গৌতম রায়
ভারতের অন্যতম শীর্ষ বাম নেতা মোহাম্মদ সেলিম যে বামপন্থার ‘রিজারেকশনের’ ডাক দিয়েছেন, তাকে মান্যতা দিয়েই সিপিআই(এমএল) লিবারেশন দলটিও বামপন্থার পুনর্জাগরণের কথা বলেছে। রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণের ক্ষেত্রে সেলিম এবং দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের এই কার্যত সমমত হওয়া,নদীতে অনেক জল বয়ে যাওয়ার পর এটা বাংলার ক্ষেত্রে কতা কার্যকরী হবে এবং সেই কার্যকারিতার প্রভাব জাতীয় রাজনীতিতে কতা পড়বে, তা এখন দেখবার বিষয়।
কমিউনিস্ট পার্টি অবিভক্ত থাকার কালে বামপন্থী মানসিকতার যে প্রভাব বাংলার জনমতে পড়ত, তার পেছনে বড় কারণ ছিল সমসাময়িক জীবন–জীবিকা ঘিরে জ্বলন্ত সমস্যাগুলিকে নিয়ে বামপন্থীদের লড়াই। সেই লড়াইয়ের বেশির ভাগটাই হয়েছিল অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারা। পরবর্তীতে সত্তরের দশকের যে আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসপর্ব, তার মোকাবিলায় একমাত্র ভূমিকা ছিল সিপিআই(এম) দলটির। অতি বামেরা তখন ভিন্ন রাজনৈতিক ভাবনার পথিক। সিপিআই হয়ে গেছে কংগ্রেসের লেজুড়। আজ বাম দাবি করা আরএসপি, ফরোয়ার্ড ব্লকের মতো দলগুলোর অবস্থাও তখন তথৈবচ। লড়াইয়ের ময়দানে থাকার চেয়ে সেই সময়ের আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসের মূল সংগঠক কংগ্রেসের সঙ্গেই তাদের বেশি সখ্যতা।
একদা ক্ষমতায় থাকা বামপন্থী এবং কখনো ক্ষমতায় না থাকা বামপন্থী উভয় স্তরেরই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ আজ গোটা ভারতের প্রেক্ষাপট মাথায় রেখেই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করছে বামপন্থার পুনর্জাগরণে। মজার কথা হলো, বাংলার প্রেক্ষাপটে এই দুই শক্তিই দীর্ঘ সময় ধরে প্রয়োগ-জনিত রাজনীতিতে যে ভূমিকা পালন করেছে, তাতে সাধারণ মানুষের বড় একটি অংশ বাস্তব অভিজ্ঞতার নিরিখে বামপন্থা সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছেন। বিরক্ত হয়ে গিয়েছেন। সেই প্রজন্ম কালের নিয়মে প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু সেই প্রজন্মের পরের নবীন প্রজন্ম, আগের প্রজন্মের অভিজ্ঞতার সদর্থক নির্যাস পায়নি; ফলে তারা বাংলার বামপন্থীদের এক বড় অংশ সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল হয়ে বড় হতে পারেনি। এই ঘটনার প্রভাব যেমন বাংলার রাজনীতিতে বামপন্থীদের প্রাসঙ্গিকতার ক্ষতি করেছে, তেমনি জাতীয় রাজনীতিতেও বামপন্থীদের গুরুত্ব কমিয়েছে। যদিও বাংলার নিরিখে ক্ষমতায় না থাকা বামপন্থীরা বিহার রাজ্যের নির্বাচনী সংগ্রামের ময়দানে পাঁচ বছর আগেই নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পেরেছিল এবং দীর্ঘ সময় শাসকের ভূমিকায় থাকা বামপন্থীদের তুলনায় তারা একটি বিশ্বাসযোগ্য অবস্থান গড়ে তুলেছে।
এই ব্যাধির দায় ক্ষমতায় না থাকা বামপন্থীদের,যারা আজ বামপন্থার পুনর্জাগরণে সেলিম-দীপঙ্করের ডাকে সামিল হয়েছেন তাদের প্রত্যেককেই নিতে হচ্ছে। আর সেলিমের মতো পরিচ্ছন্ন ইমেজের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকেও ক্ষমতায় থাকাকালীন বামেদের ভূমিস্থরের কর্মী ও নেতৃত্বের একাংশের কাজের দায় আজ পশ্চিমবঙ্গের বুকে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক বিজেপি এবং প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক তৃণমূল করে খাওয়ার যে সুযোগ তৈরি করেছে, সেই দায় খানিকটা হলেও তাকে ও তার এই সময়ের সহযোদ্ধাদের বইতে হচ্ছে।
