে পারে।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ দেশ। প্রায় প্রতিবছর বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, ভূমিধস, খরা ইত্যাদি ঘটে। তবুও বাংলাদেশ আজ দুর্যোগ মোকাবিলায় সফলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সরকার গ্রহণ করেছে বিভিন্ন উদ্যোগÑদুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন (২০১২), জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতি (২০১৫), ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি), ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল প্রতিরক্ষা আধুনিকীকরণ, কমিউনিটি ভিত্তিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং উপকূলে ১৪ হাজারেরও বেশি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ। এসব পদক্ষেপের ফলে সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়Ñসিডর, আইলা বা মোখাÑসময় প্রাণহানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
দুর্যোগ প্রশমনে শিক্ষা ও সচেতনতা অপরিহার্য। বিদ্যালয় পর্যায় থেকেই শিক্ষার্থীদের শেখানো দরকারÑনিরাপদ আশ্রয় চিহ্নিত করা, প্রাথমিক চিকিৎসা শেখা, উদ্ধারকাজের কৌশল জানা। বাংলাদেশে বর্তমানে স্কুল নিরাপত্তা কর্মসূচি ও দুর্যোগ শিক্ষা ক্লাব চালু রয়েছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সচেতন ও সাহসী করে তুলছে। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও স্থানীয় সংগঠনগুলোও জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
আজকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তিনির্ভর। উপগ্রহ প্রযুক্তির মাধ্যমে আগাম সতর্কতা দেওয়া যায়, ড্রোন ব্যবহার করে দুর্গম এলাকায় ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব। মোবাইল বার্তার মাধ্যমে দ্রুত খবর পৌঁছে দেওয়া যায়, মানচিত্রভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা নির্ধারণ সহজ হয়েছে। এসব প্রযুক্তির কারণে দুর্যোগ মোকাবিলা এখন অনেক বেশি দ্রুত, নির্ভুল ও কার্যকর।
[লেখক: প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি]