alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

ত্রিশতম জলবায়ু সম্মেলন : প্রতীকী প্রদর্শনী, নাকি বৈশ্বিক জলবায়ু রাজনীতির বাঁক নেওয়ার মুহূর্ত?

মতিউর রহমান

: বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫

বিশ্ব আজ ক্রমবর্ধমান জলবায়ু বিপর্যয়ের মুখে এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। ভয়াবহ তাপদাহ, বন-অগ্নিকাণ্ড, সাইক্লোন, বন্যা, খরা এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের ক্রমবর্ধমান উচ্চতা বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবনের মৌলিক ভিত্তিগুলোকে বিপর্যস্ত করছে। ক্রমাগত জরুরি অবস্থার মুখে দাঁড়িয়ে, ব্রাজিলের বেলেমে অনুষ্ঠিতব্য জলবায়ু সম্মেলন ত্রিশতম (কপ ৩০) নিয়ে তাই প্রত্যাশা ও সংশয়-দুই-ই দ্রুত বাড়ছে।

বেলেম কি এবার সত্যিই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারবে, নাকি আগের মতোই কাগুজে প্রতিশ্রুতি আর রাজনৈতিক কৌশলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে আরেকটি সাধারণ সম্মেলনের কোলাহলে হারিয়ে যাবে? বেলেম আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে সময় খুব কম, সংকট গভীর, এবং পথটি প্রতীকী প্রতিশ্রুতি নয়, বরং কাঠামোগত পরিবর্তনের

আমাজন রেইন ফরেস্টের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত এই শহরটি নিজেই এক শক্তিশালী প্রতীক, যা জীববৈচিত্র্যরে নাজুক অবস্থা এবং পরিবেশগত লড়াইয়ের গভীরতা স্মরণ করিয়ে দেয়। তাই এই সম্মেলনের স্থান নির্বাচন কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি বৈশ্বিক জলবায়ু রাজনীতির কেন্দ্রে ন্যায়বিচার, আদিবাসী অভিজ্ঞতা এবং বৈশ্বিক দক্ষিণের দাবি তুলে ধরার একটি রাজনৈতিক ও নৈতিক ঘোষণা।

এখান থেকেই জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের মনে মূল প্রশ্নটি জাগে- বেলেম কি এবার সত্যিই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারবে, নাকি আগের মতোই কাগুজে প্রতিশ্রুতি আর রাজনৈতিক কৌশলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে আরেকটি সাধারণ সম্মেলনের কোলাহলে হারিয়ে যাবে? বেলেম আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে সময় খুব কম, সংকট গভীর, এবং পথটি প্রতীকী প্রতিশ্রুতি নয়, বরং কাঠামোগত পরিবর্তনের।

এই জলবায়ু সম্মেলনের স্থান নির্বাচনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য অনস্বীকার্য। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রেইন ফরেস্টের দরজায় দাঁড়িয়ে এই সম্মেলন বিশ্বকে আমাজনের রক্ষকদের দিকে তাকাতে বাধ্য করে। এটি কেবল কার্বন নির্গমন কমানোর আলোচনা নয়, বরং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, বন উজাড় বন্ধ করা এবং স্থানীয় বাস্তুতন্ত্র রক্ষার একটি যৌথ দায়িত্বের ঘোষণা।

প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভার নেতৃত্বে ব্রাজিল আবার বৈশ্বিক জলবায়ু রাজনীতিতে সক্রিয় ও নৈতিক ভূমিকা নিতে শুরু করেছে। বিশেষ করে আমাজনে বন উজাড় কমানোর মাধ্যমে ব্রাজিল তার নৈতিক অবস্থানকে পুনরুদ্ধার করেছে। লুলা সরকারের অগ্রাধিকার-জলবায়ু ন্যায়বিচার, আদিবাসী অধিকার এবং দক্ষিণ–দক্ষিণ সহযোগিতা-সম্মেলনের আলোচনায় নতুন মাত্রা যুক্ত করতে পারে।