এই পর্যায়গুলো এখন সাধারণ মানুষের কতা বিবেচনার মধ্যে আছে, পশ্চিমবঙ্গের আমজনতার দিকে তাকালে তা ঘিরে একটা সংশয় তৈরি হয়। সংশয় এই কারণে যে, বামফ্রন্টভুক্ত বামপন্থীরা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলেও পশ্চিমবঙ্গে বাম মতাদর্শগত মনমানসিকতা আদৌ কতা তৈরি হয়েছিল, তা ঘিরে যুক্তিগ্রাহ্য বিতর্ক থেকেই যায়।
ভোটে জিততে থাকা এটাকেই যদি বামপন্থার জয়ের মানদ- ধরা হয়, তাহলে বলতে হয় নির্ধারকদের বামপন্থা সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণাই তৈরি হয়নি। বামপন্থীদের বাইরের অসাম্প্রদায়িক শিবিরের কথায় আবার বলতে হয় ,ভারতে ’৪৭-পরবর্তী সময়ে গণতন্ত্র যেভাবে বিকাশ লাভ করেছে, একটি ব্যক্তি বা একটি পরিবারের ‘কারিশমা’ বেশির ভাগ সময়েই মতাদর্শের চেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে এই ক্যারিশমার প্রসঙ্গ নেহরু, ইন্দিরা, রাজীব থেকে জ্যোতি বসু সবার ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য।
নেহরু-ইন্দিরার যে ভোট-টানবার ক্যারিশমা ছিল, সেটা ব্যক্তি-কেন্দ্রিকই হোক বা পরিবার-কেন্দ্রিকই হোক সেই ক্যারিশমা কখনো ভারতীয় রাজনীতিতে কোনো বোধের জায়গা নির্মাণ করতে পারেনি। আবেগ তৈরি করেছে, রাজনৈতিক সচেতনতা নয়।
একই কথা প্রযোজ্য জ্যোতি বসুর ক্ষেত্রেও। জ্যোতি বসুর রাজনৈতিক জীবনের বড় অংশ যখন তিনি পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী রাজনীতির আইকন ছিলেন,সেই সময়ের তার ভোটক্যাচার ক্যারিশমা কিংবা পরবর্তী সময়ে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তার সাফল্য এসবই তিনি যে মতাদর্শে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অবিচল ছিলেন, সেই মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে কোনো উল্লেখযোগ্য সাফল্য এনে দিতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ জ্যোতিবাবুর পরিমন্ডলের বামপন্থা শাসনক্ষমতায় থাকার সময় ভূমিস্থরে পরিপূর্ণ হয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল এমনটা ভাবার কারণ নেই।
মানুষের একটি বড় অংশের প্রবণতা হলো-চিরদিন শাসক দলের লোক হয়ে থাকা। মুখ্যমন্ত্রীত্বকালে জ্যোতিবাবুর পরিম-লের বাম মনমানসিকতার বড় অংশ তখন ব্যস্ত হয়ে পড়ল শাসনক্ষমতায় টিকে থাকার লক্ষ্যে। দলীয় বৃত্তকে ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ করে ফেলবার প্রবণতা তৈরি হলো। কারখানার শ্রমিক, ভূমিহীন চাষি, রিকশাচালক,এই শ্রমিক–কৃষক–মেহনতি জনগণের সঙ্গে একজন প্রোমোটার কখনোই কমিউনিস্ট পার্টির অন্দরমহলের লোক হতে পারে না এই উপলব্ধি যখন এলো, তখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে।
ফলে দেখা গেল-মনমানসিকতায় যারা আদৌ বাম নন, এমনকি দক্ষিণপন্থী বা সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন তারাও রাষ্ট্রক্ষমতার কারণে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী বাম শিবিরে ঢুকে পড়লেন।
