মতিউর রহমান
বাংলাদেশ যখন ক্রমবর্ধমান যুব বেকারত্বের সংকট মোকাবিলায় লড়াই করছে, তখন শ্রমবাজারে নতুন এক জটিল বাস্তবতা দৃশ্যমান হচ্ছেÑঅটোমেশন ও প্রযুক্তিগত রূপান্তর। আধুনিকায়নের পথে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদনশীলতা ও প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বাড়ালেও এর সঙ্গে সঙ্গে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক তাদের ঐতিহ্যগত কর্মক্ষেত্র থেকে ছিটকে পড়ছে। এই পরিবর্তন বৈশ্বিক বাস্তবতার অংশ হলেও বাংলাদেশের মতো শ্রমনির্ভর অর্থনীতিতে এর প্রভাব অনেক গভীর, কারণ এখানে কোটি কোটি মানুষ জীবিকার জন্য নির্ভর করে শ্রমঘন শিল্পের ওপর। ফলে অটোমেশন ও যুব কর্মসংস্থানের পারস্পরিক সম্পর্ক এখন দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে উঠেছে।
সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ৫৩.৮ লাখ চাকরি অটোমেশনের ঝুঁকিতে পড়তে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে রয়েছে তৈরি পোশাক (আরএমজি), আসবাবপত্র, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, পর্যটন ও চামড়া শিল্প। শুধু পোশাক খাতেই রোবটিক্স ও শ্রমসংরক্ষক প্রযুক্তির ব্যবহারে প্রায় ৬০ শতাংশ চাকরি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, যা প্রায় ২৭ লাখ শ্রমিকের জীবিকা হুমকির মুখে ফেলতে পারে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই খাতেই দেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি আসে এবং এতে কর্মরতদের একটি বড় অংশ নারী শ্রমিক। অটোমেশন যেমন উৎপাদন দক্ষতা বাড়াচ্ছে, তেমনি এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতামূলক সুবিধাÑসস্তা ও প্রচুর শ্রমশক্তির ওপর নির্ভরতাÑক্রমে ক্ষীণ করে দিচ্ছে।
অটোমেশনের এই প্রবণতা কয়েকটি বৈশ্বিক ও দেশীয় চাপে ত্বরান্বিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ক্রেতারা এখন দক্ষতা, স্থায়িত্ব ও নির্ভুলতাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন, ফলে স্থানীয় কারখানাগুলোকেও বাধ্য হয়ে আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ করতে হচ্ছে। মজুরি বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা এবং উৎপাদন ব্যয়ের চাপও উদ্যোক্তাদের স্বয়ংক্রিয় উৎপাদন ব্যবস্থায় বিনিয়োগে উৎসাহিত করছে। এর ফলে উৎপাদন বাড়লেও একই সঙ্গে হাজার হাজার শ্রমিকের কাজ হারানোর ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। চামড়া, আসবাব ও কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পেও ক্রমে যান্ত্রিক বাছাই, প্যাকেজিং ও কাটিং প্রযুক্তি ব্যবহারে মানুষের শ্রমের জায়গা সংকুচিত হচ্ছে।
তবে অটোমেশন শুধু কাজ হারানোর গল্প নয়; এটি নতুন ধরণের কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি করে, যদিও সেই সুযোগ পেতে হলে প্রয়োজন উচ্চ প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও অভিযোজন ক্ষমতা। ডিজিটাল ডিজাইন, মেশিন রক্ষণাবেক্ষণ, রোবট অপারেশন বা ডেটা বিশ্লেষণের মতো পেশাগুলোর জন্য প্রয়োজন ভিন্ন ধরণের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ। কিন্তু এখানেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঘাটতিÑআমাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা এখনও প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির চাহিদা মেটাতে সক্ষম নয়। একদিকে প্রযুক্তি দ্রুত বদলে যাচ্ছে, অন্যদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখনও তাত্ত্বিক পাঠদানে সীমাবদ্ধ। ফলে শিক্ষিত তরুণদের একটি বড় অংশ শ্রমবাজারে প্রবেশ করেও কাক্সিক্ষত দক্ষতা না থাকায় পিছিয়ে পড়ছে।
তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) খাত, যা তরুণ কর্মসংস্থানের অন্যতম সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হতে পারত, নিজেই এখন দক্ষ জনবলের তীব্র সংকটে ভুগছে। স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রোগ্রামিং, সাইবার নিরাপত্তা ও মধ্যস্তর ব্যবস্থাপনায় দক্ষ জনবলের অভাব মারাত্মক। এমনকি যারা তথ্যপ্রযুক্তিতে স্নাতক, তারাও প্রায়ই ব্যবহারিক জ্ঞানের অভাবে চাকরিতে টিকে থাকতে পারছেন না। কেবল প্রযুক্তিগত দক্ষতাই নয়, যোগাযোগ, দলগত কাজ, নেতৃত্ব ও উদ্ভাবনী চিন্তার অভাবও তরুণদের কর্মজীবনে অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। ফলস্বরূপ, অনেক বহুজাতিক কোম্পানি দেশে দক্ষ বিদেশি কর্মী নিয়োগ দিচ্ছে, অথচ হাজার হাজার স্থানীয় স্নাতক বেকার বা আংশিক বেকার অবস্থায় রয়ে যাচ্ছে।
এই দক্ষতার ঘাটতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে প্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকারের বৈষম্যের কারণে। গ্রামীণ ও অর্ধশহর অঞ্চলের শ্রমিকদের অনেকেরই আধুনিক যন্ত্রপাতি বা ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ নেই। ফলে পুনঃপ্রশিক্ষণ বা দক্ষতা রূপান্তরের সুযোগ না থাকলে অটোমেশন গ্রামীণ-শহুরে বৈষম্য আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। একইভাবে নারীরাÑবিশেষ করে পোশাক খাতের নিম্নদক্ষ শ্রমিকরাÑঅটোমেশনের ফলে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পড়েছেন। পুনঃপ্রশিক্ষণ, ডিজিটাল সাক্ষরতা, গুণগত নিয়ন্ত্রণ ও ডিজাইন দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নারীদের কর্মসংস্থানে ফিরিয়ে আনা সম্ভব, তবে এই উদ্যোগগুলোর পরিধি এখনো সীমিত।
আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রযুক্তি রূপান্তরের গতি ও নীতি প্রস্তুতির মধ্যে ব্যবধান। শিল্পখাত দ্রুত অটোমেশন গ্রহণ করলেও জাতীয় পর্যায়ে পুনঃপ্রশিক্ষণ, ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি ও কর্মসংস্থান স্থানান্তর বিষয়ে সমন্বিত নীতি কাঠামো এখনো তৈরি হয়নি। ফলস্বরূপ, শিল্পপতি ও শ্রমিক উভয়ই পরিবর্তনের পথে চলছেন দিকনির্দেশনা ছাড়া। এই রূপান্তর মোকাবিলায় বাংলাদেশকে দ্বৈত কৌশল অবলম্বন করতে হবেÑএকদিকে প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতার জন্য অটোমেশনকে গ্রহণ করা, অন্যদিকে এর সামাজিক প্রভাব প্রশমনের জন্য কর্মনীতি প্রণয়ন করা। এজন্য সরকারি সংস্থা, শিল্প সংগঠন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বিত সহযোগিতা অপরিহার্য।
প্রথমত, দেশে আজীবন শেখার ও অভিযোজনযোগ্য কর্মশক্তি গড়ে তোলার জন্য একটি জাতীয় কাঠামো প্রয়োজন। প্রাথমিক শিক্ষা থেকেই ডিজিটাল দক্ষতা অন্তর্ভুক্ত করা, কর্মজীবনে পুনঃদক্ষতা অর্জনের সুযোগ তৈরি করা এবং বেসরকারি খাতকে কর্মী প্রশিক্ষণে উৎসাহিত করা এখন জরুরি। ঝঊওচ মডেলটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ হলেও এটি আরও গতিশীল হতে হবে, যাতে প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাঠ্যক্রম হালনাগাদ করা