ব্রাজিল এই সম্মেলনকে এমন একটি পরিসর হিসেবে দেখতে চায় যেখানে বৈশ্বিক দক্ষিণ নির্ধারণমূলক ভূমিকা নিতে পারে, যেখানে জলবায়ু সংকটকে শুধু কার্বন নির্গমনের সংখ্যা দিয়ে নয়, সামাজিক বৈষম্য, ঐতিহাসিক অন্যায় এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর ন্যায্য চাহিদার আলোকে ব্যাখ্যা করা হবে। বেলেম তাই একটি প্রতীকী সম্মেলন নয়, এটি বৈশ্বিক দক্ষিণের নেতৃত্বের এবং জলবায়ু ন্যায়বিচারের মূলনীতি প্রতিষ্ঠার মঞ্চ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরছে।

এই জলবায়ু সম্মেলনের ইতিহাস গড়ার সম্ভাবনা নির্ভর করছে দুটি বড় সংকট মোকাবিলার ওপর-বিশ্বাসের সংকট এবং উচ্চাকাক্সক্ষার সংকট। এই দুটি সংকটের সমাধান না হলে কোনো আলোচনাই ফলপ্রসূ হবে না। প্রথমত, ধনী দেশগুলোর প্রতিশ্রুতি বারবার ভেঙে পড়ায় বৈশ্বিক দক্ষিণের আস্থা গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০১০ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দীর্ঘকাল ধরে পূরণ হয়নি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু অর্থায়ন নিয়ে অস্পষ্টতা, পুরোনো প্রতিশ্রুতির ব্যর্থতা এবং বাস্তব সহযোগিতার পরিবর্তে তথাকথিত ‘চতুর হিসাব’ বা ঋণ-নির্ভর অর্থায়নের প্রবণতা। উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রশ্ন তুলছে, এই সহযোগিতা কি বাস্তব, নাকি কেবলই এক ধরনের ‘ঋণ-ফাঁদ’?

এই সম্মেলন যদি কাঠামোগতভাবে নির্ভরযোগ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি জলবায়ু অর্থায়নের নিশ্চয়তা না দিতে পারে, তাহলে আস্থাহীনতার এই দেয়াল আরও দৃঢ় হবে। নতুন, উচ্চাভিলাষী অর্থায়ন লক্ষ্যমাত্রা (যা বছরে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন) নির্ধারণ করতে হবে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অভিযোজন এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি রূপান্তরে সহায়তা করবে। এটি কেবল অর্থের পরিমাণ নয়, অর্থায়নের ধরন নিয়েও প্রশ্ন-সহযোগিতা নাকি ঋণ? বেলেমকে এই বিতর্কে বৈশ্বিক দক্ষিণের দিকে পাল্লা ভারী করতে হবে।

উচ্চাকাক্সক্ষার সংকট ভিন্ন মাত্রায় জটিল। বৈজ্ঞানিক তথ্য বলছে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে, যদি না জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন দ্রুত এবং ন্যায়সঙ্গতভাবে কমানো হয়। কিন্তু তেল–গ্যাস উৎপাদনকারী দেশগুলো যুক্তি দেয় যে হঠাৎ করেই জীবাশ্ম জ্বালানি পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করবে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর দারিদ্র?্য দূরীকরণের পথে বাধা সৃষ্টি করবে।

পূর্ববর্তী সম্মেলনে জীবাশ্ম জ্বালানি পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার বিষয়ে যে অস্পষ্ট ভাষা গৃহীত হয়েছিল, এই সম্মেলনে তা আবার নতুনভাবে সামনে আসবে। তেল ও গ্যাস উৎপাদনকারী বৃহৎ সংস্থা এবং দেশগুলোর লবিং এই আলোচনাকে বারবার দুর্বল করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্ক, ইউরোপের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা, আর মধ্যম আয়ের দেশগুলোর উন্নয়ন অগ্রাধিকার-এই বহুমুখী বাস্তবতা জলবায়ু প্রক্রিয়াকে বারবার দুর্বল করেছে।

বেলেমের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে এই দ্বন্দ্বের সমাধান-কীভাবে একটি ন্যায়সঙ্গত রূপান্তর নিশ্চিত করা যায়, যা ধনী দেশগুলোকে দ্রুত নির্গমন কমানোর চাপ দেবে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাদের জ্বালানি নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের সুযোগ দেবে। এই সম্মেলন সফল হতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানির ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি স্পষ্ট, সময়সীমা-নির্দিষ্ট এবং বৈজ্ঞানিক ভিত্তিক পথরেখা তৈরি করতে হবে।

