alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

অস্থির সময় ও অস্থির সমাজের পাঁচালি

শেখর ভট্টাচার্য

: বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫
image

সময় বদলে যাচ্ছে। সমাজের ভেতরের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ধরন-ধারণও সমান তালে দ্রুত ভিন্ন রূপ ধারণ করছে। এক সময় ধারণা ছিলো অর্থনৈতিক বৈষম্য সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ যখন সম্পদে পরিপূর্ণ থাকে এবং অন্য অংশটি শোষণ-দারিদ্র যে ক্রমাগত বন্দী হতে থাকে, সমাজে তখন অসন্তোষ ও হতাশা সৃষ্টি হয়। এই হতাশা থেকেই অস্থিরতার জন্ম। সাম্প্রতিক কালে ধারণাটিও বদলে যাচ্ছে ক্রমাগত। সমাজের যেসব শক্তি ক্ষমতার লড়াইয়ে ব্যস্ত তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য সৃষ্ট সামজিক প্রতিক্রিয়াই আসলে সামজিক অস্থিরতার পালে হাওয়া দিতে থাকে। সামজিক অস্থিরতা যারা তৈরি করেন তাদেরকে আমরা দেখতে পাই না। তারা মঞ্চের পেছনে সুতা ধরে রাখেন খুব সাবধানে। কথাটি নতুন নয়। সকল কালেই এরকম প্রক্রিয়া চলমান ছিলো। অস্থিরতার মাত্রা অদৃশ্য শক্তির দল দ্বারাই নির্ধারিত হয়। অস্থিরতার পরিকল্পনা, বাস্তবায়নের জন্য কৌশল নির্ধারক দল আছে। দলের সামনে দল, তার সামনে কর্মী দল। কর্মী দলের মিছিল দেখে আমরা ভুল করি। দড়িকে সাপ ভাবি। বিভ্রান্ত হই। আমরা আসলে যা দেখি তা কিন্তু সত্য নয়, যা দেখিনা তা হলো আসল সত্য। আমরা দেখি নির্দেশিত মানুষদের। নির্দেশদাতাদের দেখতে পাই না। প্রতিটি আন্দোলন শেষে নাগরিকেরা কিছুটা হতাশ হয়। হতাশার মাত্রা সইতে সইতে একসময় হতাশা গ্রহণযোগ্য মাত্রায় পৌঁছে যায়। তখন আমরা বলি সমাজে নীরবতার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। তেরশত নদীর দেশে জোয়ার ভাটার মতো নীরবতা বেশি দিন স্থায়ী হয় না। জেগে ওঠে মানুষ বারবার। দুঃখের বিষয় হলো, আন্দোলনের কেন্দ্রের মানুষ বারবার বৃত্তের বাইরে চলে যায়। আবার ফিরে আসার চেষ্টা। মানব সভ্যতার ইতিহাসও একই রকম। তবে আমাদের কোমল মাটির এই দেশের প্রান্তিকেরা বোধ হয় একটু বেশি অভাগা।