যায়। অনলাইন লার্নিং, মাইক্রো সার্টিফিকেশন এবং পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাকে সবার নাগালের মধ্যে আনা যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, শিল্পনীতি ও প্রযুক্তিনীতির মধ্যে সমন্বয় স্থাপন করতে হবে। অটোমেশন কেবল উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য নয়, বরং উচ্চমূল্য সংযোজন ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির পথ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া উচিত। উদাহরণস্বরূপ, উৎপাদন প্রক্রিয়া আধুনিক হলে ডিজাইন, লজিস্টিকস, বিপণন, রক্ষণাবেক্ষণ ও ই-কমার্সে নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি হতে পারে। উদ্ভাবনী উদ্যোক্তাবৃত্তি, বিশেষ করে তরুণ উদ্যোক্তাদের উদ্যোগ, এই রূপান্তরকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে পারে। “স্টার্টআপ বাংলাদেশ” ও আইসিটি বিভাগের ইনোভেশন গ্রান্ট প্রোগ্রাম ইতিমধ্যে তরুণদের জন্য ডিজিটাল উদ্যোক্তাবৃত্তির নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে, যদিও এর সম্প্রসারণ ও কাঠামোগত সমর্থন আরও প্রয়োজন।
তৃতীয়ত, অটোমেশনের প্রভাবে যেন সামাজিক বৈষম্য না বাড়ে, সেজন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি অপরিহার্য। নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ, আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষা, এবং যে শিল্পগুলো অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে তাদের জন্য প্রণোদনা দেওয়া প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা দেখায় যে, অটোমেশনের ফলাফল নির্ভর করে মূলত নীতি ও প্রস্তুতির ওপর, প্রযুক্তির ওপর নয়। যে দেশগুলো প্রযুক্তি গ্রহণের পাশাপাশি শিক্ষা সংস্কার ও সামাজিক সুরক্ষা জোরদার করেছে, তারা সবচেয়ে সফলভাবে এই রূপান্তর সামলাতে পেরেছে।
সবশেষে, অটোমেশনকে ভয় নয়, বরং অনিবার্য বাস্তবতা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। বৈশ্বিক অর্থনীতি এখন স্মার্ট ম্যানুফ্যাকচারিং, সবুজ প্রযুক্তি ও ডিজিটাল সেবার যুগে প্রবেশ করছে। এই প্রবণতা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ও প্রতিযোগিতা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই প্রশ্ন হলো, অটোমেশন হবে কি হবে না, সেটি নয়; বরং কিভাবে অটোমেশনকে মানুষের জন্য কার্যকর ও ন্যায়সঙ্গতভাবে পরিচালিত করা যায়। শিক্ষা সংস্কার, শিল্পনীতি ও ডিজিটাল অবকাঠামোকে সমন্বিতভাবে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ অটোমেশনকে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিনে পরিণত করতে পারবে।
অতএব, অটোমেশন ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আগামী দুই দশকে বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের চিত্র আমূল বদলে দেবে। এই পরিবর্তনের সঠিক দিকনির্দেশনা নির্ভর করবে দেশের তরুণদের ওপর বিনিয়োগের মাত্রা কতটা মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয় তার ওপর। যদি বাংলাদেশ মানুষে বিনিয়োগ করতে পারে, দক্ষতা ও সৃজনশীলতাকে প্রযুক্তির সঙ্গে সমন্বিত করতে পারে, তবে এই রূপান্তর এক ভয় নয়, বরং এক সম্ভাবনা হয়ে উঠবেÑএকটি ন্যায়সঙ্গত, উৎপাদনশীল ও মানবকেন্দ্রিক ভবিষ্যতের সম্ভাবনা।
[লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]
মতিউর রহমান
সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫
বাংলাদেশ যখন ক্রমবর্ধমান যুব বেকারত্বের সংকট মোকাবিলায় লড়াই করছে, তখন শ্রমবাজারে নতুন এক জটিল বাস্তবতা দৃশ্যমান হচ্ছেÑঅটোমেশন ও প্রযুক্তিগত রূপান্তর। আধুনিকায়নের পথে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদনশীলতা ও প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বাড়ালেও এর সঙ্গে সঙ্গে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক তাদের ঐতিহ্যগত কর্মক্ষেত্র থেকে ছিটকে পড়ছে। এই পরিবর্তন বৈশ্বিক বাস্তবতার অংশ হলেও বাংলাদেশের মতো শ্রমনির্ভর অর্থনীতিতে এর প্রভাব অনেক গভীর, কারণ এখানে কোটি কোটি মানুষ জীবিকার জন্য নির্ভর করে শ্রমঘন শিল্পের ওপর। ফলে অটোমেশন ও যুব কর্মসংস্থানের পারস্পরিক সম্পর্ক এখন দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে উঠেছে।
সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ৫৩.৮ লাখ চাকরি অটোমেশনের ঝুঁকিতে পড়তে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে রয়েছে তৈরি পোশাক (আরএমজি), আসবাবপত্র, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, পর্যটন ও চামড়া শিল্প। শুধু পোশাক খাতেই রোবটিক্স ও শ্রমসংরক্ষক প্রযুক্তির ব্যবহারে প্রায় ৬০ শতাংশ চাকরি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, যা প্রায় ২৭ লাখ শ্রমিকের জীবিকা হুমকির মুখে ফেলতে পারে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই খাতেই দেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি আসে এবং এতে কর্মরতদের একটি বড় অংশ নারী শ্রমিক। অটোমেশন যেমন উৎপাদন দক্ষতা বাড়াচ্ছে, তেমনি এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতামূলক সুবিধাÑসস্তা ও প্রচুর শ্রমশক্তির ওপর নির্ভরতাÑক্রমে ক্ষীণ করে দিচ্ছে।
অটোমেশনের এই প্রবণতা কয়েকটি বৈশ্বিক ও দেশীয় চাপে ত্বরান্বিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ক্রেতারা এখন দক্ষতা, স্থায়িত্ব ও নির্ভুলতাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন, ফলে স্থানীয় কারখানাগুলোকেও বাধ্য হয়ে আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ করতে হচ্ছে। মজুরি বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা এবং উৎপাদন ব্যয়ের চাপও উদ্যোক্তাদের স্বয়ংক্রিয় উৎপাদন ব্যবস্থায় বিনিয়োগে উৎসাহিত করছে। এর ফলে উৎপাদন বাড়লেও একই সঙ্গে হাজার হাজার শ্রমিকের কাজ হারানোর ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। চামড়া, আসবাব ও কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পেও ক্রমে যান্ত্রিক বাছাই, প্যাকেজিং ও কাটিং প্রযুক্তি ব্যবহারে মানুষের শ্রমের জায়গা সংকুচিত হচ্ছে।
তবে অটোমেশন শুধু কাজ হারানোর গল্প নয়; এটি নতুন ধরণের কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি করে, যদিও সেই সুযোগ পেতে হলে প্রয়োজন উচ্চ প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও অভিযোজন ক্ষমতা। ডিজিটাল ডিজাইন, মেশিন রক্ষণাবেক্ষণ, রোবট অপারেশন বা ডেটা বিশ্লেষণের মতো পেশাগুলোর জন্য প্রয়োজন ভিন্ন ধরণের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ। কিন্তু এখানেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঘাটতিÑআমাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা এখনও প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির চাহিদা মেটাতে সক্ষম নয়। একদিকে প্রযুক্তি দ্রুত বদলে যাচ্ছে, অন্যদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখনও তাত্ত্বিক পাঠদানে সীমাবদ্ধ। ফলে শিক্ষিত তরুণদের একটি বড় অংশ শ্রমবাজারে প্রবেশ করেও কাক্সিক্ষত দক্ষতা না থাকায় পিছিয়ে পড়ছে।
তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) খাত, যা তরুণ কর্মসংস্থানের অন্যতম সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হতে পারত, নিজেই এখন দক্ষ জনবলের তীব্র সংকটে ভুগছে। স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রোগ্রামিং, সাইবার নিরাপত্তা ও মধ্যস্তর ব্যবস্থাপনায় দক্ষ জনবলের অভাব মারাত্মক। এমনকি যারা তথ্যপ্রযুক্তিতে স্নাতক, তারাও প্রায়ই ব্যবহারিক জ্ঞানের অভাবে চাকরিতে টিকে থাকতে পারছেন না। কেবল প্রযুক্তিগত দক্ষতাই নয়, যোগাযোগ, দলগত কাজ, নেতৃত্ব ও উদ্ভাবনী চিন্তার অভাবও তরুণদের কর্মজীবনে অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। ফলস্বরূপ, অনেক বহুজাতিক কোম্পানি দেশে দক্ষ বিদেশি কর্মী নিয়োগ দিচ্ছে, অথচ হাজার হাজার স্থানীয় স্নাতক বেকার বা আংশিক বেকার অবস্থায় রয়ে যাচ্ছে।
এই দক্ষতার ঘাটতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে প্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকারের বৈষম্যের কারণে। গ্রামীণ ও অর্ধশহর অঞ্চলের শ্রমিকদের অনেকেরই আধুনিক যন্ত্রপাতি বা ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ নেই। ফলে পুনঃপ্রশিক্ষণ বা দক্ষতা রূপান্তরের সুযোগ না থাকলে অটোমেশন গ্রামীণ-শহুরে বৈষম্য আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। একইভাবে নারীরাÑবিশেষ করে পোশাক খাতের নিম্নদক্ষ শ্রমিকরাÑঅটোমেশনের ফলে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পড়েছেন। পুনঃপ্রশিক্ষণ, ডিজিটাল সাক্ষরতা, গুণগত নিয়ন্ত্রণ ও ডিজাইন দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নারীদের কর্মসংস্থানে ফিরিয়ে আনা সম্ভব, তবে এই উদ্যোগগুলোর পরিধি এখনো সীমিত।
আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রযুক্তি রূপান্তরের গতি ও নীতি প্রস্তুতির মধ্যে ব্যবধান। শিল্পখাত দ্রুত অটোমেশন গ্রহণ করলেও জাতীয় পর্যায়ে পুনঃপ্রশিক্ষণ, ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি ও কর্মসংস্থান স্থানান্তর বিষয়ে সমন্বিত নীতি কাঠামো এখনো তৈরি হয়নি। ফলস্বরূপ, শিল্পপতি ও শ্রমিক উভয়ই পরিবর্তনের পথে চলছেন দিকনির্দেশনা ছাড়া। এই রূপান্তর মোকাবিলায় বাংলাদেশকে দ্বৈত কৌশল অবলম্বন করতে হবেÑএকদিকে প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতার জন্য অটোমেশনকে গ্রহণ করা, অন্যদিকে এর সামাজিক প্রভাব প্রশমনের জন্য কর্মনীতি প্রণয়ন করা। এজন্য সরকারি সংস্থা, শিল্প সংগঠন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বিত সহযোগিতা অপরিহার্য।
