alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

এবার আমরা সভ্য হলাম!

আনোয়ারুল হক

: রোববার, ২৬ অক্টোবর ২০২৫

শৈশব কালে আমরা পড়েছি- অনেক অনেকদিন আগের কথা। তখন আরব দেশের লোকেরা বর্বর ছিলো। কেনো বর্বর ছিলো? এই সময়ে আরবে কোনো ঐশী বাণী বা ধর্মগ্রন্থ ছিল না, যার কারণে সমাজ ছিল নানা কুসংস্কার, অনাচার, অন্যায়, বিশৃঙ্খলা ও গোত্রে গোত্রে সংঘাতপূর্ণ। কৈশোর কালে ইসলামের ইতিহাস বইয়ে এ বিষয়ে আরো বিস্তৃত আমরা জেনেছি। পাঠকদেরও তা অজানা নয়।

গত ১৭ অক্টোবর জানলাম আমরা বাংলাদেশীরা এতকাল যাবত বর্বর ছিলাম। কোনো আইনকানুন বা সনদ ছিলো না। যা ইচ্ছা তা-ই করা যেতো। এখন আমরা সভ?্যতায় আসলাম। কেমনে আসলাম? এখন আমরা সনদ পেলাম, দেশ পরিচালনার গ্রন্থ পেলাম যা নিয়ে আদালতে কখনও কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবে না। এভাবে আমরা সবাই সভ?্য হলাম। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং সাদা চামড়ার বৃটিশরাও আমাদেরকে একদফা সভ্য বানাতে প্রায় দু’শো বছর যাবত যারপরনাই কোশেস করেও ব্যর্থ হয়ে বিদায় নিলো। তারপর ২৫ বছর যাবত পাকিস্তানের উর্দিপরা শাসকরা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ভুলিয়ে দিয়ে পাকিস্তানি ঈমান-আকিদায় সভ্য বানানোর জন্য ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যা এবং এক কোটি মানুষকে দেশ ছাড়া করেও ব্যর্থ হল। তবে এবার আমরা সভ্য হলাম!

শুধু বাদ থাকলেন সনদ রচনা কমিটির সভাপতিকে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় ‘নিয়োগ’ করেছিলেন সেই নিয়োগকর্তারা। তারা খুবই গোস্বা করেছেন তাদের ঐসব মিত্র শক্তির উপরে যারা এই দেশের জন্মেরবিরোধী হলেও তাদেরকে জুলাই আন্দোলনের সময়ে তারা বুকে টেনে নিয়েছিলেন। রাষ্ট্র ক্ষমতায় অংশীদারিত্বের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। নিজেদের ছাত্র সংগঠনের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে সবকটি বিশ্ববিদ?্যালয়ে যাদেরকে জয়ের মুকুট পরার মতো পরিস্থিতি ও সুযোগ করে দিলেন। অথচ ‘স্বাক্ষর না করে একযোগে আরো দরকষাকষি’ করার কথা দিয়েও তারা কথা রাখলেন না। তাই এখন তাদেরকে প্রতারক, মোনাফেক ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করছেন। অন?্যদিকে দেশের জন্মযুদ্ধের বিরোধী শক্তির নেতারা বলছেন ‘জন্ম নিয়েই বাপের সাথে পাল্লা দিয়ো না’।

জামাত এনসিপির সম্পর্ক যে বাপ-বেটার তা সবাই ধারনা করলেও এবার জামায়াত সেক্রেটারি সেটা ঘোষণা দিয়ে জানান দেওয়ায় আমরা বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হলাম। কিন্তু ‘বেটা’ আরিফুল ইসলাম আদীব দাবী করছেন ‘রাজনীতিতে কারও বাপ হইতে চাওয়া এক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিগত সমস্যা। বিপদের সময় অন্যের কমান্ডিংয়ে কাজ করে, বিপদ কেটে যাওয়ার পর কমান্ডারের ওপর এখন নিজেদের কমান্ডার দাবি করা (বাপগিরি করা) এক ধরনের রাজনৈতিক বালখিল্যতা বা অসদাচরণ’। আর এক ‘বেটা’ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, ‘জামায়াতের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তাদের রাজনৈতিক দর্শন ও অতীত আচরণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মানচিত্র ও জাতীয় চেতনার পরিপন্থি। এই দেশকে আর অন্ধকারে ফেরানো যাবে না।’