ফিরে আসি সমাজের বদলে যাওয়ার প্রসঙ্গে। বদলে যাওয়া সমাজে, বদলে যাওয়া বাংলাদেশে রাতভর মিছিল, মিটিং। আমরা যারা ঊনসত্তর, একাত্তর দেখেছি। আমাদের কাছে প্রজন্মান্তরের রাতের আন্দোলন, সংগ্রাম কিছুটা বেমানান মনে হয়। এটি বোধহয় সময়ের সাথে তাল না মিলাতে পারার দুর্বলতা। তবে এরকম সামাজিক, রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখে আমরা অভ্যস্থ নই। আগুন দিয়ে পুড়ে ফেলা হচ্ছে নানা স্থাপনা। পেট্রোল বোমা দেয়া হচ্ছে বাসে। মবাতংক কখনো কখনো বোমাতংকের থেকেও ভয়ানক। একসময় বলা হতো মব জাস্টিস। প্রচলিত আইনে সুবিচার না পাওয়ার আশঙ্কা থেকে জনগণ নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে নিষ্ঠুর বিচার প্রক্রিয়ার আয়োজন করতো। এরকম নিষ্ঠুর বিচার করার প্রক্রিয়াকে মবজাস্টিস বলা হতো। এখন আর কেউ মবজাস্টিস বলছেনা। মবজাস্টিস মব সহিংসতায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে। নীরব চাঁদাবাজি সফল না হলে, তখন মব তৈরি করা হয়। ভেঙ্গে দেবো, গুড়িয়ে দেবো, পুড়িয়ে দেবো। চাহিদা মাফিক চাঁদা পেলে বিলকুল ঠিক করে দেবো। না পেলে তকমা সেটে দেয়া হবে গায়ে। যে তকমার রাজনীতি পরিবর্তনের জন্য এতো বড় আন্দোলন, সেই তকমা বসানো কিন্তু চলমান। জুলাই আন্দোলনের পূর্বের তকমা শুধু নাম পরিবর্তন করেছে। চাঁদাবাজি, দখলবাজি একরকমই আছে। ব্যবসা দখল, টিভি চ্যানেল দখল, সংবাদপত্র দখল, বাড়ি দখল, গাড়ি দখল, রাজনৈতিক দলের অফিস দখল। দখলীকরণ প্রক্রিয়া একইভাবে চলছে। জনপ্রিয় দলের একজন বটবৃক্ষ নেতাতো পলাতক ব্যবসায়ীর পুরো পরিবহন গিলে খেয়ে বলছেন “হেফাজতে রাখলাম”। এরকম হেফাজতে নানাভাবে নানাজন নানা কিছু রাখছেন। কার জানমাল কেনো, কী কারণে হেফাজতে রাখছেন তা’ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা জানতে পারছি না। হঠাৎ দু-একটা হেফাজতের গোপন খবর প্রকাশ্যে আসলে কিছুটা হৈচৈ হয় এরপর অল কোয়ায়েট ইন দ্য অল ফ্রন্ট। কীভাবে সব শান্ত হয়ে যায়, সে এক অপার বিস্ময়।

অস্থির সময় ও অস্থির সমাজের মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সময় অস্থির হয় সমাজ অস্থির হয় বলে। সমাজ অস্থির হয় রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে। এটি হলো যুক্তিবিদ্যার কার্যকারণ সম্পর্ক বা কজ-ইফেক্ট রিলেশন। সময় কি স্বয়ংক্রীয় ভাবে অস্থির হয়? নিশ্চয় তার পেছনেও কার্যকারণ সম্পর্ক আছে। এরকম কারণের কারণ খুঁজতে গেলে লেখাটি গবেষণাপত্র হয়ে যাবে। পেছনের কার্যকারণ সম্পর্ক খোঁজার জন্য প্রক্রিয়া মাফিক গবেষণার খুব প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তবে অধিকাংশ নাগরিক ভাবছেন সব রোগের একমাত্র ভেষজ ঔষধ হলো নির্বাচন। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বলা হয় মকরধ্বজ, এলোপ্যাথিকে কোরামিন। শুনেছি সব ঔষধ ব্যর্থ হয়ে গেলে শেষ ভরসা কোরামিন। অধিকাংশ নাগরিক ভাবছেন গণ-প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়ে আসলে, সব মুশকিল আসান হয়ে যাবে। অধিকাংশ মানুষ মনে করছেন নির্বাচন হয়ে গেলে ম্যাজিকেলি সব ঠিক হয়ে যাবে। অস্থির, অসচ্ছ্ব জলরাশি স্বচ্ছ্ব এবং স্থির হয়ে যাবে। ঘোলা পানিতে মাছ ধরার সুযোগ আর থাকবে না। মবের দল সুবোধ বালক হয়ে চুলে তেল দিয়ে বইপত্তর বগলে নিয়ে স্কুলে যাবে। এরকম আশা পোষণ করা ভালো। সব ব্যবস্থা ঠিক রেখে, এরকম সোনারকাঠি, রূপারকাঠির মতো নির্বাচন কি জমে থাকা এতো জঞ্জাল পরিস্কার করতে পারবে? মঞ্চের কুশীলব, পেছনের কুশীলবদের মধ্যে খুব কি বড় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে? এস্টাব্লিশমেন্টের পক্ষের লোক এবং এস্টাব্লিশমেন্টকে ঠিক রেখে বড় পরিবর্তনের আশা করা কি খুব বাস্তবসম্মত? আমাদের মতো অতিসাধারণ মানুষের পক্ষে বুঝতে বড় কষ্ট হয়। নয়া বন্দোবস্তের আলাপ শুনে বড় আশাবাদী হয়েছিলাম। এর সাথে ষাট, সত্তর দশকের মানুষ হিসেবে আমাদের সময়ের কাক্সিক্ষত স্বপ্ন বৈষম্য নিরসনের স্লোগান শুনে কিছুটা নড়েচড়ে উঠেছিলাম।