বৈশ্বিক দক্ষিণের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন ভবিষ্যৎ নয়, এটি বর্তমান। খাদ্য নিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য, কৃষি, অবকাঠামো-সবকিছুই জলবায়ুর তীব্র আঘাতে নড়বড়ে। অভিযোজন আর ‘দ্বিতীয় শ্রেণির’ আলোচ্য বিষয় থাকতে পারে না; এটিকে মূল রাজনৈতিক এজেন্ডায় আনতে হবে। অভিযোজন প্রক্রিয়ায় স্থানীয় জ্ঞান, আদিবাসী প্রথা এবং সম্প্রদায়ভিত্তিক স্থিতিস্থাপকতাকে এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত করা একটি রূপান্তরমূলক পদক্ষেপ হতে পারে। এর জন্য আন্তর্জাতিকভাবে অভিযোজন অর্থায়নে বড় ধরনের বৃদ্ধি দরকার, যা উন্নত দেশগুলো বহন করবে।

ক্ষতি ও ক্ষয়ক্ষতি তহবিল (লস অ্যান্ড ড্যামেজ) পূর্ববর্তী সম্মেলনে ঐতিহাসিকভাবে সৃষ্টি হলেও এর বাস্তব অর্থায়ন এখনো ন্যূনতম এবং অপ্রতুল। জোরালো প্রত্যাশা হচ্ছে এই সম্মেলনে এমন একটি কাঠামো গৃহীত হবে যা ক্ষতি–ক্ষতির জন্য কার্যকর, নির্ভরযোগ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা নিশ্চিত করবে। এটি যদি কেবল প্রতীকী সিদ্ধান্তে আটকে থাকে, তাহলে আন্তর্জাতিক জলবায়ু শাসনের প্রতি আস্থা আরও ভেঙে পড়বে, এবং গরিব দেশগুলো চরম অবিচারের শিকার হবে।

বেলেমে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি এই সম্মেলনকে অন্যরকম তাৎপর্য দিচ্ছে। আমাজনের রক্ষক হিসেবে তারা পরিবেশ সংরক্ষণে শতাব্দীর অভিজ্ঞতা বহন করেন, অথচ জলবায়ু আলোচনায় বহুবার উপেক্ষিত হয়েছেন। ব্রাজিল এবার তাদেরকে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই প্রতিশ্রুতি যদি বাস্তব ক্ষমতায় রূপ নেয়-যেখানে আদিবাসীরা শুধু বক্তব্যই দেবেন না, বরং নীতি প্রণয়ন, অর্থায়নের সিদ্ধান্ত এবং বন সংরক্ষণের মডেলে সরাসরি প্রভাব ফেলবেন-তাহলে এই সম্মেলন পরিবেশগত ন্যায়বিচারের নতুন অধ্যায় খুলতে পারে। আদিবাসী ভূমির সুরক্ষা কেবল মানবাধিকার নয়, এটি কার্বন সিঙ্ক সংরক্ষণেরও একটি প্রমাণিত বৈজ্ঞানিক কৌশল। তাদের অভিজ্ঞতাকে গ্রহণ করা এই সম্মেলনের নৈতিক বিজয়ের অন্যতম প্রধান মাপকাঠি হবে।

এই জলবায়ু সম্মেলনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বৈশ্বিক অগ্রগতি পর্যালোচনা। প্যারিস চুক্তির পর এটি বৈশ্বিক অগ্রগতি মূল্যায়নের একটি প্রক্রিয়া। এই পর্বে দেশগুলোকে তাদের বর্তমান জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অঙ্গীকারসমূহ পুনর্বিবেচনা করতে হবে এবং বৈজ্ঞানিক প্রয়োজন অনুযায়ী হালনাগাদ করতে হবে। এটি বাস্তব জবাবদিহির একটি মুহূর্ত, যেখানে কথার চেয়ে কার্যকর কর্মপরিকল্পনা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্মেলন সফল হতে হলে দেশগুলোকে এমন পথরেখা তৈরি করতে হবে যা জ্বালানি, শিল্প, পরিবহন, কৃষি-সব ক্ষেত্রে ন্যায়সঙ্গত ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তিক রূপান্তর নিশ্চিত করবে। এই পর্যালোচনা যদি বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফাঁকটি স্পষ্টভাবে তুলে না ধরে এবং ধনী দেশগুলোর ওপর প্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি না করে, তাহলে এই জলবায়ু প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা নিয়ে উত্থাপিত সমালোচনা আরও জোরালো হবে।