এখন দেখা যাক ‘আদর্শিক বাবার’ সংগে ‘সন্তানদের’ বিরোধ কিভাবে নিষ্পত্তি হয়। আর ‘সন্তানেরা’ তাদের নিয়োগকৃত সরকার প্রধানকে বলেছেন, যে সনদ ও গ্রন্থ রচিত হলো তা কার্যকর কিভাবে হবে সে বিষয়ে তাদের আশ্বস্ত করা হলে তারাও স্বাক্ষর করবেন, সভ?্য হবেন। কেন বর্বর থাকবেন? রাজনীতির কারবারিদের ধারণা, ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে হিস?্যা নিয়েই মূলত ‘বাপ-বেটার’ বিরোধ। সংসারে এমন বিরোধ হয় আবার মিটেও যায়।

এদিকে মূল সনদবিহীন শুধুমাত্র স্বাক্ষরের পাতায় স্বাক্ষর করে আসার দু’দিন পরেই বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা সাইফুল হক সাংবাদিক সম্মেলন করে ঘোষণা করেছেন, জুলাই সনদে যেসব প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে, সেগুলো নিয়েই কেবল গণভোট আয়োজন করতে হবে। অন্য কোনো বিতর্কিত ইস্যু গণভোটে তোলা যাবে না এবং গণভোট আইনসভা নির্বাচনের পূর্বে নয়। সনদ ঘোষণার দিন রাতে একটি দৈনিক পত্রিকার অনলাইন সংবাদে পূর্ণ সনদ দেখলাম লালে লাল। অর্থাৎ নোট অব ডিসেন্ট বা দ্বিমতগুলো লাল অক্ষরে লেখা হয়েছে এবং সেগুলোই বেশি চোখে পড়ছে। হঠাৎ দেখে বুঝা মুশকিল ঐকমত্য না বিভাজন। সাইফুল হক আরো বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার চরিত্রের দিক দিয়ে দল নিরপেক্ষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও গত ১৪ মাসে তাদের আচরণে দলনিরপেক্ষতা ছিল না। তারা পুরোপুরিভাবে পক্ষপাতদুষ্টতায় কাজ করে চলছে। সরকার যদি অচল ও একতরফা নির্বাচনের পথে যায়, তাহলে তা দেশের জন্য ভয়াবহ হবে।’

কমিউনিস্ট নেতা সাইফুল হক যে জোটে আছেন সে জোট অর্থাৎ গণতন্ত্র মঞ্চের সাথে অন্তর্বর্তী সরকার ও একই সাথে বিএনপির ঘনিষ্ঠতা আছে বলে প্রতীয়মান হয়। তাই তার এ বক্তব?্য গুরুত্ব বহন করে। এখন জামায়াত, এনসিপি, বিএনপি এবং গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা, সেফ এক্সিট এবং সনদ, গণভোট ইত্যাদি নিয়ে এবং জামায়াত-এনসিপি একে অপরের বিরুদ্ধে যেসমস্ত কথাবার্তা বলছেন তাতে কি কোনো জাতীয় ঐকে?্যর সুর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে? নির্বাচনের দোরগোড়ায় এসে ভবিষ্যৎ ক্ষমতার টানাটানিতে সব কিছু কি জট পাকিয়ে যাচ্ছে? জট পাকলে খোলার লোক আছে। দেশ বিদেশে আমাদের বন্ধুর অভাব নেই! লেখার বিষয়বস্তু এ সব বিষয় নিয়ে নয়।

লেখার মূল বিষয় হ’ল জাতি হিসেবে আমরা কতটা বর্বর ছিলাম। না, আমরা বর্বর ছিলাম না। ছিলাম না বলেই এক যুগ যাবত জবরদস্তিমূলক ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা সরকারের শাসনে থাকায় অভ?্যস্ত হয়ে যাওয়ার পরেও জুলাই হত?্যকা-ের বর্বরতার বিরুদ্ধে মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে। জবরদস্তি ক্ষমতা আঁকড়ে রাখা সরকারকে বিদায় করে ছেড়েছে। আবার গণঅভ্যুত্থান বিজয়ী হওয়ার পরে এবং পুলিশ বাহিনী পশ্চাদাপসারন বা অনেকটা আত্মসমর্পণ করার পরে হুকুমদাতারা পালিয়ে যেতে পারলেও ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে দেশজুড়ে অসংখ্য থানায় অসংখ্য পুলিশ কনস্টেবলকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে - যাদের সন্তানও হয়তোবা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মিছিলে ছিলো। এটাকেও বর্বরতা নাইবা বললাম। পুলিশের নির্বিচার গুলি বর্ষণে যে হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছিলো তাতে ক্রোধে উন্মত্ত জনতা বিচার-বিবেচনাহীন এমন ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে। মহলবিশেষ এক্ষেত্রে উস্কানিও দিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু বর্বরতা বলা যেতে পারে এ ঘটনায় রাষ্ট্রের সীমাহীন ঔদাসিন্যকে। তৎকালীন ক্ষমতাসীনগোষ্ঠীর যে কোনো পন্থায় ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার যে নীতি, তার বলি হলেন পুলিশ বাহিনীর এই সদস্যরা। তৎকালীন শাসকদের বর্বরতাকে পরাজিত করতে পেরেও নিহত এই পুলিশদের এবং তাদের পরিবারের প্রতি ঔদাসিন?্য দেখিয়ে রাষ্ট্র বর্বরোচিত আচরণের স্বাক্ষর রাখলো। আজ থেকে সভ?্য হয়ে গেলাম বললেই সব অন্ধকার দূর হয়ে যায় না।