আমরা যতোই নড়াচড়া করি না কেনো, মঞ্চের পেছনের কুশীলবদের মনে কী ছিলো, কী আছে সেটি হলো আসল কথা। পেছনের কুশীলবরা দুরদর্শী, কুশলীও বলা যায়। তারা অতি উচ্চমার্গের দার্শনিক। সাধারণ মানুষ যা দেখতে পায় না তা দেখতে পান দার্শনিকেরা। এই অর্থে তারা সকলেই দার্শনিক। সমাজের উপর তাদের নানারকম নিয়ন্ত্রণ থাকে। রাজনীতির নামে তারা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। তারা যা করেন সব কিছুই জনতার নামে। সকলেই বলেন জনগণ এটা চায়, জনমতের ওপর ভিত্তি করে আমরা মার্কেট পুড়িয়ে দিলাম। সকল কিছুর পেছনেই জনগণ। আউল, বাউল, ফকির, সন্ন্যাসীদের লম্বা চুল কাটবেন। তাদেরকে গাছের সাথে বেঁধে দস্যুর মতো চুল কেটে দেয়া হলো সমাজ বিপ্লব। মানিকগঞ্জে দেখলাম বাউলদেরকে চোর, দুস্কৃতিকারীদের মতো ধাওয়া দেয়া হচ্ছে। সংসার বিরাগী এসব মানুষ অসহায় হয়ে নদী, খাল, পুকুরে ঝাপ দিয়ে প্রাণ বাঁচাচ্ছেন। এসব দৃশ্য যখন বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে দেখা যায় তখন মনে হয়- এটি কি আমাদের সমাজ? এটি হাসন, লালন, রাধারমন, আরকুম শাহ, সহিফা বানুর বাংলাদেশ?

নবান্ন অনুষ্ঠান করতে পারবেন না, নিরাপত্তার অজুহাতে। নবান্ন তো কৃষকের অনুষ্ঠান। পৃথিবীর কোন জাতি শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে নিজেদের গৌরবময়, আবাহমান কালের অনুষ্ঠাণকে পরিত্যাগ করবে, এটি ভাবা যায়। ঐতিহ্য খুড়ে বের করা হলো সভ্যসমাজের মানূষের কর্তব্য। আমরা আমাদের চর্চিত ঐতিহ্যকে রাজনীতির নোংরামিতে ডুবিয়ে দিচ্ছি অস্থিরতা দিয়ে। এই যে অস্থিরতা, সামজিক বিশৃঙ্খলা এর অন্তর্নিহিত কারণ কী? যারা আমাদের দ্বার রুদ্ধ করে দিচ্ছেন, তারা এর সুনির্দিষ্ট কারণ বলতে পারছেন-না, কিংবা বলছেন না। সমাজে ভুল বুঝাবুঝি তৈরি হচ্ছে। বিভাজন সৃষ্টি হচ্ছে। এই বিভাজন কী জাতি হিসেবে আমাদের শক্তিশালী, সংহত করছে? জাতি হিসেবে আমরা যতো দুর্বল হবো, ততোই লাভবান হচ্ছে জাতীয়, আন্তর্জাতিক অশুভ শক্তির।

সামাজিক অস্থিরতা একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক সমস্যা। যদিও এটি একটি বহুমাত্রিক সমস্যা তবে এর নিয়ন্ত্রক হচ্ছে রাজনৈতিক ব্যবস্থা। রাজনীতিকে পরিশুদ্ধ না করলে সামাজিক সমস্যার সমাধান কোন ভাবেই সম্ভব নয়। আমরা রাজনীতিতে অন্তর্ভুক্তির কথা বলছি প্রতিনিয়ত। আমরা যতো বলছি অন্তর্ভুক্তির কথা তত দ্রুত হ্রাস করে দিচ্ছি প্রান্তিক মানুষের প্রতিনিধিত্ব।

বিশুদ্ধ গণতন্ত্র চর্চা সোনার হরিণে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্র শাসকদের ক্ষমতায় লাগাম টেনে ধরে। শাসিতদের অধিকতর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। গণতন্ত্র সকল ব্যবস্থাকে গণমুখী করে তুলে। গণতন্ত্র স্বাধীন বিচারব্যবস্থা এবং জবাবদিহিমূলক শাসন ও অর্জিত সম্পদের মালিকানার নিশ্চয়তা দেয়। এর জন্য প্রয়োজন নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। নতুন বন্দোবস্তের আলাপকে এখন প্রলাপের মতো মনে হয়। আগামী নির্বাচনে নতুন বন্দোবস্ত চাই। মনে রাখতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির জন্য গণতন্ত্র একটি অপরিহার্য রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। আমরা কি এবার সে পথে হাঁটবো?