অন্যদিকে বামফ্রন্টের বাইরে থাকা বাম দলগুলোর একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়াল বামফ্রন্ট, বিশেষ করে সিপিআই(এম)-এর বিরোধিতা করা। এক্ষেত্রে বলতে হয়-বামফ্রন্টভুক্ত দলের কয়েকজন নেতা হরকিষাণ সিং সুরজিত, জ্যোতি বসু, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, গীতা মুখোপাধ্যায়, সীতারাম ইয়েচুরি, মোহাম্মদ সেলিম, সইফুদ্দিন চৌধুরী এই হাতেগোনা মানুষ ছাড়া আরএসএস–বিজেপির বিপদকে বাবরি মসজিদ ধ্বংস-পরবর্তী সময়েও, এমনকি এনডিএ সরকার গঠনের পরও বেশির ভাগ বাম নেতা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেননি বা এড়িয়ে গেছেন।
বামফ্রন্টের বাইরে থাকা সিপিআই(এমএল) লিবারেশন দলেরও সূচনাপর্বে বিজেপির কর্মকা- পুরোপুরি অনুধাবন ছিল না। তাদের রাজনৈতিক বিবর্তনের আগে পর্যন্ত সিপিআই(এম) বিরোধিতাই ছিল মূল লক্ষ্য। তারা মনে করতেন বামপন্থার তারা-ই একমাত্র জিম্মাদার; বাকি বাম দল বামপন্থার অ-আ-ক-খ বোঝে না। ভোট-রাজনীতিতে গিয়ে চরিত্র হারিয়েছে।
তাই অতি বাম দাবি করা অনেকের কাছে সিপিআই(এম) বিরোধিতাই ছিল একমাত্র রাজনৈতিক কর্তব্য। মনসামঙ্গলের চাঁদ সৌদাগরের মনসাপুজোর মতো সামান্য কংগ্রেস বিরোধিতা করেও, তারা সমস্ত আক্রমণের দিক নির্ধারণ করতেন সিপিআই(এম)-এর দিকে।
অন্যদিকে, সিপিআই(এম)-এর তাত্ত্বিক রাজনীতির চর্চাকারীদের বড় অংশের ইতিহাসচর্চা অতিমাত্রায় অতীত নির্ভর ছিল। এই প্রবণতা বৃহত্তর বাম ঐক্য গঠনে বাধা দিয়েছে।
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন দলের অনেক বিবর্তন হয়েছে। বর্তমান সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য ভারতের জাতীয় পরিস্থিতির মূল্যায়নে বিজেপি–আরএসএস এবং গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবিরের বিপদ সম্পর্কে অত্যন্ত সঠিক মূল্যায়ন তৈরি করেছেন। যদিও বিজেপির রাজনৈতিক দর্শন ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা,এর অন্তর্গত প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে তার বিশ্লেষণ হিন্দুত্ববাদীদের প্রতিহত করার সঠিক দিশা দেখায় না। কারণ হিন্দুত্ববাদীরা যেখানে পারে না, সেখানে তারা ‘বি-টিম’ তৈরি করে নেয়।
যেমন উড়িষ্যায় নবীন পট্টনায়কের দল বিজু জনতা দলকে দীর্ঘসময় তারা প্রকাশ্যে–গোপনে ব্যবহার করেছে। বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রীত্বকালে উড়িষ্যার আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় খ্রিষ্টান সংখ্যালঘুদের ওপর সঙ্ঘ পরিবারের হামলার নজির আছে। নবীনবাবুর দল একসময় ক্ষমতায় থাকতে এনডিএর সঙ্গেও থেকেছে। আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতোই এনডিএ ছেড়েছেন। কিন্তু তার রাজ্যে সঙ্ঘ পরিবারের বিস্তারের বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেননি। এর ফলেই বিজেপির সুবিধে করেও নবীনবাবু ক্ষমতায় টিকতে পারেননি। ছলে–কৌশলে বিজেপি তাকে উৎখাত করেছে।