ইউনূস তার ভাষণে বললেন জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে গত ১৬ বছরের নৃশংসতার অবসান ঘটবে। তার আগের নৃশংসতাগুলো কি তাহলে জায়েজ ছিলো? যদিও স্বাধীনতাউত্তর সরকারের অভ?্যন্তরে কতৃত্ববাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিল তারপরেও স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা, মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ জাতীয় চার নেতাকে জেলখানার অভ্যন্তরে হত্যা করা কি বর্বরতা না সভ্যতা ছিলো? মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখসমরে পা হারানো যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল আবু তাহের, বীর উত্তমকে এক প্রহসনের সামরিক আদালতের রায়ে ১৯৭৬ সনে ফাঁসি দেওয়াকে বা ৭৫ পরবর্তীতে সামরিক শাসন আমলে হাজার হাজার সামরিক অফিসারকে হত?্যা, মৃত?্যুদ- ও গুম বা নিখোঁজ করাকে কি নৃশংসতা বলা যাবে? ১৯৭৭ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরÑশুধুমাত্র এই দুই মাসে ১ হাজার ১৪৩ জন সামরিক সদস্যকে সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতের প্রহসনের রায়ে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়েছিলো বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। নৃশংসতার কাহিনী রাজনীতিকরা তাদের সুবিধামতো এতকাল একতরফাভাবে বর্ণনা করেছেন। ইউনূসও কি রাজনীতিবিদ হয়ে গেলেন?

এ দেশে সব থেকে বর্বর গণহত্যা সংগঠিত হয়েছিলো পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও তার দোসর রাজাকার-আলবদর কর্তৃক। সেই গণহত্যাকারীদের দোসরদের পাশে রেখে প্রধান উপদেষ্টা যখন বলেন সভ?্যতায় ফিরে এলাম Ñ কেমন যেন মানায় না। এই তো ক’দিন আগে অন্তর্বর্তী সরকার মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় পরিবর্তন করে যে অধ্যাদেশ জারি করেন সেখানেও ‘মুক্তিযুদ্ধ’ অর্থ বলতে বলা হয়েছে, “১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষায় হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধ।” অর্থাৎ এই সরকারের জারীকৃত অধ?্যাদেশেই বলা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের অর্থ “... জামায়াত ইসলামী’র বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধ”। আজ যতই তারা সুসংগঠিত এবং অর্থবিত্তে প্রতাপশালী হোক তাতে দলের অপরাধ নাকচ হয়ে যায় না। অন্তর্বর্তী সরকারের মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞা অনুযায়ী জামায়াত এবং বাংলাদেশের মানুষের সম্পর্ক হচ্ছে যুদ্ধের ময়দানে প্রতিপক্ষের সম্পর্ক। ওরা আমাদের শক্র শিবিরের দোসর ও গণহত্যার সহায়তাকারী দল। এনসিপির গুঁতো খাওয়ার পরে এখন জামায়াত আমীর যুক্তরাষ্ট্রে যেয়ে নাটকের স্ক্রিপ্ট পড়ছেন, আমরা যদি কাউকে কখনও কষ্ট দিয়ে থাকি আমাদের ক্ষমা করে দেবেন। এ যেন প্রেমিক প্রেমিকার অভিমান ভাঙানোর প্রয়াস! ভুল আর ফৌজদারি (গণহত্যার) অপরাধ এক হয় নাকি? জাতির সাথে তারা মস্করা করছেন।