[লেখক: প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

ভারতে বামপন্থার পুনর্জাগরণ: ব্যাধি ও প্রতিকার

চিপনির্ভরতা কাটিয়ে চীনের উত্থান

একতার বাতাসে উড়ুক দক্ষিণ এশিয়ার পতাকা

ছবি

স্মরণ: শহীদ ডা. মিলন ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থার সংগ্রাম

মনে পুরানো দিনের কথা আসে, মনে আসে, ফিরে আসে...

রাসায়নিক দূষণ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি

আছদগঞ্জের শুটকি : অতীতের গৌরব, বর্তমানের দুঃসময়

নবান্নের আনন্দ ও আমনের ফলন

‘প্রশ্ন কোরো না, প্রশ্ন সর্বনাশী’

ভূমিকম্প, অর্থনৈতিক চাপ এবং অনিশ্চয়তা: মানসিকতার নতুন অর্থনীতি

নবম পে স্কেল ও এর আর্থসামাজিক প্রভাব

মৃত্যুদণ্ড, তারপর...

জমির ভুয়া দলিল কীভাবে বাতিল করবেন?

জুলাই সনদ আদিবাসীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি

ব্যাংকের দুরবস্থা থামানো যাচ্ছে না কেন

আমন ধানে ব্রাউন প্ল্যান্টহপারের প্রাদুর্ভাব

বৈষম্য, অপচয় ও খাদ্যনিরাপত্তার সংকট

“বাঙালি আমরা, নহিতো...”

নারী নির্যাতন, মানসিক স্বাস্থ্য এবং সমাজের দায়

কাঁপছে ডলারের সিংহাসন

ত্রিশতম জলবায়ু সম্মেলন : প্রতীকী প্রদর্শনী, নাকি বৈশ্বিক জলবায়ু রাজনীতির বাঁক নেওয়ার মুহূর্ত?

অপরিণত নবজাতক : ঝুঁকি, প্রতিরোধ ও যত্নের জরুরি বাস্তবতা

বাংলাদেশী উত্তরাধিকার: প্রবাস-জীবন ও আমাদের সংস্কৃতি

রাজনীতিতে ভাষার সহনীয় প্রয়োগ

ভারত : এসআইআর এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজন

মনে কী দ্বিধা নিয়ে...

নিরাপদ সড়ক ভাবনা

অপরিকল্পিত বাঁধ-শিল্পায়নে বিপর্যস্ত বরেন্দ্র কৃষি

ছবি

মামদানি দেখালেন নেতৃত্বের মূল পরিচয় কী

চেকের মামলায় বৈধ বিনিময়, লেনদেন, দেনা-পাওনা প্রমাণ ছাড়া আর জেল নয়

নবাগত শিক্ষকদের পেশাগত ভাবনা

মাদকাসক্তি: শুধু নিরাময় নয়, চাই সমাজ ব্যবস্থার সংস্কার

আমেরিকার “নো কিংস” আন্দোলন

ঘি তো আমাদের লাগবেই, নো হাংকি পাংকি!

“মামদানি না জামদানি...”