উড়িষ্যায় বিজেপির ক্ষমতা দখল প্রক্রিয়া এবং পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো-দুর্নীতির প্রশ্নে নবীনবাবু সবসময় সতর্ক ছিলেন। ফলে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর থেকে চিটফান্ড, নারদা–সারদা কেলেঙ্কারি, শিক্ষা দুর্নীতি, আরজিকর কান্ডে যে লাগামহীন দুর্নীতির দৃশ্য দেখা গেছ উড়িষ্যায় তার পুনরাবৃত্তি হয়নি।
বামপন্থী নেতৃত্বের ইতিবাচক ও বাস্তবানুগ বদল আমরা বুঝতে পারি সিপিআই(এম)-এর পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব মোহাম্মদ সেলিম এবং সিপিআই(এমএল) লিবারেশন-এর সর্বোচ্চ নেতৃত্ব দীপঙ্করের সাম্প্রতিক বক্তব্য থেকে। বামপন্থার পুনর্জাগরণের ভাবনাকে বাস্তবায়ন করতে গেলে সেলিমের দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদেরই ছয়ের দশকে সিপিআই(এম) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে লিবারেশন ধারার পূর্বসূরীদের অতীত নির্ভর সমালোচনা-বিষোদ্গার বন্ধ করতে হবে। তেমনি দীপঙ্করবাবু ও তার সতীর্থদের আরএসএসের ইশারায় বিজেপির জঠরে জন্ম নেওয়া তৃণমূল কংগ্রেসকে অন্য অবিজেপি দলের সঙ্গে একই বন্ধনিতে রাখা চলবে না। কেবল দুর্নীতি নয়, সাম্প্রদায়িক বিভাজনের প্রশ্নেও পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে বিজেপিকে আবার শক্তিবৃদ্ধির সুযোগ দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-যিনি প্রায় সাড়ে ছয় বছর বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। তাকে ‘অ-বিজেপি’ দল বলে শংসাপত্র দিলে ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরকেই দায়ের ভাগীদার করা হয় ,এটাও চলবে না।
[লেখক: ভারতীয় ইতিহাসবিদ]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
গৌতম রায়
বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫
ভারতের অন্যতম শীর্ষ বাম নেতা মোহাম্মদ সেলিম যে বামপন্থার ‘রিজারেকশনের’ ডাক দিয়েছেন, তাকে মান্যতা দিয়েই সিপিআই(এমএল) লিবারেশন দলটিও বামপন্থার পুনর্জাগরণের কথা বলেছে। রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণের ক্ষেত্রে সেলিম এবং দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের এই কার্যত সমমত হওয়া,নদীতে অনেক জল বয়ে যাওয়ার পর এটা বাংলার ক্ষেত্রে কতা কার্যকরী হবে এবং সেই কার্যকারিতার প্রভাব জাতীয় রাজনীতিতে কতা পড়বে, তা এখন দেখবার বিষয়।
কমিউনিস্ট পার্টি অবিভক্ত থাকার কালে বামপন্থী মানসিকতার যে প্রভাব বাংলার জনমতে পড়ত, তার পেছনে বড় কারণ ছিল সমসাময়িক জীবন–জীবিকা ঘিরে জ্বলন্ত সমস্যাগুলিকে নিয়ে বামপন্থীদের লড়াই। সেই লড়াইয়ের বেশির ভাগটাই হয়েছিল অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারা। পরবর্তীতে সত্তরের দশকের যে আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসপর্ব, তার মোকাবিলায় একমাত্র ভূমিকা ছিল সিপিআই(এম) দলটির। অতি বামেরা তখন ভিন্ন রাজনৈতিক ভাবনার পথিক। সিপিআই হয়ে গেছে কংগ্রেসের লেজুড়। আজ বাম দাবি করা আরএসপি, ফরোয়ার্ড ব্লকের মতো দলগুলোর অবস্থাও তখন তথৈবচ। লড়াইয়ের ময়দানে থাকার চেয়ে সেই সময়ের আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসের মূল সংগঠক কংগ্রেসের সঙ্গেই তাদের বেশি সখ্যতা।