মূল প্রশ্ন হলো-বেলেম কি বহুপাক্ষিক জলবায়ু সহযোগিতায় নবজাগরণের সূচনা করবে? নাকি এটি আবারও কর্পোরেট লবিং এবং কূটনৈতিক সৌজন্যের মধ্যে আটকে যাবে? ক্রমবর্ধমানভাবে সমালোচকরা মনে করেন এই ধরনের জলবায়ু সম্মেলন একটি বৈশ্বিক প্রদর্শনীতে পরিণত হয়েছে, যেখানে বাস্তব পরিবর্তনের পরিবর্তে ন্যারেটিভের আধিপত্য থাকে। বেলেম সেই আস্থা পুনর্গঠনের সুযোগ এনে দিয়েছে, কিন্তু তা সম্ভব হবে কেবল তখনই যখন কাঠামোগত সংস্কার, স্বচ্ছতা এবং বৈজ্ঞানিক সত্যের সঙ্গে নৈতিক দায়িত্ব যুক্ত থাকবে। ব্রাজিল তার নিজস্ব নীতিতে যদি শক্তিশালী ও সুসংগত অগ্রগতি দেখাতে পারে, তবে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তার নেতৃত্ব আরও বিশ্বাসযোগ্য হবে। তবে অভ্যন্তরীণ নীতিতে দ্বন্দ্ব বা অসঙ্গতি থেকে গেলে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তার দাবি দুর্বল হবে।

শেষ পর্যন্ত এই সম্মেলনের সাফল্য নির্ভর করছে রাজনৈতিক সাহস, বৈশ্বিক সংহতি, বৈজ্ঞানিক সততা এবং ন্যায়বিচারের প্রতি প্রকৃত প্রতিশ্রুতির ওপর। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রেইন ফরেস্টের দোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে বিশ্বের নেতারা যদি আবারও অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফিরে যান, তাহলে জলবায়ু শাসনব্যবস্থা আরও ক্ষয়িষ্ণু হবে। আর যদি বেলেম থেকে নির্ভরযোগ্য অর্থায়ন, জীবাশ্ম জ্বালানির ভবিষ্যৎ নিয়ে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত, অভিযোজন ও ক্ষতি–ক্ষতি বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ, এবং আদিবাসী ও বৈশ্বিক দক্ষিণকে প্রকৃত নেতৃত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি বেরিয়ে আসে-তাহলে এই সম্মেলন সত্যিই একটি বাঁক নেওয়ার মুহূর্ত হয়ে উঠতে পারে। সময় খুব কম, এবং বেলেম সেই পরিবর্তনের দরজা খুলে দিতে পারে। বিশ্বকে সেই দরজা দিয়ে প্রবেশের সাহস দেখাতে হবে।

[লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

নারী নির্যাতন, মানসিক স্বাস্থ্য এবং সমাজের দায়

কাঁপছে ডলারের সিংহাসন

অপরিণত নবজাতক : ঝুঁকি, প্রতিরোধ ও যত্নের জরুরি বাস্তবতা

বাংলাদেশী উত্তরাধিকার: প্রবাস-জীবন ও আমাদের সংস্কৃতি

রাজনীতিতে ভাষার সহনীয় প্রয়োগ

ভারত : এসআইআর এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজন

মনে কী দ্বিধা নিয়ে...

নিরাপদ সড়ক ভাবনা

অপরিকল্পিত বাঁধ-শিল্পায়নে বিপর্যস্ত বরেন্দ্র কৃষি

ছবি

মামদানি দেখালেন নেতৃত্বের মূল পরিচয় কী

চেকের মামলায় বৈধ বিনিময়, লেনদেন, দেনা-পাওনা প্রমাণ ছাড়া আর জেল নয়

নবাগত শিক্ষকদের পেশাগত ভাবনা

মাদকাসক্তি: শুধু নিরাময় নয়, চাই সমাজ ব্যবস্থার সংস্কার

আমেরিকার “নো কিংস” আন্দোলন

ঘি তো আমাদের লাগবেই, নো হাংকি পাংকি!

“মামদানি না জামদানি...”

ভাষার বৈচিত্র্য রক্ষায় নীরব বিপ্লব

উপাত্ত সুরক্ষা আইন : গোপনীয়তা রক্ষা নাকি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ?