ভাষার বৈচিত্র্য রক্ষায় নীরব বিপ্লব

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

অস্থির সময় ও অস্থির সমাজের পাঁচালি

শেখর ভট্টাচার্য

image

বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫

সময় বদলে যাচ্ছে। সমাজের ভেতরের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ধরন-ধারণও সমান তালে দ্রুত ভিন্ন রূপ ধারণ করছে। এক সময় ধারণা ছিলো অর্থনৈতিক বৈষম্য সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ যখন সম্পদে পরিপূর্ণ থাকে এবং অন্য অংশটি শোষণ-দারিদ্র যে ক্রমাগত বন্দী হতে থাকে, সমাজে তখন অসন্তোষ ও হতাশা সৃষ্টি হয়। এই হতাশা থেকেই অস্থিরতার জন্ম। সাম্প্রতিক কালে ধারণাটিও বদলে যাচ্ছে ক্রমাগত। সমাজের যেসব শক্তি ক্ষমতার লড়াইয়ে ব্যস্ত তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য সৃষ্ট সামজিক প্রতিক্রিয়াই আসলে সামজিক অস্থিরতার পালে হাওয়া দিতে থাকে। সামজিক অস্থিরতা যারা তৈরি করেন তাদেরকে আমরা দেখতে পাই না। তারা মঞ্চের পেছনে সুতা ধরে রাখেন খুব সাবধানে। কথাটি নতুন নয়। সকল কালেই এরকম প্রক্রিয়া চলমান ছিলো। অস্থিরতার মাত্রা অদৃশ্য শক্তির দল দ্বারাই নির্ধারিত হয়। অস্থিরতার পরিকল্পনা, বাস্তবায়নের জন্য কৌশল নির্ধারক দল আছে। দলের সামনে দল, তার সামনে কর্মী দল। কর্মী দলের মিছিল দেখে আমরা ভুল করি। দড়িকে সাপ ভাবি। বিভ্রান্ত হই। আমরা আসলে যা দেখি তা কিন্তু সত্য নয়, যা দেখিনা তা হলো আসল সত্য। আমরা দেখি নির্দেশিত মানুষদের। নির্দেশদাতাদের দেখতে পাই না। প্রতিটি আন্দোলন শেষে নাগরিকেরা কিছুটা হতাশ হয়। হতাশার মাত্রা সইতে সইতে একসময় হতাশা গ্রহণযোগ্য মাত্রায় পৌঁছে যায়। তখন আমরা বলি সমাজে নীরবতার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। তেরশত নদীর দেশে জোয়ার ভাটার মতো নীরবতা বেশি দিন স্থায়ী হয় না। জেগে ওঠে মানুষ বারবার। দুঃখের বিষয় হলো, আন্দোলনের কেন্দ্রের মানুষ বারবার বৃত্তের বাইরে চলে যায়। আবার ফিরে আসার চেষ্টা। মানব সভ্যতার ইতিহাসও একই রকম। তবে আমাদের কোমল মাটির এই দেশের প্রান্তিকেরা বোধ হয় একটু বেশি অভাগা।

ফিরে আসি সমাজের বদলে যাওয়ার প্রসঙ্গে। বদলে যাওয়া সমাজে, বদলে যাওয়া বাংলাদেশে রাতভর মিছিল, মিটিং। আমরা যারা ঊনসত্তর, একাত্তর দেখেছি। আমাদের কাছে প্রজন্মান্তরের রাতের আন্দোলন, সংগ্রাম কিছুটা বেমানান মনে হয়। এটি বোধহয় সময়ের সাথে তাল না মিলাতে পারার দুর্বলতা। তবে এরকম সামাজিক, রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখে আমরা অভ্যস্থ নই। আগুন দিয়ে পুড়ে ফেলা হচ্ছে নানা স্থাপনা। পেট্রোল বোমা দেয়া হচ্ছে বাসে। মবাতংক কখনো কখনো বোমাতংকের থেকেও ভয়ানক। একসময় বলা হতো মব জাস্টিস। প্রচলিত আইনে সুবিচার না পাওয়ার আশঙ্কা থেকে জনগণ নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে নিষ্ঠুর বিচার প্রক্রিয়ার আয়োজন করতো। এরকম নিষ্ঠুর বিচার করার প্রক্রিয়াকে মবজাস্টিস বলা হতো। এখন আর কেউ মবজাস্টিস বলছেনা। মবজাস্টিস মব সহিংসতায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে। নীরব চাঁদাবাজি সফল না হলে, তখন মব তৈরি করা হয়। ভেঙ্গে দেবো, গুড়িয়ে দেবো, পুড়িয়ে দেবো। চাহিদা মাফিক চাঁদা পেলে বিলকুল ঠিক করে দেবো। না পেলে তকমা সেটে দেয়া হবে গায়ে। যে তকমার রাজনীতি পরিবর্তনের জন্য এতো বড় আন্দোলন, সেই তকমা বসানো কিন্তু চলমান। জুলাই আন্দোলনের পূর্বের তকমা শুধু নাম পরিবর্তন করেছে। চাঁদাবাজি, দখলবাজি একরকমই আছে। ব্যবসা দখল, টিভি চ্যানেল দখল, সংবাদপত্র দখল, বাড়ি দখল, গাড়ি দখল, রাজনৈতিক দলের অফিস দখল। দখলীকরণ প্রক্রিয়া একইভাবে চলছে। জনপ্রিয় দলের একজন বটবৃক্ষ নেতাতো পলাতক ব্যবসায়ীর পুরো পরিবহন গিলে খেয়ে বলছেন “হেফাজতে রাখলাম”। এরকম হেফাজতে নানাভাবে নানাজন নানা কিছু রাখছেন। কার জানমাল কেনো, কী কারণে হেফাজতে রাখছেন তা’ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা জানতে পারছি না। হঠাৎ দু-একটা হেফাজতের গোপন খবর প্রকাশ্যে আসলে কিছুটা হৈচৈ হয় এরপর অল কোয়ায়েট ইন দ্য অল ফ্রন্ট। কীভাবে সব শান্ত হয়ে যায়, সে এক অপার বিস্ময়।