একদা ক্ষমতায় থাকা বামপন্থী এবং কখনো ক্ষমতায় না থাকা বামপন্থী উভয় স্তরেরই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ আজ গোটা ভারতের প্রেক্ষাপট মাথায় রেখেই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করছে বামপন্থার পুনর্জাগরণে। মজার কথা হলো, বাংলার প্রেক্ষাপটে এই দুই শক্তিই দীর্ঘ সময় ধরে প্রয়োগ-জনিত রাজনীতিতে যে ভূমিকা পালন করেছে, তাতে সাধারণ মানুষের বড় একটি অংশ বাস্তব অভিজ্ঞতার নিরিখে বামপন্থা সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছেন। বিরক্ত হয়ে গিয়েছেন। সেই প্রজন্ম কালের নিয়মে প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু সেই প্রজন্মের পরের নবীন প্রজন্ম, আগের প্রজন্মের অভিজ্ঞতার সদর্থক নির্যাস পায়নি; ফলে তারা বাংলার বামপন্থীদের এক বড় অংশ সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল হয়ে বড় হতে পারেনি। এই ঘটনার প্রভাব যেমন বাংলার রাজনীতিতে বামপন্থীদের প্রাসঙ্গিকতার ক্ষতি করেছে, তেমনি জাতীয় রাজনীতিতেও বামপন্থীদের গুরুত্ব কমিয়েছে। যদিও বাংলার নিরিখে ক্ষমতায় না থাকা বামপন্থীরা বিহার রাজ্যের নির্বাচনী সংগ্রামের ময়দানে পাঁচ বছর আগেই নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পেরেছিল এবং দীর্ঘ সময় শাসকের ভূমিকায় থাকা বামপন্থীদের তুলনায় তারা একটি বিশ্বাসযোগ্য অবস্থান গড়ে তুলেছে।
এই ব্যাধির দায় ক্ষমতায় না থাকা বামপন্থীদের,যারা আজ বামপন্থার পুনর্জাগরণে সেলিম-দীপঙ্করের ডাকে সামিল হয়েছেন তাদের প্রত্যেককেই নিতে হচ্ছে। আর সেলিমের মতো পরিচ্ছন্ন ইমেজের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকেও ক্ষমতায় থাকাকালীন বামেদের ভূমিস্থরের কর্মী ও নেতৃত্বের একাংশের কাজের দায় আজ পশ্চিমবঙ্গের বুকে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক বিজেপি এবং প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক তৃণমূল করে খাওয়ার যে সুযোগ তৈরি করেছে, সেই দায় খানিকটা হলেও তাকে ও তার এই সময়ের সহযোদ্ধাদের বইতে হচ্ছে।
এই পর্যায়গুলো এখন সাধারণ মানুষের কতা বিবেচনার মধ্যে আছে, পশ্চিমবঙ্গের আমজনতার দিকে তাকালে তা ঘিরে একটা সংশয় তৈরি হয়। সংশয় এই কারণে যে, বামফ্রন্টভুক্ত বামপন্থীরা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলেও পশ্চিমবঙ্গে বাম মতাদর্শগত মনমানসিকতা আদৌ কতা তৈরি হয়েছিল, তা ঘিরে যুক্তিগ্রাহ্য বিতর্ক থেকেই যায়।
ভোটে জিততে থাকা এটাকেই যদি বামপন্থার জয়ের মানদ- ধরা হয়, তাহলে বলতে হয় নির্ধারকদের বামপন্থা সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণাই তৈরি হয়নি। বামপন্থীদের বাইরের অসাম্প্রদায়িক শিবিরের কথায় আবার বলতে হয় ,ভারতে ’৪৭-পরবর্তী সময়ে গণতন্ত্র যেভাবে বিকাশ লাভ করেছে, একটি ব্যক্তি বা একটি পরিবারের ‘কারিশমা’ বেশির ভাগ সময়েই মতাদর্শের চেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে এই ক্যারিশমার প্রসঙ্গ নেহরু, ইন্দিরা, রাজীব থেকে জ্যোতি বসু সবার ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য।
নেহরু-ইন্দিরার যে ভোট-টানবার ক্যারিশমা ছিল, সেটা ব্যক্তি-কেন্দ্রিকই হোক বা পরিবার-কেন্দ্রিকই হোক সেই ক্যারিশমা কখনো ভারতীয় রাজনীতিতে কোনো বোধের জায়গা নির্মাণ করতে পারেনি। আবেগ তৈরি করেছে, রাজনৈতিক সচেতনতা নয়।