সমতা কি ন্যায্যতা নিশ্চিত করে?

ডেঙ্গু সংকট দূরদৃষ্টির ব্যর্থতা

ষাটের দশকে বামপন্থী ভাবনার উত্থান ও বিবর্তন

দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে!

বায়ুর অপর নাম জীবন

ছবি

হাওরের জীবন ও সংস্কৃতি

বিখণ্ডিত আত্মপরিচয়: তরল সহানুভূতিতে নৈতিক মূলধনের সমাজতত্ত্ব

প্রভাষকের ‘প্রভা’ যখন ‘শোক’: শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি বঞ্চনা

যুদ্ধ বিরতি গাজাবাসীর জন্য জরুরি ছিল

লবলং খালের মৃত্যু: স্মৃতিতে নদী, বাস্তবে দূষণ

বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা: অর্থনৈতিক স্থিতির পূর্বশর্ত

হায় যম! আর কতক্ষণ, হবে অপেক্ষা করিতে মোরে?

পোশাক শিল্প : অগ্রগতি ও শ্রমিকের অধিকার

গণভোটের রাজনৈতিক গুরুত্ব

বামঘরানার বাটখারা...

বাগদা ফার্ম : স্মারকলিপি, অবরোধ, অনশন, আন্দোলন- কিছুতেই বরফ গলেনি

ব্যাটারি-শকট: নতুন সংকট

মতপ্রকাশ কিংবা দ্বিমত পোষণ: নাগরিক অধিকার ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

ত্রিশতম জলবায়ু সম্মেলন : প্রতীকী প্রদর্শনী, নাকি বৈশ্বিক জলবায়ু রাজনীতির বাঁক নেওয়ার মুহূর্ত?

মতিউর রহমান

বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫

বিশ্ব আজ ক্রমবর্ধমান জলবায়ু বিপর্যয়ের মুখে এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। ভয়াবহ তাপদাহ, বন-অগ্নিকাণ্ড, সাইক্লোন, বন্যা, খরা এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের ক্রমবর্ধমান উচ্চতা বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবনের মৌলিক ভিত্তিগুলোকে বিপর্যস্ত করছে। ক্রমাগত জরুরি অবস্থার মুখে দাঁড়িয়ে, ব্রাজিলের বেলেমে অনুষ্ঠিতব্য জলবায়ু সম্মেলন ত্রিশতম (কপ ৩০) নিয়ে তাই প্রত্যাশা ও সংশয়-দুই-ই দ্রুত বাড়ছে।

বেলেম কি এবার সত্যিই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারবে, নাকি আগের মতোই কাগুজে প্রতিশ্রুতি আর রাজনৈতিক কৌশলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে আরেকটি সাধারণ সম্মেলনের কোলাহলে হারিয়ে যাবে? বেলেম আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে সময় খুব কম, সংকট গভীর, এবং পথটি প্রতীকী প্রতিশ্রুতি নয়, বরং কাঠামোগত পরিবর্তনের

আমাজন রেইন ফরেস্টের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত এই শহরটি নিজেই এক শক্তিশালী প্রতীক, যা জীববৈচিত্র্যরে নাজুক অবস্থা এবং পরিবেশগত লড়াইয়ের গভীরতা স্মরণ করিয়ে দেয়। তাই এই সম্মেলনের স্থান নির্বাচন কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি বৈশ্বিক জলবায়ু রাজনীতির কেন্দ্রে ন্যায়বিচার, আদিবাসী অভিজ্ঞতা এবং বৈশ্বিক দক্ষিণের দাবি তুলে ধরার একটি রাজনৈতিক ও নৈতিক ঘোষণা।

এখান থেকেই জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের মনে মূল প্রশ্নটি জাগে- বেলেম কি এবার সত্যিই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারবে, নাকি আগের মতোই কাগুজে প্রতিশ্রুতি আর রাজনৈতিক কৌশলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে আরেকটি সাধারণ সম্মেলনের কোলাহলে হারিয়ে যাবে? বেলেম আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে সময় খুব কম, সংকট গভীর, এবং পথটি প্রতীকী প্রতিশ্রুতি নয়, বরং কাঠামোগত পরিবর্তনের।