সময়ের দূরত্ব দৃশ্যকে হয়তো আড়াল করে, দৃশ?্য তখন দৃষ্টির বাইরে চলে যায়। তার মানে দৃশ্যের অস্তিত্ব শেষ হয়ে যায় না। জামায়াতের অপরাধের অস্তিত্বও শেষ হয়ে যায়নি। তাই দল হিসাবে সেই জামায়াত ইসলামের বিচার না করে তাদের পাশে নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে বলে ফেললাম, আমরা সভ?্য হয়ে গেলাম। তাতেই সভ?্য হয়ে গেলাম! আর যদি বলেন পূর্ববর্তী রাজনৈতিক সরকারসমূহ এ সব জঞ্জাল রেখে গেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব এ সব বিষয় নিষ্পত্তি করা নয়, দায়িত্ব শুধু এই অন্তর্বর্তী অবস্থা থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণ তাহলে সংস্কার, সভ?্যতা এ সব বুলি বাদ দিয়ে, দেশের ইতিহাসের বয়ান রচনা বাদ দিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করে বাংলাদেশের মানুষকেই ব?্যালটের মাধ্যমে তাদের ভাগ্য নির্ধারণের সুযোগ দিন। আসলে আপনাদের দায়িত্ব ওতটুকুই ছিলো। বাকিটুকু নির্বাচিত সংসদের।

স্বল্প সময়ের অন্তর্বর্তী দায়িত্বের বিপরীতে দীর্ঘ সময় থাকার কারণ সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে ফুটে উঠেছে। দেশের মানুষ যে আর্থিক সংকটে আছে, বিনিয়োগ ব্যবসা-বাণিজ্য থমকে আছে, দারিদ্র?্য আর বেকারত্ব বাড়ছে, রাস্তার ফুটপাথে ছিন্নমূল মানুষের ভিড় বাড়ছে সেসব বিষয়ে কোনো কথা নেই। ছাত্রসমাজ এখনও শিক্ষায় মনোযোগী হতে পারছেন না (এইচএস.স পরীক্ষা ফলাফল তার বড় প্রমাণ), শিক্ষকরা রাস্তায় - তা নিয়ে মাথা ব?্যথা নেই, কথা নেই। সনদে নারী, সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের আশার আলো না থাকলেও তিনি তার বক্তব্যে অন্তত তাদেরকে আশ্বস্ত করতে পারতেন। না, তা তিনি করলেন না। তার কথা একটাই, সারা বিশ্ব নাকি একসময় আমাদের অনুসরণ করবে। কীভাবে? আমাদের সমুদ্র এলাকা, সমুদ্র বন্দর বিদেশীদের হাতে তুলে দিলে অর্থনীতিতে দুধের নহর বয়ে যাবে। আর (ভারতের মোড়লগিরি বন্ধ করতে) সেভেন সিস্টারকে আমাদের বন্দরের সাথে যুক্ত করার বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। একটি অন্তর্বর্তী এবং অনির্বাচিত সরকারের কি এমন ঠেকা পড়লো যে দেশের বন্দর বিদেশীদের হাতে তুলে দিতে হবে! তার এসব কথায় বুঝা যায়, যে বিশ্ব মোড়লের পাল্লায় দেশ পড়েছে তার থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে উঠছে।

অথচ জুলাই আন্দোলনের মধ?্য দিয়ে মুক্তির যে আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছিলো, ‘৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয়ের সময়টা ছাড়া তেমনটা এর আগে এতা হয়নি। এরপর ১৫ মাসে তো ‘১৬ বছরের নৃশংস স্বৈরাচার ছিলো না। কেবল বাপ-বেটারা ছিলো। আর ছিলো শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার! তারপরেও কেনো অন্ধকার আমাদের স্বপ্ন আর আলোকে ঢেকে ফেলছে? সভ্যতা আর কত দূর!

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

[লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা]

জমি কী মূলে রেকর্ড হয়েছে, দলিল মূলে না উত্তরাধিকার মূলে?

কার্বন-নিরপেক্ষ শিশুর অনুপ্রেরণায় দেশ

সোনার প্রাসাদের দেয়ালে ঘামের দাগ

নিরাপদ সড়ক চাই কিন্তু কার্যকর উদ্যোগ কোথায়?

অবহেলিত শিক্ষার দুর্দশা বাড়ছে

টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত নিরাপদ সড়ক

বাংলার সংস্কৃতি কি মূলধারা হারিয়ে ফেলবে?

ছবি

সমদৃষ্টি, বহুত্ববাদী সমাজ এবং সহিষ্ণুতা

খাদ্য অপচয় : ক্ষুধার্ত পৃথিবীর এক নিঃশব্দ ট্র্যাজেডি

টেকসই বাংলাদেশ গঠনে পরিবেশ সংস্কার কেন অপরিহার্য

সে এক রূপকথারই দেশ

উপকূলের খাদ্যসংকট নিয়ে ভাবছেন কি নীতিনির্ধারকেরা?

মানসিক স্বাস্থ্য: মানবাধিকারের নতুন চ্যালেঞ্জ

ঢাকার যানজট ও বিকেন্দ্রীকরণ

নির্বাচনী মাঠে জামায়াতী হেকমত

শিক্ষা ব্যবস্থায় গভীর বৈষম্য ও জাতির অগ্রযাত্রাধ

উপমহাদেশে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন, বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

এইচএসসি ফল: সংখ্যার খেল না কি শিক্ষার বাস্তব চিত্র?