একই কথা প্রযোজ্য জ্যোতি বসুর ক্ষেত্রেও। জ্যোতি বসুর রাজনৈতিক জীবনের বড় অংশ যখন তিনি পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী রাজনীতির আইকন ছিলেন,সেই সময়ের তার ভোটক্যাচার ক্যারিশমা কিংবা পরবর্তী সময়ে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তার সাফল্য এসবই তিনি যে মতাদর্শে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অবিচল ছিলেন, সেই মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে কোনো উল্লেখযোগ্য সাফল্য এনে দিতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ জ্যোতিবাবুর পরিমন্ডলের বামপন্থা শাসনক্ষমতায় থাকার সময় ভূমিস্থরে পরিপূর্ণ হয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল এমনটা ভাবার কারণ নেই।
মানুষের একটি বড় অংশের প্রবণতা হলো-চিরদিন শাসক দলের লোক হয়ে থাকা। মুখ্যমন্ত্রীত্বকালে জ্যোতিবাবুর পরিম-লের বাম মনমানসিকতার বড় অংশ তখন ব্যস্ত হয়ে পড়ল শাসনক্ষমতায় টিকে থাকার লক্ষ্যে। দলীয় বৃত্তকে ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ করে ফেলবার প্রবণতা তৈরি হলো। কারখানার শ্রমিক, ভূমিহীন চাষি, রিকশাচালক,এই শ্রমিক–কৃষক–মেহনতি জনগণের সঙ্গে একজন প্রোমোটার কখনোই কমিউনিস্ট পার্টির অন্দরমহলের লোক হতে পারে না এই উপলব্ধি যখন এলো, তখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে।
ফলে দেখা গেল-মনমানসিকতায় যারা আদৌ বাম নন, এমনকি দক্ষিণপন্থী বা সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন তারাও রাষ্ট্রক্ষমতার কারণে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী বাম শিবিরে ঢুকে পড়লেন।
অন্যদিকে বামফ্রন্টের বাইরে থাকা বাম দলগুলোর একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়াল বামফ্রন্ট, বিশেষ করে সিপিআই(এম)-এর বিরোধিতা করা। এক্ষেত্রে বলতে হয়-বামফ্রন্টভুক্ত দলের কয়েকজন নেতা হরকিষাণ সিং সুরজিত, জ্যোতি বসু, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, গীতা মুখোপাধ্যায়, সীতারাম ইয়েচুরি, মোহাম্মদ সেলিম, সইফুদ্দিন চৌধুরী এই হাতেগোনা মানুষ ছাড়া আরএসএস–বিজেপির বিপদকে বাবরি মসজিদ ধ্বংস-পরবর্তী সময়েও, এমনকি এনডিএ সরকার গঠনের পরও বেশির ভাগ বাম নেতা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেননি বা এড়িয়ে গেছেন।
বামফ্রন্টের বাইরে থাকা সিপিআই(এমএল) লিবারেশন দলেরও সূচনাপর্বে বিজেপির কর্মকা- পুরোপুরি অনুধাবন ছিল না। তাদের রাজনৈতিক বিবর্তনের আগে পর্যন্ত সিপিআই(এম) বিরোধিতাই ছিল মূল লক্ষ্য। তারা মনে করতেন বামপন্থার তারা-ই একমাত্র জিম্মাদার; বাকি বাম দল বামপন্থার অ-আ-ক-খ বোঝে না। ভোট-রাজনীতিতে গিয়ে চরিত্র হারিয়েছে।
তাই অতি বাম দাবি করা অনেকের কাছে সিপিআই(এম) বিরোধিতাই ছিল একমাত্র রাজনৈতিক কর্তব্য। মনসামঙ্গলের চাঁদ সৌদাগরের মনসাপুজোর মতো সামান্য কংগ্রেস বিরোধিতা করেও, তারা সমস্ত আক্রমণের দিক নির্ধারণ করতেন সিপিআই(এম)-এর দিকে।
অন্যদিকে, সিপিআই(এম)-এর তাত্ত্বিক রাজনীতির চর্চাকারীদের বড় অংশের ইতিহাসচর্চা অতিমাত্রায় অতীত নির্ভর ছিল। এই প্রবণতা বৃহত্তর বাম ঐক্য গঠনে বাধা দিয়েছে।