এই জলবায়ু সম্মেলনের স্থান নির্বাচনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য অনস্বীকার্য। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রেইন ফরেস্টের দরজায় দাঁড়িয়ে এই সম্মেলন বিশ্বকে আমাজনের রক্ষকদের দিকে তাকাতে বাধ্য করে। এটি কেবল কার্বন নির্গমন কমানোর আলোচনা নয়, বরং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, বন উজাড় বন্ধ করা এবং স্থানীয় বাস্তুতন্ত্র রক্ষার একটি যৌথ দায়িত্বের ঘোষণা।

প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভার নেতৃত্বে ব্রাজিল আবার বৈশ্বিক জলবায়ু রাজনীতিতে সক্রিয় ও নৈতিক ভূমিকা নিতে শুরু করেছে। বিশেষ করে আমাজনে বন উজাড় কমানোর মাধ্যমে ব্রাজিল তার নৈতিক অবস্থানকে পুনরুদ্ধার করেছে। লুলা সরকারের অগ্রাধিকার-জলবায়ু ন্যায়বিচার, আদিবাসী অধিকার এবং দক্ষিণ–দক্ষিণ সহযোগিতা-সম্মেলনের আলোচনায় নতুন মাত্রা যুক্ত করতে পারে।

ব্রাজিল এই সম্মেলনকে এমন একটি পরিসর হিসেবে দেখতে চায় যেখানে বৈশ্বিক দক্ষিণ নির্ধারণমূলক ভূমিকা নিতে পারে, যেখানে জলবায়ু সংকটকে শুধু কার্বন নির্গমনের সংখ্যা দিয়ে নয়, সামাজিক বৈষম্য, ঐতিহাসিক অন্যায় এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর ন্যায্য চাহিদার আলোকে ব্যাখ্যা করা হবে। বেলেম তাই একটি প্রতীকী সম্মেলন নয়, এটি বৈশ্বিক দক্ষিণের নেতৃত্বের এবং জলবায়ু ন্যায়বিচারের মূলনীতি প্রতিষ্ঠার মঞ্চ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরছে।

এই জলবায়ু সম্মেলনের ইতিহাস গড়ার সম্ভাবনা নির্ভর করছে দুটি বড় সংকট মোকাবিলার ওপর-বিশ্বাসের সংকট এবং উচ্চাকাক্সক্ষার সংকট। এই দুটি সংকটের সমাধান না হলে কোনো আলোচনাই ফলপ্রসূ হবে না। প্রথমত, ধনী দেশগুলোর প্রতিশ্রুতি বারবার ভেঙে পড়ায় বৈশ্বিক দক্ষিণের আস্থা গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০১০ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দীর্ঘকাল ধরে পূরণ হয়নি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু অর্থায়ন নিয়ে অস্পষ্টতা, পুরোনো প্রতিশ্রুতির ব্যর্থতা এবং বাস্তব সহযোগিতার পরিবর্তে তথাকথিত ‘চতুর হিসাব’ বা ঋণ-নির্ভর অর্থায়নের প্রবণতা। উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রশ্ন তুলছে, এই সহযোগিতা কি বাস্তব, নাকি কেবলই এক ধরনের ‘ঋণ-ফাঁদ’?

এই সম্মেলন যদি কাঠামোগতভাবে নির্ভরযোগ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি জলবায়ু অর্থায়নের নিশ্চয়তা না দিতে পারে, তাহলে আস্থাহীনতার এই দেয়াল আরও দৃঢ় হবে। নতুন, উচ্চাভিলাষী অর্থায়ন লক্ষ্যমাত্রা (যা বছরে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন) নির্ধারণ করতে হবে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অভিযোজন এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি রূপান্তরে সহায়তা করবে। এটি কেবল অর্থের পরিমাণ নয়, অর্থায়নের ধরন নিয়েও প্রশ্ন-সহযোগিতা নাকি ঋণ? বেলেমকে এই বিতর্কে বৈশ্বিক দক্ষিণের দিকে পাল্লা ভারী করতে হবে।

উচ্চাকাক্সক্ষার সংকট ভিন্ন মাত্রায় জটিল। বৈজ্ঞানিক তথ্য বলছে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে, যদি না জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন দ্রুত এবং ন্যায়সঙ্গতভাবে কমানো হয়। কিন্তু তেল–গ্যাস উৎপাদনকারী দেশগুলো যুক্তি দেয় যে হঠাৎ করেই জীবাশ্ম জ্বালানি পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করবে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর দারিদ্র?্য দূরীকরণের পথে বাধা সৃষ্টি করবে।