বিনা ভোট, নিশি ভোট, ডামি ভোটের পরে এবার নাকি গণভোট!

কমরেড ইলা মিত্রের শততম জন্মজয়ন্তী

কত মৃত্যু হলে জাগবে বিবেক?

বৈষম্যের বিবিধ মুখ

মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় জরুরি আইনি সহায়তা

গাজা : এখন শান্তি রক্ষা করবে কে?

দোসর, বাই ডিফল্ট!

জমি কেনা দাগে দাগে কিন্তু ভোগদখল একদাগে

রাষ্ট্র কি শুধু শিক্ষকদের বেলায় এসে দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে?

শতরঞ্জ কি খিলাড়ী

শিক্ষক থাকে রাজপথে, আর পুলিশ ছাড়ে থানা

উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা : স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবিষ্যৎ কী?

ছবি

শ্লীলতা, অশ্লীলতার রাজনৈতিক সংস্কৃতি

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: অবক্ষয়ের চোরাবালিতে আলোর দিশারী

অটোমেশন ও দেশের যুব কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ

দুর্যোগে ভয় নয়, প্রস্তুতিই শক্তি

বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন

ছবি

‘আল্লাহ তুই দেহিস’: এ কোন ঘৃণার আগুন, ছড়িয়ে গেল সবখানে!

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

এবার আমরা সভ্য হলাম!

আনোয়ারুল হক

রোববার, ২৬ অক্টোবর ২০২৫

শৈশব কালে আমরা পড়েছি- অনেক অনেকদিন আগের কথা। তখন আরব দেশের লোকেরা বর্বর ছিলো। কেনো বর্বর ছিলো? এই সময়ে আরবে কোনো ঐশী বাণী বা ধর্মগ্রন্থ ছিল না, যার কারণে সমাজ ছিল নানা কুসংস্কার, অনাচার, অন্যায়, বিশৃঙ্খলা ও গোত্রে গোত্রে সংঘাতপূর্ণ। কৈশোর কালে ইসলামের ইতিহাস বইয়ে এ বিষয়ে আরো বিস্তৃত আমরা জেনেছি। পাঠকদেরও তা অজানা নয়।

গত ১৭ অক্টোবর জানলাম আমরা বাংলাদেশীরা এতকাল যাবত বর্বর ছিলাম। কোনো আইনকানুন বা সনদ ছিলো না। যা ইচ্ছা তা-ই করা যেতো। এখন আমরা সভ?্যতায় আসলাম। কেমনে আসলাম? এখন আমরা সনদ পেলাম, দেশ পরিচালনার গ্রন্থ পেলাম যা নিয়ে আদালতে কখনও কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবে না। এভাবে আমরা সবাই সভ?্য হলাম। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং সাদা চামড়ার বৃটিশরাও আমাদেরকে একদফা সভ্য বানাতে প্রায় দু’শো বছর যাবত যারপরনাই কোশেস করেও ব্যর্থ হয়ে বিদায় নিলো। তারপর ২৫ বছর যাবত পাকিস্তানের উর্দিপরা শাসকরা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ভুলিয়ে দিয়ে পাকিস্তানি ঈমান-আকিদায় সভ্য বানানোর জন্য ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যা এবং এক কোটি মানুষকে দেশ ছাড়া করেও ব্যর্থ হল। তবে এবার আমরা সভ্য হলাম!

শুধু বাদ থাকলেন সনদ রচনা কমিটির সভাপতিকে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় ‘নিয়োগ’ করেছিলেন সেই নিয়োগকর্তারা। তারা খুবই গোস্বা করেছেন তাদের ঐসব মিত্র শক্তির উপরে যারা এই দেশের জন্মেরবিরোধী হলেও তাদেরকে জুলাই আন্দোলনের সময়ে তারা বুকে টেনে নিয়েছিলেন। রাষ্ট্র ক্ষমতায় অংশীদারিত্বের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। নিজেদের ছাত্র সংগঠনের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে সবকটি বিশ্ববিদ?্যালয়ে যাদেরকে জয়ের মুকুট পরার মতো পরিস্থিতি ও সুযোগ করে দিলেন। অথচ ‘স্বাক্ষর না করে একযোগে আরো দরকষাকষি’ করার কথা দিয়েও তারা কথা রাখলেন না। তাই এখন তাদেরকে প্রতারক, মোনাফেক ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করছেন। অন?্যদিকে দেশের জন্মযুদ্ধের বিরোধী শক্তির নেতারা বলছেন ‘জন্ম নিয়েই বাপের সাথে পাল্লা দিয়ো না’।