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন দলের অনেক বিবর্তন হয়েছে। বর্তমান সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য ভারতের জাতীয় পরিস্থিতির মূল্যায়নে বিজেপি–আরএসএস এবং গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবিরের বিপদ সম্পর্কে অত্যন্ত সঠিক মূল্যায়ন তৈরি করেছেন। যদিও বিজেপির রাজনৈতিক দর্শন ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা,এর অন্তর্গত প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে তার বিশ্লেষণ হিন্দুত্ববাদীদের প্রতিহত করার সঠিক দিশা দেখায় না। কারণ হিন্দুত্ববাদীরা যেখানে পারে না, সেখানে তারা ‘বি-টিম’ তৈরি করে নেয়।
যেমন উড়িষ্যায় নবীন পট্টনায়কের দল বিজু জনতা দলকে দীর্ঘসময় তারা প্রকাশ্যে–গোপনে ব্যবহার করেছে। বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রীত্বকালে উড়িষ্যার আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় খ্রিষ্টান সংখ্যালঘুদের ওপর সঙ্ঘ পরিবারের হামলার নজির আছে। নবীনবাবুর দল একসময় ক্ষমতায় থাকতে এনডিএর সঙ্গেও থেকেছে। আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতোই এনডিএ ছেড়েছেন। কিন্তু তার রাজ্যে সঙ্ঘ পরিবারের বিস্তারের বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেননি। এর ফলেই বিজেপির সুবিধে করেও নবীনবাবু ক্ষমতায় টিকতে পারেননি। ছলে–কৌশলে বিজেপি তাকে উৎখাত করেছে।
উড়িষ্যায় বিজেপির ক্ষমতা দখল প্রক্রিয়া এবং পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো-দুর্নীতির প্রশ্নে নবীনবাবু সবসময় সতর্ক ছিলেন। ফলে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর থেকে চিটফান্ড, নারদা–সারদা কেলেঙ্কারি, শিক্ষা দুর্নীতি, আরজিকর কান্ডে যে লাগামহীন দুর্নীতির দৃশ্য দেখা গেছ উড়িষ্যায় তার পুনরাবৃত্তি হয়নি।
বামপন্থী নেতৃত্বের ইতিবাচক ও বাস্তবানুগ বদল আমরা বুঝতে পারি সিপিআই(এম)-এর পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব মোহাম্মদ সেলিম এবং সিপিআই(এমএল) লিবারেশন-এর সর্বোচ্চ নেতৃত্ব দীপঙ্করের সাম্প্রতিক বক্তব্য থেকে। বামপন্থার পুনর্জাগরণের ভাবনাকে বাস্তবায়ন করতে গেলে সেলিমের দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদেরই ছয়ের দশকে সিপিআই(এম) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে লিবারেশন ধারার পূর্বসূরীদের অতীত নির্ভর সমালোচনা-বিষোদ্গার বন্ধ করতে হবে। তেমনি দীপঙ্করবাবু ও তার সতীর্থদের আরএসএসের ইশারায় বিজেপির জঠরে জন্ম নেওয়া তৃণমূল কংগ্রেসকে অন্য অবিজেপি দলের সঙ্গে একই বন্ধনিতে রাখা চলবে না। কেবল দুর্নীতি নয়, সাম্প্রদায়িক বিভাজনের প্রশ্নেও পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে বিজেপিকে আবার শক্তিবৃদ্ধির সুযোগ দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-যিনি প্রায় সাড়ে ছয় বছর বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। তাকে ‘অ-বিজেপি’ দল বলে শংসাপত্র দিলে ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরকেই দায়ের ভাগীদার করা হয় ,এটাও চলবে না।
[লেখক: ভারতীয় ইতিহাসবিদ]