প্রথমত, দেশে আজীবন শেখার ও অভিযোজনযোগ্য কর্মশক্তি গড়ে তোলার জন্য একটি জাতীয় কাঠামো প্রয়োজন। প্রাথমিক শিক্ষা থেকেই ডিজিটাল দক্ষতা অন্তর্ভুক্ত করা, কর্মজীবনে পুনঃদক্ষতা অর্জনের সুযোগ তৈরি করা এবং বেসরকারি খাতকে কর্মী প্রশিক্ষণে উৎসাহিত করা এখন জরুরি। ঝঊওচ মডেলটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ হলেও এটি আরও গতিশীল হতে হবে, যাতে প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাঠ্যক্রম হালনাগাদ করা যায়। অনলাইন লার্নিং, মাইক্রো সার্টিফিকেশন এবং পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাকে সবার নাগালের মধ্যে আনা যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, শিল্পনীতি ও প্রযুক্তিনীতির মধ্যে সমন্বয় স্থাপন করতে হবে। অটোমেশন কেবল উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য নয়, বরং উচ্চমূল্য সংযোজন ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির পথ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া উচিত। উদাহরণস্বরূপ, উৎপাদন প্রক্রিয়া আধুনিক হলে ডিজাইন, লজিস্টিকস, বিপণন, রক্ষণাবেক্ষণ ও ই-কমার্সে নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি হতে পারে। উদ্ভাবনী উদ্যোক্তাবৃত্তি, বিশেষ করে তরুণ উদ্যোক্তাদের উদ্যোগ, এই রূপান্তরকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে পারে। “স্টার্টআপ বাংলাদেশ” ও আইসিটি বিভাগের ইনোভেশন গ্রান্ট প্রোগ্রাম ইতিমধ্যে তরুণদের জন্য ডিজিটাল উদ্যোক্তাবৃত্তির নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে, যদিও এর সম্প্রসারণ ও কাঠামোগত সমর্থন আরও প্রয়োজন।
তৃতীয়ত, অটোমেশনের প্রভাবে যেন সামাজিক বৈষম্য না বাড়ে, সেজন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি অপরিহার্য। নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ, আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষা, এবং যে শিল্পগুলো অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে তাদের জন্য প্রণোদনা দেওয়া প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা দেখায় যে, অটোমেশনের ফলাফল নির্ভর করে মূলত নীতি ও প্রস্তুতির ওপর, প্রযুক্তির ওপর নয়। যে দেশগুলো প্রযুক্তি গ্রহণের পাশাপাশি শিক্ষা সংস্কার ও সামাজিক সুরক্ষা জোরদার করেছে, তারা সবচেয়ে সফলভাবে এই রূপান্তর সামলাতে পেরেছে।
সবশেষে, অটোমেশনকে ভয় নয়, বরং অনিবার্য বাস্তবতা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। বৈশ্বিক অর্থনীতি এখন স্মার্ট ম্যানুফ্যাকচারিং, সবুজ প্রযুক্তি ও ডিজিটাল সেবার যুগে প্রবেশ করছে। এই প্রবণতা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ও প্রতিযোগিতা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই প্রশ্ন হলো, অটোমেশন হবে কি হবে না, সেটি নয়; বরং কিভাবে অটোমেশনকে মানুষের জন্য কার্যকর ও ন্যায়সঙ্গতভাবে পরিচালিত করা যায়। শিক্ষা সংস্কার, শিল্পনীতি ও ডিজিটাল অবকাঠামোকে সমন্বিতভাবে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ অটোমেশনকে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিনে পরিণত করতে পারবে।
অতএব, অটোমেশন ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আগামী দুই দশকে বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের চিত্র আমূল বদলে দেবে। এই পরিবর্তনের সঠিক দিকনির্দেশনা নির্ভর করবে দেশের তরুণদের ওপর বিনিয়োগের মাত্রা কতটা মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয় তার ওপর। যদি বাংলাদেশ মানুষে বিনিয়োগ করতে পারে, দক্ষতা ও সৃজনশীলতাকে প্রযুক্তির সঙ্গে সমন্বিত করতে পারে, তবে এই রূপান্তর এক ভয় নয়, বরং এক সম্ভাবনা হয়ে উঠবেÑএকটি ন্যায়সঙ্গত, উৎপাদনশীল ও মানবকেন্দ্রিক ভবিষ্যতের সম্ভাবনা।
[লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]