জামাত এনসিপির সম্পর্ক যে বাপ-বেটার তা সবাই ধারনা করলেও এবার জামায়াত সেক্রেটারি সেটা ঘোষণা দিয়ে জানান দেওয়ায় আমরা বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হলাম। কিন্তু ‘বেটা’ আরিফুল ইসলাম আদীব দাবী করছেন ‘রাজনীতিতে কারও বাপ হইতে চাওয়া এক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিগত সমস্যা। বিপদের সময় অন্যের কমান্ডিংয়ে কাজ করে, বিপদ কেটে যাওয়ার পর কমান্ডারের ওপর এখন নিজেদের কমান্ডার দাবি করা (বাপগিরি করা) এক ধরনের রাজনৈতিক বালখিল্যতা বা অসদাচরণ’। আর এক ‘বেটা’ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, ‘জামায়াতের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তাদের রাজনৈতিক দর্শন ও অতীত আচরণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মানচিত্র ও জাতীয় চেতনার পরিপন্থি। এই দেশকে আর অন্ধকারে ফেরানো যাবে না।’

এখন দেখা যাক ‘আদর্শিক বাবার’ সংগে ‘সন্তানদের’ বিরোধ কিভাবে নিষ্পত্তি হয়। আর ‘সন্তানেরা’ তাদের নিয়োগকৃত সরকার প্রধানকে বলেছেন, যে সনদ ও গ্রন্থ রচিত হলো তা কার্যকর কিভাবে হবে সে বিষয়ে তাদের আশ্বস্ত করা হলে তারাও স্বাক্ষর করবেন, সভ?্য হবেন। কেন বর্বর থাকবেন? রাজনীতির কারবারিদের ধারণা, ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে হিস?্যা নিয়েই মূলত ‘বাপ-বেটার’ বিরোধ। সংসারে এমন বিরোধ হয় আবার মিটেও যায়।

এদিকে মূল সনদবিহীন শুধুমাত্র স্বাক্ষরের পাতায় স্বাক্ষর করে আসার দু’দিন পরেই বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা সাইফুল হক সাংবাদিক সম্মেলন করে ঘোষণা করেছেন, জুলাই সনদে যেসব প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে, সেগুলো নিয়েই কেবল গণভোট আয়োজন করতে হবে। অন্য কোনো বিতর্কিত ইস্যু গণভোটে তোলা যাবে না এবং গণভোট আইনসভা নির্বাচনের পূর্বে নয়। সনদ ঘোষণার দিন রাতে একটি দৈনিক পত্রিকার অনলাইন সংবাদে পূর্ণ সনদ দেখলাম লালে লাল। অর্থাৎ নোট অব ডিসেন্ট বা দ্বিমতগুলো লাল অক্ষরে লেখা হয়েছে এবং সেগুলোই বেশি চোখে পড়ছে। হঠাৎ দেখে বুঝা মুশকিল ঐকমত্য না বিভাজন। সাইফুল হক আরো বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার চরিত্রের দিক দিয়ে দল নিরপেক্ষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও গত ১৪ মাসে তাদের আচরণে দলনিরপেক্ষতা ছিল না। তারা পুরোপুরিভাবে পক্ষপাতদুষ্টতায় কাজ করে চলছে। সরকার যদি অচল ও একতরফা নির্বাচনের পথে যায়, তাহলে তা দেশের জন্য ভয়াবহ হবে।’

কমিউনিস্ট নেতা সাইফুল হক যে জোটে আছেন সে জোট অর্থাৎ গণতন্ত্র মঞ্চের সাথে অন্তর্বর্তী সরকার ও একই সাথে বিএনপির ঘনিষ্ঠতা আছে বলে প্রতীয়মান হয়। তাই তার এ বক্তব?্য গুরুত্ব বহন করে। এখন জামায়াত, এনসিপি, বিএনপি এবং গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা, সেফ এক্সিট এবং সনদ, গণভোট ইত্যাদি নিয়ে এবং জামায়াত-এনসিপি একে অপরের বিরুদ্ধে যেসমস্ত কথাবার্তা বলছেন তাতে কি কোনো জাতীয় ঐকে?্যর সুর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে? নির্বাচনের দোরগোড়ায় এসে ভবিষ্যৎ ক্ষমতার টানাটানিতে সব কিছু কি জট পাকিয়ে যাচ্ছে? জট পাকলে খোলার লোক আছে। দেশ বিদেশে আমাদের বন্ধুর অভাব নেই! লেখার বিষয়বস্তু এ সব বিষয় নিয়ে নয়।