পূর্ববর্তী সম্মেলনে জীবাশ্ম জ্বালানি পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার বিষয়ে যে অস্পষ্ট ভাষা গৃহীত হয়েছিল, এই সম্মেলনে তা আবার নতুনভাবে সামনে আসবে। তেল ও গ্যাস উৎপাদনকারী বৃহৎ সংস্থা এবং দেশগুলোর লবিং এই আলোচনাকে বারবার দুর্বল করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্ক, ইউরোপের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা, আর মধ্যম আয়ের দেশগুলোর উন্নয়ন অগ্রাধিকার-এই বহুমুখী বাস্তবতা জলবায়ু প্রক্রিয়াকে বারবার দুর্বল করেছে।

বেলেমের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে এই দ্বন্দ্বের সমাধান-কীভাবে একটি ন্যায়সঙ্গত রূপান্তর নিশ্চিত করা যায়, যা ধনী দেশগুলোকে দ্রুত নির্গমন কমানোর চাপ দেবে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাদের জ্বালানি নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের সুযোগ দেবে। এই সম্মেলন সফল হতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানির ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি স্পষ্ট, সময়সীমা-নির্দিষ্ট এবং বৈজ্ঞানিক ভিত্তিক পথরেখা তৈরি করতে হবে।

বৈশ্বিক দক্ষিণের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন ভবিষ্যৎ নয়, এটি বর্তমান। খাদ্য নিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য, কৃষি, অবকাঠামো-সবকিছুই জলবায়ুর তীব্র আঘাতে নড়বড়ে। অভিযোজন আর ‘দ্বিতীয় শ্রেণির’ আলোচ্য বিষয় থাকতে পারে না; এটিকে মূল রাজনৈতিক এজেন্ডায় আনতে হবে। অভিযোজন প্রক্রিয়ায় স্থানীয় জ্ঞান, আদিবাসী প্রথা এবং সম্প্রদায়ভিত্তিক স্থিতিস্থাপকতাকে এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত করা একটি রূপান্তরমূলক পদক্ষেপ হতে পারে। এর জন্য আন্তর্জাতিকভাবে অভিযোজন অর্থায়নে বড় ধরনের বৃদ্ধি দরকার, যা উন্নত দেশগুলো বহন করবে।

ক্ষতি ও ক্ষয়ক্ষতি তহবিল (লস অ্যান্ড ড্যামেজ) পূর্ববর্তী সম্মেলনে ঐতিহাসিকভাবে সৃষ্টি হলেও এর বাস্তব অর্থায়ন এখনো ন্যূনতম এবং অপ্রতুল। জোরালো প্রত্যাশা হচ্ছে এই সম্মেলনে এমন একটি কাঠামো গৃহীত হবে যা ক্ষতি–ক্ষতির জন্য কার্যকর, নির্ভরযোগ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা নিশ্চিত করবে। এটি যদি কেবল প্রতীকী সিদ্ধান্তে আটকে থাকে, তাহলে আন্তর্জাতিক জলবায়ু শাসনের প্রতি আস্থা আরও ভেঙে পড়বে, এবং গরিব দেশগুলো চরম অবিচারের শিকার হবে।

বেলেমে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি এই সম্মেলনকে অন্যরকম তাৎপর্য দিচ্ছে। আমাজনের রক্ষক হিসেবে তারা পরিবেশ সংরক্ষণে শতাব্দীর অভিজ্ঞতা বহন করেন, অথচ জলবায়ু আলোচনায় বহুবার উপেক্ষিত হয়েছেন। ব্রাজিল এবার তাদেরকে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই প্রতিশ্রুতি যদি বাস্তব ক্ষমতায় রূপ নেয়-যেখানে আদিবাসীরা শুধু বক্তব্যই দেবেন না, বরং নীতি প্রণয়ন, অর্থায়নের সিদ্ধান্ত এবং বন সংরক্ষণের মডেলে সরাসরি প্রভাব ফেলবেন-তাহলে এই সম্মেলন পরিবেশগত ন্যায়বিচারের নতুন অধ্যায় খুলতে পারে। আদিবাসী ভূমির সুরক্ষা কেবল মানবাধিকার নয়, এটি কার্বন সিঙ্ক সংরক্ষণেরও একটি প্রমাণিত বৈজ্ঞানিক কৌশল। তাদের অভিজ্ঞতাকে গ্রহণ করা এই সম্মেলনের নৈতিক বিজয়ের অন্যতম প্রধান মাপকাঠি হবে।