অস্থির সময় ও অস্থির সমাজের মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সময় অস্থির হয় সমাজ অস্থির হয় বলে। সমাজ অস্থির হয় রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে। এটি হলো যুক্তিবিদ্যার কার্যকারণ সম্পর্ক বা কজ-ইফেক্ট রিলেশন। সময় কি স্বয়ংক্রীয় ভাবে অস্থির হয়? নিশ্চয় তার পেছনেও কার্যকারণ সম্পর্ক আছে। এরকম কারণের কারণ খুঁজতে গেলে লেখাটি গবেষণাপত্র হয়ে যাবে। পেছনের কার্যকারণ সম্পর্ক খোঁজার জন্য প্রক্রিয়া মাফিক গবেষণার খুব প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তবে অধিকাংশ নাগরিক ভাবছেন সব রোগের একমাত্র ভেষজ ঔষধ হলো নির্বাচন। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বলা হয় মকরধ্বজ, এলোপ্যাথিকে কোরামিন। শুনেছি সব ঔষধ ব্যর্থ হয়ে গেলে শেষ ভরসা কোরামিন। অধিকাংশ নাগরিক ভাবছেন গণ-প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়ে আসলে, সব মুশকিল আসান হয়ে যাবে। অধিকাংশ মানুষ মনে করছেন নির্বাচন হয়ে গেলে ম্যাজিকেলি সব ঠিক হয়ে যাবে। অস্থির, অসচ্ছ্ব জলরাশি স্বচ্ছ্ব এবং স্থির হয়ে যাবে। ঘোলা পানিতে মাছ ধরার সুযোগ আর থাকবে না। মবের দল সুবোধ বালক হয়ে চুলে তেল দিয়ে বইপত্তর বগলে নিয়ে স্কুলে যাবে। এরকম আশা পোষণ করা ভালো। সব ব্যবস্থা ঠিক রেখে, এরকম সোনারকাঠি, রূপারকাঠির মতো নির্বাচন কি জমে থাকা এতো জঞ্জাল পরিস্কার করতে পারবে? মঞ্চের কুশীলব, পেছনের কুশীলবদের মধ্যে খুব কি বড় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে? এস্টাব্লিশমেন্টের পক্ষের লোক এবং এস্টাব্লিশমেন্টকে ঠিক রেখে বড় পরিবর্তনের আশা করা কি খুব বাস্তবসম্মত? আমাদের মতো অতিসাধারণ মানুষের পক্ষে বুঝতে বড় কষ্ট হয়। নয়া বন্দোবস্তের আলাপ শুনে বড় আশাবাদী হয়েছিলাম। এর সাথে ষাট, সত্তর দশকের মানুষ হিসেবে আমাদের সময়ের কাক্সিক্ষত স্বপ্ন বৈষম্য নিরসনের স্লোগান শুনে কিছুটা নড়েচড়ে উঠেছিলাম।