লেখার মূল বিষয় হ’ল জাতি হিসেবে আমরা কতটা বর্বর ছিলাম। না, আমরা বর্বর ছিলাম না। ছিলাম না বলেই এক যুগ যাবত জবরদস্তিমূলক ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা সরকারের শাসনে থাকায় অভ?্যস্ত হয়ে যাওয়ার পরেও জুলাই হত?্যকা-ের বর্বরতার বিরুদ্ধে মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে। জবরদস্তি ক্ষমতা আঁকড়ে রাখা সরকারকে বিদায় করে ছেড়েছে। আবার গণঅভ্যুত্থান বিজয়ী হওয়ার পরে এবং পুলিশ বাহিনী পশ্চাদাপসারন বা অনেকটা আত্মসমর্পণ করার পরে হুকুমদাতারা পালিয়ে যেতে পারলেও ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে দেশজুড়ে অসংখ্য থানায় অসংখ্য পুলিশ কনস্টেবলকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে - যাদের সন্তানও হয়তোবা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মিছিলে ছিলো। এটাকেও বর্বরতা নাইবা বললাম। পুলিশের নির্বিচার গুলি বর্ষণে যে হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছিলো তাতে ক্রোধে উন্মত্ত জনতা বিচার-বিবেচনাহীন এমন ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে। মহলবিশেষ এক্ষেত্রে উস্কানিও দিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু বর্বরতা বলা যেতে পারে এ ঘটনায় রাষ্ট্রের সীমাহীন ঔদাসিন্যকে। তৎকালীন ক্ষমতাসীনগোষ্ঠীর যে কোনো পন্থায় ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার যে নীতি, তার বলি হলেন পুলিশ বাহিনীর এই সদস্যরা। তৎকালীন শাসকদের বর্বরতাকে পরাজিত করতে পেরেও নিহত এই পুলিশদের এবং তাদের পরিবারের প্রতি ঔদাসিন?্য দেখিয়ে রাষ্ট্র বর্বরোচিত আচরণের স্বাক্ষর রাখলো। আজ থেকে সভ?্য হয়ে গেলাম বললেই সব অন্ধকার দূর হয়ে যায় না।

ইউনূস তার ভাষণে বললেন জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে গত ১৬ বছরের নৃশংসতার অবসান ঘটবে। তার আগের নৃশংসতাগুলো কি তাহলে জায়েজ ছিলো? যদিও স্বাধীনতাউত্তর সরকারের অভ?্যন্তরে কতৃত্ববাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিল তারপরেও স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা, মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ জাতীয় চার নেতাকে জেলখানার অভ্যন্তরে হত্যা করা কি বর্বরতা না সভ্যতা ছিলো? মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখসমরে পা হারানো যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল আবু তাহের, বীর উত্তমকে এক প্রহসনের সামরিক আদালতের রায়ে ১৯৭৬ সনে ফাঁসি দেওয়াকে বা ৭৫ পরবর্তীতে সামরিক শাসন আমলে হাজার হাজার সামরিক অফিসারকে হত?্যা, মৃত?্যুদ- ও গুম বা নিখোঁজ করাকে কি নৃশংসতা বলা যাবে? ১৯৭৭ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরÑশুধুমাত্র এই দুই মাসে ১ হাজার ১৪৩ জন সামরিক সদস্যকে সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতের প্রহসনের রায়ে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়েছিলো বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। নৃশংসতার কাহিনী রাজনীতিকরা তাদের সুবিধামতো এতকাল একতরফাভাবে বর্ণনা করেছেন। ইউনূসও কি রাজনীতিবিদ হয়ে গেলেন?

এ দেশে সব থেকে বর্বর গণহত্যা সংগঠিত হয়েছিলো পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও তার দোসর রাজাকার-আলবদর কর্তৃক। সেই গণহত্যাকারীদের দোসরদের পাশে রেখে প্রধান উপদেষ্টা যখন বলেন সভ?্যতায় ফিরে এলাম Ñ কেমন যেন মানায় না। এই তো ক’দিন আগে অন্তর্বর্তী সরকার মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় পরিবর্তন করে যে অধ্যাদেশ জারি করেন সেখানেও ‘মুক্তিযুদ্ধ’ অর্থ বলতে বলা হয়েছে, “১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষায় হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধ।” অর্থাৎ এই সরকারের জারীকৃত অধ?্যাদেশেই বলা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের অর্থ “... জামায়াত ইসলামী’র বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধ”। আজ যতই তারা সুসংগঠিত এবং অর্থবিত্তে প্রতাপশালী হোক তাতে দলের অপরাধ নাকচ হয়ে যায় না। অন্তর্বর্তী সরকারের মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞা অনুযায়ী জামায়াত এবং বাংলাদেশের মানুষের সম্পর্ক হচ্ছে যুদ্ধের ময়দানে প্রতিপক্ষের সম্পর্ক। ওরা আমাদের শক্র শিবিরের দোসর ও গণহত্যার সহায়তাকারী দল। এনসিপির গুঁতো খাওয়ার পরে এখন জামায়াত আমীর যুক্তরাষ্ট্রে যেয়ে নাটকের স্ক্রিপ্ট পড়ছেন, আমরা যদি কাউকে কখনও কষ্ট দিয়ে থাকি আমাদের ক্ষমা করে দেবেন। এ যেন প্রেমিক প্রেমিকার অভিমান ভাঙানোর প্রয়াস! ভুল আর ফৌজদারি (গণহত্যার) অপরাধ এক হয় নাকি? জাতির সাথে তারা মস্করা করছেন।