এই জলবায়ু সম্মেলনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বৈশ্বিক অগ্রগতি পর্যালোচনা। প্যারিস চুক্তির পর এটি বৈশ্বিক অগ্রগতি মূল্যায়নের একটি প্রক্রিয়া। এই পর্বে দেশগুলোকে তাদের বর্তমান জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অঙ্গীকারসমূহ পুনর্বিবেচনা করতে হবে এবং বৈজ্ঞানিক প্রয়োজন অনুযায়ী হালনাগাদ করতে হবে। এটি বাস্তব জবাবদিহির একটি মুহূর্ত, যেখানে কথার চেয়ে কার্যকর কর্মপরিকল্পনা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্মেলন সফল হতে হলে দেশগুলোকে এমন পথরেখা তৈরি করতে হবে যা জ্বালানি, শিল্প, পরিবহন, কৃষি-সব ক্ষেত্রে ন্যায়সঙ্গত ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তিক রূপান্তর নিশ্চিত করবে। এই পর্যালোচনা যদি বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফাঁকটি স্পষ্টভাবে তুলে না ধরে এবং ধনী দেশগুলোর ওপর প্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি না করে, তাহলে এই জলবায়ু প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা নিয়ে উত্থাপিত সমালোচনা আরও জোরালো হবে।

মূল প্রশ্ন হলো-বেলেম কি বহুপাক্ষিক জলবায়ু সহযোগিতায় নবজাগরণের সূচনা করবে? নাকি এটি আবারও কর্পোরেট লবিং এবং কূটনৈতিক সৌজন্যের মধ্যে আটকে যাবে? ক্রমবর্ধমানভাবে সমালোচকরা মনে করেন এই ধরনের জলবায়ু সম্মেলন একটি বৈশ্বিক প্রদর্শনীতে পরিণত হয়েছে, যেখানে বাস্তব পরিবর্তনের পরিবর্তে ন্যারেটিভের আধিপত্য থাকে। বেলেম সেই আস্থা পুনর্গঠনের সুযোগ এনে দিয়েছে, কিন্তু তা সম্ভব হবে কেবল তখনই যখন কাঠামোগত সংস্কার, স্বচ্ছতা এবং বৈজ্ঞানিক সত্যের সঙ্গে নৈতিক দায়িত্ব যুক্ত থাকবে। ব্রাজিল তার নিজস্ব নীতিতে যদি শক্তিশালী ও সুসংগত অগ্রগতি দেখাতে পারে, তবে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তার নেতৃত্ব আরও বিশ্বাসযোগ্য হবে। তবে অভ্যন্তরীণ নীতিতে দ্বন্দ্ব বা অসঙ্গতি থেকে গেলে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তার দাবি দুর্বল হবে।

শেষ পর্যন্ত এই সম্মেলনের সাফল্য নির্ভর করছে রাজনৈতিক সাহস, বৈশ্বিক সংহতি, বৈজ্ঞানিক সততা এবং ন্যায়বিচারের প্রতি প্রকৃত প্রতিশ্রুতির ওপর। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রেইন ফরেস্টের দোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে বিশ্বের নেতারা যদি আবারও অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফিরে যান, তাহলে জলবায়ু শাসনব্যবস্থা আরও ক্ষয়িষ্ণু হবে। আর যদি বেলেম থেকে নির্ভরযোগ্য অর্থায়ন, জীবাশ্ম জ্বালানির ভবিষ্যৎ নিয়ে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত, অভিযোজন ও ক্ষতি–ক্ষতি বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ, এবং আদিবাসী ও বৈশ্বিক দক্ষিণকে প্রকৃত নেতৃত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি বেরিয়ে আসে-তাহলে এই সম্মেলন সত্যিই একটি বাঁক নেওয়ার মুহূর্ত হয়ে উঠতে পারে। সময় খুব কম, এবং বেলেম সেই পরিবর্তনের দরজা খুলে দিতে পারে। বিশ্বকে সেই দরজা দিয়ে প্রবেশের সাহস দেখাতে হবে।

[লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

back to top