আমরা যতোই নড়াচড়া করি না কেনো, মঞ্চের পেছনের কুশীলবদের মনে কী ছিলো, কী আছে সেটি হলো আসল কথা। পেছনের কুশীলবরা দুরদর্শী, কুশলীও বলা যায়। তারা অতি উচ্চমার্গের দার্শনিক। সাধারণ মানুষ যা দেখতে পায় না তা দেখতে পান দার্শনিকেরা। এই অর্থে তারা সকলেই দার্শনিক। সমাজের উপর তাদের নানারকম নিয়ন্ত্রণ থাকে। রাজনীতির নামে তারা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। তারা যা করেন সব কিছুই জনতার নামে। সকলেই বলেন জনগণ এটা চায়, জনমতের ওপর ভিত্তি করে আমরা মার্কেট পুড়িয়ে দিলাম। সকল কিছুর পেছনেই জনগণ। আউল, বাউল, ফকির, সন্ন্যাসীদের লম্বা চুল কাটবেন। তাদেরকে গাছের সাথে বেঁধে দস্যুর মতো চুল কেটে দেয়া হলো সমাজ বিপ্লব। মানিকগঞ্জে দেখলাম বাউলদেরকে চোর, দুস্কৃতিকারীদের মতো ধাওয়া দেয়া হচ্ছে। সংসার বিরাগী এসব মানুষ অসহায় হয়ে নদী, খাল, পুকুরে ঝাপ দিয়ে প্রাণ বাঁচাচ্ছেন। এসব দৃশ্য যখন বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে দেখা যায় তখন মনে হয়- এটি কি আমাদের সমাজ? এটি হাসন, লালন, রাধারমন, আরকুম শাহ, সহিফা বানুর বাংলাদেশ?

নবান্ন অনুষ্ঠান করতে পারবেন না, নিরাপত্তার অজুহাতে। নবান্ন তো কৃষকের অনুষ্ঠান। পৃথিবীর কোন জাতি শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে নিজেদের গৌরবময়, আবাহমান কালের অনুষ্ঠাণকে পরিত্যাগ করবে, এটি ভাবা যায়। ঐতিহ্য খুড়ে বের করা হলো সভ্যসমাজের মানূষের কর্তব্য। আমরা আমাদের চর্চিত ঐতিহ্যকে রাজনীতির নোংরামিতে ডুবিয়ে দিচ্ছি অস্থিরতা দিয়ে। এই যে অস্থিরতা, সামজিক বিশৃঙ্খলা এর অন্তর্নিহিত কারণ কী? যারা আমাদের দ্বার রুদ্ধ করে দিচ্ছেন, তারা এর সুনির্দিষ্ট কারণ বলতে পারছেন-না, কিংবা বলছেন না। সমাজে ভুল বুঝাবুঝি তৈরি হচ্ছে। বিভাজন সৃষ্টি হচ্ছে। এই বিভাজন কী জাতি হিসেবে আমাদের শক্তিশালী, সংহত করছে? জাতি হিসেবে আমরা যতো দুর্বল হবো, ততোই লাভবান হচ্ছে জাতীয়, আন্তর্জাতিক অশুভ শক্তির।

সামাজিক অস্থিরতা একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক সমস্যা। যদিও এটি একটি বহুমাত্রিক সমস্যা তবে এর নিয়ন্ত্রক হচ্ছে রাজনৈতিক ব্যবস্থা। রাজনীতিকে পরিশুদ্ধ না করলে সামাজিক সমস্যার সমাধান কোন ভাবেই সম্ভব নয়। আমরা রাজনীতিতে অন্তর্ভুক্তির কথা বলছি প্রতিনিয়ত। আমরা যতো বলছি অন্তর্ভুক্তির কথা তত দ্রুত হ্রাস করে দিচ্ছি প্রান্তিক মানুষের প্রতিনিধিত্ব।

বিশুদ্ধ গণতন্ত্র চর্চা সোনার হরিণে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্র শাসকদের ক্ষমতায় লাগাম টেনে ধরে। শাসিতদের অধিকতর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। গণতন্ত্র সকল ব্যবস্থাকে গণমুখী করে তুলে। গণতন্ত্র স্বাধীন বিচারব্যবস্থা এবং জবাবদিহিমূলক শাসন ও অর্জিত সম্পদের মালিকানার নিশ্চয়তা দেয়। এর জন্য প্রয়োজন নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। নতুন বন্দোবস্তের আলাপকে এখন প্রলাপের মতো মনে হয়। আগামী নির্বাচনে নতুন বন্দোবস্ত চাই। মনে রাখতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির জন্য গণতন্ত্র একটি অপরিহার্য রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। আমরা কি এবার সে পথে হাঁটবো?

[লেখক: প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

back to top