সময়ের দূরত্ব দৃশ্যকে হয়তো আড়াল করে, দৃশ?্য তখন দৃষ্টির বাইরে চলে যায়। তার মানে দৃশ্যের অস্তিত্ব শেষ হয়ে যায় না। জামায়াতের অপরাধের অস্তিত্বও শেষ হয়ে যায়নি। তাই দল হিসাবে সেই জামায়াত ইসলামের বিচার না করে তাদের পাশে নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে বলে ফেললাম, আমরা সভ?্য হয়ে গেলাম। তাতেই সভ?্য হয়ে গেলাম! আর যদি বলেন পূর্ববর্তী রাজনৈতিক সরকারসমূহ এ সব জঞ্জাল রেখে গেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব এ সব বিষয় নিষ্পত্তি করা নয়, দায়িত্ব শুধু এই অন্তর্বর্তী অবস্থা থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণ তাহলে সংস্কার, সভ?্যতা এ সব বুলি বাদ দিয়ে, দেশের ইতিহাসের বয়ান রচনা বাদ দিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করে বাংলাদেশের মানুষকেই ব?্যালটের মাধ্যমে তাদের ভাগ্য নির্ধারণের সুযোগ দিন। আসলে আপনাদের দায়িত্ব ওতটুকুই ছিলো। বাকিটুকু নির্বাচিত সংসদের।

স্বল্প সময়ের অন্তর্বর্তী দায়িত্বের বিপরীতে দীর্ঘ সময় থাকার কারণ সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে ফুটে উঠেছে। দেশের মানুষ যে আর্থিক সংকটে আছে, বিনিয়োগ ব্যবসা-বাণিজ্য থমকে আছে, দারিদ্র?্য আর বেকারত্ব বাড়ছে, রাস্তার ফুটপাথে ছিন্নমূল মানুষের ভিড় বাড়ছে সেসব বিষয়ে কোনো কথা নেই। ছাত্রসমাজ এখনও শিক্ষায় মনোযোগী হতে পারছেন না (এইচএস.স পরীক্ষা ফলাফল তার বড় প্রমাণ), শিক্ষকরা রাস্তায় - তা নিয়ে মাথা ব?্যথা নেই, কথা নেই। সনদে নারী, সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের আশার আলো না থাকলেও তিনি তার বক্তব্যে অন্তত তাদেরকে আশ্বস্ত করতে পারতেন। না, তা তিনি করলেন না। তার কথা একটাই, সারা বিশ্ব নাকি একসময় আমাদের অনুসরণ করবে। কীভাবে? আমাদের সমুদ্র এলাকা, সমুদ্র বন্দর বিদেশীদের হাতে তুলে দিলে অর্থনীতিতে দুধের নহর বয়ে যাবে। আর (ভারতের মোড়লগিরি বন্ধ করতে) সেভেন সিস্টারকে আমাদের বন্দরের সাথে যুক্ত করার বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। একটি অন্তর্বর্তী এবং অনির্বাচিত সরকারের কি এমন ঠেকা পড়লো যে দেশের বন্দর বিদেশীদের হাতে তুলে দিতে হবে! তার এসব কথায় বুঝা যায়, যে বিশ্ব মোড়লের পাল্লায় দেশ পড়েছে তার থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে উঠছে।

অথচ জুলাই আন্দোলনের মধ?্য দিয়ে মুক্তির যে আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছিলো, ‘৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয়ের সময়টা ছাড়া তেমনটা এর আগে এতা হয়নি। এরপর ১৫ মাসে তো ‘১৬ বছরের নৃশংস স্বৈরাচার ছিলো না। কেবল বাপ-বেটারা ছিলো। আর ছিলো শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার! তারপরেও কেনো অন্ধকার আমাদের স্বপ্ন আর আলোকে ঢেকে ফেলছে? সভ্যতা আর কত দূর!

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

[লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা]

back to top